আমরা এমন একটা প্রজন্ম যারা কিছুটা হলেও অভাব দেখেছি। ভাই-বোনে হাফ হাফ ডিম খেয়েছি, ডুগি-তবলার মতো! মা ডিম ভেজে আলু দিয়ে ঝোল করতো! বড় হয়ে বুঝেছি ওটা মধ্যবিত্ত সাশ্রয়ের একটা পন্থা! লন্ঠনের আলোয় পড়েছি! হলুদ রঙের বাল্ব কমন ছিলো! জানলা দিয়ে টিউবের সাদা আলো তো প্রাচুর্যের প্রকাশ!
ছোটো টেবিল ফ্যান টুলে রাখা থাকতো! বিছানায় ভাগাভাগি নিয়ে ঝগড়া হতো! সকাল সাতটায় আকাশবাণী সংবাদ ছিল রেডিওতে! তার মাঝে কপিলা গোখাদ্যের বিজ্ঞাপন ছিল! তখন বাথরুমে চৌবাচ্চা থাকতো! কেশববাবু সেই চৌবাচ্চার বারোটা বাজিয়ে রাখতেন! একটা পোষ্টকার্ডে গোটা পরিবার বিজয়ার প্রণাম সারতো! হাতের লেখা দেখে বয়স আন্দাজ করা যেতো! পোষ্টম্যানকে পাড়ায় পাড়ায় সবাই নাম ধরে চিনতো! এখন ক্যুরিয়ারওয়ালাদের কেউ চেনে না!
গরমকালে রাত্রে ছাদে বিছানা পাতা হতো! সার্কাসের তাঁবুর মতো মশারি টাঙানো হতো! অমবস্যার রাতে ঝিকিমিকি তারায় ভরা আকাশ! সপ্তর্ষি, কালপুরুষ, অরিওন, আরও কত কনস্টিলেশন! বাবা চিনিয়ে দিতো!
এই বিপুল মিল্কিওয়ের বাসিন্দা আমরা! এরকম নাকি আরও অসংখ্য গ্যালাক্সি আছে ওই অনন্ত মহাকাশে! ইনফিনিটির অসম্ভব কল্পনায় ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তো! হাতপাখা নিয়ে রাতভর মানুষটা হাওয়া করে যেতো! ক্লান্তিহীন! সুপারম্যান!
প্রযুক্তি অনেক কিছু পাল্টে দিয়েছে। এখন বাচ্চারা আর গ্ৰীষ্মের দুপুরে শাঁখের গুলি নিয়ে বেরোয় না! পুকুরের জলে খোলামকুচি ছোঁড়ার কম্পিটিশন করে না! ভোকাট্টা ঘুড়ির পেছনে লগি নিয়ে ছোটে না! গুবরে পোকা উলটে দিয়ে মজা দেখে না! ফড়িংয়ের পেছনে সুতো বেঁধে ওড়ায় না! দেশলাই বাক্সের টেলিফোন বানায় না! হাফ প্যাডেলে সাইকেল চালিয়ে বিশ্বজয়ে বেরোয় না!
বিনোদন এখন দাম দিয়ে কিনতে হয়!
তবুও একটা প্যারালাল জগৎ আছে আজও! যখন বাতানুকুল কাঁচের রেস্তোরাঁয়, কন্টিনেন্টাল খানা অর্ডার দিয়ে, শহুরে কপোত কপোতী নিউটাউনের কোনো গগনচুম্বী ইমারতে বাসা বাঁধার স্বপ্ন দেখছে, ঠিক তখনই হয়তো কোথাও কোনো গেঁয়ো রথের মেলায়, কালোকোলো একটা মেয়ে, চোখে একরাশ কৌতুক নিয়ে, হাতে নতুন কেনা কাঁচের চুড়ি পরে, পেল্লাই পাঁপড়ভাজা খাওয়ার বায়না ধরেছে তার পুরুষ সঙ্গীটির কাছে! পাশেই প্রকান্ড কড়াইতে বিজবিজ করে ফুটছে কালো তেল, তাতে পানসির মতো ভাসছে আলুর চপ! ট্রাইগ্লিসারাইডের জুজু নেই! টেবিল ম্যানারসের বালাই নেই! অবাধ স্বাধীনতায় ভেসে বেড়ানো দুটো প্রাণ!
জীবনের এই কনট্রাস্টগুলো বড্ড কাব্যিক! মায়াময়!
সেই বিদেশী রেস্তোরাঁ, রথের মেলা, পোর্সেলিন বাটিতে চিকেন স্যুপ, শালপাতায় ঘুগনি, ফিসফিসিয়ে বাক্যালাপ, উদ্দাম হাসি, আর্মানি পারফিউম, ঘামের গন্ধ, বেটোভেনের সিম্ফনি, কীর্তনের উচ্ছ্বাস, আইফোন আর দশটাকার হাত-আয়না, হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরের কালপুরুষের কাছে সব মিলেমিশে একাকার!!
……০……