শুরু হয়ে গেছে দেবীপক্ষ। মানে বাঙালির বচ্ছরকার ‘মেগাফেস্টিভাল’ প্রায় বলতে গেলে নাকের ডগায়। মনে বেশ ফুর্তি ফুর্তি ভাব।পূজো পূজো গন্ধে নাক সুড়সুড় করছে| নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের বেশ কিছু ভেলা পথভ্রষ্ট হয়ে মনের মধ্যেও ইদানিং যথেচ্ছ বিচরণ করছে। আর হবে নাই বা কেন। সারা বছর কলুর বলদের মতো খেঁটে আর জাবর কেটে দিন গুজরান করা বাঙালি এই কদিন একটু রকম ভাবে বাঁচে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। এই যেমন এখন খুব ইচ্ছে করছে সোশ্যাল মিডিয়াতে বাতেলা করতে , অকারণে কিছু জ্ঞান দিতে। পুজো এলেই এইসব সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কি আর করা যাবে। সহ্য করুন। আর তাছাড়া বাঙালির মজ্জাগত অধিকার সকলকে অকারণে বিনামূল্যে জ্ঞান বিতরণ করা। এই যেমন এখন আমি করবো।জন্মাবধি এই শহরের পুজোর আনন্দে গা-ভাসানো ভুঁড়ি বাগানো আম বাঙালি হিসেবে দু-একটা পূজো-ইস্পেশাল টিপস দেব আমার ‘ওয়ালে’ । ভুক্তভোগীদের জন্য এটি অবশ্য পাঠ্য নয়। একেবারেই প্রথম পূজো দেখা কতিপয় বিরল দর্শন ভক্তকুলের জন্যই আমার এই নিবেদন |
যাই হোক, অনেক ধানাই পানাই হল| এবার আসল কথায় আসি|এখন তো পূজো শুরু মহালয়ার আগে থেকেই। তাই ভিড় বাঁচিয়ে আগে থেকেই বেরিয়ে পড়ুন মহানগরীর অলিতে-গলিতে। গণেশ ঠাকুর যেমন মা দুর্গাকে প্রদক্ষিণ করে বিশ্বদর্শন করে নিয়েছিলেন আপনাদেরও এই সময় নগরভ্রমণে একইরকম ভাবে দুনিয়াদারির সুযোগ থাকছে যদি সব কিছু পরিকল্পনামাফিক করতে পারেন তবেই।তাই গলি থেকে রাজপথ-পুরোটাই ভালো করে আগেভাগে জরিপ করে নিন। সঙ্গী-সাথী নিয়ে গেলে প্যান্ডেল এ ঢোকা বা বেরোনোর সময় অবশ্যই হিসেব করে মিলিয়ে নেবেন। তবে চুপিচুপি বলে রাখা ভালো নিরুদ্দেশ হবার ইচ্ছে হলে বা সঙ্গী বদলের ভাবনা থাকলে পূজোর ভিড়কে ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেই পারেন। উপদেশের জন্য কর্তৃপক্ষ মানে আমি কিন্তু দায়ী থাকবো না।
হীরের প্রতিমা, আকাশ ছুঁতে চাওয়া ঝাড়বাতি, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ইন্দ্রপ্রস্থ অবশ্যই দেখবেন। তার জন্য ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ এর মতো ভিড় দেখে ভয় পেলে চলবে না। মনে রাখবেন ‘ফ্রি’ তে পুন্য পাচ্ছেন। অমন পেল্লায় ঠাকুর দেখে আপনি মন্ত্রমুগ্ধ হবেনই আর সেই সাথে সারা বছরভর বসের অত্যাচার সয়ে সয়ে নুয়ে পড়া মেরুদন্ডখানিও খানিক তেজদীপ্ত হয়ে উঠতে পারে। তাই ভিড় ঠেলে বীর বিক্রমে এগিয়ে যাবেন , হাল ছাড়বেন না। বরং কন্ঠ ছাঁড়ুন জোরে| তাতেও কাজ না হলে ‘স্ট্রেটেজিক স্ট্রাইক’ করুন মানে পশ্চাদ্দেশের নির্গত বায়ুর সদ্ব্যবহার করুন| দেখবেন আশেপাশের চাপ অনেকটা হালকা হয়ে গেছে। তবে এক্ষেত্রেও সদুপদেশের জন্য এই শর্মা দায়ী নয়। নিজ দায়িত্বে অস্ত্র প্রয়োগ করুন।
