আলোটা এবারে দপ করে নিভে গেল।
-যাহ!
ওর মুখ দিয়ে শব্দটা প্রতিবর্তক্রিয়ার মতন-ই বেরিয়ে এল। এতক্ষণ তাও ভোল্টেজের ওঠাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর বাইরের বৃষ্টির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আলোটা জ্বলছিল, নিভছিল। কিন্তু এখন সূচীভেদ্য অন্ধকার। আর সেই অন্ধকার ভেদ করে ভেসে আসছে শিল পড়ার শব্দ। ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির সঙ্গে সুর মিলিয়ে ছাদের উপরে মাঝে মাঝেই বীভৎস শব্দে ছোট-বড় শিল পড়ছে।
ঢপ!
চমকে উঠল ও। নির্ঘাত বড় একটা শিল পড়েছে ছাদে। কিন্তু………।
কিন্তু এটা তো টিনের চালে শিল পড়লে যে শব্দ হয়, তার মতন মনে হল। আর ও তো আছে একটা পাথরের বাড়িতে যার ছাদটা পাকা। ছাদ শুধু পাকা নয়, তির্যকাকৃতির। ফলে শিল পড়লে পিছলে বেরিয়ে যাবে। অথচ এই শব্দটা শুনে মনে হল যে ওর মাথার ঠিক উপরেই টিনের ছাদে বড় একটা শিল এসে পড়ল।
কী করে হয়?
টপ-টপ করে খানিকটা জল গায়ে এসে পড়াতে সম্বিত ফিরল ওর। আবারও চমকে উঠল ও। আছে তো দোতলায়। পুরানো পাহাড়ি স্থাপত্যের এই বাড়িটা চারতলা। তবে বিকেল অবধি সব ঠিক ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার পরে হঠাৎ করে ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে।
আর তাতেই এই অবস্থা? এই সামান্য বৃষ্টিতেই ছাদ আর তিনতলা, চারতলার মেঝে সব ফুটিফাটা হয়ে গেছে?
অথচ প্রথমে দেখে তো মনে হয়নি। বেশ শক্ত-পোক্তই মনে হয়েছিল বাড়িটা।
গ্রাউ…ম!
বীভৎস শব্দে ঘর লাগোয়া বাথরুমের দরজাটা এলোমেলো হাওয়ার দাপটে খুলে গিয়েই বন্ধ হয়ে গেল। কেমন বিশ্রী, বাজে আওয়াজটা! এটাও কি ও বন্ধ করেনি?
কিন্তু কিন্তু করছিল মনটা। কোনরকমে কম্বল ছেড়ে উঠে অন্ধকার ভেঙে হাতড়ে হাতড়ে বাথরুমের কাছে পৌঁছে দরজাটা ভাল করে বন্ধ করে সবে বিছানায় আবার উঠতে যাবে, এমন সময় ঠক ঠক করে দরজার শব্দে ও চমকে উঠল। কে হতে পারে?
কে? সে কি?
তাহলে……! ও কী করবে?
-সাহেব, দরজাটা খুলুন।
প্রাণ ফিরে পেল ও। চৌকিদার নারদমণির গলা।
ও ফিরে এল বাস্তবের পৃথিবীতে। তাহলে ভয় নেই। এই পরিস্থিতি বেশিক্ষণ চললে ওকে আর দেখতে হত না। খানিক আশ্বস্ত হয়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলল ও। একটা হ্যারিকেন হাতে নিয়ে আলো-আবছা অন্ধকারে নারদমণি দাঁড়িয়ে।
-সাহেব, নারদমণি বলল, -এই আলোটা রাখুন। আমি এবারে বেরোব।
-মানে?
-আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কুলবাহাদুর এসে যাবে।
মানে অন্য চৌকিদার লোকটি। কিন্তু ততক্ষণ কি ওকে একলা থাকতে হবে? প্রশ্নটা করেই বসল ও।
-আমার ডিউটি শেষ। ঝড়-বৃষ্টির জন্য কুল বাহাদুর দাজুর আসতে দেরী হচ্ছে।
ওকে আশ্বস্ত করে বলল সে,
-চলে আসবে এবারে। আপনি নিচে নেমে বরং দরজাটা লাগিয়ে নিন।
বারান্দা থেকে নেমে বৃষ্টি-কুয়াশার মধ্যে নারদমণির মিলিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে দরজা বন্ধ করে সবে দোতলার সিঁড়িতে পা রেখেছে ও, এমন সময় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ে চারিদিকটা আলোকিত হয়ে উঠল।
আর চমকে উঠল ও!
