Home / প্রবন্ধ / বাস্তবমুখী সাহিত্যিক আলবের্তো মোরাভিয়া -রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

বাস্তবমুখী সাহিত্যিক আলবের্তো মোরাভিয়া -রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

predictive-litterateur-alberto-moravia-rc
Alberto Moravia

“Good writers are monotonous, like good composers. They keep trying to perfect the one problem they are born to understand.” – Alberto Moravia

ইতালিয় সাহিত্যিক আলবের্তো মোরাভিয়া প্রসঙ্গে আলোচনার প্রথমেই বলতে হয় নিজের রচনায় তিনি যে জগৎ সৃষ্টি করেছেন তার কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। সে জগতে পরিব্যপ্ত দুর্নীতির কালো ছায়া, সে হল এমন এক জগৎ যাতে প্রতিফলিত হয়েছে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের সার্বিক অবক্ষয়। তাঁর সৃষ্ট জগতে যে মানুষদের দেখা মেলে তারা নিজেদের অনুভূতির দ্বারা পরিচালিত হয়। আরও একধাপ এগিয়ে বলা চলে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি পুরোপুরিভাবে নিজেদের চেতনার দ্বারা চালিত হয়। তাঁর জগতে ভালোবাসার থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হল আধুনিক মানুষের জীবনে যৌনতা-সংক্রান্ত বিষয়, আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে তা হল প্রেমবিহীন যৌনতা। তার পাশাপাশি রয়েছে সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবোধ, রয়েছে মার্কসবাদ, রয়েছে অস্তিবাদের ধারণা। মোটের উপর বলা চলে বিংশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ দর্শনগুলি তাঁর রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে। তার সঙ্গে অবশ্যই অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে মনস্তত্ত্ব।
১৯০৭ সালের ২৮ নভেম্বর রোম শহরে আলবের্তো মোরাভিয়ার জন্ম, মৃত্যু ১৯৯০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। তাঁর আসল নাম আলবের্তো পিত্রচারলে, মোরাভিয়া হল ছদ্মনাম। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, সমালোচক, চিত্রনাট্যকার, সাংবাদিক এবং সম্পাদক। বয়ঃসন্ধির সময় তিনি অস্হির কঠিন ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং প্রায় বছর পাঁচেক তাঁকে শয্যাশায়ী হয়ে কাটাতে হয়। এর ফলে তিনি প্রথাগত শিক্ষালাভ সমাপ্ত করতে পারেন ঠিকই, তবে এই সময়টায় তিনি বিভিন্ন পুস্তক পাঠ করা ও লেখায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি মন্তব্য করেছিলেন এই রোগে আক্রান্ত হওয়া তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূণ ঘটনা। সেই যন্ত্রণাদীর্ণ দিনগুলোয় তাঁর ভবিষ্যতের লেখকসত্ত্বা কোন পথে যাবে তাও অনেকটা স্হিরীকৃত হয়ে যায়।

মোরাভিয়ার প্রথম উপন্যাস ‘The Time of Indifference’ প্রকাশিত হয় 1929 সালে। প্রথম উপন্যাসই তাঁকে কাঙ্খিত খ্যাতি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি দিয়েছিল। এই রচনায় তিনি আধুনিক মানুষের মনস্তাত্ত্বের বিশ্লেষণ করেছেন এবং তা করতে গিয়ে যৌনতার উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু যৌনতাকে তিনি এতটা গুরুত্ব দিলেন কেন? এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা যায় মানুষের জীবনের সবথেকে অর্থবহ ক্রিয়ার ভিত্তি অনুসন্ধান করতে গিয়ে মূলগত কারণ হিসেবে তিনি যৌনতাকে চিহ্নিত করেছেন। মোরাভিয়ার সবথেকে বড় কৃতিত্ব এইখানে যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জীবনকে তিনি নিজের মত করে দেখেছেন এবং বিশ্লেষণ করেছেন। নিজের ধারণার উপর আস্হায় অবিচল ছিলেন বলেই এই উপন্যাসে তিনি দার্শনিকের মত বলতে পেরেছেন – “When you aren’t sincere you need to pretend, and by pretending you end up believing yourself; that’s the basic principle of every faith.”

