Home / কিছু ভাবনা কিছু চিন্তা / সরস্বতী মহাভাগে- মৌসুমী পাত্র

সরস্বতী মহাভাগে- মৌসুমী পাত্র

মা সরস্বতী- মধুবনী পেন্টিং
মা সরস্বতী- মধুবনী পেন্টিং

 

আজ থেকে কুড়ি তিরিশ বছর কি তারও আগে, যখন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলির এমন রমরমা শুরু হয়নি, তখন মা সরস্বতীর ছিল অখণ্ড প্রতাপ। হাতে গোনা অল্প কিছু ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রী বাদে কী গ্রামাঞ্চল, কী শহরাঞ্চল- বাঙালী গৃহের অধ্যয়নরত পুত্রকন্যার সম্বৎসরের এক এবং একমাত্র গতি কমলাসনা বাগ্‌দেবী। মা সরস্বতী পাছে বিদ্যা না দেয়, পাছে পাপ দেয়- সেই ভয়ে কত যে বেপথু বালক- বালিকা যে সুড়সুড় করে ‘সুবোধ’ হবার সাধনা করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। সরস্বতী পুজো মূলতঃ কমবয়সীদেরই পুজো। এমনকি, যেসব কচিকাঁচাদের পড়ার সঙ্গে সারাবছর বিশেষ সম্পর্ক থাকে না বললেই চলে, তারাও মহোৎসাহে পূজার্চনায় নেমে পড়ে। তার প্রমাণ মেলে যেমনতেমন একটা বিল বই নিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের চাঁদা তোলার হিড়িকে।

কিন্তু এহ বাহ্য। বাঙালীর সরস্বতী পুজোয় ধর্মীয় আবরণটি নিতান্তই এক মোড়ক মাত্র। সেই যুগে, যখন স্কুলে ‘প্রোজেক্ট’ নামক বস্তুটির বালাই ছিল না বললেই চলে, ‘গ্রুপ অ্যাক্টিভিটি’ ইত্যাদি বিজাতীয় শব্দের সঙ্গে ছেলেমেয়েরা নেহাতই অপরিচিত, সেইসময় সরস্বতী পুজোয় ধর্মাধর্ম নির্বিশেষে রঙিন কাগজে, ফুলে, মালায়, আলপনায় উৎসবে মেতেছে প্রাণভরে। পুজো তো এক অছিলা মাত্র। এ স্কুলের সঙ্গে ওই স্কুলের আলপনার প্রতিযোগিতা, প্রতিমার শিল্প সুষমায় পরস্পরকে পাল্লা দেওয়া, চিত্রপ্রদর্শনী, হাতের কাজের নৈপুণ্যে একে অন্যকে টেক্কা দেওয়া- এই সব মিলিয়েই বাঙালীর বছর শেষের সবচেয়ে বড়ো উৎসব। রাত জেগে রঙিন কাগজের শিকল বানানো, আর্ট পেপারে সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকে সাঁটানো, থার্মোকলের নানা রকম মূর্তি, নকশা ইত্যাদি তৈরি- এসব তো সরস্বতী পুজোই শিখিয়েছে বাঙালীর প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। সরস্বতী পুজোতে তাই শেষ পর্যন্ত সরস্বতীও গৌণ, পুজোও গৌণ। মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় সারস্বত সাধনা- বিদ্যাচর্চার সঙ্গে শিল্পকলার, সঙ্গীত-নৃত্যের সঙ্গে সৌন্দর্যবোধের, প্রেমবোধের সঙ্গে দার্শনিকতার। সেই পুজোতে শাড়ি পরা ফাহমিদার হাত ধরে শ্রেয়সী- ঝুমা- মৌমিতা- সংঘমিত্রারা। সৌন্দর্যের এই উদ্বোধন সম্ভবতঃ সারা বিশ্বেই বিরল।

