Home / বাঘু সিরিজ / গণ্ডামণ্ডা গেল বাঘুর কাছে – মৌসুমী পাত্র

গণ্ডামণ্ডা গেল বাঘুর কাছে – মৌসুমী পাত্র

শিল্পী- গুঞ্জা
শিল্পী- গুঞ্জা

 

 

দুপদাপ পা ফেলে হাঁটছিল গণ্ডামণ্ডা। মেজাজটা তার বেশ খারাপ। গণ্ডারনি দিদিমণি মাঝেমাঝে এমন ভয়ঙ্কর কাণ্ডকারখানা করেন যে বলার নয়!

        হয়েছিল কী, গতকাল পাঠশালায় গণ্ডারনি দিদিমণি তাঁর খড়্গে ক্যাটকেটে বেগুনি রঙ করে তাতে আবার ইয়াব্বড়ো একটা নোলক ঝুলিয়ে এসেছিলেন! দোষের মধ্যে গণ্ডামণ্ডা খালি বলে ফেলেছিল, “দিদিমণি, ওই বেগুনি রঙ না করে ওটাতে আপনি খয়েরি রঙ করতে পারতেন! আর খড়্গে নোলক না ঝুলিয়ে একটা নথ ঝোলাতে পারতেন! আর ওই থাবাতে লাল-নীল রঙ করেছেন না, ওর বদলে যদি হলুদসবুজ রঙ করতেন তাহলে বেশ সরষে খেতের ঢেউ খেলত!”

        তা ভালো কথাই বলতে গিয়েছিল গণ্ডামণ্ডা, কিন্তু গণ্ডারনি দিদিমণি গেলেন খেপে। খড়্গটাকে বিষম ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বাজখাঁই আওয়াজ ছাড়লেন, “তা তোমার কাছে এত জ্ঞান কে চেয়েচে, অ্যাঁ? আমি বলেচি জ্ঞান দিতে? ইঁ হিঁ হিঁ হিঁ! নাকে খয়েরি রঙ করবো? নথ পরবো? তোর ইচ্ছে হয়, তোর নিজের খড়্গে হাল-সবুজ-কমলা-হলুদ যা খুশি রঙ লাগাবি যা না! পুরো রামধনুটাকেই বসিয়ে নে না! কে বারণ করছে? আর সরষেখেত? এরকম উষ্টুমধুষ্টুম জ্ঞান দিতে এলে তোমাকে আমি সরষেখেত দেখিয়ে ছাড়বো, বুয়েচ বাছাধন?”

        গণ্ডামণ্ডা থতমত খেয়ে চুপ করে গিয়েছিল। কিন্তু গণ্ডারনি দিদিমণির রাগ তাতেও কমে না! গণ্ডামণ্ডাকে দশবার খড়্গবোস (মানে খড়্গ ধরে ওঠবোস আর কী!) করালেন। তাতেও শান্তি হল না তাঁর! বাতাসে কিসব গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বললেন, “আজ টিপিনে কী এনেচিস র‍্যা? বের কর টিপিনবাক্সটা?”

        গণ্ডামণ্ডার বাবা গণ্ডারকু যত্ন করে গুছিয়ে দিয়েছিল টিফিনবাক্স। গণ্ডারনি খুলে দেখে, টিফিনে দু-ডজন খাসমণ্ডা আর তিন ডজন নারকেলি মণ্ডা! গণ্ডারনি গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বলল, “তোর টিফিন আমি বাজেয়াপ্ত করলুম। এসব তোর আর খেয়ে কাজ নেই। এমনিতেই ভুলভাল বকছিস!”

        গণ্ডামণ্ডার চোখে প্রায় জলই চলে আসে আর কী! গণ্ডারনির বোধহয় একটু দয়া হল। বলল, “এক কাজ কর। তুই টিপিনে কী খাবি, তাইতো? তুই বরং আমার টিপিনটা খেয়ে নিস! এই নে, আমার টিপিনবাক্স! তোরই কপাল ভালো! দিদিমণির টিপিন খাবার সৌভাগ্য তো আর সবার হয় না!”

        তা টিফিনের সময় বাক্সটা খুলে গণ্ডামণ্ডা দেখে, তার ভেতরে রুটি আর কাঁচকলা সেদ্ধ! পাঁচ ডজন মণ্ডার দুঃখে ভেউভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে তাই-ই খেয়েছিল গণ্ডামণ্ডা।

        সেইজন্যই দুপদাপ করে হাঁটছে গণ্ডামণ্ডা। কিছু একটা তাকে করতেই হবে! কিন্তু কী করা যায়? আচ্ছা মানুষদের মনে ঘোরতর দুঃখ হলে কী করে? ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে! মানুষেরা সন্ন্যাসী হয়ে যায়! তাপ্পর হিমালয়ে গিয়ে কিসব ধ্যান ট্যান করে। কিন্তু একটাই মুশকিল! জন্তু-জানোয়ারদের মধ্যে কেউ সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনী হয়েছে? কখনো? উঁহু! সে অন্ততঃ শোনেনি।

        তা না হোকগে, সে-ই নাহয় প্রথম জন্তু-সন্ন্যাসিনী হয়ে দেখিয়ে দেবে! দিব্যচক্ষুতে দেখতে পাচ্ছে গণ্ডামণ্ডা, সে একটা উঁচু আসনের উপর বসে আছে, গায়ে গেরুয়া বসন। খড়্গ থেকে রুদ্রাক্ষের মালা ঝুলছে। গণ্ডারনি দিদিমণি এসে তার পায়ে লুটিয়ে পড়েছেন, “হে মহীয়সী! আমার জন্য এক গামলা মণ্ডার ব্যবস্থা করে দিন! গণ্ডামণ্ডা চলে গিয়ে আর মণ্ডা খেতে পাই না যে, মাতাজী!”

        মড়াৎ! পাশের একটা গাছ থেকে একটা ডাল ভেঙে নিচে পড়ল। ওপরে একদংগল কাক চড়াই মিলে জোর হল্লা বাধিয়েছে। গাছের ডালটা কুড়িয়েই ভাবনাটা মাথায় এল গণ্ডামণ্ডার। একটা গেরুয়া কাপড় লাগবে। এদিক ওদিক খুঁজে পেতে একটুকরো একটা কমলা কাপড় চোখে পড়ল তার। ব্যাগে একটা দড়ি ছিল। সেটাকে দিয়েই কমলা কাপড়ের টুকরোটাকে কোমরে বাঁধল। নাহ! এবারে একটু সন্ন্যাসিনী-সন্ন্যাসিনী লাগছে।

        কিন্তু হিমালয়ে যাবার ব্যাপারটা কী হবে? অতদূর হেঁটে যেতে তো পায়ে ব্যথা হয়ে যাবে! ধুস, তার চাইতে এখানেই বরং কাদামাটি জড়ো করে উঁচু ঢিবিমতন বানিয়ে ফেললেই হয়!

