Home / ধারাবাহিক / চতুর্থ পর্ব – ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

চতুর্থ পর্ব – ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

চতুর্থ পর্ব

৪র্থ পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর
শিল্পী- যামিনী খাঁ

মানময়ী গার্লস স্কুলের প্রাক্তন বড়দিমণি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন বছর চারেক আগে। বিয়ে-থা করেননি। একাই থাকেন একটি বুড়ি ঝিকে নিয়ে। দুর্জনেরা বলে, তাঁর বাবা মেয়েকে বিস্তর বুঝিয়ে সুঝিয়ে একখানা সুপাত্র জোগাড় করতে পেরেছিলেন বটে, কিন্তু যেই হ্লাদিনী দেবীর কানে গেল যে পাত্রের ভুঁড়ি নেই, সুঠাম নির্মেদ শরীর, অমনি সটান বিয়ে ক্যানসেল।

রিটায়ার করার পরেও হ্লাদিনী দেবীর দাপট এতটুকুও কমেনি। রোজ সকালে নিজেই ব্যাগ হাতে বাজার করতে যান। সব্জিওয়ালা, মাছওয়ালাদের অনেকেই তাঁর স্কুলের মেয়েদের গার্জেন। তাদের ধমকে-চমকে অস্থির করে যতোটা দাম কমানো যায় কমান। তারপর ধীরে সুস্থে এক ব্যাগ বাজার নিয়ে ভুঁড়ি দোলাতে দোলাতে বাড়ির পথে হাঁটা লাগান।

তা আজও চলছিল সব ঠিকঠাক। তাঁকে দেখেই সব্জিওয়ালারা ত্রাহি মধুসূদন জপতে শুরু করে দিয়েছিল। হ্লাদিনী দেবী প্রথম যে সব্জিওয়ালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, তার নাম জগাই। জলদ্গম্ভীর স্বরে তিনি হাঁকলেন, “জগাই! তোর মেয়ে টেস্টে অঙ্কে কত পেয়েছিল রে?”
মিউমিউ করে জগাই জানায়, “ইয়ে, মানে, কোনরকমে পাশ করেছিল, বড়দিমণি।”
“হুমমম। তা কদিন পরেই তো মাধ্যমিক পরীক্ষা। তা কাল কানা বেগুন দিয়েছিলি যে বড়? ধর্মের কল বাতাসে নড়ে, জানিস তো?”
ব্যস, ওতেই জগাইয়ের হয়ে গেল। ঠিকঠাক আনাজ না দিলে বড়দিমণির অভিশাপে পুঁটি এবারও ফেল মারতে পারে!
জগাই পরম ভক্তিভরে একরকম জলের দরেই হ্লাদিনী দেবীর থলে গুছিয়ে দিল। সন্তুষ্টচিত্তে তিনি এবারে গেলেন বাজারের অন্য প্রান্তে।
এবারের টার্গেট মাধাই। সে পরম নিশ্চিন্তে একটা বস্তা থেকে আলু বের করছিল আর অন্য একটা বস্তায় ভরছিল। হ্লাদিনী দেবী গিয়ে হাঁক পাড়লেন, “হ্যাঁ রে, মাধাই, পচা আলুগুলো কি বেছে বেছে সাজিয়ে রাখছিস?”
আচমকা বজ্রনির্ঘোষে খানিকটা হকচকিয়ে গেলেও তাড়াতাড়িই সামলে নেয় মাধাই। দন্ত বিকশিত করে বলে, “কী যে বলেন দিদিমণি, আপনাকে কি আর পচা আলু দিতে পারি?”
হ্লাদিনী দেবী আর এক চোট দাবড়ানি দেন, “দিতে পারি, মানে? বলি মানেটা কী? তুই বলতে চাস, তুই পরশু আমার ব্যাগে খান চারেক পচা আলু ঢোকাস নি?”
আচ্ছাটি করে জিভটিভ কেটে মাধাই বলে, “এই যাঃ, দিদিমণি! মনে পড়েছে। সেদিন আপনার আর ভবেশবাবুর ব্যাগদুটো পাশাপাশি ছিল বলেই মনে পড়ছে। একইরকম ব্যাগ তো, ওনারটায় ঢোকাতে গিয়ে হয়তো আপনারটায় ভুল করে ঢুকিয়ে ফেলেছি।”

