চরম খাড়াই রাস্তায় তীব্রগতিতে বাঁকের পর বাঁক পেরোচ্ছে গাড়িটা। ভয়ে চোখ বুজেই ফেললাম। আচমকাই পাশ থেকে মাসিমণি বলল, “নে, এবার চোখ খোল্। কালেবুঁ এসে গেছি।”
“কালেবুঁ?”, আমি সংশয়ভরা দৃষ্টি মেলে তাকাই।
“হ্যাঁ, রে, হ্যাঁ। তোরা যাকে কালিম্পং বলিস।”
“মানে? কালিম্পং আর কালেবুঁ এক! ধুস, কী যে যা তা বকো না তুমি!”
“হ্যাঁ রে, বাবা, বলছি তো। এখানকার স্থানীয় ভাষায় জায়গাটার নাম কালেবুঁ-ই। অথচ সাহেবদের বিকৃত উচ্চারণে ওটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে কালিম্পং-এ। এখানকার স্থানীয় কাগজে কালেবুঁই লেখে। বিশ্বাস না হয়, তোকে একটু পরই দেখিয়ে দিচ্ছি।”
সামনে ড্রাইভারের সিটের পাশের সিট থেকে সিকিউরিটি রাম আঙ্কল ততক্ষণে হাসি হাসি চাউনিতে মাসিমণির বক্তব্যকেই সমর্থন করছে। মাসিমণি থামতেই সে এবার শুরু করল, “জি হাঁ, ম্যাডাম। এদিককার কথায় কালে মতলব কালো ছেলে। বুঁ মতলব গিরে যাওয়া। অনেক আগে কোন্ কালো ছেলে গিরে গিয়েছিল পাহাড় থেকে, তাই এর নাম কালেবুঁ।”
রাম আঙ্কলের হিন্দী মেশানো বাংলা শুনতে দিব্যি মিষ্টি লাগছিল। কিন্তু আর শোনা হোল না, কারণ ড্রাইভার ততক্ষণে আরো একটা খাড়া চড়াই বাঁক পেরিয়ে গাড়িটা থামিয়েছে প্রকাণ্ড এক বাংলোর সামনের গেটে। চেয়ে দেখি বাংলোর গেটের ডানদিকে শ্বেতপাথরের ফলকে বাংলা আর ইংরেজিতে লেখা ‘শ্রীসদন’ আর বামদিকের ফলকে ইংরেজিতে লেখা মাসিমণির নাম। আর তলায় লেখা সাব ডিভিসনাল অফিসার, কালিম্পং।
পাহাড়ের একটা চুড়োর ওপর বাংলোটা। ড্রাইভার নিখিলের হর্নের শব্দে খাঁজকাটা সিঁড়ি দিয়ে একজন হোমগার্ড নেমে এসে গেট খুলে দিয়ে স্যালুট ঠোকে। এবার বাংলোর ভেতরের পিচঢালা রাস্তা দিয়ে আরো একবার খাড়াই বাঁক পেরোই আমরা। বাংলোর সদর দরজার পোর্টিকোর নিচে গাড়ি থামায় নিখিলভাই। আমি অবাক বিস্ময়ে চারদিকে দেখতে থাকি। আরে, এ যে রূপকথার দেশ! ভেতরে প্রচুর জায়গা। কতরকমের ফল আর ফুলের গাছ। বাউণ্ডারির গায়ে লম্বা লম্বা পাইন আর ঝাউ গাছেরা যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে। দূরের দিকে তাকালেই পাহাড়ের পর পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছোট ছোট গ্রাম শহর যেন পাখনা মেলে উড়ে যেতে চাইছে ঘন নীল আকাশে। বাংলোর একপাশে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঘন জঙ্গল নেমে গেছে। তবে পুরোটা আর ভালো করে দেখা হোল না। মাসিমণি হাঁক দিল, “নে, নে, এবার ঘরে চল। এখন কয়েকদিন তো আছিস। ধীরে সুস্থে দেখিস ভাল করে। ”
মুখ ফেরাতেই দেখি, মাসিমণির পাশে এক পাহাড়ি মেয়ে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখে মাথা দোলাচ্ছে। মাসিমণি বলল, “এ হোল সুইটিদিদি। তোকে এ কদিন ভালোমন্দ রান্না করে খাওয়াবে।”
বলতে না বলতেই সুইটিদিদি দুহাত জড়ো করে সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে হেসে বলল, “নমস্তে, মেমসাব।”
