অন্যের মুখে শোনা কাহিনী নয়। এই কাহিনীগুলো আমার বাড়ন্ত বয়সের অনুভব ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ । সেই ছোটবেলা থেকে ভূতের দেখা পাওয়ার জন্য আমি উদগ্রীব ছিলাম কিন্তু ভূত প্রেত দত্যি দানো আমাকে দেখা দেননি । লোকজনকে ভূতে ধরতে দেখেছি এবং ওঝার তিড়িং বিড়িং লাফালাফি ও জগঝম্প দেখেছি বিস্তর কিন্তু ভূতের দেখা পাইনি । রাত বিরেতে গ্রামেগঞ্জে ঘোরাঘুরির সময় একটু আধটু গা ছমছম যে করেনি তা কিন্তু নয়। কিন্তু ওই টুকুই। ভূতের উপস্থিতি বা তার কর্মকান্ড নজরে পড়েনি তাই ভাগো ভূত ভগবানে মেতেছিলাম কিছুদিন।
তবে আমি নাছোড়বান্দা, গ্রামাঞ্চলে অনেক ঘোরাঘুরির পরেও যখন তথাকথিত ভূতের দেখা পেলাম না তেমন একটা সময়ে কলকাতার কলেজে পড়তে এলাম । সেই সময়ে মূলত দক্ষিণ শহরতলির যাদবপুর অঞ্চলের সন্তোষপুর অ্যাভিনিউ-এর দুটি মেসবাড়িতে থাকলেও বেশ কয়েকমাস বাঘাযতীনের একটা বাড়িতে ভাড়ায় ছিলাম। বাড়িটি ছিল ছোট ও নিরিবিলি । আসলে গাছপালা ও বাগানে ঘেরা একতলা একটা বাড়ির পূর্ব দিকের একটা বাড়তি অংশে আমরা তিনজন থাকতাম । মুল বাড়িতে বোধহয় চার পাঁচটি ঘর ছিল। মালিক বসাক কাকু ছাড়াও সেখানে থাকতেন তাঁর স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে।
আমাদের বরাদ্দ ছিল একখানা মাত্র শোওয়ার ঘর সঙ্গে রান্নাঘর ও সংলগ্ন একখণ্ড বারান্দা । শোওয়ার ঘর শেষ হতেই বাড়ির ভিতরের দিকে ভাঙা ইঁটের রাস্তা। একটু এগোলেই কলতলা,টয়লেট ল্যাট্রিন। সোজা কথায় এখনকার মত অ্যাটাচ্ড বাথের ব্যবস্থা ওই বাড়িতে ছিলনা । আমি ছাড়াও দুজন উঠতি চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট তখন ওই বাড়ির ভাড়াটে ছিলেন। দুজনেই আমার থেকে তিন চার বছরের বড়,মেদিনীপুরের গড়বেতার সঞ্জীবদা এবং বর্ধমানের পূর্বস্থলীর চন্দনদা। দুজনেই তখন দুটো আলাদা ফার্মের আর্টিকেলশিপ করছিল। ওরা দুজনেই সেই সকালে অফিসে বেরিয়ে যেত এবং ফিরে আসত সন্ধের পরে কিংবা কোনো কোনো দিন আরো পরে রাত একটু জমাট হলে । বাঘাযতীন স্টেশন রোডের থেকে সামান্য একটু ভিতরে মস্তবড় পুকুর পাড়ের এই বাড়িটা বেশ শান্ত আর নিরিবিলি ছিল।রাস্তা থেকে বাড়িটি একটু ভিতরের দিকে ছিল। বাড়ির সামনে ও পিছনে বেশ কিছুটা জায়গা খোলা রাখা ছিল । সামনে নারকেল ও সুপারি গাছের সারি । ঘাসের লনের মাঝখান দিয়ে সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তা। রাস্তার পাশে রঙ্গনের কেয়ারি করা ঝোঁপ। পুকুরের পাশে রাস্তা। তার গায়ে সীমানা পাঁচিল বরাবর ভিতরের দিকে কামিনীর ঝোঁপ ছিল। একটা কাঁঠাল গাছ ছিল বাড়ির মুল দরজার আগে। তার পাশ দিয়েই আমাদের অংশে যাওয়ার রাস্তা। বাড়ির বিছনের দিকটা এরকম নয় বরং সেদিকে নানান অপরিকল্পিত গাছগাছালি আর জলা জায়গা, ঝোপ ঝাড়।
সেদিন বিকেলবেলা কলেজ থেকে ফিরে বিশ্রাম করছিলাম। বেশ ক্লান্ত ছিলাম তাই বিশ্রাম নিতে নিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি। যখন ঘুম ভাঙলো দেখি ঘর অন্ধকার। সন্ধ্যে ঘনিয়েছে। ঘরের বিদ্যুৎবাতি জ্বালা হয়নি। সামনের জানালা দিয়ে আবছা দেখলাম রাস্তার এল জ্বলছে কিন্তু ঘরের ভিতরটা কেমন অদ্ভুতুড়ে পরিস্থিতিতে আছে। শুয়েশুয়েই পাশফিরে পিছনের জানালার দিকে চাইতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ !
এ কি দেখলাম আমি ?
