(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে পাঠশালার খবর ভেসে আসে মাঝেমধ্যে। এলেই তোমাদের জানাতে থাকবো। পাঠশালাটা কোথায় জানো? বনের ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে প্রচুর গাছপালা মিলে মাথার উপরে একটা চাঁদোয়ার মত বানিয়েছে, আর দুটো সেগুনগাছের ইয়া মোটা মোটা গুঁড়ি দুদিক থেকে এসে একটা দরজার মতো তৈরি হয়েছে। জঙ্গলের যত ছানাপোনা জন্তুজানোয়ার, সবাই আজকাল সক্কালবেলা হলেই হাতমুখ ধুয়ে চাট্টি মুড়ি খেয়ে ওখানেই পড়তে যায়। তাদের মধ্যে আছে বাঘিনীর বাচ্চা ছেলে বাঘু, হাতির বাচ্চা মেয়ে হাতুশি আর হনুমানের ছানা মেয়ে হিনিমিনি। এছাড়াও আছে ভালুকের পুঁচকি মেয়ে ভালকি আর কুমীরের বাচ্চা ছেলে কুমরু।)
ছুটির পর পাঠশালা খুলেছে সবে। কোথায় এতদিন পরে পাঠশালা খোলায় ছানাপোনাগুলো একটু মন দিয়ে পড়াশুনো করবে, তা না! সবারই কেমন যেন একটা উদাস উদাস ভাব। ভেবেচিন্তে তাই একটা উপায় ঠাউরেছে শিয়ালনী। সকালবেলা ক্লাসে এসেই ঘোষণা করে দিয়েছে- “শোন্, আজ তো বৃহস্পতিবার। সামনের সোমবার তোদের সব্বার আমি ‘সবুজ পাঠে’র পরীক্ষা নেব। তারপর একে একে সব পরীক্ষাই হবে- বাংলা, বন পরিচয়, নামতা। প্রত্যেকটা পরীক্ষা পঁচিশ নম্বরের। আজ থেকে ভালো করে পড়। যারা যারা পরীক্ষায় পঁচিশ বা চব্বিশ পাবে, তাদের আমি প্রাইজ দেব।”
শুনেই তো যে যার থাবা বুলোচ্ছে গালে। বাঘু আবার নিজের গালে থাবা বুলোতে গিয়ে ভুল করে ভালকির গালেই থাবা বুলিয়ে ফেলেছে। হাঁউমাঁউ করে উঠেছে ভালকি, “অ্যাই বাঘু, আমার গালে থাবার বাড়ি দিচ্ছিস কেন?”
শুনেই বাঘু একহাত জিভ কেটেছে, “এই রে! ওটা তোর থাবা বুঝি? ইসসসস! তাই বলি, আমার গালটা গেল কোথায়?”
“গালটা গেল কোথায়?”, গজগজ করছে ভালকি, “তোর গাল তো তোর নিজের গালে। মানে তোর মুণ্ডুর নিচে খোঁজ ভালো করে, পেয়ে যাবি।”
ব্যস! শুরু হয়ে গেল ভালকি আর বাঘুতে জোর তর্কাতর্কি! তাই দেখে শিয়ালনী পেল্লায় এক গর্জন ছাড়ল, “অ্যাইয়ো! নো চালাকি! নো কায়দাবাজি!”
শুনেটুনে তো বসল সবাই জড়োসড়ো হয়ে। শিয়ালনীও একগাদা পড়া করতে দিল সব পোড়োদের।
তা বাঘু বাদে সবাই দুটো দিন খুব মন দিয়েই পড়াশুনো করল। সোমবার পরীক্ষা হয়েও গেল। বুধবারে খাতা বেরোতে দেখা গেল- হাতুশি আর কুমরু পেয়েছে পঁচিশে পঁচিশ, ভালকি আর হিনিমিনি পেয়েছে চব্বিশ করে, আর বাঘু পেয়েছে পঁচিশে দশ! বাঘুকে খাতাটা দিতে দিয়ে শিয়ালনী দাঁতমুখ খিঁচিয়ে উঠল, “ছি ছি বাঘু! তুই পঁচিশে মাত্র দশ পেলি! লজ্জা করে না তোর?”
বাঘু খাতার নম্বরটা দেখতে দেখতে ভারি নিরীহমুখে উত্তর দিল, “হ্যাঁ দিদিমণি। একটু একটু লজ্জামতন করছে!”
শিয়ালনী হঠাৎ কীরকম যেন রেগে গেল, “লজ্জামতন করছে! আবার মুখে মুখে কথা!”
বাঘু নিতান্ত শুকনো মুখে থাবা দিয়ে মাটি আঁচড়াতে আঁচড়াতে জবাব দিল, “তা দিদিমণি, থাবা দিয়ে কথা বলতে পারি না যে! আপনি থাবায় থাবায় কথা বলাটা শিখিয়ে দেবেন, দিদিমণি?”
ভয়ানক রাগে শিয়ালনীর চোখ লাল টকটক করছে, পেট ভুটভুট করছে, লেজের চুল খাড়া হয়ে গেছে। একখানা বাজখাঁই চিৎকার ছাড়ল শিয়ালনী, “বাঘু! বাঘুউউউউউ! খুব বাড় বেড়েছে, না?”