আমার বেশ মজা লাগল। আমার মতো এত ছোট মেয়েকে কেউ নমস্তে বলে নাকি? মাসিমণি বোধহয় আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেছিল। তাই সুইটিদিদি আমার ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে চোখের আড়াল হতেই মাসিমণি আমার কাঁধে হাত রাখল, “বুঝলি ঝিনাই, এরা প্রত্যেকেই অসম্ভব সরল, হাসিখুশি আর ভদ্র। এইটুকুনি একটা বাচ্চাও দেখবি যে তোকে হাতজোড় করে নমস্তে করছে। পশ্চিমবংগের মধ্যে থেকেও এটা সম্পূর্ণ এক আলাদা জগত। কদিন থাক। দেখবি, আস্তে আস্তে তোর নিজেরই অনেক চোখ খুলে যাবে। এখন একবার পেছনে তাকা আকাশের দিকে।”
মাসিমণির কথায় চমকে উঠে পশ্চিমদিকের আকাশপানে চাইতেই মনে হল, স্বপ্ন যেন দুহাতের মুঠোয়। ঘন নীল আকাশে দুদিকে পাখনা মেলে রাজহাঁসের মতো রাজকীয় কাঞ্চনজঙ্ঘা! কী সুন্দর! কী সুন্দর!
মাসিমণি বলল, “তোর বরাত ভালো। এসেই দেখতে পেয়ে গেলি। নইলে এ কদিন দেখাই যায় নি।”
রাম আঙ্কল ঘাড় নাড়ল, “ঠিক বলেছেন, ম্যাডাম। সানু নানি এলো আর কাঞ্চনজঙ্ঘাও আজ দেখা দিল।”
ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে রাম আঙ্কল। মুখে সবসময় হাসি লেগেই আছে। দেখলেই বোঝা যায়, ওই উদার, বিস্তৃত আকাশের মতোই খোলামেলা মানুষটি। পরনে শ্যাওলা সবুজ রঙের উর্দি।
আমি অবাক হলাম, “সানু নানি? মানে কী?”
মাসি হাসল, “সানু মানে ছোট। আর নানি মানে বাচ্চা। সানু নানি মানে বাচ্চা মেয়ে, ছোট মেয়ে।”
আমি রেগে গেলাম, “কী আমি বাচ্চা? আমি ছোট? আমি এবারে মাধ্যমিক দিয়েছি, আমি ছোট?”
রাম আঙ্কল মিটিমিটি হাসছে দেখে আমার আরো রাগ হল, “আমাকে সানু নানি বলবে না কিন্তু।”
রাম আংকল ওইরকম হাসতে হাসতেই জবাব দিল, “বেশ, বেশ, মেমসাব। তাই হবে।”
আমি আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে গেলাম। কিন্তু ওর হাসিটা দেখে মনে হচ্ছিল যে মতলবটা অন্যরকম।
দিন চারেক হয়ে গেল কালিম্পং এ আসা। অনেক ঘুরছি, ফিরছি, দেখছি। মাসিমণির বাংলোতেই যে কত দুষ্প্রাপ্য জিনিস আছে, তার ইয়ত্তা নেই। কত পুরানো পুরানো সব ছবি। তিস্তার ওপরে যখন করোনেশন ব্রিজ হয়, তার ছবি। পুরনো দার্জিলিং, পুরনো কালিম্পং-এর চিত্র। সবই পুরনো কোডাক ক্যামেরায় তোলা সাদাকালো ছবি। আরো তিনটে অদ্ভুত ছবি আছে। ছবি হয়েও ঠিক যেন ছবি নয়। সাদা কোন ধাতুতে খোদাই করা কিছু নারীপুরুষের অবয়ব। পাশে নানা জায়গায় ফুল, ফল, পাতা, চোখ, সাপ ইত্যাদির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিত্র। নারী পুরুষের পোশাক-পরিচ্ছদ, শিরোধান সবই অদ্ভুতমতো। মাসিমণিকে জিজ্ঞেস করায় বলল, “এটাকে বলে হিয়েরোগ্লিফিক্স। হায়েরোগ্লিফিক্সও বলে কেউ কেউ। সম্ভবতঃ ফারাওদের ছবি এগুলো। আর পাশে যেগুলো ফুল, ফল, পাতা ইত্যাদি আঁকা আছে, ওগুলো কিন্তু হিজিবিজি না। ওগুলো আসলে কিছু লেখা আছে। আমরা যেমন নানারকম অক্ষর জুড়ে জুড়ে শব্দ বানিয়ে, বাক্য বানিয়ে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করি, প্রাচীন মিশরীয়দের সেরকম এই আঁকাগুলোই ছিল ওদের ভাষা। এটাকে পোশাকি ভাষায় বলে পিক্টোগ্রাফি।”