        যেমন ভাবা তেমনই কাজ। বেশ খানিকক্ষণের চেষ্টায় একটা উঁচুমতন ঢিবি বানিয়েও ফেলল গণ্ডামণ্ডা। এরপর ধ্যান করতে হবে। ঢিবিটার উপর চড়ে বসল সে। আচ্ছা, ধ্যান করার সময় কিছু একটা কথা ভেবে ধ্যান করতে হয় না? কী ভাববে সে? ভাবতে ভাবতেই মাথায় আইডিয়া এলো! জোরকদমে ধ্যান শুরু করে দিল গণ্ডামণ্ডা, “ওঁ নমো মণ্ডায়…”।

        কিছুক্ষণ বাদেই তার কানে জোর মোচড়! তাকিয়ে দেখে, তার মা গণ্ডারঝিম! গণ্ডারঝিম চোখ কুঁচকে মুখ বাঁকিয়ে গলা উঁচিয়ে কানফাটানো আওয়াজ করল একটা, “এসব কী ভেল্কি হচ্ছে, গণ্ডামণ্ডা? পাঠশালার পর গায়ে কাদা মেখে এসব কী?”

        গণ্ডামণ্ডা মিনমিন করে বলার চেষ্টা করল যে সে এখন আর মোটেই গণ্ডামণ্ডা নেই, দস্তুরমতো সন্ন্যাসিনী হয়ে গেছে। তার নাম এখন গণ্ডামণ্ডাষণ্ডাপ্রচণ্ডানন্দী মাতাজী! তাতে লাভ তো বিশেষ হলই না, উলটে তার কানে আরও দুই মোচড় পড়ল। রীতিমতন চেঁচাচ্ছে গণ্ডারঝিম, “টিফিনে এইজন্য পাঁচ ডজন মণ্ডা দিয়ে পাঠানো হয়েছিল তোকে? কোমরে কমলা কাপড় বাঁধার জন্য?”

        গণ্ডামণ্ডা ফোঁত ফোঁত করে কেঁদেই ফেলল, “মণ্ডা কোথায় পেলাম? খেয়েছি তো রুটি আর কাঁচকলা সেদ্ধ!”

        শুনেই মারাত্মক রকমের চটে গেছে গণ্ডারঝিম, “কী এতবড়ো মিথ্যে কথা? পাঁচ ডজন মণ্ডা দেওয়া হয়েছিল তোকে, আর বলছিস যে রুটি কাঁচকলা সেদ্ধ খেয়েছিস?”

        গণ্ডামণ্ডা কোনমতে খালি বলার চেষ্টা করল, “সে তো গণ্ডারনি দিদিমণি…”। কিন্তু তার কথা আর শেষ করতে হল না। তার আগেই গণ্ডারঝিম তাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল।

        মনের দুঃখে রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভালো ঘুমই হল না গণ্ডামণ্ডার। শেষ রাতে আধো ঘুমে তার মনে হল, হ্যাঁ, একজনই আছে! যে পারে কিছু উপায় করতে! বাঘু!

        যেমন ভাবা তেমনই কাজ। পরের দিন শনিবার। পাঠশালা ছুটি। সকাল সকাল আগের রাতের পান্তাভাত আর ঘাসপাতার ঝোল খেয়ে চলল গণ্ডামণ্ডা। বাঘুর সন্ধানে।

        বিস্তর খোঁজখবর করতে করতে একে তাকে জিজ্ঞেস করতে করতে দু- দুখানা জঙ্গল পেরিয়ে অবশেষে গণ্ডামণ্ডা পৌঁছোল। কাছাকাছি গিয়েই গণ্ডামণ্ডা থমকে দাঁড়াল। কার গলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না? একটু দূরে একটা ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবকিছু।

        একটা ছোট গুহামতো জায়গা। তার ওপর একটা কাগজে বড়ো বড়ো করে লেখা-

 

বাঘুর গুপ্ত-আবাস

( সকলের জন্য নহে। অনুমতি ব্যতিরেকে প্রবেশ দণ্ডার্হ।)

 

নিপীড়িত, নির্যাতিত পশুছানাদের সুলভে পরামর্শ দেওয়া হইয়া থাকে।

 

পরামর্শের বিনিময়ে যৎকিঞ্চিত বাঘুদক্ষিণা- মাত্র পাঁচ আঁটি দূর্বাঘাস (অযথা দর কষাকষি করিবেন না।)

 

*** এখানে হাসা নিষেধ। প্রতিবার হাসির জরিমানা এক আঁটি করিয়া দূর্বাঘাস।

 

বি. দ্র.- প্রয়োজনবোধে এখানে সুলভে কাতুকুতু দেওয়া হয়। মূল্য- দুই আঁটি দূর্বাঘাস মাত্র (প্রতিবার কাতুকুতু পিছু)। কাতুকুতু দিবার ফলে উদ্ভূত হাসির জন্য কোনও বাড়তি জরিমানা লওয়া হয় না।

 

 

 

 

        একটা ছানা বাঘ দাঁড়িয়ে আছে গুহার সামনে। কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে উচ্চৈঃস্বরে ডাকছে, “ও বাঘুদাদা! বাঘুদাদা গো!”

        ডাকাডাকিতে গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে বাঘু। “কী ব্যাপার রে, বাঘটুস?”

        বাঘটুস একগাল হাসল, “বাঘুদাদা, কেমন আছো গো?”

        বাঘু ভুরু-টুরু কুঁচকে বলল, “জানিস না, এখানে হাসা মানা হ্যায়! ওই দ্যাখ, লেখা আছে। জরিমানা দে, এক আঁটি ঘাস।”

        বোঝাই গেল, বাঘটুস তৈরি হয়েই এসেছিল। সে সঙ্গে সঙ্গেই কাঁধের থলে থেকে এক আঁটি ঘাস বের করে বাঘুকে দিয়ে দিল। বাঘু ঘাসের আঁটিটা খানিক নেড়েচেড়ে দেখল, গন্ধ শুঁকল। তারপর বলল, “নে, ঠিক আছে। এবার বল্‌, কী সমস্যা?”

        বাঘটুস চোখ বড়োবড়ো করল, “জানো বাঘুদাদা, আমাদের বাড়ির পাশের বাড়িতে যে ধুমসো বাইসনটা আছে না, সে আমাকে দেখলেই ছড়া কাটে- বাঘটুস, ফুস ফুস!

