Home / বাঘু সিরিজ / বাঘুর ল্যাজলজ্জা – মৌসুমী পাত্র

বাঘুর ল্যাজলজ্জা – মৌসুমী পাত্র

বাঘুর ল্যাজলজ্জা/ শিল্পী- গুঞ্জা
শিল্পী- গুঞ্জা

 

 

          গতকালের আগুনঝরা গরমটা আজ অনেকখানি নরম। দুপুরবেলাতেই দমকা কালবৈশাখী এসেছিল আকাশ কালো করে। তার সঙ্গে  পাল্লা দিয়ে তুমুল বৃষ্টি। আকাশের সেই রাগী সূর্যস্যার তো ভয়েই কোথায় লুকিয়ে পড়লেন সঙ্গে সঙ্গে। বাতাসের আওয়াজ তো নয়, যেন সমুদ্রের গর্জন। গাছপালাদের মাথারা সমানে দুলছে এপাশ ওপাশ- যেন সেই সমুদ্রের ঢেউ। প্রচণ্ড শব্দে ডালপালা ভেঙে পড়ছে এদিক সেদিক, পাখিরা তাদের বাসায় বসে কাঁপছে থরথর। সন্ধের অন্ধকার নেমে এসেছে বিকেলবেলায়। বাতাসের অবিশ্রাম সোঁ সোঁ শব্দ, তার সঙ্গে হাওয়ার প্রবল হাওয়ার ঝাপট। মাঝে মাঝেই আকাশের বুক এঁফোড় ওফোঁড় করে দেওয়া চোখধাঁধানো আলোর রেখা আর তার পরপরই কান ফাটানো বিদ্যুতের শব্দ।

          আজ আবহাওয়া ভারি মনোরম। রোদের তাপ নেই। ঠাণ্ডা একটা হাওয়া হেসেখেলে বেড়াচ্ছে আপনমনে। গতকালের ঝড়বৃষ্টিতে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, কনকচূড়া, কাঠগোলাপ ফুলে আর হরেক রকম পাতায় ছেয়ে আছে জঙ্গলের মাটি। ঝড়ে বিস্তর আমও পড়েছে এদিক সেদিক।

          হাতুশি এপাশ ওপাশ চোখ চালিয়ে ইতিউতি পড়ে থাকা আম শুঁড়ে করে কুড়োতে কুড়োতে চলছিল পাঠশালার পানে। কাল বৃষ্টি হয়েছে বলেই কিনা কে জানে, ঝিঁঝিঁপোকারা আজ মনের সুখে গান ধরেছে তারস্বরে। হাতুশিও তাদের সুরে তাল মিলিয়ে গুনগুনিয়ে উঠল, “ঝিঁঝিঁপোকায় ধরেছে তান, আম খাই ভরে প্রাণ!”

          একটা বড়োসড়ো আম দেখে হাতুশি সবে সেটাকে শুঁড় দিয়ে তুলতে গেছে, এমন সময় হলুদ-কালো লেজের এক ঝটকা। হাতুশি কোনমতে আমখানাকে সামলে নিয়ে দ্যাখে, বাঘু সামনেই কোমরে থাবা দিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে। বাঘুর গলার স্বর চড়া, “অ্যাইয়ো হাতুশি, আমটা আমি আমার লেজ দিয়ে ছুঁয়ে দিয়েছি। ওটা আমার। আমাকে দে, দে বলছি।”

          হাতুশি আমটাকে পত্রপাঠ থলের মধ্যে চালান করে বলল, “ভারি তো তোর লেজ রে! তার আবার ছোঁয়া? মামাবাড়ির আবদার, না?”

          বাঘু হাতুশির থলে ধরে টানতে টানতে বলল, “মামাবাড়ির আবদার না পাঠশালার আবদার, সে তুই এখনই বুঝবি!”

