Home / প্রবন্ধ / আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো : একটি গান ও দুই বাংলার মিলনসেতু – বদরুদ্দোজা হারুন

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো : একটি গান ও দুই বাংলার মিলনসেতু – বদরুদ্দোজা হারুন

[ভাষা শহীদ আবুল বরকতের ৯৬ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে লেখা l]

 

একুশে ফেব্রুয়ারি

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি”– কোন ভাইয়ের রক্ত দেখে সেদিন এই গানটি লিখেছিলেন সদ্য প্রয়াত গাফ্ফার চৌধুরী? প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গিয়েছেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মুর্তজা বশীর তাঁর ‘একুশের ডাইরি’- তেl

না, তিনি কোনো ধোঁয়াশা রাখেননি, একদম স্পষ্ট করে বলে গিয়েছেন সেই রক্ত ঝরা ঘটনা-বৃত্তান্ত l

“হঠাৎ গুলির আওয়াজ শুনলাম। শুনে হাসলাম । ভাবলাম এসব শুধু ফাঁকা আওয়াজ । তবু রাস্তায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম । কিন্তু একি ! দেয়ালে ঘেঁষে ওরা  কাকে আনছে ? দৌড়িয়ে গেলাম l জড়িয়ে ধরলামl ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না l কল খুলে দিলে যেমন করে  পানি ঝরে, ঠিক তেমনি রক্ত ঝরছিল আবুল বরকতের l সারা মুখে বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঘামl জিভ বের করে পানি চাচ্ছিলো l হাতের রুমালে ঘাম শুকিয়ে আসা পানি l তাই নিংড়িয়ে দিলাম l যাতে সে ভয় না পায় তাই বারবার আমরা জোরে জোরে বলছিলাম, অনেকটা নামতা পড়ার মতো, কিছুই হয়নি l না, কিছুই হয়নি l”

এরপরের সংবাদ সবারই জানা l রাত দু’টোর সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বরকতের মৃত্যু l পোস্টমর্টেম রিপোর্ট– অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য বরকতকে বাঁচানো যায়নিl

সেদিনটা ছিল বৃহস্পতিবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ l “ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ । / দুপুর বেলার অক্ত / বৃষ্টি নামে…. /  বৃষ্টি কোথায় ! / এ যে বরকতেরই রক্ত !…” তাঁর কালজয়ী কবিতায়  বরকতের রক্ত ঝরার কথা লিখে গিয়েছেন কিংবদন্তি কবি আল্ মাহমুদl অথচ কী আশ্চর্য মণিকাঞ্চন যোগ ! সেই একই বৃহস্পতিবারে মারা গেলেন আল্ মাহমুদের প্রিয় ছেলে, তাঁর সর্বসময়ের ছায়াসঙ্গী শফিক আল মাহমুদ । ১৯৫২-র ২১ শে ফেব্রুয়ারি যে টগবগে তরুণ বরকতের রক্ত নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৫ সালে, পরিণত বয়সে ‘পানকৌড়ির রক্ত’ নিয়ে গল্পের ডালি সাজিয়েছিলেন তিনি কি জানতেন ২০১৯ সালের পর বাঙালির আর এক বিলাপের মাস, ফেব্রুয়ারি মাস আর কোনদিন ফিরে আসবে না তাঁর জীবনে ! সে বছরের ফেব্রুয়ারির ১৪ ই বৃহস্পতিবার হবে তাঁর জীবনের অন্তিম বৃহস্পতিবার ! যেমন জানতেন না অমর একুশের কালজয়ী গানের স্রষ্টা আবদুল গাফ্ফার ১৯৫২-র  ২১ শে ফেব্রুয়ারির সেই বিশেষ বার, বৃহস্পতিবার ফিরে আসবে আবার ২০২২’-এর মে মসের ১৯ তারিখে । আর মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে আসামের শিলচরের ১১ জন ছেলেমেয়ের ‘রক্তে রাঙ্গানো সেই দিনটি’ই হবে তাঁর জীবনের অন্তিম দিন ! হয়ত ব্যাপারটা কাকতালীয় l কিন্তু কাকতালীয়  সেই দিনটিই কেন হয় বৃহস্পতিবার ! ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো’ সেই বৃহস্পতিবার !

“এক বৃহস্পতিবার আমার আবাই মারা গেল, পরের বৃহস্পতিবার আমরা ঢাকায় পৌঁছুলাম l আমার আবাই তখন আজিমপুরের কবরে l আমাদের সঙ্গে লাখো লাখো ছেলেমেয়েরা বাঁধভাঙা ঢেউ-এর মত আবাই – এর কবর ঘিরে কাঁদছে l বুঝলাম আমার অবাই দাঙ্গা করতে গিয়ে মরেনি, দেশের জন্য, ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে l” কথাগুলো বলেছিলেন ভাষা শহিদ আবুল বরকতের (ডাকনাম আবাই) মা হাসিনা বিবি, ১৯৫২ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি I তাঁরা বরকতের মৃত্যুর দু’দিন পর রোববার  সকালে খবর পান যে, তাঁদের আদরের আবাই বৃহস্পতিবার  ঢাকায় ভাষাভাষি আন্দোলনে মারা গিয়েছে l মুর্শিদাবাদের সালার-সংলগ্ন প্রত্যন্ত বাবলা গ্রাম থেকে মহানগরী ঢাকায় পৌঁছোতে তাঁদের অনেক সময় লেগেছিলো l কারণ তখন রাস্তাঘাট এবং যানবাহন সংযোগ আরও খারাপ অবস্থায় ছিলো l ক্ষুদ্র এই শোকার্ত দলে  ছিলেন বরকতের মা  হাসিনা বিবি, বড় খালা (মাসি) বিবি কুবরাতুননেসা, বড় মামী  বিবি খায়রুননেসা এবং  পিতা মুন্সী সামসুজ্জোহা ওরফে ভোলাই মিয়া l

