ঢং ঢং করে স্কুলের ঘন্টাটা শেষ অব্দি পড়েই গেল। হাঁফাচ্ছে কুহেলি, প্রাণপণে দৌড়োচ্ছে স্কুলে যাবার গড়ানে রাস্তা ধরে। এইটুকুনি রাস্তা এতটা দূর হয়! এপাশের বাড়ির পলাশ গাছটা থেকে দুটো পলাশফুল সামনেই মাটিতে পড়ল। হাতে সময় থাকলে ঠিক কুড়িয়ে নিত। আজ… ইসস! বাচ্চাগুলো বেরোতে শুরু করেছে। হাঁফাতে হাঁফাতেই কুহেলি পৌঁছোল স্কুল গেটের সামনে। আয়ামাসী হাঁক দিয়েছে তাকে দেখে, “ঋক, ঋক…”।
চেনা ছোট্ট অবয়বটাকে এক ঝলক দেখতে পেল কুহেলি। তাকে এক পলক দেখে নিয়েই ব্যাগ আনতে ছুটেছে। ওই তো, ভারি ব্যাগ পিঠে নিয়ে টেনে টেনে আসছে ছোট্ট ঋক। মেরুন ডোরাকাটা জামা আর নীল প্যান্ট পরা ছেলেকে দেখে বুকটা জুড়িয়ে যায়। শুক্রবারে স্কুল ইউনিফর্মের বালাই থাকে না। ছেলের পিঠ থেকে ব্যাগটা নিতে গিয়ে অভ্যস্ত চোখে ধরা পড়ে বদলটুকু। ছেলের মুখটা কেমন ভার ভার লাগছে না? গুমোট আকাশের মতন? চোরা চিন্তাটাকে স্নেহের প্রলেপ লাগিয়ে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে, কিছু হয়েছে?”
আকাশের মুখে অন্ধকার আরো একটু ঘন হয় যেন। ঋক উত্তর দেয় না। পাশ দিয়ে দুড়দাড় করে দুটো বাচ্চা দৌড়ে চলে গেল। হেলমেটবিহীন ছেলেমেয়েরা হেলমেটহীন বাবাদের ক্রমাগতঃ হর্ন বেজে চলা বাইকের পেছনে চেপে পাশ দিয়ে পেরোচ্ছে। কুহেলি গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছে ছেলের হাত ধরে। আলগা আদর করে ছেলেকে বলে, “হ্যাঁ রে, আমাকেও বলবি না, তুই?”
বাদল মেঘটা এবার যেন ফুঁসেই ওঠে, “আমাকে তুমি এমন বিচ্ছিরি জামা পরিয়ে পাঠাও কেন? সবাই আমাকে বাজে বাজে জামা দেয়। দিদুন, ঠাম্মু সব্বাই। তুমিও।”
হোঁচট খেয়ে গেল কুহেলি। কী বলতে চাইছে ছেলে? সমস্যাটা আরো একটু বোঝার জন্য নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, “তোকে তো বাবা, আমরা সবাই ভালো ভালো জামাই কিনে দিই। সবকটাই তো খুব সুন্দর।”
“মোটেই না, কক্ষণো না।”, কালো মেঘ তার জটা দোলাচ্ছে সমানে, “পচা জামা। সবকটাই। টুপটুপের কত ভালো ভালো জামা… কত ফুল… প্রজাপতি…আমার অমনি একটাও নেই… আমাকে ওরকম কিনে দেবে এবারে…”
মেঘের থেকে সহসা আছড়ে পড়া বাজে যেন স্থাণু হয়ে গেছে কুহেলি। টুপটুপ নামের মেয়েটাকে চেনে সে। সুন্দর একটা ফ্রক পরে মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে গেল একটু আগেই। কিন্তু ছেলেকে এখন কী বোঝাবে সে? ছেলেদের জামায় ফুল থাকতে নেই, প্রজাপতি থাকতে নেই এইসব? নিজের কানেই কেমন ঠেকছে না?