        বাঘু শুনে ঠোঁট বেঁকাল, “ফুঃ! এটা কোন সমস্যাই নয়। আমি ভাবলাম কী না কী! তুই এক কাজ করিস। ওকে দেখলে তুই পালটা ছড়া কাটিস- বাইসন, ঢন ঢন! নে, এবারে ভিজিট তো জানিসই, পাঁচ আঁটি ঘাস! ঘাস দিয়ে তুই পালা। আর হ্যাঁ, সাত দিন পরে এসে রিপোর্ট দিবি। সেদিন অবশ্য দু আঁটি ঘাস দিলেই চলবে! তবে তুই যদি হেসে ফেলিস, তার কথা আলাদা।”

        দেখেশুনে গণ্ডামণ্ডার রীতিমতো আক্কেল গুড়ুম! আড়াল ছেড়ে বেরোবে কি বেরোবে না ভাবছে, এমন সময় তুমুল হইহল্লার শব্দ পাওয়া গেল। একদল ছানাপোনা জন্তুজানোয়ার যেন এইদিকেই এগিয়ে আসছে।

        ছানাজন্তুদের দলটা এসে থামল বাঘুর গুপ্ত-আবাসের সামনে। “ও বাঘুদাদা! বাঘুদাদা গো-ও-ও-ও! তুমি না বাঁচালে আমাদের আর কে বাঁচাবে গো-ও-ও-ও!”

        একটা পুঁচকে হরিণী, যার নাম হরিণীধিনি, সে সমানে তার কানে আটকানো ক্লিপ লাগাতে- খুলতে লাগাতে-খুলতে বিলাপই জুড়ে দিল, “ওগো বাঘুদাদা গো! দর্শন দিয়ে করো ত্রাণ, নইলে হবো যে খানখান!”

        ডাকাডাকিতে ঘাস চিবুতে চিবুতে বেরিয়ে এল বাঘু, “তোদের জ্বালায় শান্তিতে দুটো খাবার পর্যন্ত জো নেই!”

        দুটো ছোট্ট যমজ ছানা হনুমান, যাদের নাম কিনা হনুমালিশ আর হনুমলম, কাঁইমাই জুড়ল, “বাঘুদাদা, বাঘুদাদা, আমাদের না ভয়ানক বিপদ!”

        বাঘু বলল, “তা এখানে এসেছিস, নিয়মকানুন জানিসটানিস তো? আগে পাঁচ আঁটি ঘাস ফ্যাল, আমি আবার ধারের কারবার করি না!”

        ওরা প্রত্যেকে এক আঁটি করে ঘাস বের করে বাঘুর থাবায় দিল। বাঘু ঘাসগুলোকে হাওয়ায় দোলাতে দোলাতে ভুরু তুলল, “এত কিসের সমস্যা, শুনি?”

        একটা খুদে ভালুক বলতে শুরু করল, “বাঘুদাদা! আমরা তো ঝালুমালুর জংগলে থাকি, আর ওখানকার ‘কচি জানোয়ার শিক্ষায়তনে’ পড়ি। এবারে হয়েছে কী, একটা গোদা ভালুক, তার নাম ভালুফ্যাচাং, সেও কিছুদিন আগে ভর্তি হয়েছে আমাদের সঙ্গে। গায়ে বিশাল জোর।”

        বাঘু একটু ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করল, “ভ্যালাটে আর ভালুক্সিং জানে বুঝি?”

        হনুমালিশ বলল, “আরে না না, এর হল কবিতাক্সিং। মানে কবিতার বক্সিং।”

        হনুমলম চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “বা কবিতার শিং-ও বলতে পারো। তাই দিয়েই রাতদিন গুঁতোয় আমাদের।”

        বাঘু নাক-মুখ কোঁচকাল, “কবিতা তো ভালো জিনিস রে! তাই নিয়ে আবার ঝঞ্ঝাট কীসের?”

        হরিণীধিনি কানের ক্লিপ খুলে হাতে নিল, “শোনো বাঘুদাদা। বুঝিয়ে বলি। ভালুফ্যাচাংদাদা দিবারাত্র একটা মোটা কবিতার খাতা নিয়ে ঘোরে আর হাবিজাবি যা পারে লেখে। আর মিস শিয়ালমঞ্জরী ধাঁইকিড়ি কিংবা শিয়ালুর ফুসফুস স্যার কেউ না থাকলেই আমাদের চেপে ধরে শোনাবে। আর ওর কবিতা ভালো না বললেই সে চিমটে দেবে, খিমচে দেবে। আবার ভয় দেখায়, স্যার-মিসকে যদি বলে দিই, তাহলে আরও পেটাবে। এখানেও শেষ না। ভালুফ্যাচাংদাদার কবিতা আমাদের রীতিমতন মুখস্থ করতে হয়! তারপর টিফিন টাইমে পড়া ধরে। তুমিই বলো দাদা, এত কি আর সহ্য করা যায়?”

        কথা বলতে বলতে হরিণীধিনি মনের ভুলে তার মাথার ক্লিপটাকে বেমালুম বাঘুর ল্যাজে আটকে দিল আর বাঘুও লেজখানাকে গালে ঠেকিয়ে ভারি আশ্চর্য হয়ে বলল, “বটে? তা কীরকম কবিতা শুনি।”

        হনুমলম তড়বড় তড়বড় করে শুনিয়ে দিল,

“ড্যাং ড্যাং ড্যাড্যাং ড্যাং

তোর নাম ছাগল, তুই হলি পাগল,

তুই খাবি ঘাসপাতা

ড্যা ড্যা ড্যা ড্যা ড্যাং!”

               

          শুনেই বাঘুর চোখ কিরকির, নাক ঝিরঝির আর লেজ তিড়বিড় করতে শুরু করে দিল। হনুমালিশ দেখল, তারও কিছু বলা দরকার। ফলে হনুমলমের বলা শেষ হতে না হতেই সেও চটপট শুরু করল, –

“ভয়ংকর আর্তনাদ, শ্মশানের চুল্লী,

তার উপরে বসল বিল্লী

সাত আট নয় দশ

গণ্ডগোল গরমিল গরম শিঙাড়া।”

 

        বাঘু চোখমুখ গোলগোল করে বলল, “ওরে বাবারে! আমার ভয়ানক হৃৎকম্প হচ্ছে রে! খালি ওই গরম শিঙাড়াটাই যা ভালো! কিন্তু ওই অত গণ্ডগোলের মধ্যে কি শিঙাড়া খাওয়া যাবে আদৌ?”

