প্রথম দৃশ্য
চরিত্রঃ মঙ্গলা, ফুলকি, বুধন , টুনো
[নেপথ্যকণ্ঠঃ অন্ধকার যেমন তার কালো চাদরে মুড়ে দেয় সমগ্র জীবজগতকে, তেমনই আমাদের মনের পরতে পরতে মিশে থাকা কুসংস্কার ঢেকে দেয় মানুষের মন, তার সম্পূর্ণ সত্তা। অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিতদের মধ্যে তো বটেই, অনেক শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও নানারকম কুসংস্কার আজো প্রবলভাবে বিদ্যমান। আমরা একদিকে যেমন কম্পিউটার নাড়াচাড়া করি, মোবাইল ফোনে দূরদূরান্তের লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলি, তেমনই নজর দূরীকরণ কবচ পরতেও দ্বিধা করি না। পরশুরাম আজ আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু বিরিঞ্চিবাবারা রয়ে গেছেন।ডাইনি সন্দেহে মারধোরের খবর এখনো, এই একবিংশ শতাব্দীতেও খবরের কাগজের পাতায় ছাপা হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, নির্যাতিত মানুষটি প্রায়শঃই সহায়সম্বলহীনা কোন অসহায় মহিলা। গ্রামের কোন দুরভিসন্ধিসম্পন্ন মানুষের স্বার্থসিদ্ধির তাগিদেই তার গায়ে লেগে যায় ডাইনির তকমা।
আমাদের সমাজজীবন থেকে সকল কালি মোচনের ঘুচে যাক। এ জীবন পুণ্য হোক প্রাণের পরশে। শুরু হচ্ছে আমাদের প্রয়াস, আমাদের আজকের নাটক “আগুনের পরশমণি”। ] [পর্দা উঠতে দেখা গেল, মঙ্গলা পিছন ফিরে টুকিটাকি কাজ সারছেন। তাঁর মেয়ে ফুলকি ঢোকে। সে স্কুলে যাবার জন্য ব্যাগ কাঁধে তৈরি।]
ফুলকিঃ মা, ও মা। আমি আসি।
মঙ্গলাঃ আয় তাহলে। তোর ফিরতে কত দেরি হবে, ফুলকি?
ফুলকিঃ স্কুল থেকে টিউশন পড়ে ফিরব। সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
মঙ্গলাঃ বেশি রাত করিস না। গাঁয়ের লোক তোকে তখন খারাপ কথা বলবে।
ফুলকিঃ কেন, আমরা তো কারুর কুন ক্ষতি করি নাই। তাহলে বলবে কেন?
মঙ্গলাঃ দুর্বলকে খুঁচিয়ে যে সবাই আনন্দ পায়। এমনিতেই বড়ো কষ্টে আছি। ফুলকি, তুই বাবা, দেরি করিস না। দিনকাল ভালো নয়।
ফুলকিঃ তুমি চিন্তা কোরো না। পড়া শেষ হলেই ফিরে আসব। তুমি আজ খাটতে যাবে না?
মঙ্গলাঃ না রে, শরীরট ভাল লাগে না। কী করে যে কী হবে? তোর পড়ার খরচই বা যোগাব কোত্থেকে?
ফুলকিঃ আঃ, মা! তোমাকে বললাম না সেদিন, মাধ্যমিকের রেজাল্টের জন্য স্কলারশিপ পাবো স্কুল থেকে।
মঙ্গলাঃ তর কী কী খ্যাতা বই লাগবে, কিনে লিবি। মন দিয়ে লিখাপড়াট কর। তবে দুঃখুটা ঘুচে। এখন যা, তর কেলাসের দেরি হয়ে যেছে।
ফুলকিঃ আসি, মা।
(ফুলকি বেরিয়ে যায়। ফুলকির মা এটাওটা করতে থাকে। বাইরে থেকে আওয়াজ ওঠে, “হেই মঙ্গলা, বাড়ি এছিস নাকি?” মঙ্গলা পিছন ঘোরে। মুখে অপ্রসন্নতার ছোঁয়া। দুজন লোক ভেতরে ঢোকে। বুধন আর টুনো। তারা কোন অনুমতির তোয়াক্কা না করেই ভেতরে ঢুকে যে যার মতো ব্যবস্থা করে বসে যায়। মঙ্গলা হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থাকে।)
বুধনঃ তর মেয়্যাট গেল দেখলাম। লতুন সাইকেল চেপে। সাইকেল পেলি কুথায়?
টুনোঃ হঁ, এক্কেরে লতুন সাইকেল।
মঙ্গলাঃ দশ কেলাসে ভাল রেজাল্টের লেগে পেরাইজ পেছে। কেনে তর তাতে কী?
টুনোঃ আমার? (হাত উলটে) আমার কিছুই লয়। তর ভাল হলেই ভাল।
বুধনঃ শুন, তকে যেট বলার লাগে এসছি, গাঁয়ের পুবধারে তর যে জমিট আছে, উটা আর র্যানখে কী করবি? বেচে দে।
টুনোঃ তর বিটিটও ত ডাগর হইছে। ইবার ত বিয়া দিতে হব। বিয়ার খরচা আছে।
মঙ্গলাঃ বিয়া এখন দিব নাই। উ পড়ছে। আরঅ আরঅ পড়বে।
বুধনঃ তর ত কামাই কিছু নাই। পড়াবি কী করে?
মঙ্গলাঃ ক্যানে, উ কলারশি না কী বলে, সেট ত পেবে। অ্যাত অ্যাত ট্যাকা! পড়ার খরচ লিয়ে তদের ভেবতে হবে নাই।
টুনোঃ বিটিছিলাদের অত পড়াশুনা ভাল লয়। বেশি লেখাপড়া শিখে কি হাতিঘড়া হবে?
বুধনঃ হো হো হো হো হো হো।
মঙ্গলাঃ হাতিঘড়া হবে না কী হবে, তদের অত ভেবতে হবে না।
টুনোঃ তা আমরা ভেবব না ত কে ভেববে? তর মরদট থাকলে না হয় ভেবত। সে ত কবেই তকে ছাড়েছুড়ে অন্য ঘর করছে।
(মঙ্গলা চুপ করে যায়। কথাটার অভিঘাত সামলাতে তার সময় লাগে।)
বুধনঃ দ্যাখ, তর যখন মরদ নাই, আমরাই তর ভাবনাট ভেবি। কী বলিস, টুনো? (টুনোর দিকে চোখ টেপে।)
টুনোঃ কথাট ঠিকই, বুধনদা।
মঙ্গলাঃ (ফুঁসে উঠে) তরা কী বলতে এয়েচিস?
বুধনঃ দ্যাখ, মোরা ভাল কথাই বলতে এয়েচি। এই যে তর বিটিট রাত করে ঘর ঢুকছে, কথা ঊঠছে গাঁয়ে।
মঙ্গলাঃ উ স্কুলে যায়। তারপরে পেরাইভেট যায়।
টুনোঃ কুথায় যায় না যায়, কেউ কি দেখতে যেছে? কথা হছে, রেতে ফিরছে। তায় শীতের বেলা।
বুধনঃ ভাল কথাই বলছি। বিটিটকে আর ঘরে রেখিস না। বিয়াট দিয়ে দে। সব ঠিক হয়ে যেবে।
টুনোঃ আর ভাল ছেলা যখন হাতের ডগেই রয়েছে।
মঙ্গলাঃ মানে?
টুনোঃ মানেট সজা। এই বুধনদাদার ছেলার মত অমন সনার চাঁদ ছেলা কোথায় পেবি?
মঙ্গলাঃ সে ত কেলাস ফর পাশ। ফ্যা ফ্যা করে সারাদিন ঘুরে বুলে। উ ছেলেকে আমি বিটি দিব? না। আমার বিটিট পড়ছে।
বুধনঃ দ্যাখ মঙ্গলা, অত গরব ভাল লয়। তর বিটিট ভাল থাকত।
টুনোঃ বুধনদাদার অত বড় বাড়ি, উঠান, জমি- সব ওই ছেলাটই পাবে। ভাল করে ভাবে দ্যাখ।
মঙ্গলাঃ ভেববার কিছু নাই। আমার বিটিট পড়বে, যত ধুর পারে। আমার আর কেউ নাই- উ ছাড়া। যত ধুর পারে, পড়াব।
বুধনঃ কেউ নাই কেন বলছিস?
টুনোঃ আমরা ত আছি। মাঝেমধ্যে এসতে ত পারিস।
বুধনঃ (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) আমারও বউট মরল। তুইও একা। আমিও একা। মাঝেমধ্যে এসবি। তুইও ভাল থাকবি। আমিও।
মঙ্গলাঃ কী? কী বললি? (বলতে বলতে মেঝেয় পড়ে থাকা ঝাঁটা তুলে নেয় হাতে)। দাঁড়া, দেখাইছি তদের। (ঝাঁটা পড়তে থাকে।)
বুধনঃ (পালাতে পালাতে) এর ফল ভালো হবে না।
টুনোঃ (পালাতে পালাতে) আমরাও দেখব।
মঙ্গলাঃ যা যা!
