(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে পাঠশালার খবর ভেসে আসে মাঝেমধ্যে। এলেই তোমাদের জানাতে থাকবো। পাঠশালাটা কোথায় জানো? বনের ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে প্রচুর গাছপালা মিলে মাথার উপরে একটা চাঁদোয়ার মত বানিয়েছে, আর দুটো সেগুনগাছের ইয়া মোটা মোটা গুঁড়ি দুদিক থেকে এসে একটা দরজার মতো তৈরি হয়েছে। জঙ্গলের যত ছানাপোনা জন্তুজানোয়ার, সবাই আজকাল সক্কালবেলা হলেই হাতমুখ ধুয়ে চাট্টি মুড়ি খেয়ে ওখানেই পড়তে যায়। তাদের মধ্যে আছে বাঘিনীর বাচ্চা ছেলে বাঘু, হাতির বাচ্চা মেয়ে হাতুশি আর হনুমানের ছানা মেয়ে হিনিমিনি। এছাড়াও আছে ভালুকের পুঁচকি মেয়ে ভালকি আর কুমীরের বাচ্চা ছেলে কুমরু।)
পাঠশালা ছুটি। বাতাসে বেশ শিরশিরে ভাব। পাঠশালা ছুটি বলে প্রথম দু-চারদিন বাঘুর বেশ মজাসেই কাটল। সকালে উঠেই পাঠশালা যাবার তাড়া নেই, বেলা অব্দি ঘুমোও যত খুশি। তারপর উঠেও দাঁত মাজার তাড়া নেই, চান করার তাড়া নেই, বইখাতা গুছোনোর তাড়া নেই, এমনকি লেজটেজ আঁচড়ে বেরোনোরও তাড়া নেই।
কিন্তু পাঁচদিনের দিনই বাঘু খেল হাঁফিয়ে। সারাদিন একা একা আর কাঁহাতক খেলা যায়? পাঠশালে কী সুন্দর হইহই করে সারাদিন কেটে যেত! বন্ধুদের সঙ্গে দুষ্টুমি করে, দিদিমণির কাছে বকুনি খেয়ে আর লম্বাগুড়ি দিয়ে সময়টা যে কোত্থেকে কেটে যে বাঘু টেরই পেত না! এতোই মন খারাপ হয়ে গেছে যে দুপুরবেলা ভাতটাত খেয়েই বাঘু গান জুড়ল-
কোথা গেলি পাঠশালা
শিয়ালনীর কানমলা-
হিনিমিনির কাঁচকলা
কবে হবে পড়াখেলা?
দেবোই দেবো লম্বাগুড়ি
দুই কম গোটা কুড়ি
হাতুশির শুঁড় ফোলা
কবে যাবো পাঠশালা?
হে হে হে হে
রে রে রে রে
কবে যাবো পাঠশালা?
কবে যাবো পাঠশালা?
ভেউ ভেউ ভেউ ভেউ…
শেষের ভেউভেউটা কান্না। এত জোরে কান্না জুড়েছে বাঘু যে বাঘিন্নী অব্দি আঁতকে উঠে ছুটে এসেছে বাঘুর কাছে। মাকে দেখে বাঘু থাবা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ধরা গলায় বলল, “মা, মা, আমার ভাল্লাগছে না। আমি পাঠশালা যাবোঁ ওঁ ওঁ ওঁ। দিদিমণির কাছে বকুনি খাবোঁ ওঁ ওঁ ওঁ। হিনিমিনির লেজ ধরে টানবোঁ ওঁ ওঁ ওঁ।”
বাঘিন্নী বাঘুর মাথায় থাবা বোলাতে বোলাতে বলল, “চল বাঘু। আমরা বরং তোর বাঘিপিসীর বাড়ি থেকেই ঘুরে আসি। বাঘি বলছে অনেকদিন ধরে। তুইও ক’টা দিন বাঘনির সঙ্গে খেলে নে।” অমনি বাঘু ফোঁপানো টোপানো ভুলে ফূর্তিতে থাবাতালি দিয়ে উঠল, “কী মজা! কী মজা! বাঘনির বাড়ি চলে যা!”
পরের দিন বাঘু আর বাঘিন্নী যখন বাঘিপিসীর বাড়ি পৌঁছোল, তখন দুপুরবেলা। বাঘিপিসী নরম নরম শীতের রোদে পিঠ দিয়ে বসে আচার খাচ্ছিল। আর বাঘনি খাতা পেনসিল রঙ নিয়ে ছড়িয়ে বসে ছবি আঁকছিল। ওদের দেখে মহা খুশি হয়ে বাঘিপিসী বলে উঠল, “আরে এসো এসো, বাঘিন্নী! আয় আয় বাঘু, তোর কী লম্বা লেজ হয়েছে রে!”
