Home / গল্প / ট্রেনে বৃক্ষবপনকারী সেই লোকটি – নির্মাল্য ঘরামী

ট্রেনে বৃক্ষবপনকারী সেই লোকটি – নির্মাল্য ঘরামী

গল্প- নির্মাল্য ঘরামী
শিল্পী- সোমক সেনগুপ্ত

 

 

 

ভাবিনি যে ভদ্রলোকের সঙ্গে আবারও দেখা হয়ে যাবে। সেদিন যে কৌতূহলটা মনের মধ্যে জমা হয়েছিল, সংকোচে জিজ্ঞেস করতে পারিনি, আজ ঠিক করলাম সেটার নিরসন করতেই হবে।

-চিনতে পারছেন?

আলতো করে কথাটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলাম। এমনভাবে, যাতে উনি উত্তর না দিলে গায়ে না লাগে, আর কেউ কথাটা শুনতে না পায়। উনিও উদাসীনভাবে উত্তর দিলেন,

-সঠিক মানুষ বলেই মনে হয়েছে।

কী উত্তর! উনি যে চিনতে পারেন নি, সেই ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ হলাম।

 

(২)

বর্ধমান-তিনপাহাড় ট্রেনটায় ফিরছিলাম। সামনে বসা এক ভদ্রলোকও পরিবার নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। যাবেন মুরারই। তাঁর সঙ্গে টুক-টাক কথা হচ্ছিল। ইলেকট্রিসিটিতে কাজ করেন, সপরিবারে ভাড়ায় থাকেন বর্ধমানে। একমাত্র মেয়ে বারো ক্লাসে পড়ে। আমি কাউকে পরামর্শ দিতে কখনো পিছপা হই না। কথাপ্রসঙ্গে বললাম,

-তাহলে আগে থেকেই ট্রান্সফারের জন্যে চেষ্টা-চরিত্র করতে হবে।

-আসলে সমস্যা হল, ভদ্রলোক অনিশ্চিত গলায় বললেন, -মেয়েটা জয়েন্ট দিচ্ছে, জানি না এইবছরে ঠিকঠাক জায়গায় চান্স পাবে কিনা। পেলেও কোথায় ওকে যেতে হবে? আর না পেলে? আবার সামনের বছর বসবে? নাকি এইবারেই ভালো একটা কলেজ দেখে জেনারাল স্ট্রীমে ভর্তি করে দেব?

কথাটা ভাবার। আমরা হাসি-ঠাট্টা করে থাকি বটে, কিন্তু যার সমস্যা, তার চেয়ে ভালো করে কেউ সেটা জানে না, বোঝে না, ভাবে না।

-তাছাড়া কোলকাতায় থাকার জায়গা কী আর চাইলেই মেলে? খানিক বিরক্তিভরা হতাশ গলায় উনি বলে চললেন, -আমার জন্য তো আর কোয়ার্টার্স খালি করে রাখা নেই। সেই ভাড়া বাড়িই সম্বল। কিন্তু সেসব…………

কথা অসমাপ্ত রেখে আমাকে একঝলক মেপে নিলেন উনি। মনে হয় বুঝতে চাইছিলেন আমার রি-অ্যাকশন কী হতে পারে। কিছুক্ষণ ধরেই তাঁর সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলছিলাম। কয়েকবার তাঁদের থেকে চানাচুর, কাজু-বরফি খেয়েছি। একবার সবাইকে কফি অফার করেছিলাম, যদিও উনিই শুধু খেয়েছিলেন। তাই উনি মনে হয় কিছুটা হলেও ভরসা পাচ্ছিলেন।

-বোঝেনই তো, উনি আস্তে করে বলে চললেন, -ভালো জায়গায় ঘর খুঁজতে চাইলে, লোকে প্রথমে কী প্রশ্নটা করবে?