        ভালুকুশ বললো, “আরে বাঘুদাদা, ওসব খাওয়াদাওয়ার চিন্তা ছেড়ে বলো কী করা যায়? তোমাকে কিন্তু আমরা এসেই পাঁচ আঁটি ঘাস দিয়ে দিয়েছি!”

        বেজায় ফাঁপরে পড়ে বাঘু বলল, “দাঁড়া, দাঁড়া, উতলা হোস না। ভাবতে দে।”

        তা বাঘু ভাবল খানিক্ষণ। ভেবেটেবে বলল, “তোদের ক্লাসের মিস বা স্যারকে একবার অন্ততঃ গিয়ে বল্‌।”

        অমনি হাঁইহাঁই করে উঠল সকলে, “কী বলবো? বলার উপায় আছে বুঝি? ভালুফ্যাচাংদাদা মিস-স্যারদের সামনে এমন মিষ্টি আর মাখন আর জ্যাম আর জেলি মাখিয়ে কথা বলে যে কেউ আমাদের কোন কথাই বিশ্বাস করে না। আবার বলেছে ওর কবিতাগুলোর ওপর আমাদের পরীক্ষা নেবে। পাশ না করতে পারলেই লেজমলা!”

        বাঘু শুনেটুনে বলল, “শোন্‌, কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হয়! আর… বিষে বিষে বিষক্ষয়! তাহলে কবিতার ওষুধ…”

        জোর রব উঠল, “পালটা কবিতা!”

        বাঘু বলল, “কিন্তু যা তা কবিতা হলে হবে না। জোরালো কবিতা চাই। ধর ভূগোল থেকে এক লাইন, ইতিহাস থেকে এক লাইন, বাংলা থেকে এক লাইন আর অংক থেকে এক লাইন- এইভাবে নিয়ে কবিতা বানা।”

        বাঘু লেজটাকে মুখের মধ্যে নিয়ে খানিকক্ষণ চুষল। তারপর কান চুলকোল, তারপর নাক চুলকোল। তারপর শূন্যে গোটাকয়েক ঘুঁষি ছুঁড়ল। নিজের মনে একচক্কর লম্বাগুড়িও দিয়ে নিল। তারপর বলল, “হয়েছে।” 

        শুনে সবারই লেজ টিসটিস, মাথা ঢিসঢিস! বাঘু দয়াপরবশ হয়ে বলল, “বুঝলি না তো? শোন্‌, ভূগোলে কী পড়িস? নদী, পাহাড়, বন- এইসব। তাহলে তোদের প্রথম লাইন ধর হোলো- নদী মাঠ বন পাহাড়।

        “এরপর দ্বিতীয় লাইন। এটা ইতিহাস থেকে নিয়ে নে।”

        ওদের লেজ লুড়লুড়, কান কুরকুর শুরু হয়ে গেল। ইতিহাস থেকে আবার কী লাইন হবে কবিতার?”

        বাঘু বলল, “আরে, এত ঘাবড়াবার কী আছে? ভারি সোজা। ইতিহাসে কী পড়িস? প্রাচীন মধ্য আধুনিক যুগ। সেটা একটা লাইন করে দিলেই মিটে যায়। তারপর… তারপর বাংলা। বাংলায় পড়িস রচনা থাবালেখা এসব। আর তারপর অঙ্ক। অঙ্ক থেকে এক লাইন নিয়ে নে। ব্যস! মিটে গেল!”

        হঠাৎ করে গোঁ গোঁ শব্দ। ভালুকুশ কাঁপতে কাঁপতে বলল, “বাঘুদাদা… বাঘুদাদা… আমার তো এই শুনেই ভালুকজ্বর চলে এল গো! আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।”

        বাঘু তাকে দাবড়ে দিয়ে বলল, “মেলা কোঁ কোঁ করিস না দেখি। নে, পুরোটা শুনে নে ভালো করে। পুরো কবিতাটাই প্রথম থেকে বলছি…

নদী মাঠ বন পাহাড়।

প্রাচীন মধ্য আধুনিক যুগ।

রচনা থাবালেখা প্রশ্ন উত্তর।

যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ।।”

 

        শুনেই সকলে চমকে উঠে এ ওকে ভয়ের চোটে জড়িয়ে ধরল। হরিণীধিনি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতেই বাঘুর লেজ থেকে ক্লিপ নিয়ে মাথায় আটকাল ফের, “আসলে কী বাঘুদাদা, আমাদের না কবিতাতঙ্ক হয়ে গেছে!”

বাঘুর মুখে করুণার হাসি, “আরে, ওইজন্যই তো তোদের কবিতাঞ্জেকশন দিলাম। মানে কবিতার ইঞ্জেকশন! তোদের ওই ভালুফ্যাচাং না ভালুঘচাং, সে তোদের কবিতা শোনাতে এলেই তোরা সবাই মিলে পালটা এই কবিতাটাই শোনাবি। রাতদিন শোনাবি। দেখবি, সাতদিনেই ওর কবিতা লা-পতা হয়ে গেছে!”

        ছানাপোনাদের দলটা বেজায় খুশিয়াল হয়ে ‘বাঘুদাদা জিন্দাবাদ/ কবিতার চোটেই কবিতা বাদ’ বলতে বলতে চোখের আড়ালে চলে গেল।

বাঘু পেছন ফিরে গুহায় ফের ঢুকতে যাবে, এমন সময় গণ্ডামণ্ডা বেরিয়ে এল আড়াল থেকে।

        “বাঘুদাদা! বাঘুদাদা!”

        হাঁক শুনে বাঘু পিছন ফিরে ভুরু কোঁচকাল, “কী ব্যাপার, তোকে যেন চেনা চেনা লাগে?”

        গণ্ডামণ্ডা থাবাটাবা ছুঁড়ে খড়্গ উঁচোল, “আরে সেই যে… সেইবারে… ওই যে আঁকার প্রতিযোগিতার সময়… তুমি ওই যে আঁকার খাতায় মশা চিটিয়ে পাখি বলে চালাবার চেষ্টা করেছিলে, আর ছোট ছোট মাছ চিটিয়েছিলে যাতে আসল মাছ মনে হয়… তারপর অনেক লেজমলা আর কী কী সব ভালো ভালো বকুনি খেয়েছিলে, মনে নেই? আমিও তো ওইখানেতেই ছিলাম গো।”

        বাঘু চোখমুখ কুঁচকে বলল, “বুঝেছি, বুঝেছি। তোর আর অত ব্যাখ্যায় কাজ নেই। কী যেন নাম বেশ তোর?”

        গণ্ডামণ্ডা নিজের নাম বলায় বাঘু বেজায় গ্রাম্ভারি চালে বলল, “তা আমাকে কি মুশকিল আসান করতে হবে শুনি? আর সব নিয়মকানুন ভালো করে পড়ে নিয়েছিস তো?”

        খড়্গখানা চুলকোল গণ্ডামণ্ডা, “মানে, ইয়ে বাঘুদাদা, আগে তো জানতাম না। তাই ঘাস আনা হয়নি। পরের দিন নিয়ে আসবো।”

        “উহুঁ। উটি হচ্ছে না। অ্যায়সা চালাকি নেহি চলেগা। তোর সমস্যা মিটে গেলে তুই আর থোড়ি এতদূর উজিয়ে আমাকে দিতে আসবি?”

        গণ্ডামণ্ডা বিস্তর কাকুতিমিনতি করল। গোড়াতে বাঘু নারাজ হলেও শেষটায় নিমরাজি হল, “আচ্ছা বেশ। তোর সমস্যা আজ শুনবো। কিন্তু আজ আমি সমাধান দেবো না। সামনের সপ্তাহে ঘাস নিয়ে আয়। তখন বাতলে দেবো।”

        গণ্ডামণ্ডা হাঁইহাঁই করে তার সমস্যা উগরে দিল। বাঘু শুনে বেজায় ভেবলে গিয়ে বলল, “শোন্‌, গণ্ডারনি দিদিমণির বিষয় তো। আমাকে ভালো করে ভাবতেও হবে। তা তুই এক কাজ কর। তোর পরের দিন আর ঘাস এনে কাজ নেই।”

        গণ্ডামণ্ডা বেজায় খুশি হয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ, বাঘুদাদা।”

        বাঘু থাবা দিয়ে লেজ চুলকে বলল, “তার বদলে তুই এক কাজ করিস। আমাকে ঘাসমণ্ডা বানিয়ে এনে দিস। গণ্ডারনি দিদিমণি খাসমণ্ডা খায় তো, তার পালটা হিসেবে ঘাসমণ্ডাই তুই আমাকে বাঘুদক্ষিণা বাবদ দিস। তোরা গণ্ডাররা তো ঘাসটাস ভালোই খাস শুনেছি, তা তোরও দিতে সুবিধেই হবে। বেশ সরেস হয় যেন!”

 

 

 

        পরের বুধবার। পাঠশালায় শিয়ালনি দিদিমণির কাছে পড়া চলছে। দিদিমণি ভগ্নাংশের অংক করতে দিয়েছেন দু-দুখানা। প্রথমটা হল-

        একটি ছানা বাঘের লেজের দৈর্ঘ্য ২ ফুট। ছানা বাঘটি দুষ্টুমি করায় তার মা তার লেজের কিছু অংশ লাল রঙ করে দেয়। যদি ছানা বাঘটির লেজের ১/৩ অংশ লাল রঙ করে থাকে, তাহলে তার লেজটির মোট কত দৈর্ঘ্য রঙ না করা অবস্থায় ছিল? (১ফুট= ১২ ইঞ্চি)  

        দ্বিতীয় অংকটা ছিল এরকম-

        বলীবর্দ নামের এক ষাঁড় রোজ সকালে পাঁচ কিলো করে গোবর দেয়। এক থুত্থুড়ি বুড়ি প্যাঁচা এসে সেই গোবর নিয়ে যায়। একদিন বলীবর্দ পাঁচ কিলোর জায়গায় দুই কিলো গোবর দিল এবং প্যাঁচা তাই নিয়ে গেল। তাহলে সেদিন বুড়ি প্যাঁচা কত ভগ্নাংশ গোবর কম পেল?

         বাঘুর পাশে বসেছে কুমরু। তার আবার ভগ্নাংশের অংক দেখলেই মন উলুসঝুলুস করে আর টপাটপ করে ফেলে। বাঘু কুমরুর খাতাটা দেখার চেষ্টা করল, বিশেষ সুবিধের হল না। বেশি কাছে যেতেও পারছে না বাঘু, পাছে আবার কুমরুর কাঁটা গায়ে ফুটে যায়!

        দিদিমণি ওদিকে ঝিমুচ্ছেন। বাঘু খুব সাবধানে উঁকিঝুঁকি মেরে যতটা পারে কুমরুর খাতা দেখে লেখার চেষ্টা করল। তারপর কুমরু কড়াচোখে তাকিয়ে ‘অ্যাইয়ো বাঘু’ বলায় গুটিগুটি থাবায় গেল অন্যদিকে সরে গেল।

        হাতুশি আর হিনিমিনি অঙ্ক শেষ করে একমনে কাটাকুটি খেলছিল। খাতা দুটো একদিকে পড়ে ছিল। বাঘু ওদের দুজনের খাতা থেকে যতটা পারে দেখল কিন্তু উত্তরগুলো বিশেষ পছন্দ হল না বলে নিজের জায়গায় ফিরে যেমন মন চায় লিখে গেল।

        একটু পরেই দিদিমণির চটকা ভেঙে সবার কাছে খাতা চাইলেন। হাতুশিরা খেলা ফেলে, ভালকি টুথপেস্ট চাখা থামিয়ে, কুমরু কবিতা লেখা বন্ধ করে খাতা জমা দিয়ে এল। বাঘুও হেলতেদুলতে গিয়ে খাতা জমা দিল।

        বাকি সবাই মোটামুটি ঠিকঠাকই করেছে। কিন্তু সকলের শেষে বাঘুর খাতা দেখতে গিয়ে দিদিমণির ঝড়ের মত দীর্ঘশ্বাস বইতে লাগল, দু-চোখ দিয়ে বর্ষার উত্তাল নদীর মত জলধারা ঝরতে লাগল।

        হাতুশি ভয়ে ভয়ে দিদিমণির কাছে গিয়ে বাঘুর খাতায় উঁকি মারল। সেখানে লেখা আছে-

        ১)  ছানা বাঘের লেজ= ২ ফুট।

        তাহলে তার মায়ের লেজ = ৩ ফুট। মায়ের লেজে কি রঙ আছে। থাকলে কে রঙ করেছে, কেন করেছে? না থাকলে, কেন নেই? দায় কার?

        লেজে লাল রঙ। বাজারে কি নীল বা খয়েরি রঙ ছিল না?

        লাল রঙ তার মা কোত্থেকে পেল। তার কি রঙের দোকান আছে? আর রঙ করার সময় ছানা বাঘ প্রতিবাদ করেনি কেন?

