-মনে আছে তো, পুলিন বলছিল, -তরশু তোর আবার হাতে রাজকাজ। বলছিল আর মিটমিট করে হাসছিল। অন্য কেউ বললে বীরেন নির্ঘাত খেপে যেত। হয়তো মাথা গরম করে ফেলত। কিছু উল্টো-পাল্টা শুনিয়ে দিত। কিন্তু পুলিনের কথা আলাদা। ওর সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। বীরেনের যদি পাঁচজন প্রকৃত শুভার্থী থেকে থাকে এই দুনিয়ায়, পুলিন তার মধ্যে একজন।
-আছে। আস্তে করে বীরেন উত্তর দিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল ও। এই একটা বাৎসরিক ব্যাপার আছে, যেটা ওর আর ভালো লাগে না, কিন্তু কোন উপায় নেই। ছেলে-ছোকরারা আজকাল সামনে ভদ্রতা দেখালেও পিছনে হাসাহাসি করে, কেউ কেউ আবার উৎসবের পরদিন থেকে সামনা-সামনিই রসিকতা করে। কিন্তু ও নিরুপায়। ওর নিজেরই কি ভালো লাগে?
-তাহলে দেরী করিস না। পুলিন বলল, -সকালেই না খেয়ে, চান করে মন্দিরে চলে আয়। বলে একটু থামল। বীরেনকে বলার সুযোগ করে দিল। কিন্তু সে নিরুত্তর থাকল। সুতরাং পুলিনই বলতে থাকল, -প্রথমে পুজো। তারপরে সবাই মিলে শোভাযাত্রা করে যাব রাজপাড়া ফরেস্টে। তুই আগে আগে যাবি, তোর মাথায় ছত্র ধরে যাবে নরেন, পিছনে পুরোহিত শর্মাজী, আর পিছন পিছন আমরা। সেখানে পৌঁছে তোর অভিষেক। তোর কাছে যারা বিচারের জন্যে আসবে, তাদের বিচার করে দিবি। পরে সবাই মিলে খাওয়া আর ফিরে আসা।
-হ্যাঁ, বীরেন বলল, -সে তো প্রতি বছরই হয়। এ আর নতুন কি?
-একটা নতুনত্ব অবশ্য আছে। পুলিন আস্তে করে বলল, -ইন্দ্রাণী আসতে চায়।
মানে…মানে………মানে সেই সাংবাদিক মেয়েটা? মেয়েটির কথা মনে মনে স্মরণ করে একটু শিউরেই উঠল বীরেন। ওদের সঙ্গেই কো-এড স্কুলে পড়ত মেয়েটি। নিরীহ বীরেনের পিছনে কতই না লাগত। এখন শিলিগুড়িতে থাকে বলে শুনেছে। লেখালিখির কাজ করে। চলনে বলনে খুব স্মার্ট। কিছুদিন আগে জিনস-টপ পরে ওদের পৈতৃক বাড়িতে এসেছিল। সাধারণত গাঁ-গঞ্জের মেয়েরা সেই সময়ে এত স্মার্ট ছিল না। তবে কিনা ওদের মধ্যে ইন্দ্রাণী ছিল ব্যতিক্রম। এমনিতে বীরেন খুবই সঙ্কোচের সঙ্গে অন্যান্য বছরে দিনটা কোনগতিকে কাটিয়ে দেয়। কিন্তু এবার যে শিরে সংক্রান্তি! ঘাবড়ে গিয়ে এবং যুগপৎ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল বীরেন,
-সে এসে কী করবে?
-সে নাকি দিল্লি আর কোলকাতার একটা করে কাগজে আর্টিকেল লিখবে। কোন একটা চ্যানেলে নিউজ-ও করবে।
-ওকে মানা করা যায় না? কিন্তু কিন্তু করে বলে উঠল বীরেন।
-খেপে গেছিস? পুলিন ওকে বোঝানোর চেষ্টা করল, -ও বিশেষ করে তোকে নিয়েই লিখবে। আর লিখবে এলাকার প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে। আর তাছাড়া ওকে বারণ করার তুই-আমি কে? সে কি আমাদের কর্মচারী?
“যন্ত্রণা……। জ্বালা ধরাল মেয়েটা্।” ফিস ফিস করে বলল বীরেন। মনে হয় না মোবাইলের অন্যধারে পুলিন কথাটা শুনতে পেল।
-তাহলে আর কথা বাড়াচ্ছি না, পুলিন বলল, -রেডি থাকিস। আমি বাকি যোগাড়-যন্ত্র দেখছি। তারপরে স্বগতোক্তির সুরে বলল, -ইদানীং আর সেরকম লোকই হতে চায় না। আগেকার দিন হলে মেলা লেগে যেত। এখন নেতারা না এলে, গালভরা মিথ্যে প্রতিশ্রুতি না দিলে…………সবই কপাল!