বাঘুর চোখমুখ গোলগোল, “কোথায় আর বাড়লাম, দিদিমণি? মা তো বলে, মোটেই বাড়ছি না। তবে বাঘিপিসী আগেরবারে বলছিল যে আমার লেজটা নাকি বেশ লম্বা হয়েছে! আপনি এট্টু মেপে দেখবেন, দিদিমণি?”
“এট্টু মেপে দেখবেন?”, প্রায় ভেংচেই উঠল শিয়ালনী, “ই হি হি হি হি! আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই না কী!”
বাঘু বেজায় মোলায়েম সুরে বলল, “আপনার কেন কাজ থাকবে না দিদিমণি? আপনার কত কাজ! আমাদের পড়ানো, লেখানো, পরীক্ষা নেওয়া, আমাকে বকা- আপনার কি কাজের অভাব, দিদিমণি?”
হাতুশি দেখল, মহা মুশকিল। বাঘুর বদমাইশিতে আজের পড়াটাই না মাটি হয়ে যায়! তাই ভারি নরম সুরে জিজ্ঞেস করল, “দিদিমণি, এর পরের দিন কি বাংলা পরীক্ষা?”
থমথমে গলায় উত্তর দিল শিয়ালনী, “পরের দিন? হ্যাঁ, পরের দিন বাংলা পরীক্ষা। বাঘু, তোকে আমি বলে দিচ্ছি, পরের দিন যদি ঠিকঠাক পরীক্ষা না দিয়েছিস, তোকে আমি কী করব দেখবি!”
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল বাঘু, “কী করবেন, দিদিমণি?”
খানিকক্ষণ ধরে বেজায় ভেবেচিন্তে লেজটেজ চুলকে হতাশ গলায় জবাব দিল শিয়ালনী, “কী করব আমি নিজেই জানি না!”
শুনেই তো ফিকফিক করে হেসে ফেলেছে হিনিমিনি আর কুমরু। তাই দেখে বিকট এক ডাক ছাড়ল শিয়ালনী, “অ্যাইয়ো! নো চালাকি, নো কায়দাবাজি!”
হাতুশি আর ভালকি ততক্ষণে বাড়ির কাজের খাতা বাড়িয়েছে শিয়ালনীর দিকে। ফলে শিয়ালনীও আর কথা না বাড়িয়ে খাতা দেখতে শুরু করে দিল।
টিফিনের সময় বাঘু পাকড়াও করল কুমরুকে। কুমরু তখন সবে মন দিয়ে চুনোমাছের চচ্চড়ি দিয়ে ভাত খাওয়া শুরু করেছে। বাঘু এসেই হম্বিতম্বি শুরু করল, “অ্যাই, তুই পঁচিশে পঁচিশ পেলি কোন্ আক্কেলে রে?”
কুমরুরও রাগ হল । বলল, “পেয়েছি, বেশ করেছি। আরো পাব। হাতুশিও তো পঁচিশ পেয়েছে।”
বাঘু একটা থাবা ছুঁড়ল সামনে, “আরে, হাতুশি তো মনিটর। ও পেতেই পারে। তাই বলে তুই পাবি?”
কুমরু খাওয়া থামিয়ে জবাব দিল, “হ্যাঁ, পেতেই পারি। ভালো করে পড়াশুনা করেছি। পাবো না?”
বাঘু লেজখানাকে পাঁইপাঁই করে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “না, পাবি না। আমি তো মোটে দশ পেয়েছি। আমায় দেখে শিখতে পারিস না?”
শুনেই তো কুমরু পেট চেপে হো হো করে হাসতে শুরু করে দিল, “হো হো হো হো… কী বললি বাঘু? তোকে দেখে শিখব? তোকে দেখে দশ পাওয়া শিখব? ও হো হো হো হো… ওরে হাতুশি, হিনিমিনি, ভালকি… বাঘু কী বলছে শুনে যা…”
বেগতিক দেখে বাঘু তো পিঠটান দিল। কিন্তু ছুটির আগের ক্লাসে কুমরু যখন একবার বাইরে গেল, তখন বাঘু কিসব যেন হিজিবিজি কাটল কুমরুর ‘সবুজ পাঠে’র খাতায়। তারপর খাতাটা যেখানে ছিল, সেখানেই ঠিকঠিক করে রেখে দিল। ফিরে এসে কুমরু কিছুই বুঝতে পারল না। পাঠশালা ছুটি হলে বাড়ি চলে গেল অন্যদিন যেমন যায়।
পরের দিন সবার আগে পাঠশালায় ঢুকল কুমরু। ঢুকেই মনের সুখে গান ধরল-
এক যে ছিল বাঘু-
খেত সে দুধ- সাবু,
ঘুমোত সে নিয়ে তাঁবু
ঝোল খেত এক ডাবু।
মনের সুখে গাইছে কুমরু, এমন সময় বাঘু ঢুকছে পাঠশালায়। গানের প্রথম লাইনটা ভালোমতন শুনতে পায়নি বাঘু, তাই আবার কুমরুকে হাঁক দিল-, “কুমরু রে, গানটা ভালোই গাইছিলি। আর একবার গা তো।”
কুমরুও সুর তুলল-
এক যে ছিল বাঘু-
খেত সে দুধ- সাবু,
ঘুমোত সে নিয়ে তাঁবু
ঝোল খেত এক ডাবু।
গান শুনেই বাঘু তো চটমটে একশা। আর সেই সময়ে শিয়ালনী ঢুকছে পাঠশালায়। বাঘু গিয়ে তার কাছেই অভিযোগ জানাল, “দেখুন দিদিমণি, কুমরু আমার নামে কীসব ভুলভাল গান গাইছে?”