        তারপরে আসল কথা। দ্বিতীয় অঙ্ক থেকে খানিকটা গোবর নিয়ে প্রথম অঙ্কের ছানা বাঘের লেজে পুরোটা লেপে দিলেই সব ঝামেলা মেটে। তাহলে উত্তর হবে ২ ফুট। কারণ তখন সবটাই রঙ না করা।

২) দুই কিলো গোবরের থেকে প্রথম অঙ্কের জন্য এক কিলো গোবর ধার দেওয়া হয়েছে। ওই ধার ফেরত এলে তবেই এই অঙ্কটি করা যাবে। নইলে নয়।

 

        শিয়ালনির থাবা থেকে বাঘুর খাতা ছিটকে গেছে কখন। হাতুশি শুঁড়ে খাতা কুড়িয়ে এনে পড়ছে। বাকিরা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বাঘুর খাতার উপর।

        বাঘু ফিচিক ফিচিক হাসতে হাসতে গুটিগুটি থাবায় দিদিমণির কাছে গিয়ে গেড়ে বসল। তারপর ভারি বিনীত ভঙ্গিতে বলল, “দিদিমণি, আমি কি কিছু ভুল লিখেছি?”

        শিয়ালনি ফোঁস ফোঁস করে চোখের জল ফেলতে ফেলতেই বলল, “না রে, বাঘু! তুই কিছু ভুল লিখিসনি, মনা! ভুল আমারই যে বাঘুবাবু! তোকে অঙ্ক করতে দেওয়াটাই আমার মহাভুল!”

        শুনেই বাঘু মহা খুশি, “তাহলে আর কাল থেকে অঙ্ক করতে হচ্ছে না! দেরিতে হলেও যে আপনি যে নিজের ভুল বুঝেছেন, এই আমার অনেক পাওয়া! হুররে!”

        ফোঁসফোঁসানি থামিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে চাইল শিয়ালনি, “উটি হচ্ছে না, বাঘুবাবু। অত আহ্লাদে আটখানা হবারও কারণ নেই। মাইনাসে মাইনাসে প্লাস। ভুলে ভুলে ভুলক্ষয়! আসছে শনিবার সারাদিন তোর বাড়িতে থেকে তোকে পড়াবো।”

        শনিবার শুনেই কেতরে গেল বাঘু! আরে, ওইদিন তো গণ্ডামণ্ডার আসার দিন! ঘাসমণ্ডা নিয়ে আসার কথা। সেসবের তাহলে কী হবে?

        হাঁউমাঁউ করে উঠল বাঘু, “না, দিদিমণি, না। ওইদিন আমার ঘাসমণ্ডা…মানে ঘাসমণ্ডাও না, মানে প্রাইভেট প্র্যাকটিস… মানে প্রাইভেট প্র্যাকটিসও নয়… মানে… ও হো হো হো… শনিবার দিন বিপদে ফেলবেন না গো… ও হো হো… দিদিমণি গোওওওও…”

        শিয়ালনি চোখ সরু করে চাইল, “কী বলছিস, বাঘু? ঘাসমণ্ডা, প্রাইভেট প্র্যাকটিস?”

        বাঘু তাড়াতাড়ি করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “শোকেতাপে আমার মাথার ঠিক নেই গো, দিদিমণি! শনিবারে ওরা সবাই ছুটি কাটাবে, আর আমাকে ওইসব বাঘিপিসী মার্কা অঙ্ক কষতে হবে গোওওও!”

        কটমট করে চাইল শিয়ালনি, “বাঘুউউ! বাঘুউউউউউ! লেজ গুটিয়ে শুনে রাখ। আমি যা বলছি, তাই-ই হবে। না হলে তোর বাঘিপিসীকে আমি নিজে গিয়ে পাঠশালায় ডেকে নিয়ে আসব। আর শনিবার তোদের বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করব। তোর মা-কে বলে রাখিস।”

 

        এইরকম ঘোর বিপর্যয়ে পরের কয়েকটা দিনেই বাঘুর লেজ শুকিয়ে এতটুকু। শুক্রবার দিন কাঁইমাঁই করে ‘শনিবারে পড়াশুনো করার অপকারিতা’ নিয়ে শিয়ালনি দিদিমণিকে একটা ছোটোখাটো ভাষণ দেবার তালেও ছিল সে। কিন্তু দিদিমণি তার কোন কথা কানে নিলে তো?

ভয়ানক মুষড়ে গিয়ে বাঘু সেদিন আঁকার ক্লাসে কুমরুর পিছনে বসে তার গায়ের কাঁটাগুলো ইচ্ছেমতন লাল-নীল-হলুদ-সবুজ রঙ করল। কুমরু তখন এতোই একমনে ছবি আঁকছিল যে কিছু টেরই পায়নি। তারপর বাঘু হিনিমিনির দিকে তাকিয়ে বিকট ভেংচি কাটল।

সেখানেই শেষ নয়, টিফিনের সময় যখন হাতুশি, হিনিমিনি আর ভালকি আর কুমরু তখন ‘মানুষডাঙ্গা’ খেলায় মহা ব্যস্ত, তখন একফাঁকে ভালকির টুথপেস্টের কৌটোটা নিজের ব্যাগে লুকিয়ে রাখল- এই দুটো দিন ভালকি খুঁজে মরুক! সেটা সেরে হাতুশির ‘গণিত গ্রন্থি’ বইতে বিছুটি পাতা ঘষে রেখে দিল। হাতুশি বাছাধনের তো খুব অঙ্ক করার শখ! অঙ্ক করতে গেলেই বাছাধন মজাটি টের পাবেন!

        বাড়ি ফিরে ভেবে ভেবে একটা ফিকির ঠাউরাল বাঘু। শনিবার সকালে দাঁতটাঁত মেজে সাফসুতরো হয়ে জলখাবার খেয়ে লেজটেজ আঁচড়ে সুবোধ বাঘছানার মতন মুখ করে বাঘিন্নীকে বলল, “মা, আজ তো দিদিমণি আসবেন। আর এদিকে পেনসিলের বাক্সটা মনে হয় পাঠশালাতেই ফেলে এসেছি। একবার গিয়ে নিয়ে আসি। নইলে দিদিমণিই বা এসে কী পড়াবেন, বলো?”

        বাধ্য হয়েই বাঘিন্নী যেতে দিল বাঘুকে। সে কিন্তু পাঠশালার পানে আদৌ গেল না। পেনসিলের বাক্স ওর স্কুলব্যাগেই বহাল তবিয়তে আছে!

গুপ্ত আবাসে হাঁফাতে হাঁফাতে গিয়ে যখন পৌঁছোল বাঘু, তখন অনেকটাই বেলা গড়িয়ে গেছে!

