অদ্ভুত একটা নেশায় পেয়ে বসেছে আমাকে। রাত বারোটা বাজলেই নিশির ডাকের মত একটা অমোঘ আকর্ষণে উঠে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়ি। একটু পরেই শুরু হয়ে যায় দাবাখেলা। সাদা ঘুঁটি নিয়ে প্রথম দানটা আমিই দিই রোজ। প্রতিপক্ষ একটু পরেই আরম্ভ করে তার চাল। আর কিসব সাংঘাতিক সাংঘাতিক চাল! দাবাটা আমি নেহাত খারাপ খেলি না বলেই জানতাম এতদিন। কিন্তু এই রাত বারোটার খেলায় রোজই আমি মাত হই। একটা দিনও জিততে পারিনি এখনো অব্দি। আমারো রোখ চেপে গেছে, এ খেলাটায় আমাকে জিততে হবেই।
আজ সারাদিন অফিসে প্রচুর ধকল গিয়েছে। সন্ধেবেলায় ঘরে ফিরে সামান্য খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। কত্তক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না, নিচের বড় রাস্তা দিয়ে তীব্র শব্দে হর্ন বাজিয়ে একটা বাস চলে যেতেই ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। সাইড টেবিলে রাখা মোবাইলটায় সময় দেখলাম। কাঁটায় কাঁটায় রাত বারোটা। সময় হয়ে গেছে। ঘাড়ে এসে পড়া চুলগুলোকে একটা ক্লিপ দিয়ে আটকে ঠেলে উপরে পাঠালাম। এই আঠারোশো স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটটায় আমি এখন একা। নাকি একা নই?
বসার ঘরে খেলার ব্যবস্থা। চুপচাপ গিয়ে বসে পড়লাম। আজ আমি সতর্ক। ঘোড়া বের করলাম প্রথমে। অপরদিকে কাউকে সাদা চোখে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ঠিক আমার ঘোড়াটার মুখোমুখি একটা কালো বোড়ে এগিয়ে এল। আমি আর একটা ঘোড়া বের করলাম। একটা ঘোড়া ঠিক বেরিয়ে আমার ঘোড়াটার মুখোমুখি বসল।
যাই করুক, আজ আর আমি হারছি না। বোড়েগুলোকে দিয়ে জমাটি রক্ষণ বানালাম। ওপ্রান্ত থেকেও একের পর এক ঘুঁটি এসে রক্ষণ সাজিয়ে যাচ্ছে।
উল্টোদিকে তাকালাম। কোনো জনপ্রাণী নেই। অথচ নিখুঁত দান একের পর এক এসেই যাচ্ছে আমার সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে।
বিপদে পড়লাম বাঁদিকের ঘোড়াটাকে নিয়ে। সামান্য আক্রমণাত্মক হতে গিয়েছিলাম। কালো মন্ত্রী আর কালো হাতিটা আমার ঘোড়াকে বিপর্যস্ত করে তুলল। ঘোড়াকে বাঁচাবার কোন রাস্তাই নেই। ভাবলাম, মরতে হলে মেরেই মরব। আড়াই ঘরের চালে ওদের ঘোড়াটাকে কাটলাম। সঙ্গে সংগেই ওদের মন্ত্রী এসে আমার ঘোড়াকে কাটল। ঠিক আছে, কুছ পরোয়া নেই। হাতিটাকে পিছিয়ে নিয়ে আক্রমণে যাবো।
কালো ঘুঁটিগুলো অসম্ভব ভালো চালছে। আমি ওর আরেকটা ঘোড়া কাটলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আমার একটা হাতি কাটা গেল। রাগে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। আমার চেঁচানির কোন প্রত্যুত্তরও ভেসে এল না। খালি ওর মন্ত্রীটা এগিয়ে এল আমার নৌকোর কোণাকুণি। পরের দানে কাটার পরিষ্কার ধান্দা। নৌকোটাকে পেছনদিকে একঘরই সরানো সম্ভব। সরালাম। অমনি আড়াই ঘরে একটা কালো ঘোড়া এসে আমার নৌকো কেটে দিল।
আমি মন্ত্রী দিয়ে ওর কালো ঘোড়াটা কাটলাম। কিন্তু পরের দানেই ওর মন্ত্রী এসে আমার রাজাকে কিস্তি দিল।
রাজার কাছাকাছি এখন আমার একটাই নৌকো। সেই টলমল নৌকো নিয়েই কোনরকমে রাজাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। একটু পরে ফাঁক পেয়ে ওর রাজাকেও কিস্তি দিলাম।
এই চলতে থাকল খানিকক্ষণ। তারপর কিস্তি দিতে দিতে আমার মন্ত্রী এমন এক জায়গায় আটকে গেল যে এবার কিস্তি দিতে গেলে রাজার হাতেই বধ হয়ে যাবে। মরীয়া হয়ে মন্ত্রীকে অন্যপাশে দুঘর সরালাম। ওর নৌকো সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এল আমার রাজার সমান্তরালে। কিস্তি।
মরীয়া হয়ে নৌকোটাকেই রাখলাম রাজার কাছে। অন্যদিক থেকে ছুটে এল মিশকালো মন্ত্রীটা। আমার রাজা কিস্তিমাত।
ধুততেরিকা! নিকুচি করেছে!
ল্যাপটপটা শাট ডাউন করে উঠে দাঁড়ালাম আমি।