Home / গল্প / এখন বারোটা বাজে -নির্মাল্য ঘরামী

এখন বারোটা বাজে -নির্মাল্য ঘরামী

ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া প্রতুলবাবুকে দেখতে দেখতে বড়ুয়াসাহেব চ্যাটার্জিসাহেবকে বললেন,
-কী মনে হয়?
-কী?
একটু অপেক্ষা করলেন বড়ুয়াসাহেব। দরজা খুলে প্রতুলবাবু বেরিয়ে গেছেন। ধীরে ধীরে সেই দরজাও বন্ধ হয়ে গেল।
-আরে, এই আমাদের প্রতুলের কথা বলছি। তা, কেমন বুঝলেন?
-মোটামুটি কাজের, তবে আহামরি কিছু বলে মনে হল না।
-আমারও তাই মত। তায় আবার এটা-সেটা গুণ-ও আছে।
-যেমন? চ্যাটার্জিসাহেব এবারে বড়ুয়াসাহেবের দিকে কিঞ্চিত ঝুঁকে পড়লেন।
-ওর একটু হাত টান আছে। বড়ুয়াসাহেব চ্যাটার্জিসাহেবের দিকে মুখ ঘুরিয়ে সোজা তাকিয়ে বললেন, -এটা পরিষ্কার যে টুকিটাকি জিনিসপত্র সরায়।
-তাহলে ছাড়িয়ে দিচ্ছেন না কেন?
-এই টাকায় আর কে এতসব কাজ করবে? জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সকাল সাড়ে ৯টা থেকে রাত আটটা অব্দি?
-তাবলে ওর চুরি বরদাস্ত করবেন? অবাক না হয়ে পারলেন না চ্যাটার্জিসাহেব।
-আসলে, বড়ুয়াসাহেব টেবিলের উপরে আঙুলগুলো দোলাতে দোলাতে বললেন, -দামী কিছু কোনদিন নেয়নি।
-নাকি নিতে পারেনি?
-সেটাও হতে পারে। অনিশ্চিতমুখে বড়ুয়াসাহেব বললেন, -হয়তো সাহসে কুলোয় নি। তবে খোয়া যায় নি।
-তাহলে আর ভেবে কি লাভ? হতাশ গলায় চ্যাটার্জিসাহেব বললেন, -হয়েই গেল।
-তা নয়! বড়ুয়াসাহেব গলাটা খানিকটা ভারি করে বললেন, -ওকে ধমকে-চমকে রাখতে হবে। একটু নরমে-গরমে রাখলে পরে সাইজে থাকবে। নতুন কেউ এলে তার যে হাত টান থাকবে না, তার কোন গ্যারান্টি আছে?
-আপনি অভিজ্ঞ লোক দাদা, চ্যাটার্জিসাহেব খানিকটা স্তাবকতার সুরে বললেন, -কাকে কিভাবে ম্যানেজ করতে হবে, আপনার চেয়ে ভাল কাউকে বুঝতে দেখলাম না।
-আরে না, বড়ুয়াসাহেব বললেন, -বয়সের ব্যাপার! এই একগাদা পাকা চুল দেখছেন, বলে মাথাটা কিছুটা নিচু করলেন উনি। বললেন, -বয়স হোক, আপনিও সব বুঝে যাবেন।

(২)
কাজের মেয়ে সুরমাকে গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে প্রতিমাদেবী মেয়েকে কাছে ডাকলেন।
-তুই সারাক্ষণ নজরে নজরে রেখেছিলি তো?
-হ্যাঁ মা। টুনি ঈষৎ বিরক্ত মুখে বলল, -কিন্তু, আমার আর কী কোন কাজ নেই?
-একটা দিন পুজো দিতে গেছি, বিরক্ত হয়ে প্রায় খেঁকিয়েই উঠলেন প্রতিমাদেবী, -তোকে নজরে রাখতে বললাম, তাতেই এত রাগ?
-কত দিন থেকে আমাদের বাড়িতে কাজ করে সুরমামাসী। গোমড়ামুখে টুনি বলল, -তোমার শুধু সন্দেহ।
-থাম, মেয়েকে আর কথা বাড়াতে দিলেন না প্রতিমাদেবী। -ওর হাতটান আছে। এটা তুই বাদে আর সবাই জানে। সেদিন চিন্টুর মা বলছিল। সে নাকি শুনেছে সামনের গৌরী আবাসনের কোন একটা বাড়িতে সুরো কাজ করত। একটা ঘড়ি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ায় ছাড়িয়ে দেয়।
-তাহলে ওকে তুমি ছাড়িয়ে দিচ্ছ না কেন? টুনি খানিক অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল।
-আরেকটা কাজের লোক তুই জোগাড় করে আনবি?
-টাকা ফেললে কেন পাওয়া যাবে না? টুনি হার স্বীকার করতে নারাজ।
-এই তো তোর বাপের রোজগার। রাগত গলায় প্রতিমাদেবী বলে চললেন, -নেহাত বাড়ি ভাড়া থেকে বেশ কিছুটা আসে বলে আমি কোনগতিকে ধরে রেখে সংসারটা টানছি। আমার কিছু হলে দেখবি, কিরকম নাজেহাল হয়ে যেতে হয় তোদের। এই টাকায় কে আর অতক্ষণ কাজ করবে? আর তার যে হাতটান থাকবে না, সেটা তুই কিভাবে জানবি?
ঠং। ঠং। ঠং।
সাইকেলের ঘণ্টার শব্দে বাক্য বিনিময় বন্ধ করে দু’জনে মুখ তুলে চাইল। পোস্ট অফিসের একজন পিয়ন সাইকেল রেখে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছেন।
-প্রতুলবাবুর নামে একটা রেজিস্ট্রি চিঠি আছে। নিন দিদি, সেই পিয়ন প্রতিমাদেবীর কাছে এগিয়ে এসে গেটের ওপারে দাঁড়িয়ে একটা কলম আর পোস্ট অফিসের একটা খাতা বের করে সেখানের একটা পাতা খুলে সেটা ও কলমটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, -নিন, এখানে সই করুন।