        গণ্ডামণ্ডা অপেক্ষা করছিল বাইরে। থলে ভর্তি ঘাসমণ্ডা। তার বাবা গণ্ডারুককে বিস্তর ভুজুং ভাজুং দিয়ে তবেই ঘাসমণ্ডাগুলো থাবাগত (হস্তগত-র মতন আর কী!) করতে পেরেছে। বাঘুদাদার দেরি দেখে দু-চার পিস ঘাসমণ্ডাও যে তার উদরগত হয়নি, এমনটাও নয়!

        গণ্ডামণ্ডা বাঘুকে দেখে হাসতে গিয়েও সামলে নিল। কে জানে, হাসির দরুন পাছে আবার জরিমানা হয়! বাঘু দূর থেকেই হাঁক ছাড়ল, “এই যে গণ্ডামণ্ডা, ঘাসমণ্ডা এনেছিস? ওগুলো দে আগে, তাপ্পরে কথা হবে! অ্যাডভান্স পেমেন্ট ছাড়া আজকাল আমি কোন কারবার করি না।”

        গণ্ডারনি দিদিমণি এই সপ্তাহে রোজই গণ্ডামণ্ডার টিফিন কোন না কোন অছিলায় বাজেয়াপ্ত করেছেন। সেই দুঃখের কথা বলতে বলতে ঘাসমণ্ডার থলেটা বাঘুকে দিল গণ্ডামণ্ডা।

বাঘু আচ্ছাটি করে গন্ধটন্ধ শুঁকে বলল, “তোর কেসটা একেবারে নস্যি! ফুঃ! কোন ব্যাপারই নয়। তুই এক কাজ করবি। মণ্ডার সঙ্গে জবরদস্ত লংকা মিশিয়ে দিদিমণির জন্য স্পেশাল কিছু বানিয়ে রাখবি। তোর টিফিনবাক্স- যেটাতে তুই টিফিন নিয়ে যাস, ওটাতেই লংকামণ্ডা ভরে রাখবি। আর তোর নিজের জন্য অন্য একটা থলেতে ভালো খাসমণ্ডা রাখবি। সেটা তোর নিজের জন্য… চুপিচুপি। বুঝলি? ব্যস! এক দুদিনেই রেজাল্ট পাবি, একশ ভাগ গ্যারান্টি সহকারে। আর হ্যাঁ, কাঁচালংকা মেশানোর আগে তোর নিজের হাতে থাবাস্তানা পরে নিস। নইলে পস্তাবি। নে, পালা এখন! আস্তানায় ঢুকি। আমার বলে বেজায় ঘাসমণ্ডা খিদে পাচ্ছে! সকাল থেকে মোটে খাইনি কিনা!”

 

 

 

        শনিবার সকালে উঠেই হাতুশি বসেছিল অঙ্কের বই নিয়ে। কাল দিদিমণি যে পাতার অংকগুলো করাচ্ছিলেন, সেই পাতাটা খুলতেই থাবায় যেন লক্ষ পিঁপড়ের কামড়!

        চুলকুনির চোটে দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে হাতুশি। আচমকাই তার মনে হল, আরে, হিনিমিনির কাছেই একটা জবরদস্ত মলম থাকে! রম্ভোলিনি নাম। লাগালে নাকি দুনিয়ার সব চুলকানি সেরে যায়, কল জ্বালাপোড়ার উপশম হয়!

        হিনিমিনির বাড়ি গিয়ে মলমটা লাগিয়ে দিব্যি আরাম হল হাতুশির। হিনিমিনিকে পিঠে নিয়ে ঘুরতে বেরোল জঙ্গলের এপাশ ওপাশ। কিছুদূর গিয়েই দেখা ভালকির সঙ্গে। মুখচোখ কেমন উদ্‌ভ্রান্ত।

        “কী হয়েছে রে? সক্কাল সক্কাল অমন হাঁফাতে হাঁফাতে চললি কোথায়?’

        হাতুশির প্রশ্নের উত্তরে ভালকির চোখমুখ ঝুলে গেল, “আর বলিস না। আমার টুথপেস্টের কৌটোটা কাল পাঠশালে নিয়ে গেছলাম। তারপর বাড়ি ফিরে দেখি ওটা আর নেই। বাড়ির টুথপেস্টটা বেজায় ঝাল। এট্টুখানি চাখারও উপায় নেই! স্কুলব্যাগেরটাই যা একটু লুকিয়ে চুরিয়ে চাখি। তাই পাঠশালের দিকে যাচ্ছিলাম যদি ওখানে ফেলেটেলে এসেছি।”

        অমনি পেছন থেকে একটা আওয়াজ পাওয়া গেল, “পাঠশালে গিয়ে কাজ নেই। বরং বাঘুর বাড়িতে চ। ওখানে গেলে যদি পাওয়া যায়! এই দেখ না, আমার কাঁটাগুলোতে কেমন বিচ্ছিরি রঙ করেছে। জানিস, কালকে আমাদের কুমীরপাড়ায় সবাই আমাকে এই নিয়ে বিচ্ছিরি রকমের ছড়া কেটেছে-

কুমীরের পিঠে রঙ-কাঁটা,

ও কুমীর তুই চললি কোথা?

হেই কুমীর, তুই দিসনে হাঁটা-

আনগে কিনে লম্বা ঝাঁটা!

 

      কুমরুর কাঁদো কাঁদো গলা শুনে মুষড়ে পড়ল ওরা। হিনিমিনি মাথা দোলাল, “ঠিকই বলেছিস রে, কুমরু। এই যে দ্যাখ না, হাতুশির অঙ্কের খাতায় কীসব জ্বলুনে জিনিস ঘষা। আমার মনে হয়, বাঘুরই কীর্তি।”

হাতুশি শুঁড় ঝাঁকাল, “আমারও তাই সন্দেহ হচ্ছিল। কিন্তু বলিনি কারণ চোখে তো দেখিনি। দিদিমণিরও তো এখন ওদের বাড়িতেই থাকার কথা।”

ভালকি সায় দিল, “সেই ভালো। দিদিমণিকেও সবটা জানানো দরকার। কুমরুর কাঁটার রঙ অন্ততঃ বাঘু ছাড়া যে কেউ করেনি, এটা তো পরিষ্কার।”

হাতুশি মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, “আচ্ছা, সেদিন বাঘু কীসব ঘাসমণ্ডা আর প্রাইভেট প্র্যাকটিস বলছিল, তোরা কেউ কিছু বুঝেছিস।”

হিনিমিনি সঙ্গে সঙ্গেই মুখ গোঁজ করল, “আমি বাপু, কিছু বুঝিনি।”

হাতুশি বলল, “কিছু একটা তো ব্যাপার আছেই। যাকগে, চ, বাঘুর বাড়িতেই যাই!”