শিয়ালনী গানটা পাঠশালায় ঢুকতে ঢুকতে পুরোটাই শুনেছে। তাই এক হাঁক ছাড়ল, “কুমরু, বাঘুর নামে এরমকম আজেবাজে গান গাইছিস কেন?”
কুমরুর মুখ শুকনো, “দিদিমণি, গতকালের সবুজ পাঠের খাতাতে যেটাতে আপনি আমাকে পঁচিশে পঁচিশ দিয়েছেন, তার তলায় বাঘু আমার নামে যা মন যায় উল্টোপাল্টা লিখেছে।”
“তাই?”, শিয়ালনী চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে তাকাল কুমরুর দিকে, “কী লিখেছে দেখি তো। খাতাটা নিয়ে আয়।”
কুমরু খাতাটা নিয়ে এল তাড়াতাড়ি করে। শিয়ালনী পড়তে শুরু করল-
কুমরু রে কুমরু,
তুই একটি গরু।
থাকিস তুই জলে,
দেব লেজ মুলে।
কুমরু কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “দেখুন না দিদিমণি, কীরকম বিচ্ছিরি করে লিখেছে! কাল বাড়ি গিয়ে আমি মাকে নম্বর দেখাবার জন্য খাতাটা খুলেছি আর এই ছড়াটা…”, বলতে না বলতেই কুমরুর চোখে জল এসে গেল, কুমরু ফোঁপাতে শুরু করল। তাই দেখে ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে উঠে বলল শিয়ালনী, “বাঘু, বাঘুউউউ! এসব কি হচ্ছে? কুমরুর খাতায় এরকম উষ্টুম ধুষ্টুম লিখেছিস কেন?”
বাঘু গোঁজ হয়ে বলল, “দিদিমণি, আপনি খালি আমার দোষটাই দেখতে পান। আর এই যে কুমরু… এই যে হতচ্ছাড়া কুমরু কালকে আমি পঁচিশে দশ পাওয়ায় হেসেছিল, তার বেলা? ও যখন পঁচিশে পঁচিশ পেয়েছিল, তার বেলা আমি হেসেছি?”
কুমরু লেজখানা মাটিতে বার দুয়েক আছড়ে বলল, “না, তুই হাসিসনি। কিন্তু কাল টিফিনের সময় এসে আমার ওপর চোটপাট করিসনি? বলিসনি যে, কোন্ আক্কেলে পঁচিশ পেয়েছি? বলিসনি, আমার মত দশ পেতে পারতিস না?”
শিয়ালনী দেখে, এদের ঝগড়াঝাঁটি ক্রমেই বাড়ছে। তাই এক হুংকার দিল, “বাঘু! আমি যা বোঝার বুঝেছি। তুইই যত নষ্টের গোড়া! চল সবাই, এবার প্রার্থনা শুরু হবে। নো চালাকি! নো কায়দাবাজি!”
সুড়সুড় করে প্রার্থনার লাইনে গিয়ে দাঁড়াল সবাই। প্রার্থনা হয়ে গেলে ক্লাসও শুরু হয়ে গেল। আর বিশেষ কিছু গোলমাল হল না।
পরের কয়েকটা দিন মোটামুটি ভালোয় ভালোয় কাটল। শিয়ালনীর কড়া নজরে বাঘুও আর তেমন একটা ট্যাঁ- ফোঁ করার সুযোগ পায়নি। বাংলা পরীক্ষার দিন শিয়ালনী চারখানা প্রশ্ন দিল। প্রথমে ছিল ‘নাক’, ‘জল’ আর ‘শীত’ দিয়ে বাক্যরচনা। তারপরে ছিল, ‘তোমার পাঠশালার খবর জানিয়ে পরিচিত কাউকে একটি চিঠি লেখ’।
সবাই তো লিখল, যে যেমন পারে। বাঘুও লিখল। লিখল শুধু নয়। বাঘু আবার লেখার জন্য বাড়তি পাতাও নিল। বাড়তি পাতা নিতে যাবার সময় বাঘু তো হেলেদুলে একে টোকা মেরে ওকে ঠেলা মেরে পাতা নিতে গেল। আবার ফিরতি পথে শিয়ালনীর কান বাঁচিয়ে শুনিয়েও দিল সবাইকে, “হুঁ হুঁ বাবা, আমি হলাম বাঘু বাদশা! লিখতে জানি বেজায় খাসা!”
তাই শুনে ভালকি বেজায় রেগে ফুট কাটল, “তা, খাবি যা না শসা!”