(এই সবের মধ্যেই পর্দা পড়ে যায়।)
দ্বিতীয় দৃশ্য
(চরিত্রঃ হাবল, ধুনু, বুধন, টুনো)
(কয়েকজন গ্রাম্য পুরুষ-মহিলা মিলে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। )
১ম। বদির বউট বডা কাঁদছে রে, ধুনু।
২য়। ক্যানে রে হাবল? কী হছে?
১ম। বদির ছেলাটাকে সাপে কেটছে কাল রেতে। থেকিস কুথায়?
২য়। আমি কাল ঘুমিয়ে গেইছিলাম সকাল সকাল।
১ম। বদির ব্যাটাট কাল রেতে বেইরে যেছিল বড় কাজ সারতে। কালকেউটে ছিল মাঠে। আচমকা পা পড়তেই দিছে ফঁস করে।
২য়। এই হল কাপাল! কাপালে থাকলে কে আটকাবে?
১ম। সে বটে। এই যেমন মুংলির বউটর আর বাচ্চাই হছে না। কত ডাক্তর দেখাল, ঝাড়ফুঁক করাল, কিসেও কিছু হয় না।
২য়। আমার গাইটও কাল থেকে কিছু খেছে না, দুধ দিছে না। বিটিটরও জ্বর দুদিন থেকে।
১ম। আমারও বড় লাতিটর পেট ছাড়ে গেছে। আজ একবার ডাক্তর ঘর যাব। এখন যাই।
২য়। আমিও একবার বদির ঘর যাই। দেখি, ছানাট বাঁচল না মরল।
(সবাই বেরিয়ে যায়। আর তার প্রায় সাথে সাথেই বুধন আর টুনো ঢোকে পা টিপে টিপে।)
বুধন। টুনো, শুনলি?
টুনো। কী?
বুধন। এই যে, ওরা সব যা বলছিল।
টুনো। হঁ, শুনলাম। তাতে তোমার আমার কী?
বুধন। কী মানে? মঙ্গলার হাতের মারট মনে আছে?
টুনো। আছে মানে? এখনো গা হাত পা জ্বালা করছে। সুযোগ পেলে এমন দিব না!
বুধন। তাই বলছিলাম। দুই আর দুইয়ে চার করতে হবে।
টুনো। হেঁইয়ালি ছেড়ে আসল কথাট বল।
বুধন। উয়ারা সব কী বলছিল?
টুনো। কী আবার? বদির ব্যাটাটকে সাপে কেমড়েছে, আর কার গাইয়ের দুধ হছে না, কাল লাতির পেট খারাপ, কার জ্বর এইসব।
বুধন। শুন। এইগুলাকে কাজে লাগাতে হবে। উয়াদের বুঝাতে হবে, গাঁয়ে যে এইসব হছে, এগুলা সব ডানের কাজ। ডানের লজর লেগেছে।
টুনো। ডানট কে?
বুধন। এইটও বুঝলি লাই। ডান মঙ্গলা আর তার বিটি।
টুনো। উয়ারা ডান?
বুধন। হঁ রে, তুই বডা গাধা হয়েছিস রে? সত্যি সত্যি কী আর? গাঁয়ের লককে বুঝাব। তারপরে গাঁয়ের লকেরাই যা করার করবে। আমরা সরে পড়ব।
টুনো। কিন্তু কাজট কি ঠিক হবে? মিছামিছি অপবাদ দেওয়া কি ভাল কাজ?
বুধন। অত যদি সাধু সন্ত, তাইলে সিদিন আমার সঙ্গে যেছিলি ক্যানে?
টুনো। সিদিন যেছি বলেই কি মিছা অপবাদ দিতে হবে?
বুধন (রেগে গিয়ে)। দ্যাখ টুনো, যখন মঙ্গলার হাতে মার খেছিলি, তখন কেমন লাগছিল? (নরম সুরে) সুযোগ বারবার আসে না। সেদিন মঙ্গলার ঘর থেকে পালাবার সময় ত শাসিয়ে এসছিলি দেখে লিবি বলে!
টুনো। হঁ, তা বলেছি।
বুধন। কিছু না করতে পারলি মঙ্গলাই ভাববে, আমরা ভিতু, কাপুরুষ! সেদিন ত কুকুর খেদার মত যা তা বলেছিল। আমরাও যে কিছু কম লই সিটা ইবার দেখাতে হবে।
টুনো। ইট ঠিক কথা। কিছু না করতি পারলি আমাদেরই ভিতু বলবে। (ঘুরে দাঁড়িয়ে) ঠিক বলেছ। মঙ্গলা আর আর উয়ার বিটিকে ডানের ছাপ্পা মেরে দিতে হবে। ভোটে যেমন আঙ্গুলে ছাপ লাগায়, সিরকম।
বুধন। এই ত, মরদের মত কথা!
টুনো (চিন্তার সুরে)। কিন্তু বুধনদাদা…
বুধন। কিন্তু কী?
টুনো। আমরা বললেই কি গাঁয়ের লকেরা শুনবে?
বুধন। আমরা বললে হয়ত শুনবে না। কিন্তু ওঝা যদি বলে, ডানের লজর লেগেছে, ডানে বাণ মেরেছে, তবে ত গাঁয়ের লকে মানবে।
টুনো। ওঝা?
বুধন। তা লয় ত কী?
টুনো। ওঝা কী করে জানবে যে মঙ্গলারাই বাণ মেরেছে?
বুধন। একট কথা তুই বুঝ টুনো। ওঝাকেও ত তার পেটট চালাতে হয়। তার ত আর অন্য কাজকাম জানা নাই। পয়সা দিলেই তুই যা যা বলতে বলবি তাই তাই বলে দিবে। হেঁ হেঁ বাবা!
টুনো। তাইলে ত আর ভাবনাই নাই।
বুধন। আমার শ্বশুরের এক ওঝার সাথে ভাব আছে। পটাং ওঝা। তাকেই বলব।
টুনো। ভাল মতলবট করেছিস।
বুধন। তুই আর আমি একদিন যাই চ। পটাং ওঝাকে ট্যাকা দিয়ে সব বুঝাই বলে আসি। তাপ্পরে একদিন গাঁয়ের লকজন লিয়ে যাব। ওঝা সবার সামনে বলবে যে, মঙ্গলা আর উয়ার বিটি ডান।
টুনো। গাঁয়ের লকেরাই তাপ্পরে উয়াদের পিটিন শেষ করবে।
বুধন। আমাদের গায়ে ঝাঁটা তোলার ফল পাবে।
(আচমকা ১ম ব্যক্তির দৌড়োতে দৌড়তে প্রবেশ।)
১ম। বদির ব্যাটাট মরে গেল গ।
বুধন ও টুনো। অ্যাঁ, কখন?
১ম। এই অল্প আগে হাসপাতাল থেকে খপর এয়েছে। বদির বৌকে জানাতে যাচ্ছি।
(সে বেরিয়ে যায়। বুধন ঘোরে টুনোর দিকে। হাসি হাসি মুখ।)
বুধন। বদির ব্যাটাট মরে সুবিধাই হ্ল রে টুনো! (অঙ্গভঙ্গি করে)
টুনো। গাঁয়ের লকেদের বুঝাব, লজর না লাগলে জোয়ান ছেলে কি হট করে মরে যায়?
বুধন। চল, যাই। পটাং ওঝার কাছে যাবার যোগাড়ট করি।
টুনো। চল, চল। সেই ভাল। (দুজনে বেরিয়ে যায়)
তৃতীয় দৃশ্য
(চরিত্রঃ পটাং ওঝা, ফুলমণি, ভাটাই, বুধন, টুনো)
(পটাং ওঝার দরবার। তার সামনে নানারকমের জিনিস ছড়ানো ছিটোনো। নানারকমের ডালপালা, জবাফুল ইত্যাদি। পটাং ওঝা একটু উঁচু পিঁড়ির উপর বসা। একজন মহিলা, নাম ফুলমণি, তার আসনের সামনে উপুড় হয়ে আছেন। )
মহিলাঃ ও বাবা, আমাকে বাঁচাও গো।
ওঝা: (হাতের লাঠি চারদিকে ঘুরিয়ে) খাটাং খটাং খট খট। শয়তান! শয়তানের গন্ধ পাচ্ছি। দাঁড়া! (হাত থেকে একটু কিছু নিয়ে সামনে ছড়িয়ে দেয়।) ঘপাস ঘপাস ঘিং ঘিং! যা, দূর হ! হুমমম, শয়তানটাকে দূর করেছি। নে, এবারে বল, তুই কে?
মহিলাঃ বাবা, আমি ফুলমণি। সেই যে সেবারে এসেছিলাম
পটাং ওঝাঃ ফুলমণি! (স্বগতোক্তি) আহা! খাসা নাম। আহা, যেমন নাম, তেমন…
ফুলমণিঃ বাবা, কিছু বলছেন?
পটাং ওঝাঃ হ্যাঁ, মানে ইয়ে… তুই বদনার বউ না?
মহিলাঃ হ্যাঁ, বাবা।
পটাং ওঝাঃ বল, তোর আবার কী হল?