সে না দাঁড়িয়ে ওখানে? সে কি? ওকে কি ডাকছে?
আরে না, ওটা তো ভেনাসের মূর্তিটা। মনে হয় কোথা থেকে হাওয়া এসে খানিকটা নাড়িয়ে দিয়েছে ওটাকে। ভাগ্যে ওটা পড়ে যায় নি। তাহলে………।
তবে আর বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়ানো ঠিক হবে না।
মিয়াঁও!
পায়ের কাছে শব্দটা আসতে চমকে উঠল ও। আলো-অন্ধকারে তাকিয়ে দেখল একটা সাদাটে রঙের বিড়াল কোথা থেকে এসে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার উপক্রম করছে। সেদিনও এইরকমই একটা কোথা থেকে যেন চলে এসেছিল।
আরে, আরে, বিড়ালটা হঠাৎ কোথায় থেকে এল?
ভীষণ অবাক হয়ে গেল ও। সেদিনও আচম্বিতে এসে জুড়ে বসেছিল। অথচ মাঝে এ’কদিন তো দেখা পায় নি।
তবে কি কোন অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্ভাবনা সে জানিয়ে গেল? সেদিনের মতন?
আরে যা! তা হবে কেন? কোথা থেকে ঢুকে গেছে এটা। তবে ওর এখন ঘরে চলে যাওয়াই ভাল!
ভাবতে ভাবতে ও দ্রুত পায়ে ঘরের দিকে এগিয়ে এল। ঘরে এসে খানিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও। না, ভাল করে ও নজর করেছে। বিড়ালটা এদিকে আসেনি। শক্ত করে দরজাটা লাগাল ও।
নাহ, বিড়ালটা আর আসে নি।
নিশ্চিত হয়ে আলোটা একদিকে রেখে ও সবে খাটে উঠে কম্বলের নিচে ঢুকেছে, এমন সময়-
-ঠক। ঠক। ঠক।
দরজায় ধাক্কার শব্দে চমকে উঠল ও। এইমাত্র নিচে দরজা দিয়ে এল!
তাহলে? কে হতে পারে?
উত্তরটা ও জানত বলেই ভেবেছিল। একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
-কে?
উত্তরটা শুনে ও নিশ্চিত হয়ে গেল! কিন্তু এভাবে ও প্রস্তুত ছিল না তার মোকাবিলা করার জন্য।
-আমি সে, যাকে আপনি খুঁজছেন।
ওকে হতবাক করে সে বলে চলল,
-আমিও কিন্তু আপনাকে খুঁজছি!
(২)
কালিম্পং পাহাড়ের উত্তর পূর্বে ভুটান ঘেঁষা লিংসে পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত বহুপ্রাচীন একটা পুরানো লেপচা দুর্গ-কে সংস্কার করে এই সরকারী গেস্ট হাউসের রূপ দেওয়া হয়েছে। নির্জনে অবস্থিত এই গেস্ট হাউসটাতে কিছুদিন হল উঠেছে ও। সমস্যা হয়েছিল ঠিক দু’দিন আগে। সেদিন সন্ধ্যার আগে থেকেই ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। সন্ধ্যার পর সেটা তীব্রতর হল। আর শুরু হল বৃষ্টি।
-সাহেব, গতিক সুবিধের নয়। নারদমণি বলেছিল, -জুলুকের দিকে হয়তো বরফ পড়বে। জুলুকে না পড়লেও নাথাং বা কুপুপে তো পড়বেই!
-তাই?