আমি তন্ময় হয়ে শুনছিলাম। ফারাও মানে মিশরীয়দের রাজা, সেটা জানি। ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। কিন্তু এক বিন্দুও মানে উদ্ধার করতে পারলাম না। মাসিমণি যে পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার মুখের ভাব লক্ষ্য করছিল সেটা এবারে বুঝলাম, “এভাষার মানে বোঝা খুব সহজ কম্মো নয়। ফলে তোর আলাদা করে মুষড়ে পড়ার কোন কারণ নেই।”
আমি কী একটা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই সিঁড়ির দিক থেকে আওয়াজ এল, “সানু নানি!”
আমি দৌড়োলাম সিঁড়ির দিকে। রাগলাম না তার কারণ এ ক’দিনে রাম আংকলের সঙ্গে আমার দিব্যি ভাব হয়ে গেছে। রাম আঙ্কল আমাকে দেখে একগাল হাসল, “সানু নানি, এই নাও, এটা তোমার জন্য।”, বলেই একটা বড়সড় প্যাকেট ধরিয়ে দিল।
দেখি, পেয়ারা আর পেঁপের মাঝামাঝি দেখতে ফলজাতীয় একগাদা কিছু। গায়ে আবার সামান্য কাঁটা কাঁটা।
আমি অবাক, “এটা আবার কী?”
রাম আঙ্কল হাসল, “এটাকে বলে কোয়াশ। এটা রান্না করে খায়। আমার বাগানে ফলেছিল। এখানে এমনিই ফলে। বাংলোর বাউণ্ডারির গায়েও আছে। সুইটিদিদিকে বলবে, রান্না করে দেবে।”
পেছনে মাসিমণির সামান্য রাগত গলা শোনা গেল, “রাম, তুমি আবার এনেছো? এই আগের মাসেই তো এতগুলো দিয়ে গেলে! এরকম করলে তোমাদের থাকবে কী?”
রাম আঙ্কল ততক্ষণে লম্বা স্যালুট দিয়ে দুধারে মাথা নাড়তে শুরু করেছে, “না, ম্যাডাম, আমাদের ঘরে প্রচুর হয়েছে। এত হয় যে কেউ খেতে চায় না। সানু নানি এসেছে, ভাবলাম, আমাদের দেশের জিনিস খাওয়াই। ফিরে গিয়ে তো আর পাবে না।”
মাসীমণি চুপ করে গেল। এ ক’দিনে একটা জিনিস খুব ভালো বুঝেছি। এখানকার লোকেরা খুব অতিথিবৎসল। মাসীমণি বলছিল সেদিন, “একটা জিনিস ভাব তো, ঝিনাই। ভূপ্রকৃতির দিক থেকেই বল, ভাষার দিক থেকেই বল, মানুষজনের দিক থেকেই বল- এই পাহাড় এলাকাটা সম্পূর্ণই আলাদা। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে থেকেও এ যেন একটা পুরো আলাদা জগত। অথচ দ্যাখ, আমরা যখন পশ্চিমবঙ্গের তুলনা টানি, তখন পাহাড়ের কথা আমরা একবারের জন্যও ভাবি কি? পাহাড় তো আমাদের সাধারণ বাঙালীদের কাছে পিকনিক স্পট ছাড়া আর কিছু নয়।
মাসীমণিরা বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। মাসীমণির কথাগুলোই নাড়চাড়া করলাম মনের মধ্যে। সত্যিই তো, আমি নিজেও তো যখন পশ্চিমবঙ্গের কথা ভাবি বা বলি, তখন তো এই পাহাড় তো মনের মধ্যে কোথাও কোন উঁকি দিয়ে যায় না। আর এখান থেকে যেকোন প্রয়োজনে কোলকাতা যাওয়াই কি কম ঝক্কির? পাহাড়ের মনের আনাচে কোনাচে যদি কোন ক্ষোভ জমে থাকে, তাকে কি দোষ দেওয়া যায়?
