Home / কিশোর গল্প / গদাইয়ের শরীরচর্চা – নূপুর রায়চৌধুরী

গদাইয়ের শরীরচর্চা – নূপুর রায়চৌধুরী

গদাইয়ের শরীরচর্চা
শিল্পী – পুণ্যতোয়া ধর

 

দশ বছরের গদাইয়ের প্রাণ-ভোমরা একটা রুপোলি রঙের বাহারি ধাতব বাক্স। বাক্সটা প্রায় সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি চওড়া, ইঞ্চি তিনেক উঁচু, আর এক ইঞ্চির কাছাকাছি গভীর। যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, এক মুহূর্তের জন্যও বাক্সটা কাছছাড়া করে না সে। তোমরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে ফেলেছ: ওই বাক্সটা আসলে কী? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ, ওটা একটা নিন্টেন্ডো থ্রি ডি এস মডেলের ভিডিও গেম। গতবার জন্মদিনে ওর ছোট মাসিমণি প্রিয়া ওটা ওকে উপহার দিয়েছিল। সেটা পেয়ে গদাই তো আনন্দে আত্মহারা হলো কিন্তু, বাড়িতে সেই থেকে অশান্তির শুরু! গদাইয়ের মা, পরী দেবী, সময় সময়ই রেগে টং হয়ে-চিৎকার করেন ‘’কখন থেকে ডেকে ডেকে হদ্দ হয়ে গেলাম, তবু যদি নবাব পুত্তুরের সাড়াটি মেলে! সহ্য করতে পারি না এইসব নষ্টামো, একদিন দেব ফেলে ছুঁড়ে, ওই আপদটাকে সোজা আস্তাকুঁড়েয়, তখন মজাটা টের পাবি’’!

তা ওনাকেই বা দোষ দিই কী করে? নাওয়া নেই খাওয়া নেই, যখনই দেখো, গদাইয়ের হাতে ধরা সেই ভিডিও গেম আর তার মধ্যেই এঁটুলির মতো সাঁটা তার চোখদুটো। মায়ের শত চেঁচামেচিতেও কোনো হুঁশ হয় না, নিন্টেন্ডো থেকে বারেকের জন্যও চোখ তুলে তাকাবার ফুরসৎ মেলে না তার| শেষমেশ দাঁত কিড়মিড়িয়ে পরী দেবী ঘোষণা করেন, আসুক তোমার বাবা, আজ হচ্ছে তোমার!

গদাইয়ের বাবা হারিনবাবু হাইকোর্টের ঝানু উকিল, খাসা মাথা, ক্ষুরধার বুদ্ধি, যে কেসে আঙুল ছোঁয়ান জয় অনিবার্য, টাকাপয়সার যাকে বলে দেদার বাড়বাড়ন্ত। কিন্তু এত সব তো ফুসমন্তরে হয় না, প্রচুর খাটাখাটুনি আছে- ভালো করে গল্প সাজানো, আইনের মারপ্যাঁচ খুঁজেপেতে বের করে জায়গামতো সেগুলোকে ভেড়ানো, উপযুক্ত সাক্ষীসাবুদ জোগাড় করা– হ্যাপা তো মেলা; কোনোটাই ছেলেখেলা নয়! অগত্যা রাতদিনই তাঁর শুধু কাজ আর কাজ। সোম থেকে শুক্র তিনি কোর্টে বসেন, আর শনিবার? সেদিন বসেন নিজস্ব চেম্বারে। সকাল আটটায় তাঁর চেম্বার খোলার কথা কিন্তু আঁধার রাত থাকতেই মক্কেলরা হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে সেখানে। তা উপায়ই বা কী? আসে তো সব কোন দূর দূরান্তের মুলুক  থেকে; আটটা বাজতে না বাজতেই তাদের উসখুসানি শুরু হয়ে যায়, অগত্যা উকিলবাবুকেও ঘড়ি ধরে উপস্থিত হতে হয় বৈকি, দেরি হবার এক ফোঁটা জো নেই। তারপর দিনভর তো শুধু আইনের কচকচি, নিশ্বাস ফেলার সময়টুকুও মেলা ভার | ফিরতে ফিরতেও অনেক রাত হয়ে যায়, তখন না থাকে শরীরের তাকত, না থাকে মনের প্রশান্তি; আর বাচ্চারাও ততক্ষণে ঘুমিয়ে কাদা। এখন হাতে পড়ে রইল রবিবার; তা ঐদিন তিনি পরিবারের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটানোর চেষ্টা করেন, খাওয়ার টেবিলে সকলে মিলে গোল হয়ে বসে, খানাপিনা, হাসিআহ্লাদ, গল্পগুজব বেশ চলে।

