“সর্বদেবাময়ীং দেবীং সর্বরোগ ভয়াপহাম্।
ব্রহ্মেশবিষ্ণুনমিতাং প্রণমামি সদা শিবাম্।। “
আমরা সেই দেবীর আরাধনা করছি যিনি সমস্ত দেবতাদের পুঞ্জীভূত তেজ থেকে সৃষ্টি। যিনি সমস্ত রোগ, ভয় দূর করেন। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর যাঁর কাছে নত হন, তাঁকে আমি আমার প্রণাম জানাই।
শিব পুরাণ অনুযায়ী সৃষ্টির শুরুতে একক পরমব্রহ্ম নিজের আধার থেকে তৈরি করেন মাতৃশক্তিকে। যে শক্তি তাঁকে কখনো ছেড়ে যাবেনা। শক্তিকে নাম দেন অম্বিকা। দুর্গম অসুর কে বধ করেছিলেন বলে মহাদেব তাঁর নাম রাখেন দেবী দুর্গা। তিনি ছিলেন ব্রহ্মার মানসকন্যা, বিষ্ণুর সুরক্ষিত বোন আর শিবের স্ত্রী। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে এই মাতৃশক্তিকে আমরা বারবার ফিরে পাই।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী সৃষ্টির আদিতে মহারাসমণ্ডলে কৃষ্ণ সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা করেন। এরপর দ্বিতীয়বার ব্রহ্মা, তৃতীয়বার মহাদেব এবং চতুর্থবার ইন্দ্র দুর্গার সাহায্য প্রার্থনা করেন। এছাড়া জাগতিক মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে ঋষি মান্ডব্য, হারানো রাজ্য ফিরে পেতে রাজা সুরথ এবং অবতার পরশুরাম দুর্গার আরাধনা করেন।
এই পূজাগুলি হয় বসন্তকালে। তাই বাসন্তী পূজা বলা হত। মধ্যযুগের কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে কালকেতু ব্যাধ ও বসন্তকালে দুর্গাপূজা করেন।
শরৎকালের রাবণ বধের জন্য দুর্গার আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন রামচন্দ্র। মা দুর্গার অকাল বোধন হয়। ১০৮ টির নীল পদ্মের জায়গায় ১০৭ টি পদ্ম জোগাড় হওয়ায় শ্রীরাম নিজের পদ্মপলাশের ন্যায় লোচন দেবীকে অর্পণ করতে গেলে দেবী স্বয়ং তাঁকে দেখা দেন এবং বরদান করেন। ইতিহাসে ফিরে তাকালে মেসোপটেমিয়া, ব্যাবিলন ও সিন্ধু সভ্যতায় দেবী শক্তির আরাধনার ইঙ্গিত আমরা পাই। মার্কেণ্ডেয় পুরাণ মতে চেদি বংশের রাজা সুরথ ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কলিঙ্গ বা বর্তমান উড়িষ্যায় দুর্গাপূজা শুরু করেন। মধ্যযুগে মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির দুর্গা ভক্তি তরঙ্গিনী তে দুর্গা বন্দনা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণ প্রথম জাঁকজমক সহ শারদীয়া দুর্গাপূজা শুরু করেন। তবে এই নিয়ে মতভেদ আছে। ১৭৯০ সালে হুগলি জেলার ১২ জন বন্ধু মিলে বারোয়ারি বা সার্বজনীন পূজা শুরু করেন। ইংরেজ আমলে অনেক জমিদার এবং ইংরেজ আধিকারিক দুর্গাপূজায় সামিল হতেন।
