এপ্রিল মাস টাস হবে। জলছবি অফিসে কাজ করছে, পাশেই এক সহকর্মিণী। টুকটাক মোবাইল ঘাঁটছেন, কাজ করছেন, গল্পও করছেন অল্পস্বল্প। এমন সময় রাস্তার মোড় থেকে লতা মঙ্গেশকরের সুরেলা কণ্ঠস্বর ভেসে এল- অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ…
জলছবি কিছুটা উতলা। এ গান যখনই কর্ণকুহরে প্রবেশ করে, বুকের মধ্যে, মনের মধ্যে একটা অন্য রকমের অনুরণন তৈরি হয়। পুরো সত্তাটাই যেন ওকে নিমেষে অন্য কোন লোকে চলে যায়। জলছবির হাতের কলম কয়েক মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে, এমন সময় আরেকটি স্বর প্রবেশ করল কানে। সহকর্মিণীর। “এই ভরদুপুরে এই রকম এই গান চালিয়েছে! তাও ২৬ শে জানুয়ারি, ১৫ই আগস্ট হলে হত! এই সময়ে এই গান! আজিব!”
মুহূর্তেই হতবাক্ জলছবি। হাজারো শব্দ ভিড় করে এল মুখে এবং কোন কথাই বলে উঠতে পারল না শেষ পর্যন্ত ভদ্রতা রক্ষার দায়ে। জলছবির সেদিন খুব বলতে ইচ্ছে করেছিল যে আমরা কি শুধুমাত্র বছরের এই দুটো দিনই স্বাধীন? বছরের প্রতিটা দিনই তো আমরা স্বাধীনতা ভোগ করি, অথচ সেটুকুর সামান্যতম উদ্যাপনেও দোষ?
আম বাঙালি যদি জলছবির সহকর্মিণীর মতো না ভাবেন, তাহলে সত্যিই আশার কথা। কিন্তু তলিয়ে দেখতে গেলে, বছরে এই দুটো দিনই আমাদের দেশভক্তির জোয়ার ওঠে। আর তার বন্যায় হোয়াটসঅ্যাপ- ফেসবুকের কূল ভাসিয়ে ফোনের মেমরি উপচে পড়ে। গলিতে গলিতে, পাড়ায় পাড়ায়, রাস্তার এপারে ওপারে স্বাধীনতা দিবস পালনের ভয়ানক প্রতিযোগিতা দেখি আজকাল।একটি জাতীয় পতাকা, আর তার চারিধারে সারি সারি দলীয় পতাকা। কোথাও বা দলীয় পতাকা আর জাতীয় পতাকা সম উচ্চতায় বিরাজ করছে। দেখেশুনে কিরকম যেন গুলিয়ে যায়। এই কি সেই স্বাধীনতা যার জন্য ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, প্রীতিলতা, মাস্টারদা, ভগৎ সিং, বিনয়-বাদল- দীনেশের মত মানুষেরা মৃত্যুবরণ করেছিলেন? মানছি, ওই মানুষগুলোর মত অভ্রভেদী উচ্চতায় পৌঁছনো সম্ভব নয়, কিন্তু স্বাধীনতার নামে এরকম নির্লজ্জ দলাদলিও অসহ্য। বিদেশী শক্তি পায়ে পায়ে বেড়ি পরালে সে বন্ধন কেটে বেরিয়ে আসার পথ আছে, কিন্তু নিজের পায়ে নিজেই শিকল পরালে তা ভাঙা একপ্রকার দুঃসাধ্য।