(৩)
-শুনুন, টেবিলের ওপার থেকে সেই রাশভারী সেই বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, -আপনার পিছনে যে খরচটা হচ্ছে, সেটার হিসেবে বেশিই লাভ আশা করেছিলাম।
-স্যার, আসলে এবারে বাগানটায় ঝামেলা হয়ে……………
-আমি কিছু শুনতে চাই না, সেই ভদ্রলোক বললেন, -গত তিনবছর আমাদের প্রফিট এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আপনার পিছনে কোম্পানীর খরচা বেড়েই চলেছে। এটা চলতে পারে না।
-স্যার, এবারে আমি প্রফিট বাড়িয়েই দেখাব, একটা সুযোগ দিন স্যার।
-পারবেন?
সেই ভদ্রলোক ওঁর দিকে একবার ভালো করে চেয়ে নিয়ে টেবিল থেকে উঠে জানালার ধারে গেলেন। কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। তারপরে না ঘুরেই বললেন,
-কিন্তু এটাই আপনার শেষ সুযোগ। এই বছরটাই আপনার সঙ্গে আমাদের শেষ কনট্র্যাক্ট।
-ইয়েস স্যার।
-মনে থাকে যেন। বয়স্ক ভদ্রলোক এবারে ঘুরে ওঁকে ভালোভাবে দেখতে দেখতে চেয়ারে বসে পড়লেন। নিন লেগে পড়ুন, তিনি বলে উঠলেন, -এবারে একটু সত্যিকারের এফর্ট দিন তো মশাই।
-ইয়েস স্যার। বলে একটু থেমে আস্তে করে গলায় যুগপৎ মোম আর মাখন মাখিয়ে তিনি বললেন, -এবারে তাহলে আসব স্যার।
-আসুন।
চেয়ার থেকে উঠে চলে আসার সময়ে হঠাৎই বড়ুয়াসাহেবের নজর চলে গেল বয়স্ক সেই ভদ্রলোকের পিছনে টাঙানো দেওয়াল ঘড়িটার দিকে।
পুরানো আমলের ঘড়ি। তিনটি কাঁটাই একজায়গায়। কেননা সেটাতে তখন বারোটা বাজে।
ওদেরও……!

akhon-12ta-baje1-ng

Leave a comment

Check Also

স্বীকারোক্তি

স্বীকারোক্তি- ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য্য

    আজই ফোনটা ডেলিভারি দিয়ে গেলো। অনলাইনে একবার দেখেই ভারি পছন্দ হয়ে গেছিল সমীর …

দর্পণে

দর্পণে – নির্মাল্য ঘরামী    

    -চল, আমি জোরের সঙ্গে বললাম, -ওসব একদম ভাবিস না। তোকে এতদিন পরে পাচ্ছি, …

ফয়সালা

ফয়সালা – নির্মাল্য ঘরামী

  -দেখুন স্যার। বলে সিকিউরিটি গার্ডটি বিজয়ীর দৃষ্টিতে মহাকুলসাহেবের দিকে তাকালো। তার হাতে ধরা ব্যাগটির …

রক্তগোলাপ/ মৌসুমী পাত্র/ পুণ্যতোয়া ধর

রক্তগোলাপ – মৌসুমী পাত্র

  একটা মোটা দড়ি থেকে পাশাপাশি ঝোলানো সারি সারি মৃতদেহ। ছাল ছাড়ানো। গত কদিন ধরেই …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *