একটা নতুন পাঠশালা খুলেছে শিয়ালনী। বনের ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে প্রচুর গাছপালা মিলে মাথার উপরে একটা চাঁদোয়া ভাসিয়ে দিয়েছে- আর দুটো সেগুনগাছের ইয়া মোটা মোটা গুঁড়ি দু’দিক থেকে এসে একটা দরজার মতো তৈরি হয়েছে। জঙ্গলের যত ছানাপোনা জন্তুজানোয়ার, সবাই আজকাল সক্কালবেলা হলেই হাতমুখ ধুয়ে চাট্টি মুড়ি খেয়ে ওখানেই পড়তে যায়। তাদের মধ্যে আছে হাতির বাচ্চা মেয়ে হাতুশি, বাঘিনীর বাচ্চা ছেলে বাঘু আর হনুমানের ছানা মেয়ে হিনিমিনি। এছাড়াও আছে ভালুকের পুঁচকি মেয়ে ভালকি আর কুমীরের বাচ্চা ছেলে কুমরু।
এখন হয়েছে কী, শিয়ালনী সেদিন সব পোড়োদের রচনা লিখতে দিয়েছে- বর্ষাকালে গায় ব্যাঙ/ ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। লিখতে দিয়ে শিয়ালনী চেয়ারে বসে টুকুস টুকুস করে ঝিমোচ্ছে। সকলে লিখছে, যে যেমন পারে। হাতুশি, হিনিমিনি, ভালকি, কুমরু- সব্বাই। খালি বাঘু বাদে। সে তো ভাল করে লিখতেই পারে না, রচনা লিখবে কী! একটু পরে বাঘু হিনিমিনিকে বলল, “এই, কী লিখেছিস একটু দেখা না!” হিনিমিনি বলল, “তোকে দেখাব না। তুই কাল আমার টিফিন চুরি করে খেয়েছিলি। একটাও কলা খেতে পাইনি।” হাতুশি শুঁড় দোলাল জোরে জোরে, “আমিও দেখাব না। আমারো টিফিন চুরি করে খেয়েছে। কাল মা তালশাঁস দিয়েছিল। খেতেই পেলাম না।”
বাঘু বলল, “দেখাবি না তো?”
ওরা দুজনে অমনি একসাথে ছড়া কেটে বলে উঠল-
দেখাবো না মোটেই খাতা-
কাটা পাবি গাদা গাদা।
একথায় বাঘুর ভয়ানক রাগ হল। সে সাততাড়াতাড়ি তার কালির বোতলটা নিয়ে এসে সবটুকু কালি হাতুশি আর হিনিমিনির খাতার উপর ঢেলে দিল। ব্যস, ওদের দুজনের অত সুন্দর করে লেখা রচনাগুলো কালিঝুলি মেখে একাকার হয়ে গেল। বেজায় রেগে গিয়ে হাতুশি আর হিনিমিনি চলল শিয়ালনীর কাছে নালিশ করতে। শিয়ালনী তখনো টুকুস টুকুস করে ঘুমোচ্ছে তো ঘুমোচ্ছেই।
হাতুশি গিয়ে ডাকল, “ও দিদিমণি!”
হিনিমিনি ডাকল, “ও শেয়াল মিস!”
ডাক শুনে শিয়ালনী তড়িঘড়ি করে চশমাটা চোখে ভালো করে এঁটে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার?”
হাতুশি উত্তর দিল, “দেখুন না দিদিমণি, বাঘু আমাদের খাতায় কালি ঢেলে দিয়েছে।”
হিনিমিনি একটু কাছে এগিয়ে এল, “ওই যে, আপনি ঘুমোচ্ছিলেন না! সেইসময়।”
শিয়ালনী কটমট করে চাইল, “মোটেই আমি ঘুমোইনি। পরের ক্লাসে তোদের কী পড়াব, সেইটা ভাবছিলাম। যাকগে, কী হয়েছে?”
ওরা দুজনে হাঁউমাঁউ করে উঠল, “এই দেখুন না, বাঘু আমাদের খাতায় কালি ঢেলে দিয়েছে।”
“বাঘু!!!”, ঘর কাঁপিয়ে ডাকল শিয়ালনী।
সেই ডাক শুনে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এল বাঘু।
“বাঘু, কান ধর।”
এ কথায় বাঘু বেজায় অবাক হয়ে শুধোল, “কার কান, দিদিমণি?”
“কার কান আবার? তোর নিজের কান।”, এক ধমক দিল শিয়ালনী।
বাঘু বাঁ হাতে বাঁ কান ধরল। তাই দেখে দুই নম্বরের ধমকটা দিল শিয়ালনী, “দুটো কানই ধর।”
বাঘু এবারে বাঁ হাতে ডান কান আর ডান হাতে বাঁ কান ধরল। তাই দেখে তিন নম্বরের ধমকটা দিল শিয়ালনী, “বাঁ হাতে বাঁ কান আর ডান হাতে ডান কান ধর।”
এর ওপর তো আর কথা চলে না। বাঘু এবার ঠিকঠাক করে কান ধরল। “নে, এবার ওঠবোস কর।”
বাঘু একবার বসেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।
“কী হল, থেমে গেলি যে?”, চার নম্বরের বকুনিটা দিল শিয়ালনী।
বাঘু তাও দমে না, “বা রে, আপনি তো কতবার ওঠবোস করবো, সেটা কিছু বলেননি।”
“ঠিক আছে। এবারে বলছি। নে, একশ বার ওঠবোস কর। হাতুশি আর হিনিমিনি, তোরা খেয়াল রাখবি।”
ক্লাসশুদ্ধু সবার হাহা-হিহির মাঝে বাঘু ওঠবোস শুরু করল বটে, কিন্তু মনে মনে বেজায় চটল হাতুশি আর হিনিমিনির ওপর।
রোজ পাঠশালা শুরুর আগে প্রার্থনা হয়। ক্লাসের বাইরে লাইন করে দাঁড়িয়ে সুর করে গান গাওয়া হয়। শিয়ালনীর লেখা গান-
বুনো বুনো গন্ধ
গানেরই ছন্দ-
কচি কচি পশুদের মেলা…
মোদের এই পাঠশালা।।
বনের এই কোণেতে
আলো- ছায়া মেশাতে…
হই হই যত খুশি খেলা-
মোদের এই পাঠশালা।।
রঙ ভরা মন নিয়ে
লিখি পড়ি দিল দিয়ে-
আসা চাই সকালবেলা…
মোদের এই পাঠশালা।।।।
এখন হয়েছে কী, ক্লাসের সবাই প্রার্থনা করতে বেরিয়ে গেলে বাঘু চুপিচুপি কিসব করল। তারপর সবার পিছনে গিয়ে সোনামুখ করে দাঁড়াল। এদিকে তখন প্রার্থনা সবে শুরু হয়েছে।
প্রার্থনার শেষে ক্লাসে ঢুকেই তো হাতুশি আর হিনিমিনির মাথায় হাত! তাদের দুজনের ব্যাগই কে যেন কেটেকুটে একাকার করে রেখেছে!
শিয়ালনী ক্লাসে ঢুকলে রোজ সকলে উঠে দাঁড়িয়ে ‘দিদিমণি নমস্কার’ বলে। তারপর পড়া শুরু হয়। আজ শিয়ালনী ঢুকতেই হাতুশি আর হিনিমিনি একসাথে হাঁউমাঁউ করে উঠল, “দিদিমণি, দেখুন, আমাদের ব্যাগগুলো কেউ ছিঁড়ে দিয়েছে।” শিয়ালনী জিজ্ঞেস করল, “কে সবার শেষে আজ প্রার্থনায় গিয়েছিল?”
জোরালো একটা আওয়াজ উঠল- “বাঘু!” ভালকি আরো বলল, “দিদিমণি, বাঘু না অনেকক্ষণ ক্লাসে একা ছিল।”
এদিকে বাঘু তখন জড়সড় হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
শিয়ালনী তো বুঝল যা বোঝার। গমগমে গলায় ডাকল, “বাঘু! বাঘুউউউউ!”