বলে উৎসুক চোখে আমার দিকে তাকালেন। বৌদি এতক্ষণ আলগোছে আমাদের কথা শুনছিলেন। এবারে তিনিও আমার দিকে কৌতূহলীমুখে চাইলেন। আমি চোখ কিছুটা নামিয়ে নিলাম। আমার অস্বস্তি দেখে আমার পরিচয় না বোঝার মতন বোকা তাঁরা নন। তবে একটু পরেই জোর করে অস্বস্তি কাটিয়ে মুখ তুলে ম্লান হেসে বললাম,

-ধর্ম।

-ঠিক।

 

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপই কাটল। প্রান্তিক স্টেশন থেকে ছেড়ে ট্রেনটি তখন কোপাই নদীর ব্রিজ পেরোচ্ছিল। আষাঢ়ের মেঘে ঢাকা আকাশ। তবে বৃষ্টি পড়ছিল কমই। ঈষৎ ঢেউখেলানো মাঠে কৃষকেরা ব্যস্ত কৃষিকাজে। ট্রেনের সীটে হেলান দিয়ে অলস ভাবে বসে তাদের সেই কর্মব্যস্ততা দেখতে মন্দ লাগছিল না।

-জানেন, সেই ভদ্রলোক যেন গোপন কোন কথা বলছেন, এমন ভঙ্গীতে চারিদিকে একটু তাকিয়ে চাপা গলায় বললেন, -লোকে ভাবে আমাদের লোকজন নিজেরা নিজেদের খুব দ্যাখে।

‘লোক’ মানে কারা, তা অবশ্য বুঝতে বাকি থাকল না। তবে এরকম একটা সরব অভিযোগ বেশ রটে আছে বাজারে।

-আমাদের কম্যুনিটির এক সিনিয়র অফিসার সেবারে ছিলেন আমাদের বস। লোকে বলে তিনি নাকি সাক্ষাৎ দেবদূত। কাউকে ফেরান না। কিছু না কিছু উপকার করে ছাড়েন, অন্তত চেষ্টা করেন। আমিও একদিন একটা আর্জি নিয়ে গেলাম তাঁর কাছে।

বলে বিরস বদনে চুপ করে গেলেন। আমি অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কী হয়েছিল, সেটা শুনতে খুব কৌতূহল হচ্ছিল। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,

-জাস্ট না করে দিলেন। শুধু তাই নয়, সামান্য একটা কারণে কেন আমি কাজ ফেলে তাঁর কাছে এসেছি, সেই নিয়ে দিলেন খুব একচোট দাবড়ানি। মাথা নিচু করে আমি বেরিয়ে এলাম। উনি উপরতলার লোক। তাঁর কাছে বিষয়টা সামান্য হলেও আমার কাছে সেটার গুরুত্ব অনেক। বুঝলাম আমার অনুরোধ রাখলে লোকে তাঁকে অন্যরকম ভাবতে পারে, সেই ভয়ে তিনি আমাকে ভাগিয়ে দিলেন।

 

ট্রেনটা তখন বাতাসপুর স্টেশন ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা এগিয়েছিল। স্পীড কমে আসছে ট্রেনের কেননা সিউড়ির দিকের লাইন এসে এখানে মিশেছে। সামনেই সাঁইথিয়া জংশন। হঠাৎ যেন ট্রেনে একটা প্রলয় বয়ে গেল।

নিমেষে!

“ক্ল্যাং” করে বিকট একটা শব্দ হল। পরক্ষণেই সেই ভদ্রলোক মাথা চেপে ধরে বসে পড়লেন নিচে। অচিরেই ট্রেনের মেঝেতে শুয়ে পড়লেন। একটা পাথর দেখা গেল তাঁর বসার জায়গায়। বুঝলাম কেউ শয়তানি করে বাইরে থেকে ছুঁড়েছে। এদিকে প্রবল যন্ত্রণায় তখন সেই ভদ্রলোক মাথার ডান দিকটা হাত দিয়ে চেপে ছটফট করছেন, সেখানটা থেকে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত, প্রথমে কিছুটা, পরে অনেকটা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাঁর স্ত্রী আতংকে চিৎকার করে উঠলেন। ঠিক সেই সময়েই এগিয়ে এসেছিলেন পূর্বে দেখা সেই ভদ্রলোক। যেন দেবদূতের মতন হাজির হলেন বলেই মনে হল।

