Home / কিছু ভাবনা কিছু চিন্তা / গোলাপী নীলের দুনিয়া- জলছবি  

গোলাপী নীলের দুনিয়া- জলছবি  

(জলছবি বেচারি একেই খানিক আলসে, তার ওপর নানা কারণে পুরো ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিল বহুদিন। যাই হোক, বিস্তর জিভ টিভ কেটে বেচারি আবার হাজির হয়েছে আপনাদের দরবারে। ভাবখানা এই যে কাঁদুনি গেয়ে আপনাদের মন ভোলাবে। যাই হোক, কিছু সহৃদয় পাঠক তার অন্তর্ধানে বড়ই বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। বেচারি করজোড়ে মাফ চাইছে। যদিও সে যে ফের উধাও হবে না, সে গ্যারান্টি সে নিজেও দিতে পারছে না। অগত্যা ছুঁচো গেলার মতোই তাকে পেশ করা গেল…)

বছর তিনেক আগে। এক মফস্বল শহরের পরিচিত এক দোকানে গেছি বিশেষ এক নামী চকলেট কিনতে। পরিচিত বয়স্ক দোকানদার, মুখে হাসির অভাব বড় একটা দেখিনি। উদ্দিষ্ট ব্র্যাণ্ডটির নাম করায় তিনি পালটা প্রশ্ন করলেন- ‘ছেলে না মেয়ে?’ ঘাবড়েই গেলাম কিছুটা। চকলেটের আবার ছেলে মেয়ে কি? ঠিকঠাক শুনতে পাননি ভেবে ফের বললাম ব্র্যাণ্ডটির নাম। তিনিও ফের বললেন, ‘সেটাই তো বলছি, ছেলে না মেয়ে?” নিজের নির্বুদ্ধিতা প্রকট হবে জেনেও মনের প্রশ্নটা করেই ফেললাম। এবারে উনি সস্নেহে বোঝালেন, এই চকলেটগুলোর প্রতিটাতে বাচ্চাদের জন্য চকলেটের সঙ্গে একটা করে খেলনা থাকে। ছেলেদের জন্য পিস্তল, গাড়ি এইসব। আর তার মোড়কের গায়ে থাকে নীল রঙ। আর মেয়েদের গুলোতে খেলনা থাকে লিপস্টিক, পুতুল এইসব। গোলাপী রঙে রাঙানো তার মোড়ক।

একটা ঠোকর খেয়েছিলাম সেদিন। আরো একটা ঠোকর খেলাম কিছুদিন পর। মেয়ের জন্মদিনে মেয়ে একটি বই উপহার পেল- স্টোরিজ ফর গার্লস। শিশুপাঠ্য বইয়েরও তবে লিঙ্গ ভেদাভেদ হয়? বইটি নেড়েচেড়ে দেখলাম। প্রায় সব গল্পেরই প্রতিপাদ্য এক- মেয়েদের বরলাভ। আরো পরিষ্কার করে বললে, রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে। মেয়েদের সাহস, বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নেই যে তা নয়, তবে তা যৎসামান্য। পরে একইরকম আরো কিছু বই চোখে পড়ল- স্টোরিজ ফর বয়েজ। রাজা বা রাজপুত্রদের শৌর্য, বীর্য, বুদ্ধিমত্তার পরিচয় তার পরতে পরতে সুন্দরভাবে বোনা।

বিপদটা এইখানেই। ছোটবেলা থেকে মেয়েদের মনে নিখুঁতভাবে বুনে দেওয়া হচ্ছে মেয়েদের শুধুমাত্র ‘মেয়ে’ হবার প্রাথমিক শর্তগুলো। একইসঙ্গে ছেলেরাও জানছে, ঠিকঠাক ‘পুরুষ’ হবার জন্য কী কী প্রয়োজন এবং সঠিক পুরুষ হতে পারলে ‘প্রাইজ মানি’ হিসেবে একটি কোমল, পেলব নারী পাওয়ার সম্ভাব্যতা। ভারতের মতো দেশে চিরন্তন লিংগবৈষম্যের ধারণাগুলি একপক্ষে যেমন স্বাধীনতার পরের দশকগুলিতে অনেকটাই ঝিমিয়ে এসেছে, তেমনি নতুন বিপদের অশনি সঙ্কেত ঘনিয়ে আসছে পশ্চিমী ভোগবাদ ও বাজারি অর্থনীতির হাত ধরে। এবং সেই দুনিয়ায় গোলাপী জামা পরা ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেটির তার সহপাঠী বা সহপাঠিনীদের টিটকিরির শিকার হওয়া নিতান্তই স্বাভাবিক ঘটনা।

