Home / রম্যরচনা / এনকাউন্টার – যশোবন্ত্‌  বসু

এনকাউন্টার – যশোবন্ত্‌  বসু

সোমক সেনগুপ্ত
শিল্পী- সোমক সেনগুপ্ত
ব্রজকিশোর আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ব্রকজিশোর প্রত্যেক বছর আমাকে তার বাড়ির গাছের সজনেফুল আর কচি নিমপাতা খাওয়ায়। তবে শুধু সেই জন্যেই যে আমি ব্রজকিশোরকে  ভালবাসি তা কিন্তু নয়। ব্রজকিশোরের আরও অনেক গুণ আছে। সেইসব গুণের জন্য ব্রজকিশোরের প্রতি আমার ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জড়াজড়ি করে আছে।
ব্রজকিশোর একজন ভাল মানুষ এবং একজন উঁচুদরের কবি। কবিতা নিয়ে আমার কোনও কথা বলা সাজেনা। কারণ আমি কবিতার কিছুই বুঝিনা। বস্তুত কবি ও কবিতার বই আমি সবিশেষ এড়িয়ে চলি। যারা কাব্যচর্চা করে এবং কবিতা লিখতে পারে তারা নিঃসন্দেহে অসম্ভব প্রতিভাবান। তারা অন্য জাতের মানুষ। কিন্তু সব মানুষের হাত পা চোখ কান পাকস্থলী নিউক্লিয়াস মাইটোকন্ড্রিয়া একইভাবে থাকলেও প্রতিভা একরকম থাকেনা। তাই কবিতা নিয়ে আমার একড্রপও আগ্রহ নেই। তাহলে ব্রজকিশোর যে একজন উঁচুদরের কবি এই ধারণা আমার হল কী করে ? এর পেছনে একটা ছোট্ট গল্প আছে।
ব্রজকিশোর খুব গোপনে ও সন্তর্পণে কবিতাচর্চা করে। তার এই চর্চার কথা আত্মীয়স্বজন,প্রতিবেশী,সহকর্মী কেউই জানেনা। ব্রজকিশোরের বেশ কয়েকটি বাঁধানো কবিতার খাতা তার বইয়ের তাকে আমি দেখেছি। অজস্র গোয়েন্দাগল্পের বইয়ের ভিড়ে সেই খাতাগুলি মিশে আছে । সজনেফুল এবং নিমপাতা ছাড়াও গোয়েন্দাগল্পে আমার আসক্তি আছে । ব্রজকিশোরের বইয়ের তাকে কেউই হাত দেয়না। শুধু আমাকে সে অত্যন্ত ভালবাসে বলেই আমার ইচ্ছেমতন বইপত্র নিয়ে যেতে দেয়।
এই বই নিতে গিয়েই একবার ভুল করে গল্পের বইয়ের সঙ্গে ব্রজকিশোরের একখানি কবিতার খাতাও আমি বাড়িতে নিয়ে আসি। বই ভেবে সেই খাতা খুলে পড়তে গিয়েই ভুলটা ধরা পড়ে। খাতাটা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে রেখে দেওয়াটাই আমার পক্ষে স্বাভাবিক ও শোভন ছিল। কিন্তু সেই চৈত্র মাসের দুপুরে কী জানি কী হয়ে গেল, জীবনে সেই প্রথমবার ব্রজকিশোরের কবিতা আমি চাক্ষুষ করলাম বলেই কিনা কে জানে, ধৈর্য ধরে একখানা আস্ত কবিতা আমি পড়ে ফেললাম ! কবিতাটা এইরকম –-
“ ধূসর পৃথিবী থেকে উঠে এসে ছেলে
  ভিখারির মতো শুধু ধরতে চায় চাঁদ
  সেই কাক-জোছনাতে ধুলো লেগে গেলে
 পড়ে থাকে হাড়-পাঁজরা আর মৃত্যুফাঁদ ”
