Home / অনান্য / বাংলা ভাষা উচ্চারিত (না) হলে- মৌসুমী পাত্র

বাংলা ভাষা উচ্চারিত (না) হলে- মৌসুমী পাত্র

 

 

কিচ্ছু হবে না! বিশ্বাস করুন কিচ্ছু হবে না!

বাংলা ভাষা উচ্চারিত না হলে কিচ্ছু যায় আসে না। হ্যাঁ, বুদ্ধিবাগীশরা চশমা চোখে এঁটে প্রশ্ন তুলতেই পারেন- অ্যাঁ, সে কী কথা? তাহলে আমাদের বচ্ছরকার বইমেলার কী হবে? ওই যে বাগিয়ে ক্যামেরা দাপিয়ে সেলফি কিংবা ভালোমন্দ ইত্যাদি সাঁটিয়ে ফেসবুকে দমাদ্দম ছবি সাঁটানো- আম্মো বইমেলা গেছি, তার কী হবে? (জেলার বইমেলার কথা এখানে বাদই রাখা হচ্ছে, কারণ ‘জেলা’য় বসবাস করার সুবাদে তার ‘বাঙালি’ত্ব কিছুটা হলেও ‘এ মা ছি ছি, বাংলা মিডিয়াম’ গোছের!)

বাংলা ভাষাও ইদানীং একটি নিখাদ চচ্চড়ি ভাষার বেশি কিছু বলে তো বোধও হয় না! সাধারণ  যে কোন বাংলা বাক্য – ধরে যদিও নেওয়া যায় যে বাক্যটি বাংলাই- বক্তা এবং উদ্দিষ্ট দুজনেই বাঙালি- তবুও সেই বাক্যে এক বা একাধিক বিশুদ্ধ ইংরেজি শব্দ (এবং কখনো সখনো বা হিন্দিও) থাকবে না, তা কি হয় নাকি হতে পারে?

বসতবাটি খালি করে গাঁ ঘরের লোক শহর চলে গেছে, এখন সে বসতবাটি থাকলেই কি আর গেলেই কি? মাঝে মধ্যে খালি হাত-পা ছড়িয়ে ‘আহা রে! আমার সাতপুরুষের ভিটে’ বলে বিলাপ করার মধ্যে যে সার্থকতা- বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও এখন তাই দশা!

আছেই বা কী বলুন ভাষাটার? কিছু শৌখিন লিখিয়ে, তাঁরা কলম কিংবা মাউস পিষে মাঝেমাঝে বাকতাল্লা মারছেন, আলোচনাসভায় বিদগ্ধ জনের মধ্যে বাংলাভাষার প্রায়-মৃত দেহ নিয়ে হাফ ডজন বাঙালি ডাক্তার থুড়ি, বিদ্দ্বজনেদের শব-ব্যবচ্ছেদ চলছে নিত্য নিয়মিত! মরা হাতির দাম লাখ কেন, কোটিতেও ঠেকতে পারে- কিন্তু হাতির তাতে কী?

যেকোন চলিষ্ণু সবল ভাষারই দুটো দিক থাকে- এক, তার ব্যবহারযোগ্য দিক আর দুই, তার লিখিত ক্ষেত্র। ব্যবহারযোগ্য দিক মানে মানুষের মুখ-চলতি ভাষা। সাধারণ মানুষ- দোকানদার, ব্যবসায়ী, রাজমিস্ত্রি, মাছওয়ালা, সবজিওয়ালা, রাস্তাঘাট বাজারের তাবৎ জনগণ – সবার মুখে মুখে যে ভাষা চালু থাকে, যে ভাষা নিত্য পরিবর্তনশীল, যে ভাষার সঙ্গে সমাজ ও জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, সে ভাষাই চলমান ভাষা! এ ভাষার উচ্চারণ বদলায়, বাক্যবিন্যাস শব্দবন্ধ বদলায়, শব্দের প্রয়োগ বদলায়, এমনকি শব্দের মানেও বদলে যায়!

