ভালোই চলছিল ট্রেনটা। এমনিতে এই ট্রেনটায় ওঠেন না কিন্তু অফিসে বীরেনবাবুই বলেছিলেন -“আরে মশাই ,এতদিন পর যখন বাড়ি ফিরছেন তখন নয় ট্যাঁকের কড়ি একটু খসলোই বা। প্রতিবারই তো বার পাঁচেক বাস পাল্টে যাতায়াত করেন। এবার নয় আমার কথা শুনে রাতের মেলটা ধরুন। যাবেও ভালো আর দেখবেন ভিড়ও নেই প্রায়। উঠেই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়বেন আর সকাল হলেই দেখবেন পৌঁছে গেছেন বাড়ি। গিন্নিও খুশি আর সেই সাথে আপনিও।” প্রস্তাবটি বেশ মনে ধরেছিলো জীবনবাবুর। কাঁহাতক আর পয়সা বাঁচাবেন। দিন কয়েক আগে ভগবানের কৃপায় ছেলেটারও ছোটোখাটো একটা চাকরি জুটেছে। এখন একটু আয়েশ না করলে আর কবে করবেন! সেদিনই অফিসে বসে একজনকে ধরে অনলাইনে কেটে ফেলেছিলেন টিকিটটা।
নির্দিষ্ট দিনে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে একটু আগেভাগেই এসে পৌঁছে গিয়েছিলেন স্টেশনে। ট্রেনটি এসেও পড়েছিলো সময়মতো। সিটটিও পেয়েছিলেন খাসা। একেবারে জানলার ধারে। যদিও খানিক বাদেই বুঝেছিলেন ট্রেনটির তেমন পসার বা পরিচিতি না থাকাতে বেশিরভাগ আসনই ফাঁকা। সিট তাই আগে থাকতে রিসার্ভ না করলেও বসার জায়গা পেতে সমস্যা হতো না। যাই হোক। সঠিক সময়েই ছাড়লো ট্রেন। দুগ্গা দুগ্গা বলে কপালে হাতজোড়া ঠেকিয়ে নিলেন একবার।
হাওড়া থেকে ছাড়ার পর ঘন্টা চারেক কেটে গেলো নির্বিঘ্নে। ইতিমধ্যে সন্ধ্যে পেরিয়ে গভীর হয়েছে রাত। লোকজন কম থাকায় অন্য ট্রেনের মতো এই ট্রেনে হকারদের আনাগোনাও যথেষ্ট কম, প্রায় নেই বললেই চলে। যদিও এরইমধ্যে কপাল জোরে এক চা-ওয়ালা উঠেছিল তাই রক্ষে। না হলে চা তেষ্টায় শুকিয়ে উঠেছিল জীবনবাবুর প্রাণ। প্রথমে পুরো কামরাটিতে সাকুল্যে জনা আটেক লোক থাকলেও খালি হতে হতে এখন রয়েছে তাকে নিয়ে মোটে দুজন। মিনিট পনেরো বাদে সামনের স্টেশন আসতে নেমে গেলেন শেষ সহযাত্রীও। এখন গোটা কামরা জুড়ে জীবনবাবু ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো প্রাণী নেই। বাইরে দুরন্ত গতিতে ছুটে যাচ্ছে নিকষ কালো অন্ধকার। চিরকালের ঘুমকাতুরে জীবনবাবু আরো আশ্চর্য হয়েছেন আজকের এই নিঃসঙ্গ রাতে নিদ্রাদেবীর অকারণ বেইমানিতে। এরই মধ্যে মিনিট দশেক হলো ট্রেনের গতিও খানিক কমেছে। সবমিলিয়ে কেমন যেন পানসে হয়ে উঠেছিল শরীর-মন দুইই। অন্যদিন এই সময় বাড়ি ফিরে এলেও অফিসের ফাইল-পত্তর বা নিদেনপক্ষে খবরের কাগজটুকু সাথে থাকে। আজ পথে হারিয়ে ফেলার ভয়ে ট্রেনেও উঠেছেন এক্কেবারে খালি হাতে। সারা বছরের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর বড়কর্তার কাছে অনেক তোষামোদ করে এক হপ্তার ছুটি মিলেছে। অনেক দিন আগে থেকেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন ছুটিটা বাড়িতে গিন্নির হাতের রান্না খেয়ে আর মৌজ করে ঘুমিয়ে কাটাবেন| তার মতো ছাপোষা কেরানির কাছে এই অনেক পাওয়া। আপাতত পরিকল্পনামাফিক আগামী কয়েকদিনের কথা ভেবে খুশি হবার চেষ্টা করলেন খানিক।