এমনিতে হারিনবাবু মানুষটা বেশ ঠান্ডা, কিন্তু, রাগলে একেবারে অগ্নিশর্মা। পরী দেবী তাই সংসারের দৈনন্দিন ঝক্কিঝামেলা নিজেই পোহান, সহজে কর্তার কানে সেসব তোলেন না, সংসারের শান্তিটা তো বজায় রাখতে হবে, না কি! কিন্তু, আজ সকালে জলখাবারের টেবিলে গদাইকে দেখতে না পেয়ে কর্তামশাই যেই না সেই কথা গিন্নিকে জিজ্ঞাসা করেছেন, অমনি তিনি ঝামটা মেরে বলে উঠলেন ‘’হুঁ, তার কি আর সময় আছে, মস্ত বড়ো খেলোয়াড় তো, নাকে মুখে যা হোক একটু গুঁজেই ‘’দে চম্পট’’! দেখো গিয়ে এতক্ষণে সেই খেলাতেই হয়তো আবার বুঁদ হয়ে গেছে!”

হারিনবাবু গভীর অধ্যবসায়ের সঙ্গে তাঁর সামনের চিনামাটির প্লেটে সাজানো ফুলকো লুচির একটুকরো ছিঁড়ে আলু ফুলকপির ঝোলঝোল বাটি চচ্চড়িতে সেটাকে সযত্নে ডুবাতে যাচ্ছিলেন, গিন্নির গলায় অভিযোগের সুর শুনেই একটু থেমে গেলেন, বুড়ো আঙুল, তর্জনী আর মধ্যমার ত্র্যহস্পর্শে, কায়দা করে ধরে রাখা লুচির টুকরোটা শূন্যেই থেমে থাকল, তাঁর মোটা লোমশ ভুরু কুঁচকে গেল, তিনি গিন্নিকে জিজ্ঞেস করলেন, খেলাধুলা? তা সে তো চমৎকার জিনিস! এতে আবার সমস্যা কিসের? আমি তো পইপই করে সে কথাই বলে আসছি তোমায় কবে থেকে, যাক, এত দিনে সে কথা কানে তুললে তাহলে! তা, এই সক্কাল সক্কাল মহারাজ গেল কোথায়? কোনো ম্যাচ আছে না কি? কোন মাঠে?”

“না, না এ সে খেলা নয়, এ হলো ভিডিও গেম, ওই যে ওর জন্মদিনে ছোট যেটা উপহার দিল না? সেই সেটা -নিন্টেন্ডো না কিসব ছাই যেন, তখন কত বললুম, দিস না, দিস না ছোট, ওসব অলুক্ষণে জিনিস দিস না, তা কে শোনে কার কথা”— নিজের মনে গজগজ করতে করতে হারিনবাবু’র প্রিয় শালীর দিকে দোষটা ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করেন পরী দেবী, একটু আগের বেফাঁস কথাটা ধামাচাপা দেওয়া দরকার। সপ্তাহের একটা মাত্র ছুটির দিন, কর্তার মেজাজ না আবার বিগড়ে যায়! জয় মা তারা, ঘরের শান্তি রক্ষা কোরো মা!