 

পেটপুরে ঘাসমণ্ডা খেয়ে জবরদস্ত এক ঘুম দিয়ে উঠল বাঘু। দিদিমণি নির্ঘাত অপেক্ষা করে চলে গেছেন এতক্ষণে। কয়েকটা ঘাসমণ্ডা থলে থেকে উঁকি দিচ্ছে। ওগুলোকে উদরস্থ করে বাড়ি ফিরে মা-কে বানিয়ে বানিয়ে একটা ভালো গল্প ফেঁদে দিলেই চলবে!

মহানন্দে ঘাসমণ্ডা খেতে শুরু করেছে বাঘু। আরামে চোখ মুদে আসছে। আহহা! বেড়ে সোয়াদ!

এমন সময় বেজায় কোলাহল শোনা গেল গুহার বাইরে। কারা যেন খুব উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে! গলাগুলোও চেনা চেনা ঠেকে যেন!

ঘাসমণ্ডা খেতে খেতেই কৌতূহলে গুহার বাইরে মুণ্ডু বাড়িয়েই বাঘু কেঁপেঝেঁপে একশা। শিয়ালনি দিদিমণির পিছু পিছু হাতুশিরা সবাই!

শিয়ালনি দিদিমণির গলার স্বরে যেন গুহাটাই ফেটে চৌচির হয়ে যাবে, “বাঘুউ! বাঘুউউউউ! অ্যাঁ, কী পেয়েছিস কী তুই? আমাকে সকাল থেকে তোর বাড়িতে শুধু শুধু বসিয়ে রেখে নাকাল করার মতলব?”

কুমরু ফুচ ফুচ কাঁদল, “কাল আমার পিছনদিকের সবকটা কাঁটায় রঙ দিয়ে রঙবাজি করেছিস!”

হাতুশি শুঁড় তুলল, “আর আমার অঙ্ক বইয়ের পাতায় চুলকানি পাতা নিশ্চয়ই তুই ঘষেছিস। তুই-ই ঘুরঘুর করছিলি ওখানে। আর তোর ব্যাগে বিছুটি পাতা আর গ্লাভসের কী প্রয়োজন?”

ভালকি বলল, “আর আমার টুথপেস্টের কৌটো? সেটা তোর স্কুলব্যাগের মধ্যে গেল কী করে? বাঘিন্নীমাসি তোর স্কুলব্যাগ ঘেঁটে স-অ-ব বের করেছে।”

শিয়ালনি বলল, “আর তোর পেনসিলের বাক্স তো তোর ব্যাগেই ছিল। মা-কে ভড়কি দিয়ে পড়ায় ফাঁকি দেবার ফিকির?”

হিনিমিনি দেখল তারও কিছু বলা দরকার। সে বলল, “আর বাঘু, হ্যাঁ রে, হ্যাঁ রে, হ্যাঁ রে, ক্লাস চলার সময় তুই যে আমাকে ভেংচি কেটেছিলি, সে তো আমি স্বচক্ষেই দেখেছি।”

শিয়ালনি এগিয়ে এল, “বাঘুউউউ! এটাও শুনে রাখো। রাস্তায় গণ্ডামণ্ডার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল। ছানাপোনা জন্তুজানোয়ারদের উষ্টুমধুষ্টুম বুদ্ধি দিয়ে ঘাস খাবার মতলব, না? আর তার জন্যই সকালবেলায় ডুব মারলি? চল্‌, তুই, এক্ষুণি ঘরে চল। সকালবেলাটা যেমন নষ্ট করেছিস, তেমনি তোর বাড়িতে আমি আজ রাতেও থাকব আর পড়াব তোকে!”

আর বাঘু? মনের দুঃখে ভেউভেউ করে কান্নাই জুড়ে দিল, “ওরে আমার গণ্ডামণ্ডা রে… তুই এ কী আমার সব্বোনাশটাই না করলি রে… আঁই আঁই আঁই (কান্না)… এবারে দিদিমণি যে আমার ঘাড়ে ধরে পড়া করাবে রে… আঁই আঁই আঁই (কান্না)… ওরে আমার প্রাইভেট প্র্যাকটিস যে মাঠে মারা গেল রে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… আঁই আঁই আঁই আঁই…।”

 

……০……            

                                 

 

বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি থাবাছানি দিচ্ছে নিচের লিঙ্কেঃ-

১। বাগে এলো বাঘু

২। গিঁটের গেরোয় বাঘু

৩। বাঘু খেল ঘাস

৪। বাঘু হলেন মনিটর

৫। শিয়ালনী কুপোকাত

৬। অযোধ্যা পাহাড়ে বাঘু 

৭। পরীক্ষা দিলেন বাঘু

৮। গণ্ডারনী ও গণ্ডগোলিক্স

৯। নামতা শেখেন বাঘুবাবু

১০। শিয়ালনীর পাঠশালায় সিংহালু

১১। বাঘু হল চিৎপটাং 

১২। ঘুম দিলেন বাঘুবাবু  

১৩। পাঠশালায় ধুন্ধুমার

১৪। বাঘুবাবু ও জান্তা জট 

১৫। বনভোজনে বাঘুবাবু

১৬। হোলি খেলল হিনিমিনি      

১৭। ভোটে দাঁড়ালেন বাঘুবাবু

১৮। পাঠশালা মহাসভায় হাতুশি 

১৯। বাঘুর ল্যাজলজ্জা

২০। ছবি আঁকেন বাঘুবাবু         

২১। জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু

২২। উল্কার কবলে বাঘু

২৩। কবি সম্মেলনে বাঘুবাবু

২৪। বিদেশি মোলাকাতে বাঘু

২৫। বাঘু দিল গো- ও- ও- ল

২৬। কদলীপ্যাথি চিকিৎসাধীন বাঘু                                        

Leave a comment

Check Also

baghu_kobi sommelan

কবি সম্মেলনে বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

            পাঠশালায় আসছিল শিয়ালনি। আজ দেরিই হয়েছে কিছুটা। কাল সন্ধেবেলা খরগোশাই ডাক্তারদিদির বাড়ি নিমন্ত্রণ …

উল্কার কবলে বাঘু

উল্কার কবলে বাঘু – মৌসুমী পাত্র

(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা  তোমাদের দিযছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ …

শিল্পী- সোমক সেনগুপ্ত/ জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু

জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

  পিঠে থলে ঝুলিয়ে বাঘু চলেছে পাঠশালার পানে। মনে বেশ খুশি খুশি ভাব। একটা গাছের …

ছবি আঁকেন বাঘুবাবু- মৌসুমী পাত্র

ছবি আঁকেন বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। …