এরই মধ্যে উদয় হলো নতুন আরেক সমস্যার।
খানিকক্ষণ আগে থেকেই অনুভব করছিলেন যে ট্রেনের গতি আগের তুলনায় কমেছে বেশ। কিন্তু বোঝা যায়নি যে সেটি এভাবে গড়াতে গড়াতে এসে হঠাৎই বিনা নোটিশে সুনসান নামগোত্রবিহীন একটা ব্রিজের ওপর লম্বা বাঁশি বাজিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়বে। ট্রেনের এমন অদ্ভুত আচরণে বেশ বিরক্তই হয়েছিলেন জীবন বাবু। সমস্যা যে সহজে মেটার নয় বুঝলেন যখন কিছুক্ষনের মধ্যেই সমস্তরকম ইঞ্জিন আর কলকব্জার ঘড়ঘড়ানিও বন্ধ হয়ে গেলো একেবারে। চারিদিকে এরপর শুধু জমাট বাঁধা আঁধারে মোড়া নিশ্ছিদ্র নিস্তব্ধতা। ট্রেনটার এরকম বেয়াক্কেলেপনায় অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন জীবনবাবু। সদালাপী, হই-হুল্লোড়প্রিয় মানুষ তিনি। কলকাতার মেসবাড়ি একাই মাতিয়ে রাখেন। তেমন কাজের মানুষ না হলেও ব্যবহারের গুণে অফিসেও তার বন্ধুভাগ্য সুপ্রসন্ন। অন্যান্যবার বাসে যখনি বাড়ি ফিরতেন তখনি অনেক পরিচিত-অপরিচিতের সাথে গল্প-গুজবে কেটে যেত সময়। ট্রেনের থেকে মোটের ওপর সময় বা পথশ্রম বেশি হলেও তেমন গায়ে লাগতো না তাই। কিন্তু আজকে ট্রেনের এমন পরিবেশে একেবারেই স্বস্তি বোধ করছিলেন না তিনি তা সে যতই আরামদায়ক আর নিরিবিলি হোক না কেন।
লম্বা একটা হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। বাইরের এমন মিশকালো অন্ধকার জীবনে বোধ হয় প্রথমবার চাক্ষুস করলেন। কোথাও জোনাকির আলো অব্দি চোখে পড়ছে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেলো – আজ তো অমাবস্যা। বুঝলেন প্রকৃতিরও যথেষ্ট মদত রয়েছে এমন ভৌতিক আবহ তৈরির পিছনে। ভাবলেন লেখক হলে মনের মাধুরী মিশিয়েএমন পরিবেশে একটা খাসা ভূতের গল্প পেড়ে ফেলা যেত। আর সময়ও কাটতো খাসা | কিন্তু তেমনটিতো হওয়ার নয়। অতএব চুপচাপ অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো গতি নেই।
অনুভব করলেন চারিদিক কেমন যেন গুমোট হয়ে আসছে আসতেআসতে। গাছের পাতা অব্দি নড়ছে না। মনে হচ্ছে যেন কোনো মৃত্যুপুরীতে হাজির হওয়া গেছে যেখানে জীবনবাবু বাদে কারুর দেহেই কোনো প্রাণ নেই। সবই নিশ্চল-নিস্পন্দ।
সব মিলিয়ে ভাব-গতিক মোটেই সুবিধের ঠেকছিল না।সময় যত যাচ্ছিলো রাজ্যের অলক্ষুণে চিন্তা ভিড় করছিলো মনে। যেন এই বুঝি কিছু একটা বিপর্যয় ঘটতে চলেছে খুব শিগগিরই। এ যেন তারই অশনি সংকেত। ভেবে দেখলেন যদিও মাঘের শেষ ,তবু বড়ো ধরনের ঝড় -বৃষ্টি আসলেও আসতে পারে। আজকাল তো কোনো কিছুরই তেমন ভরসা নেই।