মহিলাঃ বাবা, আমার মরদটা মদ খেয়ে রোজ আমাকে পিটায়। কত বলেছি, রাগ করেছি, কিছু হয়নি।
ওঝা: ইন্তিড়ি মিন্তিড়ি টিকা টিং! হোই গিনাকি ধিনাকি ধা, চলে আয় এই লাঠিতে! সব শয়তান দূর হয়ে যাবে।
(কথার মাঝে আরো একজন লোক ঢুকে এসে বসে)
মহিলাঃ বাবা, আমার তাহলে কী হবে?
পটাং ওঝাঃ শোন, তুই এই মন্ত্রপূত বীজ নিয়ে যা। এটা বেটে তর মরদকে খাইয়ে দিবি।
মহিলাঃ বাবা, আমার মরদটার কোন ক্ষতি হবে না তো?
পটাং ওঝাঃ কিছু হলে তো আমি আছি। তোর পটাং ওঝা তোর জন্য আছে রে!
(মহিলা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে)
পটাং ওঝাঃ শুন, পনের দিন পরে আবার আসবি। আর শোন, তোর ঘরের ছাগলটাকে দিয়ে যাবি। ওটার শোধন করতে হবে।
মহিলাঃ (অবাক হয়ে) ছাগলের শোধন?
পটাং ওঝা (রাগত সুরে)ঃ যা বলছি, শোন। তর ছাগলটার উপর দুষ্টু আত্মা ভর করেছে। ওটার শোধন না হলে ওই তদের বিনাশ করবে। এখন যা। ছাগলটা একবার এসে দিয়ে যাবি।
মহিলাঃ হ্যাঁ বাবা। (প্রণাম করে যেতে যেতে বিড়বিড় করে) বড়ো ভাল ছাগলটা ছিল… বড় লক্ষ্মী ছাগল…
(পটাং ওঝা এবার পুরুষটির দিকে ফেরে)
পটাং ওঝাঃ তর কী হল, ভাটাই? ভাটকি গাধকি গিধা গা- শয়তানরা দূর হয়ে যা! কী হয়েছে, বল তাড়াতাড়ি।
পুরুষঃ আমার ব্যাটাটর পাঁচ দিন ধরে পেট খারাপ। কিছুতেই ঠিক হছিল না। ডাক্তর ঘর যাচ্ছিলাম, তা উয়ার মা বলল, একবার আপনার থানে ঘুরে যেতে।
পটাং ওঝাঃ ডাক্তার? খবরদার, ডাক্তারদের কাছে যাবি না। আমার এই জাদুলাঠির চেয়ে ডাক্তাররা বেশি জানে?
পুরুষঃ না, না, আমি সেকথা বলিনি।
পটাং ওঝাঃ জানিস, এই জাদুলাঠি কত সাধনা করে পাওয়া। ঢিকান ঢিকান ঢিকা ঢা! মাথা নিচু কর, তোর মাথায় একবার ঠেকিন দি।
(পুরুষ মাথা নিচু করে। পটাং ওঝা জাদুলাঠি মাথায় ঠেকিয়ে দেয়।)
পটাং ওঝাঃ শোন, এই মন্ত্রপূত ধুলো দিচ্ছি। এই নে। (লোকটি হাত বাড়িয়ে নেয়।) খুব ভোরে সূয্যি ওঠার আগে এই ধুলো একটু জল আর মধু দিয়ে খাইয়ে দিবি। আর ভাবতে হবে না।
পুরুষঃ আপনাকে কী দেব?
পটাং ওঝাঃ কী? এতবড় কথা? পটাং ওঝা নিজের জন্য কিছু নেয় না। তবে তুই যদি দিতে চাস, কাল অমাবস্যায় আমার বিশেষ যজ্ঞ আছে। তুই দু কিলো চাল, এক কিলো মুগ ডাল, আর একটা গোটা নারকেল দিয়ে যাবি।
পুরুষঃ হ্যাঁ বাবা। আজ বিকেলেই দিয়ে যাব।
পটাং ওঝাঃ ঠিক আছে, এখন যা।
(পুরুষটি বেরিয়ে যায়। পটাং ওঝা সেদিকে তাকিয়ে উঠে পড়ে পায়চারি করতে থাকে।)
পটাং ওঝাঃ এই বোকা লোকগুলোকে ঠকিয়েও সুখ! একমুঠো ধুলো দিলাম, বিশ্বাস করে নিয়ে চলে গেল। আগের মেয়েটাকে ধুতরার বীজ দিলাম নিয়ে চলে গেল। নাহলে আমারই বা চলে কী করে?
(পটাং ওঝার গান ও নাচ)
গদাম গদাম গা
লাঠির ঘায়ে ধা
লোকঠকানি ব্যবসা আমার
নজরানা দিয়ে যা!
এইই কারা যেন আসছে! যাই, গিয়ে বসে পড়ি।
(পটাং ওঝা গিয়ে বসে পড়ে নিজের আসনে। একটু পরেই ঢোকে বুধন আর টুনো।)
পটাং ওঝাঃ কে তোরা? কী চাস?
বুধনঃ বাবা, আমরা কমলপুর গাঁ থেকে এসছি।
টুনোঃ হুই দূর থেকে।
পটাং ওঝাঃ নাম কী?
বুধনঃ আমি বুধন।
টুনোঃ আমি টুনো।
বুধনঃ বাবা, পুজোর প্রণামী এক হাজার টাকা।
পটাং ওঝাঃ না, তোরা ভাল লোক। ভক্তি ছেদ্দা আছে। এবারে বল।
বুধনঃ আমাদের গাঁয়ে পরপর কিছু ঘটনা ঘটছে। কাউকে সাপে কাটছে, কারুর পেট খারাপ।
টুনোঃ কারুর জ্বর, কারুর গাইয়ের শরীল খারাপ।
পটাং ওঝাঃ তোদের কী ধারণা?
বুধনঃ আমাদের মনে হয়, লজর লাগছে।
টুনোঃ ডানের লজর। না হলি এত কিছু হয়।
পটাং ওঝাঃ (হাতের লাঠি ঘুরিয়ে)ঃ ঘিচিং পিচিং পিং! বল তো জাদুলাঠি, কী হচ্ছে ওদের গাঁয়ে? (কানে চেপে শোনার ভঙ্গি করে) হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক, ঠিক। ডানেরই নজর লাগছে। (লাঠি সরিয়ে) তোদের কাউকে সন্দেহ হয়?
বুধন আর টুনোঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ। মঙ্গলা আর তার বিটি ফুলকি।
পটাং ওঝাঃ তাকুড় নাকুড় না! বল তো জাদুলাঠি, ডান কে? (কানে চেপে শোনে) কী বললি? মঙ্গলা? আর… আর… ফুলকি।
বুধনঃ বাবা, একটি উপকার করতে হবে।
পটাং ওঝাঃ কী?
টুনোঃ আমরা বললে তো গাঁয়ের লোকে শুনবে না। আপনাদের বলতে হবে।
বুধনঃ আমরা গাঁয়ের লোকেদের নিয়ে আসব।
টুনোঃ খরচাপাতি যা লাগে সব দেব।
পটাং ওঝাঃ ঠিক আছে। তোরা এত করে বলছিস যখন। সামনের সোমবারে নিয়ে আসিস।
বুধন আর টুনোঃ আজ তাহলে আসি বাবা।
(বুধন আর টুনো বেরিয়ে যায়। পটাং ওঝা আবার নাচতে থাকে…)
গদাম গদাম গা
লাঠির ঘায়ে ধা
লোকঠকানি ব্যবসা আমার
নজরানা দিয়ে যা!
চতুর্থ দৃশ্য
(চরিত্রঃ হাবল, ধুনু, বুধন, টুনো)
(গাঁয়ের রাস্তায় দুজন কথা বলছে। ১ম ব্যক্তি হাবল, ২য় জন ধুনু।)
১ম। বদির বউটর দিকে তাকান যায় না। কেমনপারা হয়ে যেছে। সবই কাপাল!
২য়। আমার লাতিটা আজ তিন বছর ধরে কেলাসে শুধু ফেলই মারছে। কপাল ছাড়া আর কী!
১ম। আমার বউটর জ্বর আজ সাতদিন হল। সুস্থ মানুষট জ্বরে পড়ে আছে। কপালে না থাকলি অমনি হয়?
২য়। ওই ত বুধন আর টুনো আসছে।
(বুধন ও টুনোর প্রবেশ)
২য়। বুধন, বদিদের সংসারট যি ভেসে যেছে।
১ম। কপালে থাকলি অমন হবেই।
টুনো। কপাল লয়। কপালের জন্য অমন হয় না।
২য়। কপাল লয়? তবে কী?
বুধন। কেউ বাণ মেরেছে।
টুনো। লজর লাগছে।
১ম। বাণ?
২য়। লজর?
বুধন ও টুনো। হঁ, হঁ। ডানে বাণ মারছে।
(সবাই মিলে এ ওর দিকে তাকাতে তাকাতে ঘাড় নাড়ে।)
১ম (সংশয়ের সুরে)। তা ডানে বাণ মারছে বুঝলি কেমন করে?