          হাতুশিও কি কম যায়? বাঘুর লেজ ধরে পাঁইপাঁই করে পাঁচ পাক খাইয়ে লেজখানাকে পেঁচিয়ে বাঘুকে তুলল পিঠে। তারপরই দে-দৌড়! সোজা পাঠশালা।

বাঘুর বক্তিমে লম্বাচওড়া হলে কী হবে, আসলে তো বেজায় ভীতু! ভয়ের চোটে আঁকড়ে ধরে আছে হাতুশিকে। যেদিক দিয়ে হাতুশি ঢুকছে, তার ঠিক উল্টোদিক দিয়ে তখন ঢুকছে শিয়ালনী। দিদিমণিকে দেখেই হাঁউমাঁউ করে উঠছে বাঘু, “ও দিদিমণি গোওওওওও! হাতুশি আমার কী হাঁড়ির হালটাই না করেছে গোওওওওও! আমার অত সাধের লেজখানা শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছে গোওওওও!”

          শিয়ালনী ভুরু কোঁচকাল, “অমন তো হবার কথা নয়, বাঘুবাবু! নিশ্চয়ই তুই কিছু করেছিলি! নইলে ও শুধুশুধু অমন করবার মেয়ে নয়! কী করেছিলি, বল?”

          হাতুশি ধপাস করে দিদিমণির সামনে নামাল বাঘুকে। তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে বলল সব। শুনেটুনে বলল শিয়ালনী, “যেমন কর্ম, তেমন ফল; যেমন মেঘ, তেমন জল!”

          তাই শুনে কাঁইমাঁই বেজায় জুড়ল বাঘু, “দিদিমণি, আমার লেজের প্রতি আপনার এট্টুও মায়া নেই! আমি লেজব্যথায় কাতর, দিদিমণি!”

          “ও! লেজব্যথায় কাতর! ইসস, খুব ভালো বাংলা শিখেছিস দেখছি! তাও যদি না আগের পরীক্ষায় পঁচিশে দশ পেতিস!”

          বাঘুর হেলদোল নেই, “সে তো দিদিমণি, আগের পরীক্ষায় কুমরুর দেখে টুকেছিলাম বলে! হাতুশির দেখে টুকলে আরও বেশি পেতাম!”

          শুনেই শিয়ালনী কেঁপেঝেঁপে অস্থির! এমনই কেঁপে গেছে শিয়ালনী যে চোখের চশমাখানা ইড়িংপিড়িং করে লাফিয়ে লেজের ফুলে গেছে আটকে! দিদিমণির মুখচোখ কৃষ্ণচূড়া ফুলের মত টকটকে লাল, “বাঘু! বাঘুউউউউ! বলি কী ভেবেছিস কী তুই? পরীক্ষার সময় টুকলি করেছিস, আবার সেকথা ফলাও করে বলা হচ্ছে?”

          বাঘু ঘাবড়ে গিয়ে মিনিমিন করে বলল, “ফলাও করে কোথায় বললাম, দিদিমণি? আপনিই তো পঁচিশে দশ পাবার কথা তুললেন! হতভাগা হাতুশিটা খাতা দেখাল না কিছুতেই যে! আপনিই বলুন না দিদিমণি, বিপদে বন্ধুকে না সাহায্য করলে আর বন্ধুত্ব কিসের? পরীক্ষার মতন অমন একটা ঘোরতর বিপদ, এট্টুও বন্ধুকে সাহায্য করল না, দিদিমণি! উঁহুঁ হুঁ হুঁ হুঁ!”

          হাতুশি ভুঁউউউউস করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে শুঁড় বাগিয়ে তেড়ে গেল বাঘুর দিকে, “তুই নিজে পড়াশুনো করে আসতে পারিস না? তাহলেই তো আর বিপদ হয় না!”