সত্যিই কপাল!
নাহলে…………
নাহলে বীরেনের আজ এই হাল হওয়ার কথা নয়। মাঝে মাঝে মনে মনে নিয়তির উপরে ভয়ানক রেগে যায় সে। ভাবে যে একটা রক্তারক্তি করে ফেলবে। কিন্তু অদৃশ্য সেই নিয়তির সঙ্গে সাক্ষাতই হয় না। ভুল হল, বড়ই বেশি সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু সে যে রয়ে যায় পর্দানশীন হয়ে, অন্তরালে। সেখান থেকেই পরিচালনা করে সব। পুতুলনাচের মতন চালাতে থাকে বীরেনকে। আর অনাকাঙ্ক্ষিত ফলশ্রুতিতে মনে মনে গুমরে ওঠে ও।
এই ইন্দ্রাণীকে ও একসময় একটু পছন্দই করত। কিন্তু পাত্তা দেওয়া দূরে থাকুক, ইন্দ্রাণী ওকে নিয়ে সেই সময় থেকেই শুধু ঠাট্টা-ইয়ার্কি করত। ফলে ওর কৈশোর-যৌবনের সেই হাতছানি মাঝপথেই দিশেহারা হয়ে পড়ত। জমাট কুয়াশায় পথ খুঁজে পেত না ওর আবাগী দৃষ্টিশক্তি। অথচ মন কেন অন্য কাউকে টানত না? ভীরু, কোমল, আপাত নরম স্বভাবের মেয়েদের কোন অভাব সেখানে ছিল না। অথচ……। আশ্চর্য! যা পাওয়া সম্ভব না, মন মানুষের সেদিকেই টানে। নিয়তির ফের……? বিপরীত লিঙ্গের আরও বিপরীত মানসিকতার ব্যক্তির দিকে মনটা অনেক বেশি পরিমাণে আকৃষ্ট হয়। যুগে, যুগে। কিন্তু কেন? অথচ আজও যে তাই!
(*)
-শোন, ইন্দ্রাণী বলল, -তুই ক্যামেরার দিকে মুখ করে বলে যাবি। মনে রাখবি আমি সাংবাদিক। আমি তোকে আপনি-টাপনি সম্বোধন করে আজকের দিনের তাৎপর্য জিজ্ঞেস করব। তুই সিরিয়াস সিরিয়াস মুখে সব উত্তর দিবি। মোটে ঘাবড়াবি না।
‘এমনিই আমার মুখ সিরিয়াস হয়ে আছে। আর বেশি সিরিয়াস হয়ে দরকার নেই।’ মাথা নিচু করে চোখটা ইন্দ্রাণীর দিক থেকে সরিয়ে নিতে নিতে বীরেন মনে মনে বলল।
সকালে মন্দিরের পুজোমণ্ডপে একপ্রস্থ পুজো-আচ্চা হয়ে গেছে। সেখানে পূর্বের রাজপুরোহিতদের বংশধর শর্মাজী ওর মাথায় ফুল-হলুদ দেওয়া সুগন্ধি জলের ছিটে দিয়েছেন। ওর কপালে তিলকও কেটেছেন। সেখান থেকে শোভাযাত্রা করে ওরা এসেছে নির্জন অরণ্যের মধ্যে বীরেনদের বংশের সেই পুরানো প্রাসাদটির নিকটে, যেটা আজকাল প্রায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। কাছেই সবাই মিলে একটা ছোট-খাট রাজসভা বসিয়েছে। বীরেনের মাথায় ধরা হয়েছে ঐতিহ্যশালী ছত্র- হাল এটার সুবিধের না, তবে উৎসবের কথা ভেবে পুলিন এটাকে যতটা সম্ভব সারিয়ে রেখেছিল। সারি সারি প্রাচীন অমাত্যদের আধুনিক বংশধরেরা কেউ কেউ এসেছিল। তারা জায়গামতন বসল। অন্যদিকে সমানে মন্ত্রোচ্চারণ করে চলছিলেন শর্মাজী। তবে কিনা আজ আর কেউ বিচারের জন্যে আসেনি। আজকাল পঞ্চায়েতই সব বিচার করে। বড়জোর আশে-পাশের লোকে কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বাড়িতে সালিশী বসায়। আগেকার দিনের সামন্তরাজার উত্তরাধিকারীদের পুছবে-টা কে? আগে তাও একটা জমজমাট হাট বসে যেত, আজ এক-দু’জন নিতান্ত গরীব ফেরিওয়ালা ঘুরে গেছে, কিছুই প্রায় বিক্রী হয়নি। যাই হোক ওর রাজ্যাভিষেক শেষে সবাই মিলে পাত পেড়ে বসে খাওয়া-দাওয়া করল। সামান্যই আয়োজন, তবে কিনা আজকে সবাই বীরেনের দিকেই তাকাচ্ছে। তার অনুমতি ছাড়া, তা সে যতই লোক দেখানো হোক না কেন, কেউই কিছু করতে পারবে না, খেতে শুরু করা তো নয়ই। যাই হোক ইন্দ্রাণী যে আলোকচিত্রীকে নিয়ে এসেছিল, সে অনেক ছবি-টবি তুলল- স্থির এবং মুভি মোডে। আর খেতে বসার আগেই ওর সাক্ষাৎকার নিয়েছিল ইন্দ্রাণী।
