Home / প্রবন্ধ / রূপকথার গল্প, সমালোচনা ও আত্ম-আবিষ্কার- রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

রূপকথার গল্প, সমালোচনা ও আত্ম-আবিষ্কার- রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

 “The whole world is a series of miracles, but we’re so used to them we call them ordinary things.” – Hans Christian Anderson

 

পৃথিবীর সব দেশেই যুগে যুগে রূপকথা রচিত হয়েছে। সর্বদেশের সর্বশ্রেণীর মানুষ রূপকথার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। রূপকথার বহিরঙ্গ বিশ্লেষণে মনে হতে পারে গল্পের টানই এর কারণ, কিন্তু অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণে দেখা যায় এর মধ্যে মানবজীবনের পরম সত্য লুকিয়ে থাকে যা কোনওকালেই মিথ্যে হয়ে যায় না। রূপকথা আমাদের এমন এক মায়ার জগতে নিয়ে যায় যেখানে বাস্তব আর অবাস্তবের সীমারেখা মুছে যায়, লৌকিক ও অলৌকিকের ভেদ ঘুচে যায়। রূপকথার হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলো সংকলিত ও লিপিবদ্ধ করার জন্য জার্মানির গ্রিম ভাইরা (জ্যাকব লুডউইগ কার্ল এবং উইলহেলম কার্ল) অমর হয়ে আছেন। তাঁদের অমর সৃষ্টি ‘The Frog Prince’, ‘The Goose-Girl’, ‘Hansel and Gretel’, ‘Sleeping Beauty’, ‘Snow White’ ইত্যাদি গল্পগুলো যুগ যুগ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের পাঠকদের সম্মোহিত করে রেখেছে। এভাবেই সাহিত্যের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে ফরাসী লেখক শার্ল পেরো-র (১৬২৮-১৭০৩) নাম, যিনি আমাদের ‘Cinderella’, ‘Little Red Riding Hood’, ‘Bluebird’ প্রভৃতি গল্প উপহার দিয়েছেন। বাংলাদেশে এই কাজ করেছেন লালবিহারী দে, তাঁর ‘Folktales of Bengal’ বইটির গুরুত্ব অপরিসীম। একইরকম গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ প্রণেতা দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। বিদেশে নতুন করে যাঁরা রূপকথা লিখেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অস্কার ওয়াইল্ড – ‘The Happy Prince’, ‘The Nightingale and the Rose’, ‘The Selfish Giant’, ‘The Remarkable Rocket’ এবং ‘The Devoted Friend’ প্রভৃতি গল্পগুলি বিশ্বসাহিত্যের সম্পদ বলে বিবেচিত হয়। তবে সকলের কথা মাথায় রেখেও সবথেকে আগে যাঁর নাম করতে হয় তিনি হলেন হান্স ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসন।

১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের ওডেন্স শহরে হান্স অ্যান্ডারসনের জন্ম, ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু। তাঁর পিতা ছিলেন দরিদ্র মুচি এবং মাতা ছিলেন ধোপানী। তাঁর বয়স বারো হওয়ার আগেই পিতার মৃত্যু হয়। হান্সের শৈশব ও বাল্যকাল চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। অল্প বয়সেই লেখাপড়া ছেড়ে তিনি পুতুল নাচিয়েদের দলে ভেড়েন। চোদ্দ বছর বয়সে তিনি কোপেনহেগেন শহরে চলে যান, সেখানে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় অনাহারে অর্ধাহারে তাঁকে দিন কাটাতে হয়েছিল। এই সময় তাঁর কয়েকজন বন্ধু রাজা ষষ্ঠ ফ্রেডেরিককে অনুরোধ করে তাঁকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি তাঁর সেরকম ঝোঁক ছিল না, বরং যা কিছু আগ্রহ ছিল সাহিত্যরচনায়।