হিনিমিনি যোগ করল, “সঙ্গে পেয়ারা ডাসা!”
কুমরু ভুউউউস করে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ল, “দেখা যাক, বাঘুর নম্বরের কী হয় দশা!”
হাতুশি তার থাবা চুলকে বলল, “মনে হয়, মারবেই দশখানা মশা!”
শিয়ালনী কিসব কাজকর্ম করছিল খুব মন দিয়ে। এবারে বেজায় বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল, “এত কিসের কথা আর হাসা?”
বাঘু বলল, “দেখুন না দিদিমণি, আমি একটু বেশি বেশি লিখছি- তাইতে ওদের গোঁসা!”
রাগের চোটে চশমাটাকে মাথায় তুলল শিয়ালনী। তারপর এক হুংকার ছাড়ল, “অ্যাইয়ো! নো কথাবার্তা! যে যার লেখ মন দিয়ে। আর পনেরো মিনিট পরেই আমি খাতা নিয়ে নেব। নো চালাকি! নো কায়দাবাজি!”
ব্যস, সব্বাই চুপ। যাইহোক, পরীক্ষা পর্ব তো মিটল ভালোয়- ভালোয়।
পরের দিন। ওদের সবাইকে লিখতে দিয়ে বাংলা পরীক্ষার খাতাগুলো দেখছিল শিয়ালনী। হাতুশি ভালো মেয়ে, সে সব ঠিক করেছে। রচনাটাও ভালো লিখেছে। দেখতে দেখতে আপনমনে মাথা নাড়াচ্ছিল শিয়ালনী। ভালকিও ঠিক করেছে সব। হাতুশি, ভালকি দুজনেই পঁচিশে পঁচিশ। কুমরুর দুটো ভুল হয়েছে। রচনাতেও বানান ভুল হয়েছে অল্প। কুমরু পেল বাইশ। হিনিমিনির একটা মোটে ভুল হয়েছে বলে পেল চব্বিশ।
সবার শেষে বাঘুর খাতা। খাতা দেখতে দেখতে শিয়ালনী একবার খুচখুচ করে কাঁদে, একবার হুউউউস করে হাসে। একবার ‘ও হো হো হো’ বলে বিকট সুরে চেঁচায়, একবার ‘হায় হায় হায় হায়’ করে মিহিসুরে বিলাপ করে।
হাতুশি ব্যস্ত হয়ে শুঁড় দুলিয়ে প্রশ্ন করল, “কী হয়েছে, দিদিমণি? শরীর খারাপ লাগছে? আপনি এরকম করছেন কেন?”
শিয়ালনী পুঁ-পুঁ-পুঁ-পুঁ করে মুখে এক আওয়াজ তুলে বলল, “কী করি বল্? বাঘুর লেখা পড়ে হাসব না কাঁদব, নাচব না ছুটব, লাফাব না হামাগুড়ি দেব- তাই বুঝতে পারছি না।”
শুনেটুনে হিনিমিনির লেজ গেল মাথায় উঠে। কোনমতে বলল, “কেন, দিদিমণি, কী লিখেছে বাঘু?”
ভালকি অবাক হল, “দিদিমণি, বাঘু যে উত্তর লেখার জন্য বাড়তি পাতাও নিল!”
শিয়ালনী চশমাটা চোখে নিয়ে ভালো করে এঁটে নিয়ে উত্তর দিল, “সেখানেই তো দুঃখু রে! এর চেয়ে খালি খাতা জমা দিলেও ভাল ছিল রে!”
কুমরু বলল, “বলুন না, দিদিমণি। বাঘু কী লিখেছে?”
শিয়ালনী আরো বারদুয়েক ভেউ-ভেউ করে নিজের মনে কেঁদে নিল। তারপর চশমাটাকে নাকের ডগায় নামিয়ে পড়তে শুরু করল, “প্রথমে নাক দিয়ে বাক্যরচনা। বাঘু লিখেছে- নাক নড়ে, কাক ওড়ে। জল দিয়ে বাক্যরচনা করতে গিয়ে বাঘু লিখেছে,- আমি বাক্যরচনা লিখতে গিয়ে চোখের জলে, নাকের জলে হচ্ছি। ‘শীত’ নিয়ে বাক্যরচনা করতে গিয়ে বাঘু লিখেছে, শীতে লেপের তলায় শুয়ে মুড়ি খাওয়াকে বলে লেপমুড়ি দেওয়া।”
শুনেই তো হাসতে হাসতে হাতুশি গড়িয়ে পড়ল হিনিমিনির গায়ে, হিনিমিনি পড়ল ভালকির গায়ে, ভালকি ঠেলা দিল কুমরুকে, আর কুমরু সোজা গিয়ে পড়ল বাঘুর গায়ের উপর। অমনি বাঘু আর্তনাদ করে উঠল, “উফফ! উফফ! কী কাঁটা রে, তোর গায়ে কুমরু!”
কুমরু বাঘুর গায়ের থেকে উঠতে উঠতে বলল, “তা তুই অমন ভুলভাল লিখেছিস বলেই তো অত কাণ্ড!”
