-চল, শিনি বলল, -চলে যাওয়ার আগে তোকে একটা ট্রীট দিই।
আমি মোবাইলটা কানে ধরে থাকা অবস্থাতেই চোখ তুলে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম। অনেক কিছু গুছিয়ে নিলেও এটা এখনও অবধি প্যাক করা হয়ে ওঠেনি। ঘড়িতে তখন দুপুর আড়াইটা বাজে। খানিকক্ষণ আগে খাওয়া দাওয়া সেরে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আবার গোছ-গাছ শুরু করব বলে ভাবছিলাম, এমন সময়ে ফোনটা এল। হালকা গলায় জানতে চাইলাম,
-কোথায় যাবি?
-তুই যেখানে বলবি।
মনে হল কিছুটা আমোদে চোখ বুজে এল শিনির। সেটা আমার ধারণা হলেও প্রায়শই আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যাকগে, এই কাল বাদে পরশুই আমি টা-টা করে দিচ্ছি সবাইকে।
-তাহলে চ, আজ একটা অফবীট জায়গা থেকে ঘুরে আসি। যেতে বড়জোর সোয়া ঘণ্টা লাগবে।
-দূরে কোথাও? মনে হল নিজের মনেই নিজেকে প্রশ্ন করে উঠল শিনি। পরক্ষণেই হয়তো সব চিন্তা-ভাবনাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে জানতে চাইল, -কিন্তু ভালো রেস্তোরাঁ আছে তো সেখানে?
-সে দেখা যাবে। আমি বললাম, -আগে তো চল। ফিরতে আবার সময় লাগবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শিনিকে আমার গাড়িতে তুলে নিয়ে রওনা দিয়ে দিলাম। আলিপুরদুয়ার জংশন স্টেশন ছাড়িয়ে উত্তরে কিছুটা এগোতেই দমনপুর ফরেস্ট শুরু হল। নামেই ফরেস্ট, এখানে জঙ্গল এখন অনেক পাতলা। ডানদিকে মাঝেরডাবরি চা বাগান, তবে রাস্তার ধারের চা বাগান ছেঁটে সেখানে ইতস্তত বাড়ি-ঘর-দোকান গজিয়ে উঠেছে। বাঁদিকে রাস্তার ধারে ইঁটের পিলার বা কাঠের গুঁড়ির উপরে ফরেস্টের ছোট ছোট কাঠের কোয়ার্টার্স। সেখানকার বাচ্চাদের ফূর্তিতে খেলতে দেখে বেশ লাগল। আমি চোখ সরিয়ে রাস্তার উপরে মনোনিবেশ করলাম। অচিরেই জয়ন্তী যাওয়ার সোজা রাস্তা ছেড়ে বাঁদিকে বেঁকে হাইওয়েতে উঠে পড়লাম।
-কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?
-বাংরি নদীর ধারে কোথাও গিয়ে বসব।
-সেটা কোথায়?
-মাদারীহাট থেকে কিছুটা উত্তরে টোটোপাড়া যাওয়ার রাস্তায় পড়ে জায়গাটা।
-কী আছে রে?