বাল্যকাল থেকে কবিতা দিয়ে হান্স অ্যান্ডারসনের লেখকজীবন শুরু হয়েছিল। তারপর সারা জীবন তিনি বহু গল্প-উপন্যাস-নাটক লিখেছেন। কিন্তু রূপকথার গল্পের জন্যই তিনি বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। মূলতঃ ছোটদের জন্য লেখা হলেও বিশ্বের সব দেশের সব বয়সের মানুষই তাঁর রূপকথার গল্পের পাঠক। এই গল্পগুলি ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রকাশিত হতে থাকে, শেষ বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে। সারা বিশ্বের পাঠকদের কাছে ‘The Little Mermaid’, ‘The Emperor’s New Clothes’, ‘The Snow Queen’, ‘The Princess and the Pea’ প্রভৃতি গল্পগুলির আকর্ষণ কোনওদিন কমবে না।

হান্স অ্যান্ডারসনের বেশীর ভাগ গল্পই নিজের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এবং গভীরতর অর্থের আলোকে উজ্জ্বল। তাঁর ছেলেবেলা যে ভয়াবহ দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে কেটেছে তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত “The Little Match Girl” গল্পটিতে। সমাজ ও সংসার সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা বিধৃত হয়েছে “The Ugly Duckling” গল্পে। এটি শুধুমাত্র এক কুৎসিত হাঁসের ছানার রাজহাঁস হয়ে ওঠার গল্প নয়, আসলে এ হল জনৈক হতদিরদ্র মুচির ছেলের হাজারো অপমান ও লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে লেখক হান্স অ্যান্ডারসন হয়ে ওঠার গল্প। অথচ এই গল্পে কোথাও তিক্ততার ছাপ নেই, কারুর প্রতি ক্রোধ বা অভিমান নেই। এই গল্পের মধ্যে জীবনের এক পরম সত্য লুকিয়ে আছে যার ঔজ্জ্বল্য কোনওদিন হ্রাস পাবে না।

“কুৎসিত হাঁসের ছানা” গল্পটি আরও গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করা দরকার। একজন প্রতিভাবান মানুষের প্রতি তার পরিবারের সদস্যরা যে কত হৃদয়হীন আচরণ করতে পারে এই গল্পে তারই প্রতিফলন দেখা যায়। লেখক যেন ইশারায় বলতে চেয়েছেন একদল সাধারণ মানুষের মধ্যে অসাধারণ হয়ে জন্মানোটাই অপরাধ। আর সেই অপরাধের জন্য শাস্তিভোগ করাই  নিয়তির বিধান। কুৎসিত হাঁসের ছানার জ্ঞানত কোনও অপরাধ ছিল না। রাজহাঁসের ডিম হয়ে পাতিহাঁসের ডিমের ভিতরে মিশে থাকাটাই যেন তার অন্যায় হয়েছিল। এখান থেকেই তার জীবনে যত অপমান ও লাঞ্ছনার শুরু। পাতিহাঁসের ডিমগুলো একে একে ফুটতে থাকে, বেরিয়ে আসে ফুটফুটে ছানারা। কিন্তু রাজহাঁসের ডিমটা বেঢপ, অন্য ডিমগুলোর মত নয়। তারপর একদিন রাজহাঁসের ডিমটা ফুটতেই যে হাঁসের ছানাটা বেরিয়ে আসে সে দেখতে অন্যদের মত নয়। আর এটাই হয়ে দাঁড়ায় তার মহা অপরাধ। আশেপাশের হাঁসের দল প্রতিনিয়ত কুৎসিত হাঁসের ছানাটাকে অপমান করে, আক্রমণ করে। নিজের সন্তান মনে করে তার উপর মায়ের একটা সহানুভূতি ছিল বটে, কিন্তু অন্য হাঁসেরা তাকে দেখলেই তাড়া করে। এমনকী মুরগীরাও তার পিছনে লাগতে ছাড়ে না। ভয়ে জড়সড় কুৎসিত হাঁসের ছানা এই অসহনীয় অবস্থার প্রতিবাদ করতে পারে না, শুধু মন খারাপ করে একপাশে পড়ে থাকে। দিন দিন তার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। ভাইবোনেরা তাকে প্রতিনিয়ত দূরছাই করে, এমনকি একদিন মা পর্যন্ত ধৈর্য্য হারায়। সকলেই তাকে তেড়ে মারতে আসে, অন্য হাঁসেরা তাকে কামড়ায়, মুরগীরা তাকে খোঁচায়। সব বুঝতে পেরেও সে চুপ করে থাকে। যে মেয়েটি রোজ তাকে খাওয়াতে আসে, সে-ও একদিন তার গায়ে লাথি মেরে চলে যায়। এভাবে কতদিন এই পরিবারে থাকা সম্ভব! কুৎসিত হাঁসের ছানা একদিন এই হৃদয়হীন পরিবার ছেড়ে চলে যায়। তার উদ্দেশ্য স্বাধীনভাবে নিজের মত করে বাঁচা।