বাঘু বেজায় লজ্জা লজ্জা মুখ করে ভালোবাঘের মত ডানদিকের থাবা দিয়ে বাঘিপিসীর চার থাবায় প্রণাম করল। দেখাদেখি বাঘনিও তার বাঘিন্নীমামীকে থাবাপ্রণাম সারল। বাঘিপিসী বলল, “বাঘু, থাবাটাবা ধুয়ে নে। গরম গরম ভাত আর মাংসের ঝোল বানিয়ে রেখেছি, দুজনে মিলে খাবি আয়।”
বাঘিপিসী আর বাঘিন্নী ভেতরে চলে যেতেই বাঘু ফিরল বাঘনির দিকে, “ছ্যা ছ্যা, কী যে সব ছবি আঁকিস বাঘনি! গাছ-পাতা ফুল-ফল, এসব কি ছবি হল?” বাঘনি ভারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে তুই কিরকম ছবি আঁকিস বাঘুদাদা?” বাঘু বেশ বীরের ভঙ্গিতে গোটা দুয়েক ডিগবাজি খেয়ে বলল, “আমি এমন ছবি আঁকি যে কেউ বুঝতেই পারে না। এমনকি আমি নিজেও না।”
বলেই বাঘু তিন নম্বরের ডিগবাজিটা দিল। আর ডিগবাজি দিয়ে পড়বি তো পড়, পড়ল একেবারে বাঘিপিসীর আচারের বয়ামের উপর আর একটা থাবা পুরো ঢুকে গেল বয়ামের ভিতর। থাবাটা যখন বের করল বাঘু, পুরো আম আর আচারতেলে মাখামাখি। থাবাতে অনেকগুলো আমের টুকরো আটকে আর তেলমশলা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে নির্বিবাদে। বাঘুর তাও হেলদোল নেই, মনের সুখে থাবার আম আর তেল চাটতে শুরু করে দিল। বাঘিপিসী এদিকে খাবার জন্য ডাকতে এসে দেখে এই অবস্থা। বাঘিপিসী আবার কিঞ্চিৎ জাঁদরেল গোছের। এই কাণ্ড দেখে বাঘুকে সটান এক লেজমলা দিয়েই ধমক, “বাঘু, তুই এসেই আবার শুরু করেছিস? তুই পাঠশালায় যা করিস করিস, এখানে ওসব করতে গেলে তোর লেজের কপালে দুঃখু আছে- এই বলে দিলাম।”
বেচারী বাঘু আর কী করে? সুড়সুড় করে গিয়ে খেতে বসল। পাশাপাশি খেতে বসেছে বাঘু আর বাঘনি। বাঘু খেতে খেতে যথা রীতি বাঘনির মাংসের বাটির দিকে থাবা বাড়িয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গেই বাটিটা সরিয়ে নিতে গেছে বাঘনি। বেশ খানিকটা ঝোল পড়েছে মাটিতে আর খানিকটা ঝোল ছিটকে গিয়ে ছপাত করে লাগবি লাগ, লেগেছে বাঘিপিসীর চোখেমুখে গালে। ভয়ঙ্কর বেঘো চোখে চাইল বাঘিপিসী আর তাই দেখে বাঘুর তো মোটামুটি হয়ে গেল। বাঘুর পেট গুরগুর করতে থাকল, নাক ফুরফুর করতে থাকল, কান কটকট করতে থাকল, দাঁত কনকন করতে থাকল। অবস্থা বেগতিক দেখে বাঘিন্নী পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করল, “বাঘু! তোর যদি কিছু লাগে তো চাইলেই পারতিস। চাইলে কি আমরা তোকে দিতাম না ?”
বাঘুর কোন ভাবান্তর নেই। তার মন পড়ে আছে বাঘিপিসীর গাল বেয়ে ঝোল গড়ানোর দিকে। বলল, “মা, বাঘিপিসীর গালটা আমি চেটে পরিষ্কার করে দেব?” রীতিমতো গর্জন করে উঠল বাঘিপিসী, “বাঘু-উ-উ-উ! এত কিছু করেও তোর হল না, না? এবারে আমার গালের ঝোল চাটতে হবে?” যাইহোক, বাঘিন্নী ততক্ষণে বাঘু আর বাঘনি দুজনকেই আরও একবাটি করে মাংসের ঝোল দিল বলে ব্যাপারটা ওখানেই থামল।
পরের দুটো দিনে বাঘু আবার হাঁফিয়ে উঠল। বাঘনির পাঠশালার তো আর ছুটি হয়নি। তার উপর ওদের দিদিমণিরা বেজায় কড়া। অনেক অনেক বাড়ির কাজ দেয়, আর না করে নিয়ে গেলে লেজমলা, কানমলা- এইসব শাস্তি আছেই। তার জন্য বাঘিপিসী রোজ সকাল- সন্ধে দু’দফা বাঘনিকে পড়াতে বসে। আর তার সঙ্গে এখন বাঘুকেও।
প্রথম দিন সকালেই বাঘিপিসী বাঘুকে নামতা লিখতে দিয়েছে দুই থেকে দশ অব্দি। তা বাঘু ভালবাঘের মত মুখ করে জিজ্ঞেস করতে গেছে, “পিসী, একের নামতা লিখব?”
অমনি বাঘিপিসী দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল, “দ্যাখ বাঘু, আমার সঙ্গে চালাকি করতে আসিস না। ওসব চালাকি আমার জানা আছে। তোর বয়সে ওরকম চালাকি আমিও ঢের ঢের করেছি!”
অগত্যা বাঘু বেজার মুখে দুই থেকেই নামতা লিখতে শুরু করল। ছয় অব্দি নামতা লেখার মধ্যে বাঘুর তিনবার তেষ্টা পেল, দু’বার ছোট বাইরে যেতে হল, দু’বার মাথাব্যথা করল, একবার পেটব্যথা করল। ছয়ের নামতা শেষ করেই মেঝেতে গড়াগড়ি দিতে শুরু করল বাঘু। বাঘিপিসী তাই দেখে থাবা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার বাঘু, ওরকম গড়াগড়ি দিচ্ছিস কেন?”
বাঘু গায়ে যথেচ্ছ ধুলো মেখে উঠে বসল, “পিসী, আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে, কান শোঁ শোঁ করছে, নাক টোঁ টোঁ করছে, পেট কোঁ কোঁ করছে। আর তাছাড়া, আমার লেজব্যথা করারও সময় হয়ে গেছে!”