-এই নদী, পাহাড় আর আমরা।
-তুই না………
হাসিমারা পেরিয়ে তোর্সা নদী। তোর্সা পেরিয়ে হাইওয়ে ধরে কিছুটা দক্ষিণে এগোলেই মাদারীহাট অর্থাৎ জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের প্রবেশদ্বার। মাদারীহাটে না ঢুকে ডানদিকের ডুয়ার্স রেললাইন পেরিয়ে টোটোপাড়া রোড ধরে কিছুটা এগিয়ে বাংরি নদীর কালভার্ট অতিক্রম করে কিছুটা গেলে পর ডানদিকে শুরু হয়ে গেল ছোট ছোট টিলার সমাহার। ডানদিকে নিচু পাহাড়, বাঁদিকে বিস্তীর্ণ ডুয়ার্স সমতল, আর মাঝখানের এই রাস্তা উঁচু-নিচু, নরম পিচ ঢালা। রাস্তাটা ঘুরে গিয়ে ফের ডান দিকে বাঁক নিল, হাণ্টাপাড়া চা বাগানের মধ্যে দিয়ে পাকা রাস্তা চলে গেছে, দু’দিকে তার চা-গাছে ছাওয়া উঁচু-নিচু টিলা। সেখান থেকে কিছুটা এগোলে পর হান্টাপাড়া মোড়ের চার মাথার রাস্তা। সেটা থেকে ডানদিকে ঘুরে কিছুটা এগিয়ে একটা নির্জন জায়গায় এসে পৌঁছলাম। সামনে বিস্তীর্ণ শুষ্ক খাতের বাংরি নদী, তার ওপারে ডুয়ার্সের নিবিড় জঙ্গল। উত্তরে ভূটানের পাহাড়রাজি। সেদিক থেকেই পাহাড়ের কোন এক অজানা কন্দর থেকে বাংরি নদী বেরিয়ে এসেছে। গাড়িটাকে রাস্তা থেকে যথাসম্ভব ডানদিকে চেপে রেখে আমি বড় একটা পাথরের পাশে এসে দাঁড়ালাম। কাছেই একটা অর্জুন গাছ। শিনিও বেরিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়াল। কিছুটা দূরে নদীর উপর দিয়ে মাঝে মাঝে কয়েকটা বাইক চলে যাচ্ছে চা বাগানের লেবার লাইনের দিকে। কয়েকজন হেলতে দুলতে মৃদুমন্দ গতিতে যেন ভবিতব্যের মতন মিশে যাচ্ছে অরণ্যের অন্তরালে। তাদের বাসার কাছে আমাদের দেখতে পেয়ে পাখিরাও শুরু করেছে কিচির-মিচির।
-বেশ না জায়গাটি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
-মন্দ না।
-আমার বেশ লাগে। এই নদীকে দেখলে মনেই হয় না এর তলা দিয়ে স্রোত বয়ে চলেছে?
-তাই? শিনি বিস্ময়ে বলল, -কিন্তু আমি তো পাথরভর্তি শুকনো নদী দেখতে পাচ্ছি।
-নদী খুঁড়লে প্রথমে পাথর, পরে ভিজে বালি, তারও পরে পরিষ্কার জল পাওয়া যায়। গরমে চা-বাগানের বস্তিতে যখন জলের সঙ্কট দেখা যায়, অনেকেই নদী খুঁড়ে জল নিয়ে যায়।
-সে তো কষ্টকর।
-খুব কঠিন নয়, আমি বললাম, -তবে আদৌ আরামদায়ক অভিজ্ঞতা নয় সেটা।
-তুই তাহলে পরশু চলেই যাচ্ছিস? হঠাৎ কথা ঘুরিয়ে শিনি জানতে চাইল।
-হ্যাঁ রে! অনেকদিন হয়ে গেল এদিকে। এবারে ঘরে ফিরতে হবে।
যেটা বললাম না সেটা হল আলিপুরদুয়ারকেও ঘর বানানো যেত। কিন্তু তা আর কপালে হোলো না। তাছাড়া এই করোনার মরশুমে বাড়ি থেকে দূরে দূরে থাকার রিস্ক নেওয়া উচিত নয়। এবারে যখন করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলাম, তখনই বুঝেছিলাম পরিস্থিতি। একা একটা ছোট্ট বাড়িতে থাকতাম, আর দু’টো দিন থাকবও, বাড়িওয়ালা আমাকে একরকম চৌকিদার হিসেবেই রেখেছে, অবশ্য মন্দ টাকা ভাড়া নেয় না। এদিকে করোনা হওয়ার সময়ে কাউকে আর পেলাম না। এক লোকে ভয় খেয়ে গেছিল, দুই আমাকে সাহায্য করতে এলে তাদেরকে বাকিরা একঘরে করে দেবে বা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে- এইসব ভয় কাজ করছিল মনে। নেহাত একা থাকি, তাই কেউ জোর করে তুলে দেয়নি। আর মাইল্ড করোনা হয়েছিল, অসুস্থ অবস্থাতেও নিজেই সব কাজ করতে পেরেছিলাম। নাহলে যে কী হত?
-আর আসবি না এদিকে?
-কোন্ কথাটা শুনতে চাস?
-মানে?