এখানেও মজার বিষয় আছে। সবাই তো আর সাধারণ হন না- পাতি এলেবেলে ইতর মানুষজনের প্রতি অসীম অনুকম্পাওয়ালা ‘অসাধারণ’ মানুষজনও থাকেন, যাঁরা ভাষাটাকে নিয়ন্ত্রিত করে থাকেন, তাঁদের ভাষার পরিবর্তন কিঞ্চিৎ অন্য ধরনের। সে কথায় পরে আসছি।

আপাততঃ যেটা বলার ভাষার লিখিত দিক দিয়ে। বাংলা ভাষায় লেখালিখি হচ্ছে না, উৎকৃষ্ট পত্রিকা বা বই প্রকাশ পাচ্ছে না- এরকম অপবাদ বোধহয় অতি বড়ো শত্রুতেও দিতে পারবে না! কিন্তু কথা হচ্ছে লেখে বই, পড়ে কে?

এ কথায় অনেকেই হয়তো হাঁই হাঁই করে তেড়েই আসবেন, অ্যাঁ, সে কী কথা? বললেই হল? বাংলা বইয়ের বিক্রি গতবছর এই এত ছিল, এবছর এত… ইত্যাদি ইত্যাদি…। কিংবা-  জানেন, ইউনেস্কো বাংলা ভাষাকে বিশ্বের মধুরতম ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে, বাংলা ভাষা গোল্লায় গিয়েছে বললেই হল আর কী?

কথাটা হচ্ছে, পরিসংখ্যান দিয়ে সবসময় সব কিছুর বিচার হয় না। এই কারণেই হয়না যে পরিসংখ্যানের আড়ালে লুকিয়ে থাকে অন্য পরিসংখ্যান, কোন সমীক্ষার আওতায় যাকে ধরা ছোঁওয়ার চেষ্টা করা হয় না কোন কালেই।

শহরাঞ্চলে যেখানেই তিন-চারটি বাচ্চা একত্রিত হয়ে খেলাধূলা করছে, তাদের মুখের ভাষা শুনুন, যেখানে কলেজের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছে তাদের মুখের ভাষা শুনুন, শপিং মলে, দামী রেস্টুরেন্টে, পার্লারে যাওয়া বাঙালির মুখের ভাষা শুনুন! পরিবর্তনটা নিজেই বুঝতে পারবেন।

এই যে বাঙালি, যার কিনা একই অঙ্গে অহংবোধ এবং হীনম্মন্যতাবোধ প্রবল দ্বৈতসত্তা নিয়ে সদা বিরাজমান- সমস্যা তাদেরই। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ করে গলা ফাটানোর বেলায় তার এই অহংবোধ কাজ করে। কিন্তু উল্টোদিকে উচ্চকোটির ‘পশ’ শপিং অঞ্চলে গিয়ে কিংবা অত্যাধুনিক কেতাসম্পন্ন রেস্তোঁরায় গিয়ে বুক ঠুকে বাংলা বলে ‘আর একটু মুরগির মাংস হবে?’ বলতে তার কালঘাম ছুটে যাবে! কারণ চিকেনের বদলে মুরগির মাংস, মাটনের বদলে খাসি, ব্রেডের পরিবর্তে পাঁউরুটি- এসব নব্য বাঙালির ‘উন্নাসিক’ অভিধানে ট্যাবুসম!

‘অসাধারণ’ বাঙালি মোটামুটি এঁদেরই সমগোত্রীয়। তাঁরা উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত। বছরে দু-বার ধুমধাম সহকারে তাঁরা ‘ইন্ডিপেনডেন্স ডে’ এবং ‘রিপাবলিক ডে’ পালন করে থাকেন। এবং বছরের বাকি দিনগুলিতে তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলা বাক্যে যথেচ্ছ ইংরেজি শব্দের প্রয়োগ করে তার প্রায়শ্চিত্ত করে থাকেন। এবং মাঝেমধ্যেই তাঁদের এই ‘শ্যাবি বেংগলি’ নিয়ে খেদোক্তি প্রকাশ করতেও শোনা যায়! হ্যাঁ, এই প্রাণীগোষ্ঠীর মধ্যে অভিনেতা-অভিনেত্রী নামক জীবেদেরও দূরদর্শনের পর্দায় মখমলি উপস্থিতি জনসাধারণকে প্রভূত প্রেরণা দিয়ে থাকে! এবং তাঁদের বাক্যচ্ছটার অপরূপ ইংরেজি-হিন্দির যুগলবন্দীর মধ্যে বাংলা একটি-দুটি শব্দের সকাতর উপস্থিতি ‘কাবাব মে হাড্ডি’র মত নিতান্তই বেমানান লাগে!