“তবে রে! লেজব্যথা করারও সময় হয়ে গেছে? আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করার আর জায়গা পাসনি বাঘু?”, মেঝেতে লেজ আছড়াতে আছড়াতে গর্জন করছে বাঘিপিসী।
বাঘু অম্লানবদনে বলল, “কেন পিসী, এই তো, বেশ ভালো জায়গাই পেয়েছি।”
বাঘিপিসীর চোখ দুটো ভাঁটার মত জ্বলছে, নাক দিয়ে জোরে জোরে গরমাগরম নিঃশ্বাস পড়ছে, লেজখানা মাথায় উঠে গেছে, “বাঘু-উ-উ-উ-উ! যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা?”
বাঘু ভয়ে ভয়ে ঘাড় নাড়ল, “আচ্ছা পিসী, এরপর থেকে মুখের মাপের মতন কথা বলবো।”
বাঘিপিসী এগিয়ে এসেছে গর্জন করতে করতে, “বাঘু, কোন কথা নয়। নামতা লেখাগুলো শেষ কর। না হলে কিন্তু তোর লেজের কপালে দুঃখু আছে, এই বলে দিলাম।”
বেচারি বাঘু আর কী করে? মনের দুঃখে ছয় থেকে নয় অব্দি নামতা লিখে শেষ করল। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, বাঘনিটা অব্দি ফ্যাকফ্যাক করে তার দুর্দশা দেখে হাসছে। পাঠশালা থেকে ফেরার পর বাঘনিকে পাকড়াও করল বাঘু, “তোর অত মন দিয়ে লেখাপড়া করার কী আছে রে? আমাকে দেখেও শিখতে পারিস না?”
“ইসসস! কী শিখব, বাঘুদাদা? তোর মতন ফাঁকিবাজি? সকালে মা যখন তোকে বকছিল, তোর মুখখানা যা খাসা কাঁচকলা সেদ্ধর মত লাগছিল না!”, বলেই ফিকফিক করে হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল বাঘনি।
তা এরকম পরিস্থিতিতে তো প্রতিবাদ করতেই হয়। বাঘু তাই বাঘনির লেজ ধরে টেনে দিল, কান মলে দিল আর দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল, “আর কোনদিন বলবি এসব?”
কিন্তু বাঘনির গায়েও যে এত জোর, বাঘু ভাবেইনি। বাঘনি বাঘুকে এক ঠেলা দিয়ে ফেলে দিল, তার উপর চড়ে বসল, লেজ টেনে দিল, তারপর কান মুলে দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “বেশ করেছি, বলেছি। আরও বলবো, হাজারবার বলবো।”
বাঘুর তখন হাঁসফাঁস অবস্থা। কোনমতে ছাড়া পেয়ে বাঘু ঘরে গিয়ে ধীরেসুস্থে বাঘনির ছবি আঁকার খাতায় যথেচ্ছ কালি ঢালল, বাঘনির পেনসিলগুলোকে ছুলে ছুলে অর্ধেক মাপের বানালো আর গোটা ঘরময় পেনসিলের খোসা ছড়িয়ে রাখল। তারপর বাঘনির স্লেটে বাঘনির একটা বাজেমত ছবি এঁকে তার তলায় বড় বড় করে লিখল – বাঘনি বিটকেলনি!
বাঘনি এসে দেখেশুনে তো চটল বেজায়। হাঁইমাঁই করে ডাক ছেড়ে স্লেটে বাঘুর আরো বাজে একটা ছবি আঁকল আর তার তলায় লিখল- বাঘু, ফাঁকিবাজির তাঁবু!
তা এরকম জোরকদমে আঁকাআঁকি চললে থাবাথাবি (হাতাহাতির মতন আর কী!) হওয়াটাই স্বাভাবিক! বাঘু আর বাঘনির এমন জোর থাবাথাবি শুরু হল যে বাঘিপিসী তার রঙের বুরুশ আর বালতি নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে হাজির হল। বাঘিপিসী এতক্ষণ তার গুহাঘর রঙ করছিল মন দিয়ে। আর ওদিকে বাঘিন্নী আরাম করে বসে বসে ‘জানোয়ার বার্তা’ কাগজখানা পড়ছিল। চেঁচামেঁচির চোটে কাগজখানা মনের ভুলে মুখে নিয়েই হাঁফাতে হাঁফাতে এল। কাণ্ডকারাখানা দেখে দুজনেরই মাথায় থাবা! বাঘু আর বাঘনিকে টানাটানি করে ছাড়াতে গিয়ে বাঘিপিসীর হাতের রঙের বুরুশ উড়ে গিয়ে এক পোঁচ রঙ লাগল বাঘিন্নীর কপালে। সেখান থেকে কপালে, গালে রঙ পড়তে লাগল গড়িয়ে গড়িয়ে। আর বাঘিন্নীর হাতে ধরা ‘জানোয়ার বার্তা ’ কাগজখানা ফুটো হয়ে বাঘিপিসীর মাথা পেরিয়ে গলায় ঝুলতে থাকল মাফলারের মতন ! বাঘনি ওদিকে গালে থাবা বুলোচ্ছে সমানে আর বাঘুর লেজ ফুলে ঢোল!