-দাঁড়ান, ক্ষতস্থানটা আগে বাঁধুন।

বলতে বলতে প্যাসেজের অন্য দিকের সিট থেকে এগিয়ে এলেন তিনি। আমি আগে তাঁকে খেয়াল করিনি। তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে এসে পকেট থেকে নিজের রুমালটা বের করে দ্রুতহাতে বেঁধে দিলেন ক্ষতস্থানে।

-ঘাবড়াবেন না। তবে এখানেই ট্রেন থেকে নেমে যেতে হবে।

-ট্রেন থেকে নেমে স্ট্রেচারের ব্যবস্থা করব?

আমি জিজ্ঞেস করলাম। নিজের উপরে ক্রমশ কর্তৃত্ব ফিরে পাচ্ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন,

-আপনি বরং নেমে স্টেশন মাস্টারের কাছে খবর পাঠান। ট্রেনটাকে দাঁড় করাতে হবে। আর দিদি, সেই ভদ্রমহিলাকে উনি বললেন, -তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিন। দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। চিন্তা করবেন না, হাত নেড়ে আশ্বাস দিয়ে বললেন, -সাঁইথিয়ায় একটা ভাল সরকারী হাসপাতাল আছে। কিছুদিন হল আপগ্রেড হয়েছে।

আশ-পাশ থেকে আরো লোকজন চলে এসেছিলেন। তাঁরাও অনেক সাহায্য করলেন। পরোপকারী সেই ভদ্রলোকই দ্রুতপায়ে বাইরে বেরিয়ে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সেটাতে চড়ে বসলেন। সাঁইথিয়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালে পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না। দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

 

গল্প/ নির্মাল্য ঘরামী
শিল্পী- সোমক সেনগুপ্ত

 

আমি হাসপাতাল ক্যাম্পাসে একটা শিমূল গাছের বেদীতে বসে ছিলাম। বৌদি, তাঁর মেয়ে ও সেই পরোপকারী ভদ্রলোক আহত ব্যক্তিকে নিয়ে ভিতরে গেছিলেন। আমি শুধু ভাবছিলাম, হঠাৎ করে ভগবানের মতন যেন উনি উদয় হলেন। এর আগের দিনও উনিই যেচে সেই মহিলার উপকার করে দিয়েছিলেন। ভাবনাজাল ছিন্ন করে হঠাৎ সেই পরোপকারী ভদ্রলোক আমার সামনে উদয় হলেন, সঙ্গে আহত ভদ্রলোকের মেয়েটি ও অচেনা দু’জন ভদ্রলোক।

-শুনুন, সেই পরোপকারী ভদ্রলোক আমাকে বললেন, -উনি ঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছেছেন। আর কোন চিন্তা নেই।

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। মনে হয় অল্পের উপর দিয়ে গেছে।

পাশ থেকে সেই দু’জন ভদ্রলোকের মধ্যে থেকে একজন বললেন,

-আপনারা আজ যা করলেন, ভুলতে পারব না।

কৃতজ্ঞতার স্পষ্ট ছাপ ছিল সেই গলায়। শুনলাম যে তাঁরা এই ভদ্রলোকের আত্মীয়। সাঁইথিয়া শহরেই থাকেন। মোবাইলে খবর পেয়ে তড়িঘড়ি করে এসে পৌঁছেছেন। তাঁরা আমাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। পরোপকারী সেই ভদ্রলোক তাঁর নাম বললেন “চিরঞ্জীব তুরি।” শুনে আমি চমকে উঠলাম। যাইহোক এরপরে সেই দু’জন ভদ্রলোক আমাদের নিয়ে গিয়ে একটা দোকানে খাইয়ে-দাইয়ে স্টেশনে এসে ট্রেনে তুলে দিলেন। উনি যাবেন পাকুড়, আমি রামপুরহাট। কিছু পরে একটা ট্রেন এল। ট্রেনে বসেই আমি জিজ্ঞেস করলাম,

-দাদা, আপনার নাম কিন্তু সেবারে অন্যরকম শুনেছিলাম বলে মনে হচ্ছে।

নিঃশব্দে হাসলেন উনি, কিন্তু আর কিছুই বললেন না। জিজ্ঞেস করলাম,

-কী করেন আপনি? আর কেনই বা বারে বারে নিজের পরিচয় পালটে ফেলছেন?