-আজকের এই অনুষ্ঠানের ব্যাপারটা আমাদেরকে একটু বুঝিয়ে বলবেন…………।
ইন্দ্রাণীও তাকে আজ আপনি করে বলছে! এটা নাকি একটা বিখ্যাত আন্তর্জাতিক চ্যানেলের ডকুমেন্টারিতে দেখানো হবে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বীরেনের বংশের অন্তত পাঁচশ বছরের ঐতিহ্য। ভাবতে ভাবতেই ও যেন ফিরে যাচ্ছিল সেই সুদূর, বর্ণোজ্জ্বল অতীতে। ওর গলা গমগম করে উঠছিল।
-আমার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন কুচবিহারের রাজাদের আত্মীয় বংশ। বিস্তীর্ণ এলাকায় তাঁর প্রভাব দেখে সামন্তরাজা হিসেবে তাঁদেরকে সম্মান দেওয়া হয়েছিল। তাঁরাই এখানে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। ওই দূরে যে ভাঙাচোরা বিশাল প্রাসাদ দেখছেন, সেটা তাঁদেরই। চারিদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা থাকত। এখান থেকে যুদ্ধ-বিগ্রহের সময় মহারাজের সাহায্যার্থে সৈন্য পাঠান হত। যুদ্ধ শেষ হলে তারা ফিরে এসে আবার লেগে পড়ত খেত-খামারের কাজে। বর্ষা আর শীতের শেষে ফসল উঠত যখন, প্রজারা সব তাদের খাজনা দেওয়ার জন্যে চলে আসত এখানেই। দিনে-রাতে সরগরম থাকত জায়গাটা।
-এখানকার ইতিহাস, বলে ইন্দ্রাণী নিজেই ক্যামেরার দিকে মুখ করে বলে চলল, -অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুরের রায়কতরা ঐতিহ্যশালী ছিলেন, কিন্তু বৈকুণ্ঠপুর সংলগ্ন বিহারের এলাকা থেকে দলে দলে সন্ন্যাসী লোকজন ভাগ্যান্বেষণে চলে এল অরণ্যাবৃত বৈকুন্ঠপুর ও পার্শ্ববর্তী এইসব জায়গায়। ধীরে ধীরে তখন ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছিল কুচবিহারের রাজাদের ক্ষমতা। সেই সুযোগ নিয়ে সাম্রাজ্যের পশ্চিমদিক থেকে ডুয়ার্সের ঘন অরণ্যকে আশ্রয় করে লুঠ-তরাজ চালিয়ে শেষে সেই অরণ্যেই আবার ঢুকে যেত সন্ন্যাসীরা। ফলে দিনে দিনে দুর্বল হচ্ছিল মহারাজের শাসন। সেই সুযোগে উত্তরদিক দিক থেকে আক্রমণ করল ভূটানীরা। সংখ্যায় কম হলেও তারা খুবই একতাবদ্ধ- জঙ্গলযুদ্ধে বা হাতাহাতি লড়াইতে তারা ছিল রণনিপুণ। বিপদ বুঝলেই তারা আশ্রয় নিত উত্তরের পাহাড়ে, প্রয়োজনে তারা তিব্বতী লামাদের থেকে সামরিক সাহায্য চাইত। আজকের বক্সা ফোর্ট ছিল সেই যুগে ভূটানীদের মূল ঘাঁটি। কুচবিহার সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে অচিরেই তারা এইসব এলাকার দখল নিয়ে নিল। আর ভূটানীরা বর্তমান এই সামন্তরাজার পূর্বপুরুষকে “কাৎমা” অর্থাৎ স্থানীয় শাসক হিসেবে বহাল রাখল। তাদের একজন রাজ-প্রতিনিধি উপস্থিত থেকে তাঁর কপালে টিকা এঁকে দিতেন। সেই ঐতিহ্য আজও চলে আসছে। সেই সময় থেকে শুরু করে ইংরেজ শাসন চালু হবার আগে পর্যন্ত তাঁরাই ছিলেন এখানকার প্রকৃত শাসক। সেই সাম্রাজ্যের বর্তমান উত্তরাধিকারীর সঙ্গে এইমাত্র আপনাদের সাক্ষাৎ হল। এখন চলুন আপনাদের নিয়ে যাই সেই ঐতিহ্যশালী প্রাসাদ দর্শনে, যদিও আজ তার নিতান্ত ভগ্নদশা।