………
অযোধ্যা পাহাড়ে ঘুরছে হাতুশি। পাঠশালা ছুটি হয়েছে কয়েকদিন আগে। মায়ের শুঁড় ধরে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছোতে প্রায় বিকেলই হয়ে গেল। হাতুশির মা হস্তিনীর থলেতে একটা দুটো ছোটোখাটো কলাগাছ সবসময়ই থাকে। তাইই খেল হাতুশি। হাতুশির মা কাছাকাছি থাকা একটা দুটো গাছের ডাল শুঁড় দিয়ে ভাঙতে ভাঙতে বলল, “হাতুশি, তুই কি আমার সঙ্গে ঘুরতে বেরোবি না একা একাই যাবি?” হাতুশি শুঁড়খানা মায়ের পেটে বোলাতে বোলাতেই উত্তর দিল, “আমি বরং একাই একটু ঘুরে আসি, মা। তোমার তো দেরি আছে।”
একা একাই বেরিয়ে পড়ল হাতুশি। চারিদিকে কত রকমের গাছপালা। পাখিরা কিচিরমিচির করতে করতে এই ডাল থেকে সেই ডাল করে বেড়াচ্ছে। আকাশের নরম গদিতে সূর্যটা আরাম করে হেলান দিয়ে বসে আছে আর একটু একটু করে পিছলে নেমে যাচ্ছে। যেতে যেতে যেতে যেতে একটা জায়গা ভারি পছন্দ হয়ে গেল হাতুশির। কী সুন্দর নরম নরম সব চিকণ সবুজ রঙের গাছপালা। একটা গাছের ডালের দিকে সবে শুঁড় বাড়িয়েছে হাতুশি, অমনি পেছন থেকে একটা গলা পাওয়া গেল, “অ্যাইয়ো!”
চমকে পিছন ফিরে তাকাল হাতুশি। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। আবার শুঁড় বাড়িয়ে ডালটা ভাঙতে যাবে, অমনি পেছন থেকে আওয়াজ, “অ্যাইয়ো!”
পেছন ফিরল হাতুশি। কিন্তু এবারও কাউকে দেখতে পেল না। একটু দূরেই দুটো বড় পলাশগাছ। তলাটা ঝোপেঝাড়ে ভর্তি । কিছু বুনোফুল ফুটে আছে। কিরকম অন্ধকার ঝুপসিমত হয়ে আছে জায়গাটা। যাইহোক, হাতুশি আর একবার ওপরের দিকে শুঁড় বাড়িয়েছে, অমনি পেছন থেকে কে যেন এসে গায়ে এক ঠেলা দিয়ে বলে উঠল, “ধাপ্পা!”
বেজায় চমকে গিয়ে হাতুশি দেখে, ভালকি! দাঁত বের করে হাসছে। হাসতে হাসতেই ভালকি বলে, “হি হি! কেমন ভয় দেখালাম!”
হাতুশি শুঁড় ওল্টাল, “আমি মোটেই ভয় পাইনি।”
ভালকি হেসেই কুটি কুটি, “ভয় পাসনি? তাহলে যে ওরকম চমকে গাছের ডালটা ছেড়ে দিলি?”
হাতুশি রাগ রাগ মুখে বলে, “অত হাসার কিছু নেই, বুঝলি! পেছনে ওরকম কেউ বললে ঘাবড়ে যাবো না?”
ভালকি বলে, “রাগ করিস না। কুলের আচার এনেছি শালপাতায় মুড়ে। চ, দুজনে মিলে খাই।”
দুজনে মিলে আরাম করে বসে কুলের আচার খেতে থাকে। খেতে খেতেই হাতুশি বলে, “হিনিমিনি গেছে ওর ঠাকুমার বাড়ি। আমি হিনিমিনিকে কত করে বললাম, তুই হনুমতীমাসীকে নিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ে চলে আয়। ও কানেই নিল না। বাঘু আর কুমরুর খবর জানিস?”
ভালকি তারিয়ে তারিয়ে কুলের আচার খেতে খেতে জিভে টকাস করে একটা আওয়াজ তুলে বলল, “বাঘু? সে তো শুনলাম ওর বাঘিপিসীর বাড়ি গেছে। ওর পিসতুতো বোন বাঘনি- তার সঙ্গে নাকি অনেক মজা আর খেলাধূলা করবে।”
হাতুশি চিন্তিত মুখে শুঁড় নাড়ল, “সে তো ঠিকই আছে রে। কিন্তু বাঘুটা যা দুষ্টু, গণ্ডগোল করলে ওর বাঘিপিসী কি আর ওকে আস্ত রাখবে?”
ভালকি মুখের মধ্যে থাকা একটা কুলের বীজ একটু দূরে ছুঁড়ে বলল, “আমিও শুনেছি, ওর বাঘিপিসী খুব কড়া।”
হাতুশি আচারটা শেষ করে শুঁড়ের এক ফুঁয়ে শালপাতাটা দূরের ঝোপের মধ্যে ফেলল। তারপর শুঁড় দিয়ে মুখের ভেতরটা একবার চেটে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আর কুমরু?”
“কুমরু তো শুনলাম মা- বাবার সঙ্গে সুন্দরবনে গেছে। ওখানেই নাকি ওদের আদি বাড়ি। চল্, সন্ধে হয়ে আসছে। মায়েদের খুঁজি।”, ভালকি উঠে দাঁড়ায়।
দুই বন্ধুতে মিলে গল্প করতে করতে ফিরতে থাকে। কিন্তু মায়েরা গেল কোথায়? না হাতুশির মা, না ভালকির মা- কারুরই কোন হদিশ নেই। এদিকে পাহাড়ের বুকে সন্ধে নেমে আসছে দ্রুত। হাতুশি একবার চেঁচায়, “মা মা”, আরেকবার চেঁচায় “ও ভালকিনমাসী”। ভালকি হাঁক দেয়, “মা, ও মা”, আরেকবার হাঁক দেয়, “ও হস্তিনীমাসী”। দুজনের গলাব্যথা হয়ে গেল ডেকে ডেকে, কিন্তু কারুরই কোন পাত্তা নেই।
হাতুশির শুঁড় শুকিয়ে এইটুকু, “হ্যাঁ রে, কোথায় গেল বল তো?”