          এদিকে শিয়ালনীর মুখ হাঁ হতে হতে ইয়াব্বড়ো হয়ে উপরের চোয়ালে গেছে আটকে। চোখ দু’খানা ঠেকেছে কপালে। ভাগ্যে ভালকি আর কুমরুও এসে পড়েছে ততক্ষণে। অবস্থা দেখে তারা তাড়াতাড়ি করে জলটল নিয়ে এল। শুঁড়ে করে জল ছেটাতে শুরু করল হাতুশি। কিন্তু কিছুতেই আর কিছু হয়না!

          এদিকে হিনিমিনি ‘তুমি যাও পথে পথে, আমি চলি গাছে গাছে’ গান গাইতে গাইতে পাঠশালের উপরের একটা শালগাছে এসে থেমেছে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল, বা! বেশ জমজমাট ব্যাপার তো! সবাই মিলে দারুণ মজা করছে মনে হচ্ছে!

          দিদিমণিকে সবাই ঘিরে থাকায় চোখে পড়েনি তার। উপর থেকে মস্ত একখানা লাফ দিল সে। ইচ্ছেটা, একেবারে হাতুশির পিঠের উপর পড়ে তাকে আচ্ছাটি করে চমকে দেওয়া! কিন্তু এদিকে হিনিমিনিও লাফ দিয়েছে আর হাতুশিও গেছে সরে! আর পড়বি তো পড়, হিনিমিনি পড়ল একেবারে দিদিমণির ঘাড়ে!

          তড়াক করে এক লাফ দিয়েছে শিয়ালনী, “হিনিমিনি, আমার ঘাড়টা কি তোমার বালির বস্তা বলে মনে হয়? নাকি আমাকে তোমার পাশবালিশ বলে ধারণা?”

          অমনি সমস্বরে হইহই বেধে গেল, “দিদিমণি সেরে গিয়েছেন! দিদিমণি সেরে গিয়েছেন!”

          ভয়ানক এক ধমক দিল শিয়ালনী, “দিদিমণি সেরে গিয়েছেন? ওরে হতভাগারা, আমি অসুস্থ হলাম কবে যে সেরে উঠবো? হাতি, হনুমান, বাঘ, ভালুক, কুমীর- যত্তো সব!”

          বাঘু এতক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোমরে থাবা দিয়ে মজা দেখছিল! এবারে সামনে এসে ভারি মোলায়েম ভঙ্গিতে বলল, “দিদিমণিকে এত কষ্ট দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে তোদের? দিদিমণি বলে তোদের কত্তো ভালোবাসেন! আহা! আমাদের দিদিমণি! ঠিক যেন একমুঠো চিনি!”

          ফোঁস করে উঠেছে হাতুশি, “আর তুই বাঘু? যেন দুধ-সাবু!” 

গর্জে উঠেছে শিয়ালনী, “পাজি, নচ্ছার সব! এগুলোর জ্বালায় শান্তিতে আমার একটু পাঠশালা চালানোরও জো নেই! বলি বাছাধনেরা, এত যে বেলা হল, অথচ প্রার্থনাটাই হল না- সেদিকে হুঁশ আছে কারুর?”

দিদিমণির ধমকধামক খেয়ে প্রার্থনার লাইনে দাঁড়াল সবাই। প্রার্থনা হল। ক্লাসও শুরু হয়ে গেল।

 

প্রার্থনার পর শিয়ালনী শুরু করেছে পড়াতে, “শোন্‌ সবাই। ‘সবুজ পাঠ’ বইটা খোল। একান্ন পাতায় যা। দ্যাখ, লেখা আছে ‘সমার্থক শব্দ’ বা ‘প্রতিশব্দ’। ‘সমার্থক শব্দ’ মানে হল যে শব্দগুলোর অর্থ বা মানে একই। যেমন ধর, রবি মানেও সূর্য। আবার দিনমণি মানেও সূর্য। দিবাকর মানেও সূর্য। তাহলে সূর্য, রবি, দিবাকর বা দিনমণি এগুলো সব হল সমার্থক শব্দ বা প্রতিশব্দ। বুঝেছিস সবাই? বাঘুউউ, বুঝলি?”

