এক যে ছিলো বেলুনওয়ালা। রকমারি রংবেরঙের বেলুন ছিল তার কাছে। যেখানেই যেত সে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভিড় লেগে যেত তাকে ঘিরে। বেলুনওয়ালা লোকটিও ছিল ভারি মজাদার। সবসময় তার মুখে হাসি লেগেই থাকত। টকটকে ফরসা গায়ের রঙ, মাথায় সাদাকালো কাঁচাপাকা চুল, দু’চোখে কোন সুদূরে হারিয়ে যাওয়া দৃষ্টি- সব মিলিয়ে ভারি ভোলেভালা একটা ব্যাপার ছিল তার মধ্যে। এখন হয়েছে কী, সেই বেলুনওলা একদিন এসেছে একটা নতুন পাড়ায়। বিকেলবেলা। পাড়ার মস্তো বড়ো মাঠে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা ছুটছে, ফিরছে, খেলছে। একঝাঁক প্রজাপতি যেন উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে মাঠের মধ্যে। বেলুনওয়ালা সেই বিশাল মাঠের এককোণে তার বেলুনের ঝাঁপি নিয়ে দাঁড়ালো। তারপর সুর তুলল গলায়, “বেলুন নেবে গো, বেলুন? রংবেরঙের বেলুন, মজাদার বেলুন, পালতোলা বেলুন, সুরওলা বেলুন/ বেলুন নেবে গো, বেলুন?”
বেলুনওয়ালার মায়াময় গলার হাতছানিতে একে একে ছেলেমেয়েরা খেলা ফেলে ভিড় জমাল তার কাছে। দেখতে দেখতে বেলুনওয়ালার সামনে একটা ছোটোখাটো মেলাই প্রায় বসে গেলো। আর নানারকম ছোটোবড়ো কচিকাঁচার কলস্বর ভেসে বেড়াতে লাগলো।
“বেলুনওলা, ও বেলুনওলা, আমাকে ঐ হাতিবেলুনটা দাও না!“
“ও বেলুনকাকু, আমাকে ওই ঘুড়ি বেলুনটা দাও না গো!”
“আমাকে কিন্তু একে চন্দ্রর মতো বেলুনটা দেবে।”
“আমি ঐ জ-মার্কা বেলুনটা নেবো।”
“আমার এই জিরাফের মতো বেলুনটা চাই।”
“আমি কিন্তু গদাবেলুনটা নিয়ে খেলবো!”
বেলুনওলা হাসিমুখে সকলের আবদার মেটাতে থাকে। সবাই তো আর মাঠে পয়সা নিয়ে আসে না। ফলে অনেকেই বাড়ি ছোটে বাবামায়ের থেকে টাকাকড়ি নিয়ে আসতে। কাছেপিঠেই বাড়ি সব, ফলে চটপটই আবার এসে হাজির হয় আর পছন্দমত বেলুন কিনে নিয়ে হইহই করতে করতে বাড়ির পথ ধরে।
এমনি করে করে পুরো মাঠ প্রায় খালি হয়ে গেলো। পড়ে রইল কেবল বেলুনওলা আর একটি বেলুন। নাঃ, সামান্য ভুল হোলো! আর রইলো একটি ছোট্টো মেয়ে।
বেলুনওলা শুধোল, “কী গো ছোট্টো মেয়ে, তুমি বেলুন নিলে না?”
ছোট্টো মেয়ে হাসল। মনখারাপের হাসি। অনেক ঝরে পড়া বকুলফুল মিশে ছিল সেই হাসিতে।
“আমার তো পয়সা নেই। কী করে কিনবো?”
“কেন, তোমার বাবা মা’র থেকে তো নিতে পারতে! নাকি তোমার বাবা মা বেলুন কেনা পছন্দ করেন না?”
