অন্ধকার কি দূর হয় এতোই সহজে? এতোই সহজ?
দীপাবলি আলোর উৎসব। এবং শব্দের। এবং অপরিণামদর্শিতার। এবং হয়তো বা কিছুটা অন্ধকারেরও।
দীপাবলি মানে কী? দীপ মানে প্রদীপ অর্থাৎ আলো। আবলি মানে সমূহ। সোজা কথায় প্রদীপসমূহ। হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিকে জ্বালিয়ে অন্ধকার দূরীভূত করার সমবেত প্রয়াস। আলো জ্বলে ঠিকই, আপন আলো জ্বলে কি? বাইরের আলো জ্বালানো সহজ, নিজের মনের আলো জ্বালানোই কঠিন। যে হাত প্রদীপ জ্বালায়, সে হাতই উঠে গিয়ে শিশুকে পাচার করে, বৃদ্ধাকে ঝুপড়ি থেকে উচ্ছেদ করায়, বাড়ির বধূটিকে ঠেলে দেয় মৃত্যুযন্ত্রণার দিকে। কিংবা হয়তো তাও-ও নয়, প্রদীপ জ্বালাতে ব্যস্ত মনের অন্দরের গভীর মন বেশি ব্যস্ত থাকে প্রতিবেশীকে টেক্কা দিয়ে আরও জাঁকজমকের রোশনাইয়ের দেখনদারিতে, সহকর্মীর চলন-বলনের নিখুঁত সমালোচনায়। এ অন্ধকার রুধিবে কে? মুদি দোকানী ব্যস্ত থাকে দেওয়ালির দিনে খদ্দের ঠকিয়ে দু’ পয়সা আখের গোছানোয়, মাছ দোকানি ব্যস্ত থাকে পচা মাছ গছিয়ে দেওয়ালির আগে নিজের স্টক ক্লিয়ারেন্সে। ভেজালের কারবারিরা মহাসুখে ভেজাল মেশাতে থাকে- নে, নে, মর তোরা! পুজোর দিনগুলোতে খেতে থাক যথেচ্ছ, আর মরতে থাক! আমাদের লাভের কারবার উপচে পড়ুক ফুলে- ফলে। নেতানেত্রীরা মুখেচোখে রঙিন বাতির রোশনাই জ্বালিয়ে ‘উপহার’ পাওয়া বিদেশি ব্র্যাণ্ডের মোবাইল দেখায় ব্যস্ত। কত কাজ তাঁদের দিবারাত্র! এ আঁধার রুধিবে কে?
বাইরের আঁধার দূর করা যায় যতোটাই সহজ, মনের ভেতরের অন্ধকার ঘুপচি কোণায় পরতে পরতে জমে থাকা অন্ধকার দূর করা ঠিক ততটাই কঠিন। আর ঠিক সেই কারণেই আমাদের আতসবাজি জ্বলে- পোড়ে, আলোর গুঁড়োরা অঝোরে ঝরতে থাকে মাটির বুকে; আর হয়তো বা সেই সময়েই হাইওয়েতে অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে চাঁদা-মাফিয়ারা ব্যস্ত থাকে দীপাবলির অনুপান আদায়ে! কিংবা হয়তো কোথাও অটিজমে আক্রান্ত শিশুটি তীব্র চিৎকার করে, বাইরের তীব্র আওয়াজ তার ভেতরে জন্ম দেয় আরও সুতীব্র আক্রোশের আর তার সেই আর্তনাদ চাপা পড়ে যায় পৃথিবী দীর্ণ করে দেওয়া আরও ভয়ংকর সব শব্দে।
আমরা উৎসবকে বহিরঙ্গে যতটা গ্রহণ করি, অন্তরঙ্গে ততটা আপন করতে পারি না। তাই যে উৎসব প্রকৃতপক্ষে ছিল অন্তরের ও বাহিরের সকল রকম তামসকে বিসর্জন দেবার উৎসব, সেই উৎসব পর্যবসিত হয় শব্দাসুর ও দূষণাসুরের যৌথ বিজয়মিছিলে। আমরা ফিরেও তাকাই না, ফিরেও ভাবা তো পরের ব্যাপার।
আজকাল একটা কথা হামেশাই শোনা যায়। অমুক জায়গায় প্রচুর উন্নয়ন হচ্ছে, তমুক জায়গায় কিছুই হচ্ছে না- এইসব। বাইরের উন্নয়ন নিয়ে আমাদের মাতামাতির আর অন্ত নেই। বাইরের উন্নয়ন দরকার, অবশ্যই দরকার- কিন্তু নিজের অন্তরের উন্নয়নও যে একান্তই জরুরী। সে কথা আমাদের আর খেয়াল থাকে কই? মানবসম্পদের উন্নয়ন তাই গালভরা কথা হয়েই ভরা থাকে কেতাবি অর্থনীতিকের ঝুলিতে।
বুদ্ধদেব তাঁর অন্তিম শয্যায় শিষ্য আনন্দকে বলেছিলেন- আত্মদীপো ভব। নিজেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠো, যাতে সেই আলোয় আপন পথটি চিনে চলতে পারো। পার্শ্ববর্তী দু-একজনও চলতেই পারে তোমার আলোকে। মনুষ্যত্বের উদ্বোধনই যদি না হয়, তাহলে মানুষ আর পশুতে ফারাক নেহাতই কম হয়ে দাঁড়ায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদ বলছে-
অসতো মা সদ্গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মামৃতং গময়।
আবীরাবীর্ম এধি।
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং
তেন মাং পাহি নিত্যম্।
অসত্য থেকে নিয়ে চলো আমায় সত্যে, অন্ধকার থেকে নিয়ে চলো আলোর পথে। মৃত্যু থেকে উপনীত কর অমৃতে। হে স্বপ্রকাশ, প্রকাশিত হও আমার সম্মুখে। রুদ্র, যে তোমার প্রসন্ন মুখ, সে যেন সর্বদা রক্ষা করে আমাকে।
সত্যের একটি নিজস্ব আলো থাকে। শুভবুদ্ধির একটি নিজস্ব ছটা থাকে। আঁধার, সে আপনি কালো- তাই অন্ধকার। আকাশে যখন সূর্য থাকে, আলোর প্রয়োজন পড়ে না। কারণ সে স্বপ্রকাশ এবং স্বরাট। কিন্তু যখন অন্ধকার, আলোর প্রয়োজন তখনই। শত প্রদীপ কিন্তু হাজার মানুষকে দিশা দেখাতে সক্ষম। শুভশক্তির কাছে অশুভশক্তির বিনাশের জন্য কিন্তু দীপশিখারাই যথেষ্ট।
আমাদের সকলের মনের সকল অন্ধকার দূর হোক, নিজের আন্তর আলোয় যেন উদ্ভাসিত হতে পারি আমরা। এই কামনাটুকুই থাকুক এই দীপাবলি দিনে।
শুভ দীপাবলি!