সব শিল্পীই নিজের মত করে বাঁচতে চায়। অঁদ্রে জিদ একদা লিখেছিলেন – “Families, I hate you.” এখানেই না থেমে তিনি আরও লিখেছিলেন – “There is nothing more dangerous for you than your family, your own room, your own past. . . . You must leave them.” মিলান কুন্দেরা একটি রচনায় লিখেছেন ইবসেন, স্ট্রিন্ডবার্গ, জয়েস, সেফেরিস একথা জানতেন বলেই, “they spent a large part of their lives abroad, away from family’s power.” এই প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে কাফকা ও বেকেটের কথা, কারণ তাঁরাও বাড়ি ছেড়েছিলেন। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিখ্যাত জার্নালে অঁদ্রে জিদ বলেছেন, “my whole soul longs for that nomadic state.” তারপরেই তিনি জানিয়েছেন – “I do not find a single word of Christ that strengthens, or even authorizes, the family and marriage.” প্রসঙ্গত জানাই হান্স অ্যান্ডারসনও সারাজীবন অবিবাহিত ছিলেন।

যাদের প্রতি সংসারে আবদ্ধ মানুষের দায়বদ্ধতা থাকে তাদের দেখাশোনা করতে করতেই সে একদিন নিঃশেষিত হয়। পরিবার তাকে ক্রমাগত শোষণ করে ছিবড়ে করে ফেলে, বাইরের পৃথিবীকে তার আর দেওয়ার কিছু থাকে না। পরিবার যে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে তার উদাহরণ দিতে গিয়ে দুটি কাহিনীর উল্লেখ করব – একটি টলস্টয়ের গল্প “Death of Ivan Illyich” এবং অন্যটি কাফকার কালজয়ী সৃষ্টি “The Metamorphosis”।  ইভান ইলিচ এবং গ্রেগর সামসা উভয়েই নিজের পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য উৎসর্গীকৃতপ্রাণ ছিল। কিন্তু বিনিময়ে তারা মৃত্যুর সময় কারুর থেকে একটু সহানুভূতিও পায় নি, বরং তাদের মৃত্যুতে পরিবারের সকলে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল।