-হ্যাঁ, আমি কি ফায়ার প্লেস-টা জ্বালিয়ে দেব? রাতে ঠান্ডা পড়বে, হিটার না জ্বালাতে পারলেও ঘরটা গরম থাকবে।
-দিতে পারো।
উদাসীন গলায় বলল ও। ঠান্ডা নিয়ে অহেতুক ওর কোন মাথাব্যথা নেই। দীর্ঘদিন ইংল্যাণ্ডে থেকে ওর আর ঠান্ডায় কোন অসুবিধে হয় না।
-ঠিক আছে সাহেব, আমি এখনি ফিরে আসছি কাঠ নিয়ে।
খানিক পরে ফিরে এল নারদমণি। ফায়ার প্লেস-টা জ্বালিয়ে দিল। ঘরেই রাখা একটা চেয়ার আর ছোট্ট একটা টেবিল টেনে ফায়ার প্লেসের কাছে রেখে দিল সে।
-সাহেব, ওর দিকে ফিরে সে বলল, -মাঝে মাঝে একটু শিক দিয়ে কাঠগুলো নাড়বেন, তাতে আগুনটা জ্বলবে ভাল।
তারপরে বাদবাকি শুকনো কাঠ কাছেই একটা র্যাকে রেখে সে বলল,
-এখানে বাকি কাঠ থাকল। প্রয়োজন হলে নিয়ে নেবেন। এই গরম জলের ফ্লাস্কটা দিয়ে গেলাম। আর কিছু লাগবে?
-না।
ফায়ার প্লেসের সামনে বসে আগুনের উত্তাপ নিতে নিতে বাইরের দিকে তাকাল ও। কিছুই প্রায় দেখা যায় না। তবে বৃষ্টি কমে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ বাজ পড়ছে। সেই আলোতে বাইরের নির্জন বাগানটা দেখা যায়। দেখা যায় তার নীরব, ক্লান্ত পাইন গাছগুলিকে। তবে চারিদিকে বেশ কুয়াশা থাকায় আবছা মাত্র বোঝা যায়। সেদিন এরকম-ই পরিবেশ ছিল। আর বেশি ভাবল না ও। দেরাজ খুলে ব্র্যাণ্ডির বোতলটা বের করে আনল। টেবিলে রাখা গ্লাসে অভ্যস্ত হাতে কিছুটা ব্র্যাণ্ডি ঢেলে তাতে ফ্লাস্কের জল মিশিয়ে একটা চুমুক দিল ও।
-না, বেশ খোলতাই হয়েছে!
নিচের উপত্যকা থেকে হঠাৎ-ই একটা কুকুর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ডেকে উঠল। করুণ সেই সুর।
ঠিক এই করুণ সুরেই সে মিনতি করেছিল।
কিন্তু………
আর ঠিক তখন-ই প্রবল আওয়াজ করে কাছেই কোথাও বাজ পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে আলোটা নিভে গেল। হয়তো এতক্ষণ ইনভার্টার-টা কাজ করছিল। তবে এখন মনে হয় তার ফিউজটা গেছে, কোনভাবে। ইলেকট্রিসিটি থাকায় ফায়ার প্লেসের আলোটা আগে বোঝা যাচ্ছিল না। এবারে সেটা ঊজ্জ্বল হয়ে উঠল।
ফট! একটা আগুনের ফুলকি ফায়ার প্লেস থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল। সেটা কোথায় পড়ল দেখতে গিয়েই ও চমকে গেল।
আরে, এটা কী?
ঘরের মধ্যে এই লম্বা ছায়াটা কিসের?
চমকে গেছিল ও। ভয়ার্ত চোখেই কোনগতিকে ভালো করে তাকাল।
নাহ! ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওর-ই ছায়া। ফায়ার প্লেসের আলোয় সেটা লম্বা হয়ে, সরু হয়ে দেওয়ালে মিশে গেছে, একটা লম্বা ভোজালির মতন।
আজ এইরকম অস্ত্রেই খুনটা হয়েছে!
গ্রাউ…ম!
চমকে উঠে তাকাল ও জানালার দিকে। হঠাৎ বাতাসের এলোমেলো স্রোত এসে সেটা খুলে দিয়ে গেছে। অথচ এতক্ষণ তো সেটা ঠিক-ই ছিল, এত ঝড়েও। তবে কি কেউ এসেছে?
আরে কী যা-তা ভাবছে ও!