আর একটিই বোধহয় উৎসব আছে, যেখানে বাঙালী ঘরের সন্তান- সন্ততিরা নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তি, সৃজনীক্ষমতা বিকাশের কিছুটা ক্ষেত্র পায়। তবে তা ধারে- ভারে কোনভাবেই সরস্বতীপুজোর সমতুল্য নয়। সেটি ঝুলনোৎসব। ঘাসের চাঙড় কেটে পাহাড় বানানো, ইঁটের গুড়ো দিয়ে লাল মাটির রাস্তা বানানো কিংবা কাল পাথর দিয়ে পিচের রাস্তা- ইত্যাদির মধ্যে শিশুর কল্পনাশক্তি কিছুটা নিজের চলার পথ খুঁজে পেত। পড়াশুনোর চাপে এবং আরো নানা কারণে সেটা প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছে। সরস্বতী পুজো কিন্তু সেখানে আপন মহিমায় ভাস্বর। বিশ্বায়ন, বাজারি অর্থনীতি- কিছুই তার জৌলুসে থাবা বসাতে পারেনি। সরস্বতী পুজো এবং তার পরের খিচুড়ি- এছাড়া যেন বাঙালী নারী- পুরুষের বিদ্যালাভ অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েদের জন্য সান্টা ক্লজ আছেন। বড়দিনের সময় তাঁর আবির্ভাব। তিনি সান্টাদাদু- ভালোবাসায় ভরিয়ে দেন সকলকে। আদর করে কাছে টানেন, নানারকমের উপহার নিয়ে আসেন বাচ্চাদের জন্য। সরস্বতী ঠাকুর সেখানে ভয়- ভক্তি- ভালোবাসায় মাখামাখি। তাঁর পুজোয় অনেক আনন্দ, অনেক মজা। ছেলেরা মেয়েরা নির্বিবাদে একে অন্যের স্কুলে যেতে পারে। আবার কোন কারণে তিনি চটে গেলে পরীক্ষায় ফেল করাও বিচিত্র নয়। তবুও তিনি ভয় দেখান না। বরং তাঁর কাছে চুপিচুপি ক্ষমা চেয়ে নেওয়া যায়। না পড়েও পরীক্ষা পাশের আবদার জানানো যায়। কে জানে, হয়তো তাঁরই দয়ায়, পাশফেল প্রথা এখন অতীতের গর্ভে!

সর্ব অর্থেই, কমলাসনা কমললোচনা এই দেবীর আরাধনা সমাজের কমবয়সীদের, তরুণ-তরুণীদের প্রাণের উৎসব। ধর্মীয় অনুষঙ্গ হিসেবে যেটুকু আছে, সেটুকু বাহুল্যমাত্র। ব্রাহ্মণ এবং পুরুষ পুরোহিত দিয়ে পূজার্চনায় ইদানীং আপত্তি উঠছে অনেকক্ষেত্রে, এবং তা সঙ্গত কারণেই। ধর্ম তো প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যত্বের উদ্বোধন। সমাজের সকলস্তরের মানুষের সমান অংশগ্রহণ ছাড়া তাই যেকোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান সার্থক হওয়া প্রকৃতপক্ষেই অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথ কবেই বলে গেছেন- যারে কয় ভালোবাসা, তারে কয় পূজা। তাই অব্রাহ্মণ এবং মহিলারা ভালোবেসে পুজোর কাজে এগিয়ে আসছেন ক্রমশঃ। সমাজে যে মুক্ত মানসিকতা, স্বচ্ছ চিন্তাধারার প্রসার ঘটছে- এইসব ঘটনা তারই সজীব প্রমাণ! এ প্রসঙ্গে একটি পুরনো ঘটনা মনে পড়ছে। একদা কোন এক ছাত্র তার মেয়ে সহপাঠীকে কিছুটা গর্বের সুরে বলেছিল, ‘তোরা তো নিজেরা পুজো করতে পারিস না! সেই ছেলেদেরই ডাকতে হয়!’ মেয়েটি একটুও না দমে উত্তর দিয়েছিল, ‘সে হতে পারে, কিন্তু সেই মেয়েকেই তো তোদের পুজো করতে হয়!’  যদূর জানি, ছেলেটি আর কথা বাড়ায়নি!