কুৎসিত হাঁসের ছানা পরিবার ও সংসার থেকে পালিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বাইরের বিরাট দুনিয়াও তার কাছে খুব সুখকর হয়নি। প্রথমেই ঝোপের পাখিরা তাকে দেখে ভয়ে পালিয়েছিল। তারপর নিজে উড়ে পালাতে পালাতে সে একটা মস্ত বিলে এসে পড়ে। সেখানে সারারাত কাটানোর পর ভোরের দিকে দুটো হাঁস তার দিকে উড়ে এসে জানিয়ে গিয়ে গেল সে বড়ই কুৎসিত। শান্তিতে কাটানোর বাসনায় সে বিলের মধ্যে দুদিন রইল, তারপর এল একদল শিকারী ও তাদের সঙ্গে একটি কুকুর। কুকুরটা তাকে হিংস্র চোখে দেখলেও কিছু বলে নি। হাঁসের ছানা ভেবেছিল সে কুৎসিত বলেই কুকুরটার পর্যন্ত তাকে কামড়াতে ইচ্ছে হয় নি। এই বিপজ্জনক স্থান ছেড়ে আবার পালিয়ে গিয়ে সে এক চাষার ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে এল। সেখানে থাকত এক বিড়াল ও এক মুরগী, এবং এক বুড়ি। যেহেতু সে মুরগীর মত ডিম পাড়তে পারে না বা বিড়ালের মত পিঠ বাঁকিয়ে গোঁ গোঁ করতে পারে না, কেবল জলে সাঁতার দিতে পারে, তাই এখানেও তার জায়গা হয় নি। এখান থেকে বেরিয়ে পড়ার পরেও সমস্যা তার পিছনে ধাওয়া করে। সে কুৎসিত হওয়ার কারণে যেখানেই যায় সেখানেই তাড়া খায়, সকলে তাকে দূর দূর করে। তারপর একদিন সে একঝাঁক রাজহাঁস দেখতে পায়। রাজহাঁসদের দেখে তার ভাল লেগেছিল এবং তাদের ভালবেসে ফেলেছিল। এটাই তো স্বাভাবিক, কারণ সে যে তাদেরই একজন। তবে সে নিজেও যে রাজহাঁস সেটা তার কাছে তখনও অজানাই ছিল। একদিন প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় সে জলাশয়ের বরফের মধ্যে আটকে গিয়ে হিম হয়ে জমে যায়। একজন কৃষক তাকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসে। বাড়ির ছেলেরা তার সঙ্গে খেলতে চাইলেও সে ভয় পেয়ে উড়ে গিয়ে একবার দুধের কড়ায় পড়ে, আবার মাখনের বাটিতে, আবার খাবারের থালায়। বাড়ির গিন্নি রেগে গিয়ে তাকে মারতে গেলে সে কোনওক্রমে উড়ে পালায়। আরও পরে অবশ্য সে নিজেকে জানতে পারে, যখন শীত ও বর্ষা কেটে গিয়ে শরৎকালের আগমন ঘটে। সে বিলের জলে গা মেলে দেয়, কাকচক্ষু জলে নিজের ছায়া দেখে আত্ম-আবিস্কার করে। এখানেই তার নবজন্ম হয় এবং সে নিজের প্রকৃত সত্তাকে চিনতে পারে।

চারপাশে হৃদয়হীন লোকেদের মধ্যে থেকেও  রূপকথার গল্পের কুৎসিত হাঁসের ছানা বাঁচার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল। গল্পকার হান্স অ্যান্ডারসনের নিজের জীবনটাও যে এরকমই। প্রতিভাবানদের জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায় সাধারণ মানুষদের ভিড়ে অসাধারণ হয়ে জন্মানোটাই যেন এক মস্ত অপরাধ বলে গণ্য হয়। জগৎসংসারের কাছে বরেণ্য বলে স্বীকৃতি পাওয়ার আগে কত না লাঞ্ছনা, অপমান তাঁদের সহ্য করতে হয়। এর স্বপক্ষে বহু উদাহরণ দেওয়া যায় – দার্শনিক সক্রেটিশকে হেমলক বিষ পান করে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল, বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে ধর্মযাজকদের কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হয়েছিল, সাহিত্যিক দান্তে প্রাণভয়ে ফ্লোরেন্স ছেড়ে পালিয়েছিলেন, সংগীতস্রষ্টা বাখকে একমাস কারাবাস করতে হয়েছিল, সুরস্রষ্টা মোৎসার্ট কতৃপক্ষএর হাতে চরম অবমাননা সহ্য করেছিলেন, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে রবীন্দ্রনাথকে অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছিল, অধুনা লেখক সলমন রুশদীকে কম ভুগতে হয়নি।