 

(৩)

কিছুদিন আগে শিয়ালদা যাওয়ার জন্য আজিমগঞ্জ-শিয়ালদা ভায়া রামপুরহাট ট্রেনটা ধরেছিলাম। সেদিন আমার পাশে এই ভদ্রলোক বসে ছিলেন। তখনও তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়নি। বরং আমার সামনে বসে থাকা একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলার সঙ্গে পরিচয় হল। জিজ্ঞেস করলাম,

-কোথায় নামবেন দিদি?

-নৈহাটি।

আমি অবাক হলাম। ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হচ্ছিল যে তিনি কোলকাতার বা শহরতলীর দিকের নন। অন্তত উচ্চারণ তো নয়ই। দিব্যি উত্তর রাঢ়বাংলার টানে কথা বলছেন। মনে হয় উনি আমার মনের কথা অনেকটা বুঝতে পারলেন। সহজভাবেই বললেন,

-আমরা নৈহাটিতেই থিতু হয়ে গেছি। এখন গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরছি।

-আচ্ছা।

হালকা কৌতূহলের সঙ্গে কথাটা বললাম, যাতে উনি আমার কথা শুনে উৎসাহ পান, বিরক্ত না হন।

-মেয়ে কোলকাতাতেই পড়ে। উনি বলে চললেন, -ছেলেটা পুণেতে আছে, একটা সফটওয়্যার ফার্মে, ফিরবে বলে মনে হয় না। আর এদিকে থেকে কী করব? তাছাড়া……

বলতে বলতে উনি থমকে গেলেন। কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কোথায় যেন সংকোচ হচ্ছে ওনার। তাই ইতস্ততভাবে চুপ করে গেলেন উনি। বুঝি যে সব কথা সব জায়গায় বলার নয়। কিন্তু আমার কৌতূহলটা যে অন্যের পক্ষে বিরক্তিকর, প্রায়শই সেই হুঁশ আমার থাকে না।

-ছেলে কি ফ্যামিলি নিয়ে সেটল করে গেছে পুণেতে?

-হ্যাঁ। এবারে মেয়েটা’র গ্র্যাজুয়েশন হয়ে গেলে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে।

-আপনাদের গ্রামের দিকেই তো থাকতে পারতেন। আমি বললাম, -ছেলে ফিরবে না, মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে, আপনাদের দু’জনকে দেখার সেভাবে কেউ থাকবে না। আর কোলকাতার দিকে কে, কাকে চেনে? সেখানে আত্মীয়দের পর হতে বেশি সময় লাগে না।

-তা হয়তো থাকতে পারতাম ভাই। উনি কিন্তু কিন্তু করে বললেন, -আসলে…

বলে সংকোচে চুপ করে গেলেন। কথাবার্তা খোলাখুলিই বলছিলেন, কিন্তু মনে হল কিছু চেপে যেতে চাইছেন।

-আমাকে বলতে পারেন দিদি, আমি ভরসা দেওয়া স্বরে বললাম, -যদি না একান্ত ব্যক্তিগত হয়।

-আসলে, বলে আমাকে ও পাশের সেই ভদ্রলোককে একবার উনি দেখে নিলেন। তিনি তখন চোখ বুজে ছিলেন। হয়তো বা তন্দ্রাচ্ছন্ন। খানিক আশ্বস্ত হয়ে আস্তে করে বললেন, -বেশ কিছুদিন আগে কোলকাতায় একটা মোমবাতি মিছিল হয়ে গেল, মনে আছে?