“ভুল যখন করেই ফেলেছিস, ভুলের প্রায়শ্চিত্ত কর। গুরুশাপ জানিস তো, একবার লেগে গেলে আর রক্ষে নেই।”
কঠোর নিদান দিয়ে হ্লাদিনী দেবী কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জরিপ করতে লাগলেন মাধাইকে।
মাধাইয়ের দুই মেয়ে প্রায়ই বাড়িতে “বড়দিমণি-বড়দিমণি” খেলে। পাছে গুরুশাপে তাদের বড়দিমণি হওয়া ভেস্তে যায়, এই ভয়ে মাধাই সাততাড়াতাড়ি জিভটিভ কেটে দাঁত বের করে বলে, “সে কী কথা,দিদিমণি? আপনি থলেটা বাড়ান,আমি আগের দিনেরটা আপনাকে ফ্রিতেই দিচ্ছি। আর সাথে আধা কিলো ফাউ।”
সব্জিওয়ালার পর মাছওয়ালা। মাছওয়ালা নিতাইয়ের বড়োমেয়েটা পড়াশুনোয় বেশ ভালো। ফি-বছরই ক্লাসে প্রথম কয়েকজনের মধ্যে থাকে। এবারে উচ্চমাধ্যমিক দেবে।
নিতাই এক খদ্দেরের ব্যাগে গুনে গুনে মাছের পিস ডোকাচ্ছিল- সাত, আট, নয়, দশ, এগারো…।

হ্লাদিনী দেবী খুব মিহিস্বরে হাঁক পাড়লেন, “নিতাই, ও বাবা নিতাই!”
নিতাই আমল দিল না। সারাদিন কত খদ্দের এসে তাকে গলাবার চেষ্টা করে। ওতে টসকালে কি তার চলে?
সাড়া না পেয়ে হ্লাদিনী দেবী এবার অন্য রাস্তা ধরলেন, “নিতাই, বলি ও বাবা, আশালতা ঠিকঠাক পড়াশুনো করছে তো?”
মেয়ের নামটা কানে যেতেই তড়িৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠে তাকায় নিতাই, “বড়দিমণি? আপনি? আমি আসলে এই বাবুকে মাছ দিচ্ছিলাম, তাই খেয়াল করিনি।”
“তা আর কেন করবি বাবা? সবার কাছেই শুনি, তুই আজকাল রীতিমতো লায়েক হয়েছিস। তা যাকগে, আশালতা কেমন পড়াশুনো করছে বল। উচ্চমাধ্যমিকে জেলার মধ্যে রেজাল্টে আসবে তো?”
তার লায়েক হবার সংবাদে এর মধ্যেই নিতাই মনে মনে বেজায় দমে গেছে। তাই সে কোনমতে মিনমিন করে বলল, “তা দিদিমণি, আপনি যদি আশীর্বাদ করেন…”
“আশীর্বাদ? হুমমম।”, ভোঁ-ও-ও-স করে একটা একফুট লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন হ্লাদিনী দেবী, “সে যাক, তুই বল, তোর মাছের আজ কী দর যাচ্ছে?”
মাছের দর যাই হোক, নিতাই এখন আশীর্বাদ পেতে মরীয়া। তড়িঘড়ি বলে, “ও মাছের দর নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। একদম কেনা দামেই আপনাকেই ছেড়ে দিচ্ছি। টাটকা দেশি কাতলা, খেয়ে সুখ পাবেন। কিন্তু দিদিমণি, আপনার আশীর্বাদ না পেলে আশালতা যে একেবারে ডুবে যাবে।”