এই প্রসঙ্গেই সংস্কৃতের কথা মনে পড়ে। লুপ্তপ্রায় কিন্তু বিলুপ্ত নয় ডোডোপাখির মত। আদ্যন্ত বিজ্ঞানের মতোই ধরাবাঁধা ছকে বাঁধা, এবং যে কারণে ব্যবহারিক জীবনে অচল। কিন্তু… যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা অসম্ভব নিষ্ঠাবান এবং দায়বদ্ধ ভাষাটির প্রতি। এবং সেটি পরিস্ফুট হয় তার বিভিন্ন পরিভাষার দিকে নজর দিলেই। খুব সম্ভবতঃ হেন কোন ইংরেজি শব্দ নেই যার কোন নিজস্ব সংস্কৃত পরিভাষা নেই। সে ‘কম্পিউটার’ই হোক, বা ‘মোবাইল’, অথবা ‘জগ’, ‘চেয়ার’, ‘রিফিল’ ইত্যাদির মতন শব্দ। এ নিয়ে বিতর্ক উঠতেই পারে যে বিদেশি  শব্দের প্রবেশে বাংলা শব্দভাণ্ডার নিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সে বিতর্কে আপাততঃ না গিয়েও যেটুকু বলা যায় যে বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দের উপযুক্ত পরিভাষা সৃজনে আমাদের বাংলার বুদ্ধিজীবীদের কেন জানিনা খুব উৎসাহ চোখে পড়ে না।

উচ্চশিক্ষায় বাংলাভাষায় উপযুক্ত পরিভাষা নিয়েও এই আক্ষেপ তাই থেকেই যায়! বড় একটা আশার আলো আপাততঃ চোখে দূরবীন লাগিয়েও দূর ত্রিসীমানাতেও দেখা যাচ্ছে না। বাংলা ভাষা, ভাষার ব্যবহার, বাংলা বানান- ইত্যাদি সব কিছু নিয়েই এক চরম ঔদাসীন্য এবং তাচ্ছিল্য আজ প্রায় সর্বজনীন। নির্ভুল বাংলা লেখা এখন প্রায় একরকম অপরাধের পর্যায়েই পর্যবসিত।

এই প্রসঙ্গেই একটি কাহিনী আজ মনে পড়ল। নিখাদ বাস্তব।  এক অধ্যাপক (ঘটনাচক্রে তিনি বাংলারই অধ্যাপক ছিলেন) গিয়েছিলেন দিল্লীতে কোন কাজে। এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত, খিদেও পেয়েছে চরম। কাছেই এক পুরি-সবজিওয়ালাকে চোখে পড়ল। লোকজন আসছে তার কাছে- ‘দো পুরি দিজিয়ে গা’, ‘পুরি কিতনে কা’ ইত্যাদি করেটরে দিব্যি পুরি কিনছে! ইনি বাঙালি মানুষ, হিন্দি বলায় মূলগত জড়তা। ইংরেজিতে পুরি চাইলেন। পুরি বিক্রেতা দিব্যি বুঝেছে তাঁর কথা, কিন্তু দেবে না। তাঁর কথায়- দিব্যি দেখছি লোকজন ফটাফট আসছে, হিন্দি বলে পুরি নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যেহেতু আমি ইংরেজি বলছি, সে আমাকে দেবে না। শেষকালে বাধ্য হয়েই লোকজনের দেখাদেখি ‘চার পুরি দিজিয়ে’ বলতে তবে গিয়ে পুরি মিলল!

