Home / কিশোর গল্প / রসেবশে রামায়ণ- মৌসুমী পাত্র

রসেবশে রামায়ণ- মৌসুমী পাত্র

রামায়ণের গল্প আমরা সবাই জানি। কিন্তু গল্পেরও কিছু ভেতরকার কথা থাকে। যাকে বলে, পেটের কথা। সেইরকম একটা কাহিনী আজ চুপিচুপি শোনাবো।

তাড়কা রাক্ষসীর সঙ্গে রাম- লক্ষ্মণের যুদ্ধের কথা নিশ্চয়ই জানো। কিন্তু আসলে কী হয়েছিল? সে ভারি মজাদার ব্যাপার। বলি তবে?

রাজা দশরথের সভায় একদিন এলেন মহামুনি বিশ্বামিত্র। তিনি আবার খুব রাগী। কথায় কথায় রেগে যান। তা এরকম একজন মানুষকে, তায় আবার মুনি, কে না ভয় করবে? কাজে কাজেই, রাজা দশরথ অনেক আদরযত্ন করে মুনিকে সভায় বসালেন, প্রণাম করলেন।

তা বিশ্বামিত্র কি আর ওসবে ভোলেন? তিনি সোজাসুজি কথা পাড়লেন। কী কথা? না, রাক্ষসের উৎপাতে তাঁর আশ্রমে যজ্ঞ করাই দায় হয়ে উঠেছে। তাই রাম- লক্ষ্মণকে তিনি নিতে এসেছেন। রাম-লক্ষ্মণ গিয়ে লড়াই করে রাক্ষসদের হটিয়ে দেবে।

কোন্‌ বাবামা আর এরকম ঝামেলার কাজে ছোট বাচ্চাদের পাঠাতে চায়? রাজা দশরথও তাই প্রথমটায় রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু পরে বিশ্বামিত্রের ভয়েই রাজি হলেন। নইলে কী করতে কী করে বসবেন এই রাগী মুনিটি, তার কি কোন ঠিক আছে?

যাই হোক, বিশ্বামিত্র তো রাম- লক্ষ্মণকে নিয়ে রওনা দিলেন। রাম- লক্ষ্মণ রাজবাড়ির বাইরে বড় একটা যায় না, তাই তাদের বেজায় ভালো লাগছে। ভালো কিছু দেখলেই এক ভাই আর এক ভাইকে ঠেলা মেরে দেখাচ্ছে। চারদিকে কত রকমের কত গাছপালা, গাছে গাছে পাখিরা কিচিরমিচির করে, গান গেয়ে, শিস দিয়ে হেসেখেলে বেড়াচ্ছে। দূরে সরযূ নদী বয়ে যাচ্ছে আপনমনে। তার তীরে কত লোকজন। কেউ চান করছে, কেউ কলসীতে জল ভরছে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হইহই করে সাঁতার কাটছে। কেউবা একটু দূরে ছোট জাল ফেলে মাছ ধরছে। আর কোন মেয়ে হয়তো এমনিই নদীর পাড়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আর পথের লোকজন যারা দুই ভাইকে চেনে, তারা কানাকানি করছে, “ওই দ্যাখ, দ্যাখ, বিশ্বামিত্র মুনি কেমন রাম-লক্ষ্মণকে নিয়ে যাচ্ছে। ঘরে ওদের বাবা-মায়েরা নিশ্চয়ই কান্নাকাটি জুড়েছে!”

গল্প করতে করতে হাঁটছে দুই ভাই। কি সুন্দর হালকা হালকা নরম নরম বাতাস বইছে। নদীর শীতল বাতাসে জুড়িয়ে যাচ্ছে ওদের শরীর। গাছপালার গন্ধ, মাটির গন্ধ, চারিদিকে রকমারি ফলফুলের গন্ধ মিলিয়ে মিশিয়ে এক অপরূপ সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। দুই ভাই বুকভরে শ্বাস নিচ্ছে। চারিদিকে যাই দেখছে, তাই তাদের ভালো লাগছে। এই যে এত এত পথ তারা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, তবুও কষ্ট লাগছে না তাদের। হাওয়া- বাতাস করার কেউ নেই, কিন্তু নদীর বাতাসের ঝাপটাতেই তাদের প্রাণমন জুড়িয়ে যাচ্ছে।

এরকম করে যেতে যেতে ওরা কত বন পেরোল, মাঠ পেরোল, নদীনালা পেরোল। তারপর এল এক মহাবন। বিশ্বামিত্র মুনি বললেন, “রাম- লক্ষ্মণ, এই বনে কিন্তু তাড়কা রাক্ষসী থাকে। সে খুব ভয়ংকর আর তার খুব তেজ।”

রাম- লক্ষ্মণ অবাক হয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকায়। কোথায় কী? দিব্যি বনের ভিজে ভিজে মাটি, বাতাসে হালকা সোঁদা গন্ধের আমেজ, বড় বড় গাছের মিষ্টি মিষ্টি ছাওয়া আর তার ফাঁকে রোদের লুকোচুরি। এর মধ্যে রাক্ষস টাক্ষস আসে কোত্থেকে?