টকাত করে ঘাড় নাড়ল সবাই। এমনকি, বাঘুও।

শিয়ালনী এপাশ ওপাশ মাথা দোলাল, “বেশ, কেমন বুঝেছিস দেখি। বাঘু, তুইই-ই বল্‌ হাতি শব্দের প্রতিশব্দ কী কি হতে পারে?”

বাঘু সটান উঠে দাঁড়িয়ে হাসিহাসি মুখে মাথা দোলাল, “এ তো দিদিমণি, ভারি সোজা। হাতি মানে হাতুশি। আর তার মানে, হাতির প্রতিশব্দ হবে পাজি, নচ্ছার, ছুঁচো এইসব।”

এতোই চটে গেছে শিয়ালনী যে তার লেজ পাঁইপাই করে ঘুরছে, নাকের ডগা টাঁইটাঁই করে কাঁপছে, কানের ভেতর সাঁইসাঁই করছে আর তার চোখ চাঁইচাঁই করে উপর-নীচে করছে।

বাজখাঁই এক আওয়াজ ছাড়ল শিয়ালনী, “বাঘুউউউ! হাতির প্রতিশব্দ পাজি, নচ্ছার, ছুঁচো? আর তাহলে বাঘের প্রতিশব্দ কী শুনি?”

বাঘু দিব্যি ভালোবাঘের মতন মুখ করে বলল, “বাঘের প্রতিশব্দ? বাঘের প্রতিশব্দ- শান্ত, নরম, ভদ্র এইসব।”

খসে পড়া গাছের পাতা যেমন প্রবল ঝড়ে অবিরাম পাক খেতে থাকে, তেমনই বনবন করে ঘুরছে শিয়ালনীর চোখদুটো- “বাঘু! বাঘুউউউউ! চালাকি পায়া হ্যায়? কায়দাবাজি পায়া হ্যায়? আমি এই পড়িয়েছি? এই বুঝিয়েছি? হতভাগা!”

বাঘুর হেলদোল নেই, “আমি তো ঠিকই বলেছি, দিদিমণি। পাজি, নচ্ছার, ছুঁচো এসব বলতে আমার হাতুশির কথাই মনে হয়। আর আয়নার সামনে আমি যখন দাঁড়াই সন্ধেবেলায়, নিজেকে কত ভদ্র, নরম, শান্ত মনে হয়!”

ধাঁইধাঁই করে কপাল চাপড়াচ্ছে শিয়ালনী, “ওরে, এই বাঘুটাকে নিয়ে যে আমি কী করি? বাঘু, তুই এক্ষুণি… কোন কথা না। এক্ষুণি তুই গুনে গুনে দশবার লেজবোস করবি। তারপর আমি তোদের আবার পড়াবো।”

বেচারি বাঘু আর কী করে? শুরু করল লেজবোস। হাতুশি তাই দেখে মুখে শুঁড় চাপা দিয়ে আর বাকি পশুয়ারা কেউ মুখে থাবা চাপা দিয়ে, কেউ মুখে লেজ চাপা দিয়ে ফিকফিক করে হেসেই সারা!

বাঘুর ‘লেজবোস’ শেষ হলে পড়া শুরু হল ফের। দিদিমণি বোর্ডের কাছে গিয়ে পড়াচ্ছেন, মাঝেমাঝে পিছন ফিরে লিখছেন, বাকিরা মন দিয়ে শুনছে। বাঘু এদিকে কুমরুর পাশে বসে সমানে গজগজ করেই যাচ্ছে, “বুঝলি কুমরু, দিদিমণির বিচারখানা দেখলি? নাহয় মুখ ফসকে কয়েকটা সত্যি কথা বলেই ফেলেছি, তাই বলে আমাকে উনি লেজবোস করাবেন? তুই-ই বল্‌ না, আমাকে দেখে তোর শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট ভদ্র বাঘবাচ্চা বলে মনে হয় না? আর হাতুশি? সকালবেলায় জানিস্‌, দিদিমণির সামনেই আমাকে ধপাস করে কুমড়ো বস্তার মতো ফেলেছিল, তা দিদিমণি দেখেও দেখলেন না, বুঝলি? ওঁর কি চশমায় ভুষো কালি লাগানো আছে?”

