Home / ধারাবাহিক / সপ্তম ও অষ্টম পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

সপ্তম ও অষ্টম পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

সপ্তম পর্ব

7&8vurelbatir vuri chor/mp
শিল্পী- যামিনী খাঁ

         ফিরছিলেন সকলে। থানা পেরিয়ে একটু এগোলেই বিডিও অফিস। বড় বড় করে লেখা ‘সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের কার্যালয়’। দলটা তার পাশ দিয়ে বেরোনোর সময় পয়মন্তের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল কথাটা, “আচ্ছা, ব্লকে গিয়ে বিডিওকে একবার জানালে হয় না?” দেখা গেল, বাকি সবারই মনে কথাটা ঘুরঘুর করছিল। ফলে দলটা গিয়ে সোজা ঢুকল বিডিওর চেম্বারে।

          বিডিও মন দিয়ে কাজ করছিলেন। চারদিকে রাশি রাশি ফাইল, কাগজপত্র। নেহাতই অল্পবয়সী। পুলিন মৃদুস্বরে ডাকল, “ম্যাডাম!”

বিডিও মুখ তুলে চাইলেন। অল্প হেসে বললেন, “বসুন। বলুন, কী ব্যাপার?”

এবারে চিন্তাহরণবাবু খোলসা করলেন। হ্লাদিনী দেবীর মনে হল, বারদুয়েক খুক খুক আওয়াজ বেরোল বিডিওর গলা দিয়ে, কিন্তু সেটা হাসির না কাশির ঠিক ধরতে পারলেন না।

চোখমুখ লাল হয়ে গেছে বিডিওর, কাশি চাপা দিতে গিয়েই হবে হয়তো। টেবিলে পড়ে থাকা একটা রুমাল চাপা দিলেন মুখে। তারপর বললেন, “দেখুন, আপনাদের কথা যদি সত্যিও হয়, তাহলেও তো এরকম  ধারাবাহিক চুরির পিছনে কোন মোটিভ থাকবে।”

পুলিন প্রায় গর্জেই উঠল, “মোটিভ? আমাদের ভুঁড়েলবাটির মানসম্মান ধুলোয় মেশানোই মোটিভ।”

চিন্তাহরণবাবু সুচিন্তিত মন্তব্য পেশ করলেন, “ভুঁড়ি থাকা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। সেই অধিকার খর্ব করা হচ্ছে।”

পয়মন্ত বলে বসল, “ভুঁড়ি ইজ মাই বার্থরাইট অ্যাণ্ড আই শ্যাল হ্যাভ ইট।”

হ্লাদিনী দেবী বললেন, “আমাদের ভুঁড়ৈতিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা যাবে না।”

পুলিন বলল, “অ্যাটেম্পট টু মার্ডার অফ ভুঁড়ি!”

বিডিও বললেন, “দাঁড়ান, আমি এক এক করে আপনাদের ঘটনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ শুনি। কেউ কিচ্ছু বাদ দেবেন না।”

সকলে যে যাঁর অভিজ্ঞতা বলতে শুরু করলেন। সমস্যায় পড়লেন হ্লাদিনীদেবী। এই বয়সে লোকের বাড়ির গাছে পেয়ারা-কুল পাড়তে উঠেছিলেন, এটা সবার সামনে বলতে একটু লজ্জা লজ্জাই করছিল তাঁর। অথচ এদিকে হেডমিস্ট্রেসি জীবনে মিথ্যাবাদিতাকে ভয়ানক ঘৃণা করে এসেছেন। যাইহোক, সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠে বলেই ফেললেন দিনেদুপুরে তাঁর ভুঁড়ি অদৃশ্য হওয়ার ঘটনা। কুল-পেয়ারা চুরির ব্যাপারটা যথাসম্ভব রেখেঢেকেই বললেন। শুনে বিডিও বাদে সবাই একচোট হাসলেন যদিও, তবে হ্লাদিনী দেবী গায়ে মাখলেন না।