বলতে বলতে আলোকচিত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সেই ভগ্ন প্রাসাদের দিকের জঙ্গলে অদৃশ্য হল ইন্দ্রাণী। আর প্রস্থানরত একদা সহপাঠী ঝকঝকে চেহারার ইন্দ্রাণীকে দেখতে দেখতে নিজের কপালকে আবারও দোষারোপ করে উঠল বীরেন- হতাশায় প্রাচীন অরণ্যে যেন মিশে যেতে চাইল।
(*)
তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। জঙ্গল থেকে সামান্য দূরে ঘর্ঘরিয়া নদীর পাড়ে বসে ছিল বীরেন। কিচির-মিচির করে একগাদা পাখি শেষবেলার খেলাধুলো সেরে নিচ্ছে। চুপ করে বসে সেদিকে তাকিয়ে ছিল ও। সামনে ঘর্ঘরিয়া নদীর ওপারের বনে সূর্য অস্ত গেছে। হালকা আলোর আভা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। মজে গেছে নদীটা, এখন একেবারে ছোট একটা খালের মতন হয়ে গেছে। অথচ একসময়ে এই নদী যুক্ত ছিল তোর্সা নদীর সাথে। সেখান থেকে ব্রহ্মপুত্র হয়ে পদ্মা। এই নদীপথে দেশ-দেশান্তর থেকে লোকজন যাতায়াত করত, ব্যবসা বাণিজ্য চলত। আর এখন? ঐতিহাসিক অভিশাপে আক্রান্ত নদীটি কোনগতিকে টিকে আছে টিম-টিম করে।
আচ্ছা এই নদীটাও কি শতাব্দীর সুদীর্ঘ ক্লান্তির দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে?
ওর মতন সেও কি আজ নিঃস্ব, রিক্ত?
ওর মতন সেও কি চাইছে এই বিষাক্ত হাহাকার থেকে অব্যাহতি পেয়ে প্রকৃতিতে মিশে যেতে?
এই প্রাত্যহিক হাহাকার, ভগ্ন জীবন নিয়ে লাভ কী? তার চেয়ে ভালো হত না ইতিহাসে বিলীন হয়ে গেলে? অন্তত লোকে উপেক্ষার দৃষ্টিতে তাকাত না- ওর দিকে বা এই নদীটার পানে। তারা বরং কল্পনার রঙিন মায়াবী জাল বুনে চলত। গাঁথা হত অজস্র গল্প-কবিতার মালা। কেন অতীতে অর্ধেক প্রোথিত করে ওদেরকে ছেড়ে দেওয়া হল আধুনিক বাস্তবের নৃশংসতায়? কেন শ্যাম বা কূল, কোন কিছুই সে রাখতে পারছে না? কেন প্রাত্যহিক যন্ত্রণা তার নিত্য সঙ্গী? ওই নদীটাও সেই ঐতিহাসিক অবহেলার যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে, মানসিক যন্ত্রণায় চিৎকার করছে- কিন্তু কেউ শুনছে না, জানতে চাইছে না!
কেউই হারতে চায় না, কিন্তু হারতে হয়! বুকফাটা হাহাকারের মধ্যে অন্যদেরকে জায়গা করে দিতে হয়, নিজেকে সরিয়ে নিতে হয়, সাধারণত বাধ্য হয়ে যদিও।
কাল থেকে আবার শুরু হয়ে যাবে তার প্রাত্যহিক কর্ম। মুদি দোকান আর মাঝে মাঝে সুবিধামতন বিভিন্ন জিনিস স্টক করা তার ব্যবসা। তাতে কোনক্রমে কালাতিপাত হয় মাত্র। মনটা তার মাঝে মাঝেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে এই সিস্টেমের উপরে। কোথায় ছিল তার পূর্বপুরুষেরা, আর আজ সে কোথায়? শরিকি ঝামেলায় স্বাধীনতার আগেই তাদের ছেড়ে দিতে হয়েছিল সেই প্রাসাদ, তার পূর্বপুরুষদের স্থান। স্বাধীনতার পরে ভূমি সংস্কার আইনে ধীরে ধীরে ছাড়তে হল বিভিন্ন জায়গা-জমি। কত লোকে একই পরিবারের নানান জনের নামে আলাদা-আলাদা পরিবার দেখিয়ে অধিকাংশ জমি নিজেদের কাছেই রেখে দিল, কিন্তু ওরা পারেনি। উল্টে ওদের কতক জমি পরবর্তীতে আবার বেদখল হল।
আচ্ছা জমিও তো সম্পদ- টাকা পয়সার মতন, নয় কী?