কুমরুর বেজায় বিরক্তি লাগছিল। বাধ্য হয়েই বলল, “বাঘু, তুই থামবি, নাকি আমি দিদিমণিকে বলবো, তুই আমায় ডিস্টার্ব করছিস?”

বাঘু ঠোঁট ওল্টাল, “ইসস! ভারি কথা শিখেছিস! ডিস্টার্ব! বেশ, ক্লাস শেষ না হওয়া অব্দি তোর সঙ্গে আড়ি! আড়ি আড়ি আড়ি, কাল যাবো বাড়ি, পরশু যাবো ঘর, কুমরুর লেজ নিয়ে টানাটানি কর! এক বালতি জল নিয়ে পা পিছলে পড়্‌…”

বাঘু গজগজ করতেই থাকল আপনমনে। কুমরু আর পাত্তা দিল না। সর্দি হয়েছে বলে কুমরু টুপি পরে এসেছিল। মাথার টুপিটা একবার খুলে আরেকবার ভালো করে আটকে বাঘুর দিকে চেয়ে মুখ দিয়ে আওয়াজ ছাড়ল, “ফুঃ!”

বাঘু ফুলছে রাগে। আগের দিন বাঘু সন্ধেবেলা বসে বসে দুটো কাগজের শিং বানিয়েছিল। আর একটা কাগজে বড় বড় করে লিখেছিল- গাধা! দুটো ক্লিপ দিয়ে শিং আটকে দিল কুমরুর টুপিতে। আর গাধা লেখাটা আটকে দিয়েছে কুমরুর লেজে। পড়া শোনায় এতোই মগ্ন ছিল কুমরু যে সে কিছু টেরই পেল না।

পড়াতে পড়াতে এদিকপানে ফিরেই শিয়ালনী হতভম্ব। কুমরুর মাথার টুপির উপর উঁচিয়ে আছে দু’খানা বড় বড় শিং!

কুমরু কিছু বোঝেইনি। সে লেজখানা নিয়ে বোর্ডের পড়া দেখতে দেখতে আপনমনে গালে লেজ বোলাচ্ছে। শিয়ালনী দেখে- লেজে বড় বড় করে লেখা, ‘গাধা’!

কানফাটানো আওয়াজ ছাড়ল শিয়ালনী, “এসব কী হচ্ছে, কুমরু! ক্লাসের মাঝে টুপিতে শিং গজিয়ে বসে আছো? লেজে আবার গাধা লেখা! গাধা কে, কুমরু? আমি, না তুমি?”

কুমরু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। নিজের টুপিতে থাবা বুলিয়ে আর লেজে চোখ বুলিয়ে খুচ খুচ করে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলল কুমরু, “দিদিমণি! এ নিশ্চয়ই বাঘুর কাণ্ড! ওই দেখুন, কেমন ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে!”

বাঘু তারস্বরে প্রতিবাদ করল, “না দিদিমণি, আমি মোটেই ফ্যাকফ্যাক করে হাসছি না। আমি খুব মিষ্টি করে ফিচিক ফিচিক হাসছি!”

শিয়ালনীর গলায় মেঘগর্জন, “বাঘু! বাঘুউউউউ! আমি জানতে চাই, এসব কি তোর কাণ্ড? তুই ছাড়া আর কারই বা হবে? তোর মোটে লাজলজ্জা নেই, না?”