-কোনটা দিদি?

-আরে সেই যে একটা ছেলে অন্য ধর্মীয় একটা মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিল। মনে পড়ছে?

-সমস্যাটা হল, উনি কিছুটা আশ্বস্ত হলেও ইতস্তত করছিলেন। একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমি আগ্রহের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম তাঁর দিকে। উনি সংকোচ ঝেড়ে ফেলে বললেন, -আসলে এরকম একটা ঘটনা আমাদের গ্রামের দিকেও ঘটে গেল।

-তাই? আমি কৌতূহলী হয়ে উঠছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, -তা কী হল?

-কোলকাতায় যেটা ঘটেছে, অনেকটা সেইরকমই ঘটল, তবে বিপরীত ধরনের ঘটনা।

-তা আপনারা সেটা নিয়ে নিশ্চয়ই খুব আন্দোলন করলেন? আমি কৌতূহলী মুখে জিজ্ঞেস করলাম, -এরকম একটা বর্বরতা ঘটে গেল, কেউ নিশ্চয়ই মুখ বুজে মেনে নেয় নি?

-কে প্রতিবাদ করবে ভাই? উনি হতাশার ভঙ্গীতে বললেন, -ওদিকে আমাদের সংখ্যা বড় কম। নেহাত শহর বা গঞ্জগুলোতেই যা একটু প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে। তা, কিচ্ছু হল না। সবাই আতঙ্কিতমুখে চুপচাপ মেনে নিল। উনি চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলে চললেন, -একদিন ওঁর সঙ্গে অনেক আলোচনা হল। মেয়ে পরের বছর উচ্চমাধ্যমিক দেবে, সোমত্ত মেয়ে। এদিকে এলাকার পরিবেশ ভালো ঠেকছে না।

-সেই। আমি সহানুভূতিসূচক ঘাড় নাড়লাম।

-তা, উনি বলে চললেন, -ঠিক করলাম আমরা কোলকাতার দিকে চলে যাব। আমাদের কয়েকজন আত্মীয়-পড়শি সেদিকেই চলে এসেছেন। অসুবিধে ওনার। ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে আরেক জায়গায় জমিয়ে বসা চাট্টিখানি কথা নয়।

-মন বসেছে তাহলে নতুন জায়গায়? আমি হালকা হেসে জিজ্ঞেস করলাম।

-সে কি আর হয় গো ভাই? উনি খানিক আহতস্বরে বললেন, -পূর্বপুরুষের জমি-বাড়ি ছেড়ে নতুন জায়গায় যাওয়া কি যে সে কথা?

দেশ ভাগ হয়েছে, কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিভাজন কমেনি। নিরন্তর সেটা বেড়েই চলেছে। তাহলে দেশ ভাগ করে কী লাভ হল?

 

ভদ্রমহিলা উঠে মনে হয় বাথরুমের দিকে গেছিলেন। ফিরে সবে তাঁর সীটে বসতে যাবেন, ট্রেনটা বিচ্ছিরিভাবে দুলে উঠল। সামলাতে না পেরে উনি ব্যালান্স হারিয়ে জানালার উপরে এসে পড়লেন। তাঁর ডান হাতটা সজোরে ঠুকে গেল জানালার রডে।

-আহহ!

যন্ত্রণায় উনি চিৎকার করে উঠলেন। কোনরকমে নিজেকে সামলে সীটে বসে যন্ত্রণাকাতর মুখে উনি নজর দিলেন কনুইয়ের দিকে। মনে হল না ভাঙলেও ভালই চোট লেগেছে তাঁর হাতে।

-দেখি দিদি।

আমার পাশ থেকে সেই ভদ্রলোক বললেন। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল যে উনি ঘুমোচ্ছেন। কিন্তু আমার বা আমাদের আন্দাজ হয়তো সঠিক ছিল না।

-না ভাঙেনি।

কনুইটার অবস্থা দেখে নিয়ে উনি বললেন। তারপরে সহসা প্যাসেজের দিকে মুখটা বাড়িয়ে চিৎকার করে ডাক দিলেন,