লাঙ্গল যার জমি তার, এই স্লোগানে যদি কারুর জমি কেড়ে নেওয়া ন্যায্য বলে ধরা হয়, তাহলে কেউ যদি গায়ের জোরে ব্যাংক লুঠ করে, তাহলে সে কোন অন্যায়টা করছে? টাকা ও জমি- উভয়েই তো সম্পদ-একই মুদ্রার ভিন্ন দিক মাত্র। এসব ইস্কুলের অর্থনীতির বইতে ও বেশ পড়েছে।
“জোর যার সম্পদ তার!
দরকার যার, সম্পদ তার।”
তাহলে তাদের সেই সম্পদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ওরা পেল না কেন? কেন এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে ওরা ক্রমান্বয়ে গরীব থেকে গরীবতর হয়ে চলেছে?
কিন্তু…………।
আইন বানিয়ে তাঁরাই মজা দেখেন যাঁরা আইনের বলে ব্যক্তিগতভাবে নিজেরা বিপদে পড়বেন না। সেই ব্যবস্থা অন্তত করা থাকে।
ধীরে ধীরে অন্ধকারের তুলি বোলানো অরণ্যের ভিতরে ঢুকে পড়ল সে। জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে আসা চাঁদের হালকা আলোয় এগিয়ে চলল কিছুটা দূরের সেই ভগ্ন প্রাসাদের দিকে। আজ এক রাজা এগিয়ে চলেছে তার পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। অতীতের সাক্ষী আকাশের চাঁদ ওকে নিজে থেকেই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে।
(*)
-এস, আলোক ঝলমলে প্রাসাদের সিংহদ্বারে দাঁড়িয়ে গম্ভীরগলায় ওর পিতা বললেন, -আমরা কবে থেকে অপেক্ষা করে আছি, তুমি একদিন ঠিক আসবে।
তাঁর পিছনে সারিবদ্ধ হয়ে রাজবেশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আরও অনেকে। বাইরে থেকে ও ঠিক বুঝতে পারছিল না। তবে সংখ্যায় তাঁরা অনেক, সম্ভবত এই বংশের সকল পূর্বপুরুষ আজ উপস্থিত। সবাই মিলে একত্র হয়ে ওকে অভ্যর্থনা করার জন্যেই মনে হয় আজ এখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন।
-ভিতরে এস।
বলে বীরেনের পিতা নিজেই সরে গিয়ে ওকে প্রবেশের স্থান করে দিলেন। তাঁর পিছনে বাকিরা সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁরাও সারিবদ্ধভাবে একপাশে একটু সরে এলেন।
-এস তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। ওর পিতা ভরাট গলায় বললেন, -তারপরে আজ হবে তোমার সত্যিকারের রাজ্যাভিষেক। এবারে তোমার রাজত্ব তুমি নিজেই বুঝে নাও। এতকাল আমরা আগলে আগলে রেখেছি।
সকলে সারি দিয়ে তাঁদের জন্যে নির্দিষ্ট করা স্থানে এসে বসলেন। বীরেনের জন্যে একটা বিশেষ সিংহাসনের ব্যবস্থা করা ছিল। ওর পিতার ইশারায় ও সেখানে গিয়ে বসল। ওর পিতা ওর সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেন। জমকালো পোশাকের একজন এসে সিংহাসনের পিছনে দাঁড়িয়ে ওর মাথায় ধরলেন রাজকীয় ছত্র। প্রধান পুরোহিত এগিয়ে এসে ওর কপালে টিকা পরিয়ে দিলেন। শুরু হয়ে গেল ওর সত্যিকারের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান। নিকটেই একদল পুরোহিত মিলে সমবেত কণ্ঠে শুরু করে দিলেন মন্ত্রোচ্চারণ। পূর্বপুরুষেরা তাঁদের স্থান ছেড়ে সারিবদ্ধ হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বরণ করে নিলেন নিজেদের উত্তরাধিকারীকে।
-এই প্রাসাদের দায়িত্ব এবার থেকে তোমার, ওর পিতা কম্পিতস্বরে বললেন, -এবারে আমরা বিদায় নেব।
-আমি তাহলে কী করব? কুণ্ঠিতস্বরে ও জিজ্ঞেস করল।
-তোমার এখন অভিষেক হয়ে গেছে। তুমি আজ থেকে এখানেই থাকবে। আর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজ্য চালাবে।
-আপনারা?