ভালকিও ভয় পেয়ে গেছে, “কী হবে যদি খুঁজে না পাই?”
হাতুশি শুঁড়টা রাখে ভালকির কাঁধে। ভরসা দেয় বন্ধুকে, “শোন, অত ঘাবড়ে যাস না। চল, আবার খুঁজি। কোথায় আর যাবে? খুঁজে ঠিক পাবোই। ”
আবার খোঁজাখুঁজি, ডাকাডাকি শুরু হয়। কিন্তু মায়েদের না মেলে সাড়া, না মেলে দেখা। শেষকালে এমন অবস্থা হল যে ওরা আর ডাকতেও পারছে না। দুজনেরই গলা শুকিয়ে কাঠ। ভালকি কোনমতে বলে, “আসার সময় আমি ওদিকে একটা ঝরনা দেখেছি। আগে গিয়ে জল খাই।”
হাতুশি কিছু বলে না। খালি শুঁড় দোলায়।
ধুঁকতে ধুঁকতে ওরা গিয়ে পৌঁছোয় ঝরনার কাছে। ঝরঝর কলকল করে অনেকটা উপর থেকে ঝরনার স্রোত নেমে আসছে। যেমন জলের তোড়, তেমনই জোর আওয়াজ। হাতুশি আর ভালকি পেটপুরে জল খেয়ে সামনে দু’পা এগিয়েই দেখে, ঝরনার পিছনদিকে একটা বড় পাথরের চাঁইয়ের উপর বসে মহানন্দে গল্প করছে ভালকিন আর হস্তিনী আর হাসির চোটে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়েছে। ঝরনার জলের আওয়াজেই এতক্ষণ মেয়েদের ডাক ওদের কানে পৌঁছোয়নি। বাচ্চাদের দেখে মায়েরা একটু লজ্জাই পেল। হস্তিনী শুঁড় দুলিয়ে ডাকল, “আয় রে! তোরা কি অনেকক্ষণ ধরে খুঁজছিস?”
ভালকিন হাসল, “ জানিস তো, তোদের মতো আমরাও বন্ধু ছিলাম। শিয়ালনীর মা শিয়ালী দিদিমণির পাঠশালায় আমরা সবাই পড়তাম। খালি কুমরুর মা বাদে।”
হস্তিনী তাকাল ভালকিনের দিকে, “শিয়ালনীকে তোর মনে আছে? তখন এইটুকুনি। মাথায় ফিতে বেঁধে মায়ের সঙ্গে পাঠশালে আসত আর একপাশে বসে আমাদের পড়া শুনত।”
ভালকিন মাথা ঝাঁকাল, “ব্বাব্বা! মনে থাকবে না? বাঘিন্নীও কিন্তু বাঘুর মতোই দুষ্টু ছিল। আর বাঘুর বাবা বাঘরু ভর্তি হয়েছিল অনেক পরে।”
হাতুশি দেখল, মায়েদের গল্প ছেড়ে ওঠার মোটে মন নেই। তাই ভালকিকে ছোট্ট করে এক ঠেলা মেরে ইশারা করে বলল, “মা, মা, আমার খুব খিদে পেয়েছে।”
ভালকিও ইঙ্গিত বুঝল। সেও বায়না জুড়ল, “মা, মা, আমারও না খুব খিদে পেয়েছে।”
বাধ্য হয়ে মায়েদের উঠতে হল। ফিরে এসে তাড়াতাড়ি করে হস্তিনী আর ভালকিন ওদের দুজনকে আলুসেদ্ধ, শসা, পেঁয়াজ, চানাচুর, ছোলা, আচারতেল দিয়ে মশলামুড়ি মেখে খেতে দিল। হস্তিনী বলল, “ভালকিন, ওরা খাক। আমরা বরং ততক্ষণে তাঁবুটা খাটিয়ে নিয়ে রাতের রান্নার জোগাড়যন্ত্র করে ফেলি। তারপর মুড়িমাখা খেয়ে রান্না চাপাব।”
ভালকিন ঘাড় নাড়ল, “সেই ভালো।”
মায়েরা তো কাজকর্মে লেগে গেল। হাতুশি আর ভালকি এদিকে আরাম করে মশলামুড়ি খাচ্ছে। হাতুশি শুঁড় নাড়িয়ে একগাল মুড়ি খেতে খেতে বলল, “বুঝলি রে ভালকি, হিনিমিনিটা এই সময় এখানে থাকলে বেজায় ভালো হত!”
যেই না এই কথা বলেছে হাতুশি, অমনি কে যেন পাশের ঝাঁকড়া গাছটা থেকে এক লাফ মেরে হাতুশির পাতা থেকে এক মুঠো মুড়ি তুলে আবার গাছে লাফিয়ে উঠে গেল! হাতুশি চেঁচাল, “হিনিমিনি!”
হিনিমিনি ধীরেসুস্থে পাশের গাছ থেকে নেমে এল, “মুড়ি মাখাটা বেড়ে হয়েছে রে! দে, আরো খাই।”
ভালকি খানিকটা মুড়ি এগিয়ে দিল হিনিমিনির দিকে, “কিন্তু তুই কখন এসে পৌঁছোলি?”