বাঘু লেজখানাকে গালে ঠেকিয়ে চিন্তার সুরে বলল, “কী বললেন, দিদিমণি? ল্যাজলজ্জা? মানে ল্যাজের লজ্জা? তা দিদিমণি, মিছে কথা কইব না, কুমরুর মাথায় শিং দেবার সময় আমার লেজখানার একটু একটু লজ্জামতন করছিল বইকি! তবে লজ্জাটা এখন সেরে গেছে, দিদিমণি!”

“লজ্জা সেরে গেছে, না? দাঁড়া, তুই ক্লাস শেষ হলে টিফিনের সময় আজ গুনে গুনে দু’শ পাক লম্বাগুড়ি দিবি, হাতুশি নজরদারি করবে। আর কাল তোকে লেজের উপর একটা গল্প লিখে নিয়ে আসতে হবে। এটাই তোর শাস্তি। টিফিনের পর শেষের ক্লাসে তোর গল্প পড়া হবে।”

বাঘু লেজখানাকে আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বলল, “শাস্তিটা বুঝলাম, দিদিমণি। কিন্তু ভালো বুঝলাম না। লম্বাগুড়ি দেওয়া অভ্যেস করে রেখেছি, ও দুশোটা দিয়ে দেব। চিন্তা নেই। কিন্তু লেজের উপর গল্প মানে কী? মানে খাতাটাকে লেজের উপর বিছিয়ে তারপর লিখতে হবে?”

তেড়েমেড়ে এল শিয়ালনী, “বাঘু! বাঘুউউউউ! লেজের উপর গল্প মানে এমন একটা গল্প লিখবি, যার মূল বিষয় হবে লেজ। বুঝেছিস? নাকি বুঝিসনি? আর এরপরেও যদি না বুঝিস, তাহলে কাল তোর লেজের আমি কী দশা করি দেখবি।”

শুকনো মুখে ঘাড় কাত করল বাঘু, “না দিদিমণি, আমি বুঝেছি। সব বুঝেছি। এমনকি, আমার লেজও বুঝে গেছে।”

 

          পরের দিন। টিফিনের পর শেষের ক্লাস। সবাই ভয়ে ভয়ে আছে। বাঘুর লেখা গল্প শোনার কথা। তার লেজ আবার আজ ফুলেফুলে ঢাকা! একখানা বড়োসড়ো বেলফুলের মালা জড়ানো, সেটায় আবার কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ, জবা, কাঠগোলাপ, টগর, মালতী- আরও নানা ধরনের ফুল। লেজ প্রায় দেখাই যাচ্ছে না বলতে গেলে। শিয়ালনীর গলা গুরুগম্ভীর, “বাঘু! মনে আছে তো? গল্প লিখে এনেছিস?”

বাঘু টকাত করে ঘাড় নাড়ল, “হ্যাঁ দিদিমণি। আপনি আদেশ করেছেন। আপনার আদেশ কি আর না মেনে পারি? লিখে এনেছি, দিদিমণি।”

          শিয়ালনী বলল, “বেশ। তাহলে তুই পড়। আমরা সবাই শুনি। সবাই সামলে সুমলে বসিস রে।”

          হিনিমিনি বলল, “দিদিমণি, আগে থেকে একটা কদলী বটিকা খেয়ে নেবেন? তাহলে দুম করে কিছু হবে না। আমার দিদা অনেকগুলো কদলী বটিকা পাঠিয়েছেন গতকাল।”

          শিয়ালনী চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ পিটপিট করল, “তা মন্দ বলিসনি। তোর দিদা তো আবার বিখ্যাত কদলীপ্যাথি চিকিৎসক। তা তিনি যখন দিয়েছেন, ভালোই হবে।” হাত বাড়াল শিয়ালনী, “তাই দে। বাকিদেরও দে।”

          বাঘু বাদে বাকি সবাই একটা করে কদলী বটিকা খেল। বলা যায় না, বাঘুর গল্প শুনতে শুনতে আচমকা কখন কী হয়ে যায়! সাবধান থাকাই ভালো।