-আমাদের সময় হয়ে গেছে। তোমাকে আমরা তোমার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিলাম। আজ থেকে আমাদের ছুটি। একটু পরে অমাত্য অতুলদেব এসে তোমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেবেন।
ধীরে ধীরে নীরবে তাঁরা সিংহদুয়ার দিয়ে প্রস্থান করলেন। তাঁদের সঙ্গে প্রস্থান করলেন পুরোহিতের দল, আর ছত্রধারী সেই ব্যক্তি।
(*)
-মহারাজ, সম্বিত ফিরতে ও চেয়ে দেখল রাজসভার উপযুক্ত পোশাক পরে একজন ব্যক্তি এসে দাঁড়িয়েছেন ওর সামনে। করজোড়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আদেশের অপেক্ষায় চেয়ে থাকলেন।
-কী সংবাদ, অমাত্য অতুলদেব? নিজের গম্ভীর, ভরাট কণ্ঠস্বরে বীরেন নিজেই চমকে গেল।
-চলুন মহারাজ, আপনাকে আমি রাজপ্রাসাদ ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিই।
-এখনই?
-হ্যাঁ, মহারাজ। অতুলদেব কিছুটা নত হয়ে বললেন, -আপনার পিতা সেইরকম আদেশই দিয়ে গেছেন।
-ঠিক আছে।
অতুলদেবের ইঙ্গিতে কয়েকজন সান্ত্রী এগিয়ে এল। তাদের মধ্যে দু’জনের সঙ্গে অতুলদেব আগে আগে চললেন, পিছনে আরও দু’জন সশস্ত্র রক্ষী ওদের অনুসরণ করল। অতুলদেব ওকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দ্বিতল সেই প্রাসাদের নিচের ও উপরের তলা দেখিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন পূর্বের সেই অভিষেক কক্ষে।
-মহারাজ, একটু বিরতি নিয়ে অতুলদেব বললেন, -এবারে আমরা যাব গোপন কক্ষে।
-গোপন কক্ষ? অবাক হয়ে বীরেন জানতে চাইল। ওর বাবা তো এই ব্যাপারে বলে যান নি।
-হ্যাঁ মহারাজ। অতুলদেব নত হয়ে গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, -এই প্রাসাদের গুপ্তকক্ষে কয়েকটি সিন্দুকে আপনার বংশের সব ধনদৌলত গচ্ছিত করে রাখা আছে। আমাকে বলা হয়েছে আপনাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে।
-চলুন।
একতলাতেই একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন অতুলদেব। বললেন,
-মহারাজ, এই কক্ষটিই আপনার মন্ত্রণাকক্ষ, সেটা কিছুক্ষণ আগেই আপনি জেনেছেন।
বীরেন সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
-এবারে দেখুন। আস্তে করে তিনি এগিয়ে গেলেন মন্ত্রণাকক্ষের সিংহাসনের সামনে, যেখানে আগামীকাল থেকে ও বসে থাকবে। তারপরে উনি সিংহাসনটিকে একপাশে বেশ কিছুটা সরিয়ে দিলেন। এরপরে সিংহাসনের নিচের গালিচা কিছুটা গুটিয়ে নিলেন। দেখা গেল মেঝেতে কিছুটা ফাঁক রয়েছে। নিচু হয়ে সেই ফাঁকা জায়গাতে হাত দিয়ে তিনি মেঝে থেকে অবলীলায় একটি বড় পাথরের খণ্ড সরিয়ে ফেললেন। তারপরে তার পাশের অনুরূপ আরেকটি পাথরও সরিয়ে নিলেন। প্রাসাদের আলোতে দেখা যাচ্ছিল নিচে চলে গেছে একটি ছোট্ট সিঁড়ি। সেটি নেমে গেছে এই কক্ষের নিচে একটি প্রায়ান্ধকার, গুপ্ত প্রকোষ্ঠে। অতুলদেব হাতে ক্ষুদ্র একটি মশাল নিয়ে ধীরে ধীরে সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন নিচের সেই কক্ষে। তারপরে ওকে আসতে অনুরোধ জানালেন। কৌতূহল ওরও বশ মানছিল না। ও অচিরেই নেমে গেল সেই কক্ষে। তাকিয়ে দেখল সারি সারি সিন্দুক রাখা নাতিদীর্ঘ সেই কক্ষটিতে। অতুলদেব ওকে সবকটি সিন্দুক খুলে খুলে দেখালেন, সিন্দুকের গুপ্ত প্রকোষ্ঠগুলিও বাদ দিলেন না।
“এ যে সাত রাজার ধন!” দেখা শেষ হলে পর ও প্রায় চিৎকার করেই বলতে চাইল, “আমাকে দেখে যাও ইন্দ্রাণী!”