লক্ষ্মণ বেশ বিজ্ঞের মত বিশ্বামিত্রমুনিকে জ্ঞানই দিয়ে বসল, “মুনিমশাই, আপনি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন। তাড়কাই আসুক আর ফাড়কা, আমি আর দাদা মিলে তাকে তড়কা বানিয়ে ফেলব।”

বিশ্বামিত্রও মজা পেয়েছেন কথা শুনে। মুচকি হেসে বললেন, “হুঁ হুঁ বাবা, তাড়কা এলেই বুঝবে, কত ধানে কত চাল হয়?”

রাম তাই শুনে বলল, “এ আর এমন কি জটিল হিসেব? পাঁচ মণ ধানে চার মণের মত চাল বেরোবে।”রাম সবে এই কথা বলেছে, এমন সময় মনে হল, বিশাল জোরে মটমট আওয়াজে গাছপালা ভাঙতে ভাঙতে কে যেন এগিয়ে আসছে। তারপর সে যখন একদম সামনে চলে এল, তখন ওরা বুঝেই গেল, এ তাড়কা না হয়ে যায় না! সত্যিই বিশাল চেহারা! মাথার চুল এলোমেলো, উসকোখুসকো। মুখে চোখে গায়ে নানারকমের কালি লেপা। সামনের দুটো দাঁত আবার খানিকটা করে বেরিয়ে আছে।

তা দিনেদুপুরে এরকম একখানা মূর্তি দেখলে ভয় পাবারই কথা। তা রাম- লক্ষ্মণও ভাবছিল যে, একটু ভয় পাওয়াই উচিত। কিন্তু সে সময়েই তাড়কা রাক্ষসী একখানা বিকট হুংকার দিয়ে বলে উঠল, “কে রে তোরা? আমার জঙ্গলে ঢুকেচিস? তোদের সাহস তো কম নয়! এইটুকুনি পুঁচকে বাচ্চা হয়ে তাড়কার জঙ্গলে এয়েচিস?”

তা পুঁচকে বললে কার না রাগ হয়? রাম-লক্ষ্মণের এত রাগ হল যে রাগের চোটে ভয়ডর বেমালুম উবে গেল।

রাম হাতের তীর- ধনুক উঁচিয়ে বলল, “তবে রে! তোর এত বড় আস্পর্ধা! মাথার চুলে তো তেলও দিস না, আঁচড়াসও না ভাল করে! গায়ে আবার কীসব রঙ মেখেছিস! চুলকুনি হলে বুঝবি।”

একথা শুনে তাড়কা দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল, “বটে? যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা! আমার দাঁত দেখেছিস? কত লম্বা আর কত সুন্দর।”

এবারে লক্ষ্মণ কোমরে হাত দিয়ে ফ্যাকফ্যাক করে হাসতে হাসতে বলল, “সে তো তুই সকালে- রাতে ভালো করে দাঁত মাজিস না বলে। আর তারপর দুধও ত মনে হয় খাস না। তোর শরীরে বোধহয় ক্যালসিয়াম যায় না। ছ্যা ছ্যা।”

পাশ থেকে রাম পুট করে বলে উঠল, “দাঁতের ডাক্তার দেখা। কী বিচ্ছিরি দাঁত রে বাবা!”

তাড়কা তখন খুব রেগে গিয়ে ডান হাতটা বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “দাঁত নিয়ে খোঁটা দিবি না, বুঝলি? এমনিতেই বলে রোজ রাতে দাঁতের ব্যথায় মরে যাই।”

রাম বলল, “তা আর হবে না? রোজ এক গেলাস করে দুধ খাবি।”

এদিকে তাড়কাকে দেখেই বিশ্বামিত্র  একটা গাছের আড়ালে লুকিয়েছেন। তিনি দেখলেন, মহা মুশকিল। এরা যুদ্ধটুদ্ধ ভুলে গিয়ে খালি তর্ক করছে। তিনি আড়াল থেকেই বললেন, “বাবা রাম-লক্ষ্মণ, আমি কিন্তু এবার সত্যি সত্যিই রেগে যাব বলে দিচ্ছি। বলি, হাত থাকতে মুখে কথা কেন? বাবামা পয়সা খরচ করে তীরধনুক কিনে দিয়েছেন কি তামাশা দেখতে?”

এ কথা শুনে রাম- লক্ষ্মণের বেজায় রাগ হল। রাম পিঠের তূণীর থেকে তির  বের করে ধনুকে লাগাতে লাগাতে বলল, “আয় তবে, আজি তোরে করিব সংহার।”

লক্ষ্মণ বলল, “করিব বেদম প্রহার।”

এ কথায় তাড়কাও ডান পা দিয়ে মাটিতে একখানা লাথি মেরে বলল, “মোটেও না। তোদেরই আজ হইবে হার।”

রাম বলল, “আমাদের হার হবে? আগে বল তাহলে, তুই আজ কী খেয়ে যুদ্ধ করতে এসেছিস?”