বাঘু চটেমটে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই লেজ নাড়িয়ে এক ধমক দিল শিয়ালনী, “অ্যাই, সব চুপ! এবারে আমি আমি বাঘুর লেখা চিঠি পড়ব। সব্বাই সাবধান! নইলে কিন্তু বিপদ ঘটতে পারে।”
একরকম ভয়ে ভয়েই বাঘুর লেখা চিঠি পড়তে শুরু করল শিয়ালনী। বাঘু চিঠি লিখেছে তার বাঘিপিসীর মেয়ে বাঘনিকে। বাঘু লিখেছে-
প্রিয় বাঘনি,
তুই যদিও আমার বিশেষ প্রিয় নোস, তবুও পাছে দিদিমণি নম্বর কাটে সেই ভয়েই তোকে প্রিয় বাঘনি বললাম। বুঝতেই পারছিস, দিদিমণি পরীক্ষার খাতায় চিঠি লিখতে দিয়েছে। আচ্ছা, তুই-ই বল্, এরকম মিছিমিছি চিঠি লেখার কোন মানে হয়? চিঠিটা কি দিদিমণি হাতে করে তোর কাছে নিয়ে যাবেন?
যাকগে, আমার দুঃখের কথা তোকে আর কী বলি বল্! বুঝতেই পারছিস, পাঠশালায় এখন পরীক্ষা চলছে। একটা পরীক্ষা হয়েও গেছে। নম্বরও বেরিয়েছে। আমার চেয়ে কম নম্বর আর কেউ পেতেই পারেনি! কী মজা বল্ দেখি। আমার লাস্ট হতে খুব ভালো লাগে কিনা। আমি ঠিক করেছি, সব পরীক্ষায় সবসময় লাস্টই হবো। তোরও উচিত, সবসময় লাস্ট হবার চেষ্টা করা। তবে কিনা, এসব ভালো ভালো কথা পাঁচকান না হওয়াই ভালো। বিশেষ করে, বাঘিপিসী যখন তোর মা। তুই একটা কাজ করতে পারিস। এখন তো এমনিতেই ঠাণ্ডা আছে। তুই শীতের সকালে বাঘিপিসীর মাথায় বালতি পাঁচেক ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেখতে পারিস বাঘিপিসীর মাথা ঠাণ্ডা হয় কিনা। তবে তার দরুন তোর পিঠে যদি গরমাগরম পড়ে, তার দায় কিন্তু আমার নয়।
এই দ্যাখ, পাঠশালার কথা লিখতে লিখতে বাঘিপিসীর কথায় চলে গেছি। বাঘিপিসীর উপরে তো আর চিঠি লিখতে দেয়নি। এজন্য আবার নম্বর না কেটে নেয়! জানিস বাঘনি, আমি মাথা খাটিয়ে কত ভালো ভালো উত্তর লিখি, কিন্তু দিদিমণির কিছুই পছন্দ হয় না। এই তো, গত সপ্তাহে দিদিমণি অঙ্কের প্রশ্ন দিয়েছিলেন, একটি গরু যদি এক ঘন্টায় ২ কেজি ঘাস খায়, তাহলে দশ ঘন্টায় কত ঘাস খাবে? তা আমি উত্তর দিয়েছিলাম- সে বলা ভারি শক্ত। কারণ গরু যদি দশ ঘন্টা টানা ঘাস খায়, তাহলে তার পেট খারাপ হবেই। এবং ঘাস খাবার অবস্থায় থাকবে না। কখন পেট খারাপ হচ্ছে, পেট খারাপ হয়ে আবার কতটা ঘাস বেরিয়ে যাচ্ছে- এ সবকিছুই খুব খেয়াল রাখতে হবে। তারপরে গোরুটার সহ্যক্ষমতা কেমন, টীকা নিয়েছে কিনা- এসবও খেয়াল রাখা দরকার। সবচেয়ে ভালো হয়, একটা গরুকে যদি পাঠশালার সামনে খুঁটি বেঁধে রাখা হয়, আর তারপরে তাকে দশ ঘন্টা সমানে ঘাস খাওয়ানো হয়। তাহলেই সব কথা জানা যাবে।
তা বুঝলি বাঘনি, এতো ভালো ভালো কথা লিখলাম, দিদিমণি আমাকে এত বড় করে একটা শূন্য দিলেন। এরকম করলে কার না রাগ হয় বল্?
আমাদের পাঠশালা এরকমই রে! হাতুশিটা আবার পড়াশুনায় খুব ভালো, অঙ্কে নাকি বিরাট মাথা। তার নাকি আবার পড়াশুনো করতে বেজায় ভালো লাগে। হিনিমিনি, ভালকি, কুমরু- ওরাও সব যেন পড়াশুনোর গাদায় শুয়ে আছে। শুনছি, সিংহী মামীর মেয়ে সিংহালু ভর্তি হবে পাঠশালায়। সে এলে যদি আমার দুঃখুটা ঘোচে।
আর দিদিমণির কথা কি আর বলি? পাঠশালা খুলতে না খুলতেই পরীক্ষা কেউ নেয়? আমি নেহাত ভালো, তাই কিছু বলিটলি না। যাকগে, দিদিমণি যদি এবারেও আমাকে কম নম্বর দিয়ে সুখ পান তো পাবেন। নম্বরের পরোয়া করি নাকি আমি? আমি হলাম বাঘুবাবু, কম নম্বরে হই না কাবু।
ভালো থাকিস আর পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়ার চেষ্টা করিস।
ইতি-
তোর দুর্ভাগা দাদা বাঘু
ঠিকানাঃ–
বাঘনি
প্রযত্নে, বাঘি বাঘ-শিরোমণি
বাঘগুহা,
১ নং হালুম পথ,
বাঘগুড়ি।
লেখাটা পড়ল শিয়ালনী। একবার, দুবার, তিনবার। তারপর পাঠশালা কাঁপিয়ে এক হুংকার দিল, “বাঘু!!! বাঘুউউউউউউউ!!!”