তবে বলতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে ও নিজেকে সামলে নিল। কথাগুলো তাই নিজের মনে মনে বলল। আজ না ও আসল রাজা! আজ থেকে ও আর সাধারণ কেউ নয়। একজন রাজার বৈশিষ্ট্য তাঁর গভীর আত্মসংযম। এই বৃহৎ প্রাসাদ, এই মণিরাজি, রাশি রাশি এতসব নারায়ণী মুদ্রা- সকলই ওর সম্পত্তি। কেন এতদিন ও অবহেলায় ব্রাত্য করে রেখেছিল নিজের রাজপ্রাসাদকে? সেই অতুলনীয় সম্পদকে? আজ নিজেকে মনে হচ্ছে এই পৃথিবীর অন্যতম সুখী পুরুষ ও! এই প্রাসাদ ছেড়ে ও আর কোথাও যাবে না। ধীরে ধীরে পূর্বের সেই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এল ও, পিছন পিছন অতুলদেব। উনি স্থানটিকে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দিলেন। তারপরে ওকে নিয়ে এগিয়ে চললেন পূর্বের সেই অভিষেক কক্ষের দিকে।
-রাজন, ও অভিষেক কক্ষে আসা মাত্রই এক রক্ষী এগিয়ে এসে নত হয়ে করজোড়ে বললে, -মহারানী ইন্দ্রাণী আপনার অপেক্ষায় আছেন। তিনি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের অনুমতি চেয়েছেন।
-কোথায় তিনি? ভারিক্কী কণ্ঠে ও জানতে চাইল।
-তিনি এই মুহূর্তে অন্তঃপুরে আছেন মহারাজ।
-চল!
-মহারাজ, অতুলদেব বললেন, -আমি এইখানে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি। আপনি ফিরলেই আমি আপনাকে রাজকার্য বুঝিয়ে দেব। অন্যান্য অমাত্যগণ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বাইরে আপনার প্রতীক্ষায় আছেন।
-আমি শীঘ্রই ফিরে আসব। গম্ভীর কণ্ঠে ও উত্তর দিল, -তাঁদের ভিতরে নিয়ে আসুন।
দ্বিতলে অন্তঃপুর। এর আগে অতুলদেব দেখিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু ভিতরে নিয়ে যান নি কেননা তাঁর অন্তঃপুরে প্রবেশের অনুমতি ছিল না। তিনি ওকে প্রাসাদ চিনিয়ে দিচ্ছিলেন বলে বীরেন সেইসময়ে অন্তপুঃরে প্রবেশ করেনি। এবারে ও এগিয়ে গিয়ে পর্দা সরিয়ে অন্তঃপুরে প্রবেশ করল। ওকে মহারানীর কক্ষে ঢুকতে দেখে মহিলা রক্ষী ও মহারানীর সখীরা কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। কক্ষে প্রবেশ করে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে নিকটেই রাখা একটি পীঠিকায় ও বসল।
-মহারাজ, নিকটেই অন্য একটি পীঠিকায় বসে ছিল মহারানী ইন্দ্রাণী। বীরেনের স্বপ্নের সেই মেয়েটি। ইন্দ্রাণী কালক্ষেপ না করে ওকে জিজ্ঞেস করল, -আমার প্রস্তাবটা আপনি ভেবে দেখেছেন মহারাজ?
-কোন প্রস্তাব মহারানী?
-আমি কি আপনাকে নিত্যনতুন প্রস্তাব দিই মহারাজ? ইন্দ্রাণী তার তির্যক ভঙ্গী অব্যাহত রেখেছে। পরেও যা ছিল, আগেও তাই আছে ! গলা কিছুটা নামিয়ে সে বলল, -আমি কয়েকদিন আগে শুধু বলেছিলাম মহারাজ, দক্ষিণদিক থেকে শ্বেতাংগ বিদেশীরা এসেছে। তাদের সঙ্গে বাণিজ্য করে অনেকেই ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।
-আমি জানি মহারানী।
-মহারাজ, ইন্দ্রাণী বলল, -তাদের সঙ্গে বাণিজ্যে অচিরেই আপনার সম্পদ কয়েকগুণ হয়ে ফেরত আসবে।
-আমি অবহিত আছি মহারানী।
-মহারাজ, ইন্দ্রাণী বলল, -আপনি তো জানেনই আমার পিতা অমাত্য রাজেন্দ্র নারায়ণ আজকাল রংপুরেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
-আমি জানি, মহারানী। স্বাভাবিক গাম্ভীর্য ক্রমশ আরও বেশি করে ফুটে উঠছিল ওর গলায়, ওর আচরণে। বীরেন বলল, -তিনি সেখানকার এক গণ্যমান্য বণিক, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী।
-তিনি আপনাকে বিশেষভাবে সেখানে চেয়েছেন। বলেছেন স্থান প্রস্তুত, এইবারে সেখানে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দিলে পর সবদিক থেকেই মঙ্গল।
-কিন্তু আমার প্রজাদের ছেড়ে আমি যাব না মহারানী। গম্ভীরকণ্ঠে বীরেন বলল, -আমার রাজত্ব ছেড়ে আমি অন্যের আশ্রয়ে, বিদেশীর দয়ায় বাস করতে পারব না।
-ভেবে দেখুন রাজন, মিনতির সুরে ইন্দ্রাণী বলল, -ভূটান আর কুচবিহার সাম্রাজ্যের টানাপোড়েনের মধ্যে আমরা পড়ে আছি। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে ভূটান ও কুচবিহার সীমানায় আমাদের বসবাস। দু’জনের মধ্যে পড়ে আমাদের গতিক সুবিধের নয়। এই সামন্ত রাজ্যের সীমানা ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। যে কোনদিন আমাদের ধন-দৌলত কেউ লুঠ করে নিলে কিছুই করার থাকবে না। আর, বলে একটু বিরতি দিয়ে অস্বস্তিভরে ওকে দেখতে দেখতে ইন্দ্রাণী আস্তে করে বলে উঠল, -সম্পদ না থাকলে সে আবার কিসের রাজা?