বরকতের পিতামাতাকে দেখার জন্য সেদিন অধীর  আগ্রহে   মহানগরী ঢাকা যেন অপেক্ষা  করেছিলো । তাঁদের আজিমপুর গোরস্থানে পৌছুঁতে হয় সমুদ্রসম ছাত্র-জনতার ভীড়ের মধ্য দিয়ে l  দলে দলে ছাত্ররা  শহিদ-জননী হাসিনার  পা ছুঁয়ে শপথ নেয় সেদিন– মা, তুমি কেঁদো না l আমরা তোমার সন্তান l ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ আমরা নেবোই l

ঢাকায় তখন প্রশাসন বলতে কিছুই নেই l চারিদিকে শুধু থিকথিকে জনতার ভিড় । ক্ষোভে ফুটছে সবাই l  শহিদ-জননী হাসিনার তিন মাস আর দেশের বাড়ি মুর্শিদাবাদের বাবলায় ফেরা হয়নি । কারণ তখন তিনি শহিদ-জননী, বাংলা ও বাঙালির আশা-আকাংক্ষার প্রতীক l

পরবর্তীকালে ১৯৫৬ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি, যেখানে আবুল বরকত গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, ঠিক সেই খানেই শহিদমিনার নির্মাণের স্থান নির্বাচন করা হয় এবং শহিদ-জননী হাসিনাকে দিয়ে উদ্বোধন করা হয় l তখন তাঁর একপাশে ছিলেন তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আবুল হোসেন সরকার, অন্যপাশে মজলুম-নেতা মাওলানা ভাসানী l মাওলানা ভাসানী সেদিনের জন-সমুদ্রের মাঝখানে বরকতের গর্ভধারিণী শহিদ-জননী হাসিনাকে ‘সাড়ে-চার কোটি বঙ্গসন্তানের জননী’ হিসাবে ঘোষণা করেন l

ভাষার কী আশ্চর্য ক্ষমতা ! বরকত-জননীকে কেন্দ্র করে দুই বাংলা যেন হঠাৎ একসূত্রে বাঁধা পড়ে  গিয়েছিলো  ! সন্তান-হারা জননী আর ভাষা-জননী কখন যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো, পরবর্তীতে  কেন্দ্রীয় শহিদমিনার নির্মাণ পরিকল্পনায় তা শিল্পী হামিদুর রহমান আরও স্পষ্টতর করে তুলেছিলেন l ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে হামিদুর রহমান বরকত যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন ঠিক সেখানেই তাঁর অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করেছিলেন I তরুণ শিল্পী তাঁর  হৃদয়ের সবটুকু রস উজাড় করে ভাষা আন্দোলনের উপর হাজার বর্গফুটের একটি ম্যুরাল চিত্রের নক্সা করেন l আর তার দুই স্তম্ভের কাজ অপূর্ব শৈল্পিক মুন্সিয়ানায় সমাপ্ত করেন l ১৯৭১ সালে পাক হানাদারদের বর্বর আক্রমণে এই শহিদ মিনারটি ধ্বংস হয়ে যায় l ঠিক যেন  চেঙ্গিস-পুত্র হলাগু খানের বাগদাদের শিল্পকলা  ধ্বংসের  নিষ্ঠুরতার হুবহু অনুবর্তন ঘটে !

শিল্পী হামিদুর রহমানের পরিকল্পনায় শহিদ মিনারের স্তম্ভগুলির ভেতর থেকে লেবু-হলুদ ও গাঢ় নীল রঙের স্টেইন্ট গ্লাসের তৈরি অজস্র নয়নাভিরাম নয়ন থেকে সূর্যে-বিচ্ছুরিত সাতরঙ্গা রামধনুর মোহময় প্রতিফলনের যে প্রতিচ্ছটা ছিলো হয়তো তা একমাত্র লিওনার্দো-দা- ভিঞ্চির সঙ্গেই তুলনীয় হতে পারতো !  মিনারের চারপাশের বর্ণমালা ঘেরা রেলিং ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ l যেদিকে তাকানো যায়, যেখানেই চোখ ফেরানো যায়, সেখানেই যেন রাত্রিকালীন  আলোর পরিরা  ঝলমল  করে ওঠে !