কিন্তু ভবি ভোলবার নয়কো মোটেই, অ্যায়সা রাগ হলো হারিনবাবুর কথাটা শুনে, হুঁ, বলে নাক দিয়ে ফোঁত করে একটা নিশ্বাস ছাড়লেন তিনি প্রথমে, ঠোঁটটা খানিক চেপে রাখলেন আর তারপরই তাঁর গলা দিয়ে বজ্রগম্ভীর একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল গদ—আ–আ –ই-ই-ই!

ওদের কাজের লোক আন্নামাসি তখন জম্পেশ করে বেলা একটা লুচি, সবে গরম ঘিয়ে ছাড়বার উপক্রম করছিল, কর্তামশাইয়ের পিলে চমকানো চিৎকারে তার হাত কেঁপেমেপে একশা হয়ে গেল, লুচিটুচি সব মাথায় রইল, সে তড়িঘড়ি এসে খাবার ঘরের দোরগোড়ায় সটান হাজির হলো, জানে এইবার তার ডাক পড়বে, তা হলো’ও তাই। গদাইয়ের মা আন্না’র দিকে তাকিয়ে চোখ’টা একটু টিপে দিলেন, আর সে পড়ি  কি মরি করে একটা দৌড় দিল গদাইয়ের ঘরের দিকে, ছেলেটাকে কর্তার সামনে এখুনি না হাজির করতে পারলে, ঘরে এক্কেবারে প্রলয়কান্ড ঘটে যাবে, না, না, রোববারের দিনে ওসব অশান্তি মোটেই ভালো নয়। ‘’দাদাভাই ত্বরা করে খাবার ঘরে যাও, কত্তাবাবু ডাকতেছেন তোমারে’’ … আন্না হাঁপাতে হাঁপাতে বলে। মাসির মুখের ভাব দেখেই গদাই যা বুঝবার বুঝে নেয়, ভিডিও গেমটা চট করে টেবিলের দরাজের গোপন গভীর অন্দরমহলে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয় সে, তারপর গুটি গুটি পায়ে এসে হাজির হয়, বাবার সামনে।

গদাইয়ের মাথা থেকে পা অবধি ভালো করে একবার দেখলেন হারিনবাবু, ছেলের চেহারাটা দেখেই তিনি কেমন বোম হয়ে গেলেন, মাত্র তো দশ বছর বয়স, কিন্তু চেহারা দেখ, যেন ছোটোখাটো একটা সুমো লড়িয়ে! কৈ, আগের রবিবার তো এতটা চোখে লাগেনি, এ কি সপ্তাহে সপ্তাহে প্রস্থে বাড়ছে না কি?

চট করে নিজের ওই বয়সের ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠল হারিনবাবুর। কৈ, তিনি তো এমন ছিলেন বলে মনে পড়ে না, বেশ রোগাপাতলাই তো ছিলেন-আর শুধু তিনি কেন? তাঁর সঙ্গীসাথী-কালু. ভোম্বল, নরেন, নিধু সকলেরই ওরকম দোহারা গড়ন ছিল। তাঁরা কি আর খেতে পেতেন না? না কি আদর যত্নের কিছু কমতি ছিল? মধ্যবিত্ত পরিবারে যেমন জোটে সেরকমই ভাত ডাল তরিতরকারি, মাছ, এসব খেয়েই বড়ো হয়েছেন; অথচ গদাইয়ের এমন আলুভাতে মার্কা হোঁতকা চেহারা এই বয়সে— নাহ, আর ভাবা যাচ্ছে না! গিন্নির উপর প্রচন্ড রাগ হতে লাগল, খাওয়াও, আরও ঠেসে ঠেসে পরাণের নিধি’কে চিপস, কোল্ড ড্রিংক, পিৎজা খাওয়াও! অবশ্য আরেকটা বিশাল পার্থক্যও ছিল, দেদার খেলতেন তাঁরা, বিকেলে স্কুল থেকে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই বল নিয়ে সোজা ছুটতেন নন্দীদের বারোয়ারি মাঠে; আর সে উস্তম-খুস্তম খেলা শেষ হতো সন্ধ্যেটি পার করে, যখন বাড়ির লোকেরা সোজা মাঠে এসে চড়াও হতো। খেলতে খেলতে ওঁরা একেবারে ঘেমেনেয়ে একশা হতেন, হৃদপিন্ডটা যেন হাঁপর টানত; আর ওতেই শরীর হয়ে উঠত টানটান- যেন ছিলা পড়ানো ধনুক! নাহ, বড়ো ভুল হয়ে গেছে, এতদিন চোখ বুজে বসে ছিলেন, ছেলেটার শরীরচর্চার ভার এবার নিজের হাতেই নিতে হচ্ছে, আর এক মুহূর্তও দেরি করা চলবে না। মাথার মধ্যে উথলে ওঠা রাগটাকে অনেক কষ্টে চেপে ধরে বসিয়ে দিলেন তিনি, এখন মাথা গরম করলে কাজ হবে না, আর ছেলেকে বকাঝকা করলে ওদিকে রান্নাঘর থেকে আবার দয়ার অবতার গিন্নি ছেলের হয়ে সালিশি করতে ছুটে আসবেন, আর তাহলেই সব পরিকল্পনার মাথায় বাড়ি, খুব কায়দা করে সবকিছু করতে হবে, আজ থেকেই চালু করা যাক।