স্বাধীনতার পরবর্তী দশকগুলোতে একপক্ষে সমাজে মেয়েদের নিয়ে চিরায়ত ধারণার বদল ঘটেছে ও ঘটছে। একইসঙ্গে নতুন নতুন কাঁটাও গজাচ্ছে নিত্যদিন। শিশুপাঠ্য বাংলা বইগুলির কথা ছেড়েই দিলাম, কিন্তু ইংরেজি শিশুপাঠ্যগুলিও কি এই রোগ থেকে মুক্ত? উত্তর একটাই। প্রবল না।  ইংলিশ মিডিয়ামের জগতে মায়েরা কেক বেক করে, বাবারা নিউজপেপার পড়ে। সেই জগতে ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার ইত্যাদি তথাকথিত উচ্চকোটির পেশায় ছেলেদেরই দেখা যায়, এবং মেয়েদের জন্য শিক্ষকতা ছাড়া আর বিশেষ কিছু পড়ে থাকে না। কোন বাচ্চা যদি ফাদার/ মাদার দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করতে গিয়ে লেখে, ‘ফাদার ইজ কুকিং ইন দা কিচেন’, তাহলে হয় সে গোল্লা পাবে, নাহয় মিসের (বা স্যারের) প্রবল টিটকিরির শিকার হয়ে বাড়ি ফিরবে। সেখানে জন নামের বালকটি টয় ট্রেন নিয়ে খেলা করে, তার বোন লুসি খেলে পুতুল নিয়ে। প্রিন্সেসরা সেখানে ‘ডেলিকেট’, ‘টেণ্ডার’; প্রিন্সরা চিরাচরিত পৌরুষের ধ্বজাধারী। সাতখানা তোশকের তলায় একটা চুল থাকলে যে মেয়ের রাতে ঘুম হয় না, প্রিন্সেস হিসেবে সেই তো আদর্শ।

হয়তো এই চিত্রগুলোই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সত্যি। কিন্তু মারাত্মক ক্ষতিকর যেটা, সেটা হচ্ছে যে এর ফলে শিশুমানসে অজান্তেই বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়ে যায় যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বেশি সম্মানের জায়গাগুলি ছেলেদেরই একচেটিয়া। আমরা যখন খুব সাধারণভাবে কোন বিচারক, উকিল, ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার ইত্যাদির আলোচনা করি, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের মননে যে রূপকল্পটি হানা দেয়, সেটি কোন পুরুষের। এর ফলে ক্ষতি হচ্ছে কিন্তু ছেলে মেয়ে উভয়েরই। ভবিষ্যতে যখন হয়তো স্ত্রীটি কর্মদক্ষতা বা কার্যকুশলতায় এগিয়ে যান স্বামীর থেকে, আবাল্য শিক্ষালাভের ফলে লব্ধ পুরুষ-নারীর সমীকরণটি কোথাও ধাক্কা মারে পুরুষ অহং- এ। এবং এর ফলে উদ্ভূত সমস্যা নারীটিকে ঠিক ততটাই আঘাত করে, যতটা আঘাত করে পুরুষটিকে।

