সে ছিল এক ভারী সুন্দর বাগান। কত রকমের যে গাছ ছিল সেখানে! রকমারি ফুলের গাছ, নানা ফলের গাছ, আরো অনেক অ-নে-ক গাছ ছিল সেই বাগানে। হাজারো ফলফুলের বাহারি রঙে, তাদের মনমাতানো সুবাসে যেন মেলা বসে যেত! আর ছিল হরেক রকমের কীট-পতঙ্গ। বিচিত্র তাদের রঙ আর ধরন।
একদিন সকালে সেই বাগানের এককোণে একটা সজনে গাছের এক পাতার তলায় দেখা গেল এক শুঁয়োপোকাকে। সে তখন সবে গুটিগুটি হাঁটতে শুরু করেছে। শুঁয়োপোকাকে সবার প্রথমে চোখে পড়ল ফড়িঙের। সঙ্গেসঙ্গেই সে ডেকে আনল বাকিদের, “দেখবি আয়, কীরকম একটা নতুন পোকা এসেছে আমাদের বাগানে।” গুবরে পোকা দেখেই মুখ বাঁকাল, “এ ম্যা গো, কী বিচ্ছিরি দেখতে!” উচ্চিংড়ে বলল, “এই সুন্দর বাগানে এত বাজে দেখতে পোকা এল কী করে!” মৌমাছি বলল, “সারা গায়ে আবার রোঁয়া ভর্তি!” ভোমরা ভোঁ ভোঁ করে বারকয়েক শুঁয়োপোকাটার চারপাশে পাক দিয়ে বলল, “হাঁটার ছিরি দেখ! চলতেও শেখেনি ঠিক করে!” পিঁপড়ে বলল, “আদবকায়দা কিচ্ছু জানেনা।”
মোটকথা, সকলে একমত হল যে এমন কুৎসিত পোকা আর কখনো দেখেনি তারা।
শুঁয়োপোকাটা শুনতে পেয়েছিল সবই। খুব কষ্ট হচ্ছিল তার। নিজের চেহারার জন্য যত না খারাপ লেগেছিল তার, তার চেয়েও বেশি মন খারাপ হয়েছিল সবার কথা শুনে। কিন্তু সেই বা কী করে? এমন চেহারা তো সে আর নিজের ইচ্ছেয় বানায়নি। সারাদিন সে যত ঘুরতে ফিরতে থাকল, গাছের পাতা খেতে থাকল- আর ততই তার ঘুরেফিরে মনে পড়তে থাকল সবার কথাগুলো।
এমনি করেই দিন যায়। শুঁয়োপোকার খুব খিদে পায় আজকাল। আর তাকে খেতে দেখলেই কেউ না কেউ ঠিক কথা শোনাবে, “দেখেছিস, একে ওই চেহারা! তায় খাবার বহর দ্যাখ। খেয়েই যাচ্ছে… খেয়েই যাচ্ছে। সজনে গাছটাকে তো পুরো ন্যাড়াই করে দিল।”
সঙ্গে সঙ্গে কেউ না কেউ তাল দেবে, “ঠিক বলেছিস। অত খাবার কোথায় জমা করে বল্ দেখি। ওই তো এইটুকুনি চেহারা!”
মনের ভেতরে দুঃখের পাহাড় জমতে থাকে তার। তবুও সে কিছু বলে না। কারুর কথার প্রতিবাদও করে না। খিদের ওপর তো তার হাত নেই। তাই সে পছন্দমত পাতা খেয়ে চলে, খেয়েই চলে। আর তার ভেতরের যন্ত্রণাগুলো জমতে থাকে, জমতেই থাকে।
এমনি করে বর্ষা এসে যায়। বেচারী কোনমতে একটা বড় পাতার নিচে নিজের শরীরটাকে গুটিয়ে এইটুকুনি করে চুপ করে বসে থাকে। আর তার মনের মধ্যে জমে থাকা দুঃখ- কষ্টেরা তার চারপাশে দেওয়াল তুলে ফেলে।
বাকিদের চোখে পড়ে গেলে কেউ না কেউ তাকে ঠিক শুনিয়ে বলে, “ঢং দেখো। অত খাবার খেয়েও হল না। এখন চারপাশে কিরকম ঘেরাটোপ বানিয়ে ঘুমোচ্ছে দেখ।”
তার পাশে থাকা অন্য কেউ তখন বললে, “তা তো হবেই। অত খেলে তো ঘুম পাবেই।”
সে কিছু বলে না। ওদের কথা আজকাল আর তেমন করে কানেও আসে না তার। নিজের দেওয়ালের মধ্যে গুটিশুটি মেরে সে ক্রমশঃ এক ঘোরের মধ্যে ডুবে যেতে থাকে…
তারপর এক শরতের সকালে শিউলি গাছগুলোর পা যখন শিশিরে ভিজে ভিজে- তখন ঘোর ভেঙে উঠে বসল সে। আর উঠেই চমক। একি! তার গায়ের আবরণ খসে পড়েছে- দুটো কী সুন্দর বাহারি ডানা গজিয়েছে তার। লাল-হলুদ-কমলা-সবুজের ছিটে ছিটে। ডানাগুলো নাড়াল সে। আরে, কী দারুণ লাগছে!
ঘুরছে প্রজাপতি, উড়ছে বাগানময়। নিজের মনের আনন্দে নেচে নেচে ঘুরে ঘুরে এ ফুল সে ফুলকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফিরছে। বাগানের যত কীট-পতঙ্গ খবর পেয়ে ভিড় জমিয়েছে। সবাই বলছে, আরিব্বাস! কী সুন্দর দেখতে!
ফড়িংই প্রথম লক্ষ্য করল ব্যাপারটা। বলল, “সেই শুঁয়োপোকাটা গেল কোথায়? সেই যে বিচ্ছিরিমতন।”
একটা টুনটুনি পাখি একটা হলুদ ফুলে ঠোঁট ডুবিয়ে মধু খাচ্ছিল। সে শুনে বলল, “আরে, ওই শুঁয়োপোকাটাই তো প্রজাপতি হয়েছে। যখন ওই খোলস ভেঙে বেরোল, আমি দেখেছিলাম।”
শুনে সবাই তাজ্জব। একটু পর গুবরে পোকা বলল, “প্রজাপতি, আমাদের সঙ্গে খেলবি?”
বাকি সকলে একসুরে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। আয় না, খেলবি আমাদের সঙ্গে।”
প্রজাপতি ওদের কথায় আর কানই দিল না। নিজের মনে যেমন উড়ছিল, তেমনই পুরো বাগান আলো করে মনের আনন্দে উড়তে থাকল, উড়তেই থাকল…