“কী হল? এবারে একটা ফ্রক কিনে দেবে তো?”, একটা টান পড়ল হাতে। কোনমতে কুহেলী বলল, “আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। হবে। এখন তো দেরি আছে পুজোর।”
একটা খালি টোটো পেরোচ্ছিল সামনে দিয়ে। হাত দেখিয়ে তাড়াতাড়ি করে রাস্তা পেরিয়ে সেটায় উঠে পড়ল কুহেলি ছেলেকে নিয়ে।
কুহেলি নিজের ছেলেকে যেটা স্পষ্ট করে বলতে পারেনি, সেটাই রাখঢাক না করে বলে দিলেন শাশুড়ি। রোজ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই ঠাম্মুর ঘরে ঢুকে যায় পুপাই। তিনি ততক্ষণ পুজোটুজো সেরে ফ্যানের তলায় সবে বসেছেন হাওয়া খেতে। পুপাই সোজা ঢুকেই বলল, “ঠাম্মু, তুমি আমাকে একটা জিনিস দেবে কিন্তু।”
“কী নেবে, নকুলদানা? তোমার জন্য নকুলদানা, বাতাসা আমি সাজিয়ে রেখেছি দাদুভাই।”
“না, নকুলদানা নয়। তুমি আমাকে একটা ফ্রক কিনে দেবে। খুব সুন্দর। ফুলফুল।”
তাঁর ছেষট্টি বছরের জীবনে এমন অদ্ভুত কথা বড় একটা শোনেননি বাসন্তীদেবী। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে হাসিহাসি মুখে বললেন, “কিন্তু ছেলেরা তো ফ্রক পরেনা দাদুভাই। ফ্রক তো পরে মেয়েরা।”
“কেন? কেন পরবে না? টুপটুপ আগের শুক্রবার শার্টপ্যান্ট পরে এসেছিল। তার বেলা? ও মেয়ে হয়ে ছেলেদের পোশাক পরলে দোষ নেই? খালি ছেলেরা পরলেই যত দোষ? ও পরলে আমিও পরবো।”
“দাদুভাই! তুমি না ছেলে! তুমি বড় হয়ে চাকরিবাকরি করবে।”
“তাতে কী হয়েছে? মিস ক্লাসে সেদিন বলেছে, ছেলেমেয়ে সবাই সমান।”
প্রমাদ গুনলেন বাসন্তীদেবী। মিস তো স্কুলে বলেই খালাস। নাও, এবারে ম্যাও সামলাও! তবুও বলার চেষ্টা করলেন তিনি, “দ্যাখো, তোমার মা তো চাকরিবাকরি করে না। তাই মাও রঙিন পোশাক পরে। আর বাবা চাকরি করে বলে বাবা পরে না। তুমি বড় হয়ে বাবার মতোই হবে। নয় কী?”
“কেন, মায়ের বন্ধু রুম্পিমাসীও তো চাকরি করে আর কত সুন্দর সুন্দর পোশাক পরে। আর মাকে তো তুমিই চাকরি করতে দাওনি।”
একখানা বাজ যেন ভেঙে পড়ল কুহেলির বুকে। রুম্পির কাছে ফোনে সেদিন দুঃখ করছিল এই নিয়ে। পুপাই একপাশে বসে ছবি আঁকছিল। কী করে বুঝবে, ওইটুকুনি বাচ্চার একটা কান পড়ে আছে মায়ের কথার দিকে! ইসসস, বাজে ব্যাপার হয়ে গেল। এ নিয়ে না আবার ঝামেলা হয়!
পুপাই ততক্ষণে অন্য আবদার জুড়েছে, “আমার ক্লাসের মেয়েবন্ধুরা কত সুন্দর সুন্দর জুতোও পরে আসে। আমাকেও ওরকম কিনে দিও।”
ঠাম্মির কাছে আবদার সেরেই পুপাই ফিরল মায়ের কাছে, “মা, ঠাম্মু আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলছে না। দুটো মাথার ক্লিপ কিনে দিতে বললাম, বলল তোর মাকে বল্।”
মনের মধ্যে জমে থাকা অভিমান, ক্লেদ থাপ্পড় হয়ে নামে ছোট্ট ছেলেটার গালে, “সব সময় অত মেয়েলিপনা কিসের তোর? তুই ছেলে, ছেলের মত থাকতে পারিস না?”
আচমকা মার খেয়ে ভ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করেছে পুপাই। তাই দেখে রাগ আরো বেড়ে যায় কুহেলির। বাচ্চার কিছুক্ষণ আগের আবদারগুলোই এখন বিকট বিকারের মত লাগতে থাকে তার। চিৎকারে ফেটে পড়ে সে, “মেয়েদের মত জামা না পরলে চলছে না, না? মেয়েদের মত? মেয়ে হবি? মেয়ে?”
কচি কচি দুটো গাল ভেসে যাচ্ছে জলে। নরম মনটা এতটা রূঢ়তায় অভ্যস্ত নয়। পুপাই কাঁদছে আর সমানে বলছে, “ও মা, মা, আমি কী করবো? ও মা, বোকো না। ও মা, আমাকে বকছ কেন?”