‘’এই গদাই, আজ আমার সাথে মিত্তিরদের আখড়ায় শরীরচর্চা করতে যাবি চল’’, মুখে একেবারে মধু ঢেলে কথাটা বললেন হারিনবাবু।

‘’না, ওসব ভালো লাগে না আমার, আমি এখন ভিডিও গেম খেলব’’, ঘাড় শক্ত করে উত্তর দিল গদাই।

শুনেই পিত্তি জ্বলে গেল হারিনবাবুর, মনে হলো ছেলের নড়া ধরে কষে ঝাঁকিয়ে দেন, কিন্তু, অতি কষ্টে সামলে নিলেন তিনি, সবাই তাঁকে দুঁদে উকিল বলে মান্যিগণ্যি করে, আর এই পুঁচকে ছোঁড়াকে তিনি বাগে আনতে পারবেন না? অসম্ভব!

‘’কোন গেমটা খেলছিস? নামটা বল, দেখি তোর পছন্দ কেমন’’?

অবাক চোখে তাকায় গদাই বাপের দিকে, ‘’তুমি তো জানোই না ওসব গেম, নাম শুনে কী করবে’’?

‘’কে বললে জানি না, মারিও, ডঙ্কি কং, ইয়োশি –কি ঠিক বলিনি’’? মৃদু হেসে, চোখ নাচিয়ে বলেন হারিনবাবু।

গদাইয়ের চোখ এখন এক্কেবারে ছানাবড়া, ‘’কোত্থেকে জানলে? নিশ্চয়ই বানিয়ে বানিয়ে বলছ সব’’, অবিশ্বাসের ছোঁয়া লেগে রয়েছে গদাইয়ের গলার স্বরে।

হাসলেন মনে মনে হারিনবাবু, খেলা শুরু হলো তাহলে! ‘’শোন গদাই, শুনলাম মোড়ের ওই ভিডিও গেমের দোকানে নাকি একটা নতুন গেম এসেছে, সুপার মারিও না কি যেন নাম, যাবি নাকি দেখে আসতে’’?

‘’কি দত্তকাকুর দোকানে? তুমি জানলে কী করে? কে বলল তোমায়’’?

‘’আরে, সে যেই বলুক, চল না গিয়ে নিজের চোখেই দেখে আসা যাবে’’।

গদাই, এবার সোৎসাহে বলে, ‘’হ্যাঁ হ্যাঁ’’, তারপর উত্তেজনায় হৈহৈ করে উঠে এক পা নেচেই নিল সে।

হারিনবাবু এবার প্যান্টের পকেট হাতড়াতে থাকেন, তারপর কোমরে হাত দিয়ে, ঠোঁট উল্টে বলেন, ‘’এই যাহ, মানি-ব্যাগটা মনে হয় উপরের বেডরুমেই রয়ে গেছে, একটু নিয়ে আসবি ওটা গদাই’’?