ভিড়ে চিড়েচ্যাপ্টা হতে হতে মণ্ডপের ভেতরে আলো চুঁইয়ে পড়া গালিচা বিছানো খোলামেলা ভি আই পি সরণি দেখে হিংসে করবেন না। মনে রাখবেন সবকিছু সবার জন্য নয়। জোড়হস্তে বেরিয়ে আসুন প্যান্ডেল থেকে। বেরিয়ে না আস্তে চাইলেও বেরিয়ে ঠিক পড়বেনই। ট্যাঁকে ভালো লাগা আর পুণ্যটুকু গুঁজে বেরিয়ে পড়ুন সামনের ‘হেভিওয়েট’ পূজোর দর্শনে। মিস করবেন না। কে বলতে পারে যেটা দেখলেন না সেটাই হয়তো সবচেয়ে বড় চমক ছিল। ভিড়ে পাটিসাপ্টা হতে হলেও ক্ষতি নেই তাতে। কষ্ট করলে তবেই না কেষ্ট থুড়ি দেবীদর্শন হয়। ও তো তীর্থযাত্রারই সামিল। তার জন্য একটু নয় গুতোগুতি হলো,পুলিশের লাঠির খোঁচা, অপুলিশের হাতের চাপড় ,ক্যামেরার উপর তাদের অকারণ আক্রোশ একটু সহ্যই নয় করলেন। মনে রাখবেন তারাও তো মানুষ।সারাবছর উপোষী থাকার পর এই তথাকথিত ‘ভলান্টিয়ার’ বা রক্ষককুল এই সময়টুকুর জন্যই কমপ্ল্যান বয় হয়ে ওঠে। তাই অন্যসময় এদের পাত্তা না দিলেও এই সময় এদের সমীহ করতে ভুলবেন না যেন। এদের ওপর ভর করেই পূজো বৈতরণী পার করেন বড়ো বড়ো উদ্যোক্তারা।
এই কটা দিন আমার আপনার কাছে এরাই শেষ কথা। এরা সব জানে মানে মনে মনে বিশ্বাস করা ‘প্র্যাকটিস’ করুন এরা সবজান্তা মহেশ্বর মায় ভিড়ের চাপে ‘ব্যালান্স’ না করেও কিভাবে ঝাক্কাস ফটো তোলা যায় সেটাও এরা জানে । আপনি জানেন না সেটা আপনার অপরাধ। শুধু তাদের কাছে জানতে চেয়ে লজ্জা দিবেন না। কারণ সেটি ‘টপ সিক্রেট’ । বরং ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে DSLR এর গুমোর দেখবেন না যদি না ওই ইস্পেশাল গালিচাপাতা পথে হাঁটতে পারার যোগ্যতা থাকে।জয় মা দুগ্গা বলে শুধু জনজোয়ারে ভেসে যান। দেখবেন কখন প্যান্ডেলে ঢুকলেন বা বেরোলেন টেরই পাবেন না।
ঠ্যালার নাম বাবাজি কি আর সাধে বলে। ভিড়ের চাপে চটি ছিঁড়ুক ,কোঁচা খুলুক, কিংবা মাথায় টাক পড়ুক-একেবারেই গায়ে মাখবেন না। সবই ভগবানের ইচ্ছে। মনে রাখবেন ত্যাগই মোক্ষ লাভের সেরা পথ। সম্ভব হলে খালি পায়ে নির্দায় হয়ে ঠাকুর দেখুন। বছরের অন্যসময় আপনি নিজেকে যতই কেউকেটা ভাবুন না কেন ,ফর্সা-স্লিম সচ্চরিত্রের পাত্রী চাই বলে বিজ্ঞাপন দেওয়া স্বচ্ছল সম্ভ্রান্ত পরিবার বলে দাবি করুন না কেন কিংবা ‘অল্টো’, ‘আই -টেন’ চেপে বেড়ানো নিউটাউনে ফ্লাট হাঁকানো আমেরিকা ফেরত কর্পোরেট বাবু হন না কেন জনগণের ভিড়ে কিন্তু আপনার কোনো আলাদা ‘ক্লাস’ নেই। vip পাস্ না থাকলে আপনি এই ‘মাস’ এরই অংশ।
এই যেমন দু-ঘন্টা ধরে আপনার সামনের যে লোকটি ঠাকুর দেখার লাইনে দুটো বাচ্চা দুহাতে ধরে আপনার আগে আগে হাঁটছেন এবং মাঝে মাঝেই যার ঘামে ভেজা বগলের গন্ধ ‘ওভার শ্যাডো’ করে দিচ্ছে আপনার বিদেশী ডিওর গন্ধকে তিনি হয়তো আপনারই অফিসের আর্দালী। তাই জামদানি-‘ফিউশন’ শাড়ী বা ধনেখালি যাই পড়ুন না কেন -মনে রাখবেন ‘শো স্টপার’ কিন্তু একজনই -মা দুর্গা। তাই অন্যান্য দামি জিনিসের মতো পারলে ‘ইগো’ টাকেও খুলে রেখে যান বাড়িতে।