প্রতিভার অধিকারী হওয়াটা বরাবরই প্রতিভাবানদের জীবনে এক অদ্ভুত সমস্যা। শুধুমাত্র এই কারণবশতঃ সাধারণের দল তাঁদের উপর কম অত্যাচার তো করেন না! কখনও ধর্মের ধ্বজাধারীরা, কখনও রাজনীতির কারবারিরা, কখনও অজ্ঞ বা অর্ধশিক্ষিত সমালোচকরা তাঁদের তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন। শেক্সপীয়র সম্বন্ধে রবার্ট গ্রীণ মন্তব্য করেছিলেন, ‘an upstart crow, beautified with our feathers.’  শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন পোড়ানো হয়েছিল। জীবনানন্দের কবিতা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেননি, এই দুর্বোধ্যতার কারণে কবি-লেখক-সমালোচকেরা তাঁকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন। সত্যজিত রায়ের ছবি পথের পাঁচালী বুঝতে না পেরে সমালোচক মন্তব্য করেছিলেন – “pad pad pad through the paddy fields.” আবার রাষ্ট্র কখনও কখনও অত্যাচারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় – রাশিয়া, চীন, নাৎসি জার্মানি, কিউবা প্রভৃতি দেশের ক্ষেত্রে একথা খুব বেশী করে প্রযোজ্য। রাশিয়ার সুরস্রষ্টা প্রোফোকিয়েভের সংগীত সম্পর্কে একদা বলা হয়েছিল, ‘decadent formalism’ এবং তা নাকি ‘unable to reflect the greatness of our people.’ আর শস্তাকোভিচের সংগীত প্রসঙ্গে প্রাভদায় মন্তব্য করা হয়েছিল, ‘muddle instead of music’ কিউবার লেখক রোনাল্ডো এ্যারেনাসের পাণ্ডুলিপি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল এবং তাঁকে জেলে ঢোকানো হয়েছিল। শেষে বাঁচার জন্য তিনি আমেরিকায় পালিয়ে যান।

লেখকরাও তো অন্য লেখকদের সমালোচনা করতে পিছপা হন না। ভিক্টর হুগোর মত বড় মাপের সাহিত্যিক স্তাঁদালের ‘Red and Black’ উপন্যাস সম্পর্কে একজনকে বলেছিলেন, ‘I have tried to read it . . . . But how you were able to continue beyond the fourth page?’ আসলে হুগো মনে করতেন এটি অত্যন্ত দুর্বল রচনা। এমনকি স্যঁৎ বোভের মত সমালোচকও স্তাঁদালকে বুঝতে ভুল করেছিলেন। অনেক বিদগ্ধজন তাঁর সম্পকে বলে থাকেন ‘had no style’। বালজাকের কথাই ধরা যাক, সমকালের অনেকেরই মতে যিনি ‘was no creator’। তাঁর ‘Old Goriot’ সম্পর্কে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে এক সমালোচক বলেছিলেন, ‘We advise no woman to read this volume.’ এর কারণ বইটির বিরুদ্ধে ছিল ‘brutal realism’ এবং ‘materialism’-এর দ্বিমুখী অভিযোগ ছিল। কেউ কেউ তো আবার এরকমও মন্তব্য করেছেন বইটির সবথেকে বড় ত্রুটি হল ‘lack of moderation and of method’।

গুস্তাভ ফ্ল্যবেরের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা মাদাম বোভারী উপন্যাসটির কপালেও অনেক সমালোচনা জুটেছিল। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে স্যাঁত বোভ এক মহিলাকে এই বইটি সম্পর্কে লিখে জানিয়েছিলেন – “I do not advise you to read this novel. It is too raw for the majority of women and it would offend your feelings.”  জনৈক সমালোচক একটি পত্রিকায় মাদাম বোভারী সম্পর্কে লিখেছিলেন এই উপন্যাসে সত্য নেই, মৌলিকতা নেই এবং এটি বালজাকের অনুকরণ। আরও একজন অভিমত প্রকাশ করেন – “There is neither emotion nor feeling nor life in this novel.” মার্সেল প্রুস্তকেও অনেক আক্রমণ ও সমালোচনা হজম করতে হয়েছিল। প্রুস্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তাঁর গদ্যে  ল্যাটিন ভাষার শৃঙ্খলা, স্পষ্টতা বা ভারসাম্য নেই। সমালোচকরা অভিমত প্রকাশ করেছিলেন তাঁর গদ্য নাকি অপরিচ্ছন্ন।  প্রুস্তকে সেন্সর করা হয়েছিল, কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল কী করে শুদ্ধ ফরাসী লিখতে হয় তা তিনি জানেন না। দুঃখের বিষয় হল অঁদ্রে জিদের মত বরেণ্য লেখকও প্রুস্তকে বুঝতে পারেননি।