এক হাত মাথা হেলিয়ে, হ্যাঁ বলেই, দৌড়ে দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠে যায় গদাই বেডরুমের দিকে, আর একটু বাদে সেই ছুটে ছুটে এসেই বাবার হাতে ব্যাগটা দেয় সে।

বাবা একটু হেসে বলেন, ‘’দারুণ, বেটা, এবার গাড়ির চাবিটা, ওই ডাইনিং টেবিলের ওপরই রয়েছে, প্লিস, ওটাও একটু এনে দে বাবা’’!

গদাই দৌড়ে গিয়ে চাবিটাও এনে বাবার হাতে তুলে দিল।

‘’বাবা, এবার কি আমরা ওই গেমের দোকানটায় যেতে পারি’’?

ছেলের চোখেমুখের প্রত্যাশার তীব্র অভিব্যক্তি হারিনবাবুর চোখ এড়াল না জোর করে তিনি মন শক্ত করে নিলেন, ‘’গদাই, আমার কেন জানি না একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে, আমার চাদরটা পড়ার ঘরে রাখা আছে, ওটা ছাড়া যাওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না, তুই ওটা নিয়ে আসতে আসতে, আমি বরঞ্চ একটু গরম জল খেয়ে নিই, কি বল’’?

গদাইয়ের চলার গতিবেগ এখন অনেকটাই শ্লথ, একটু অসন্তোষের ভঙ্গিতেই সে এগিয়ে যায়, হারিনবাবু চোখের কোণ দিয়ে ছেলের চলে যাওয়াটা লক্ষ করতে করতে, মাথার চুলে আঙ্গুল চালিয়ে কী জানি ভেবে নেন।

ওদিকে বাবার পড়ার ঘরের সোফা, দেয়াল আলমারি, টেবিল, চেয়ার আঁতিপাঁতি করে খোঁজা হয়ে গেল গদাইয়ের, কিন্তু চাদরটা মিলল না নাহ, কোথায় যে রেখেছে বাবা ওটা, ধুস, ভালো লাগে না কিচ্ছু! খাটের তলাটাও একবার গুঁড়ি মেরে দেখে নেয় সে। হাঁসফাঁস করতে থাকে গদাই, কপালে তার বিনবিনে ঘাম, জোরে জোরে শ্বাস নেয় সে | পা ঘষটাতে ঘষটাতে এঘরে ফিরে আসে গদাই, ‘’বাবা, ওইঘরে কোত্থাও নেই তোমার চাদর’’, বিরস মুখে জানায় সে।

‘’এহ, এবার মনে পড়েছে, ওটা মনে হয় তরুণদের ফ্ল্যাটে গতকাল ফেলে এসেছি, একটু যা না খোকা, ওটা নিয়ে এলেই আমরা ঝটপট রওয়ানা হতে পারি’’।

‘’তরুণদের ফ্ল্যাট? সে তো সেই পাঁচ তলায়’’! প্রায় কঁকিয়ে উঠল গদাই ।

‘’হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে’’?

‘’আমি অত উঠতে পারব না, ঘাড় গোঁজ করে বলে গদাই’’, তার গলায় রীতিমতো কান্নার সুর ।

‘’সে কী! মাত্র তো পাঁচ তলা, তুই ছেলেমানুষ, লাফিয়ে লাফিয়েই ঠিক উঠে যাবি’’!

গদাই তবু কোনো সাড়া দেয় না, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, নড়বার কোনো নামগন্ধও করে না ।

নাহ, আরেকটু খেলাতেই হবে, ভাবেন হারিনবাবু ।

‘’গদাই, ভিডিওগেমের দোকানে জিনিসপত্র ঝাড়পোঁছ করে যে লম্বা মতো ছেলেটা সে বলছিল’’,

‘’কে পিন্টুদা’’? এবার গদাই মুখটা তোলে, চোখে একটু কৌতূহলের ঝিলিক, ‘’কী বলছিল পিন্টুদা’’?