বাঘু হেলেদুলে ভালোবাঘের মতো উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “আপনি কি এখন আমাকে বকবেন, দিদিমণি?”
শিয়ালনী ফুঁসছে রাগে, “বকবেন দিদিমণি? হতভাগা, এটা চিঠি লেখা হয়েছে? তুই নম্বরের পরোয়া করিস না, না? তোকে আমি শূন্যই দেবো।”
বাঘু খুব আরাম করে একবার লেজ চুলকে নিয়ে বলল, “ইয়ে… মানে বলছিলাম কি দিদিমণি… আপনারও তো একটা মানসম্মান বলে ব্যাপার আছে… একেবারে শূন্য দিলে কি সেটা আপনার পক্ষে ভালো দেখাবে? হাজার হোক, আমি তো আপনারই পাঠশালার পশুয়া! মানে, পশু যোগ পড়ুয়া আর কী!”
কিরকম যেন ভেবলে গেল শিয়ালনী। গোঁজ হয়ে বলল, “ঠিকাছে, ঠিকাছে। আমার মানসম্মান নিয়ে তোকে অত ভাবতে হবে না। ‘বনপরিচয়’টা পড়তে দিয়েছি, মন দিয়ে পড়।”
খাতার নম্বর বের হলে দেখা গেল, হাতুশি পেয়েছে যথারীতি পঁচিশে পঁচিশ। ভালকিও পঁচিশ পেল। হিনিমিনি পেল চব্বিশ, কুমরু তেইশ। আর বাঘু? বাঘু পেল তেরো।
খাতাটা দিয়ে শিয়ালনী তেড়ে বাঘুকে বকতে যাবে, কিন্তু তার আগেই বাঘু ফুঁত ফুঁত করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “দিদিমণি, আপনি আমাকে এট্টুও ভালোবাসেন না। বাকি সবাইকে কত কত নম্বর দেন, আর আমার বেলায় সবসময় কম নম্বর! আমাকেও পঁচিশে পঁচিশ দিতেই হবে দিদিমণি! আমি একবারো পাইনি।”
বলেই হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে ধুলোয় গড়াগড়ি দিতে শুরু করল বাঘু। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে শিয়ালনী, “এ কী মামাবাড়ির আবদার পেয়েছিস, বাঘু? তুই ভুলভাল লিখবি তো নাম্বার পাবি কোত্থেকে?”
“ওসব আমি জানি না, দিদিমণি। আমাকে পঁচিশ দিতেই হবে। না হলে আমি আজ টিফিন খাবো না। ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ।”
শিয়ালনী দেখে মহা মুশকিল। বাধ্য হয়ে বলল, “বাঘু, তোর বড়জোর এক নম্বর বাড়ানো যায়। তেরো পেয়েছিস, বড়োজোর চোদ্দ করা যায়।”
বাঘু ধুলোয় আরেক পাক গড়াগড়ি খেয়ে বলল, “ঠিক আছে, তাহলে চব্বিশই দেন, দিদিমণি। পঁচিশ পাওয়াটা একটু বাড়াবাড়িও হয়ে যাবে। চব্বিশই দিয়ে দেন।”
কিরকম যেন খেপে গেল শিয়ালনী, “এ কি তোর বাজারের আলু পটল নাকি যে দরাদরি শুরু করেছিস, বাঘু! বাকিদের মত ভালো করে পড়লেই পারতিস, তাহলেই নম্বর পেতিস!”
বাঘু গায়ে আরেক প্রস্থ ধুলো মেখে সটান চড়ে বসল শিয়ালনীর কোলে। তার পর শিয়ালনীর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “ও আমার সোনা দিদিমণি! ও আমার মান্তু দিদিমণি! ও আমার পান্তু দিদিমণি! আপনি আমায় বকলেন?”
শিয়ালনী চটে লাল, “বাঘু, কায়দাবাজি ছাড়। কোল থেকে নাম বলছি।”
বাঘু শিয়ালনীর গলা জোরে জড়িয়ে ধরে বলল, “চব্বিশ না দিলে তো নামব না, দিদিমণি। তেইশ হলেও চলবে। নিদেনপক্ষে কুড়ি তো চাই-ই।”
শিয়ালনী পড়েছে বেগতিকে। গলা থেকে বাঘুর থাবা সরানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, “বাঘু, ছাড়, ছাড় বলছি। নাম্বার বাড়াতে হবে? কুড়ি দিতে হবে? ইসসস! মামাবাড়ির আবদার আর কী!”