“আহা! তা কেন হবে? আশালতা আমার বিশেষ স্নেহের পাত্রী”, নিতাইয়ের চোখ এড়িয়ে একটু মুচকি হাসেন হ্লাদিনী দেবী, “ওকে আমি এই অনেক আশীর্বাদ করে দিলাম। দেখবি, ও খুব ভালো রেজাল্ট করবে। আর বিশেষ করে তোর মতো এমন মহৎপ্রাণ বাবার মেয়ে যখন।”
বলতে গেলে একরকম জলের দরেই মাছ ঢুকে যায় তাঁর বাজারের থলিতে। খুশি খুশি মনে এবারে বাড়ির পথ ধরেন তিনি। বাজারটা আজ, মোটের ওপর, মন্দ হয়নি।

তিনখানা বাজারের থলি দুই হাতে নিয়ে ফেরার পথে রমেনবাবুদের বাড়ির সামনেটায় পাদুটো কীরকম যেন আটকে গেল হ্লাদিনী দেবীর। দীর্ঘকাল বাড়িটা তালাবন্ধ পড়ে আছে। রমেনবাবুর মেয়ে দিল্লীতে কীসব উঁচু পোস্টে চাকরি করে, রমেনবাবুরা তার কাছেই থাকেন। আসেনই না প্রায়। বাগানভর্তি জঙ্গল। খাবার লোক নেই বলে কুলগাছ ভর্তি থোকা থোকা কুল, পেয়ারাগাছ ভর্তি থরে থরে পেয়ারা হাপুসনয়নে কাঁদছে। পাড়ার ছেলেছোকরারা আজকাল ভিডিও গেমস, মোবাইল এসব নিয়েই ব্যস্ত। সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট না কিসব ছাইপাঁশ হয়েছে, সেখানে নাকি এরকম খামার বানিয়ে ভারচুয়াল পেয়ারা পেড়ে খাবার বন্দোবস্ত আছে বলে তিনি শুনেছেন। কুল-পেয়ারা এসব নাকি তারা মুখেও তোলে না। রোল, পিজ্জা, নুডলস এসব না হলে মুখে রোচে না তাদের।
কুল-পেয়ারাগুলো যেন তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। নিচু পাঁচিলটার ওপর ব্যাগ তিনটে নামালেন। পাঁচিলটা কোনমতে টপকিয়ে আবার ব্যাগ তিনটে হাতে নিলেন। কাছাকাছি মানুষজন নেই, এই রক্ষে। নইলে লজ্জার একশেষ হত!

বিস্তর আগাছা। জঙ্গল হয়ে আছে জায়গাটা। কুলগাছ ভর্তি কুল, পেয়ারাগাছ ভর্তি পেয়ারা। কয়েকটা কুল পেড়ে মুখে পুরলেন। দিব্যি মিষ্টি। খেতে খেতে আবেশে চোখ প্রায় বুজে এল।
কুল খেয়ে মনকে কথঞ্চিৎ শান্ত করে হ্লাদিনী দেবী এবার মন দিলেন পেয়ারাগাছে। আহা রে! কতকাল বেচারিদের কেউ ছোঁয়নি। দেখো! পুরো অচ্ছুত করে রেখেছে। দাঁড়া রে, বাবারা, দাঁড়া। দুঃখু পাস না। আমি আসছি।
এদিক ওদিক তাকিয়ে শাড়ির কুঁচিটাকে মালকোঁচা মেরে দক্ষিণী মেয়েদের কায়দায় পিছনে গুঁজলেন। তারপর পেয়ারাগাছ বেয়ে উঠতে লাগলেন।
একে দীর্ঘদিন গাছে চড়ার অভ্যেস নেই, তায় ভুঁড়িটা পদে পদে বাগড়া দিচ্ছে। কোনরকমে হাঁচোড় পাঁচোড় করে পেয়ারাগাছটার দোতলায় উঠলেন। একটা মজবুত ডাল দেখে তার দুপাশে পা দুটো নীচের দিকে ঝুলিয়ে দিয়ে বেশ মৌজ করে বসলেন তিনি। চারিধারে ফলন্ত পেয়ারা। পাড়ছেন আর খাচ্ছেন, খাচ্ছেন আর পাড়ছেন। জায়গাটা দিব্যি নিরিবিলি। খেতে খেতেই হ্লাদিনী দেবী নজর চালাচ্ছিলেন চারপাশে। আচমকা একটা পাখির টু-ই-ই-ই ডাকে পাখিটাকে নজর করতে গিয়েই চোখে পড়ল লোকটাকে। অনেকটা দূরে, শিশিরদের একতলা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে একটা বাইনোকুলার মতো কী একটা চোখে লাগিয়ে এদিকেই তাক করে আছে।
আর ঝুঁকি নিলেন না হ্লাদিনী দেবী। আধখাওয়া পেয়ারাটাকে কোনমতে মুখের মধ্যে পুরে প্রায় তরতর করেই নেমে এলেন। দুহাতে তিনটে থলে নিয়ে হনহন করে বাড়ি আসার সময়ও শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছিল। তবে কিনা, মনের নিদারুণ চিন্তায় শরীরকে কে কবেই বা পাত্তা দিয়েছে?