‘একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ !  মিনারের সামনের নক্সায় ছিলো ঝর্না — কৃষ্ণ-কালো ডাগর চোখের আকৃতিতে বিশাল এক ঝর্না, যেন মাতৃভূমি বঙ্গভূমির সেই চোখ অনবরত অশ্রুতে টলমল করে ঝরছে অঝোরে, কালের বুক বিদীর্ণ করে উঠছে হাহাকার, আমি শহিদের মা, তাই আমার এই কান্না..!.. যদি পেইন্টিংটা সত্যিই বাস্তবায়িত  হতো তাহলে ওটাই হতো পৃথিবীর দীর্ঘতম  পেইন্টিংগুলোর অন্যতম একটি l অত্যাধুনিক যুগের পৃথিবীর এক পরম বিস্ময় !’

কিন্তু তা হয়নি l ১৯৫৮ সালের মার্চ মাসে আতাউর রহমান খান সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পী হামিদুর রহমানকে বহিষ্কার করা হয় শহিদ মিনারের চত্বর থেকে l তারপর ‘৫৮ থেকে ‘৬২ পর্যন্ত পাঁচ বছর জনগণের চোখের পানিতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ পালন করা হয়েছে অসম্পূর্ণ বেদিতে l শহিদ জননী হাসিনাকে প্রতিবারই  পশ্চিমবঙ্গের বাবলা থেকে ছুটে  গিয়ে ছাত্র-জনতাকে বলতে হয়েছে–‘আমি তো তোমাদের শহিদ ভাইয়ের মা, তোমাদের শহিদ-জননী, আমি এখনও বেঁচে আছি, বাছারা ভয় পেয়ো না, জয় তোমাদের হবেই, বাংলা ভাষার জন্য তোমাদের ভাইয়ের আত্মদান বৃথা যাবে না l’

শহিদ মিনার নাই, তাতে কি, জনগণের উৎসাহের কোনো ভাটা  নাই । ‘শহিদ জননী আমাদের মা হাসিনা আছেন, জয় আমাদের হবেই l’ চারিদিকে শুধু গাফফারের গান — ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি ..’l   সেদিনের ছাত্র-জনতার স্বপ্ন,   আর শহিদ-জননী হাসিনার  স্বপ্ন মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গিয়েছিলো l

ভাঙা শহীদমিনার আবার বাস্তবে রূপ পেতে চলেছিলো  ১৯৬২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজম খান পূর্ববঙ্গের গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই l গভর্নরের দায়িত্ব নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ড. মাহমুদ হোসেনকে সভাপতি করে ১৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠিন করে দিয়েছিলেন তিনি l আর শিল্পী হামিদুর রহমানের নক্সা মোতাবেক শহিদ মিনার পুনঃনির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্ত স্বৈরাচারী শাসক আয়ুব খানের  এসব বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়েছিলো l ফলে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আজম খান    পদত্যাগ করেন, কিন্তু আয়ুবের হুকুমের গোলাম হতে রাজি হোন  না l ফাইলে বহাল রাখেন শহীদমিনার গড়ার নির্দেশনামা l

পরবর্তী গভর্নর  মোনায়েম খাঁর সাধ্য হয়নি সেই নির্দেশনামাকে অগ্রাহ্য করার l  হামিদুর রহমানের নক্সাকে তাই মাথায় রেখে, পরিস্থিতির চাপে, অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের শহিদ মিনার নির্মাণের সুপারিশ গ্রহণ করতে বাধ্য  হন তিনি  l আর এই নতুন শহীদমিনার উদ্বোধন  করার জন্য বরকত-জননী হাসিনার কাছে  পূর্ববাংলায় জনতার পক্ষ থেকে যথারীতি আমন্ত্রণ পত্র এসে পৌঁছায় বাবলার বাড়িতে l   আমন্ত্রণ পত্র তো নয়, যেন ছাত্র যুবা জনতার আকুল প্রার্থনা তাদের মায়ের কাছে ।  ‘মাগো, তুমি এসো । আমরা জয়ী হয়েছি l আমাদের ভাই বরকতের রক্ত যেখানে পড়েছিলো ফোঁটা ফোঁটা করে, ঠিক সেখানেই তো আমরা আবার শহীদমিনার তৈরি করছি এবার l দেখবে না তুমি ? আমরা যে তোমার সন্তান, তোমাকেই ডাকছি মা..মাগো …!’

নানান পারিবারিক সমস্যায় বাবলার মাটিতে বরকত-জননী হাসিনার তখন বেহাল অবস্থাl  পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই, না গ্রামের মানুষ, না  আত্মীয়স্বজন l কিন্তু সন্তানহারা এক মায়ের কানে তখন লক্ষ লক্ষ সন্তানের ডাক — ‘মা, …মাগো তুমি এসো l আমরা যে তোমারই পথ চেয়ে…!’

হাসিনা আর স্থির থাকতে পারেননি l সানন্দে সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন l  তিনি যেমন এ – বাংলার বাসিন্দা, এক অতি সাধারণ বিনয়ী ভারতীয় নাগরিক,  তেমনি ও-বাংলার সাড়ে চারকোটি বাঙালির জননী, আন্তর্জাতিক ভাষাশহিদ আবুল বরকতের গর্ভধারিণী ! যেতে তো তাঁকে হবেই l তাঁকে ঘিরে সোনার ছেলেমেয়েরা গাইবে — আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি / আমি কি ভুলিতে পারি !….’