          আচ্ছাটি করে সামলে সুমলে বসল সবাই। তারপর বাঘু শুরু করল তার গল্প-

“অনেক অনেক দিন আগে এক দেশে একটি মানুষ ছিল। সে থাকত বনের কাছাকাছি। একদিন তার মনে হল, সব জন্তুজানোয়ারেরই তো লেজ থাকে। তা আমার লেজ কেন থাকবে না? বাঘ, সিংহ, খরগোশ, হনুমান, কাঠবিড়ালী – সবারই লেজ আছে। এমনকি, মাছেরও আছে। পাখিরও আছে। তাহলে আমারই বা থাকতে দোষ কী?”

          ভাবনায় ভাবনায় সে দিশেহারা। কী উপায় করা যায়? সে একদিন ভাবল, দু’দিন ভাবল। তিনদিনের দিন ভাবতে গিয়ে তার মনে হল, সব কিছুরই যখন একজন না একজন ঠাকুর আছে, লেজেরই বা থাকবে না কেন?

          এই ভেবে সে লেজঠাকুরের তপস্যা করতে শুরু করে দিল। সে কী ভয়ানক তপস্যা! বনের যত পশুপাখি, সবাই তার তপস্যা দেখে গেল ঘাবড়েতারাও একজোট হয়ে তপস্যা শুরু করল। একটা মানুষকে কিছুতেই তারা লেজ নিতে দেবে না। লেজঠাকুর পড়লেন মহা ফাঁপরেভেবেচিন্তে তিনি পশুপাখিদের কাছেই আগে এলেন। পশুপাখিরা পা জোড়, থাবাজোড় করে মিনতি জানাল, “হে লেজঠাকুর! আপনি না বাঁচালে কে বাঁচাবে? লেজ আমাদের ইজ্জত কা সওয়াল! দয়া করে একটা মানুষকে লেজ নিয়ে যেতে দেবেন না।”

লেজঠাকুর সব শুনলেন, লেজগুলো নাড়লেন। তাঁর পিছনে একশ আটখানা লেজই নড়লতারপর বললেন, “দাঁড়াও, বাছারা। একটু ভাবতে দাও। দেখি কী করা যায়?”

          এই বলে তিনি গেলেন মানুষের কাছে। মানুষ তো কেঁদে ককিয়ে হাতজোড় করেটরে নিবেদন করল, “হে লেজঠাকুর! একটা অন্ততঃ লেজ আমায় দিন। জন্তুজানোয়ারেরা চোখের সামনে সব লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটে, এ যে আর প্রাণে সহ্য হয়না প্রভু! লেজ দিন প্রভু, লেজ দিন।”

          লেজঠাকুর তাঁর একশ আটখানা লেজ দুলিয়ে বললেন, “দাঁড়াও বৎস, অত উতলা হোয়ো না। কথাটা হচ্ছে, মানুষের লেজ পাবার নিয়ম নেই।”

          মানুষও কম যায় না। সে বলল, “ও আপনি একটা নিয়ম বানিয়ে নিন না। নিয়মের জন্য লেজ, নাকি লেজের জন্য নিয়ম?”

          লেজঠাকুর কুপিত হয়ে বললেন, “শোনো মানুষ, কথার মারপ্যাঁচ কষতে এসো না। ওসব লেজটেজ হবে না। এখন লেজের সাপ্লাই নেই।”

মানুষও তর্ক জুড়ল, “সাপ্লাই নেই মানে? দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, আপনার পেছনে হরেক কিসিমের একগোছা লেজ। ওর থেকেই দিয়ে দিন না। পরে সাপ্লাই এসে গেলে আপনি নাহয় একটা তার থেকে নিয়ে নেবেন

          লেজঠাকুর রেগে গিয়ে হিন্দী করে বললেন, “কভি নেহি। লেজ নেহি দেগা।”