বাড়ি ফিরে দেখলেন, ঠিকে কাজের মেয়ে দোলা এসেছে। দোলাকে তিনি বিশেষ পছন্দ করেন না। বড্ডো বেশি বকে আর প্রচণ্ড মিথ্যেবাদী। তাঁকে দেখেই দোলা হইহই করে উঠল, “এই যে দিদিমণি, কখন থেকে তোমার জন্য বলে হেদিয়ে মরছি। যাও, যাও, তাড়াতাড়ি ঘরদোর খোলো। চটপট কাজ সেরে বিদেয় হই। এখনো তিনঘরের কাজ বাকী।”
মহা বিরক্ত হয়ে হ্লাদিনী দেবী তাঁর হেডমিস্ট্রেসি কালের বিখ্যাত চাউনি দিয়ে আর ততোধিক বিখ্যাত জলদগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “দ্যাখ দোলা, বেয়াদপির একটা সীমা আছে। নিজের কাজ করবি যা। আজ যদি দেখি, ঘরদোর ঠিকঠাক পরিষ্কার হয়নি, তাহলে তোর কিন্তু একদিনের মাইনে কাটা যাবে।”

অন্যদিন হলে দোলা ঝগড়াঝাঁটি করে হুলুস্থূল বাধাত, আজ সেসবের ধার দিয়েই গেল না। বরং একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকা খিলখিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল, “বলি ও দিদিমণি, তোমার ভুঁড়ি গেল কোথায়, অ্যাঁ?”
হতভম্ব হ্লাদিনী দেবী মুহূর্তের প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় পেটের ওপর হাত রাখলেন। মসৃণ, নির্মেদ পেটের ওপর দিয়ে হাতটা সড়াক করে পিছলে গেল।

………০………

ক্রমশঃ……

(পরবর্তী সংখ্যার জন্য চোখ রাখুন www.utolodhara.com  এ পরের শুক্রবারে)

আগের পর্ব গুলি দেখুন – ধারাবাহিক লিঙ্কে 

Leave a comment

Check Also

ষষ্ঠ পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভু্ঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

ষষ্ঠ পর্ব নতুন দারোগাবাবু গুছিয়ে বসে নানান ভাবনাচিন্তা করছিলেন একটু আগে। তাঁর পূর্বসূরী খাসা একখানা …

পঞ্চম পর্ব-ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর

পঞ্চম পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

পঞ্চম পর্ব উপর্যুপরি এইসব ঘটনায় গঞ্জে মহা শোরগোল পড়ে গেল। লোকজনের সমবেত চাপা দীর্ঘশ্বাসে প্রায় …

তৃতীয় পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

তৃতীয় পর্ব পয়মন্তর মনটা আজ একটু ভার ভার। উপস্থিত ক’দিন যাবত ভুঁড়েলবাটিতে তেমন কোন ঘটনাই …

vurelbatir-vuri-chor2-mp

দ্বিতীয় পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

দ্বিতীয় পর্ব পুলিশবাবুর আজকাল ঘুম থেকে উঠতে বেশ একটু বেলাই হয়ে যাচ্ছে। সবাই তাঁকে ‘পুলিশবাবু’ …