সকলের বলা শেষ হলে বিডিও টেবিলের উপরে থাকা পেপারওয়েটটা নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, “আচ্ছা, আমি দেখছি। আপনারা তো থানায় জানিয়েছেন বললেন। আমিও একটু নাড়াচাড়া করে দেখি।”

ওঁরা যখন বেরিয়ে এলেন, পশ্চিম দিগন্তে থাকা সূর্যটাও বিশাল একটা লাল ভুঁড়ির মতোই পশ্চিম দিগন্তে গড়াতে শুরু করেছে। সেদিকে চেয়ে চেয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এল সবারই বুক চিরে।

 

অষ্টম পর্ব

ভুঁড়ি উধাও হওয়ার কিনারা কিন্তু হল না। দিনগুলো গড়িয়ে যেতে লাগলো কুমড়ো গড়ানোর মতোই। মাঝখান থেকে জগত্তারণবাবু আর টিনুবৌদির ভুঁড়িও বেপাত্তা হয়ে গেল। সবাই মিলে একবার থানা, আর একবার বিডিও অফিস ঘুরে এলেন, কিন্তু খুব কাজের কাজ কিছু হল না।

বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে। হ্লাদিনী দেবীর ড্রয়িং রুমে জাঁকিয়ে বসেছেন সবাই। সবারই মুখেচোখে চিন্তার ছাপ।

চিন্তাহরণবাবু বললেন, “চিন্তায় চিন্তায় শুকিয়ে যাচ্ছি, বুঝলে?”

স্টিম ইঞ্জিনের মত ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পয়মন্ত, “ভুঁড়ি কি আর আমাদের কপালে আছে? কথায় বলে কপালের নাম গোপাল!”

হ্লাদিনী দেবী চিরকালই প্রবল আশাবাদী। রিটায়ারমেন্টের দিনেও তিনি স্কুলের মেয়েদের জন্য একগুচ্ছ নতুন কর্মসূচী হাতে নিয়েছিলেন। তিনি বললেন, “হাল ছেড়ো না। হতাশ হোয়ো না। ওতে ভুঁড়ি আরো চুপসে যাবে।”

পুলিন সোফা থেকে তড়াক করে একটা লাফ মেরে বলল, “না! এবারে দেখছি, আমাকেই মাঠে নামতে হবে।”

চিন্তাহরণবাবু মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, “তা তুমি নামো না, কে বারণ করেছে? মাঠে ঘাটে, পুকুরে, জলে-জঙ্গলে, বনে, যেখানে খুশি নামো না, কে বারণ করছে? প্যারাসুট নিয়ে আকাশ থেকে নামলেও বা কে ঠেকাচ্ছে?”

পুলিন খুব উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় জগত্তারণবাবু আর টিনুবৌদি ছাতা গুটোতে গুটোতে এসে ঢুকলেন।

হ্লাদিনী দেবী আহ্বান করলেন, “আসুন, জগুকাকা। টিনু, এসে বসো।”

চোখমুখ আমসি হয়ে যাওয়া জগত্তারণবাবু বসতে বসতে বললেন, “বলি হ্যাঁ হে, তা এই যে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে, বলি প্রতিকারের উপায় ভেবেছো?”

টিনুবৌদি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “দূর ঘটনা নয় জগুকাকা, বলুন নিকট ঘটনা। একদম ভুঁড়ির ওপর চেপে বসেছে।”

চিন্তাহরণবাবু ফস করে বলে উঠলেন, “আঃ, জগু! সবেতেই অত চিন্তিত হয়ো না।”

পুলিন উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে বেশ পুলিশি ঢঙ-এ বলল, “আমার একটা প্রস্তাব আছে।”

সবাই একটু নড়েচড়ে বসল। পুলিনের প্রস্তাব মানে সে নিশ্চয়ই ভালো কিছু ভেবেছে। টিনুবৌদি তার চশমাটাকে নাকের ডগায় নামিয়ে এনে ওপর দিয়ে তাকাল, “বলে ফেল পুলিশ ঠাকুরপো।”

পুলিন তার চুলে বারকয়েক আঙ্গুল চালিয়ে তার বক্তব্য পেশ করে, “আমি ভাবছিলাম, আমাদের একটা ভুঁড়ি সুরক্ষা সমিতি হলে কেমন হয়?”