হাতের গ্লাসটা টেবিলে রেখে উঠে গিয়ে জানালাটা ভালোভাবে বন্ধ করে দিল ও। পুরো বাগান সাদা কুয়াশায় ঢাকা। কাছের পাইন বা ওক গাছগুলিকেও আর স্পষ্টভাবে বোঝার উপায় নেই। বেশ কিছুটা উঁচুতে রংলি শহর আর কিছুটা নিচে রেনক শহরের আলোগুলো অন্যদিন দেখা গেলেও আজ আর বোঝা যাচ্ছে না। শুধু নীরবতা ভেঙে মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক কানে ভেসে আসছে। পর্দাটা ভালো করে টেনে দিয়ে ফিরে এসে চেয়ারে বসল ও। তবে আবার ঝড় আসতে শুরু করেছে।
টিকবে তো ও?
ক্লান্তভাবে চোখ বুজে চেয়ারে ভালোভাবে হেলান দিয়ে বসল ও।
(৩)
লালচে রং-এর শিং-বিহীন সুন্দর ছোট্ট পাহাড়ি হরিণীটি একা একা চরে বেড়াচ্ছিল বাড়িটার সামনে অংশত ছায়াঘেরা বাগানটায়। এক মনে একটি পাহাড়ি অশ্বত্থ গাছের আড়াল থেকে একটা হায়েনা সেই হরিণীটাকে দেখছিল। তাড়া খেয়ে আর খাবারের লোভে সে এখানে এসে জুটেছে। বেশ কিছুদিন শিকার পায় নি। ফলে শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ক্লান্তি ছাপ ফেলেছে তার মনে। চেয়ে চেয়ে সে দেখছিল হরিণীটার চাল-চলন। বেশ একটা মাদকতা আছে তার চলার ছন্দে। এমন একটা শিকার পেলে অনেকদিন আর শিকার না করলেও চলে যাবে। এখন একটা সুযোগ পেলে হয়!
কিন্তু এখন শিকার করা যাবে না।
টিবেট্যান ম্যাস্টিফ প্রজাতির একটা ভয়ঙ্কর পাহাড়ি কুকুর কাছেই ঘোরাঘুরি করছে। এই সময় সে চারদিকটা পাহারা দেয়। বেচাল দেখলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়বে। যদিও ম্যাস্টিফটি জানে না যে কাছেই একটি হায়েনা এসে জুটেছে, কিন্তু তার পাহারা দেওয়ার কাজে কোন গাফিলতি রাখতে চায় না। সে ঘুরে ঘুরে তাই পাহারা দিয়ে চলেছে। আর হরিণীটিও পরিচিত ম্যাস্টিফটির সান্নিধ্যে বেশ নিরাপদ বোধ করছে। ফলে চুপ চাপ শুয়ে শুয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না হায়েনাটার।
এমন সময় নিচের উপত্যকা থেকে একটা পরিচিত ডাক ভেসে এল। ডাকটা তার খুব পরিচিত। তার মনিব তাকে খেতে ডাকছে। এদিকে বিপদের কোন আশংকা সে করে না। ফলে হরিণীটির দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে ম্যাস্টিফটি চলে গেল। হরিণীটিও মাথা নেড়ে অন্যদিনের মতন সেদিনও তাকে বিদায় জানাল।
চুপি চুপি হায়েনাটি এগিয়ে গেল হরিণীটির দিকে। হঠাৎই হরিণীটির নজর পড়ল এদিকে। আর সে অমনি চঞ্চল হয়ে উঠল। এমন জন্তু তো সে কোনদিন এদিকে দেখেনি! কেমন যেন অস্বস্তিকর এই প্রাণীটির আগমন। অথচ পালিয়ে যাওয়ার জায়গা নেই। অন্তত দৌড়ে সে পারবে না। শঙ্কিত, ভয়ার্ত চোখে সে তাকিয়ে থাকল হায়েনাটির দিকে।
শান্ত অথচ হিংস্র চোখে মৃত্যু এগিয়ে আসছে, সে কি তখনই সেটা বুঝতে পেরেছিল?
বিপদ এসেছে হয়তো, কিন্তু সেটা যে মৃত্যুর ন্যায় শীতল, সেই বোধ কি তার এসেছে?