বাঘু কাছে আসতে শিয়ালনী বলল, “শোন, তুই আজ সারাদিন ক্লাসের বাইরে নিজের কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক। কোন হাতে কোন্ কান ধরবি সেটা তোর ব্যাপার। মোটকথা, তুই আজ আর ক্লাসে বসতে পাবি না।”
বাঘু তো চলে গেল বাইরে। বাইরে সেদিন বৃষ্টিতে বেশ জলকাদা হয়েছিল। বাঘু তার থাবা দিয়ে যতটা পারে গর্ত করে রাখল পাঠশালা থেকে বেরোনোর রাস্তাটা।
ছুটি হতেই রোজকার মতন হাতুশি বেরোল সবার আগে। আর বাইরে বেরোনো মাত্রই সেই গর্তে পা পড়ে ধপাস্! আর বাঘুর সে কী ফূর্তি! সমানে হাততালি দিয়েই যাচ্ছে। ভাগ্যে হিনিমিনি চটপট চটপট করে পাশের মাটিতে একটা মোটা ডাল পুঁতে দিল। সেই ডালে শুঁড়ের ভর দিয়ে আর হিনিমিনিকে ধরে কোনরকমে উঠল হাতুশি।
যেতে যেতে হিনিমিনি জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে হাতুশি, তোর খুব লেগেছে না রে?”
হাতুশি বলল, “লেগেছে তো বটেই। তবে আমি ভাবছি অন্য কথা।”
হিনিমিনি শুধোল, “কী?”
হাতুশি বলল, “দ্যাখ! আমি যেটা ভাবছি, এরকম তো চলবেই। বাঘু আমাদের নাকাল করবে, আমরা দিদিমণিকে বলব, দিদিমণি ওকে কিছু সাজা দেবে। পরের দিন আবার বাঘু অন্য কিছু বদমাইশি করবে। এমন করে আর ক’দিন চলবে?”
হিনিমিনি শুনে বলল, “তা যা বলেছিস। বাঘুটা যা দুষ্টু। এমন কিছু করতে হবে, যাতে ও আর একদম আমাদের পেছনে লাগার সাহস না পায়।”
হাতুশির শুঁড়ের কাছে একটা মাছি ঘুরঘুর করছিল অনেকক্ষণ ধরে। জোর একটা ফুঁ-উ-উ-উ-স দিয়ে মশাটাকে হুই তালগাছটার ওপারে পাঠিয়ে দিল হাতুশি। তারপর বলল, “আইডিয়া!”
হিনিমিনি জিজ্ঞেস করল, “কী আইডিয়া রে, হাতুশি?” হাতুশি বলল, “এদিকে আরো কাছে আয়। কানে কানে বলছি। কেউ শুনলে মুশকিল।
শুনতে শুনতে হিনিমিনির চোখে আলো খেলে গেল। বলল, “দারুণ! কাল সকালেই তবে…।”
পরের দিন পাঠশালাতে প্রার্থনা হবার পর বাঘু নিজের জায়গায় বসে ব্যাগটা খুলতেই দ্যাখে, তার ভেতর একটা ভারি সুন্দর কার্ড। কী সুন্দর লতাপাতা নকশা করা। মাঝে আবার কিসব লেখাও আছে। লেখাটা পড়তে থাকে বাঘু। সেখানে লেখা আছে-
প্রিয় বাঘু,
তোমার সাহস আর বুদ্ধি দেখে আমি খুব খুশি। তুমি যেভাবে হাতুশি আর হিনিমিনিকে নাকাল করেছ, সেটা দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। হাতুশি আর হিনিমিনিকে একদম বিশ্বাস কোরো না। ওরা দুজনেই খুব পাজী। যাই হোক, তোমার উপর খুশি হয়ে আমি তোমাকে একটা উপহার দেবো ঠিক করেছি। তুমি একটা কাজ করবে। আজ পাঠশালা ছুটির পর বনের পশ্চিমদিকে যে বুড়ো বটগাছটা আছে, ওখানেই চলে আসবে। আমি তোমার জন্য উপহার নিয়ে অপেক্ষা করব।
ইতি-
কচাং কচাং কুচ।
পুঃ- হাতুশি আর হিনিমিনিকে কিন্তু এসব কথা একদম জানাবে না। তাহলে কিন্তু ওরা তোমার উপহার ছিনিয়ে নিতে পারে।
কার্ডটা দুবার ভালো করে পড়ল বাঘু। হুঁ হুঁ বাবা, এইবারে হাতুশি আর হিনিমিনি মজাটি টের পাবে। ক্লাসের ফাঁকে দু- চার কলি গানও বেরিয়ে গেল তার।
যাইহোক, পাঠশালা যখন শেষ হল, বাঘু মহানন্দে চলল বনের পশ্চিমদিকে। সোজা গিয়ে সে সেই বুড়ো বটগাছটার তলায় থামল। তারপর হাঁক পাড়ল- কচাং কচাং কুচ! কচাং কচাং কুচ!