বাচ্চাদের জন্য নির্মিত বিভিন্ন কার্টুন ইত্যাদির ক্ষেত্রেও সেই একই গল্প। মহাভারতের মধ্যম পাণ্ডবের নামাঙ্কিত প্রবল জনপ্রিয় কার্টুনটির মুখ্য চরিত্রটিও একটি ছেলেই- যার সাহস, বুদ্ধিমত্তা বারংবার আমাদের মুগ্ধ করে। একইসঙ্গে তার পার্শ্ববর্তিনী মেয়েটি প্রায়শই লম্বা বেণী, গোলাপী আভারঞ্জিত দুই গালসহ ছেলেটির বিশ্বস্ত সঙ্গী।  যেসব ছেলেদের এবং মেয়েদের এইসব কার্টুন একান্ত সঙ্গী, নারী- পুরুষের সামাজিক বিভাজনের রূপরেখাটি নিজেদের অজান্তেই তাদের মনে একটা আদল করে নিচ্ছে।

মুশকিলটা এখানেই। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেয়েরা (এবং ছেলেরাও) কী ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছে, সেটা দেখার বা ভাবার মত অবসর আমাদের প্রায়ই থাকে না। ফলতঃ এই পুং- অহং বনাম উঠতি নারীসত্তার দ্বন্দ্ব আমাদের সমাজজীবনে এক অমোঘ বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লিংগবৈষম্যের প্রাথমিক ধারণা শিশুমনে উঠে আসে তিনটি জায়গা থেকে- তার বাড়ি, বিদ্যালয় এবং তার আশপাশের সামাজিক পরিসর থেকে। বাড়ির মধ্যে মা বা পরিবারের অনান্য নারীদের অবস্থান থেকেই শিশুমন প্রাথমিক ধারণাটুকু করে নেয় পুরুষ নারীর অবস্থানের তারতম্যটুকু। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শিশুটি তার চারপাশের পরিবেশে কী দেখছে বা শুনছে। এবং এই দেখা বা শোনাকে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা কার্যত অসম্ভব। কিন্তু যেটা করাই যায় এবং করা একান্ত আবশ্যক, সেটা হল, শিশুপাঠ্য পুস্তকগুলিকে, লিঙ্গবৈষম্যের ব্যাধি থেকে মুক্ত করা। এবং এটা খুব আয়াসসাধ্যও নয়। সামান্য সদিচ্ছা থাকলেই সমতার ধারণাটুকু কিন্তু শিশুমনে বুনে দেওয়া যায়। এবং সেটা ভবিষ্যৎ পুরুষ ও ভবিষ্যৎ নারী উভয়ের পক্ষেই মংগলকর।

মহিলাদের প্রতি প্রতিনিয়ত বেড়ে চলা অত্যাচার- পণের জন্য বধূহত্যা, খুন , ধর্ষণ, ইভটিজিং কিন্তু পুরো ভারতেই এক জ্বলন্ত সমস্যা। এবং সমস্যার মূল উৎস একটাই। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় মেয়েদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে ভাবা। যাদের নিয়ে যা খুশি তাই করা যায়। এই মানসিকতার বদল ঘটানো একান্ত আবশ্যক এবং সেই শিক্ষাটুকু একটি শিশু যত ছোটবেলাতে পায় ততই কল্যাণকর।

শিশুদের দুনিয়ায় গোলাপী- নীলের তফাত নাই বা থাকল!

 

আরো পড়ুন : কিছু ভাবনা কিছু চিন্তা 

 

………০………

 

Leave a comment

Check Also

Tagore কে আমি like করি

Tagore কে আমি like করি – মৌসুমী পাত্র

  হ্যাঁ, এটা ট্রু যে আমি টেগোরকে লাইক করি। আর করবো নাই বা কেন? এই …

শিল্পী- পুণ্যতোয়া

এত যুদ্ধ কেন ? – সুমেধা ভৌমিক

                              …

ঈশ্বরঃএজেন্ট ও মার্কেটিং

ঈশ্বরঃ এজেন্ট ও মার্কেটিং – সুদীপ্ত বিশ্বাস

    যে কোনও প্রোডাক্ট মার্কেটে বিক্রির জন্য ভালো মার্কেটিং এর জুড়ি নেই। মার্কেটিং ঠিকঠাক …

হেসে কেশে ভালোবেসে

হেসে কেশে ভালোবেসে- সোমক সেনগুপ্ত

    বড়, উন্নত শহর মানেই পেল্লাই সব বাড়ি। যেমন বই এর তাকে বই রাখা …