“আমার যে বাবামা কেউ নেই, বেলুনওলা।”, ছোট্টো মেয়ের স্বরে অনেক লুকোনো কান্না মিশে ছিলো।
বেলুনওলা চুপ হয়ে রইলো খানিকক্ষণ। মাঠে অন্ধকার নেমে গেছে অনেক আগে। চাঁদটাও মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে। এদিক ওদিক থেকে ভেসে আসা টিমিটিমি আলোতে আবছা দেখা যায় বেলুনওলার মুখ। যখন কথা বলল সে, তখন বিষাদের ছোঁয়া লেগেছে তার গলাতেও।
“এই বেলুনটা তুমি রাখো, ছোট্টো মেয়ে। এটা দেখতে হয়ত ততো ভালো নয়, কিন্তু এটা খুব কাজের। তোমার যখন বাবামায়ের জন্য খুব মন খারাপ করবে, তখন তুমি এই বেলুনটাকে আদর কোরো। আর যত্ন করে নিয়ে যেও এটাকে। আজ আমি আসি। কিন্তু তুমি এখন কোথায় যাবে?”
“আমার এক দূর সম্পর্কের দিদিমার কাছে আমি থাকি। তারও কেউ নেই।”
কথা শেষ করতে না করতে ছোট্টো মেয়ে দেখে বেলুনওলা ধীর পায়ে মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের বুকে।
ছোট্টো মেয়েটিও বেলুনটাকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে বাড়ির পথ ধরে।
বাড়ি ফিরে অন্য দিন ছোট্টো মেয়েটি,যার নাম টুই, বইখাতা খুলে পড়তে থাকে। আজ আর তার কিছুতেই পড়ায় মন বসলো না। খালি তার মনে ভাসতে থাকলো বিকেলের খেলার মাঠ, সেই মাঠে তার বন্ধুরা, আর সেই বেলুনওলা আর তার রাশি রাশি বেলুন। আর তার খুব মনখারাপ করতে লাগলো তার হারিয়ে যাওয়া বাবামায়ের জন্য।
তার বুড়ি দিদিমা ডাকলো, “টুই, খেয়ে নিবি আয় রে! গরীবের ঘরে যেটুকু পারি করেছি। তোর বাবামা থাকলে আজ তোকে কতো আদরযত্ন করে খাওয়াতো!”
কোনরকমে চোখের জলটল মুছে টুই খেতে যায়। খাবার বলতে খানিকটা মুড়ি আর আলুসেদ্ধ। ক্ষিদের চোটে তাই গোগ্রাসে গেলে। খেতে খেতে আবারো চোখে জল এসে পড়ে। বাঁ হাতে মুছে নেয়। দিদিমার নজরে এলে তার আবার মনখারাপ কেন?
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে দিদিমা শুয়ে পড়ে। সে বেচারী বুড়ো হয়েছে, আর কতই বা ধকল নেবে? টুই যদিও অনেক সাহায্য করে দেয়, তবুও তো কাজ থাকে!
অন্যান্য দিন হলে টুই খাওয়ার শেষে দিদিমার কোল ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। আজ তার মন এতই খারাপ যে সে বারান্দায় বসে বসে খালি তার হারানো বাবামায়ের কথা ভাবতে লাগলো। খানিক বাদে তার মনে পড়লো বেলুনওলার কথা। সে যে বলেছিলো, মনখারাপ করলে বেলুনটাকে আদর করতে। ঘরের ভেতর থেকে বেলুনটাকে নিয়ে এলো সে। বেলুনটার গায়ে হাত বুলোতে থাকলো।
এমন সময় হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া উঠলো, আর তার হাত থেকে বেলুনটা ছাড়া হয়ে ভাঙা গ্রিলের ফোকর গলে বেরিয়ে গেলো।
তড়িঘড়ি সে বেলুনটাকে ধরতে বেরোলো। বেলুনওলা পইপই করে বলে দিয়েছিল, বেলুনটাকে খুব সাবধানে রাখতে আর যত্ন করতে।