-আমি জানি মহারানী। গম্ভীরমুখে বীরেন জবাব দিল।
-তাহলে আপনি যাবেন না? গ্রীবা ঈষৎ ঘুরিয়ে কটাক্ষে জানতে চাইল ইন্দ্রাণী।
-আপনি বুঝতেই পারছেন মহারানী।
-আমার অনুরোধ আরেকটিবার ভেবে দেখুন মহারাজ, ইন্দ্রাণী পুনরায় অনুনয়ের সুরে বলল, -এখানকার কোন ঝামেলা সেখানে নেই। বিদেশীদের শাসনে সুন্দর এক শান্তি বিরাজ করছে রংপুরে। পিতা বলেছেন বহিরাগত শ্বেতাংগরা আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখে থাকে। এবং সেখানে ব্যবসা করলে অতি দ্রুত আপনার সম্পদ দশগুণ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
-আমি আমার রাজত্ব, প্রজাদের ছেড়ে অন্যের আশ্রয়ে যাব না। দৃঢ় গলায় বীরেন বলল।
-এতে কিন্তু আপনার অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে মহারাজ। ইন্দ্রাণী শেষ বারের মতন অনুরোধ করল, -সেদিন আমার কী হবে, ভেবে দেখেছেন? চলুন আপনি আমার সঙ্গে।
-আমি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি মহারানী।
-তাহলে আমাকে বিদায় দিন মহারাজ। আপাত শক্ত গলাতেই নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল ইন্দ্রাণী।
-আমি নিরুপায় মহারানী।
-আমিও মহারাজ! ইন্দ্রাণী তার মাথা নামিয়ে নিল। সে আজ একটা হেস্ত-নেস্ত করবে বলে ঠিক করেই রেখেছিল। ক্রমাগত ভূটান ও কুচবিহার সাম্রাজ্যের মাঝে জাঁতাকলে পড়ে ওদের অবস্থা সুবিধের নয়। ফলতঃ ওর বাবা নিজের মেয়ের জন্যে সবিশেষ চিন্তিত। এবং সিদ্ধান্ত সে নিয়েই ফেলেছে। কিন্তু ওর আকণ্ঠ কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। নিজের স্বামীকে ছেড়ে সে কিভাবে চলে যাবে? কিন্তু গতিক সুবিধার নয়। তার বাবা নিজের মেয়ের জন্যে প্রতীক্ষায় আছেন। আর সেখানে আছে ধন ও জীবনের নিরাপত্তা। কোনরকমে সামলে নিয়ে মাথা নিচু করে দ্রুত সে নিজেকে আগত ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে ফেলল।
সেদিন ঘর্ঘরিয়া নদীর ঘাটে সন্ধ্যার বিলীয়মান আলোকে দাঁড়িয়ে অপসৃয়মান ইন্দ্রাণীর বজরা দেখতে দেখতে দৃঢ় সঙ্কল্পে মাথা নেড়েছিল বীরেন। ওর নিজস্বতা ও ছাড়তে পারবে না। আস্তে আস্তে শতাব্দী জাগরণের ক্লান্ত পায়ে ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে এল ও। ধীর পায়ে হেঁটে প্রবেশ করল সেই প্রাসাদে। স্থির পদক্ষেপে এগিয়ে চলল পূর্বের সেই অভিষেক কক্ষের দিকে। আর পৌছেই ও হাঁক পাড়ল,
-অতুলদেব, আমি এসেছি। আমাকে বিষয়কর্ম বুঝিয়ে দিন…………
পরদিন বীরেনের খোঁজে অনেক তল্লাশী চলেছিল। বিকেলের মধ্যেই চারিদিকে খবর ছড়িয়ে পড়ল, অভিশপ্ত বংশটির সুদীর্ঘ অধ্যায় অবশেষে চিরতরে সমাপ্ত হয়েছে।
……০……