বলা বাহুল্য, ঐ কবিতার মাথামুন্ডু আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। খাতাটা পত্রপাঠ ব্রজকে ফিরিয়ে দেওয়াটাই সঠিক ভদ্রলোকের কাজ হোত। কিন্তু সেই বসন্তের অদ্ভুত দুপুরে ঐ কবিতার কিছু কিছু শব্দ আমার মাথার মধ্যে এমন বেমক্কা গেঁথে গেল, কোনওমতেই আর তাদের তুলে ফেলে দিতে পারলাম না। গোয়েন্দাগল্প পড়াও মাথায় উঠল। মানে কী থেকে কী হয়ে গেল, আমি ঠিক করলাম, ব্রজকিশোরের এই কবিতার খাতা একবার অলোকবাবুকে দেখাতে হবে।
অলোকবিজয় মিনতিপুত্র আমার ভাইপোর কলেজের বাংলার অধ্যাপক এবং ডাকসাইটে কবি। শিমুলতলায় আমার এক বন্ধুর একটি লজের তিনটি ঘর অলোকবাবুদের জন্য আমি একবার টেলিফোন করে বুক করে দিয়েছিলাম। সেই সূত্রে আলাপ ছিল। আমার ভীষণ মনে হচ্ছিল, অলোকবাবুর মতন জবরদস্ত কবি এবং নিপাট ভদ্রলোক ব্রজকিশোরের এই কবিতার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারবেন।
এবং তিনি করলেনও। খাতাটি দিনতিনেক পরে আমাকে ফেরত দিতে সটান আমার বাড়ি এসে হাজির হলেন। সঙ্গে ব্রজকিশোরকে উদ্দেশ করে লেখা এক লম্বা চিঠি। এরপরেই অলোকবিজয় বাবু আমার দুটি হাত জড়িয়ে ধরে একান্ত অনুরোধ করে বসলেন, আমি যেন ব্রজকিশোরের সঙ্গে তাঁর একটিবার আলাপ করিয়ে দিই ।
এই অনুরোধে আমি বেজায় মুশকিলে পড়ে গেলাম। ব্রজকিশোরের মতো লাজুক, একটেরে, অন্তর্মুখী মানুষ তার কবিতা নিয়ে এমন লোকজানাজানিটা নির্ঘাত ভালভাবে নিতে পারবেনা। এমনকী এই দুষ্কর্মের অজুহাতে হয়তো তার সঙ্গে আমার চিরকালের মতো বিচ্ছেদও ঘটে যেতে পারে। আবার এদিকে অলোকবিজয় বাবুর মত খ্যাতনামা কবি ও অধ্যাপকের এই সুভদ্র অনুরোধটিকেও আমি ফেলে দিতে পারব না। এমন উভয় সংকটে আমি অনেক ভেবে একটা রফা করলাম।
অলোকবিজয় বাবুকে শেষ পর্যন্ত এই বলে রাজি করালাম যে, আগে আমি তাঁর কথা এবং তাঁর চিঠির কথা ব্রজকিশোরকে জানাব। তারপর অবস্থা বুঝে অধ্যাপকের সঙ্গে কবির সাক্ষাতের ব্যবস্থা করব।
সেদিন সন্ধেবেলা অলোকবিজয় বাবুর চিঠিটা আমার হাত থেকে নিয়ে ব্রজকিশোর কয়েক মুহূর্ত চোখ বুলিয়েই আমাকে আবার ফিরিয়ে দিল। অজানা আশঙ্কায় আমার বুক কেঁপে উঠল। কিন্তু তারপরেই আমাকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে ব্রজ বলল, “ তুই পড়ে শোনা ”।
সুন্দর ঝরঝরে হাতের লেখায় অধ্যাপক অলোকবিজয় বাবু লিখেছেন,
“ জীবন কখন কোন্‌ নান্দনিক অভিজ্ঞতার সামনে এনে আমাদের দাঁড় করায়, তা স্বপ্নেরও অতীত। সাহিত্যের অঙ্গনে পেশা ও নেশার তাগিদে এতবছর কালাতিপাত করার পরে আপনার কবিতার সঙ্গে এই পরিচয়লাভ আমার জীবনলব্ধ এক অনুপম অভিজ্ঞতা। আপনার মতো এক নির্জনতাপ্রিয়, নিবিড় কবিতাসাধকের এই রত্ন-আকরের সন্ধান পেয়ে আমি তুঙ্গ অভিভূত। আপনার কবিতার আত্মায় ও শরীরে এই বিস্ময়কর অবগাহন আমার কবিতাবোধের দিগন্তে এক আশ্চর্য উদ্ভাস !