বিখ্যাত ফরাসী সংগীতস্রষ্টা ক্লদ দ্যবুসি-র শিক্ষক তাঁর ছাত্রের সংগীত শুনে বলেছিলেন – “I’m not saying that what you do isn’t beautiful, but it’s theoretically absurd.” একথার জবাবে দ্যবুসি বলেছিলেন – “There is no theory. You merely have to listen. Pleasure is the law.” শিল্প-সাহিত্য-সংগীত ও বিভিন্ন সুকুমার কলা বিষয়ে এটাই শেষ কথা। কেবল খুঁত ধরার জন্যই সমালোচনা করা কখনই প্রকৃত সমালোচকের কাজ নয়। কিন্তু কুৎসিত হাঁসের ছানার মত শিল্পী-সাহিত্যিকরা যুগে যুগে সমালোচকদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছেন। ঘর-সংসার ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েও তাঁদের রেহাই নেই, বাইরের জগৎটাও পরিবার-আত্মীয়স্বজনদের মত একইরকম হৃদয়হীন।

কোনও মানুষই শিল্পী হয়ে মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হন না, তাঁকে কাজের মাধ্যমে শিল্পী হয়ে উঠতে হয়। যে কোনও শিল্পীর জীবনে আত্ম-আবিস্কার একটা বিরাট বড় ব্যাপার। যেদিন সে নিজেকে চিনতে পারে সেদিন তার নবজন্ম হয়, যখন সে নিজেকে আবিস্কার করতে পারে তখন থেকেই সে শিল্পী হতে শুরু করে। তখন সে বুঝতে পারে আর পাঁচজনের মত সাধারণ নয়, অন্যদের থেকে সে আলাদা। রূপকথার গল্পের কুৎসিত হাঁসের ছানা অপমানিত, অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হতে হতে একদিন জলাশয়ের টলটলে জলে নিজের ছায়া দেখেছিল। তখন সে নিজেকে চিনতে পেরেছিল। তখন বুঝেছিল সে কুদর্শন বেঢপ পাখির ছানা নয়, আসলে সে রাজহাঁস যে কিনা হাঁসেদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। পাতিহাঁসের ঘরে জন্মালে কী হবে, তার ভ্রুণ সুপ্ত ছিল রাজহাঁসের ডিমের মধ্যে। গল্পকার হান্স অ্যান্ডারসনের জীবনও তো তাই। তাঁর বাবা ছিলেন দরিদ্র মুচি, মা ধোপানী, চরম অভাবের মধ্যে তাঁর বড় হয়ে ওঠা। কিন্তু কোথায় এবং কোন পরিবেশে তাঁর জন্ম হয়েছিল তাতে কিছু যায় আসে কী? আসল কথা হল নিজেকে চেনা। কার মধ্যে কী সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে কেউ জানে না। নিজের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ যেদিন ঘটবে, সেদিন সারা দুনিয়ার মানুষ তাকে চিনতে পারবে, যে কারণে রূপকথার গল্প লিখে হান্স অ্যান্ডারসন সারা দুনিয়ার পাঠকদের কাছে এতটা সমাদৃত হয়েছেন। এই সত্য উপলব্ধি করেছিলেন বলেই তিনি লিখতে পেরেছিলেন – “Life itself is a wonderful fairy tale.”

 

………0………

 

 

 

 

 

Leave a comment

Check Also

একুশে ফেব্রুয়ারি

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো : একটি গান ও দুই বাংলার মিলনসেতু – বদরুদ্দোজা হারুন

[ভাষা শহীদ আবুল বরকতের ৯৬ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে লেখা l]   “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো …

মহাশিল্পী রবিশংকর : ভারতের মোৎসার্ট – রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

  বিশ্বের সংগীতপ্রেমীদের কাছে রবিশংকর ও মোৎসার্ট দু’টি নামই সুপরিচিত। উভয়েই বহুশ্রুত হলেও সংগীতের গভীরে …

pablo neruda

পাবলো নেরুদা : জীবন ও কবিতার সংরাগ – রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

।। এক।। দক্ষিণ আমেরিকার তিনজন অসীম প্রতিভাশালী কবি হলেন সোর জুয়ানা ইনেস ডি লা ক্রুজ, …

দু’একটা সত্য কথা – সুদীপ্ত বিশ্বাস

মাত্র ১০০০০ বছর আগে কোনো ধর্মই ছিল না। ছিলনা ধর্ম-ধর্ম করে মানুষের সাথে মানুষের বিভেদ। …