দূরে একটা রাখাল চরানো শেষ করে তার গোরুগুলো নিয়ে বাংরির শুকনো নদীখাত ধরে হান্টাপাড়া চা বাগানের লেবার লাইনের দিকে ফিরছিল। একটা গোরুর গলায় বাঁধা কাঠের ঘণ্টা থেকে ঠাক-ঠুক-ঠাক করে বেশ শব্দ বেরোচ্ছিল। সেটা শুনতে শুনতে শিনি নিশ্চয়ই কিছুটা আনমনা হয়ে গেছিল! নাকি অন্য কিছু শুনতে চেয়ে? জানি না।
-লোকে কোন জায়গা ছেড়ে, তার বন্ধু-বান্ধবদের ছেড়ে চিরকালের জন্যে চলে যাওয়ার আগে বলে যে সে শিগগিরি ফিরে আসবে। আবার সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দেবে, বন্ধুদেরকে সে আহ্বান জানায় তার নতুন গন্তব্যে যেতে, কিন্তু বাস্তবে তা আর হয় না। সত্যিটা সে জানে, তার বন্ধুরাও জানে। কিন্তু যে চলে যাচ্ছে, সে আশার কথা শোনায়। বাকিরা দেখা আর হবে না, সে ফিরবে না জেনেও সেকথা মন দিয়ে শোনে।
-তবে সত্যি বলতে, বলে নড়ে চড়ে বসে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, -এই চূড়ান্ত ব্যস্ত জীবন থেকে সময় বের করা মুশকিল। ফলে জানি না তোর সঙ্গে কবে, কোথায় আবার দেখা হবে।
-ততদিনে হয়তো আমার সব চুল পেকে যাবে, না?
-তার চেয়েও বেশি, আমি আস্তে করে বললাম, -তুই হয়তো একগাদা জনগণ নিয়ে সংসারে ব্যস্ত থাকবি, আমার কথা মনেও পড়বে না।
কিছুক্ষণ আমরা নীরবে বসে থাকলাম। অর্থপূর্ণ অথচ বাহ্যত একেবারেই অর্থহীন এই চুপচাপ বসে থাকা। আমি উঠে পড়লাম। পাখিরা নীড়ে ফিরছে। এবার আমাকেও আমার অস্থায়ী নীড়ে ফিরতে হবে। বেশ কিছু কাজ বাকি আছে।
-চল, ওঠা যাক। আমি বললাম।
-চল।
আস্তে আস্তে অনিচ্ছার সঙ্গে উঠে দাঁড়াল ও। কিন্তু আমি আর অপেক্ষা করতে রাজি নই। অনেক হয়েছে। এবারে আমাকে নিজের রাস্তা খুঁজে নিতে হবে।
-একটা কাজ কর না, কিছুটা আব্দারের সঙ্গে শিনি বলল, -চল লঙ্কাপাড়া হয়ে যাই।
-কোথায়? আমি অবাক হয়ে বললাম, -ফিরতে হবে না?
-ফিরবই তো। তবে লঙ্কাপাড়া হয়ে জলদাপাড়া ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে হলং নদী পেরিয়ে হলাপড়া ওয়াচ টাওয়ারের পথ ধরে উঠে ডুয়ার্স রেললাইনের নিচ দিয়ে গিয়ে হাইওয়ে ধরে নেব।
-তুই এই গাড়ি চালাতে পারবি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
-না রে। সখেদে বলল ও, -স্কুটারই চালাতে পারি না।
-তাহলে? আমি চিন্তিত সুরে বললাম, -ওই রাস্তায় মোটে লোকজন যায় না। এই ছোট গাড়ি কাদায় কোথাও আটকে গেলে অসুবিধে হয়ে যাবে। সারা রাত না জঙ্গলে থাকতে হয়।
-তুই না একটা ভিতুর ডিম। শিনি বলল, -ঝুঁকি নিতে শেখ।
কিছুদিন হল সবে করোনা থেকে সেরে উঠেছিলাম। খুব একটা বেশি সিম্পটম ছিল না যদিও, শরীরটাকে কাহিল করে দিয়ে গিয়েছিল। বড়ই একাকী মনে হয় ইদানীং নিজেকে। ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছে বেশ কমে গেছে। আর বাইরে বাইরে থাকতে ভালো লাগছে না। তাই তো চেষ্টা চরিত্র করে বাড়ির দিকে পোস্টিং নেওয়ার ব্যবস্থা করেছি এবারে। আগে যখন ঝুঁকি নিয়ে শিনিকে কিছু বলতে চেয়েছিলাম, ও কেমন চোখে তাকিয়েছিল আমার দিকে, কেমন যেন হাঁকিয়ে দিয়েছিল আমার চাহনিকে। সুতরাং……