কাগপুলিনের কথায় জোর গুঞ্জন শুরু হল। হ্লাদিনী দেবী সবে সকালের কাগজের তিন নম্বর পাতা খুলেছিলেন। কাগজ থেকে চোখ না তুলেই আপনমনে বললেন, “ভুঁড়িই নেই তার সুরক্ষা!”

চিন্তাহরণবাবু বললেন, “দাঁড়াও, একটু চিন্তাভাবনা করে দেখি।”

পয়মন্ত তার গলায় সদ্য ঝোলানো একটা মাদুলি নাড়তে চাড়তে বলে উঠল, “শাস্ত্রে বলেছে, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।”

জগত্তারণবাবু সোফায় বসে পেণ্ডুলামের গতিতে পা দোলাচ্ছিলেন। কিছু একটা না বলা খারাপ দেখায়, এই ভেবে তিনি বললেন, “বুঝলে হে ভায়া, কপালের লিখন খণ্ডাবে কে?”

এ কথায় টিনুবৌদি বলল, “কাকাবাবু, ভুঁড়ি কি আপনার কপালে লেখা থাকে নাকি?”

জগুবাবু বললেন, “আহা, বৌমা, তুমি ব্যাপারটা বুঝছ না। কপাল হল সমতল, সেখানে লেখালিখি করা সুবিধে। আর ভুঁড়ি তো গোল, তার ওপর লেখাটা অসুবিধেজনক।”

পুলিন দেখল, এইসব চক্করে তার প্রস্তাবটাই মাঠে মারা যেতে বসেছে। সে বলল, “তাহলে কি ধরে নেবো, আপনারা সবাই রাজি?”

এ কথায় মুহূর্তের মধ্যে প্রবল হইচই বেধে গেল। চিন্তাহরণবাবু বললেন, “যা ব্বাবা! চিন্তা করার সময়ই পেলাম না, তার মধ্যে এত কিছু?”

হই- হট্টগোলের মধ্যেই দোলা ট্রে ভর্তি গরমাগরম পনির পকোড়া আর কফি নিয়ে ঢুকল।

          ঘরের তাপমাত্রার পারদ নেমে গেল মুহূর্তের মধ্যেই।

………০……….

                                                                                                                       ক্রমশ…

(পরবর্তী সংখ্যার জন্য চোখ রাখুন www.utolodhara.com  এ পরের শুক্রবারে)

আগের পর্ব গুলি দেখুন – ধারাবাহিক লিঙ্কে 

 

 

Leave a comment

Check Also

পঞ্চম পর্ব-ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর

পঞ্চম পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

পঞ্চম পর্ব উপর্যুপরি এইসব ঘটনায় গঞ্জে মহা শোরগোল পড়ে গেল। লোকজনের সমবেত চাপা দীর্ঘশ্বাসে প্রায় …

৪র্থ পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর

চতুর্থ পর্ব – ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

চতুর্থ পর্ব মানময়ী গার্লস স্কুলের প্রাক্তন বড়দিমণি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন বছর চারেক আগে। বিয়ে-থা …

তৃতীয় পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

তৃতীয় পর্ব পয়মন্তর মনটা আজ একটু ভার ভার। উপস্থিত ক’দিন যাবত ভুঁড়েলবাটিতে তেমন কোন ঘটনাই …

vurelbatir-vuri-chor2-mp

দ্বিতীয় পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

দ্বিতীয় পর্ব পুলিশবাবুর আজকাল ঘুম থেকে উঠতে বেশ একটু বেলাই হয়ে যাচ্ছে। সবাই তাঁকে ‘পুলিশবাবু’ …