হিনিমিনি মুড়ি চিবোতে চিবোতেই উত্তর দিল, “এই তো! এসেই দেখি, তোরা মুড়ি খাচ্ছিস। ওই দ্যাখ না, মাও এসে গেল।”
বলতে না বলতেই পাশের গাছ থেকে পিঠে এক বিশাল বস্তা নিয়ে পাশের গাছ থেকে ঝুপ করে নামল হিনিমিনির মা, হনুমতী। এদিকে ততক্ষণে গলার আওয়াজ পেয়ে হস্তিনী আর ভালকিনও এসে পড়েছে। হনুমতীর হাতে ধরা শালপাতার ঠোঙায় আবার গরমাগরম জিলিপি। সকলে মিলে হইচই, হাসি- ঠাট্টা- মজা করে বেশ জমাটি খাওয়াদাওয়া হল। ভালকিন বলল, “বাচ্চারা, রাতের খাবার খিচুড়ি, পাঁপড়ভাজা আর চাটনি। এর বেশি কিন্তু কেউ কিছু চাইবে না।”
হাতুশি শুঁড় তুলে, ভালকি থাবা ছুঁড়ে আর হিনিমিনি লেজ দুলিয়ে জবাব দিল, “চাইব না, চাইব না!”
তাঁবুর ভেতরে শুকনো ঘাসের ওপর ত্রিপল বিছিয়ে তার উপর পুরু করে কম্বল- চাদর বিছিয়ে বিছানা করে দিয়েছে হস্তিনী। বেশ ঠাণ্ডা। এককোণে একটা ছোট লন্ঠন জ্বলছে খালি। লেপের ভেতর জমিয়ে বসেছে ওরা তিন বন্ধু। হাসি, মজা খুনসুটি চলছে জোর তালে। হিনিমিনি বলল, “ভাগ্যিস, পাঠশালে অত ঝামেলা হল! আর তাই দিদিমণি ছুটি দিলেন!”
ভালকি ভুউউস করে লেপের তলায় একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, “তা নইলে কী আর আমাদের এত মজা হত!”
হাতুশি শুঁড়খানাকে লেপের তলায় ঢুকিয়ে নিতে নিতে বলল, “তবে যাই বলিস, বাঘুটা থাকলে আরো অনেক মজা হত!”
যেই না বলেছে হাতুশি, অমনি বাইরে একটা বাচ্চা বাঘের ডাক শোনা গেল আর কে যেন হুড়মুড় করে ওদের লেপের উপর উঠে নাচ শুরু করে দিল!
ভালকি চেঁচামেচি জুড়ল, “বাঘু-উ-উ! গায়ের ওপর নাচানাচি করবি না। লাগছে।”
হিনিমিনি রাগ রাগ গলায় বলল, “বাঘু-উ-উ, তুই থামবি?”
বাঘু গান জুড়ল-
থামিব না, থামিব না,
করিব আমি নাচাগানা।
হাতুশি বলল, “এভাবে হবে না। চল, সবাই মিলে ওকে কাতুকুতু দিই।”
হাতুশি, হিনিমিনি আর ভালকি মিলে শুরু করল বাঘুকে জোরদার কাতুকুতু দেওয়া। বাঘু তো সঙ্গে সঙ্গেই কাবু! এদিকে একবার হাত পা ছোঁড়ে তো ওদিকে একবার, আর বলে, “হি হি… হি হি… ওরে, ছাড় না রে… হি হি হি হি… অ্যাই হি হি ভালকি… হু হু হু হু হিনিমিনি… ওরে ছাড় না রে… হো হো হো হো হাতুশি… ই ই ই… কাতুকুতু লাগে… হি হি হি হি…”।
ওরা আর ছাড়ে! বাঘুকে বাগে পেয়েছে এতক্ষণে! কাতুকুতু দিতে দিতেই সবাই মিলে গান জুড়ল-
বাঘু রে বাঘু,
খাবি কাতুকুতু।
পেটপুরে খেয়ে নিয়ে-
হবি তুই ছাতু।
ওরা সকলে মিলে মনের সুখে গান জুড়েছে, এমন সময় তাঁবুর পর্দা সরিয়ে ঢুকল বাঘুর মা বাঘিন্নী। বাঘিন্নীকে দেখেই তো ওরা সবাই বাঘুকে ছেড়ে দিয়ে সুবোধ জন্তুর মতো মুখ করে এদিক ওদিক বসে পড়ল আর বাঘু হাঁফাতে হাঁফাতে চোখ বড়োবড়ো করে উঠে দাঁড়াল, “মা, জানো এরা সবাই আমার উপর কী অত্যাচারটাই না করছিল এতক্ষণ! আমাকে কাতু দিয়েছে… কুতু দিয়েছে… এমনকি কাতুকুতুও দিয়েছে!”
হিনিমিনি ফস করে বলে বসল, “না জেঠিমা, আমরা শুধুই কাতুকুতু দিয়েছি। আলাদা করে কাতু আর কুতু দিইনি।”
বাঘু অমনি ফিকফিক করে হাসতে হাসতে বলল, “দেখলে মা, হিনিমিনি নিজেই মেনে নিল যে কাতুকুতু দিয়েছে।”
বাঘিন্নী এক দাবড়ানি দিল বাঘুকে, “দিয়েছে, বেশ করেছে। তোকে নিয়ে আমি আর পারি না। ছি ছি ছি, বাঘির ওখানে গিয়ে কী কাণ্ডটা করলি বল্ তো! ইসস, লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়!”
হাতুশি শুঁড় দুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী করেছে গো, বাঘিন্নীমাসী? বেশিদিন তো ছিলেও না ওখানে!”
ফোঁস করে উঠল বাঘিন্নী, “আরে, থাকব কী করে? তোদের বন্ধু বাঘুকেই জিজ্ঞেস কর না! এমন ঝামেলা জুড়ল যে বাধ্য হয়ে দুদিন আগেই চলেই এলাম এখানে।”
ভালকি চোখ গোল গোল করে বলল, “বাঘিন্নীমাসী, তোমার গালে কপালে ওসব কী রঙ লেগেছে গো?”