আর একটি কথা। সরস্বতী পুজোয় আনন্দ- আহ্লাদ, ঘোরাফেরা, খিচুড়ি প্রসাদ, গঠনমূলক কাজকর্ম ইত্যাদি তো অনেক হয়, কিন্তু প্রকৃত অর্থে শিক্ষা চেতনার উন্মেষ হয় কতটুকু? মানুষের মননশীলতার প্রসার, বিদ্যার প্রতি আগ্রহের বিস্তার হয় কতটুকু? সেই অগ্রগতির হিসাব কিন্তু একান্তই জরুরী। বাগ্‌দেবীর কাছে দোয়াত- কালি- কলম- পুস্তকের প্রতীকী উপচারের অন্তর্নিহিত মর্মবাণীটি যদি আমরা অনুধাবন করতে না পারি, তাহলে মৃন্ময়ী প্রতিমার চিন্ময়ী মাতৃমূর্তিরূপে ভাস্বর হয়ে ওঠার আশা বৃথা। চকলেট- চিপস- মোবাইলে মগ্ন আজকের শিশুর কাছে বইয়ের অমৃতভাণ্ডের চাবিকাঠিটি তুলে দেবার দায় একান্তভাবে আমাদেরই। যে তরুণটি সযতনে ছাল তোলা জিনস্‌ পরে পরম মনোযোগে সরস্বতী পুজোর দিন মেয়ে নিরীক্ষণে ব্যস্ত- সে যদি বইপড়ার অমৃতরসের আস্বাদ না পায়, তার দায় কার?

তাই আসুন, পরবর্তী প্রজন্মকে বইমুখো করে তোলার কিছুটা দায়িত্ব অন্ততঃ আমরা পালন করি। দুর্গাপুজোয় জামাকাপড় ইত্যাদি সন্তানকে কিনে দেবার সময় মা দুর্গার পাশে থাকা মা সরস্বতীর কথা মনে রেখে একটা অন্ততঃ পূজাবার্ষিকী কিনে দিই। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বাচ্চাদের হাতে যখনতখন চকলেট- বিস্কুট তুলে দেবার খরচা সামান্য বাঁচিয়ে একটা অন্ততঃ শিশুপাঠ্য পত্রিকা বা বই তুলে দিই। চারাগাছকে তার প্রয়োজনীয়, যথাযথ পুষ্টিটুকু জোটাতে না পারলে সে গাছ মহীরুহ হবে কেমন করে? বিদ্যাদেবী আমাদের বিদ্যা দিন, জ্ঞান দিন, আলো দিন। অজ্ঞানতার কুজ্ঝটিকা দূর হয়ে নির্মল পবিত্র আলোয় ভরে উঠুক চরাচর। বিদ্যাং দেহি নমোহস্তুতে।।

……০……

Leave a comment

Check Also

Tagore কে আমি like করি

Tagore কে আমি like করি – মৌসুমী পাত্র

  হ্যাঁ, এটা ট্রু যে আমি টেগোরকে লাইক করি। আর করবো নাই বা কেন? এই …

শিল্পী- পুণ্যতোয়া

এত যুদ্ধ কেন ? – সুমেধা ভৌমিক

                              …

ঈশ্বরঃএজেন্ট ও মার্কেটিং

ঈশ্বরঃ এজেন্ট ও মার্কেটিং – সুদীপ্ত বিশ্বাস

    যে কোনও প্রোডাক্ট মার্কেটে বিক্রির জন্য ভালো মার্কেটিং এর জুড়ি নেই। মার্কেটিং ঠিকঠাক …

হেসে কেশে ভালোবেসে

হেসে কেশে ভালোবেসে- সোমক সেনগুপ্ত

    বড়, উন্নত শহর মানেই পেল্লাই সব বাড়ি। যেমন বই এর তাকে বই রাখা …