বেলুনটার পিছন ছুটতে ছুটতে সে চলে এলো তাদের বিকেলের খেলার মাঠটায়। চাঁদের আলোয় মাঠটার জেল্লা আরো খুলেছে। এখানে এসে বেলুনটা যেন খুব ফূর্তি পেয়ে গেলো। মাঠময় চক্কর খেতে থাকে, আর টুই তার পিছু পিছু ধাওয়া করতে থাকে।
কিছুক্ষণ চললো এরকম। তারপর বেলুনটা গোঁত্তা খেতে থাকলো। মাঠের একপাশে কারা যেন বেশ বাড়ি করবে বলে ডাঁই করে ইঁট রেখেছিলো। কয়েকটা ইঁট তার মধ্যে অবিন্যস্ত হয়ে এমনভাবে ছড়িয়েছিলো যেন একটা গহ্বর। গোঁত্তা খেতে খেতে বেলুনটা গিয়ে ঢুকল তার মধ্যে। আর টুই তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে তাকে তুলে নিলো।
একটুক্ষণ টুই বেলুনটাকে নিয়ে আদর করেছে কি করেনি, বেলুনটা ফেটে গেলো ফটাস করে আর তার মধ্যে থেকে ধোঁয়া ধোঁয়া মতো কীসব বেরোতে থাকলো। ধোঁয়াটা মিলিয়ে গেলে টুই দেখে কী, তার হাতে একটা বড়োসড়ো টিপের মতো কী একটা জিনিস। ভালো করে দেখার জন্য জিনিসটা যেই ঘষেছে টুই, অমনি সেটা মিলিয়ে গিয়ে দেখে, বিশাল একখানা গাছ সেখানে! ডালপালাগুলো প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে। কতো রকমের কতো ফল, ফুল ধরে আছে। একটা আপেলের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে গেলো সে। অমনি আপেলটা বলে উঠলো, “তুমি আমাকে খেতে পারো।”
টুই আপেলটা খেলো। দিব্যি মিষ্টি। শরীর মন যেন জুড়িয়ে গেলো।এবারে সে ঘুরে ঘুরে ভালো করে দেখতে থাকলো গাছটাকে। একটা গন্ধরাজ ফুলের গায়ে হাত বুলিয়ে খানিক আদর করে ছেড়ে দিলো সে। ও মা, অমনি পাশ থেকে একটা চাঁপা ফুল বলে উঠলো, “সে কি, তুমি আমাকে আদর করলে না?”
টুই তাকেও আদর করলো। শিউলি ফুলটা অমনি পাশ থেকে ভারি আহ্লাদি গলায় বলে উঠলো, “আমিও আদর খাবো, আমিও আদর খাবো।”
টুই তাকে ধরেও নেড়ে দিলো একটু। অমনি একধার থেকে একটা পেয়ারা মিহিসুরে বলল, “আর আমি কী দোষ করলাম?”
বাধ্য হয়ে টুই পেয়ারাটাও খেলো। আর তখনই তার নজরে এলো, গাছের কাণ্ডের মাঝামাঝি অনেক পাতার আড়ালে লুকোনো একটা ছোট্টো বাহারি দরজা।
ভালো করে দেখবে বলে টুই যেই দরজাটার কাছাকাছি গিয়েছে, তৎক্ষণাৎ দরজাটা গেল খুলে। আর ভেতর থেকে কে যেন ভারি মিষ্টি সুরে বলে ঊঠলো, “ ভেতরে এসো, টুইসোনা।”
টুইও নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়লো গাছের অন্দরে। এ কী! এ যে বেজায় সুন্দর জায়গা। কী চমৎকার একখানা রাস্তা চলে গেছে এঁকেবেঁকে ভিতরপানে। দারুণ দারুণ সব আলো, ছবি আর খেলনা দিয়ে সাজানো পথটার দুইধার। কোথায় একটা বেশ টুংটাং করে গানের সুর বেজে চলেছে। আপনমনে দেখতে দেখতে টুই চলতে থাকলো।
অনেকক্ষণ চলল টুই। চলতে চলতে তার দুই পা টনটন করতে থাকলো, তবুও সে থামলো না। যতো যায়, গানের সুর ততোই জোরালো হয়। শেষকালে টুই যখন আর একদমই পারছে না, তখনই তার চোখে পড়লো নদীটাকে। একদম সামনে। কী অপূর্ব টলটলে জল! হালকা সবুজ-নীল, অথচ পুরো স্বচ্ছ। আর নদীর জল বয়ে যাচ্ছে টুংটাং সুরে, যেটাকে টুই এতক্ষণ গানের সুর বলে ভুল করেছিলো। আর নদীর ওপারে অদ্ভুত সুন্দর একটা খেলার মাঠ। নদীর জলে নেমেই পড়লো টুই। রেশমকোমল জল তার দুই পা ধুইয়ে দিতে থাকলো।
খেলার মাঠে পৌঁছে টুই আর পারলো না। বিশ্রাম নেবার জন্য বসেই পড়লো একটা দোলনায়। সারাদিনের পরিশ্রমে তার দুই চোখ পুরো বুজে এলো।
ঘুম যখন তার চোখে প্রায় পুরোদস্তুর বিছানা পেতে দিয়েছে, তখন কে যেন তার দুটি নরম হাত দিয়ে টুইয়ের দুই চোখ জড়িয়ে ধরলো। সেই হাতের স্পর্শে এতো আরাম, এতো আরাম যে টুই তার সারাজীবনে যেন পায়নি। আর তার সাথে বহুযুগের ওপার থেকে ভেসে আসা ডাক, “টুইসোনা, ও টুইসোনা।”
চোখ খুললো টুই। আর চোখ খুলেই দেখে ভারি সুন্দর এক ভদ্রমহিলা ও এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। তাদের দুই চোখ দিয়ে যেন ভালোবাসা ঝরে ঝরে পড়ছে। বুঝতে ভুল হোল না টুইয়ের। সাথে সাথেই সে ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের কোলে, “মা, ও মা! বাবা!”
টুইয়ের মা বললেন, “টুইসোনা, ও টুইসোনা, তোকে আমরা কতো করে খুঁজেছি। শেষে এখানে আজ এখানে মাঠের এখানে পেরোতে গিয়ে একটা ছোটো মেয়ে বসে আছে দেখে ভাবলাম, দেখি তোর সন্ধান দিতে পারে কিনা। তা’ কাছে এসে দেখি সত্যিই তুই।”
টুইয়ের বাবা বললেন, “হ্যাঁ রে, তুই শুনেছি আমাদের সেই ছোটোবেলার সোনামাসির কাছেই থাকিস। এতোদিন কেউ সন্ধান দিতে পারেনি। আজ একজন বলল, এই জায়গাটা একবার ভালো করে খুঁজে দেখতে। সেই শুনে আমরা সাথে সাথেই বেড়িয়ে পড়েছি।”
তারপরে টুইয়ের মা আর বাবা টুইকে নিয়ে এলেন সেই বুড়িদিদার বাড়ি। তাদের দেখে বুড়ির যতো আনন্দ, ততো কান্না।
টুইয়ের মা বলেন, “কী গো, অতো কাঁদো কেন?”
সে বলে, “টুই এতো কষ্টের পর তোমাদের ফিরে পেলো। আর তেমনই আমাকে ছেড়ে এবার তো তোমাদের কাছে চলে যাবে, তাই কাঁদছি।“
টুইয়ের মা বলেন, “সে কী কথা গো? তুমি চলে যাবে মানে? তুমিই তো এতোদিন এতো কষ্ট করে টুইকে বড়ো করলে। আর তাছাড়া, আমাদের তো মা নেই, তুমি আমাদের মা হয়ে থাকো।”
একথা শুনে বুড়ির ফোকলা মুখে আর হাসি ধরে না। বুড়িমা হাসছে, হাসছে আর হাসছে। হাসির জোর বাড়তে বাড়তে খুব আওয়াজ উঠল আর টুই চোখ মেলে দেখে, হাতের মধ্যে বেলুন তেমনই ধরা। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার আর ঝড়ের সাঁই সাঁই শব্দ উঠেছে জোর। বিশ্বচরাচর উথাল পাথাল হতে লাগল সেই ঝড়ে। অন্যদিন হলে টুই ভয় পায়, আজ কিন্তু সে একটুকুও ভয় পেল না। স্বপ্নে দেখা মা- বাবা ফিসফিস করে টুইয়ের মনের মধ্যে বলে উঠলেন, ভয় কি টুইসোনা, আমরা তো আছি। আছি তোর মনের মধ্যেই।
এক পরম প্রশান্তি নিয়ে শুয়ে পড়ল টুই। যত রাতই হোক, যত ঝড়ই উঠুক, সকাল তো হবেই।