একটু পরেই গাছের ডালপালার ফাঁক থেকে একটা গমগমে গলা ভেসে এল- বাঘু! তুমি এসে গিয়েছ। আমি খুব খুশি। তোমার উপহার আমি ওপর থেকে ফেলে দিচ্ছি। এই পুঁটলিতে তুমি পা দিয়ে জোরে ধাক্কা মারবে। তাহলেই তোমার চারপাশে কত দারুণ দারুণ জিনিস ছড়িয়ে পড়বে।
বলতে না বলতেই ওপর থেকে একটা পুঁটলি এসে ধপ করে পড়ল বাঘুর সামনে। আর বাঘুও অমনি জোরে একটা লাথি কষিয়েছে পুঁটলিটায়। আর তার সাথে সাথেই পা পিছলে গিয়ে- টিয়ে জোর আছাড় খেল বাঘু আর পুঁটলিটা খুলে গিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে গেল একরাশ কলার খোসা। বাঘু যখন ভাবতে বসেছে যে ব্যাপারটা কী হল, ঠিক তখন ওপর থেকে আর একটা পুঁটলি তার গায়ে পড়ে পুরো শরীর তার ধুলোয় ভরে গেল।
কোনমতে চোখ মেলে বাঘু দেখল, গাছের ওপর থেকে নেমে আসছে হিনিমিনি, তার হাতে একটা মাটির হাঁড়ি ধরা। এতক্ষণ সে ওই মাটির হাঁড়ির মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে কথা বলছিল।
কলার খোসা আর ধুলোকাদার মধ্যেই লটরপটর করতে করতেই বাঘুর আরো চোখে পড়ল, হাতুশির সঙ্গে তার দিকেই ধেয়ে আসছে বাঘুর মা, বাঘিন্নী।
বাঘিন্নীকে আজ শিয়ালনী ডেকেছিল পাঠশালায়। বাঘুর নামে সবকথা শুনে এমনিতেই তার মেজাজ গরম হয়ে ছিল। তার উপরে হাতুশির ডাকে এখানে এসে দেখে এই অবস্থা!
হাতুশি আর হিনিমিনি তার সামনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। বাঘিন্নী ফুঁসছে। বাঘু বেচারি আর থাকতে না পেরে কান্নাই জুড়ে দিল, “আর কোনদিন এমন করবো না… আঁই আঁই আঁই(কান্না)… আর কোনদিন টিফিন চুরি করব না… আঁই আঁই আঁই(কান্না)… আর কোনোদিন কারুর খাতায় কালি দেব না… আঁই আঁই আঁই(কান্না)… আর কোনদিন ব্যাগ ছিঁড়ব না… আঁই আঁই আঁই(কান্না)… আর আছাড় খাওয়াবো না… আঁই আঁই আঁই(কান্না)… ওরে আমার হাতুশি রে… ওরে আমার হিনিমিনি রে… আঁই আঁই আঁই আঁই আঁই আঁইইইইই!!”
………..o………