তাড়কা খুব খুশি হয়ে গর্বভরা গলায় বলল, “আমি? আমি আজ খেয়েছি চিপস, কুড়কুড়ে, প্যাটিস, বার্গার এইসব।”

তাই শুনে রাম- লক্ষ্মণ দুজনেই একে ওকে জড়িয়ে ধরে হো হো করে হাসতে শুরু করে দিল। সেই দেখে তাড়কা চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করল, “হাসছিস কেন রে? এতে অত হাসির কী হল?”

রাম বলল, “হাসব না? তোর তো মোটে পুষ্টিই হয়নি। তুই লড়বি কী করে রে? ওসবে তো কোন পুষ্টিই নেই।”

লক্ষ্মণ বলল, “ওই জন্যই তোর অমন হাতির মতন চেহারা। গায়ে আসলে কোন জোরই নেই। আমরা এক চড় দিলেই চড়ুইপাখি হয়ে যাবি।”

তাড়কা কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “তোরা তাহলে কী খেয়ে এসেছিস?”

রাম মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, “আমরা? আমরা খেয়েছি দুধ, ছানা, ফল, শাকসবজি, ভাত, ডিম এইসব।”

লক্ষ্মণ একখানা আঙুল নাচাতে নাচাতে বলল, “মাছও খেয়েছি।”

তাড়কা প্রায় কেঁদেই ফেলে আর কী! “আমি তো এসব কিছুই খাই না। আমার ভালোই লাগে না।”

লক্ষ্মণ সুযোগ পেয়ে টুক করে ফের জ্ঞান দিয়ে দিল, “ওইজন্যই তো তোর শরীরে পুষ্টি নেই। আর পুষ্টি নেই বলে গায়ে জোরও নেই। তুই আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে দাঁড়াতেই পারবি না।”

রাম দেখল, ছোট ভাই হয়েও লক্ষ্মণ একাই জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে। সে সাততাড়াতাড়ি বলল, “ভালো না লাগলেও খেতে হয়। খেতে খেতেই ভালো লেগে যায়।”

তাড়কা এবার ফোঁত ফোঁত করে দুবার কেঁদে নিয়ে বলল, “আজ যুদ্ধ না করলে হয় না?”

গাছের আড়াল থেকে বিশ্বামিত্র বলে উঠলেন, “না, যুদ্ধ করতেই হবে। কথা দিয়ে কথার খেলাপ করা ঠিক নয়।”

রাম বলল, “আয় তাড়কা, যুদ্ধং দেহি।”

লক্ষ্মণ বলল, “আ, আ, চু চু চু চু।”

বেগতিক দেখে তাড়কা সামনের দিকে এগিয়ে এল। রাম আর লক্ষ্মণ দুজনে দুদিক থেকে তাকে দু কিল দিল। কিল খেয়ে তাড়কা কাটা কলাগাছের মত লুটিয়ে পড়ল।

এবারে বিশ্বামিত্র গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন, “শোনো বাপুরা, সামনের মাটিতে দুখানা তির পুঁতে দাও। তাতে ব্যাপারটা বেশ জোরদার হবে।”

রাম- লক্ষ্মণ তাই করল। লক্ষ্মণ বলল, “দাদা রে, খুব খিদে পেয়ে গেল যে।”

বিশ্বামিত্র শুনতে পেয়ে বললেন, “বাছাধনেরা, পা চালিয়ে চল। আশ্রমে লুচি- পায়েসের ব্যবস্থা করে রেখেছি। গিয়ে গরমাগরম খাবে।”

রাম বলল, “আর ঘুগনি।”

লক্ষ্মণ বলল, “আর মিষ্টি।”

রাম বলল, “আর বেগুনভাজা।”

লক্ষ্মণ বলল, “আর অল্প করে বোঁদে। আমরা বেশি খাই না। বেশি খাওয়া ভালো নয়।”

রাম দেখল ভাই আবার জ্ঞান দেবার তাল করছে। তাই সে তড়িঘড়ি বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। একেবারেই কম। পাখির আহার বললেও কম বলা হয়।”

 

বিশ্বামিত্র বেচারি আর কী করেন?  সামান্য মাথা চুলকিয়ে বললেন, “তাই হবে।”

 

………০………

Leave a comment

Check Also

ভুতুম থুম- মৌসুমী পাত্র

পূর্ণিমার চাঁদটা ভেসে আছে বিরাট একটা গোল থালার মতো। একটা শিশুগাছের ডালের কয়েকটা পাতার ছায়া …

 ছেঁড়া রামধনু – মৌসুমী পাত্র

আমার মা বেজায় দুষ্টু হয়েছে আজকাল। একটা কথাও শুনতে চায় না। এই তো পরশুদিন, বললাম, …

chitrogupter-computer-mp

চিত্রগুপ্তের কম্পিউটার- মৌসুমী পাত্র

“যত্ত সব আদ্যিকালের জিনিস নিয়ে কাজকারবার! আর পারা যায় না বাপু!”, নিজের মনেই গজগজ করতে …

শিল্পী- গুঞ্জা

ফুল-পাখি কথা – মৌসুমী পাত্র

সে ছিল এক গভীর বন। আর সেই বনের ঠিক মধ্যিখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় ছিল এক …