-এই বরফ! তাড়াতাড়ি এস তো দাদা।

হকার লোকটি খানিক আগেই ঘুরে গিয়ে ওদিকে মনে হয় বসে ছিল। সে এলে পর তার থেকে দু’টি বরফ কিনে উনি এগিয়ে দিলেন সেই ভদ্রমহিলার দিকে। সেটা তাঁর কনুইতে ভাল করে ধরে থাকতে বললেন। ভদ্রমহিলা বেশ অনেকক্ষণ সেগুলো ভালো করে বোলালেন। বোঝাই যাচ্ছিল যে একটু আরাম পেয়েছেন।

-এই নিন দিদি, সেই ভদ্রলোক তাঁর পকেট হাতড়ে দু’ধরনের ট্যাবলেট বের করে তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, -খেয়ে নিন। ব্যথার আর গ্যাসের। ব্যথাটা কমবে।

ভদ্রমহিলা কৃতজ্ঞতাপূর্ণ চোখে বাঁহাতে সেগুলো নিয়ে মুখে ফেলে দিলেন। তারপরে নিজের জলের বোতল টেনে নিয়ে জল ঢাললেন গলায়।

-আপনি কোথায় নামবেন? সেই ভদ্রলোক বললেন, -নেমে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন।

-নৈহাটি।

-দাদা কী স্টেশনে আসছেন? ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, -এই অবস্থায় এত এত মালপত্র নিয়ে বাড়ি পৌঁছবেন কিভাবে?

-না ভাই। মাথা নাড়লেন দিদি। বললেন, -উনি ব্যবসার কাজে ঘাটশিলা গেছেন। মেয়ে গেছে এক আত্মীয়ের বাড়ি। তবে আশা করি কুলি পেয়ে যাব।

-স্যরি দিদি, সেই ভদ্রলোক বললেন, -নৈহাটিতে সবসময় কুলি পাওয়া যায় না।

-তাহলে? ব্যথা কমলেও দিদি চিন্তায় পড়ে গেলেন।

-আমি যদিও শিয়ালদা’তে নামব, সেই ভদ্রলোক ভাবলেশহীন মুখে বলে চললেন, -তবে আপনার এই অবস্থার কথা চিন্তা করে আমি নৈহাটিতেই ট্রেন থেকে নেমে আপনাকে বাক্স-প্যাঁটরা সমেত রিক্সায় তুলে দিয়ে তবেই অন্য ট্রেন ধরব।

-আপনার বাড়ি কোথায় ভাই?

-কোলকাতার একবালপুরে।

বলে তিনি ভদ্রমহিলার দিকে ভালো করে তাকালেন। দিদির মুখ দেখে বুঝতে পারলাম যে জায়গাটা উনি চেনেন না। ভদ্রলোক মনে হয় নিজের পরিচয় দেওয়ার জন্য ব্যগ্র ছিলেন। তাই দিদি আর কিছু জিজ্ঞেস না করা সত্ত্বেও উনি বললেন, -আমার নাম মহম্মদ ফারুক। একবালপুর জায়গাটা দক্ষিণ কোলকাতায়।

দিদির দিকে দ্রুত আমার দৃষ্টি চলে গেল। উত্তর শুনে উনি একেবারে গুটিয়ে গেছেন। সংকুচিত হয়ে গেছেন আচম্বিতে। তবে বরাভয়ের ভঙ্গীতে হাসলেন এই ভদ্রলোক, পূর্বের সেই নির্বিকার আচরণ ঝেড়ে ফেলে। বললেন,

-চিন্তা করবেন না। আমাকে আপনার ভাইয়ের মতন ভাবতে পারেন। আপনাকে তুলে দিয়ে তবে আমি রওনা দেব। এই অবস্থায় আপনাকে ছাড়ি কী করে?