এত হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসের ধুলো সরিয়ে আজও যখন প্রতিমার সামনে পুজোর দিনে দাঁড়াই মাতৃত্বের নির্ভয় নিরাপদ আবরণ মনে করিয়ে দেয় ছেলেবেলার কিছু ছবি। আমার সুন্দরী, অভিজাত চেহারার দিদার হাতে ঝকঝকে কাঁসার থালা। দিদার বানানো লেসের ঢাকনা দিয়ে ঢাকা। তাতে আছে দুর্গা বরণের কিছু সামগ্রী। ঢাকনা তুলে নিলে দেখা যাবে দিদার হাতে বানানো ছাঁচে তৈরি ক্ষীরের সন্দেশ, তক্তি, মনগোল্লা। আর আছে বাড়ির বাগানে ফোটা স্থলপদ্ম, শিউলি, অপরাজিতা। দিদার পেছন পেছন চলেছি প্যান্ডেলে। বড় বড় ঘাস পেরিয়ে যাবার সময় শিশিরে ভিজে যাচ্ছে পায়ের নতুন জুতো। ফুলে ভরা শিউলি গাছ ঝাঁকাচ্ছি। অজস্র ফুল ঝরে পড়ছে চোখেমুখে। সুগন্ধে ভিজে যাচ্ছে সমস্ত চেতনা। সবুজ ঘাসে টাটকা ফুলের সাথে বিছিয়ে আছে আরও অজস্র পুরনো ফুলের মৃতদেহ। ম্লান হয়ে আসছে শরতের ঝলমলে আকাশ। দু-একটা কালো জলভরা মেঘ উঁকি মারছে। এবার পুজোয় বৃষ্টি হবে। পাঁজি অনুযায়ী দুর্গার আগমন হবে নৌকায়।
মহিষী মাতার পুত্র মহিষাসুরকে বধ করছেন দুর্গা। প্রতিমার সামনে দাঁড়ালে মাতৃত্বের আশ্বাসের সাথে সাথে এক নির্ভীক, নির্মম, তেজস্বী নারীশক্তিকেও খুঁজে পাওয়া যায়। চুল খোলা, হাতে কালজয়ী অস্ত্র। মনে হয় যেন মহাকালের শুরুতে কোন প্রাচীন যুদ্ধক্ষেত্রের থেমে যাওয়া এক মুহুর্তকে প্রতি বছর আমরা ফিরিয়ে আনি এই মর্ত্যে। দেবী ত্রিনয়নী বলে তাঁর নাম ত্র্যম্বক। বাম চোখ বাসনা বা চন্দ্র, ডান চোখ কর্ম বা শৌর্য, কেন্দ্রীয় চক্ষু জ্ঞান বা অগ্নি। প্রতীকী অস্ত্র দশ হাতে। ত্রিশূল সত্ত্ব, রজঃ আর তমোগুণের প্রকাশ। যুদ্ধের সময় দুর্গার ভ্রূযুগল থেকে তৈরি হন কালী।
শ্রীরামকৃষ্ণ বিবেকানন্দকে পাঠিয়েছিলেন মা কালীর কাছে বর প্রার্থনা করতে। বিবেকানন্দের নিজের কথায় – ” reaching the temple as I cast my eyes on the image, l actually found that the divine mother was living and conscious, the perennial fountain of divine love and beauty. I was caught in a surging wave of devotion and love.” (Page -31, Swami Vivekananda on himself)
প্রতি বছর অপেক্ষা করি সেই আদ্যাশক্তি মহামায়ার যিনি এসে বলবেন – “পৃথিবীতে ঘরে-বাইরে সব যুদ্ধ তোমরা থামিয়ে দাও। আর দেখো সমস্ত মানুষ যেন দুবেলা খেতে পায়। ”
মনে পড়ছে প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা একটি কবিতা “আগমনী” –
বর্ষা করে যাব যাব
শীত এখনো দূর
এরই মধ্যে মিঠে কিন্তু
হয়েছে রোদ্দুর
মেঘ গুলো সব দূর আকাশে
পারছেনা ঠিক বুঝতে
ঝরবে, নাকি যাবে উড়ে
অন্য কোথাও খুঁজতে !
থেকে থেকে তাই কি শুনি
বুক- কাঁপানো ডাক
হাঁকটা যতই হোক না জবর
মধ্যে ফাঁকির ফাক
আকাশ বাতাস আনমনা আজ
শুনে এ কোন ধ্বনি,
চির নতুন হয়েও অচিন
এ কার আগমনী।
………০………
অংকনঃ গুঞ্জা