দমবন্ধকর এই পরিস্থিতিতে কেটে গেলো আরো তিরিশ মিনিট। কাঁহাতক আর চুপ করে বসে থাকা যায়। ব্যাপারখানা ঠাওর করার জন্য দরজা দিয়ে আবার উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলেন I দূরে লাল সিগনালের কাঁপা কাঁপা মিটমিটে আলো ছাড়া এই ভরা অন্ধকারে চোখে মালুম হলো না কিছুই। দেখেশুনে বুঝলেন আশেপাশের কামরাতেও লোকজন তেমন নেই। তিনিই বোধ হয় একমাত্র উদ্বিগ্ন যাত্রী যিনি এইরকম বিপজ্জনক ভাবে উঁকিঝুঁকি মারছিলেন। তাছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে তেমন চোখে পড়লো না। মনে মনে ভাবলেন কোনো কিছু খোঁজ-খবর না নিয়ে ঝোঁকের মাথায় এমন ট্রেনে রাত-দুপুরে একা সফর করাটা বড্ডো বেশি বোকামি হয়েছে। আর কিছু না হোক , এই পরিবেশে ডাকাত পড়লেও তো প্রাণ বাঁচানো দায় হবে। কান মুললেন আর এপথে দ্বিতীয়বার তিনি যাচ্ছেন না। যত কষ্টই হোক এর চাইতে বাসই ভালো।
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও ট্রেনের মতিগতির পরিবর্তনের কোনো আশা না দেখে দরজাটা টেনে শক্ত করে এঁটে দিলেন ভেতর থেকে। সাবধানের মার নেই। তারপর সিটে এসে বসলেন আর বসতে না বসতেই ঝুপ করে নিভে গেলো কামরার সব আলো। একেবারে যাকে বলে টোটাল ব্ল্যাক আউট।
ট্রেনে যারা সফর করেছেন বিশেষত রাতের বেলা তাদের অনেকেরই কম-বেশি এই আলো নিভে যাওয়া কামরায় সময়যাপনের নানান অভিজ্ঞতা রয়েছে। এমনকি জীবনবাবুর কাছেও ব্যাপারটা নতুন কিছু নয় তবে এই মুহূর্তে সব মিলিয়ে এতোরকমের বিপত্তি একযোগে ঘটে যাওয়াতে মেজাজটা কেমন যেন তিরিক্ষে হয়ে উঠেছিল। কানের পাশে মশকবাহিনীর অবিরাম সুরমূর্ছনা ছাড়া জগৎ চরাচরে আর কোনোকিছুই শ্রবণগোচর ছিলো না। সময় যেন এখানে এসে থমকে গেছে কোনো অনির্দিষ্ট কালের জন্য।
হাতে ঘড়ি নেই। চাকরির প্রথমে ঘড়ি ছিল বিলাসিতা। পরে সুযোগ মতো হাতে তুললেও খোয়া যাবার ভয়ে সেই অভ্যাস ছেড়েছেন বহুদিন। তারপর অনেকবছর ধরে তিলে তিলে পয়সা জমিয়ে অনেক সাধ বিসর্জন দিয়ে কিনেছিলেন নোকিয়া ১১০০ মডেলের একটি মোবাইল । তাকে নিয়ে কেটে গেছে একযুগ। কথা বলা, সময় দেখা বা জায়গামতো টর্চের প্রয়োজনে ভরসা এখন সাদামাটা আনস্মার্ট মুঠোফোনটিই । বলতে গেলে জীবনবাবুর একপ্রকার অন্ধের যষ্ঠি। পকেট হাতড়িয়ে বের করলেন সেই হারানিধি । সময় বলছে রাত ১টা বেজে ২৫ মিনিট। সেই সাথে এও লক্ষ্য করলেন ফোনটির জীবনীশক্তি প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। মনে পড়লো বাড়ি থেকে বেরোবার আগে সেটিকে চার্জ দিতে বেমালুম ভুলে গিয়েছেন । সাধে কি আর বলে বিপদ যখন আসে তখন একা আসে না! না হলে এমন ভুল তার সচরাচর হয় না। মনে মনে এই ভেবে চিন্তায় পড়লেন বাড়ির লোক দরকারে তার সাথে চাইলেও যোগাযোগ করতে পারবেন না। তার দেরি দেখে হয়তো অযথা চিন্তা করবেন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার এই ভাবনাকে সত্যি প্রমাণ করে দেহ রাখলো মুঠোফোনটি এবং সেই মুহূর্ত থেকে সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের শেষ সূত্রটুকুও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো তাঁর।