বাঘিন্নী ফোঁত ফোঁত করে দুটো শ্বাস ফেলে বলল, “সে অনেক কথা। চল, রান্না হয়ে গেছে। খেতে খেতে শুনবি।”
গরমাগরম খিচুড়ি, পাঁপড়ভাজা আর চাটনি খেতে খেতে চোখমুখ গোলগোল করে ওরা শুনতে লাগল বাঘুর কীর্তিকাহিনী। বাঘু বাঘনির খাতায় আজেবাজে ছবি এঁকেছিল বলে বাঘনিও বাঘুর পালটা বাজে ছবি এঁকেছিল। সেই নিয়ে বিশাল কাণ্ড! বাঘিপিসীর রঙের বুরুশ উড়ে এসে বাঘিন্নীর গালে কপালে লেগে একাকার! বাঘিপিসী ভয়ঙ্কর রেগে গিয়ে বাঘুকে একশ বার লেজমলা দিয়ে একশপাতা হাতের লেখা করিয়েছিল, দুশোখানা অঙ্ক করিয়েছিল, আর তিনশোবার বাঘিপিসীর গুহাঘর ঝাঁট দেওয়া করিয়েছিল! সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে বাঘু আবার রাতের বেলা বাঘিপিসী আর বাঘনি যখন ঘুমোচ্ছিল, তখন ওদের দুজনের লেজই বাঘিপিসীর রঙ করার বুরুশ দিয়ে আচ্ছাটি করে রঙ করে দিয়েছিল! এদিকে পরের দিনই ছিল বাঘিপিসীদের বার্ষিক লেজুড় সভা। তার সভানেত্রী হয়েও বাঘিপিসীকে লেজে মাফলার বেঁধে যেতে হয়েছিল আর কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে হয়েছিল যে, লেজে খুব ঠাণ্ডা লেগেছে! আর বাঘনি তো লজ্জায় দুদিন পাঠশালা যেতেই পারেনি। বাঘিপিসীও মহা রেগে গিয়ে বাঘুকে দিয়ে দুশো পাতা হাতের লেখা করিয়েছিল আর একই অঙ্ক দুশো বার করতে দিয়েছিল। তা ওই একই অঙ্ক পঞ্চাশবার করার পরই বাঘুর মাথা ঘুরতে থাকে, পেট ভসভস করতে থাকে, নাক ফসফস করতে থাকে আর তার ফলে বাঘু গোল চক্কর কেটে ঘুরছিল তো ঘুরছিলই। তাকে আর থামানো যায় না। আরো যে কত কী গণ্ডগোল হতে পারে তাই ভেবে একরকম বাধ্য হয়েই বাঘিন্নী বাঘুকে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে অযোধ্যা পাহাড়ে চলে এসেছে!
বাঘুর কাণ্ডকারখানা শুনতে শুনতে ওদের সবারই খাওয়া শেষ। খালি বাঘুরই খুব রাগ হয়েছিল বলে বন্ধুদের সঙ্গে বসে একবার খেল আবার মায়েদের সঙ্গে বসেও আরেকবার খেল। বন্ধুরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে বলে ওদের সঙ্গে শুতেও গেল না। পরে মায়েদের সঙ্গে যখন শুতে গেল, তখন হাতুশি, হিনিমিনি আর ভালকি ঘুমিয়ে কাদা!
পরের দিন খুব ভোরেই হাতুশির মনে হল, কে যেন ডাকছে, “ওরে হাতুশি, হিনিমিনি, ভালকি, বাঘু- কোথায় গেলি রে তোরা সব? এই দেখ! একদম টাটকা খেজুর রস এনেছি। ঊঠে সব খেয়ে নে। নইলে মজা পাবি না।”
তাড়াতাড়ি করে উঠতে গেছে হাতুশি। উঠতে গিয়েই পেছনে এক টান! টনটন করে উঠেছে পেছনটা। তাকিয়ে দেখে, তার আর হিনিমিনির লেজ গিঁট দিয়ে বাঁধা! নির্ঘাত বাঘুর কাজ! ততক্ষণে শিয়ালনী তাঁবুর তলা দিয়ে ঢুকেই পড়েছে, “এই যে হাতুশি, উঠে পড়েছিস দেখছি। নে, নে, খেজুর রস এনেছি। খেয়ে নে। কই গো মায়েরা, উঠে পড়ো সব।”
হাঁউমাঁউ করে উঠেছে হাতুশি, “দিদিমণি, বাঘু না কাল রাতে ঘুমোবার সময় আমার আর হিনিমিনির লেজে গিঁট দিয়ে দিয়েছে। উঠতেই পারছি না।”
এক হুংকার দিল শিয়ালনী, “বাঘু, অযোধ্যা পাহাড়ে এসেও তোর স্বভাব বদলাল না দেখছি। ওঠ, ওঠ বলছি, হতভাগা।”
বাঘু তো লেপের তলায় ঘাপটি মেরে চুপটি করে শুয়ে আছে। হনুমতী উঠে হাতুশি আর হিনিমিনির লেজের বাঁধন খুলে দিল। বাঘু বাদে সবাই উঠে পড়েছে। হস্তিনী আর ভালকিন খেজুর রস সাজিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। বাঘিন্নী গিয়ে বাঘুর কানে এক পোঁচ দিল, “বাঘু! ওঠ, ওঠ বলছি। তোর বাঘিপিসী কিন্তু যেকোন সময় এখানে চলে আসতে পারে।”