ছেলের কান্নার তোড়ে থমকে যায় কুহেলি। দু’হাত বাড়িয়ে ছেলেকে টেনে নেয় বুকে। ছেলের চোখের জলের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে মায়ের চোখের জল…
পুজোর ছুটিতে চুঁচুড়ায় ননদের বাড়ি এসেছে কুহেলি, ছেলেকে নিয়ে। ননদের মেয়ে বুবলি আর পুপাই পিঠোপিঠি। খুব খেলা জমেছে দুজনের। দেবর্ষি আসেনি, তার অফিস খুলে গেছে। লক্ষ্মীপুজো আর কালীপুজোর মাঝের ক’টা দিন ছুটি কাটিয়ে ফিরবে কুহেলিরা।
একটা শতরঞ্জি পেতে দিয়েছে ননদ। তার ওপর বুবলির রাজ্যের খেলনা ছড়ানো। একটা বন্দুক তাক করেছে বুবলি পুপাইয়ের দিকে, “ঢিসুম, ঢিসুম। ঠ্যা ঠ্যা ঠ্যা ঠ্যা ঠ্যা ঠ্যা… ।”
“আমার বন্দুক নিয়ে খেলতে ভালো লাগে না। আয় না, বসে বসে লুডো খেলি।”
“ধুস”, বুবলি ঠোঁট উল্টোয়, “আমার বসে বসে খেলতে ইচ্ছে করে না। চল বরং, চোর পুলিশ খেলি। তুই চোর, আমি পুলিশ। আমি তোকে ঢিসুম ঢিসুম করবো।”
“আমি খেলবো না।”, ঘাড় গোঁজ করে পুপাই।
“ঠিক আছে। তুই তাহলে পুলিশ হ, আমি চোর। তুই ঢিসুম ঢিসুম করবি।”, লোভ দেখানোর চেষ্টা করে পুঁচকে মেয়েটা।
“আয় না, বসে বসে খেলি কিছু। আমার বন্দুক নিয়ে খেলতে ভালো লাগে না।”, পুপাই বুবলির হাত ধরে এক টান লাগায় এবার।
“না , বসে বসে খেলবো না।”, দুই ভাইবোনের টানাটানি, কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়।
দুই মা-কেই ছুটে আসতে হয়। ননদের মুখে চাপা হাসি, “যাই বল বৌদি, পুপাইকে নিয়ে তোমার কোন সমস্যা নেই। কী সুন্দর মেয়েদের মতো বসে বসে খেলা করে, নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে। আর আমার মেয়েটা হয়েছে পুরো উড়নচণ্ডী। ফেলবে, ছড়াবে…। বসে বসে খেলার কোন ব্যাপারই নেই। তোমারটা ছেলে হয়েও মেয়ে, আর আমারটা মেয়ে হয়েও ছেলে!”
দুই কান, মাথা রীতিমতো ঝাঁ ঝাঁ করছে কুহেলির। কোন উত্তরই মুখে জোগাল না। পুপাই যে শান্ত, ভদ্র, নিজের জিনিস গুছিয়ে রাখে- সেই শিক্ষাটা সে ছোটবেলা থেকে পেয়েছে বলেই না! ঝিম্পি যদি তার মেয়েকে সেটা শেখাতে না পেরে থাকে, তার দায় তারই। মনের মধ্যে অজস্র রাগেরা একে অন্যের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, কলবল করে কথা বলে যাচ্ছে- কিন্তু মুখ দিয়ে উত্তরে একটাও শব্দ এগিয়ে এল না কুহেলির। ভদ্রতাবোধের লক্ষ্মণরেখায় কোথায় যেন আটকে গেল সব!
ঝিম্পি চলে গেছে রান্নাঘরে। কুহেলির আর ইচ্ছে করছে না। ধপ করে বসে পড়ল শতরঞ্জিটায়। পুপাই আর বুবলি এখন খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলছে। কই, কোথাও তো কোন সমস্যা নেই।
বাচ্চা হবার আগে ননদ খুব ছেলে ছেলে করত! বাপের বাড়িতেই এসে ছিল ঝিম্পি। পুপাই তখন সবে বছরখানিকের। আত্মীয়স্বজন যাঁরাই আসতেন, তাঁরাই আশীর্বাদ করতেন ছেলে হবার। সেসময়গুলো বুকটা যেন ছ্যাঁত করে উঠত কুহেলির! ভাগ্যে তার ছেলে হয়েছে! নইলে তার ওপর কী সব ঠেসবাক্য বর্ষিত হত কে জানে!
নিজের সময়ও দেখেছে কুহেলি, ঝিম্পির সময়েও দেখেছে! কম পরিচিতা, বেশি পরিচিতা, যে মহিলাই আসুন না কেন, সন্তানসম্ভবাকে অবধারিতভাবে পুত্রসন্তানের আশীর্বাদ না করলে যেন ভাত হজম হয় না! তাঁর ছেলে হবার পর যাঁরা আহ্লাদে মুখ ভরিয়ে বলেছিলেন, “বলেছিলাম না, ছেলে হবে! মিলল তো!”, তাঁরাই ঝিম্পির মেয়েকে দেখে ঠোঁটের কোণে একটা যেমনতেমন হাসি ঝুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছেন, “আহা! মেয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে? আজকাল ছেলেমেয়ে সব সমান।”
একটা সারসত্য বুঝেছে কুহেলি। সমাজ এখনো মেয়েদের আবির্ভাবকে আপদ বলেই মনে করে। সে চারিদিকে যতোই প্রগতিশীলতার ঢক্কানিনাদের বন্যা বয়ে যাক না কেন!