বাঘু শিয়ালনীর কোলে আরো ভালো করে জাঁকিয়ে বসে বলল, “মামাবাড়ির আবদার কেন হবে দিদিমণি? আপনার পাঠশালার আবদার!”
শিয়ালনীর তো হাঁসফাঁস অবস্থা। হাঁইমাঁই করে উঠল, “বাঘু, না নামলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। ওরে হাতুশি, হিনিমিনি, কুমরু, ভালকি- বসে বসে মজা দেখা হচ্ছে না এতক্ষণ ধরে? বাঘুকে নামাতে পারছিস না কোল থেকে?”
ওরা চারজনে এগিয়ে এল চারদিক থেকে। তারপর শুরু করল কাতুকুতু দেওয়া। বাঘু তো ‘হিঃ হিঃ হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ হুঃ হুঃ হৌ হৌ’ করে হাসতে শুরু করল বেজায় আর থাবা গেল আলগা হয়ে। ওরা চারজনে বাঘুকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে এসে ধপাস করে ওর বসার জায়গায় ফেলে দিল।
পরের সোমবার। ‘বন পরিচয়’ পরীক্ষার দিন। ওরা পরীক্ষা দিচ্ছে আর পাঠশালা থেকে একটু দূরেই একটা গরু ঘাস খাচ্ছে। গরুটার সারা গায়ে নানারঙের কালি দিয়ে কিসব হিজিবিজি লেখা। বাঘু একবার করে ‘জল খাবো’, ‘বাইরে যাবো’ করে গরুটার কাছে যাচ্ছে আবার দিদিমণির চোখের আড়ালেও মাঝেসাঝে উঠে উঠে গরুটার কাছে যাচ্ছে। কী হল, ব্যাপারটা ঠিক বোঝা গেল না, কিন্তু পরীক্ষার নম্বর বেরোতে দেখা গেল, বাঘু পেয়েছে পঁচিশে বাইশ। হিনিমিনি পেয়েছে পঁচিশ, হাতুশি আর ভালকি চব্বিশ, কুমরু তেইশ।
সবার খাতা দিয়ে শিয়ালনী চোখমুখ কুঁচকে বলল, “কী ব্যাপার রে, বাঘু, তুই এতটা নম্বর পেয়ে গেলি যে?”
বাঘু গোঁজ হয়ে বলল, “দিদিমণি, আমি বেশি নম্বর পেলেও দোষ, কম নম্বর পেলেও দোষ! আপনি খালি আমাকে কেমন কেমন করেন!”
শিয়ালনী ব্যস্ত হয়ে বলল, “আহা! আহা! সেকথা বলিনি বাঘু। বলছি যে, এবারে তুই নিশ্চয়ই খুব ভালো করে পড়েছিস, তাই ভালো নম্বর পেয়েছিস। খুব ভালো করে পড় বাঘু, তবেই তো জানোয়ারের মতো জানোয়ার হতে পারবি!”
একথায় বাঘু তো ভক্তির চোটে শিয়ালনীকে রীতিমতো থাবাপ্রণাম সেরেই ফেলল। শিয়ালনী বিব্রত হয়ে বলল, “আহা! থাক থাক বাঘু। তোর লেজের শ্রীবৃদ্ধি হোক, জন্তুর মতো জন্তু হ।”
বাঘুর দেখাদেখি থাবাপ্রণামের ঘটা পড়ে গেল। হাতুশি, হিনিমিনি, ভালকি, কুমরু- সকলেই এসে ঢিপঢিপ করে প্রণাম শুরু করল শিয়ালনীকে। তাই দেখে বাঘু ফের উঠে এসে প্রণাম করল শিয়ালনীকে। শিয়ালনী তো অবাক, “বাঘু, তুই আবার প্রণাম করলি?”
বাঘু থাবার ধুলো মাথায় ঝাড়তে ঝাড়তে উত্তর দিল, “দিদিমণি, প্রণামটা রিভিশন দিলাম।”
পরের সোমবার। শেষ পরীক্ষা- নামতা। বাঘু এসেই ঘোষণা করে দিয়েছে- আমি আজ পঁচিশে পঁচিশ পাবোই। কারুর সাধ্যি নেই আমাকে আটকায়। পরীক্ষা শুরুর একটু পরেই আবার দেখা গেল গরুটাকে। বাঘুও আগের দিনের মতোই একটু পর পরই জল খাবার আর বাইরে যাবার নাম করে গরুটার কাছে ছোটে। ফিরে এসে উত্তর লেখে। হাতুশি একবার তাকিয়ে দেখল, গরুটার সারা গায়ে আগের দিনের মতোই হিজিবিজি। তবে এবারেরটা কেমন যেন আলাদা। যাইহোক, হাতুশি আর বেশি মাথা না ঘামিয়ে নিজের উত্তর লেখায় মন দিল।
বাঘু এদিকে একবার করে লেখে, একবার করে গরুর দিকে তাকায়। তার মন পড়ে আছে গোরুর দিকে। এরপরে যেই আরেকবার ‘জল খাবো’ বলে উঠতে যাচ্ছে, অমনি দ্যাখে, কে জানে কেন, গোরুটা ল্যাজ তুলে ছুটতে শুরু করে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই বিকট এক চিৎকার ছাড়ল বাঘু, “আমার নামতা পালাচ্ছে! ও হো হো হো! ও গো গরুদাদা গো, নামতা নিয়ে পালিও না গো!”