বাঘু এবার মিছিমিছি চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসল। ভালকিন এক গ্লাস খেজুর রস দিল বাঘুকে। শিয়ালনী বলল, “বাঘু, আগে তুই আরাম করে খেয়ে নে, তারপর যা হবার হবে।”
আরাম করে খেজুর রস খেল সবাই। খাওয়াদাওয়ার পর শিয়ালনী বলল, “শোনো সবাই। ছাগলীর মা আর গাইসার মাকে আমি আসার সময় খবর দিয়ে এসেছি। ওরা একটু পরে এসে দুধ দিয়ে যাবে। বাচ্চারা একটু পরে একগেলাস করে গরম দুধ খাবে। আর আসার সময় দেখলাম, শজারু ঘুম থেকে উঠেছে। ওর দোকান থেকে আলুর চপ, মুড়ি আর বেগুনি আনলেই হবে।”
ছাগলী একটা বাচ্চা ছাগল। আর গাইসা একটা বকনা বাছুর। সব ব্যবস্থাই করে এসেছে শিয়ালনী। হস্তিনী বলল, “বাচ্চারা, মুখটুখ ধুয়ে তোমরা তৈরি হয়ে নাও। তারপরে খেয়ে নিয়ে সবাই মিলে একসঙ্গে খেলা করো। নো মারামারি, নো ঝগড়াঝাঁটি।“”
জলখাবার খেয়ে তো জোর নাচানাচি শুরু হয়ে গেল ওদের। তাই দেখে ভালকিন শিয়ালনীকে বলল, “হ্যাঁ রে, তুই তো আগে বেশ নাচ করতিস। আজ একটু নাচ কর দেখি ।”
সকলের চাপাচাপিতে নাচ শুরু করল শিয়ালনী। ভালকিন শুরু করল গান গাইতে-
ধিন তা না না না
বাবুই পাখির ছানা,
রঙে রঙে কী বাহার
যেন দেখি আল্পনা!
একটু বাদেই বাঘু বলল, “আমারও না বেজায় নাচ পাচ্ছে। যাই, আমিও গিয়ে একটু নাচানাচি করি বরং।”
বন্ধুরা সবাই হাঁ হাঁ করে বারণ করার আগেই বাঘু গিয়ে শিয়ালনীর চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচ শুরু করে দিল। আর সে কী নাচ! শিয়ালনীর সঙ্গে তার নাচের তাল মোটে মিলছে না, কিন্তু বাঘুর নাচ থামায় কার সাধ্যি! কিছুক্ষণ পরে বাঘু নাচতে নাচতে ভালকির কাছে এসে ধাঁই করে একটা চড় কষাল ভালকির গালে।
ভালকি গেল বেজায় রেগে, “বাঘু, তুই আমাকে চড় মারলি কেন?”
বাঘু নাচতে নাচতেই উত্তর দিল, “কোথায় তোকে চড় মারলাম? মোটেই চড় দিই নি।”
“কী মিথ্যেবাদী তুই রে বাঘু? চড় দিয়ে বলছিস চড় মারিনি?”, ভালকির চোখ রাগে লাল টসটসে।
বাঘু এতক্ষণে নাচ থামিয়ে ফ্যাকফ্যাক করে হাসল, “আরে, ওটা তো নাচের মুদ্রা!”
“নাচের মুদ্রা? তবে রে বাঘু!”, বলেই ভালকি ছুটে দিয়ে ধাঁইধাঁই করে দুই চড় কষাল বাঘুর দু’গালে, “এই নে, অমন নাচ আমিও জানি।”
ব্যস! শুরু হয়ে গেল ঝটাপট, দমাস, দমাস, গদাম! ভালকি আর বাঘুর মধ্যে শুরু হয়ে গেল জোর মারামারি! নাচ থামিয়ে দৌড়ে এসেছে শিয়ালনী, “এ কী রে! তোরা মারামারি করছিস কেন?”
হাতুশি ভারি নিরীহ মুখে বলল, “মারামারি কোথায় দিদিমণি? ওরা তো নাচানাচি করছে!”
শিয়ালনী তো শুনে থ! এদিকে বাঘু দৌড়ে গেছে তাঁবুর ভেতরে। ভেতরে একটা কলসী আছে, সকালেই দেখেছে। ওই কলসীর জলটা ভালকির মাথায় ঢালবে এবার! বাঘুর হাতে কলসী দেখেই ভালকির তো চোখ রসগোল্লার মতো গোল হয়ে গেছে! হাতুশি আর হিনিমিনিও ঠেকাতে গেল বাঘুকে। সকলের চেঁচামেচি, ধাক্কাধাক্কিতে কলসীটা উপুড় হয়ে পড়ল বাঘুর মাথায় আর… কলসী ভেঙে মধু ঝরে পড়তে লাগল বাঘুর মাথায়, গালে, কপালে। শিয়ালনী আর বাঘিন্নী ছুটে এসেছে বলতে বলতে, “বাঘু-উ-উ-উ! তুই-ই যত নষ্টের গোড়া!”
মধুর ভিতর থেকে কোনমতে পিটপিট করে তাকাল বাঘু। আর তখনই চোখে পড়ল, ঊর্ধ্বশ্বাসে ধেয়ে আসছে বাঘনি আর বাঘিপিসী! বাঘনি হাঁফাতে হাঁফাতে বলতে বলতে আসছে, “বাঘুদাদা! আজ তোর হবে। মায়ের দাঁতনের শিশিতে খুব চুন ভরে রেখে দিয়ে আসা হয়েছিল, না?”
……০……
অংকনঃ রিমিল জানা
বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি পড়ুন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করেঃ-