ওই বলছিল যে, ‘’ওরা একটা বাই ওয়ান গেট ওয়ান গেম ক্যাসেটও অফার দিচ্ছে ওই নতুন গেমটার জন্য’’।

‘’উরে ব্বাস, কী মজা’’! হাত তালি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে গদাই, একটু আগের গোমড়ানো ভাবটা উধাও হয়ে মুখে একটা ঝিকমিকে হাসি শোভা পাচ্ছে ।

‘’তাহলে? চাদরটা ছাড়া যাই কী করে এখন’’? মরা মাছের মতো চোখ করে বলেন হারিনবাবু ।

বাবার মুখের দিকে একবার তাকায় গদাই, নাহ, সেখানে কোনো ছাড়াছাড়ির ব্যাপারই নেই, যেতেই হচ্ছে তাহলে তরুণদের ফ্ল্যাটে ।

তরুণদের ফ্ল্যাটে যাওয়ার জন্য এবার সদর দরজার দিকে গুটি গুটি এগোয় গদাই, একটু আগের হাসিটা মুছে গেছে ওর চোখ থেকে । প্রায় পঁচিশ মিনিট বাদে ক্লান্ত পায়ে প্রায় ধুঁকতে ধুঁকতে ফিরে আসে সে ।

‘’কি রে পেলি ওটা’’?

কোনোরকমে মাথাটা ঈষৎ নেড়ে না জানায় গদাই ।

ছেলের নিরাশ মুখটার দিকে তাকিয়ে ভারী মায়া হয় হারিনবাবুর, বলেন, ‘’ওখানেও পেলি না? তাহলে মনে হয় ঘরেই কোথাও লুকিয়ে আছে ওটা, যাক গিয়ে, চাদরে কাজ নেই, আমি বরং জ্যাকেটটা নিয়েই বের হই’’।

বাবার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে, পিছু ফিরে নিজের পড়ার ঘরের দিকে থপথপিয়ে এগোয় গদাই ।

হারিনবাবু ডাক দেন, ‘’কী হলো, ওদিকে যাচ্ছিস কোথায়? ভিডিও গেমের দোকানটাতে যাবি না? এখন তো সব তৈরি’’ ।

‘’নাঃ, আমার পায়ে খুব ব্যথা করছে, আমি আর এক ফোঁটাও দাঁড়াতে পারছি না, চাই না, চাই না আমার ভিডিও গেম’’ ।

‘’সে কী? এ যে ভূতের মুখে রামনাম, বুঝেছি, শরীরচর্চা একদিনে খুব বেশি হয়ে গেল বুঝি? ফিকফিক করে হেসে ওঠেন হারিনবাবু ।

এবার আর বুঝতে দেরি হয় না গদাইয়ের । বেদম জোরে জোরে মেঝেতে খানিক পা দাপায় সে, তারপর কান্নাভরা চোখে ‘’ঠকিয়েছ, তুমি আমায় ঠকিয়েছ’’, বলে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে, রান্নাঘরের দিকে ছুট্টে পালায়!

 

…….o……

 

Leave a comment

Check Also

 ছেঁড়া রামধনু – মৌসুমী পাত্র

আমার মা বেজায় দুষ্টু হয়েছে আজকাল। একটা কথাও শুনতে চায় না। এই তো পরশুদিন, বললাম, …

chitrogupter-computer-mp

চিত্রগুপ্তের কম্পিউটার- মৌসুমী পাত্র

“যত্ত সব আদ্যিকালের জিনিস নিয়ে কাজকারবার! আর পারা যায় না বাপু!”, নিজের মনেই গজগজ করতে …

শিল্পী- গুঞ্জা

ফুল-পাখি কথা – মৌসুমী পাত্র

সে ছিল এক গভীর বন। আর সেই বনের ঠিক মধ্যিখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় ছিল এক …

রসেবশে রামায়ণ- মৌসুমী পাত্র

রামায়ণের গল্প আমরা সবাই জানি। কিন্তু গল্পেরও কিছু ভেতরকার কথা থাকে। যাকে বলে, পেটের কথা। …