কম তো বয়স হল না স্বাধীনতার। মাঝে মাঝে ধাঁধা লাগে, ইংরেজ শাসন কি অবলুপ্ত, নাকি শেষ হয়েও হইল না শেষ? আমাদের চলনে- বলনে, আচার- আচরণে, বেশভূষায়, ভাষা- কথাবার্তায় ইংরেজের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের প্রমাণ প্রতি পদে দিয়ে চলেছি আমরা। দাসত্ব জিনিসটা খারাপ, আরো বেশি খারাপ হল মন যখন স্বেচ্ছায় সেই দাসত্ব স্বীকার করে নেয়। ব্রিটিশ শাসনে বাঙালীর শৌর্যবীর্যের প্রচুর প্রমাণ যেমন বিদ্যমান, তেমনই বাঙালির পদলেহনের নমুনাও নিতান্ত কম নয়। আসল কথা, আমরা আমাদের দাস মনোবৃত্তির কাছে নিজেরাই গোহারান হেরে বসে আছি। আমাদের ভাষা, আমাদের খাদ্যাভ্যাস, দৈনন্দিন জীবনযাপনের ধরনধারণ যে কোন অংশেই হীন নয়, বরং অনেকাংশেই শ্রেয়- এই উপলব্ধিটুকু আসা একান্ত প্রয়োজন।
শিক্ষিত বাঙালি আজকাল সকালে ‘ব্রেড বাটার’ দিয়ে ‘ব্রেকফাস্ট’ সারে, লাঞ্চে রাইস-চিকেন হলে জমে যায়, বিকালে বার্গার- প্যাটিস- স্যাণ্ডুইচ না হলে রাতের ডিনারের অ্যাপেটাইটটাও ঠিক আসে না। ইংলিশ মিডিয়ামের বাঙালি দিদিমণিরা আর কিছু পারুন নাই পারুন, সদ্য বোল ফোটা বাচ্চাদের ‘থ্যাংক ইউ’ আর ‘সরি’ শেখাতে বদ্ধপরিকর। বোকার মত মনে প্রশ্ন জাগে, প্রবল জ্বরে বাচ্চার কপালে জলপট্টি দেওয়া বাঙালি মাকে বাচ্চা কখন ‘থ্যাংক ইউ’ দেবে? জ্বরের ঘোরেই বিড়বিড় করে নাকি সেরে গেলে? যতগুলো জলপট্টি ততগুলোই কি ‘থ্যাংক ইউ’ দিতে হবে? নাকি একটা বড়ো করে দিলেও চলবে? স্কুলের পোশাকও সেই ইংরেজি মাপকাঠিতেই চলছে। গলাবন্ধ, দমচাপা। ভারতের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশের পক্ষে যা একেবারেই অনুপযোগী। প্রবল গরমে ইংরেজি কেতার ভারতীয় কোট- প্যান্ট- টাই পরে গলদঘর্ম হয়ে ইন্টারভিউ দিতে ছোটে। ময়ূরপুচ্ছধারী কাক হওয়াটা যেমন হাস্যকর, তেমনি কাকপুচ্ছধারী ময়ূর হওয়াটাও কাজের কথা নয়। রাশিয়া বা জার্মানদের জাত্যভিমানের কথা বাদই দিলাম, কিন্তু ঘরের পাশের ভুটানকে দেখেও তো শেখা যেত।
অথচ আমাদের সামনে সুযোগ ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী দশকগুলোতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যা কিছু ভালো, সেটুকু ছেঁকে নিয়ে এক নতুন ভারত গড়ার। আমরা বিদেশের বাজে জিনিসের অনুকরণ করেছি এবং হেলায় হারিয়েছি আমাদের নিজস্ব সম্পদ। কিন্তু বিশেষ করে ১৯৯১ সালের মুক্ত অর্থনীতির পর ভোগবাদের যে বন্যা বয়ে গেল, তাতে আমরা খড়কুটোর মত শুধু ভেসেই চললাম। তাগা- তাবিজ আমরা সযত্নে ধারণ করে রেখেছি, আবার ‘টাচ উড’ বলাও শিখেছি অবলীলাক্রমে। এখন আমরা বাজার যেমন চালায়, তেমন চলি- যেমন ভাবায়, তেমন ভাবি। ফল, আমাদের আকাশে বিষ, খাবারে বিষ, মাটিতে বিষ। গ্রামীণ বাংলার স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি আজ কার্যতঃ ধ্বংসপ্রাপ্ত। গ্রাম-বাংলার কামার-কুমোর-কলু-তাঁতি মোটামুটি মিউজিয়ামে যাবার পথে পা বাড়িয়েছে। একদিকে পারিবারিক জীবিকার উপর নির্ভরশীল মানুষগুলো যেমন বংশানুক্রমিকভাবে চলে আসা কাজে আগ্রহ হারিয়েছেন ( আগ্রহ থাকলেও পেট চালানো মুশকিল), একই সঙ্গে চাপ বাড়ছে শহরগুলির ওপর।