পূজোর কয়দিন যাই করুন না কেন অষ্টমীর অঞ্জলি আর দশমীর মাতৃবরণ এবং সিঁদুর খেলা অবশ্যই ‘টু-ডু’ লিস্টে রাখবেন। এই দুই রীতি পালন করতে যেতেই পারেন কোনো ঐতিহ্যশালী’ বিগবাজেটের’ পুজো প্যান্ডেলে। অভিজ্ঞতা বলে সেখানের বেশিরভাগ পুরোহিতই পোড় -খাওয়া এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। তাই মাতৃচরণে যা নিবেদন করবেন তার সবটাই ‘স্পীডপোস্টে ডেলিভারি’ হবার সম্ভাবনা বেশি। শুধু মনে রাখবেন রাজা-উজির এসব বড়ো পুজোতে অনেক বেশি মাত্রায় হাজির থাকতে পারেন। দেবী দর্শনের সাথে সেটি আপনার উপরি পাওনা।
সেই নক্ষত্র সমাবেশ উপভোগ করুন ভগবানের আশীর্বাদ মনে করে। তাঁরা উপস্থিত থাকলে তাদের পুজোই আগেই হবে। ওতে গোঁসা করবেন না। শাস্ত্রমতে ওনাদের পুষ্পার্ঘ্য ‘স্পেশাল ম্যাসেঞ্জার’ দিয়ে সকলের আগে পাঠানোটাই বিধিসম্মত। বাকি ভক্তবৃন্দের মতো আপনি ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করুন।পুজো দেওয়া হয়ে গেলে প্রশান্ত মনে পেটপুজো এবং পকেটের শ্রাদ্ধ করে বাড়ি ফিরুন। আরামকেদারায় একটু এলিয়ে দিন শরীরটা। সময় থাকলে ঘড়ির কাঁটা ধরে হালকা ঘুমিয়েও নিতে পারেন। উঠে রেডি হয়ে নিন চটপট। রাতের ঘোরা বাকি এখনো।
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ-
রোজ কমপক্ষে ৫কিলোমিটার হাঁটা অভ্যাস করুন।
গাড়ি লোককে দেখানোর জন্য হলে নিয়ে যেতে পারেন। ঠাকুর দেখে বেরোনোর পর গাড়ি খোঁজা গরু খোঁজার চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারে। ঠাকুর দেখার জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট আর পদযাত্রাই সেরা। আর হ্যাঁ অবশ্যই ট্রাফিক আইন মেনে চলুন।
থিমের অনেক পুজোই আপনার মাথার সাধারণ এন্টেনাতে ধরা নাও পড়তে পারে। অযথা চাপ নেবেন না। নিজের মতো করে একটা কিছু ভেবে নিন আর ছেলে-মেয়ে জানতে চাইলে তেমনটাই নির্দ্বিধায় বুঝিয়ে দিন। অনেক কষ্ট করে প্যান্ডেলে ঢুকে লোকের ভিড়ে , ‘ভলান্টিয়ারের’ গলাধাক্কায় আর থিমের ডামাডোলে দুর্গা ঠাকুরও খুঁজে না পেতে পারেন। বাইরে বেরিয়ে এসে ঘাবড়াবেন না। মনে রাখবেন অমন ‘কেস’ অনেকেই খেয়েছেন। শুধু বাকিদের বুঝতে দেবেন না। তাহলেই কেল্লা ফতেহ্।
বৃষ্টিতে ভিজে ঠাকুর দেখার জন্য প্রস্তুত থাকুন। পারলে পরে পুজোর বাজেটে কাটছাঁট করে কিছু টাকা বর্ষাতি আর প্লাস্টিকের জুতো কেনার জন্য তুলে রাখুন।
পূজোর আলো -রোশনাই-কোলাহল সবটুকু ধরে রাখুন আপনার মনের মনিকোঠায় শুধু দয়া করে ভুলে যান হীরের গয়নায় সাজানো মায়ের মণ্ডপের সামনে আপনার কাছে কাঁপা কাঁপা হাতে ফুটোফাটা বাটিটা এগিয়ে ধরা বৃদ্ধার নির্বাক চোখের আর্তি, ভুলে যান এবারের পুজোর সেরা চমক শিষমহলের মাঠে দুধের শিশুকে নিয়ে আপনার কাছে খাবার চাইতে আসা দুটো শীর্ণ হাত , ভুলে যান সবথেকে বেশি প্রাইজ পাওয়া পূজো প্যান্ডেলের পিছনে গলির অন্ধকারে তালপাতার পাখা আর ভেঁপু নিয়ে বসে থাকা ছেলেটির কথা যার সারাদিনে রোজগার ২৫টাকা এবং স্বপ্ন দেখে পূজো শেষে বোনকে জামা কিনে দেবার। মনে রাখবেন পূজো মানেই সারা বছরের মনের ক্লান্তি ধুঁয়ে মুছে প্রচুর মজা আর দেদার আনন্দে মেতে ওঠা। এই কটাদিন ভালো থাকুন সকলে। সকলকে ভালো রাখার কাজটুকু নয় জগজ্জননীর জন্যই তোলা থাক। হ্যাপি পূজো।