শিনিকে যথারীতি বাঁ-পাশে বসিয়ে আমি গাড়ি নিয়ে এগোলাম। শুষ্ক বাংরি নদীখাতের উপর দিয়ে অজস্র গাড়ি যাওয়ার দাগ দেখে নদীতে আয়েস করে এলিয়ে থাকা পাথরগুলোকে পাশ কাটিয়ে আমি সাবধানে এবড়ো-খেবড়ো নদীখাত বেয়ে গাড়ি নিয়ে এগোলাম। নদী পেরিয়ে সাবধানে গাড়ি তুললাম অসমতল রাস্তায়- রাস্তাটি সোজা চলে গেছে লঙ্কাপাড়ার দিকে। উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে বেশ ঝড়ের বেগে কিছুক্ষণ গাড়ি চালালাম। কিন্তু অচিরেই গতির লাগাম টানতে হল। সামনেই তিতি নদী। এটিও পুরো শুকনো নদী। নদী পেরিয়ে বাঁদিকের প্রাগৈতিহাসিক অরণ্যকে সাক্ষী রেখে কিছুটা এগিয়ে গেলে লঙ্কাপাড়ার ফরেস্ট রেঞ্জ অফিস। তবে তার আগেই ডানদিকে একটা রাস্তা ঢুকে গেছে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে। একটিই মাত্র গাড়ি যাওয়ার কাঁচা রাস্তা আছে। ঘন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে সেই রাস্তা। জায়গায় জায়গায় গাছের ডাল এসে লাগছে গাড়ির গায়ে। মাঝে মধ্যেই কিছুটা করে জল জমে আছে রাস্তায়। প্রায়ই সেখানে ফার্স্ট বা সেকেণ্ড গিয়ারে গাড়ি চালাতে হচ্ছিল।
-কেমন লাগছে রে?
-দুর্দান্ত। কতদিন বাদে এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। জানিস, শিনি আস্তে করে বলল, -তোর কি মনে আছে?
-কী?
-তোর যখন করোনা হয়েছিল, আমি সেই রাতে তোর কাছে চলে এসেছিলাম।
-তাই? কিন্তু……
কিছু পাখির শব্দ আর ঝিঁঝির ডাক চারিদিকে। আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম হলং নদীর ব্রিজের উপরে। ব্রিজ না বলে কজওয়ে বললেই ভালো হয়। নিচ দিয়ে দ্রুত বেগে বয়ে চলেছে হলং নদী। শান্ত, স্তব্ধ চারিধার। আস্তে আস্তে আঁধার নেমে আসছে চারিদিকে। আমি নিশ্চিত আরো কিছুক্ষণ এখানে অপেক্ষা করলেই বন্য জন্তুদের জল খেতে দেখতে পাব। ওদের আগমনের সময় হল বলে। তবে হাতি এসে গেলে মুশকিল। জলদাপাড়ার জঙ্গলে হাতি, গণ্ডার আর বাইসনের মুড বোঝা সম্ভব নয়। তা সে দেখাই যাক না। গাড়িটার স্টার্ট অফ করে আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জঙ্গলের ঘ্রাণ নিচ্ছিলাম।
-সরে আয়, হঠাতই নিস্তব্ধতা ভেঙে শিনি বলে উঠল।
-কি হল রে?
বলে আমি দ্রুত সরতে গিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম হলং নদীর বুকে। ডুবে যেতাম না, জল খুব বেশী নেই, কিন্তু ঐ খরস্রোতা জলে পড়ে গেলে বেশ নাকানি-চোবানি খেতে হত। তবে সে আর হল না। শিনি আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। আমি প্রায় এলিয়ে পড়লাম ওর গায়ে। সামলে নিতে নিতে ওকে বললাম,
-কী হয়েছে?
-আরে ওই দ্যাখ গাড়ির গায়ে একটা জোঁক। তুই যখন গাড়ির পাশে ছিলি, তোর গলা টার্গেট করে ধরার চেষ্টা করছিল।
-আমি তাকিয়ে দেখলাম জোঁকটাকে। নির্ঘাত গাড়ির গায়ে যেসব ডাল-পালা এসে লেগেছিল, সেগুলোর কোন একটা থেকে এটা এখানে লেগে গেছে। আমি জোঁকটাকে দু’হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে টেনে দু-টুকরো করে ফেললাম। তারপরে ছুঁড়ে দিলাম হলং-এর স্রোতে।
-তুই কী নিষ্ঠুর রে!