বরকত জননী হাসিনার পূর্ববাংলা সফরের নিশ্চয়তা পাওয়া মাত্রই ওখানকার  সব প্রখ্যাত পত্রিকায় তাঁর ঢাকা আগমনের আগাম খবর ফলাও করে প্রকাশিত হতে থাকে l জনগণের  মধ্যে বিপুল সাড়া পড়ে যায় l ফলে উদ্বোধনের দিন শহিদমিনার-চত্বর লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় l অমন রেকর্ড ভিড় একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের আগে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সেই ভাষণের দিন ছাড়া কেউ কখনও দেখেনি, যে ভিড় সেদিন হয়েছিল শহিদজননী হাসিনাকে ঘিরেl

ঢাকার এই শহিদমিনার শিল্পী হামিদুর রহমানের কল্পনায় বরকত-জননী হাসিনার অবয়ব যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিলো l মা হাসিনার বৃদ্ধ বয়সেও দৃষ্টিশক্তি ছিলো অতি প্রখর l একটু কুঁজো হয়ে হাঁটতেন তিনি l সেই আদলেই তাই শহিদমিনার নির্মাণ করা হয় l সামনের দিকে একটু ঝুঁকে শহিদজননী হাসিনা যেন তাঁর চার পুত্র–বরকত-জব্বার-রফিক-সালামকে কোলের শিশুর মতো স্নেহের ডোরে বাঁধতে চাইছেন ! এ এক অপূর্ব দৃশ্য !’ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি ‘ — বাবলার বরকত, কখন যেন দুই বাংলার   বরকত হয়ে যান ! তাঁর আজিমপুরের কবরের ফলকে সেই পরিচিতি জ্বলজ্বল করে — আবুল বরকত, পিতা : শামসুজ্জোহা, গ্রাম :  বাবলা, পো : তালিবপুর, থানা : ভরতপুর, জেলা : মুর্শিদাবাদ, ভারত l

 

||দুই||

 

 

এক অদ্ভুত মিল ছিলো মুর্শিদাবাদের  বরকতের সঙ্গে ময়মনসিংহের গাফফার চৌধুরীর ! একজন ‘একুশে ফেব্রুয়ারির শহিদ’ হিসেবে বাংলাভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মহিমায় অধিষ্ঠিত করেছেন, আর একজন সেই ‘বরকতেরই রক্ত’ দেখে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি / আমি কি ভুলিতে পারি…’ শিরোনামের গানটি লিখে আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেয়েছেন ! একজন মরে অমর হয়েছেন, আর একজন বেঁচে থাকা অবস্থায় অমর হওয়ার গ্যারান্টি পেয়েছেন l যতোদিন পৃথিবীতে বাঙালি থাকবে ততোদিন ফেব্রুয়ারির একুশের ভোরে বাঙালিদের ঠোঁটে ঠোঁটে ফিরবে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলতে পারি”! বরকতকে যেমন বাঙালি ভুলতে পারবে না, তেমনি গাফ্ফার চৌধুরীকেও না। তিনি কত বড় কবি, সাহিত্যিক, সংবাদিক, ঔপন্যাসিক কিম্বা দেশপ্রেমিক কিংবা বুদ্ধিজীবী ছিলেন — সেসব  হয়তো উহ্যই থেকে যাবে, থেকে যাবে শুধু তাঁর শহীদ-ভাই বরকতের লাশ দেখে লেখা হৃদয়-নিংড়ানো   গানের কথাগুলি “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি”!

বাঙালির চিন্তায়-মননে, নিভৃত-স্বপনে, কল্পনার সৌধ-নির্মাণে বরকত ও গাফ্ফার চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির একুশের ভোরের আলো ফুটলেই l ছাত্রীরা প্রভাতফেরি গাইতে গাইতে চলবে এলোচুলে, ছাত্ররা পা মেলাবে তাদের সাথে, দেশবিদেশের রাষ্ট্রদূতেরা ফুলের স্তবক হাতে আসবেন শ্রদ্ধা জানাতে, তার আগে রাত্রি বারোটা হলেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি – প্রধানমন্ত্রীকে আসতে হবে শহীদমিনারের সামনে, ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে মিনারচত্বর। সেই গানের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি  উঠবে চারিদিকে – ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি…’! আকাশে বাতাসে বিউগলে ছড়িয়ে যাবে.. নিঃশব্দে নীরবে তার সুর মূর্চ্ছনা !

আবেগ আর বিবেক একসঙ্গে কাজ করলে ভুল বোঝার অবকাশ থাকে না l তাই প্রশ্ন উঠতে পারে কি যুক্তি প্রমাণ, দলিল দস্তাবেজ আছে যে মুর্শিদাবাদের ছেলে  বরকতের লাশ দেখে ময়মনসিংহের গাফ্ফার চৌধুরী নামে এক কিশোরের বুক নিংড়ে কান্নার ঢেউ উঠেছিলো, যা তাকে প্রাণিত করেছিলো এমনভাবে যাতে আবেগবহুল কথাগুলো বাঙ্ময় উঠেছিল ভেতর থেকে — ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ !

হ্যাঁ, কথাগুলি প্রথমে তাঁর মনের ভেতর বুদবুদের মতো বিড়বিড় করে ফুটে উঠেছিলো, পরে সুর-তাল-লয়ে রূপ পেয়েছিলো এক অবিস্মরণীয় গানে l তারজন্য আরও কয়েকটা দিন সময় লেগেছিলো তাঁর l  প্রেক্ষাপটে অন্য কুশীলবদের আগমনও ঘটেছিলো l সমবেত ভাষাপ্রেমী তরুণদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছিল ভাষা আন্দোলনের এই যুগ-চিহ্নিত  গানটিকে মানুষের মনের কোণে পৌঁছে দিতে l

সাধারণ কিছু কথা কী করে অনিন্দ্য-সুন্দর একটি গাথায় রূপান্তরিত হলো এবং  কী করে একটি কালজয়ী গানে, একটি জাতির ক্রমোত্থানের সাক্ষী হিসেবে রয়ে গেলো তার নেপথ্য কাহিনী সংক্ষেপ বলে গিয়েছেন গানটির  রচয়িতা স্বয়ং গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর নিজের জবানিতেl

”৫২ সালে আমি ছিলাম ঢাকা কলেজের ছাত্র l ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়ার বৈঠকে আমি ঢাকা কলেজের প্রতিনিধিত্ব করি l

মিছিলে আমি ছিলাম সবার পেছনে l পুলিশের গুলির পর আমরা সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই l বেশ কিছু সময় পরে শুনি মেডিকেল কলেজে একটি লাশ পড়ে আছে l গিয়ে দেখি সেটি আবুল বরকতের লাশ l সেখানে সবাই তখন কাঁদছিলো l সেই লাশের সামনে দাঁড়াতেই কবিতার একটি লাইন — ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ‘ — কথাগুলো আমার মনে আসে l

এই ঘটনার পর ঢাকা কলেজ বন্ধ হয়ে যায় l আমি প্রথমে সংবাদ পাঠাই দাউদ মজলিশের বাসায়,  পরে সে ও আমি শফিক রেহমানের বাসায় আশ্রয় নিই l অনেক পরে সৈয়দ আহমদ হোসেন আমাকে অনুষ্ঠানে ও ইশতিহারে প্রকাশের জন্য ঐ কবিতাটি (আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি) শেষ করে দিতে বলেন l আমার কাছে সৈয়দ আহমদ হোসেনকে পাঠিয়েছিলেন আবদুল্লাহ আল মুতী l শেষ পর্যন্ত সেই অনুরোধেই শফিক রেহমানের বাসায় বসে পুরো কবিতাটি লিখে ফেলি l এই কবিতাটি লেখার জন্য ঢাকা কলেজ থেকে আরও ১১ জনের সঙ্গে আমাকে বহিষ্কার করা হয় l”

স্বয়ং গানটির স্রষ্টা যখন গানটি রচনার পটভূমির ব্যাখ্যা নিজের জবানীতে করেছেন, তখন  অন্য কোনো পটভূমি নিয়ে আর  গবেষণার সুযোগ থাকে না, এমনকি শফিউর রেহমান বললেও না l গানটি রচনার পটভূমি খুঁজতে  রফিক – সালাম বা অন্য কোন ভাষা শহিদের সঙ্গে অযথা কোনো  লিঙ্ক খুঁজতে যাওয়ার   অজুহাতও এক্ষেত্রে আর খাটে না ।

আর এইভাবেই ধুমায়িত অগ্নির মত বাঙালির মননে  ‘৫২ – র ঘটনা একটি চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে যায় l  আর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বৃহস্পতিবারও কোন অদৃশ্য কারণে একটি বিশেষ বার হিসেবে যেন যুক্ত হয়ে যায় l  তাই বৃহস্পতিবারই বরকতকে গুলিবিদ্ধ হতে হয়, বৃহস্পতিবারই মুর্শিদাবাদের বাবলা থেকে তাঁর পিতামাতাকে অশ্রুসজল চোখে আজিমপুর গোরস্থানে তাঁর প্রিয় পুত্র বরকতের কবরের কাছে গিয়ে পৌঁছোতে  হয়l l

লাখো ছাত্র-জনতার বেষ্টনীর মধ্যে তাঁরা শহিদ পুত্রের সমাধির পাশে বসে বিষণ্ণ বদনে, অশ্রুসজল চোখে সেদিন প্রার্থনা জানিয়েছিলেন অন্তর্যামী আল্লাহর কাছে, তাঁদের নয়নের-মণি পুত্রের আত্মার পারলৌকিক কল্যাণের জন্য। এছাড়া আর কিই বা করতে পারতেন হতভাগ্য পিতামাতা !