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। দেখি, পাইনের বনে মেঘ জমছে দ্রুত। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামছি আমি। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি মেঘের কণাগুলোকে। অন্ধকার ঘনাচ্ছে। আমি ওথার চেষ্টা করছি। আচমকা তাকিয়ে দেখি, সামনের পাইন গাছে একটা বড়সড় কোয়াশ ধরে আছে। হাত বাড়িয়ে নিতে যাব, অমনি শুনি কে যেন বলে, “সানু নানি, কোয়াশ খাবা?” তাকিয়ে দেখি, রাম আঙ্কল! আমি হাত বাড়িয়ে নিতে যাবো, অমনি রাম আঙ্কল বলল, “দাঁড়াও, আগে হুইসিলটা বাজাই।”, এই বলে খাকি প্যান্টের পকেট থেকে একটা ইয়াব্বড়ো হুইসল বের করে বাজাতে শুরু করল। সে কী আওয়াজ! কী তীক্ষ্ণ। আমি যত রাম আংকলকে বলি, আওয়াজটা বন্ধ করো, সে কানেই তোলে না। শব্দ হতেই থাকে।
শব্দটা মাথার মধ্যে পাক খেতে খেতে বিছানায় উঠে বসি। গাড়ির হর্ন বাজছে। মাসীমণি কি ফিরে এল? চটিটা পায়ে গলিয়ে দৌড়তে দৌড়তে নিচে নামি। রাম আঙ্কল বলে, “ব্বাব্বা! সানু নানির বড্ডো ঘুম।”
আমি উত্তর দিলাম না। নীচের বারান্দায় ঝোলানো দোলনাটায় বসে দোল খেতে শুরু করলাম। স্বপ্নের রেশটা মনে জড়িয়ে গেছে। রাম আঙ্কল কাছে এগিয়ে এল, “সানু নানি, গুসসা হয়েছো? বেশ, আর সানু নানি বলব না। জানো, আমার ঘরেও একটা সানু নানি আছে। ক্লাস ফোরে পড়ে। আমার মেয়ে।”
এবারে আমার সত্যিই রাগ হল। চেঁচিয়ে উঠলাম, “তা এতদিন আনোনি কেন?”