-নিষ্ঠুরতার কী দেখলি? আমি হতবাক হয়ে বললাম।
-ওইভাবে ওটাকে মেরে দিলি? এটা না অভয়ারণ্য? এখানে না জন্তু-জানোয়ার স্পর্শ করাও অপরাধ।
-তাহলে কী ওটাকে আমার রক্ত খাওয়াতাম? তারপরে জঙ্গল থেকে বের হয়ে পর ধরে ক্যালাতাম?
-তোর মুখের ভাষা আর ঠিক হল না। বলে শিনি বিরক্তমুখে গাড়িতে গিয়ে বসল।
এই এক মুডি মেয়ে ও। এখনই মুড ঠিক আছে, আর পরক্ষণেই ও মুখ গোমড়া করে ফেলে। হয়তো এই কারণে ওকে আমি আরও বেশি পছন্দ করি। ভেবেছিলাম এই রোমান্টিক পরিবেশে আরো কিছুটা সময় আড্ডা দেব। তা আর হল না। আমি ঘুরে চালকের আসনে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলাম।
-আমি ভেবে দেখলাম, শিনি আস্তে করে বলল, -তুই তোর বাসাতেই ছিলি করোনার সময়ে। আমার ভুল হয়ে যাচ্ছে।
-নারে, আমি বললাম, -করোনার কারণে আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে, একথা তোকে বলা মাত্র তুই এসে আমাকে সেবাশুশ্রূষা করেছিলি।
-তাই???????
আস্তে করে চোখ বুজে সীটে মাথা হেলিয়ে দিল শিনি।
গাড়িটা খুব সাবধানে চালাতে হচ্ছিল। শুধু জল না, বেশ কিছু জায়গায় কাদাও আছে। ধীরে ধীরে বুঝে শুনে গাড়ি চালাচ্ছিলাম বলে বেশি কথাও বলতে পারছিলাম না। দুজন বাইকওয়ালা ব্যক্তিকে সাইড দিতে গিয়ে আরেকটু হলে কাদায় ফেঁসে যাচ্ছিল আর কি গাড়িটা। ওরা মনে হয় বল্লালগুড়ি যাচ্ছে বা সেটা পেরিয়ে টোটোপাড়া। যাইহোক হলাপাড়া মোড়ের কাছে এসে একটু স্বস্তি পেলাম। একজন ফরেস্ট গার্ড আমাদের গাড়িটা দেখল, তবে কিছু বলল না। ডানদিকে ঘুরে তোর্সা নদীর বাঁধে তুলে দিলাম গাড়িটা। আবারো নির্জন রাস্তা, কিন্তু আর ভয় নেই। চাকা বসে যাওয়ার বিশেষ কোন সম্ভাবনা নেই। আর তা হলেও হাঁক-ডাক দিলে কিছু একটা সুরাহা হয়ে যাবে। গাড়িটা একধারে রেখে আমরা দু’জনে গাড়ি থেকে বাঁধের রাস্তায় নামলাম। একটা পায়ে চলা রাস্তা নেমে গেছে তোর্সা নদীর বুকে। সেটা ধরে আমরা নেমে এলাম নদীতে। একটু নিচেই বয়ে চলেছে তোর্সা নদী। উজানের দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম দু’টি বাইসন জল খেতে এসেছে নদীর বুকে। আরো উত্তরে দেখা যাচ্ছে ফুণ্টশোলিং-এর আবছা অবয়ব, তার পাহাড়ি দেহের ইতস্তত আলোকরাজি। আমি একটা পাথরের উপরে এসে বসলাম। শিনি এসে দাঁড়াল আমার গা ঘেঁষে।
-জানিস, আমার কী মনে হচ্ছে? শিনি গভীর, কবোষ্ণ স্বরে বলল।
-কী?
-আমি না গাড়ি চালাতে জানি।
-কিভাবে বুঝলি?
-তোর যখন করোনা হয়েছিল, প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল, দ্রুত তোকে হাসপাতালে ভর্তি না করাতে পারলে তোর জীবন-সংশয় হতে পারত, আমি সেই রাতে খবর পাওয়া মাত্রই গাড়িতে বসিয়ে নিজে ড্রাইভ করে তোকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম।
********************************************************************************************************