এই তো সেদিন, কামারশালের কাছে জ্যামে আটকে গিয়েছিল সে। অনেকগুলো চারচাকাই ফেঁসে ছিল জ্যামে। সব্বার প্রথমে আটকে ছিল যে চারচাকাটা, সেটার স্টিয়ারিং ধরে বসে ছিল একটা মেয়ে। তার বয়সীই হবে। আর চতুর্দিকের জ্যামে আটকে পড়া লোকজনেদের যত রাগ, যত বিদ্রূপোক্তি- সব ছুঁড়ে ছুঁড়ে গিয়ে জমছিল তার গায়ে। পুরুষ ড্রাইভারে অভ্যস্ত চারপাশের পুরুষ চোখেরা মুখে মুখে উগরে দিচ্ছিল নারীজাতির প্রতি যাবতীয় ঘৃণা! সেই মেয়েটার থমথমে অপমানিত মুখটা এখনো চোখে ভাসছে কুহেলির।
“মা, মা, দেখো না বুবলি আমাকে মারছে!”
চমকে তাকায় কুহেলি। মার খেয়ে ছোট ছেলেটা ঠোঁট ফুলিয়ে বসে আছে।
“তুই না খেলে ছবি আঁকছিলিস কেন?”, পাল্টা তেড়ে আসে বুবলি।
তাই তো, সামনে পড়ে থাকা একটুকরো কাগজে কত সুন্দর নকশা ফুটিয়ে তুলেছে পুপাই! ছেলের মাথার চুল ঘেঁটে দিল কুহেলি, “ভারি সুন্দর হয়েছে রে!”
স্কুল খুলে গেছে পুপাইয়ের। ওরা ফিরে এসেছে উলুবেড়িয়ায়। কুহেলিরও তিনদিন ধরে জ্বর। জ্বর গায়ে ধুঁকতে ধুঁকতেই ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে ফিরল কুহেলি। যতোই কষ্ট হোক, তার কাজগুলো তো তাকেই সারতে হবে। ছেলের জামাকাপড় বদলে দিয়ে খেতে বসিয়ে নিজেও একটা নাইটি পরে বিছানায় লেপের তলায়। জ্বরটা আসছে আবার। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা সংসারের হাজারো চিন্তা নিয়েই চোখটা বুজে আসে তার। আর তখনই, কে যেন তার কানের পর্দা এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় মাত্র দুটো শব্দবন্ধে, “আস্তে, লেডিজ!” বন্ধ চোখের পর্দায় ছায়াছবির মত ভেসে ওঠে পুপাইয়ের স্কুল, স্কুলের ছেলেমেয়েরা, তাদের কথাবার্তা।
আরো অনেক মায়েদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে কুহেলি। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। পুপাই এসে হাত ধরেছে মায়ের, মুখ শুকনো। পিছন পিছন একটু দূরেই রৌনক আর আর্য নিজেদের মধ্যে কীসব হাসাহাসি করছে। লক্ষ্য যে পুপাই, বুঝতে ভুল হয় না কুহেলির। আর্যের কথাটা কানে এল কুহেলির, “একফোঁটা মারামারি পারে না, ছেলে হয়েছে!” রৌনক ঠোঁটে আঙুল দিল, “সসসস! আস্তে, লেডিজ!” নিমেষের মধ্যে রাতের অন্ধকার নেমে এল পুপাইয়ের মুখে।
“না- আ- আ- আ- আ!”, তীব্র একটা চিৎকার ছুঁড়ে বিছানার উপর উঠে বসল কুহেলি। ওঘর থেকে ছুটে এসেছে পুপাই। তার খাওয়া শেষ, হাতে ধরা হলুদ রঙের প্যাস্টেল। শাশুড়ির গলা পাওয়া যাচ্ছে , “পুপাই, দেখ তো, তোর মায়ের জ্বরটা বাড়ল কিনা!”
পুপাই এসে রেখেছে মায়ের কপালে, “মা, কষ্ট হচ্ছে? জল খাবে?”
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে কুহেলি। এই কী, তার ছেলে? নিষ্পাপ, পবিত্র একটা মুখ। ছেলেই তো, ও তো ছেলেই। তাহলে সবাই মেয়ে বলে কেন? বিড়বিড় করছে কুহেলি, “মারপিট… একটু মারপিট করতে পারিস না বাবা… তাহলেই তো আর কথা শুনতে হয় না…।”
পুপাই এগিয়ে এসেছে কাছে, “কী বলছো, মা? আমার ব্যাগে একটা ক্যাডবেরি আছে। এনে দিই? জানো না, চকলেট এনার্জি দেয়?”
ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে কুহেলি। জ্বরটা বাড়ছে এবার।
জ্বর থেকে সেরে উঠে কুহেলি দেখা করল ওদের ক্লাসটিচারের সঙ্গে। এক দু’ কথার পরই পাড়ল আসল কথা। ক্লাসের অন্যান্য ছেলের হাতে প্রায়ই মারধোর খাচ্ছে ঋক। চুপচাপ সব শুনলেন ওদের ক্লাস টিচার। তারপর বললেন, “মিসেস কর, আপনার সমস্যাটা আমি বুঝতে পারছি। আমি দেখব ব্যাপারটা। না না, এ মোটেই ঠিক নয়। এভাবে টিজ করা আমি মোটেই অ্যালাউ করি না। ক্লাসের ছেলেদের আমি বকে দেব।” তারপরই বেগুনি রঙা লিপস্টিক-রঞ্জিত ঠোঁট বাঁকালেন তিনি, “তবে আপনাকেও একটা কথা বলি, মিসেস কর। ছেলেকে এভাবে মেয়েদের মত করে মানুষ করবেন না। আপনার ছেলে তো দেখি আজকাল মেয়েদের সঙ্গেই বেশি সময় কাটায়! ছেলেরা একটু ড্যাশি-পুশি না হলে মানায়! একটু আধটু মারপিট করবে, রাফ অ্যাণ্ড টাফ হবে। তবেই না পুরুষমানুষ!”