 

এরপর জনতার বাঁধ-ভাঙা উচ্ছ্বাসে ভীত হয়ে পড়ে স্বৈরাচারী শাসক l ভাষা আন্দোলনের বীজকে বাংলার মাটি থেকে সমূলে উৎখাত করতে  চেষ্টার ত্রুটি রাখে না l আর এর মধ্যেই আসে ১৯৫৩ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ভাষাশহিদ ভাইদের নতুন করে আবার স্মরণের দিন l সেই উপলক্ষ্যে ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করা হয় ধূপখোলা মাঠে।

কানায় কানায় ভরে যায়  মাঠ l  যেদিকে তাকানো যায় শুধু মানুষ আর মানুষ l সেই জনসমুদ্রে কম্পিত কন্ঠে মঞ্চে ওঠেন গাফ্ফার চৌধুরী l অকম্পিত-কন্ঠে পাঠ করেন তাঁর গহীন মন থেকে উঠে আসা সেই কালজয়ী কবিতার লাইনগুলি — “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি”– I   সেখানে উপস্থিত ছিলেন  তখন  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র (পরবর্তীতে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক) রফিকুল ইসলাম l গাফফারের কন্ঠে কবিতাটি শুনেই তাঁর  মনে ভাবান্তর হয় l কে যেন ভেতর থেকে বলে ওঠে — এতে সুর দিলে খুব ভালো গান হতে পারে l হ্যাঁ, ভালো গান, যা যুগযুগ ধরে মানুষের মনকে স্পর্শ করবে l

সঙ্গে সঙ্গে মনের ইচ্ছার বহির্প্রকাশ ঘটে তাঁর  l  নিজের ভাই আতিকুল ইসলামকে বলেন সেকথা,  তৎকালীন উদীয়মান সুরশিল্পী আবদুল লতিফকে কবিতাটিতে সুরসঞ্চালনা  করে সুরেলা গানের মাধুর্য আনতে অনুরোধ জানাতে বলেন তিনি  l কারণ আতিকুল ইসলামের সঙ্গে আবদুল লতিফের সখ্যতা ছিলো l সেই মতো ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা কলেজের অনুষ্ঠানে আতিকুল ইসলাম ও মমিনুননেসার যৌথ নেতৃত্বে দলীয়ভাবে গানটি প্রথম পরিবেশিত হয় l পরে আলতাফ মাহমুদ আবদুল লতিফের অনুমতি সাপেক্ষে গানটিতে নতুন সুরারোপ করেন, যেটি আজ পর্যন্ত চলে আসছে দেশে বিদেশে সর্বত্রই  l  একুশের প্রভাত ফেরি ও একুশের যে কোনো অনুষ্ঠানের  উদ্বোধনী সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বরকতের রক্ত দেখে লেখা  বাঙালির আবেগের শ্রেষ্ঠতম এই গণসংগীতটি l

১৯৫২ সেই একুশে ফেব্রুয়ারির সেই ঘটনার দিনকে  স্মরণ করে স্মৃতিকথায় মুর্তজা বশীর স্বল্পকথায় তাঁর পিতা ভাষাচার্য অধ্যক্ষ ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মনোভাব তুলে ধরেছেন এক অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় l তাঁর কথায় “বাসায় যখন এলাম, বাবা ডাকলেন l আমি রাজনীতি করি বাবা পছন্দ করতেন না l তাঁর সম্মুখে দাঁড়াতেই (আমাকে দেখে) নির্বাক হয়ে গেলেন তিনি l কিছুক্ষণ পর আমার মাকে বললেন, তাঁর কালো আচকান বের করে দিতে l একটা কাঁচি দিয়ে আচকানের প্রান্ত কাটলেন তিনি l কালো কাপড়ের ফিতেটা আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন, তাঁর হাতে বেঁধে দিতে l আমি বেঁধে দিলাম l

আজকে যখন এই দিনে ( অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি,১৯৭১)  সেই উনিশ বছর আগের কথা ভাবি, তখন অবাক হই এই ভেবে, সেই মন, সেই সংগ্রামী চেতনা আজ কোথায় ? তাই আজ একুশের দিনে নিজেকে মনে হয় পলাতক l কাপুরুষ l”

 

কারণ ‘৭১-র মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত সাফল্যের পর ‘৫২-র আদি ধারণার কিছু রদবদলের প্রয়াস প্রায়শঃ লক্ষ্য করা যায় l শাসক তুষ্টির ব্যাপার থাকে বলে কিছু তথ্য লোপাট করে বানোয়াট ইতিহাসের রচনায় একটা প্রবণতা দেখা যায় অতি উৎসাহী কিছু মানুষের মধ্যে l এসবকে গুরুত্ব দেওয়া বুদ্ধিজীবীদের, ইতিহাসবিদদের কাজ নয় l কারণ যা প্রক্ষিপ্ত তা আজ, কাল বা আগামী কাল  প্রক্ষিপ্ত বলে হতে বলে  বাধ্য l

এমনকি ৫২’ র ভাষা আন্দোলন কিভাবে জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকেও  ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো তা তাঁর পুত্র মুর্তজা বশীরের জবানিতে ঐতিহাসিক প্রমাণ হিসেব বিধৃত হয়ে রয়েছেl