জানালার থেকে প্ৰায় বিশ হাত দূরে মাটিথেকে প্রায় দশবারো ফুট উপরে একটা মৃদু আলোর পিন্ড । বাতাসে যেন একটু দুলে দুলে ভাসছে। কেমন যেন একটা আধিভৌতিক জিনিস। ঠিক দেখছি না ভুল দেখছি বুঝতে পারছি না। নিজের অবস্থা ও অবস্থান দুটোই বোঝার চেষ্টা করছি। খেয়াল করে দেখলাম সঞ্জীবদা বা চন্দনদা এর মধ্যে ফিরে আসেনি। কেমন জানি গা টা ছমছম করে উঠলো।
অন্ধকার ঘরে চোখের দৃষ্টি প্রায় সয়ে এলো। পিছনের জানালার বাইরের দিকে চেয়ে আলোর বৃত্তটিকে বোঝার চেষ্টা করছি। কি হতে পারে? কি হতে পারে না দুইই বোঝার চেষ্টা করছি। কলেজে পড়া ভূত ও ভগবানে অবিশ্বাসী ছাত্রের কাছে এর ব্যাখ্যা দরকার। বেশ কিছুক্ষন থম ধরে বসে থাকার পর পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। সন্ধ্যের আবছা আলোতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আলোটি একটা খেজুরগাছকে কেন্দ্র করে উঠছে নামছে। ওই গাছের নিচে বুনো কচু গাছের ঝোপ ও জলাজমি। যে জলাজমিতে মিথেন গ্যাসের সৃষ্টি ও সঞ্চয় দুই ই হতে পারে।
আর কে না জানে উপযুক্ত পরিমান মিথেন গ্যাস বাতাসের বা বিশেষ করে অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে জ্বলে যায় বা আগুনের শিখা তৈরী করতে পারে।
যাই হোক আরো কিছুক্ষণ আলোর ওই দীপ্তি দেখতে পাচ্ছিলাম। যাক এখন আর ভয় নেই। এই আলোর ব্যাখ্যা এখন আমি জানি। মনে পড়ল এই সংক্রান্ত বিষয় ভৌতবিজ্ঞানের বইতে পড়েছি। এছাড়া ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির প্রবীর ঘোষের ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ বইয়ের কোনও একটা খন্ডে এই সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা পড়েছি তাছাড়া কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান পত্রিকার কোন সংখ্যাতেও এই নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে মনে পড়ল । অতএব ভয় কিসের !
এমন সময় কেউ একজন সামনের দরজায় ঠকঠক করে আওয়াজ করছে শুনতে পেলাম। ভাবলাম বুঝি চন্দনদা-সঞ্জীবদারা বা ওদের কেউ একজন ফিরে এসেছে। ঘরের আলো জ্বেলে দরজা খুলে দেখি আমাদের রান্নার দিদি , রাতের রান্না করতে এসেছে। ভীতু মহিলা তাই কিছু বললাম না। আমি নিজের পড়াশুনো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
আধঘন্টা পার হয়নি কাজের দিদি দরজা খুলে কলতলার দিকে যাবে বলে দরজা খুলে সবে মাত্র দুই পা এগিয়েছে কি এগোয়নি। “দাদা ভূতে খেয়ে ফেলল ‘, বলে জোরে চিৎকার করে হুড়মুড় করে আবার ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ল এবং তারপর “রাম, রাম। রাম, রাম।’ করে চোখ কপালে তুলে ফেলল।
এ কি বিপদে পড়লাম রে বাবা !
আমি মনে মনে ভাবছি। বড় ফ্যাসাদে পড়লাম তো ! এখন উপায়। প্রায় সেই সময় মেসে দুই বোর্ডার সঞ্জীবদা ও চন্দনদা ফিরে এল। পুরো ঘটনা বললাম এবং রান্নার দিদির চোখে মুখে জলের ছিটে দেওয়া হল। এর কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান ফিরল এবং তাকে তার বাড়িতে রেখে আসা হল।
কিন্তু ভূতের গল্প শেষ হল না। অনেক হাঁকডাক ও আওয়াজের ফলে বাড়িওয়ালা কাকিমা ও তার ছেলে মেয়েরা এসেছিল। সবাই সেই সব নিয়ে মেতে উঠল। এবং যার যা ভূতের গল্পের স্টক শেষ করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। আমি বললাম। ভূত নেই। যা আছে তা বর্তমান আর ভবিষ্যৎ।
কিন্তু সঞ্জীবদা ও চন্দনদা দুজনেই বলল। না রে ভূত আছে ,অন্য কোনো ডাইমেনশনে। আমি মজা করে বললাম ,”বেশ তাহলে তার অডিট করে জানিও।”
দুজনেই একটু রেগে গেল ,চন্দনদা বলল ,”যা জানিসনা ,তা নিয়ে তর্ক করতে আসিস না।”
আমি বললাম ,”দাদা,আমি যা জানি তাই বললাম। ভূত-টুত সবই মনের ভুল ‘
চন্দনদা আরো রেগে গিয়ে বলল ,”বললেই হল ! জানিস কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে ভূত আছে , এমনকি আলিপুরের স্টিফেন হাউসে ভূত আছে, হেস্টিংস হাউসে ভূত আছে , ভূত আছে আকাশবাণীতেও। ”
আমি বললাম , অতশত জানিনা দাদা এটা ভূতপ্রেতের বিষয় নয় অতিসাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনা। আলেয়া বলে সবাই। আসলে মিথেন গ্যাসের স্বাভাবিক জ্বলন ছাড়া কিছু নয়। ছোটবেলায় মুর্শিদাবাদে মামার বাড়ির মাঠে ঘাটে এমন আলো আমিও দেখেছি।
এরপর সবাই যেন গল্পের ঝাঁপি নিয়ে বসল।
সে যাই হোক অনেকপরে কলকাতায় কাজের সূত্রে স্টিফেন হাউসে রাত কাটিয়েছি। একটা গা ছমছমে ব্যাপার থাকলেও ভূতের দেখা মেলেনি। সে গল্প আরেকদিন বলব।