বাংলা বাক্যের মধ্যে যিনি যত বেশি ইংরেজি শব্দ গুঁজতে পারেন, তিনি তত বেশি পণ্ডিত। ‘ট্যাগোর’ ইংরেজিতে পড়লে অবশ্যই পাণ্ডিত্যের আরও ভারবৃদ্ধি হয়। ‘সিম্পল লিভিং, হাই থিংকিং’-র যুগ থেকে ‘হাই লিভিং অ্যাণ্ড সিম্পল থিংকিং’-র এক সর্বনাশা যুগে ক্রমশঃ প্রবেশ করছি আমরা। আমরা একদিকে ক্রমশঃ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি ব্র্যাণ্ডেড জামাকাপড়, নামী রেঁস্তোরা ইত্যাদিতে এবং একইসঙ্গে অনভ্যস্ত হয়ে পড়ছি বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায়। লিপস্টিক, মেকআপ করা বাঙালী জীবনের আড়ালে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে নির্মল হাসির সারল্যটুকু।
একথাও অনস্বীকার্য যে, এর পিছনে আমাদের গণমাধ্যমগুলির ভূমিকাও নেহাত কম নয়। মানুষের জীবনের পক্ষে, সমাজজীবনের পক্ষে ক্ষতিকর বস্তুগুলি রঙচঙে রাংতায় মুড়ে পরিবেশন হচ্ছে। আমাদের বলিউড- টলিউডের অভিনেতা- অভিনেত্রীদের পিছনে রোজ সংবাদপত্রের যত পাতা খরচ হয়, তার কতটুকু খরচ হয় মনীষী ভাবনায়? ভাবতে অবাক লাগে, অভিনেতা- অভিনেত্রীদের মেকআপ, জীবনযাপন, গসিপ- এসব অপ্রয়োজনীয় জিনিস নির্বিবাদে পরিবেশিত হচ্ছে এবং একদল মানুষ পরম তৃপ্তিতে সেইসব জিনিস গলাধঃকরণ করছেন।
খুব ভরসা দেখি না অদূর ভবিষ্যতে। এক এবং একমাত্র উপায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থভাবে গড়ে তোলা। মানুষের জীবনের মৌলিক নীতিবোধের অঙ্কুর যদি বাল্যাবস্থায় শিশুমনে রোপণ করা যায়, তাহলে অন্ততঃ এটুকু আশা করা যেতেই পারে যে ভবিষ্যতে তারা খুব একটা বিচ্যুত হবে না। আজ যারা এ টি এমের পিন হ্যাক করছে, নানা ধরনের জালিয়াতি-খুন- জখম- ডাকাতি ইত্যাদি করছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাদের শৈশবের কোথাও বড় ধরনের গণ্ডগোল লুকিয়ে আছে। কিন্তু আমাদের প্রাক্ প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষাও বড়োই অবহেলিত। এটাই চিন্তার।
তবুও, আশা করা যেতে পারেই যে, ভুল করতে করতেই একদিন আমরা ঠিক পথে চলব। সকলের সমবেত শুভবুদ্ধির জোয়ারে ভেসে যাক্ যা কিছু অশুভ- এই শুভকামনাটুকু নিয়েই শেষ করছি আজকে। জয়হিন্দ্। বন্দে মাতরম্।