মাথা খুঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল তার। কেন যে মরতে কথা বলতে এসেছিল! অনেক কথা অবিরল মাথা ঠোকাঠুকি করছিল মনের মধ্যে। কিন্তু মুখে একটাও কথা ফুটল না তার। নিছক সৌজন্যের খাতিরে, নাকি দিদিমণিকে না চটানোর তাগিদে, কে জানে, একটা শুকনো ‘থ্যাংক ইউ’ বলে বেরিয়ে এসেছিল কোনমতে।
সেই থেকেই একটা অসহ্য কষ্ট কুরে কুরে খাচ্ছে কুহেলিকে। দেবর্ষিকে একবার সুযোগ পেয়ে বলতে গিয়েছিল। সে তো হেসেই উড়িয়ে দিল, “আরে, ওসব ভুলভাল ভেবে মাথা খারাপ কোরো না তো! এক এক মানুষ একরকম। কেউ ইন্ট্রোভার্ট হবে, কেউ এক্সট্রোভার্ট! সেটাই প্রকৃতির নিয়ম। যাও এখন, এক কাপ চা করে আনো তো। ম্যাচটা দেখি। পুপাই, পুপাআআআই, কী করছিস রে? আয়, তোকে ক্রিকেট খেলাটা বোঝাই।”
গোঁজ হয়ে থেকে রান্নাঘরে চলে গেল কুহেলি। কী করে সে সমস্যাটা বোঝাবে? দেবর্ষির যে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। কিছু কিছু দহন থাকে, যার জ্বালায় একাই পুড়তে হয়! গরম জলের ধোঁয়া উঠছে রান্নাঘরে, চা পাতা দিতে ভুলে গেছে সে।
বাবা- ছেলের সম্মিলিত আনন্দোল্লাস ভেসে আসছে বাইরের ঘর থেকে। বিরাট বোধহয় আরেকটা ছয় মারল। সেদিকে হুঁশ নেই কুহেলির। পাঁচফোড়ন আর লঙ্কাফোড়নের ঝাঁঝ উঠেছে রান্নাঘর জুড়ে। কে জানে, তার জেরেই হয়তো বা, এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল ওর চোখের কোল বেয়ে।
বিচিত্র এক অন্ধকূপে ডুবে আছে কুহেলি। এ এক এমন সমস্যা যে সমস্যা বলেই কেউ চট করে মানতে চাইবে না। এমনকি তার নিজের বরই বুঝতে চাইছে না আদৌ কোথাও কিছু সমস্যা আছে বলে। অথচ সমস্যা তো আছেই। নাহলে কেন বারেবারে মুশকিলে পড়তে হচ্ছে পুপাইকে? সমস্যাটা কি পুপাইয়ের নাকি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির? আচ্ছা, এরকম তো মাঝেমধ্যে শোনা যায় যে জঙ্গলের জন্তুজানোয়ারদের মধ্যে কোন মানুষের বাচ্চা বড় হলে সে তাদেরই হাবভাব পায়। বেশি কথা কী, টারজানের কথাই ধরো না! তখন তো কই, অন্যরকম কথা ওঠে না? পুপাই এমনিতেই মা- ঠাম্মার কাছে মানুষ, বাবাকে আর পায় কতটুকু? তারপরে স্বভাব লাজুক বলে স্কুলেও মেয়েদের সঙ্গেই ভাব বেশি। ফলে তাদের দেখে যদি তার রঙচঙে ফুল- প্রজাপতির দিকে মন যায়, তাতে দোষ কতটুকু?
নিজের মনেই প্রতিযুক্তির জাল বুনছে কুহেলি। আচমকাই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। যা ভাবছে, তা যদি না হয়? যদি পুপাইয়েরই কোন সমস্যা থাকে? হে ঠাকুর ঠাকুর, অমনটা যেন না হয়! পরীক্ষায় কম নম্বর পাক পুপাই, মেনে নেব ঠাকুর, কিন্তু অন্যরকম কিছু যেন না হয়!