ছোট্ট হরিণীটা চেয়ে দেখল নিচের উপত্যকার দিকে। আশায় আশায় চাইল যদি ম্যাস্টিফটি ফিরে আসে। কিন্তু সেখানে শুধুই শূন্যতা। আর এদিকে একটি হিংস্রতা তাকে গ্রাস করে নেওয়ার জন্য শীতল চোখে ধীর পায়ে এগিয়ে এল ওর দিকে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল হরিণীটি।
ঠিক এতটা স্বপ্ন দেখার পরে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল। স্বপ্ন অথচ যেন স্বপ্ন নয়। আর প্রচণ্ড জল তেষ্টা পেল। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল না।
(৪)
-দেখুন সাহেব, সেদিন দুপুরে নারদমণি তার মোবাইলের ছবিগুলি বের করে ওকে দেখাতে দেখাতে বলেছিল, -কুলবহাদুরের মেয়েটাকে এমনভাবেই মেরে রেখে দিয়ে গেছে জানোয়ারটা।
পাহাড়ের অনেকেই দেখতে একেবারে ইউরোপীয়ানদের মতন। কুলবহাদুরকে দেখলে ওর-ও শুরুতে তাই মনে হয়েছিল, যদি না শুধুই স্থানীয় পাহাড়ি পোশাক পরে থাকত। ওর এই ফুটফুটে মেয়ে লীলাও দেখতে অনেকটা ইউরোপীয়ানদের মতন, অন্তত স্প্যানিশ বা পর্তুগীজদের মতন তো বটেই। ছবিটা ভালো করে দেখতে দেখতে মনে হল ও চলে এসেছে ইংল্যান্ড-এ। লীলার অবাক, বিস্মিত, অসহায় মুখটি ওর চোখের সামনে একবার ফুটে উঠেই যেন মুখটা বদলে গেল। পোশাকটাও।
এ কাকে দেখছে ও?
কুলবহাদুরের মেয়ে লীলা না রুথ-কে?
সেই একই নিষ্পাপ মুখ। যেন শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে সে। শুধু সেই ঘুম আর ভাঙবে না।
মাথাটা দপ দপ করছিল ওর। শুধুই অশান্তি?
গ্রাউ…ম!
ভীষণ শব্দে আরেকটা জানালা খুলে যেতে ওর চিন্তাজাল ছিঁড়ে গেল।
এ কী করে সম্ভব? সব জানালাই কি ও আলগা করে আটকেছে? তাই বা কেন হবে?
এত ভেবে কাজ নেই। আগে তো আটকানো যাক। খোলা জানালা দিয়ে হাওয়া ঢুকে এলোমেলো করে দিচ্ছে ঘরটা। কখন আবার চুল্লীর আগুনটা না নিভে যায়। তাছাড়া ঘরে মেঘ ঢুকে পড়ছে।
লীডস-এ এমনটাই ছিল পরিবেশ। এই রোদ, এই বৃষ্টি। সেই আবহাওয়া আর আজকের এই আবহাওয়ার মধ্যে বেশ মিল আছে, ঠিক যেমন এই ঘটনাটির সঙ্গে।
আর বেশি ভাবল না ও। উঠে গিয়ে জানালাটা ভালো করে বন্ধ করে বাকি জানালাগুলো দেখে নিল। সেগুলো ভালোভাবেই আটকানো আছে। দেখে খানিক নিশ্চিত হল ও।
তারপরে ফিরে এসে চেয়ারে বসে ডুবে গেল চিন্তায়।
-মিয়াঁও!
শব্দটা শুনে ওর চটকা ভাঙল। ফায়ার প্লেস থেকে দরজাটা খুব দূরে নয়। মনে হয় কোন বিড়াল দরজার ওপাশেই আছে। কিন্তু এখানে এসে এই ক’দিন তো কোন বিড়াল চোখে পড়েনি ওর। তাহলে?
তাহলে?
দরজা আঁচড়ানোর শব্দে ওর খেয়াল হল। বিড়ালের তো এত জোর থাকে না। চিতাবাঘ হলে তাও বোঝা যেত। কিন্তু…।
এবারে মনে হল যে প্রাণপণে দরজা আঁচড়াচ্ছে বিড়ালটা। তবে বিড়াল-ই। কেননা একবার সেটি জোরে “মিয়াঁও” বলে ডেকে উঠল।
এত ভয় পাওয়ার কী আছে?