সবকিছু অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দিয়ে সিটে হেলান দিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য ঘুমের প্রস্তুতি নিতে যাবেন এমন সময় দূর থেকে একটা ট্রেন আসার মৃদু কিন্তু স্পষ্ট শব্দ শুনতে পেলেন জীবনবাবু । শব্দটা ক্রমে বাড়তে লাগলো, সেই সাথে উল্টোদিকের ট্র্যাকটিও আলোকিত হয়ে উঠতে লাগলো তীব্র হলুদ আলোতে। বুঝতে পারলেন উল্টো অভিমুখে আরেকটি ট্রেন যাবে ব্রিজের ওপর দিয়ে। ব্রিজটি কাঁপতে লাগলো ট্রেনের গতির তালে তালে। চাঁপা অন্ধকার আর নিস্তব্ধতার প্রাচীর ভেঙে বেশ দুলকি চালে উল্টো পথে এগিয়ে যেতে লাগলো ট্রেনটি। যদিও জীবনবাবুর সওয়ার হওয়া ট্রেনটির মধ্যে কোনোরকম প্রাণস্পন্দন দেখা দিলো না। অগত্যা তিনি জানলা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন অপর পাড়ের ধীর গতিতে ছুটে চলা ট্রেনটি আর ট্রেনে বসে থাকা ভাগ্যবান যাত্রীদের।।
লক্ষ্য করে দেখলেন ছুটন্ত ট্রেনটির এক একটি কামরার দৃশ্যপট যেন একেকটি গল্পের আধার। কোনো কামরাতে মায়ের আপ্রাণ চেষ্টা অবুঝ শিশুকে ঘুম পড়ানোর আবার কোথাও জানলা দিয়ে বিশ্বদর্শনে ব্যস্ত দুই ছোট্ট কচি-কাঁচার উজ্বল নিদ্রাহীন দুজোড়া চোখ , কোথাও দরজার ধার ঘেঁষে তরুণ তুর্কির উদ্ধত নিশিযাপন আবার কোথাও নব-দম্পতির সুখরাত্রিযাপন, কোনো কামরাতে ঘুম কেড়েছে তাসের আসরে জমাটি আড্ডা আবার কোনো কামরাতে দমকা কাশির হাঁপর তোলা বৃদ্ধের শিয়রে নিদ্রাহীনা বৃদ্ধা। দেখতে দেখতে এমনই নানান ভালোবাসা মন্দবাসা বাক্সবন্দি করে হুশ-হাশ শব্দ করে পেরিয়ে গেলো ট্রেনটা। মন জুড়ে রয়ে গেলো শুধু এরকমই নানা টুকরো টুকরো মুহূর্তের কোলাজে বন্দি এক জীবনদর্শন।
দেখতে দেখতে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন জীবন বাবু। হঠাৎই চটকটা ভাঙলো। টের পেলেন পাগলের মতো কাঁপছে ব্রিজটি । মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। অনেক নীচে বয়ে যাচ্ছে নাম না জানা স্রোতস্বিনী। অন্ধকারেই উঠে দাঁড়াতে গেলেন, কিন্তু পারলেন না তাল সামলাতে। মুখ থুবড়ে পড়লেন সামনে। মাথাটা ঠুকে গেলো সামনের সিটে। সংজ্ঞা হারানোর আগে শেষবারের মতো আরেকবার মনে পড়ে গেলো উল্টোপথে যাওয়া ট্রেনের ছায়াছবি ।
একি , কেন জানি মনে হচ্ছে সেই দামাল কিশোর ,সেই উদ্ধত বেপরোয়া যুবকটি আর সেই তাসের আড্ডায় নীলশার্ট পড়া লোকটি তার ভীষণ চেনা,ভীষণ আপন। অনেকটা যেন তারই মতো দেখতে, আয়নায় ঠিক যেমন নিজেকে দেখেছেন জীবনের বিভিন্ন সময়ে , বিভিন্ন বয়সে। তার মানে কি, তবে নিজেই নিজেকে দেখলেন? একি তবে নিজের জীবনেরই প্লেব্যাক ? আর কিছু ভাবার অবকাশ নেই। জীবনবাবু এখন সমস্ত ভাবনা চিন্তার ঊর্ধ্বে। অবচেতন জুড়ে শুধুই এখন অতীতের ধূসর ছায়াপাত আর তারপর বাকি সব অন্ধকার।
কয়েক মুহুর্তের বিলম্ব মাত্র| চারপাশের নিস্তব্ধতা খানখান করে ভেঙে পড়লো ব্রিজটি আর সেই সাথে জীবনবাবুর জীবনের শেষ ট্রেনটি তলিয়ে গেলো স্রোতস্বিনীর গর্ভে। জীবনের সফর শেষ করে অবশেষে বাড়ী ফিরলেন জীবনবাবু |