২য়। হঁ হঁ, কেমন করে বুঝলি?
বুধন। তা না হলি অমন জোয়ান ব্যাটাছেলা সাপের কামড়ে মরে?
টুনো। মুংলির বউটর যি ছেলাপিলা হয়নি, কিসের জন্যি? ডানের লজর লাগলি পেটের বাচ্চা পেটেই শুকিন যায়।
১ম ও ২য়। তা বটে, তা বটে।
বুধন। এই যি পেট ছাড়া, কেলাসে ফেল করা- সব ডানের লজর।
টুনো। গাইয়ের দুধও যে শুকিন যেছে। জ্বরজ্বালা হইয়েই যেছে। ডানের লজর বডা কঠিন রে!
১ম। মানলম তোদের কথা। কিন্তু ডানট কে?
২য়। হঁ। ডানট কে?
বুধন। ডান কে আমি কি আর জানি?
টুনো। ওঝা বলতে পারে।
১ম ও ২য়। ওঝা?
বুধন। হঁ, ওঝা।
টুনো। ওঝাদের অনেক খ্যামতা। সব দেখতি পায়।
১ম। কোন ওঝার খোঁজ জানিস?
বুধন। হঁ, জানি একজনকে। পটাং ওঝা।
২য়। কী? কী বললি?
বুধন। পটাং ওঝা। উর বিশাল ক্ষমতা। আগু পিছু সব দেখতি পায়। উয়ার একট জাদুলাঠি আছে। সেইট ঘুরিন ঘুরিন সব বলি দিতি পারে।
টুনো। তবে আর দেরি লয়। সামনের সোমবারেই চল।
২য়। হ্যাঁ হ্যাঁ, সোমবারেই চল।
১ম। দেরি করা ঠিক লয়।
বুধন। তবে তাই চল।
টুনো (যেন কিছু মনে পড়ে গেছে এভাবে)। হঁ রে বুধন, ওঝার কাছে যাবি, খরচাপাতি লাগবে না?
বুধন। হঁ, তা কিছু লাগবে।
১ম। হঁ হঁ, খরচাপাতি সব দিব।
২য়। হঁ, হঁ, সব দিব।
১ম। দরকারে ঘটিবাটি বিচে দিব।
২য়। আমিও দিব।
টুনো। তাইলে এখন আসা-যাওয়ার খরচা, খাওয়া খরচা আর ওঝার ভেট- সব মিলে হাজার পাঁচ ছয় লাগবে।
বুধন। সবাই এক হাজার টাকা করে দিলে হয়ে যাবে।
১ম। এক হাজার?
২য়। এক হাজার?
১ম। অত পারব নাই।
বুধন। তবে তোদের ডানে কাটুক।
টুনো। ডানের লজর লেগে তোদের সব শেষ হয়ে যাক।
১ম। না না, তা বলি নাই।
২য়। আচ্ছা, যা লাগে দুব।
১ম। হঁ দুব।
বুধন। বদিকেও বলতি হবে।
টুনো। চল তাহলে, বদির বাড়ি যাই। আর লোক জুটাই।
বাকিরা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই চল।
(সবাই বেরিয়ে যায়।)
পঞ্চম দৃশ্য
(চরিত্রঃ পটাং ওঝা, বুধন, টুনো, হাবল, ধুনু)
(পটাং ওঝার দরবার। পটাং ওঝা বসে বসে এটা সেটা করছে।)
পটাং ওঝাঃ আজ সোমবার। আজই সেই ওদের আসার কথা না গাঁয়ের লোক লিয়ে। কী যে নাম বলেছিল মেয়েদুটোর? হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ম-ম-ম-মঙ্গলা আর…আর… ফুলকি। (একটু থেমে) গাঁয়ের লোকগুলোকে এমন দেব না… পটাং ওঝার ভেলকি বুঝে যাবে।! হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ, হাঃ।
অনেক বেলা হয়ে গেল। এখনো কেউ এল না। অন্য খদ্দেরও কেউ আসেনি। এরকম হলে মুশকিল।
(বুধন, টুনো ও বাকি দুইজনের প্রবেশ। সবাই মিলে ঢুকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে।)
পটাং ওঝাঃ (চোখ ঘুরিয়ে) কী ব্যাপার, তোরা কারা?
বুধন। বাবা, আমরা অনেক দূর থেকে এসছি। হুই কমলপুর গাঁ থেকে।
টুনো। অনেক আশা নিয়ে এসেছি।
বাকিরা। আমাদের ফেরাবেন না, বাবা।
বুধন। একটু দয়া করুন।
পটাং ওঝাঃ (হাতের লাঠি ঘুরিয়ে) খিটন্তি খিটন্তি খিটন্তি যাঃ। খটাখটি লেগে যা। (হাতের লাঠিটা শুঁকে) ডানের গন্ধ পাই যেন!
টুনো। বাবা, আপনি ঠিকই ধরেছেন।
বুধন। আপনার কী খ্যামতা!
বাকিরা। অবাক খ্যামতা!
পটাং ওঝাঃ বল এবারে, কী সমস্যা তোদের গাঁয়ে?
টুনো। আমাদের গাঁয়ে নানা ঘটনা ঘটছে।
১ম। সাপে কেটে একজন মারা যেছে।
বুধন। গাঁয়ের বৌদের বাচ্চাকাচ্চা হছে না।
২য়। গাইয়ের দুধ শুকিয়ে যেছে।
১ম। জ্বরজ্বালা।
২য়। পেটখারাপ।
পটাং ওঝাঃ আবলুস বাবলুস খিচিমিচি খিচিমিচি। এ ডান ধরা লাঠি। বল দেখি জাদুলাঠি, দেখি তোর কেরামতি! বাটিং ঘাটিং টিকা টট- বলে দে তো, এদের গাঁয়ে ডান কে? (কানের কাছে লাঠি নিয়ে গিয়ে শোনার ভান করে) কী, ক্কী বললি? ম-ম-মং-মঙ্গলা। তোদের গাঁয়ে মঙ্গলা কেউ আছে?
সবাই (সমস্বরে)। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছে, আছে।
পটাং ওঝাঃ আর কেউ আছে কিনা দেখি। খানানি ঝানানি বিটাং বিট! বল ত জাদুলাঠি, আর কেউ ডান আছে এদের গাঁয়ে? (কানের কাছে শোঁকার ভান করে) কী? ক্কী? জোরে বল। শুনতে পেছি না। ফু- ফু- অ্যাঁ কী? ফুল- ফুল-জোরে বল(এক চাপড় মারে লাঠিটাকে) ফুলকি। মঙ্গলা আর ফুলকি। ওরা দুজনেই ডান। আছে তোদের গাঁয়ে?
বুধন আর টুনো। আছে।
১ম। (অবাক হয়ে) মঙ্গলা!
২য়। (অবাক হয়ে) ফুলকি!
১ম। ওরা তো সাতে পাঁচে থাকে না।
২য়। ফুলকি ত পড়াশুনা লিয়েই থাকে। স্কুল যায়, আসে।
১ম। দশ কেলাস পাশ দিয়েছে।
২য়। ফাস্টো ডিভিশন পেইছে।
পটাং ওঝাঃ (রেগে গিয়ে) তবে কি আমার জাদুলাঠি মিথ্যে বলছে?
বুধন। হতেই পারে না।
টুনো (হাতজোড় করে) অপরাধ নেবেন না, বাবা। অনেক ধূর থেকে এসছি।
১ম। আর একবার দেখলে হয় না?
২য়। যদি কোন ভুল হয়!
১ম। আর একবার দেখুন, বাবা।
পটাং ওঝাঃ ঠিক আছে। তোরা বলছিস যখন। গিটিগিটি পিচিকিটি ঝাকা ঝ্যাং- বল ত জাদুলাঠি,এদের গাঁয়ে কে ডান? (শোনার ভান) হ্যাঁ হ্যাঁ, মঙ্গলা আর ফুলকি। কোন ভুল নেই।
(১ম, ২য় মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।)
বুধন। বাবা, আপনার কী ক্ষ্যামতা!
টুনো। মঙ্গলা, ফুলকির পেটে পেটে যে এত!
১ম। আমরা কোনদিন বুঝতেই পারিনি।
২য়। আমরা ভাল বলেই জানতাম।
বুধন। ওই চুপচাপ থাকাটাই ওদের ভেক। যাতে কেউ সন্দেহ না করে।
১ম। কী শয়তান!
২য়। ভালমানুষ সেজে থাকত।
পটাং ওঝাঃ ওই ডাইনিদের জব্দ করতে হবে। নইলে তোদের গোটা গাঁয়ের অমঙ্গল।
১ম। অ্যাঁ?
২য়। আমরা সব করব।
বুধন। গাঁয়ের স্বার্থে সব করতে হবে।
পটাং ওঝাঃ হাপিজ কাপিজ ডিকা ডিং! শোন, প্রাণে মারিস না আর ভিটেমাটিটা কাড়িস না।
টুনো। তাই হবে।
১ম, ২য়। আপনি যা বলবেন তাই হবে।
বুধন। বাবা, আপনি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন।
১ম,২য়। চোখ খুলে দিছেন।
পটাং ওঝাঃ যা,তাহলে তোরা এখন।
বুধন। বাবা, সামান্য কিছু প্রণামী এনেছি।
টুনো। এটুকু নিতেই হবে।
১ম। না করবেন না।
২য়। তাহলে বড়ো কষ্ট পাব।
পটাং ওঝাঃ বেশ। তোরা এত কষ্ট করে এনেছিস যখন, ফেলি কী করে?
(বুধন আর টুনো টাকা দেয়। পটাং ওঝা হাত বাড়িয়ে নেয়।)
পটাং ওঝাঃ ভুটুম খাটুম গাবু গা! আয় তাহলে।
(সবাই মিলে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। পর্দা পড়ে যায়।)
ষষ্ঠ দৃশ্য
(চরিত্রঃ মঙ্গলা, ফুলকি, বুধন, টুনো, হাবল, ধুনু, সুদীপা দিদিমণি)
(মঙ্গলা সংসারের কাজকর্ম সারছেন। ফুলকি বসে বসে পড়াশুনো, লেখালিখি করছে।)
মঙ্গলা। ফুলকি, তর বার কেলাসের পরীক্ষাটা কবে?
ফুলকি। চার মাস দেরি আছে। সামনের মাসে টেস্ট।
মঙ্গলা। হঁ রে, ঠিক ঠিক পড়ছিস ত?
ফুলকি। হ্যাঁ, মা।
মঙ্গলা। ভাল করে পড়, বাবা। অভাবের সংসারে দুঃখটা যদি একটু ঘোচে।
ফুলকি। মা, বলতে ভুলে গেছি, কন্যাশ্রীর টাকাটা কাল ব্যাঙ্কে ঢুকেছে।
মঙ্গলা। পঁচিশ হাজার টাকা?
ফুলকি। হ্যাঁ মা।
মঙ্গলা। টাকাটা ফালতু কাজে খরচ করিস না। তর বইখাতা যা লাগবে কিনে নিস। মাস্টরদের মাইনে দিস। সংসারটা আমি যেমন চালাচ্ছি কষ্ট করে চালাব।
ফুলকি। তাই হবে মা। কালই সব কিনে আনব। আর মা জানো, সুদীপা দিদিমণি বলেছেন, আমাকে ঘরে এসে মাঝে মাঝে পড়িয়ে যাবেন। আজও আসতে পারেন।
মঙ্গলা। সুদীপা দিদিমণি? সেই যে সেবারে এসেছিলেন?
ফুলকি। হ্যাঁ মা, বড়ো ভাল মানুষ। আমাদের সবাইকে অনেক সাহায্য করেন।
মঙ্গলা। তবে ত ভাল হয়। মন দিয়ে পড়িস, বাবা।
ফুলকি। হ্যাঁ, মা।
মঙ্গলা। দেখি, টিপকল থেকে জল লিয়ে আসি। সন্ধে হলে আর যাওয়া যাবে না।
ফুলকি। মা, এখন আর যেতে হবে না। কাল সকালে আমি বরং নিয়ে আসব।
মঙ্গলা। না, তকে যেতে হবে না। জল কম আছে। আমি যাব আর আসব। তুই পড়তে থাক।
(মঙ্গলা একটা বালতি নিয়ে বেরিয়ে যায়। ফুলকি পড়তে থাকে। একটু পরে বাইরে সমবেত গলার আওয়াজ পাওয়া যায়… “হেই মঙ্গলা, বাড়ি আছিস নাকি”। ফুলকি বইখাতা গুটিয়ে ওঠে। উইংসের কাছে গিয়ে দরজা খুলতে যেতেই হুড়মুড় করে বুধন, টুনো ও বাকি চারজন ঢুকে পড়ে।)
বুধন। এই যে, একটা ডানকে পেয়েছি।
টুনো। আর একটা কোথায় পালাল?
১ম। মার, মার ওকে।
ফুলকি। কী, কী করছ তোমরা?
২য়। কী করছি জানিস না?
ফুলকি। না, জানি না।
বুধন। বদির ব্যাটাটকে মেরেছিস।
টুনো। মুংলির বউয়ের বাচ্চা হয় না।
২য়। আমার গাইটাকে বাণ মেরেছিস।
১ম। আমার ছুট লাতিটর দিকে লজর দিছিস।
২য়। তুই ডান।
বুধন। তর মাও ডান।
টুনো। তোরা দুজন ডান মিলে আমাদের গাঁটকে শেষ করেছিস।
(সবাই মিলে ঘিরে ধরে ফুলকিকে মারতে থাকে।)
ফুলকি। আমরা ডান নই। আমরা কিছু করিনি। ছেড়ে দাও।
বুধন। কে ছাড়বে?
(এমন সময় মঙ্গলার গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। ‘ফুলকি, এত গোলমাল কিসের’ বলতে বলতে ঢোকে। অবস্থা দেখে হাতের বালতি ছিটকে পড়ে যায়। বাকি সবাই হইহই করে ওঠে।)
ফুলকি। মা, মা বাঁচাও। এরা আমাকে মেরে ফেলল।
বুধন। তর মাটকেও মারব।
টুনো। আর একটা ডান এসেছে।
বাকিরা। মার, মার ওকে।
(সবাই মিলে ঘিরে ধরে মারতে থাকে। মঙ্গলা, ফুলকি প্রতিরোধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। মঙ্গলা, ফুলকির ক্ষীণ স্বর শোনা যায়- ‘বাঁচাও, বাঁচাও আমাদের।’)
(মারধোর চলতে থাকে। এমন সময় দুয়ারে এক মহিলার গলা পাওয়া যায়, “ফুলকি, কী হয়েছে রে?” বলতে বলতে সুদীপা দিদিমণি ভেতরে ঢোকেন। ঢুকেই ভেতরের অবস্থা দেখে)
দিদিমণি। কী ব্যাপার, আপনারা কে?
ফুলকি। দিদিমণি, আমাদের বাঁচান।
মঙ্গলা। এরা আমাদের মেরে ফেলল।
দিদিমণি। বেরোন, বেরোন আপনারা।
বুধন। দিদিমণি, আপনি আমাদের মাঝে ঢুকবেন না।
টুনো। এরা ডান।
ফুলকি। মিছা কথা।
মঙ্গলা। আমরা ডান লই।
টুনো। দিদিমণি, আমাদের ব্যাপার আমাদের বুঝতে দিন।
দিদিমণি। ডান বলে কিছু হয় না।
বাকিরা। উরা আমাদের গাঁটাকে খেয়ে শেষ করে দিল।
মঙ্গলা ও ফুলকি। আমরা কিছু জানি না। দিদিমণি, বাঁচান।
দিদিমণি। আপনারা বেরোবেন, না পুলিশ ডাকব?
১ম, ২য়। পুলিশ?
বুধন, টুনো। পুলিশ?
(দিদিমণি ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে নম্বর টিপতে থাকেন। )
বুধন। চল, চল, পালাই।
টুনো। হ্যাঁ, হ্যাঁ, পালানো যাক।
বাকিরা। চল, চল, পালাই।
(ওরা হুড়মুড় করে বেরিয়ে যায়। দিদিমণি ফোনে কথা বলা শেষ করে ওদের কাছে বসেন।)
দিদিমণি। ইসস, রক্তে পুরো ভিজে গেছে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ফুলকি… ফুলকি…।
(ফুলকির সাড়া পাওয়া যায় না। মঙ্গলা শুধু কোনমতে চোখ তুলে তাকায়। দিদিমণি এদিকে ফোন কানে দেন। তাঁর খালি গলা পাওয়া যায়… “তাড়াতাড়ি অ্যাম্বুলেন্স পাঠাও…”)
সপ্তম দৃশ্য
(চরিত্রঃ নিতাইবাবু, দীপেন, শ্যামল, রবি, সুদীপা দিদিমণি)
(তিন চারটে চেয়ার পাতা। কয়েকজন বিভিন্ন বয়সী মিলে কাগজ পড়ছেন।)
নিতাইবাবু। কাগজটা একবার দাও তো হে দেখি, দীপেন।
(দীপেন কাগজ বাড়িয়ে দেয়। নিতাইবাবু পড়তে থাকেন।)
শ্যামল। রবি, তোর হাতে ওটা কিসের আংটি?
রবি। কাম্যাক্ষ্যাবাবা দিয়েছেন। কাল গেসলাম।
শ্যামল। কামাক্ষ্যাবাবা? উনি তো খুব নামকরা জ্যোতিষী।
শ্যামল। আমিও ভাবছি একবার যাব। ভাগ্যটা ভালো যাচ্ছে না।
দীপেন। তুই এসব মানিস?
শ্যামল। না মানার কী আছে?
রবি। আমি বাবা সব মানি। মন্ত্রতন্ত্র, মারণ উচাটন বশীকরণ-সব মানি।
শ্যামল। কিসে কী হয় কে বলতে পারে? মানাই ভালো।
দীপেন। আমি যতদূর জানি, কামাক্ষ্যাবাবা মাধ্যমিকে ফেল। একবার জেলও খেটেছেন। জেল থেকে বেরোনোর পর এসব বুজরুকি ধরেছেন।
রবি। (কানে আঙুল দিয়ে) ছিঃ ছিঃ, এসব শোনাও পাপ।
দীপেন। তা বটে। নিজের ভাগ্য বদলাতে পারে না, লোকের ভাগ্য বদলাতে এসেছে!
শ্যামল। তোমার মুখে আগুন!
দীপেন। তা বটে। সত্যি কথা তো অপ্রিয় হবেই। সংস্কৃতে বলেছে, হিতং মনোহারি চ দুর্লভং বদ।
নিতাইবাবু (কাগজে মুখ ডুবিয়ে রেখেই)। বাপরে, কী সাংঘাতিক!
শ্যামল। কী হল, নিতাইদা?
নিতাইবাবু। ছিঃ! ছিঃ! এই আজকের যুগেও এমন কাণ্ড! ভাবা যায়?
রবি। কী হল, বলবেন তো?
দীপেন কী লিখেছে?
নিতাইবাবু। এই নাও হে। দীপেন, তুমি পড়ে শুনিয়ে দাও।
(দীপেন কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তে থাকে।)
দীপেন। এই একবিংশ শতাব্দীতে যে এখনো সমাজের একটি অংশ অন্ধকারে ডুবে রয়েছে, সেটি প্রমাণ করে দিল সম্প্রতি ঘটে যাওয়া স্থানীয় কমলপুরের একটি ঘটনা। গত পরশুদিন সন্ধ্যায় বিকেলে ডাইনি সন্দেহে কমলপুর গ্রামের একজন মহিলা ও তাঁর মেয়েকে নির্মমভাবে পিটানো হয়। মেয়েটি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এবং সে এখন আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঘটনাচক্রে মেয়েটির স্কুলের এক শিক্ষিকা সুদীপা মণ্ডল এসে পড়ায় তারা প্রাণে বাঁচে। যতটুকু জানা গিয়েছে, স্থানীয় এক যুবক প্রকৃতির ডাকে বাইরে বেরিয়ে সাপের কামড়ে মারা যান। এছাড়াও গ্রামে ছোটখাটো নানা রোগ অসুখ ঘটেছে বিভিন্ন পরিবারে। প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গ্রামবাসীদের কাছে বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও তাঁদের অনেকেই এখনো নির্মল বাংলার আওতায় শৌচাগার বানান নি। মৃত যুবকটির পরিবারও সেই দলে। প্রশ্ন উঠছে, এই ঘটনার পিছনে কি গ্রামেরই কোন দুষ্টচক্র জড়িত। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে।
রবি। ছিঃ! ছিঃ কী কাণ্ড! আজকের দিনেও এতো কুসংস্কার!
শ্যামল। ভাবাই যায় না।
নিতাইবাবু। একবার ভাবো, আমাদেররই জেলার ঘটনা।
দীপেন। এই সুদীপা মণ্ডল কে? আমাদের সুদীপা দিদিমণি নয় তো।
রবি। কে জানে? হতেও পারে।
শ্যামল। ওই দ্যাখ, দ্যাখ, সুদীপা দিদিমণি যাচ্ছে।
নিতাইবাবু। তাড়াতাড়ি ডাকো।
(দীপেন, উইংসের কাছে গিয়ে)
দীপেন। ও দিদিমণি, এদিকে একটু শুনে যান।
(রবিও ওঠে) রবি। ও দিদিমণি।
(দিদিমণি ঢোকেন। সাথে সাথে দীপেন আর রবি।)
নিতাইবাবু। দিদিমণি,বসুন। আমরা এই আজকের কাগজটা পড়ছিলাম।
দীপেন। কমলপুরের যে ঘটনাটার কথা লিখেছে, ওখানে কি আপনি ছিলেন?
সুদীপা। হ্যাঁ, মেয়েটিকে পড়াতে গিয়ে দেখি ওই কাণ্ড। তারপর অ্যাম্বুলেন্স ডাকলাম, পুলিশে খবর দিলাম।
শ্যামল। এখন কোথায় যাচ্ছেন?
সুদীপা। হাসপাতালে যাচ্ছি। মেয়েটিকে একবার দেখে স্কুলে ঢুকব।
নিতাইবাবু। কীরকম কুসংস্কার বলুন দেখি।
রবি। যত্ত সব অশিক্ষিতদের কারবার!
শ্যামল। ওই সব লোকগুলোই ওরকম।
সুদীপা। তা ঠিক। ওরা অশিক্ষিত, ওরা ছোটলোক। কিন্তু আপনারাই বা কী? এই যে হাতে গাদা গাদা জ্যোতিষী আংটি পরেছেন, এগুলো কুসংস্কার নয়?
দীপেন। ঠিক, ঠিক।
সুদীপা। আপনারা কী করেন? ছোট বাচ্চার কপালে কাজলের টিপ পরিয়ে হাতের কড়ে আঙুল কামড়ে দেন না? যাতে নজর না লাগে? এগুলো কুসংস্কার নয়?
দীপেন। একদম খাঁটি কথা।
সুদীপা। আপনারা নাহয় রোগ অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে যান, কিন্তু তার সাথে মানতটাও তো সেরে রাখেন। এগুলো কী?
দীপেন। কুসংস্কারের জাল বড়ো ভয়ানক। আষ্ঠেপৃষ্ঠে নাগপাশের মতো জড়িয়ে রেখেছে।
সুদীপা। নিজেদের দিকে একটু তাকান। একটু ভাবুন। তাহলেই বুঝবেন, শিক্ষিতদের মধ্যেও কুসংস্কার কম নেই।
দিপেন। ঠিক, ঠিক।
সুদীপা। মানুষ ডাইনি হয় না, মানসিকতাই ডাইনি হয়।
নিতাই। ভালো কথাই বলেছ, মা।
রবি। এভাবে ভাবিনি আগে।
শ্যামল। ভাবার মতো।
আশা। আজ আসি। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
বাকিরা। ঠিক আছে। (সবাই হাত নাড়ে। সুদীপা দিদিমণি বেরিয়ে যান।)
অষ্টম দৃশ্য
(চরিত্রঃ বড়োবাবু,মেজোবাবু, হাবল, ধুনু, মঙ্গলা, ফুলকি)
(থানার দৃশ্য। কিছু টেবিল চেয়ার। বড়োবাবু উত্তেজিতভাবে পায়চারি করছেন।)
বড়োবাবু। মেজোবাবু তো অনেকক্ষণ বেরিয়েছে। এখনো ফিরল না! কমলপুরের কেসটা তাড়াতাড়ি ফয়সালা করতে না পারলে মুশকিল। দেখি মেজোবাবুকে ফোন করি। (ডায়াল করে মোবাইল কানে লাগান।) হ্যাঁ মেজোবাবু, ঢুকে গেছেন…ও হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন আসুন।
(মোবাইল পকেটে ভরেন। আর তার প্রায় সাথে সাথেই দুইজনকে নিয়ে ঢোকেন মেজবাবু।)
মেজোবাবু। স্যার, বহু কষ্টে এদের ধরেছি। গোয়ালঘর, মাচা থেকে সবাইকে টেনে টেনে নামিয়েছি।
বড়োবাবুঃ ওয়েল ডান, মেজোবাবু। কিন্তু এদের তো আইডেন্টিফাই করাতে হবে।
মেজোবাবুঃ কিচ্ছু ভাববেন না, স্যার। সেই ভিকটিম মেয়েটি আর তার মাকে আনতে গাড়ি পাঠিয়েছি। একটু পরেই এসে যাবে।
বড়োবাবুঃ বাঃ! বা! এই না হলে মেজোবাবু!
মেজোবাবুঃ স্যার, এবারে একটু জিজ্ঞাসাবাদ হোক।
বড়োবাবুঃ হ্যাঁ হ্যাঁ। অ্যাই, তোরা সব কমলপুর গাঁয়েই থাকিস?
১ম, ২য়। হ্যাঁ, ছার।
বড়োবাবুঃ নাম কী?
১মঃ ছার, আমি হাবল।
২য়ঃ ছার, আমি ধুনু।
মেজোবাবুঃ ওদের মা মেয়েকে মারতে গেছলি কেন?
১ম। বদির ব্যাটাটকে উয়ারা খেইছে।
২য়। আমার লাতিটকে বাণ মেরছে।
১ম। ঘরে ঘরে জ্বরজ্বালা।
২য়। পেটখারাপ।
বড়োবাবু (হুংকার ছেড়ে)। হতভাগা, ঘরে শৌচাগার বানিয়েছিস?
১ম। না ছার।
মেজোবাবু। বাঃ, বাঃ, শৌচাগার বানাবি না, রাতেভিতে বাইরে বেরোবি, আর সাপে কামড়ালে তার বেলা ডান?
বড়োবাবু। মারব এক থাবড়া।
২য়। ছার, আমরা কী করব? আমাদের পটাং ওঝা বললি যে।
১ম। হ্যাঁ হ্যাঁ, ওঝার উপরে ত আর কথা হতি পারে না।
২য়। জাদুলাঠি ঘুরিয়ে সব দেখিন দিছে। সব বলিন দিছে।
মেজোবাবু। ওঝার সন্ধান কে দিল?