জাতীয় সংগীত আর মানুষের মনের  সংগীতের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকতে পারে l ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, যেমন ১৯০৫ সালের স্মৃতি বহন করে, তেমনি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ১৯৫২ সালের স্মৃতি বহন করে l আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি — একটি জাতির যেমন  গর্বের ও জাতীয়তাবাদের প্রতীক, তেমনি আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি। — একটা জাতির সচেতন অভ্যুত্থানের প্রতীক, তার অস্থি-মজ্জার মধ্যে মেরুদণ্ড গঠনেরও প্রতীক l

২০০৬ সালে বি. বি. সি. বাংলা সর্বকালের সেরা যে ২০ টি বাংলা গানকে তালিকাভুক্ত করেছিলো তার মধ্যে গাফ্ফার চৌধুরীর এই সাড়া জাগানো  গানটিকে ৩ নং – এ স্থান দিয়েছিলোl অথচ ঐতিহাসিক ঘটনার  নিরিখে  এই গানটিকে সর্বশ্রেষ্ঠ গানের তকমা দিলে  নির্বাচনের গুরুত্ব অন্য মাত্রা পেতো l কারণ এই গানটির সুত্র ধরেই ‘ একটি মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি ঝড়ের ধ্বনি হয়ে স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিয়েছিলো l  নেপথ্যে চালিকা শক্তি ছিলো ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র সেই সঞ্জীবনী অনুপ্রেরণা l

আমাদের মুর্শিদাবাদের  বরেণ্য সাহিত্যিক আবুল বাশার বলেছেন — “একুশের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমেই মনে আসে : বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রধান চার ভাষা শহিদের একজন বরকত মুর্শিদাবাদ জেলার ছেলে l ভাষা আন্দোলনের উদ্বেলতায়, একুশে ফেব্রুয়ারির বিজয় গৌরবে তাই অংশ রয়েছে এই সীমান্ত জেলার l সালারের বাবলা গ্রামে বরকতের নামে এখনও একটা ক্লাব রয়েছে l একুশে ফেব্রুয়ারি সালার তথা সারা মুর্শিদাবাদের শ্রেষ্ঠ উৎসব, ভাষা উৎসব, ভাষা আবেগের ধমনী দেশভাগকে পাল্টা পরিহাস করে ! …. চরের জমিতে চাষীর আবাদ l.. বর্ডার ডিঙ্গিয়েই তো বরকত গিয়েছিলেন ঢাকায় পড়াশোনা করতে, এই পদ্মা তাঁকে পেরুতে হয়েছিল l”

হ্যাঁ, পদ্মা তাঁকে পেরুতে হয়েছিলো, সে দেশে থাকার জন্য নয়, লেখাপড়া শিখে বাড়ি ফিরে আসার জন্য ।

না বাড়ি তাঁর ফেরা হয়নি । তাঁর জীবনের দুটি প্রিয় জিনিসের মধ্যে একটি ছিলো প্রিয় ভাষা বাংলা, আর অন্যটি প্রিয় জন্মমাটি বাবলা । একটি ইচ্ছা তাঁর পূরণ হয়েছে তিনি  প্রিয় বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, অন্য ইচ্ছাটি তাঁর অপূর্ণ থেকে গিয়েছে । তিনি তাঁর জন্মমাটি বাবলায় আর ফিরতে পারেননি । অথচ তিনি ও-দেশের নাগরিক নন, ভারতীয় নাগরিক । তাঁর নাগরিকত্বের প্রমাণ ঢাকার মাটিতে তাঁর কবরের স্মৃতি-ফলকে খোদাই করে লেখা আছে । তাঁর পিতা, তাঁর আত্মীয় স্বজন সকলেই  পশ্চিমবঙ্গের বাবলা গ্রামে তাঁদের পারিবারিক গোরস্থানে শায়িত । কেউ ভারতীয় নাগরিকত্ব ত্যাগ করে অন্য দেশের নাগরিকত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করতে যাননি ।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ রচয়িতা গাফ্ফার চৌধুরীও  এ-বছর ২০২২ সালের ১৯ মে বৃহস্পতিবার লন্ডনের একটি হাসপাতালে প্রাণত্যাগ করেছেন l ২৫ মে, বিদেশ বিভুঁইয়ে নয়,  দেশের মাটিতে অর্থাৎ  বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে তাঁকে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে l কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া বরকতের দেহের তো আর দেশে  ফেরা হয়নি, তাঁর প্রিয় জন্মমাটি মুর্শিদাবাদের বাবলা গ্রামের মানুষদের তাঁর মৃতদেহকে দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়নি । পিতা ভোলাই মিয়া পুত্রের স্মৃতি-বিজড়িত  বাবলার মাটি আঁকড়িয়ে পড়েছিলেন আমৃত্যু । শোনা যায় নিশুতি রাতে পুত্র শোকাতুর পিতা ভোলাই মিয়া বাবলা গ্রামের অলিতে গলিতে  কেঁদে কেঁদে ফিরতেন, “আবাই,  ই-কি করলি বাপ !”