আমাদের চারপাশের চেনা জগতের নিপুণ অবলোকন, প্রতিদিনের তুচ্ছতার মধ্যেও অরূপের সন্ধান, নাগরিক গ্লানিময়তাসঞ্জাত অনপনেয় চিত্রকল্প, আপনার কবিতায় ব্যবহৃত নতুনতর ভাবমুদ্রা আমাদের এতকালের কবিতা-পাঠাভ্যাসকে এক আনকোরা পথের বাঁকে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
উদাহরণস্বরূপ আপনার ‘ রবিবারের সকাল ’ কবিতাটির উল্লেখ করতেই হয়। এই কবিতায় বর্ণিত অকল্পনীয় বিপরীতাভাস দৈনন্দিন ধূসরতা ছাপিয়ে এক অদ্ভুত শ্বাসরুদ্ধ অরব অভিব্যক্তি। নিষ্ঠুর চিত্ররূপময় সংক্ষিপ্তি আমাদের চেতনায় চকিত আঘাত হানে যার অভিঘাত বয়ে বেড়াতে হয় বাদবাকি সমস্তদিন এবং জীবনের বাকি সমস্ত রবিবারকেও এই আঘাত সদা বিপন্ন করে রাখার বিলি-বন্দোবস্ত করে রাখে।
আপনার কবিতার নিবিড়-গভীর স্বপ্নচারিতা, পরাবাস্তবতা, বিপন্ন অস্তিত্ববাদ প্রকৃত কাব্যরসিক পাঠককে কোনওমতেই স্বেচ্ছাদূরত্ব নির্মাণ করে সরে থাকতে দেয়না। কবিতার এই অমোঘ লাইনগুলি আমাদের কবিতাবোধের প্রান্ত ধরে হ্যাঁচকা টান মারে। সমান ও বিপরীতমুখী টানে এই কবিতা আছড়ে পড়ে আমাদের শীলিত সাম্যাবস্থার অন্তঃসারশূন্য সত্তায়।
আপনার ‘ রবিবারের সকাল ’ যে আমি এই দু’তিন দিনে কতবার সঘন উচ্চারণে পড়েছি তার ইয়ত্তা নেই।
“ সকালবেলার আলোর রেণু মাখল গায়ে সবাই
  কসাইখানায় খাসিগুলি হবে এবার জবাই ।”
আপনার অভূতপূর্ব কবিপ্রতিভাকে কুর্নিশ ! ”
( শেষ সংযোজন – এই পত্রাঘাতের পর লাজুক ব্রজকিশোর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অধ্যাপক অলোকবিজয়ের সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে ।)
                                 _______

Leave a comment

Check Also

বর্ষামঙ্গল/ বুদ্ধদেব

বর্ষা মঙ্গল – বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়

  অবশেষে বর্ষা আসিল । উহা আগের মতো পৃথুলা, মেদবতী নাই। কালের গতিকে স্লিমকায়া হইয়াছে। …

বাস

বাঁশযাত্রা- সোমক সেনগুপ্ত

  বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছি। ত্রাহি-ত্রাহি রবে একটা মানুষের স্তূপ এলো! কার কোনটা মাথা, কোনটা বডি …

পুরুষ গরু – রঘুনাথ মণ্ডল

সুবিমলবাবুর কর্মসূত্রে শহরে বাস। গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক দুর্গাপুজো, তাই প্রতিবছর পুজোর সময় গ্রামের বাড়ি যান। …

স্মৃতি সততই শোকের – যশোব ন্ত্‌ বসু

ছবি – সোমক সেনগুপ্ত শেফালির বিয়ের কথাটা মনে পড়লেই নৃপেন্দ্রশেখরের মুখটা তেতো হয়ে যায়, মেজাজ …