বক্তব্য এটা নয় যে আমাদের বাংলাভাষী খদ্দের না মিললে খাবারদাবারের বিক্রিবাটা বন্ধের ব্যবস্থা করা, কিন্তু যেটা প্রতিপাদ্য সেটা হল এই যে অন্যান্য জাতির নিজেদের মাতৃভাষার প্রতি এই প্রবল অনুরাগের কাছে কোথাও গিয়ে মাথা নত করতেই হয়! মাতৃভাষার প্রতি একান্ত বীতরাগ বোধহয় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির পক্ষেই সম্ভব।

আর একটা কথা। বাংলাদেশের কথা কেউ এই প্রসঙ্গে অবতারণা করতেই পারেন। বাংলাদেশ থাকতে বাংলাভাষা সম্পর্কে ততটা দুর্ভাবনা না করলেও চলে! কথাটা খুব খাঁটি, কিন্তু বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে যখন বাস করি, আর তার বাইরে যাবার সম্ভাবনা যখন আর নেই বললেই চলে, তখন এপার বাংলায় বসে এপার বাংলার ‘কোমা’দশা নিয়ে দুশ্চিন্তা না হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক!

তবু আশা আজ সামান্য হলেও জেগেছিল। কাজের প্রয়োজনেই এক জায়গায় গিয়েছিলাম। অনেক মহিলা জড়ো হয়েছেন। সবাই প্রায় খেটে খাওয়া পরিবারের। কাজের কথার পরিসরেই উঠে আসে ছোট ছোট সুখদুঃখ। সে সব চলতে চলতেই এক মাঝবয়সী মহিলা বলে উঠলেন, “বাংলা ভাষায় কথা বলব, তায় আবার লজ্জা কিসের?”

মনে পড়ল আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। বেশ একটা আশার সঞ্চার হল। যাক, তাহলে সব অন্ততঃ ফুরিয়ে যায়নি। খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্যে টিকেই যাবে বাংলা ভাষা।

তারপরে গেলাম আরেক জায়গায়। এখানেও সেই নিম্নবিত্তের মহিলারা। কাজের কথার শেষ পর্যায়ে এক অতি অল্পবয়সী মহিলাকে নিয়ে এলেন তাঁরা। মেয়েটির স্বামী মারা গেছেন আজ পাঁচ দিন। সেসব নিয়ে নানান আলোচনা চলছিল। কিভাবে তাঁকে সুবিধা দেওয়া যেতে পারে এইসব। একজন প্রায় লেখাপড়া না জানা মহিলা বলে উঠলেন, “ওর কণ্ডিশন খুব খারাপ।” পাশ থেকে অন্যরা সবাই সমস্বরে বললেন, “ওকেও কিন্তু স্ট্রং হতে হবে।”

মেয়েটির দৈন্যদশা সাময়িক, এটা জানি। কারণ তাঁর সমস্যার নিরসনের চেষ্টা চলছে। হয়েও যাবে আশা করি।

কিন্তু বাংলা ভাষার যে দৈন্যদশা, সেই শ্মশানযাত্রা রুধিবে কে?

আশার খুব কিছু দেখি না। একটাই চেষ্টা বরং করা যেতে পারে। আসুন, সকলে মিলে মহা সমারোহে ‘ডিজাইনার’ চিতা সাজাই বরং!

আর কিছু না হোক, শেষযাত্রাটা তো সাড়ম্বর অশ্রুসজল হবে!

 

……০……

Leave a comment

Check Also

করোনা সিরিজ ৯

করোনা সিরিজ ৯- সোমক সেনগুপ্ত

  ( ভয়ঙ্কর এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি আমরা। মহামারী করোনা যেন গিলে নিতে চাইছে আমাদের সভ্যতা, …

করোনা সিরিজ ৮

করোনা সিরিজ ৮- সোমক সেনগুপ্ত

        ( ভয়ঙ্কর এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি আমরা। মহামারী করোনা যেন গিলে নিতে …

করোনা সিরিজ ৮- সোমক সেনগুপ্ত

করোনা সিরিজ ৭- সোমক সেনগুপ্ত

  ( ভয়ঙ্কর এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি আমরা। মহামারী করোনা যেন গিলে নিতে চাইছে আমাদের সভ্যতা, …

করোনা সিরিজ ৬/ শিল্পী- সোমক সেনগুপ্ত

করোনা সিরিজ ৬ – সোমক সেনগুপ্ত

    ( ভয়ঙ্কর এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি আমরা। মহামারী করোনা যেন গিলে নিতে চাইছে আমাদের …