আর সবচেয়ে বড় কষ্টের বৃত্তান্ত এই যে, বরকতের ভাগ্যহীনা জননী হাসিনা স্বামী পুত্রের স্মৃতি বিজড়িত তাঁর প্রিয় জন্মমাটি বাবলায় শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেননি । ১৯৮০ সালের পর অশ্রু সজল চোখে, পরিস্থিতির চাপে তাঁকে পরিবারের অবশিষ্ট পোষ্যদের নিয়ে বাবলার মাটি ছাড়তে হয়েছিল । শহিদ জননী হিসেবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি যে সাদর অভ্যর্থনা ও কিংবদন্তি-তুল্য খ্যাতি পেয়েছিলেন সেকথা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না ।

এক অখ্যাত গ্রাম্য কবি তাই খেদ করে লিখেছেন — “মুর্শিদাবাদ জেলার সালার থানার তালিবপুর / সেখান থেকে ‘বাবলা’ গ্রামটি নয়কো বেশি দূর l / সেই গ্রামেতে জন্মেছিলেন সুমহান বরকত, / ভোলাই মিয়ার নয়নমণি, হাসিনার জহরত l”/… এরপরই কবির খেদ এবং খেদের সঙ্গে  দ্রোহ,  যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি হয়ে বাবলা থেকে বাংলার আকাশ-বাতাসকে ভারাক্রান্ত করে তোলে — “এ-পারেতে ভোলাই মিয়া অখ্যাত বাংলায় / এজমালি এক সমাধি স্থলে পড়ে রয় একলাই l / সাগরপাড়ের কবরের নিচে প্রহর গুণে সদা / সকাল হলে চিনবে লোকে তিনিও শহিদের পিতা l /  শহিদ মাতার সমাধি যখন ঢাকে পরিচ্ছদে, / শহিদ পিতার কবরে তখন শিয়াল কুকুর কাঁদে l / ও-পার বাংলায় শহিদ মাতা সালাম শ্রদ্ধা পায়, / এ-পার বাংলা ডুকরে কাঁদে, / আবাই ফিরে আয় …l”

গত আড়াই দশক ধরে এপার বাংলার নেতা-মন্ত্রীরা প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি বাবলার মাটিতে দাঁড়িয়ে বরকতের স্মরণে কিছু করার জন্য শুধু কথা দিয়ে এসেছেন, কথা রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবেননি কেউ l

অথচ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটিই হতে পারতো দুই বাংলার মিলনসেতু l আর বৃহস্পতিবার হতে পারতো একুশে ফেব্রুয়ারির মতো একটি বিশেষ বার । কারণ এই বারে যাঁকে দেখে গানটি লেখা এবং যিনি লিখেছেন উভয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন। রয়ে গিয়েছে শুধু তাঁদের স্মৃতি-বিজড়িত সেই অমর সঙ্গীত —  আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি….!

 

_______________________________________________________________________________________

১. অমর একুশে : সম্পাদনা – হাসান হাফজুর রহমান / পৃষ্ঠা – ৪১ l

২. আমি শহীদ বরকতের উত্তরসুরী আইনুদ্দিন বরকত : ২০০০ সালের একটি সাক্ষাৎকার, স্থান : সালার, মুর্শিদাবাদ l

২. অমর একুশে : সম্পাদনা – হাসান হাফিজুর রহমান / পৃষ্ঠা – ২৪ l

৩. সচিত্র সন্ধানী, একুশে ‘৭১ – র সংখ্য থেকে l

৪. শহিদ আবুল বরকত স্মৃতি সংঘ -বাবলা : সম্পাদক – সৈয়দ সিয়াদত আলি l

৫. সীমান্ত এক অশ্রুরেখা, তারই পারে ঘর দেখা যায় : আবুল বাশার ।

৬. আবাই ফিরে আই: জগবন্ধু সাহা : একুশের ভাবনা, সম্পাদক : বদরুদ্দোজা হারুন , প্রথম সংখ্যা, কলকাতা- ২০১৭ l

Leave a comment

Check Also

গোল করলেন বাঘুবাবু

বাঘু দিল গো-ও- ও-ল – মৌসুমী পাত্র

  শীতটা এবারে কেমন যেন ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়েছে! অন্যান্য বছর কার্তিক মাস পেরোতে না পেরোতেই …

আশমানি পাঠশালা

আশমানি পাঠশালা – ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য্য

  ” ডান দিকটা একটু ওপরে উঠে গেছে। নামা। ব্যস, ঠিক আছে। এবার দড়িটা শক্ত …

আত্মারামের বাসর যাপন

আত্মারামের বাসর যাপন – রঘুনাথ মণ্ডল

    আত্মারামের বিয়ে, কনে বিল্ববাসিনী। আগে আত্মারাম কনে দেখেনি। বাবা, মামা সম্বন্ধ করে ঠিক …

সেই সব শীতকাতুরেরা

সেই সব শীতকাতুরেরা – সোমক সেনগুপ্ত

[ সে এক সময় ছিল বটে! ভিনগ্রহী জীব তবু হয়তো কল্পনা করা যেত- কিন্তু মোবাইল …