“মা ,একটা পাখি বানিয়ে দাও নাআআ..” আহ্লাদী সুরে আবদার করল রেণু । মা মুচকি হেসে ব্যস্ত হাতেই আটার গোলা থেকে একটু আটা নিয়ে বানিয়ে দিলো ছোট্ট একটা পাখি। রেণু তো মহা খুশি। সব কাজ ফেলে পাখিকে নিয়ে খেলতে বসে গেল। খেলতে খেলতেই প্রশ্ন জুড়ল, “মা, ওর নাম কি?”
কাজ করতে করতেই সাড়া দিলো মা। বললো, “ওর নাম…ওর নাম হলো গিয়ে টুয়া”।
-“কিন্তু টুয়ার গায়ে যে রং নেই যে মা! রং ছাড়া কি পাখি হয়?”
মা বলল, ” চিন্তা কিসের? এই নে হলুদ গুঁড়ো। লাগিয়ে দে দেখি ওর গায়ে। দেখবি কেমন হলদে রঙের পাখি হয়ে যাবে।”
রেণু তাড়াতাড়ি হলুদের বাটিটা টেনে নিয়ে বসলো । তারপর সব কাজ ফেলে যত্ন করে ধরে ধরে রং লাগিয়ে দিল টুয়ার গায়ে। খুব সাবধানে একটা থালায় বসিয়ে টুয়াকে শুকোতে দিল বারান্দার ফাঁক গলে চলে আসা রোদের আলোয়।
বিকেল বেলা ঘুম ভাঙলো দিদির ডাকে, “এই রেণু, ওঠ। পাখিদের যে ঘরে ফেরার সময় হয়ে এলো। জানলা দিয়ে দেখ, পাখিরা কেমন ঘরে ফিরে যাচ্ছে। টুয়াকে নিয়ে দেখে আসি চল।”
সেই শুনে তড়াক করে ঘুম থেকে উঠেই রেণু ছুটল বারান্দায়। দেখলো, সত্যি তো, টুয়া কেমন একলা একলা চুপটি করে বসে আছে বারান্দার এক কোণে। বিকেলের কমলালেবু রোদ্দুরে পাখির গায়ের হলুদ রংটাও কেমন যেন চোখ বুজে আছে। রেণু বলল,”ইস, টুয়াও যদি ওদের মত ডানা মেলে উড়তে পারত, কি মজাই না হত!”
দিদি বলল, “সে কি করে হবে? টুয়ার কি প্রাণ আছে? ওতো আটার গোলা, খেলনা পাখি। চল, টুয়াকে নিয়ে ছাদে খেলতে যাই? এরপর তো সন্ধ্যে হয়ে যাবে!”
রেণু দিদির সাথে ছাদে উঠে দেখলো একটা হলুদ বেগুনি মৌটুসী পাখি ছাদের ওপর ঝুঁকে পড়া জাম গাছের ডালে একটু বসেই কোথায় যেন উড়ে গেল। মনে মনে ভাবলো রেণু, কি সুন্দর হলুদের ওপর নীল রঙের পালক। তাই না অত সুন্দর দেখায় মৌটুসীকে। আজই মাকে বলতে হবে টুয়ার গায়েও অমন দু-রঙা পালক বানিয়ে দেবার জন্য।
মায়ের কাছে নিচে গিয়ে বায়না জুড়তেই মা কাপড় কাচার নীল রঙ দিয়ে সুন্দর করে টুয়ার ঘাড়ে, মাথায় রং করে দিলো। বাড়ির সকলে দেখে বলল,” বাঃ, কিইই চমৎকার! এ যে সত্যি পাখি নয়, বোঝে সাধ্যি কার?”
রেণু তো তখন মহা খুশি। নেচে ঘুরে টুয়াকে নিয়ে বেড়াতে লাগলো চারদিক। এই করতে গিয়ে পাখির ঘাড়ের দিকে একটুখানি নীল রং কখন যেন বেখেয়ালে উঠে গেছে, লক্ষ্য করে নি রেণু। দিদি দেখতে পেয়ে বলল, “চিন্তা করিস না। আমি ঠিক করে দিচ্ছি। তুই বরং হয়ে যাবার পর ছাদে পুজোর ঘরের জানলার পাশে টুয়াকে রেখে আয়। রং না শুকোলে আর ধরিস না।”
-” কিন্তু দিদি, ওখানে তো পায়রার বাসা। ডিম রয়েছে দুটো। আমি আজও দেখেছি। মা পায়রাটা বসে রোজ ডিমগুলোতে তা দেয়। আচ্ছা দিদি, তা দেওয়া মানে কিরে? ”
-“মানে ডিমগুলোর ওপর বসে ডিমগুলোকে গরম রাখা যাতে ডিমের ভিতর পাখির ছানাগুলো আরাম করে থাকতে পারে আর সময় হলে ডিম ফুটে পুঁচকি পাখিগুলো বেরিয়ে এসে আকাশে উড়ে যেতে পারে।”
-“আচ্ছা, আমি তবে টুয়াকে ওই বাসার মধ্যে রেখে আসি এখনই। মা পায়রা যখন তা দেবে তখন ওর শরীরের গরমে টুয়ার গায়ের রঙও শুকিয়ে যাবে তাহলে। তারপরে আমরা টুয়াকে নিয়ে খেলবো। খুব মজা হবে তখন”, বলেই রেণু ছুটে গেলো ছাদের ঘরে।
সেদিন সারা রাত ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রেণু শুধু টুয়ার কথাই ভাবলো।
পরদিন ভোর হতেই রেণু ছুটল ছাদের ঘরে টুয়াকে দেখতে। গিয়ে দেখে পাখির বাসায় ডিমগুলো ফুটে ছোট্ট ছোট্ট দুটো পাখি জড়ামড়ি করে বসে আছে। মা পায়রা কোথাও নেই। আর হ্যাঁ, টুয়াও নেই কাছেপিঠে কোথাও। শুধু ছাদের ওপর ঝুঁকে পড়া জাম গাছের ডালে একটা হলদে নীল মৌটুসী পাখি একলা বসে দোল খাচ্ছে।
রেণু তো কাঁদতে কাঁদতে মাকে গিয়ে জানালো সব কথা। মা তখন আদর করে বললো, “ধুর বোকা মেয়ে, জামগাছের ডালে বসা পাখিটাই তো তোর টুয়া”।
রেণু চোখ মুছে বলল, “যাঃ, ও আবার উড়তে শিখল কবে?”
-“ওই যে মা পায়রার বুকের ওম। ওতে যে জাদু আছে রে রেণু… তাতেই তো প্রাণ পেয়েছে তোর টুয়া। মায়েদের ভালোবাসা যে এমনই হয়। সবসময় চিরকাল।”
……০……
অংকনঃ পুণ্যতোয়া