ছবি – সোমক সেনগুপ্ত
শেফালির বিয়ের কথাটা মনে পড়লেই নৃপেন্দ্রশেখরের মুখটা তেতো হয়ে যায়, মেজাজ গরম হয়ে ওঠে।
প্রেমিকা শেফালি নৃপেনের সঙ্গে তাদের সাত বছর চার মাসের সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে দুম করে সূর্য পালিতকে বিয়ে করে বসে। সূর্য পালিত সরকারি হাসপাতালে অর্ডার সাপ্লাই এবং পৌরসভার ঠিকাদারি করে। নৃপেন তখনও কাঠ বেকার।
নৃপেনদের বাড়িতে আট বছরের বোনঝি মুল্কিকে নিয়ে বিয়ের নেমন্তন্ন করতে এসেছিল শেফালি। কার্ড দিয়ে দু’চারটে মামুলি ন্যাকান্যাকা কথা বলে বেরিয়ে যাবার সময় মুল্কি যখন নৃপেনদের উঠোনের কুলগাছের তলায় পড়ে থাকা কুল কুড়োতে খানিক ব্যস্ত সেই ফাঁকে শেফালি নৃপেনের ডান হাতখানা নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে আলতো চাপ দিয়ে গাঢ় নীচু গলায় বলেছিল, ” অবশ্যই যেয়ো কিন্তু। না গেলে খুউব মনখারাপ হবে। আর একটা বিশেষ অনুরোধ আছে, কোনও উপহার টুপহার নিয়ে যেয়ো না লক্ষ্মীটি। “
শেফালিরা চলে যাবার পর নৃপেন তার ডানহাত লাইফবয় সাবান দিয়ে ধুয়ে নেয়। তদুপরি সেই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে, বিয়েতে যাবে না।
কিন্তু বিয়ের দিন রাত সাড়ে আটটা নাগাদ নৃপেন ডিসিশন চেঞ্জ করে। রেডি হয়ে বেরিয়ে প্রথমেই বাজারে যায়। হরিমতি পুস্তকালয় তখন বন্ধ হবার মুখে। বাইরে ঝোলানো শোকেসটি ভেতরে ঢুকিয়ে শাটার নামানোটুকু বাকি। বেশি বাছাবাছির আর সুযোগ নেই। স্বামী গোকুলানন্দের লেখা ‘ সৎ ও নীতিনিষ্ঠ জীবনযাপনের পথনির্দেশ ‘ বইখানি কিনে পাশে মিত্যনের দোকান থেকে দু’টাকা দিয়ে একটি লাল কাগজে মুড়িয়ে নেয়। তার আগে বইয়ের ভেতরের পাতায় শুভেচ্ছাবার্তায় লেখে, ” স্নেহের সূর্য ও শেফালি, তোমাদের দুজনের জীবনেই এই বই দিশা দেখাবে এই শুভকামনায় — নৃপেনদা।”
শেফালিদের বাড়ির দোতলার ছাদে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয়েছিল। শেফালি সেজেগুজে বসেছিল একতলার টানা বারান্দায়। নৃপেনকে দেখে কপালে ঈষৎ বিস্ময় এবং কণ্ঠে ঈষৎ আদুরেপনার আভাস এনে বলে, ” ইস্ , এতক্ষণে বাবুর আসার সময় হল ! আমি সেই কখন থেকে… ” বাক্যটি শেষ না করেই কেজো গলায় বলে ওঠে, ” যাও,যাও আর দেরি কোরো না নেপুদা, বোধ হয় লাস্ট ব্যাচটা বসছে। তুমি ছাদে গিয়ে খেতে বসে যাও, আমি বিয়েতে বসতে চললুম।”
সিঁড়ির তলায় জুতো খুলে রেখে ছাদে খেতে গেছে সবাই। নৃপেন সেই রাশিকৃত জুতোর ভিড় থেকে একটু তফাতে জুতো খুলে ওপরে উঠে দেখে সেই লাস্ট ব্যাচও প্রায় শেষ হবার মুখে। মফস্বল শহরে মাঘ মাসের বিয়েবাড়ির খাওয়াদাওয়া তখন বেশি রাত পর্যন্ত গড়াতো না।
পরিবেশনের ছেলেদের একজন ব্যাজার বদনে নৃপেনের সামনে শালপাতা, প্লাস্টিকের গ্লাস ইত্যাদি নামায়। ঠান্ডা খাবার কোনওরকমে খানিকটা খেয়ে গ্লাসের জলের পুরোটা ঢকঢক করে শেষ করে নীচে নেমে এসে নৃপেনের আক্কেলগুড়ুম ! তার খুলে রেখে যাওয়া নতুন জুতোজোড়া উধাও ! বাইসাইকেল শ্যু, চটি ও জুতোর কম্বো রূপ। সেই বছরেই পুজোয় মনোহর শ্যু স্টোরে অর্ডার দিয়ে বানিয়েছিল। বৌদি দাদাকে লুকিয়ে আলাদা টাকা দিয়েছিল ওই জুতোর জন্য। নৃপেনের খুব শখের জুতো, বড্ড মায়া ও ভালোবাসা জড়িয়ে ছিল সে-জুতোতে। এই বিয়েবাড়ির আগে মাত্র দু’বার ব্যবহার করেছিল।
নীচে নেমে এসে নৃপেন দেখে, তার অত সাধের জুতোজোড়ার জায়গায় রাখা আছে ফিতেয় সেফটিপিন লাগানো একজোড়া পুরনো হাওয়াই চটি। গোড়ালির দিকগুলোয় রাবারের সাদা রং উঠে তলার নীল রং বেরিয়ে পড়েছে।
দেরি করে খেতে আসার জন্য পরিবেশনের ছোকরাদের কেউ কি প্রতিশোধ নিল ?
সেই জুতো হারানোর শোক নৃপেন আজও ভুলতে পারেনি। শেফালির মুখটা ভুলে গেছে।
কিন্তু শেফালির বিয়ের দিনটার কথা ভাবলে আজও নৃপেন্দ্রশেখরের মেজাজ গরম হয়ে ওঠে এবং তার আগে মুখটা তেতো হয়ে যায়।
………০………