শিয়ালনী সহ বাকি পোড়োরা তো হতবাক। বাঘু এদিকে ছুটতে শুরু করেছে গরুটার পিছন পিছন। হাতুশির মাথা ততক্ষণে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। শুঁড় দোলাল হাতুশি, “দিদিমণি, আমি দেখে আসি।”
গরু ছুটছে, তার পেছনে বাঘু, তার পেছনে হাতুশি। তার পিঠের উপর লাফ দিয়ে বসেছে হিনিমিনি। ভালকি আর কুমরু পিছন পিছন দৌড়চ্ছে । আর সবার শেষে হাঁফাতে হাঁফাতে শিয়ালনী।
গরু আর বাঘুর কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছোল যখন ওরা, তখন দু’জনে রীতিমতো তর্ক বেঁধে গেছে। গরুকে বলতে শোনা গেল, তুই যে বলেছিলি, আজ অর্ধেক পড়া হলেই এক বস্তা ঘাস এনে দিবি, তার বেলা?”
উত্তরে বাঘু ফিসফিস করে বলছে, “তোমার পায়ে পড়ি, গরুদাদা। এক বস্তা ঘাস নয়, তোমাকে দু’ বস্তা ঘাসই দেবো। কিন্তু তুমি দয়া করে ওখানে চলো।”
“ইসসস! তোর কথায় বিশ্বাস করি আর কী! এমনিতেই বলে তুই আমার সারা গায়ে নামতা লিখেছিস বলে গরুকুলে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি পড়ে গেছে!”
ততক্ষণে ওরা সবাই তো একদম কাছে পৌঁছে গেছে। অবাক হয়ে দেখে সবাই, গরুটার সারা গা ভর্তি নামতা লেখা। চশমা ঝুলে পড়ল শিয়ালনীর, “মানুষেরা শুনেছি নামাবলী পরে, কিন্তু এ যে দেখছি নামতাবলী!”
হাতুশি শুঁড় কপালে তুলল, “দিদিমণি, বাঘু মনে হয় তাহলে আগের দিনও এই কাণ্ডই করেছিল!”
ভালকি বলল, “কী ভণ্ড রে তুই, বাঘু!”
কুমরু লেজ নাড়ল, “তোর নম্বর পাওয়া এবারে পণ্ড।”
হিনিমিনি সায় দিল, “সে যতই করিস লণ্ডভণ্ড।”
“তাহলে শুনুন দিদিমণি”, বারদুয়েক গলা ঝেড়ে আবার মুখ খুলল গরুটা, “আপনার এই বাঘুর কীর্তি। বাঘু আমাকে বলেছিল যে আমার গায়ে ও নাকি কিসব আঁকালেখা করবে। আর পরীক্ষার দিনগুলোতে আমাকে পাঠশালার সামনে দাঁড়াতে হবে। তার বদলে ও আমাকে দু’ বস্তা করে ঘাস দেবে। তা আগের দিন দু’ বস্তার বদলে এক বস্তা ঘাস দিল। কথা দিয়েছিল, আজ আদ্ধেক পরীক্ষার পরই এক বস্তা ঘাস দিয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় কী? বাঘুকে আজ পরীক্ষার মাঝে বলতে গেলাম, তা বাঘু বলল, পরীক্ষা শেষ হোক, তারপর ভাববে। তাই আমিও চলে আসছিলাম।”
শিয়ালনীর লেজ রাগে বনবন করে ঘুরছে, চোখ জ্বলছে, কান দিয়ে শাঁইশাঁই করে গরম বাতাস বইছে। ভয়ানক এক আওয়াজ ছাড়ল শিয়ালনী, “বাঘু! বাঘুউউউউউ! এইসব চালাকি করে বেশি নম্বর পাবার ফন্দি এঁটেছিলি, না? আগেরদিন এই করেই ভালো নম্বর পেলি? আমার বড় বড় কথা! তুই এখন গুনে গুনে দু’শোবার লেজবোস কর। মানে, লেজ ধরে ওঠবোস। আর কোন কথা আমি শুনতে চাই না। শুরু কর বাঘু। নো চালাকি, নো কায়দাবাজি!”
বাঘু বেচারি কী আর করে? লেজবোস শুরু করল কাঁদতে কাঁদতে, “ওরে আমার এ কী হল রে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না) …এক বস্তা ঘাসের জন্য এ কী নাকাল রে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… ও গরুদাদা গো, …আঁই আঁই আঁই আঁই … এত তুমি পাষাণ গো… আঁই আঁই আঁই আঁই … ওরে, তীরে এসে আমার তরী ডুবল রে… আঁই আঁই আঁই আঁই …আঁই আঁই আঁই আঁই… আঁই আঁই আঁই আঁই।”
……০……
অংকনঃ রিমিল জানা
বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি পড়ুন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করেঃ-