রাম আঙ্কল বলল, “পরশো তো তুমার জনমদিন। ওইদিন নিয়ে আসবো। তুমিও তো আর দুদিন পরে চলে যাবা।”
এতদিনে প্রথম ক্লান্ত লাগে রাম আংকলের গলা, “এক রাজ্যে থেকেও এতো দূরত্ব কেন বলতে পারো, সানু নানি? অবশ্য দূরত্বটা আমাদেরই তরফে। তোমরা তো জানোই না আমরা আছি।”
কথাটা খুব খাঁটি।
কালিম্পং এ জন্মদিনটা বেশ ধুমধাম করেই হল এবার। মা- বাবা আসতে পারেনি বলে একটু দুঃখ হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু রাম আঙ্কল, সুইটিদিদি, বিধানদাদা সবাই মিলে এত জমিয়ে দিয়েছিল যে, মনখারাপ করার বিশেষ সুযোগ পাইনি। রাম আংকলের মেয়ের সংগেও আমার খুব খুব ভাব হয়ে গেল। বাংলোর বাগানে হুল্লোড় করে অনেক খেললাম আমরা।
দেখতে দেখতে যাবার দিন এসে গেল। মাসীমণি আমাকে পৌঁছিয়ে দিয়ে দুদিন থেকে ফেরত আসবে। কোনমতে দুদিনের ছুটি ম্যানেজ করেছে। রাত্রিবেলা শিলিগুড়ি সার্কিট হাউসে থেকে পরের দিন ভোর পাঁচটায় শতাব্দী এক্সপ্রেস। ওই ভোরে উঠে যাবার পথে রাম আঙ্কল খালি কালি বলে, “সানু নানি, আবার আসবা কিন্তু। ভুলবা না।”
ট্রেনে উঠে বসেছি, জিনিস্পত্র সব তোলা হয়ে গেছে। রাম আঙ্কল না বলে উধাও। মাসীমণি বলে, “রাম না বলে কোথায় চলে গেল? এরকম তো করে না।”
ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগে আগে ঢুকল রাম আঙ্কল। আমার হাতে একগাদা চিপস, বিস্কুট, চকলেট, লস্যির প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, “সানু নানি, আবার আসবা কিন্তু।”
মাসীমণি বোধহয় ধমক দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই সে বলে উঠল, “ম্যাডাম, এটা আমার সানু নানির জন্য। আপনি প্লিজ না করবেন না।”
এমন একটা আর্তি মিশে ছিল রাম আংকলের গলায় যে মাসীমণি আর কিছু বলতেই পারল না।
ট্রেন ছেড়ে দিল। কামরার জানালায় ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে গেল রাম আংকলের মুখ।
পুজো চলে এল। বাবামায়ের এবারে আর ছুটির তেমন অসুবিধা নেই। ওদের বহুকষ্টে রাজি করিয়েছি, এবার পুজোর ছুটিটা কালিম্পং এ কাটানোর জন্য। মাসীমণির তো আর ছুটি নেই। রাম আঙ্কলকে দেখিয়ে দেবো, আমি কথা রাখতে জানি। আবার যাবো বলেছি যখন, যাবোই।
যাবার ঠিক দুদিন আগে এল মাসীমণির ফোন। আমি যথারীতি ফোন ধরে তড়বড় তড়বড় করে বলে যাচ্ছি, কী কী গোছানো হল, আরো কী কী নেওয়া বাকি। কার জন্য কী নিয়ে যাচ্ছি। রাম আঙ্কলের জন্য একটা সুন্দর হলুদ-রঙা টি শার্ট নিয়ে যাচ্ছি। মাসীমণি বলল, “ঝিনাই, প্লিজ থাম। আনিস না।”
একটু কি ধরা ধরা লাগল মাসীমণির গলা? আমি বিশেষ পাত্তা দিলাম না, “শোন মাসীমণি, তুমি এর মধ্যে ঢুকবে না। আমি রাম আঙ্কলকে দেবো, তাতে তুমি বাগড়া দিচ্ছ কেন?”
“প্লিজ ঝিনাই। থাম, আর বলিস না। আর পারছি না।”, মাসীমণির গলা ভেঙ্গেচুরে যেতে যেতে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
অজানা আশঙ্কায় আঁতকে ঊঠলাম আমি, “কী হয়েছে, মাসীমণি?”
“রাম আর নেই রে। প্রেসার বেশি ছিল, কিন্তু ওষুধ খেত না কিছুতেই। কত বলেছি। কাল রাতে খেয়ে উঠতে উঠতেই হার্ট অ্যাটাক। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব শেষ। তুই আসবি শুনে খুব খুশি ছিল। কাল সকালেও বলেছে, সানু নানি কথা রেখেছে। ভোলেনি…”
“না-আ-আ-আ!”, আর্তনাদ করে উঠে ফোনটা রেখে দিলাম আমি।
মা-বাবা ছুটে এল, “কী হয়েছে রে?”
আমি মাথা নাড়তে নাড়তে বললাম, “আমি কালিম্পং যাবো না। কিছুতেই না।”
মা –বাবার স্বর ধাওয়া করছে আমাকে, “যাবি না কেন? কি হয়েছে?”
কী করে বোঝাই, রাম আঙ্কল নিজেই কথা রাখল না?
আমার চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে হলুদরঙা শার্টটা।
………০………