তাঁর গলায় নিশ্চয়তার আভাস শুনে নিশ্চিত হয়েছিলাম সেদিন।

 

(৪)

সেদিন উনি নিজের নাম বলেছিলেন “মহম্মদ ফারুক।” আর আজ সাঁইথিয়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালের চৌহদ্দিতে দাঁড়িয়ে নাম বললেন “চিরঞ্জীব তুরি।” আমি ঠিক মেলাতে পারলাম না। তাহলে? এদিকে হাতে সময় বেশি নেই। একটু পরেই রামপুরহাটে আমি নেমে যাব।

কী করেন উনি?

কেনই বা বারে বারে নিজের পরিচয় পাল্টাচ্ছেন?

হেঁয়ালি করছেন কেন?

আমার প্রশ্ন শুনে উনি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চুপ করে থাকলেন। নিজেকে মনে হয় একটু গুছিয়ে নিলেন।

-জানেন, উনি বলে চললেন, -ফ্রয়েড একটা কথা বলেছিলেন, মানুষের চেতনায় যুক্তির চেয়ে কুযুক্তির স্থান বেশি। বড় হয়ে উপলব্ধি করলাম কথাটা কতটা সত্যি। কে বা কারা কবে কী বলেছে, করেছে, সেই নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ, সন্দেহ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।

উত্তেজনায় চোখ বন্ধ হয়ে এল সেই ভদ্রলোকের। আবেগমথিত স্বরে তিনি বলে চললেন,

-পারস্পরিক সন্দেহের যে বিষ বাষ্প সৃষ্টি হচ্ছে, ভালো কোন কাজের মাধ্যমে তাকে শুষে নেওয়ার চেষ্টা করে থাকি মাত্র। আপনারা শুধু বাহ্যিক পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ করতে গাছ লাগিয়ে থাকেন। আর আমি মানসিক পরিবেশ দূষণ রোধ করতে সহাবস্থানের যে বীজ বপন করি, যেটা কেউ চিন্তাও করে না। ট্রেনে, স্টেশনে প্রচুর লোক থাকে। এখানে একটা ছোট ঘটনাতেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। তাই আমি কাজের জন্য রেলকেই মূলত বেছে নিয়েছি।

 

আমি গন্তব্যে নেমে গেলাম। একটু পরেই ট্রেনটা ছেড়ে দিল। চারিদিকটা হঠাৎই যেন কেমন দমবন্ধ লাগছিল। প্রাণান্তকর এই পরিবেশে একটু মানসিক অক্সিজেনের বড়ই অভাব অনুভব করছিলাম। মানসচক্ষে দেখলাম সেই প্রয়োজনে এই সাম্প্রদায়িক রোদ্দুরে এক ব্যক্তি সম্প্রীতির বীজ নীরবে বপন করে চলেছেন- ট্রেনে, স্টেশনে, জনারণ্যে, যাঁর আসল পরিচয় আমি জানি না!

+++++++++

অংকনঃ সোমক সেনগুপ্ত

Leave a comment

Check Also

স্বীকারোক্তি

স্বীকারোক্তি- ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য্য

    আজই ফোনটা ডেলিভারি দিয়ে গেলো। অনলাইনে একবার দেখেই ভারি পছন্দ হয়ে গেছিল সমীর …

দর্পণে

দর্পণে – নির্মাল্য ঘরামী    

    -চল, আমি জোরের সঙ্গে বললাম, -ওসব একদম ভাবিস না। তোকে এতদিন পরে পাচ্ছি, …

ফয়সালা

ফয়সালা – নির্মাল্য ঘরামী

  -দেখুন স্যার। বলে সিকিউরিটি গার্ডটি বিজয়ীর দৃষ্টিতে মহাকুলসাহেবের দিকে তাকালো। তার হাতে ধরা ব্যাগটির …

রক্তগোলাপ/ মৌসুমী পাত্র/ পুণ্যতোয়া ধর

রক্তগোলাপ – মৌসুমী পাত্র

  একটা মোটা দড়ি থেকে পাশাপাশি ঝোলানো সারি সারি মৃতদেহ। ছাল ছাড়ানো। গত কদিন ধরেই …