ইতালিতে মুসোলিনির জমানায় ফ্যাসিবাদ বিরোধী অবস্হানের জন্য মোরাভিয়া শাসকদের বিষনজরে পড়েন। তাঁকে রাষ্ট্রের শত্রু বলে অপপ্রচার করা হয়। এই সময় তিনি সাংবাদিকতাকে অবলম্বন করেছিলেন। পরিশেষে ১৯৪৩ সালে তিনি রোম থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তিনি গ্রামাঞ্চলে ঘোরেন এবং কৃষকদের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখেন। এই অভিজ্ঞতার ফলে মোরাভিয়ার রচনায় সমাজসচেতনতা যে আগের থেকে বেশী পরিমাণে ফুটে ওঠে তাই নয়, তা আরও বেশী করে মার্কসবাদ নির্ভর হয়। এই সময় তিনি ‘Two Adolescents’ (১৯৪৪) নামক বড়গল্পটি লিখেছিলেন, পরবর্তীকালে যা একটি আধুনিক ক্লাসিকরূপে গণ্য হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মোরাভিয়ার জনপ্রিয়তার গ্রাফ দ্রুত উপরের দিকে উঠতে থাকে। এর অন্যতম কারণ সমকালীন সমাজজীবনের (বিশেষত মধ্যবিত্ত জীবনের) সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা ভণ্ডামি প্রভৃতি সামাজিক অসুখ, প্রেম ও বিবাহের মত প্রথাগত পদ্ধতির উপর মানুষের অবিশ্বাস প্রভৃতি থেকে তিনি রচনার বিষয়বস্তু আহরণ করেছেন। পাশাপাশি কাহিনীর চমৎকারিত্ব সহজেই পাঠককে আকর্ষণ করে। যেমন ‘The Woman of Rome’ (১৯৪৭) উপন্যাসের উপজীব্য হল একটি বারবণিতার কাহিনী যে ইতালিতে ফ্যাসিবাদের জমানায় ষড়যন্ত্রকারিদের চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তাছাড়াও ‘Disobedience’ (১৯৪৮), ‘Conjugal Love and other stories’ (১৯৪৯) প্রভৃতি রচনাগুলি পাঠকচিত্ত জয় করতে সমর্থ হয়। তাঁর রচনায় যে জীবনবোধ ফুটে উঠেছে তা সর্বাংশে বাস্তবতার উপর আধারিত। এই ধারণার স্বপক্ষে ‘The Woman of Rome’ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি – “I gave up the unequal struggle against what appeared to be in my fate, indeed, I welcomed it with more affection. As one embraces a foe one can’t defeat and I felt liberated.”

বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে (আরও নিদিষ্টভাবে বললে ১৯৫০ সালের পর থেকেই) মোরাভিয়ার লেখায় একটি মৌলিক পরিবর্তন আসে। জগতের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের কথা চিন্তা করতে গিয়ে তিনি মার্কসবাদের উপর আর ততটা নির্ভর করেন নি। তার পরিবর্তে বুদ্ধিজীবীসুলভ মানসিকতা দ্বারা পরিচালিত হয়ে সমস্যাগুলির বৌদ্ধিক সমাধানের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করতে থাকেন; অর্থাৎ intellectual solution তাঁর কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। তাঁর রচনায় এর সুস্পষ্ট প্রভাব পড়ে। বক্তা হিসেবে তৃতীয় ব্যক্তির ব্যবহার থেকে তিনি সরে আসেন। এই সময়কাল থেকেই তিনি লেখার সময় Objective style ব্যবহার করা ছেড়ে দেন। এই ভঙ্গি পুরোপুরি বর্জন করে তিনি subjective style-এ লিখতে আরম্ভ করেন। এই ভঙ্গী ব্যবহার করার ফলে তাঁর রচনায় সবথেকে লক্ষ্যণীয় যে বৈশিষ্ট্যটি চোখে পড়ে সেটি হল এখন থেকে নায়ক হয় উত্তম পুরুষ।

বিংশ শতাব্দীর পাঁচের দশকে যে উপন্যাসগুলি মোরাভিয়াকে প্রভূত জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল তার মধ্যে ‘The Conformist’ (১৯৫১), ‘Contempt’ (১৯৫৪) এবং ‘Two Women’ (১৯৫৭) আলাদা করে উল্লেখের দাবী রাখে। পাশাপাশি এই দশকের দুটি ছোটগল্পের সংকলন ‘Roman Tales’ (১৯৫৪) এবং ‘More Roman Tales’ (১৯৫৯) তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সহায়ক হয়। বহিরঙ্গ বিশ্লেষণে কাহিনীর উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হলেও অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণে দেখা যায় তাঁর রচনায় বাস্তবতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিজস্ব স্বকীয়তাপূর্ণ জীবনদর্শন। এর উপর ভিত্তি করেই Contempt উপন্যাসে তিনি লিখেছিলেন – “Because the world today is so constructed that no one can do what he would like to do, and he is forced, instead, to do what others wish him to do.” জীবনকে তিনি নিজের দৃষ্টিতে দেখেছেন, বিভিন্ন পরিস্থিতি এবং ঘটনাকে নিজের মত করে বিশ্লেষণ করেছেন এবং তৎসঞ্জাত উপলব্ধির নির্যাস পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

সাহিত্যমূল্যের নিরিখে বিচার করলে তাঁর অন্যতম বিখ্যাত উপন্যাস ‘The Empty Canvas’ (১৯৬০) বিশেষভাবে তাৎপর্যপূণ। এর কাহিনী রোম শহরের এক ধনী যুবক চিত্রকর ও একটি মেয়ের মধ্যে সমস্যাপূর্ণ সম্পর্কের উপর আধারিত, যেখানে যৌনবাস্তবতা সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। পরবর্তীকালে এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। প্রসঙ্গত জানাই একাধিক বরেণ্য পরিচালক মোরাভিয়ার বিভিন্ন কাহিনী অবলম্বন করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, যাঁদের মধ্যে আছেন ভিত্তোরিও দে সিকা, জাঁ-লুক গোদার এবং সেড্রিক কান্।

১৯৬৫ সালে প্রকাশিত ‘The Lie’ উপন্যাসটি মোরাভিয়ার সবথেকে বিখ্যাত রচনাগুলির মধ্যে একটি। প্রকাশকালেই উপন্যাসটি সাড়া জাগিয়েছিল, কারণ এখানেই প্রথম একজন খ্যাতনামা লেখক ইতালির সমাজে অজাচার নিয়ে কলম ধরেছিলেন। আসলে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ক্ষুণ্ণ করে শারীরিক সম্পর্কের বিপথগামীতাকে চিহ্নিত করতে গিয়ে অজাচারকে তিনি রূপক হিসেবে নিয়েছেন। এখানে দুটি বিষয় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে – আবেগের অভাব এবং সম্পর্কের গভীরতার অভাব। তবে এটাই উপন্যাসটির একমাত্র দিক নয়, সেই সময়ের ইতালির বুদ্ধিজীবীদের বামপন্থী মানসিকতার দিকে ঝোঁকার যে ফ্যাশন চালু ছিল সেটাও প্রতিফলিত হয়েছে। সর্বোপরি লেখকমনে কীভাবে একটি উপন্যাসের সূত্রপাত হয় এবং কীভাবে ধীরে ধীরে সেটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসের অবয়ব ধারণ করে সেটাও তিনি দেখাতে চেয়েছেন।

সমালোচকদের অনেকের বিচারে মোরাভিয়ার প্রধান দুর্বলতা হল ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি বাস্তবকে পাঠকের সামনে সরাসরি উপস্থাপিত করেছেন, কিন্তু তার ব্যাখ্যা দেওয়ার বা ঘটনার বিশ্লেষণ করার কোনরকম চেষ্টা করেন নি। এক্ষেত্রে মোরাভিয়ার সমর্থনে বলা যায় এটা তাঁর রচনাশৈলীর কোন ত্রুটি নয়, বরং এ হল এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী, কারণ তিনি মনে করতেন – “An intellectual is nothing else than a witness of his time.” সেই মনোভাবই তাঁর রচনায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চোখে পড়ে যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফল উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ – প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে তাঁর রচনায় বস্তুনিষ্ঠ মানসিকতার ছাপ পড়েছে, আর পরোক্ষ ফল হিসেবে ঔপন্যাসিকের কঠিন নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি বাস্তবের বর্ণনা করেছেন এবং যা বলতে চেয়েছেন একেবারে সরাসরি বলেছেন, আর বিচার-বিশ্লেষণের দায়িত্ব পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর রচনাশৈলী মোটের উপর অলঙ্কারবিহীন এবং সাধারণ প্রচলিত শব্দরাজি অনবদ্য বাক্যবিন্যাসের কৌশলে অতীব চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছে। এটাই মোরাভিয়ার গদ্যশৈলীর সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্যরূপে বিবেচিত হয়, যা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠককে টেনে রাখে। তিনি বিশ্বাস করতেন একজন লেখককে যদি রচনায় বাস্তবকে প্রতিফলিত করতে হয় তাহলে তাঁকে যেমন একটি নৈতিক অবস্থান নিতেই হবে, তেমনই সুস্পষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক ও দার্শনিক ধারণাও থাকতেই হবে। সেইজন্যই তিনি লিখেছিলেন – “Every true writer is like a bird; he repeats the same song, the same theme, all his life.”

Leave a comment

Check Also

একুশে ফেব্রুয়ারি

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো : একটি গান ও দুই বাংলার মিলনসেতু – বদরুদ্দোজা হারুন

[ভাষা শহীদ আবুল বরকতের ৯৬ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে লেখা l]   “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো …

মহাশিল্পী রবিশংকর : ভারতের মোৎসার্ট – রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

  বিশ্বের সংগীতপ্রেমীদের কাছে রবিশংকর ও মোৎসার্ট দু’টি নামই সুপরিচিত। উভয়েই বহুশ্রুত হলেও সংগীতের গভীরে …

pablo neruda

পাবলো নেরুদা : জীবন ও কবিতার সংরাগ – রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

।। এক।। দক্ষিণ আমেরিকার তিনজন অসীম প্রতিভাশালী কবি হলেন সোর জুয়ানা ইনেস ডি লা ক্রুজ, …

দু’একটা সত্য কথা – সুদীপ্ত বিশ্বাস

মাত্র ১০০০০ বছর আগে কোনো ধর্মই ছিল না। ছিলনা ধর্ম-ধর্ম করে মানুষের সাথে মানুষের বিভেদ। …