লোকটা ফস্ফস্ করে বিড়ি ফুঁকছিল। আমাকে দেখে মুখের বিড়িটা ফেলে দিয়ে বলল, “বাবু, ভালো আছেন?” চল্লিশ- বিয়াল্লিশ বয়স, ভাঙাচোরা এলোমেলো চেহারা, মুখে রুখো দাড়ি। রাস্তার পাশের বাড়িতে রাজমিস্ত্রীর যোগাড়ের কাজ করছে।
আমার স্মৃতিশক্তি চিরকালই কমজোরি। হাঁ করে তাকিয়ে থাকা দেখেই লোকটি আবার বলে, “বাবু, আমি হাসান। টিনভাঙা, লোহাভাঙা, প্লাস্টিক ভাঙা, পুরনো বই- খাতা কিনতাম।”
ওহ্, হ্যাঁ! মনে পড়েছে। কুড়ি- বাইশ বছর পর ছেলেটির সঙ্গে দেখা। এখন অবশ্য আর ছেলে নেই, ছেলেমেয়ের বাবা হয়ে গেছে!
তখন ও কুড়ি- বাইশের সদ্য যুবা, মাগুর মাছের মতন চেহারা, সাইকেলের দুপাশে ঝুড়ি বেঁধে বেড়িয়েছে টিন ভাঙা লোহা ভাঙা কিনতে। চোত-বৈশাখের খর বেলা। ছেলেটি ঘেমে নেয়ে একশা। বলে-‘কাকু, কিছু হবে?’ হবে হয়ত কিছু। স্বভাব কুঁড়ে আমি। বলি-‘না বাবা, কিছু নেই।’
ছেলেটি বলে-‘পুরনো পেপার অন্ততঃ কিছু দিন।’ এই বলে সাইকেল থেকে নেমে ঘরের ছায়ায় দাঁড়ায়। আমি ওকে বারান্দায় আমার কাছে ডাকলাম।
একটু জল-বাতাসা খেতে দিয়ে জিজ্ঞেস করি,- “বাবা, তোমার বাড়ি কোথায়?”
“এখান থেকে সাত- আট কিলোমিটার দূরে।”
জিজ্ঞেস করি, “বাবা, তোমার বাড়িতে কে কে আছে? কাদের জন্য এই পরিশ্রম করছো?”
ছেলেটি উত্তর দেয়, “আমার আব্বা, আম্মা, ভাই বোন আছে। আব্বা পাড়ায় পাড়ায় সবজি বেচে। তাতে আমাদের ভাল খাবার জোটে না। তাই আমি ভাঙা টিন লোহা কিনে বিক্রি করি যাতে আমরা একটু ভাল করে খেতে পারি। টালির চালের ঘর- মাটির মেঝে- বর্ষায় স্যাঁতসেঁতে হয়ে যায়। যদি পাকা করতে পাড়ি তো মা বাবা ভাই বোন মিলে একটু আরামে বাস করতে পারবো।”
সেই দেখা। তারপর এই এতদিনে! রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করছে। কাজটা বেশ খাটনির। তবুও করছে।
ওকে জিজ্ঞেস করি, “এই বয়সে এত পরিশ্রমের কাজ করছ কাদের জন্যে?”
“বাবু, বাড়ি বউ বাচ্চা কাচ্চা আছে। তাদের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবারের জোগান দিতে আমাকে এই কাজ করতে হয়।”
আমি জিজ্ঞাসা করি, “তোমার মা বাবা, তাঁরা কোথায়?”
“বাবু, আম্মা কবরে, আব্বা আলাদা থাকে।”
“তুমি আব্বার খাওয়া- পরা দেখাশোনা কর না?”
হাসান অত্যন্ত কুণ্ঠার সঙ্গে উত্তর দেয়- “পারি না, বাবু।”
……০……