১ম। বুধন আর টুনো।
২য়। হ্যাঁ হ্যাঁ, ঊরাই ত লিয়ে যেছে পটাং ওঝার কাছে।
বড়োবাবু। বুধন আর টুনো কে?
মেজোবাবু। ওরাই তাহলে নাটের গুরু।
১ম। ঊরা গাঁয়ের মাথা।
বড়োবাবু। হুমমম। ওদের তাহলে ধরতে হবে।
মেজোবাবু। বল, ওরা কোথায় আছে?
(এইসময় মঙ্গলা আর ফুলকির প্রবেশ)
স্যার, এই যে সেই মা আর মেয়ে। এদেরকেই ডাইনি অপবাদ দিয়ে মারধোর করেছে।
বড়োবাবু। দ্যাখো তো, এদের চিনতে পারো কিনা।
মঙ্গলা। হঁ ছার, ইরাই। ইরাই মেরছে।
ফুলকি। বুধনকাকা আর টুনোকাকাও ছিল।
মঙ্গলা। ওরা ছার, জেবনটা ছারখার করে দিল।
মেজোবাবু। কী হয়েছে, বলো তো দেখি।
মঙ্গলা। ছার, বুধন আর টুনো একদিন আমার ঘরে এসে নানারকম খারাপ খারাপ কথা বললে। আমি ঝাঁটা নিয়ে ওদের তেইড়ে দিছি। সেই রাগে আমাদের ডান বলে ঝাল মিটোচ্ছে।
ফুলকি। স্যার, আমরা আমাদের ঘরে নিজেরা নিজেদের মত থাকি।
মঙ্গলা। আমি বহু কষ্টে খেটেখুটে সংসার চালাই। মেয়েটাকে পড়াচ্ছি। তাতে যদি আমাদের সংসারের দুঃখুট ঘুচে।
বড়োবাবু। বুঝলাম। মেজোবাবু, এক্ষুণি ওদের দুজনকে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে।
মেজোবাবু। ইয়েস স্যার। আর সেই পটাং ওঝাটাকেও।
বড়োবাবু। ঠিক, ঠিক। ওটাকেও বাদ দেওয়া চলবে না।
মেজোবাবু। হ্যাঁ, স্যার।
বড়োবাবু। মেজোবাবু, এদের আজ নিয়ে লক আপে ডুকিয়ে দেন। কাল কোর্টে চালান হবে।
মেজোবাবু। তাই করছি, স্যার।
১ম। স্যার, এবারটির মত ছেড়ে দিন স্যার।
২য়। আর কখুনো এরম করবু নি।
১ম। বুধন আর টুনো মিলেই মোদের মাথাট খেইছে।
২য়। আর সাথে পটাং ওঝা।
১ম। ছার, উদের কী হবে?
২য়। ছার, উদেরও ছেড়বেন নি।
মঙ্গলা। ছার, সবকটাকেই জেলে পুরেন। আমার মেয়েটর আসছে হপ্তা থেকে পরীক্ষা রয়েছে। মেয়েট আমার পড়তেই পেল নি।
বড়োবাবু। চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
মেজবাবু। ফাইনালের তো এখনো মাস তিনেক বাকি। ভালো করে পড়ো।
বড়োবাবু। হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভালো করে পড়ো। এই সময়টা কাজে লাগাও।
মেজোবাবু। আমরা এদিকটা সামলে নিচ্ছি।
বড়োবাবু। আপনি তাহলে এদের নিয়ে যান।
মেজোবাবু। এই চল, চল সব।
(মেজবাবু সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে যান।)
বড়বাবু। (মঙ্গলা ও ফুলকির দিকে ঘুরে) তোমরাও এস তাহলে। বুধন আর টুনো ধরা পড়লে আর একবার আসতে হবে চেনানোর জন্য। বাইরে গাড়ি আছে। তোমাদের গাঁয়ে পোঁছে দেবে।।
মঙ্গলা ও ফুলকি। আসি বড়োবাবু। (ওরা বেরিয়ে যায়।)
নবম দৃশ্য
( পটাং ওঝা, বড়োবাবু, মেজবাবু, বুধন, টুনো, ফুলমণি, ভাটাই)
(পটাং ওঝার দরবার। আসন খালি, কেউ নেই। বড়বাবু ও মেজবাবুর প্রবেশ।)
বড়বাবু। এটাই তো সেই পটাং ওঝার আসর।
মেজবাবু। স্যার, কেউ তো নেই দেখছি।
বড়বাবু। এখুনি কেউ এসে পড়তে পারে।
মেজবাবু। লুকিয়ে পড়াই ভাল, স্যার।
বড়বাবু। বুধন আর টুনোও আসতে পারে খবর আছে।
মেজবাবু। তাহলে তো আরো ভালো।
বড়বাবু। চলুন, ওই ধারেতে লুকোই।
মেজবাবু। তাই চলুন, স্যার।
(দুজনে মিলে এক কোণায় পর্দার আড়ালে লুকিয়ে যান। একটু পরে পটাং ওঝার প্রবেশ।)
পটাং ওঝা। এভাবে কি চলে নাকি? সেই কমলপুরের ডানের ব্যাপারটতে যা দুপয়সা হয়েছিল। তারপর থেকে আর ভাল কিছু আসছেই না। এখনো ত কেউ আসেনি। যাহোক, বসে থাকি। দেখা যাক।
(ওঝা তার আসনে বসে পড়ে চোখ বুজে। একটু পরেই বুধন আর টুনোর প্রবেশ। কাছাকাছি গিয়ে)
বুধন। বাবা!
টুনো। বাবা!
পটাং ওঝা (চোখ মেলে) কী ব্যাপার? ও তোরা? হ্যাঁ, তোদের নামগুল কী যেন বেশ?
বুধন। বাবা, আমি বুধন। আর এ টুনো।
পটাং ওঝা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বল, কী ব্যাপার?
টুনো। সেবারে সেই যে আপনি ডানকে পেটানোর হুকুম দিলেন, আমরা আপনার কথামতোই কাজ করেছি।
জানগুরু। বাঃ, বাঃ! বেশ, বেশ।
বুধন। কিন্তু তারপর থেকেই পুলিশ আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।
জানগুরু। (চমকে গিয়ে) অ্যাঁ, সে কী?
বুধন। হ্যাঁ বাবা, সেজন্যই আপনার কাছে আসা।
জানগুরু। আমি… আমি কী করব?
টুনো। বাবা, কটা দিন যদি একটু লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন।
বুধন। এখানে তো আর পুলিশ আসবে না।
জানগুরু। (ঈষৎ চিন্তা করে)… হুমমম…হুঁ… আচ্ছা, বেশ। তোরা যখন বলছিস এত করে। কিন্তু থাকার তো কিছু খরচখরচা আছে…
টুনো। সে আপনি ভাববেন না বাবা।
বুধন। আমরা প্রণামী নিয়েই এসেছি। (বুধন হাত বাড়িয়ে একটা খাম দেয়। জানগুরু নেয়। এইসময় বড়বাবুদের ওখান থেকে একটা খচমচ আওয়াজ হয়।)
টুনো। ক্কী? কীসের আওয়াজ ওখানে?
জানগুরু। ও কিছু না। ইঁদুর টিঁদুর হবে বোধহয়। এক কাজ কর। তোরা বরং ওইদিকের কোণটাতে লুকিয়ে পড়। আমার কাছে বাইরের লোকজন আসতে পারে এখন। তোদের না দেখাই ভাল।(অন্যদিকের কোণ নির্দেশ করে)
বুধন ও টুনো। হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই ভালো। (ওরা চটপট লুকিয়ে পড়ে)
(৩য় দৃশ্যের পুরুষের প্রবেশ। তাকে আড়চোখে দেখে হাতের লাঠি ঘুরিয়ে)
পটাং ওঝা। মাজাগিসা গাজাগিসা গা/জাদুলাঠির খেল দেখে যা! যা মুশকিল আছে এই দুনিয়ায়, জাদুলাঠির ঘায়ে সব মুশকিল আসান!
পুরুষ। (কিছুটা তেরিয়া ভঙ্গিতে) হেই জানগুরু।
জানগুরু। কী হয়েছে, বল।
পুরুষ। তোর কথা শুনে আমার ব্যাটাট মরতে বসেছিল। শেষে হাসপাতালে লিয়ে গিয়ে কোনমতে বাঁচায়ছি। টু আমার চাল, ডাল, নারকোলের দামট ফেরত দে।
জানগুরু। কী-ই-ই-ই? এতবড়ো কথা? আমার এই লাঠিটা জানিস ঝড়-বৃষ্টি এনে দিতে পারে!