অদৃশ্য নির্বাক দেবতার উদ্দেশ্যে মনে মনে মাথা ঠুকতে থাকে কুহেলি।
একটা সুযোগ কুহেলি খুঁজছিল কয়েকদিন ধরেই। পুপাইটা দুপুরবেলা ঘুমোয় না, আর রাত্রিবেলা বাবা না ফিরলে কিছুতেই ঘুমোবে না। ঘুম পাড়াতে হবে সেই কুহেলিকেই, কিন্তু ততক্ষণে বাচ্চাকে আর একলা পায় কোথায়? এদিকে আজকাল লজ্জাবোধও হয়েছে, মায়ের কাছে চান করার সময়ও প্যান্ট পরেই করে। খালি বাবার কাছে শনি- রবিবারে চানের সময় প্যান্ট খোলে।
অনেক সাধ্যসাধনা করে ছেলেকে আজ দুপুরে ঘুম পাড়িয়েছে কুহেলি। আজ তাকে ভালো করে দেখে বুঝে নিতে হবে সবকিছু। নিরন্তর এই দহনকাঁটার ভার আর সে বইতে পারছে না। দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিয়েছে। পুপাইয়ের ঘুম গভীর হয়েছে বোঝার পর পা টিপে টিপে বিছানায় উঠল কুহেলি। পশ্চিমদিকের জানালাটা সন্তর্পণে খুলে পর্দাটা ফেলে দিল। যাক্, বাইরে থেকে কেউ অন্ততঃ দেখতে পাবে না। যেটুকু আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঘরের ভেতর ঢুকছে দিনমানে, তাতে দেখার কোন অসুবিধা নেই। এইবারেই আসল কাজ। এতটুকু শব্দ যেন না হয়। নিঃসাড়ে দুরুদুরু বুকে এগিয়ে গেল ছোট্ট শরীরটার দিকে। নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে। পবিত্র শিশু ঘুমের ঘোরে আরও পবিত্র হয়ে যায়! তার মা যে কী করতে চলেছে, সে সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই তার। ধীরে, অতি ধীরে পুপাইয়ের প্যান্টখানা হাঁটুর কাছে নামিয়ে আনল কুহেলি। পুপাই উসখুস করল একটু, কিন্তু জাগল না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা শুরু করল কুহেলি। কোথাও কোন অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে কি? ছেলেদের যেমন হয়, তেমনই তো! নাহ! সবই তো ঠিকঠাক। প্যান্টটা পরানোর সময় মানসিক উত্তেজনায় একটু জোরেই টেনে থাকবে হয়তো, ধড়মড়িয়ে উঠে বসল পুপাই। বোবা বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আরও একবার প্রাণান্তকর চেষ্টায় ঘুম পাড়িয়ে দিল কুহেলি।
কুহেলির নিজের মন কিছুটা প্রবোধ মানল হয়তো, কিন্তু সমস্যা মেটে কই? এক একদিন স্কুল থেকে বেরোয় ঋক, ক্ষোভ- অপমানের ছোঁয়া মেখে থমথম করে কচি মুখখানা। কুহেলি বোঝে সব, কিন্তু কী করবে? পুপাইকেই বোঝায় ঠারেঠোরে- বন্ধুরা কেউ কখনো আজেবাজে কথা বললে একদম কান দিবি না। পুপাই শোনে, কিন্তু কিছু বলে না।
এর মধ্যেই সেদিন পুপাইকে নিয়ে বেরোচ্ছে, পেছন থেকে দৌড়ে এসেছে টুপটুপ, “জানো আন্টি, ওরা না রোজ ঋককে আজেবাজে কথা বলে। বলে ও না কি লেডিজ!”
আশেপাশে বাচ্চাদের মায়েদের মধ্যে হাসির হররা উঠল একটা। কুহেলি আর পারল না। পেছনে তাকিয়ে দেখল, স্কুল গেটের মুখেই সেই মোটা ছেলে দুটো। রৌনক আর আর্য। পুপাই যে হাতের মধ্যে শক্ত করে ধরা, তাও ভুলে গেল সে। পুপাইকে হাতে ধরে টানতে টানতেই একরকম তেড়ে গেল ছেলেদুটোর দিকে, “কী ভেবেছ তোমরা? রোজ রোজ ওর পেছনে লাগতে লজ্জা করে না তোমাদের?”