ফায়ার প্লেসের শিকটাকে হাতে তুলে নিয়ে টলোমলো পায়ে ও সোজা হয়ে দাঁড়াল। আজ একটা হেস্ত-নেস্ত করে ছাড়বে। শিকটাকে বাগিয়ে নিয়ে এক ঝটকায় দরজাটা ও খুলে ফেলল।
নেই!
কিচ্ছু নেই! কেউ কোথাও নেই! হয়তো থাকার কথাও নয়।
শুধু দমকা হাওয়া এসে ঘরের ভিতরটাকে এলোমেলো করে দিল। আর ও বাইরে থাকার ঝুঁকি নিল না। দরজা লাগিয়ে দিল। সবে শিকটাকে ফায়ার প্লেসের ধারে রেখে চেয়ারে বসতে যাবে, চমকে উঠল ও।
আরে সামনেই টেবিলের উপরে বসে আছে একটা সাদা রঙের বিড়াল!
কখন ঢুকল এটা?
কিভাবে?
আরে সে যে বাবুর মতন বসে বেশ ড্যাব ড্যাব চোখ করে চেয়ে আছে ওর দিকে।
কী বিশ্রী ওই দৃষ্টি! তাকানো যায় না।
যেন বলতে চাইছে, -তুমিও?
রুথ এভাবেই ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।
কিন্তু রুথ………লীডস…………এখানে?
এখানে সে কিভাবে আসবে?
আরে কুলবহাদুরের মেয়ে লীলার মুখটা যেন বসানো এই বিড়ালটার মুখে। যেন ওর সামনে সে বসে আছে। কত মিষ্টি মেয়েটা। এই সেদিনও কুলবহাদুরের সঙ্গে এসেছিল। ও কয়েকটা চকোলেট দিয়েছিল। বড় সরল মেয়েটা। তাই হয়তো এমনটা হল। যাই হোক না কেন, একটা বদ্ধ ঘরে ও বিড়ালের সঙ্গে থাকতে পারবে না।
কোনরকমে উঠে টলতে টলতে ও দরজা খুলে দিল।
তারপরে টেবিলের দিকে ফিরে চাইতে চাইতে ও বলল,
-যা ভাগ!
আরে কোথায় সেই বিড়ালটা?
টেবিল বিলকুল খালি!
বাথরুমের দরজা বন্ধ। ঘরের মধ্যে চারিদিক আঁতি-পাঁতি করে খুজল ও। খাটের নিচটাও দেখল। কোথাও নেই! কিছু নেই! গেল কোথায় সেটা?
মাথাটা ওর বড়ই ঝিম ঝিম করছিল। সেবারে রুথের গভীরে ও তলিয়ে যেতে চাইছিল। যুগ্ম শিখরদ্বয়ের মধ্যবর্তী শুষ্ক উপত্যকা থেকে নিম্নের অরণ্য প্রদেশের দিকে ও এগিয়ে চলেছিল। তিরতির করে কাঁপছিল রুথের কপাটগুলি- আমন্ত্রণে, উল্লাসে। ঠিক এমন সময়……।
ও পারল না!
স্প্রে করে নিল আবার………।
কিছুক্ষণ পরে। কিন্তু সেই……একই পরিণতি।
রুথের লাথিটা সজোরে ওর বাঁ গালে এসে লেগেছিল।
আহ! গায়ে কে যেন গা ঘষছে?
আরে এ যে সেই বিড়ালটা! কোথা থেকে এল হতচ্ছাড়াটা? এতক্ষণ তো দেখাই যাচ্ছিল না।
-যাহ! চিৎকার করে বলে উঠল ও।
-চলে যা এখান থেকে।
নিচ থেকে একটা আলো ক্রমশ উপরে উঠে আসছিল। অন্ধকার চিরে হাতে একটা টর্চ নিয়ে নারদমণি এসে দাঁড়াল ওর সামনে।
-সাহেব, কিছু বলছিলেন? ওকে দেখতে দেখতে উৎকণ্ঠিত মুখে সে জিজ্ঞেস করল, -আলো দেব একটা?
-দরকার নেই। ও একটু ইতস্তত করে বলল, -একটা কাজ করতে পারবে?
-কী কাজ?
-আমি একটা পুরস্কার ঘোষণা করতে চাই। যে বা যারা কুলবহাদুরের মেয়েটির হত্যাকারীকে ধরিয়ে দিতে পারবে বা কোন ক্লু দেবে, তাকে আমি পুরস্কার দেব।
-আমি কী করব?
-সেই পুরস্কার ঘোষণার কাগজ ছাপিয়ে জায়গায় জায়গায় টাঙিয়ে দিতে হবে- থানা, চেক পোস্ট, হোটেল, হোম স্টে, পোস্ট অফিস, সব জায়গায়। আমি খরচা দেব, চিন্তা কোর না।
আধো অন্ধকারে নারদমণির মুখের দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে ওর মনে হল সঠিক লোককেই ও বলেছে। এখানে এসে ইস্তক ও বুঝেছে যে এর এলেম আছে। যদি হয় তো একে দিয়েই হবে। কোন ব্যাপারে না নেই ওর। যেন টিপিক্যাল এক গোর্খা সৈন্য!
(৫)
দরজা খুলে দিল ও। আর আবছা আলোতেও সামনের লোকটিকে দেখে হতবাক হয়ে গেল।
তাহলে কি?
এই?
কিন্তু ও……।
-আমি কিন্তু আপনাকে খুজছি। অন্ধকার থেকে সেই আগন্তুক ওকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল।
-কিন্তু আপনি খুন করলেন কেন?
লীলার হত্যাকারীকে দেখতে পাবে, এত তাড়াতাড়ি, সেটা ও আগে ভাবেনি।
-কামে আমি অন্ধ হয়ে গেছিলাম! বলে চলল আগন্তুক, -কিন্তু রুথের মা ভারতে এসে সবার কাছে আবেদন জানিয়েছেন তাঁর মেয়ের হত্যাকারীকে ধরে দিতে। মোটা অংকের পুরস্কারও ঘোষণা করেছেন। আজ দুপুরে সেটা টিভি-তে দেখলাম।
-আপনি কী চান? শক্ত গলায় জানতে চাইল ও।
-ধরা দিতে………। কিন্তু যে আমার দুঃখটা বুঝবে………। সমাজে আমার-ও স্থান আছে, কিন্তু আমি হয়তো সাধারণের থেকে আলাদা। কিন্তু………মানুষ তো বটে।
-তাহলে আমি কার কাছে ধরা দেব?
গ্রা…ক…।
দমকা হাওয়ায় ভারী দরজাটা হঠাৎই খুলে গেল। ঠিক যেমনভাবে ওর মনটা খানিক আগে মেলে দিয়েছিল। আগন্তুক চলে গেছে। কিন্তু বদ্ধ জায়গায় সে এলই বা কি করে আর গেলই বা কী করে? তবে কি……
তবে কি লীলাকে চকোলেটের লোভ দেখিয়ে নির্জনে নিয়ে গিয়ে ওই হত্যা করেছে? ও কি সিরিয়াল কিলার হতে চলেছে? কিন্তু এর তো শেষ থাকা দরকার………।
আরে দরজাটা খুলল কী করে? কেউ তো আসেনি?
না, ও নিশ্চিত কেউ আসেনি………। তবে আসবে……। নিঃসন্দেহে!
দমকা এলোমেলো হাওয়ায় দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে আবার খুলে গেল। যা ভেবেছে তাই……।
দরজায় দু’পায়ে দাঁড়িয়ে সেই বিড়ালটা………। ক্রমশ সে আকারে বড় হয়ে উঠছে। পিছনের দু’পায়ে ভর দিয়ে “হাত” দু’টো সামনে বাড়িয়ে সে এগিয়ে এল।
আর ঠিক তখনি দমকা একটা হাওয়া এসে আলোটাকে নিভিয়ে দিল।
প্রাণ কি এভাবেই নিভে যায়?
চিরতরে?
———–:———–
অংকনঃ পুণ্যতোয়া ধর