পুরুষ। ঝড়বাদলে আমার কাজ নাই গা। আমার ট্যাকা ফেরত কর।
(৩য় দৃশ্যের মহিলার প্রবেশ)
মহিলা। হেই জানগুরু। তু ধুতরার বীজ খাইয়ে আমার মরদটকে মারতে চেয়ছিলি? আমার মরদট গোঁয়ার বটে। কিন্তু তাকে ত আমি মারতে চাই নাই।
জানগুরু। উট ধুতুরার বীজ লয়। উট শোধন করার বীজ।
মহিলা। তাই বটে? তবে তুই লিজেই খেয়ে দ্যাখ। (জোর করে খাওয়াতে যায়।)
পুরুষ। হঁ হঁ, তুই লিজেই খা। (সেও যোগ দেয়।)
মহিলা। লিজেই শোধন হ।
পুরুষ। হঁ, হঁ, তরই শোধনট এগে দরকার।
পটাং ওঝা। এই ছাড়, ছাড়। কী হচ্ছে? হচ্ছে কী?
(জোর ঝামেলা লেগে যায়। বড়োবাবু, মেজবাবু পিস্তল উঁচিয়ে বেরিয়ে আসেন।)
বড়বাবু। পটাং ওঝা, এবারে তোমার খেল খতম। হ্যাণ্ডস আপ।
পটাং ওঝা। এ কী? কী ব্যাপার?
মেজবাবু। আমরা থানা থেকে আসছি। ইনি বড়োবাবু, আমি মেজবাবু।
পটাং ওঝা। লে, লে, তদের মত বড়বাবু, মেজবাবু ঢের ঢের দেখা আছে। তরা জানিস, আমি তদের দুটাকেই বাণ মারে শেষ করে দিতে পারি!
বড়বাবু। (ব্যঙ্গ করে)বাণ মারে শেষ করে দিতে পারি! এতদূর?
মেজবাবু। লক আপে ঢুকে বাণ মারবি। নে, ওঠ!
পটাং ওঝা। কেন, আমি কী কার কী খেতি করেছি?
বড়বাবু। জানিস না? জানিস না? না? (এক রদ্দা)
মেজবাবু। কমলপুরের কেসটায় তোর ইন্ধন আছে। যারা ধরা পড়েছে, তারা তোর নাম করেছে।
মহিলা। হেই বড়বাবু, আমার মরদটকে ধুতরার বীজ দিইছিল।
বড়বাবু। অ্যাটেম্পট টু মার্ডার!
পুরুষ। আমার ব্যাটটকেও মারতে যেছিল।
মেজবাবু। অ্যানাদার অ্যাটেম্পেট তো মার্ডার!
বড়বাবু। এই কেস দুটোকেও জুড়ে দিতে হবে।
মেজবাবু। হ্যাঁ, সার।
পটাং ওঝা। মাইরি বলছি, আমি কিছু জানি না।
মেজবাবু। কিছু জানি না?
বড়বাবু। তবে রে?
মহিলা। আমার ছাগলটাকে যে শোধন করতে লিয়েছিলি, সেটারই বা কী হল?
পুরুষ। উয়ার পেটকেই শোধন হই যেছে।
মহিলা। আমার ছাগল… (রোদন)
বড়বাবু। চল, চল বলছি। ওঠ। হাত তোল।
(পটাং ওঝা হাত তোলে। লাঠিটা হাত থেকে পড়ে যায়। মহিলাটি কুড়িয়ে নেয়।)
বড়োবাবু। আমি এদিকটা সামলাচ্ছি। আপনি ওদিকটা দেখুন।
(বুধন ও টুনোর কাছে গিয়ে) মেজবাবু। বুধন, টুনো, বেরিয়ে আয়।
(বুধন, টুনো মাথার উপরে হাত তুলে সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসে।)
মেজবাবু। এখানে দাঁড়া। (বুধন, টুনো দাঁড়ায়। এই ফাঁকে পটাং ওঝা পালাতে যায়।)
বড়বাবু। ধর! ধর!
(মহিলাটি লাঠি বাগিয়ে এক ঘা দেয় পটাং ওঝাকে।) তবে রে!
(পটাং ওঝা মাটিতে পড়ে যায়।)
পটাং ওঝা। ওরে বাবারে! গেলাম রে!
পুরুষ। ফটাস ফটাস ফট! লাঠির ঘায়ে ফট!
বড়োবাবু। ওঠ। ওঠ বলছি। (বলে হুইসল দেন)
(জানগুরু খোঁড়াতে খোঁড়াতে ওঠে।)
মেজবাবু। চল, লাইন করে চল সবাই। বাইরে ভ্যান আছে। আরামে যাবি।
(বুধন, টুনো সামনে, পেছনে পটাং ওঝা লাইন করে এগোয়।)
মহিলা। (ব্যঙ্গ করে) ও বাবা, আপনার জাদুলাঠিটা রয়ে গেল যে!
পুরুষ। ঝড়বাদলের তাহলে কী হবে?
মহিলা। (লাঠিটা পটাং ওঝার কাছে নিয়ে গিয়ে) দুম ফটফট! দুম ফটফট! ফটাস! ফটাস! পটাং ওঝা ফটাস!
দশম দৃশ্য
(মঙ্গলাদের বাড়ির উঠোন। মঙ্গলা ঝাঁট দিচ্ছে। )
মঙ্গলা (নিজের মনে)। ফুলকিটা কী করছে কে জানে? আজ যে বলল, পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে…। মেয়াটা যেন ভালভাবে পাশ করে! আমার যা হয়ার হবে… আর কী? দেখি, ফুলকিকে ডাকি। ফুলকি, ও ফুলকি…
(ফুলকি এসে দাঁড়ায়। সে স্কুলে যাবার জন্য তৈরি।)
ফুলকি। মা ডাকছিলে?
মঙ্গলা। হঁ, তুই বেরাবি?
ফুলকি। হ্যাঁ, মা।
মঙ্গলা। খাবি কিছু?
ফুলকি। না মা। রেজাল্টটা নিয়ে আসি। আসছি মা।
(ফুলকি এগোয়। আর সেসময়ই সুদীপা দিদিমণি ঢোকেন।)
সুদীপা। ফুলকি, বেরোচ্ছিলি নাকি?
ফুলকি। হ্যাঁ, দিদিমণি।
সুদীপা। আর যেতে হবে না। খুব ভালো খবর আছে। তুই স্কুলে ফার্স্ট হয়েছিস। বিরানব্বই পারসেন্ট নাম্বার পেয়েছিস।
ফুলকি। সত্যি? তাই?
মঙ্গলা। কী আনন্দ গো!
(মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে)
সুদীপা। শুধু তাই নয়, ডাক্তারি, ইঞ্জিনীয়ারিং- দুটোতেই পেয়েছিস। ওটার রেজাল্ট কাল বেরিয়েছে। আমি আর জানাইনি। ভাবলাম আজ একবারে নিজের মুখে সব জানাব।
(ফুলকি শুধু হাসতে থাকে। আশা এবার এসে ফুলকির মাথায় হাত রাখে)
সুদীপা। ফুলকি। তুই অনেক খেটেছিস। এ তারই ফল।
মঙ্গলা। সবই আপনার আশীর্বাদ, দিদিমণি। আপনি না থাকলে কোনকিছুই হত না।
(বড়বাবু ও মেজবাবুর প্রবেশ।)
বড়বাবু। ফুলকি, তুই তো শুনলাম কাঁপিয়ে দিয়েছিস।
(ফুলকি হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়ে।)
মেজবাবু। হ্যাঁ, তা হবে না? কত কষ্ট করে পড়েছে।
সুদীপা। আপনারা কী করে জানলেন?
মেজবাবু। থানার সবাই বলছে।
বড়বাবু। আমরা ভাবলাম, একবার দেখা করেই যাই।
মঙ্গলা। ওদিকের খবর কী?
বড়োবাবু। সব কটা এখন জেলের ঘানি টানছে। হে হে হে হে হে হে!
মেজবাবু। যেমন কর্ম, তেমন ফল। এখন পচুক জেলে।
বড়বাবু। যা জব্বর জব্বর কেস দিয়েছি না!
মেজবাবু। কাল জামিন চাইতে গেছল। আদালত দেয়নি।
ফুলকি। (হাততালি দিয়ে) দারুণ হয়েছে।
সুদীপা। বড়বাবু, ফুলকি ডাক্তারি, ইঞ্জিনীয়ারিং-দুটোই পেয়েছে।
বড়বাবু। এ তো দুর্দান্ত ব্যাপার!
সুদীপা। ফুলকি, তোর কিন্তু এখানে থামলে চলবে না।
মেজবাবু। ঠিক, ঠিক। তা কী পড়বে স্থির করলে?
মঙ্গলা। এই তো সবে জানলাম। ওর দিদিমণি, ও মিলে যা ঠিক করবে, তাই হবে।
বড়বাবু। সেই ভাল।
সুদীপা। ফুলকি, এখনো তোকে আরো অনেক দূর যেতে হবে। আরো অনেক পড়তে হবে।
পড়াশুনো হল সেই আগুনের পরশমণি, যার স্পর্শে আমরা পবিত্র হই।
বড়বাবু। যত নোংরা কুসংস্কার দূর হয়ে যাক।
মেজবাবু। মনের যত আঁধার দূর হয়ে যাক।
মঙ্গলা। দূর হোক মলিনতা।
ফুলকি। এ জীবন পুণ্য হোক প্রাণের পরশে।
গানঃ আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবন পুণ্য কর……