একটা ছেলে চুপ করে রইল। অন্য ছেলেটা নির্বিকার মুখে বলল, “না আন্টি, আমরা তো কিছুই বলিনি।”
“কিছু বলোনি? তাহলে কি ও মিথ্যে বলছে?”, পেছন ফিরে চাইল কুহেলি। টুপটুপ তখন তার বাবার বাইকের পিঠে চাপছে। ছেলেদুটোর মায়েদেরও দেখতে পেল কুহেলি। এ ওর গায়ে ঢলাঢলি করে হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে ঢুকছে। দুজনে আবার নাকি প্রাণের বন্ধু! কুহেলি হাল ছেড়ে দিল। ওদের বলে লাভ নেই। ছেলেদের হয়তো শাসন করবেই না, উলটে ওদেরই পক্ষ নেবে। মাঝখান থেকে ঋক খোরাক হয়ে উঠবে গোটা স্কুলের।
বাড়ি ফিরেই রুম্পিকে হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ পাঠাল কুহেলি, “হ্যাঁ রে, ফিরেছিস? একবার কথা বলতাম।”
রুম্পির ফোন এসে গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। অফিসের বিদেশ ট্যুর ছিল থাইল্যাণ্ডে। কাল রাতে ফিরেছে। আজ বাড়িতেই আছে। হাঁউমাঁউ করে পুপাইকে নিয়ে চলা সমস্যার কথা উগরে দিল কুহেলি। রুম্পি শুনল মন দিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “শোন, এসব জিনিসের কোন রেডিমেড সমাধান হয় না। আমাদের স্কুলগুলো লেখাপড়া শেখায়, পরীক্ষা পাশ শেখায়- অপরের প্রতি সহিষ্ণুতা তো শেখায় না। স্কুলও না। বাড়িও না। বরং নিজের সঙ্গে, নিজের পোশাক আশাক অভ্যাস ইত্যাদির সঙ্গে বিন্দুমাত্রও না মিললে মানুষ তাকে ব্যঙ্গ করে অদ্ভুত আনন্দ পায়। তোর ছেলের কথা বলছিস। আমার কথা শোন্। জানিসই তো, খবরের কাগজ, নানারকমের বইপত্র- এসব না পড়লে আমার ভাত ঠিকঠাক হজম হয় না। তা ইউনিভার্সিটিতে যখন পড়তাম, হোস্টেলের কাগজওলাকে বলে আলাদা কাগজ নিতাম নিজের। সারাদিন সময় হত না। সন্ধেবেলা ফিরে চা বানাতাম। মুড়ি মাখাতাম। তারপর খবরের কাগজ নিয়ে বসতাম। তা আমার রুমমেট একদিন আমাকে কী বলল জানিস্? বলল যে, তোর তো পুরো ছেলেদের মত হাবভাব! ক্লাস সেরে ফিরেই চশমা এঁটে বাবাদের মত কাগজ পড়তে বসে যাচ্ছিস! আমি তো শুনে থ। আমাদের সমাজ মানুষ তৈরি করে না কুহেলি, ছেলে কিংবা মেয়ে তৈরি করে!”
কুহেলি চুপ। কী-ই বা বলে? যে মেয়ে প্লাস্টিকের নখ পরে ঘুরে বেড়ায়, তার ‘মেয়েত্ব’ নিয়ে কারুর কোন সমস্যা হয় না! আর ট্রেকিং-র নেশায় বিভোর মেয়েকে অবলীলাক্রমে দাগিয়ে দেওয়া যায়- ও তো ছেলেদের মতো! অবশ্য তাই-ই বা কেন, ‘মেয়েলি’ কোন জিনিস ছেলেরা বাছলে তাতেও মুশকিল। বিয়ের আগে নাচ শিখত সে। বিয়ের পর প্রায় ছাড়াই হয়ে গিয়েছিল, বেশির ভাগ মেয়েদেরই যা হয়! পুপাই হবার পরে মাঝেমধ্যে নাচটাচ করে কচি ছেলের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করত। দেখে দেখে পুপাইও নকল করার চেষ্টা করত। বছর তিনেক বয়স যখন পুপাইয়ের, বেশ রপ্ত করে ফেলেছিল নাচের বিভিন্ন মুদ্রা। মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বাসনাটাকে একদিন খাবার টেবিলে এনে ফেলেছিল কুহেলি, “আমি ভাবছি, পুপাইকে একটা নাচের স্কুলে দিয়ে দেব। এত ভালো নাচ করছে আজকাল ও।”
খাওয়া থমকে গিয়েছিল দেবর্ষির। স্থির চোখে তাকিয়ে মেপেছিল কুহেলিকে। তারপরই চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, “নাচ শেখাবে ছেলেকে? মেয়েদের মত?”
মৃদু প্রতিবাদ করেছিল কুহেলি, “কেন, অনেক ছেলেই তো নাচ শেখে। অসুবিধে কি?”
হাল ধরেছিলেন শাশুড়ি, “অসুবিধে একটাই। ও ছেলে। মেয়ে নয়। আর এ বাড়ির ছেলেরা কেউ নাচ শেখে নি কোনদিন।”
প্রতিবাদ করলে অনেক কথাই তো বলা যেত। উদয়শংকর, কেলুচরণ মহাপাত্র- এঁরা কি পুরুষ নন? বলিউড, টলিউডের এরকম কোন স্টার আছে নাকি যে নাচ জানে না? তাদের সিনেমা তো হামলে পড়ে দেখো। অনেক কথাই বুকের মধ্যে ঠেলাঠেলি করছিল তার, কিন্তু কিছুই বলে উঠতে পারল না। সে স্বভাবতঃ চুপচাপ, নির্বিরোধী স্বভাবের। যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে প্রতিপক্ষকে প্যাঁচে ফেলার ধাত তার নয়। এই জায়গাতেই সে হেরে যায় বরাবর। আজও গেল। আর বলেই বা কী করবে? বাবা- ঠাকুমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে ছেলেকে নাচের স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আসতে পারবে না। অতএব, চুপচাপ থাকাই শ্রেয়।
সকাল সকাল রাঁধাবাড়া, খাওয়ার কাজ আজ গুছিয়ে নিয়েছে কুহেলি। পুপাইয়ের ইউনিট টেস্ট সামনে। কিছু প্রশ্ন বানিয়ে রাখবে, দুপুরবেলায় করাবে পুপাইকে বসিয়ে। একটা বাংলা খাতা টেনে নিল। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল। নতুন প্রশ্নোত্তর লিখিয়েছেন দিদিমণি। কিন্তু এটা কী? প্রশ্ন লিখিয়েছেন, ‘কী বৃষ যায়’? উত্তর হবে – ‘কৃশ বৃষ যায়’। ‘কী বৃষ যায়?’- এটা প্রশ্ন হল? দিদিমণির সামান্যতম বাংলা জ্ঞানটুকুও আছে কি? বিস্ময়ের অভিঘাতে কুহেলি যখন বিমূঢ়, তখনই পাশে রাখা মুঠোফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা কানে চাপল সে- হ্যালো।
- ঋকের মা বলছেন? আমি স্কুল থেকে বলছি।
বুকের ভিতর দুমদুম ঘন্টাধ্বনি শুরু হয়ে গেল যেন। কোনমতে বলল, “হ্যাঁ, বলছি।”
- আপনাকে এখনি একবার স্কুলে আসতে হবে। ঋককে বাড়ি নিয়ে যান।
প্রবল উৎকণ্ঠা বুক চিরে বেরিয়ে এল তার, “ঋক ঠিক আছে তো?”
- “হ্যাঁ, ও পুরো ঠিক আছে। আপনি চলে আসুন।”
রীতিমতো ছটফটানি শুরু হয়ে গেল তার। পুপাই যদি ঠিকই থাকবে তাহলে বাড়ি ফেরত নিয়ে যেতে বলবে কেন? কিন্তু… স্কুলই বা কেন অসুস্থতার খবর চাপবে? তাহলে কি অন্যকিছু? কিন্তু কীই বা হতে পারে?
মনের মধ্যে হাজারো চিন্তার ঘূর্ণিপাকের মধ্যেই তৈরি হয়ে নিল কুহেলি। শাশুড়িকে দু’চার কথায় বুঝিয়ে দিয়ে খাবার বেড়ে নিয়ে খেতে বলে দিল। কে জানে, তার দেরিও হতে পারে। ফোন রাখতে বলল হাতের কাছে। দরকার বুঝলে ফোন করবে। দেবর্ষিকে আর কিছু জানাল না কুহেলি। থাক সে নিজের মত অফিসে আছে, থাকুক।
হাঁফাতে হাঁফাতে স্কুলে পৌঁছে সব শুনে কুহেলি হতভম্ব। টিফিনের সময়ে দু-চারজন বন্ধুর সঙ্গে রুমালচুরি খেলছিল পুপাই, সেইসময় রৌনক ওকে বারকয়েক ‘লেডিজ’ বলে ডাকে। আচমকাই বুবাই চরম আক্রমণ করে ছেলেটিকে। মারধোর, কিল-ঘুঁষি কিছুই বাদ যায়নি। পুপাইকে নাকি বন্ধুরা সকলে মিলেও সামলাতে পারছিল না। রৌনক ঘাবড়ে গিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। তখনই স্কুলের দেওয়ালে লেগে মাথা ফেটে যায়। তাকে পাঠানো হয়েছে হাসপাতালে। পুপাইকে আজ আর স্কুলে রাখার ঝুঁকি নিতে চাইছেন না মিসেরা। আগামী এক- দুদিন না পাঠানোই ভালো- ঠারেঠোরে এমন ইঙ্গিতও ভেসে এল। অমন শান্ত ছেলে যে দুম করে অত খেপে গেল- তাই নিয়েই আলোচনার বন্যা বইছে জোর। ছেলেকে হাতের মুঠোয় ধরে চুপচাপ সব শুনল কুহেলি।
পাশ দিয়ে টোটো, অটো, বাইক সাঁইসাঁই করে পেরোচ্ছে। বাতাসে হালকা আগুনে আঁচ। তেমনিভাবেই ছেলেকে হাতের মুঠোয় ধরে হেঁটে হেঁটে ফিরছে কুহেলি। ইচ্ছে করেই অটো, টোটোয় চাপেনি। মুঠোবন্দী এই উত্তাপটুকু বড়ো প্রয়োজন এখন। দুজনেরই। মিসেদের কাছে শোনা কথাগুলোর নিরন্তর অনুরণন চলছে মনের ভেতর। রৌনক যেন সুস্থ হয়ে ওঠে তাড়াতাড়ি। আচমকাই একটা কথা মনে হওয়ায় নিজের মনেই হেসে উঠল কুহেলি। পাশ থেকে বোবা বিস্ময়ে পুপাই চাইল তার মায়ের দিকে।
তার ছেলেটা কি সত্যিই ‘ছেলে’ হয়ে উঠল এতদিনে??!!
………০………