          মানুষও চেঁচাল, “আলবাত দেগা। দিতেই হোগা।”

          লেজঠাকুর বললেন, “নেহি। নেহি। আরে কী করছিস কী… ছাড় ছাড় বলছি… ওরে, কাতুকুতু লাগে যে…”।

          মানুষ তো এদিকে লেজঠাকুরের লেজ ধরেই টানাটানি শুরু করেছে। আর সেই টানাটানিতে… লেজঠাকুরের একটা লেজই গেল ছিঁড়ে। লেজঠাকুর বাকি লেজগুলি নিয়ে কোনরকমে পালিয়ে বাঁচলেন।

আর তারপর? তারপর মানুষের হাতে রইল একটা লেজের বিশাল বড়ো টুকরো। সে তো আর পেছনে গোঁজা যাবে না। তাই সে কোমরেই বেঁধে নিল।

সেই থেকে মানুষেরা লেজকে বেল্ট বানিয়ে পরে।”

 

বাঘুর গল্প শেষ। হাউহাউ করে ডুকরে কেঁদে উঠল শিয়ালনী, “ওরে বাঘু রেএএএএএ! এ কী গল্প শোনালি রেএএএএএ!”

বাঘু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন, দিদিমণি? গল্প ভালো হয়নি?”

শিয়ালনী কপাল চাপড়াতে শুরু করেছে, “ওরে, গল্পের গরু গাছে ওঠে জানি, কিন্তু তোর লেজের গল্প যে মহাকাশে উঠে গেছে! ও হো হো হো!”

বাঘু মুখ গোঁজ করল, “আপনি এমন করে বলছেন দিদিমণি? জানেন, আমার প্রাণে কতটা বেদানা হয়েছে?”

শিয়ালনী হাঁ হয়ে খানিক চেয়ে থেকে বলল, “বেদানা নয় রে, হতচ্ছাড়া, বেদনা!”

বাঘু মাথা ঝাঁকাল, “দিদিমণি, আমার বেদনা অনেক বেশি কিনা। বেদনা বেশি হলে তাকে বলে বেদানা। একটা আ-কার বাড়তি যোগ হচ্ছে কিনা!”

শিয়ালনী চটেমটে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই কার যেন একটা জোরদার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল পাঠশালার বাইরে। তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে ওরা দেখে, একটা বুনো মোষ দাঁড়িয়ে ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে! বাঘুকে দেখেই সে একেবারে রাগে ফেটে পড়ল, “এই তবে সেই বদমাশ বাঘটা! আমার ‘মহিষ পুষ্প নিকেতন’ থেকে ফুল চুরি করে আনা হয়েছে?”

শিয়ালনী বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বললেন, “ইয়ে, মানে আমি… আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না… আপনাকে অবশ্য এমনি দেখেছি… ওই ফুলের বাগানটা তো আপনারই…”

প্রবল এক হুঙ্কার দিল মোষটা, “হ্যাঁ, বাগানটা আমার অনেক সাধের। আর এই আপনার বাঘটা- এর কীর্তি শুনুন। সকালে আমি ছিলাম না। সেই ফাঁকে গেছে ওখানে। আমার ওখানে দুটো কাঠবিড়ালি কাজ করে সকাল-সন্ধে। তাদের গিয়ে বিস্তর ভুজুং ভাজুং দিয়ে এত এত ফুল তুলে এনেছে। ওকে নাকি আজ ‘লেজ-কুল-তিলক’, ‘লেজচূড়ামণি’ এসব উপাধি দেবেন আপনি! আমার আজ একটা ভালো বায়না ধরা ছিলো- শজারুলির নাচের অনুষ্ঠানের জন্য ফুল দেবার ছিল দু’ঝুড়ি। সেখানে কম পড়ে গেল। জানেন, আমার কত ক্ষতি হল?”

গনগনে চোখে বাঘুর দিকে চাইল শিয়ালনী, “তবে রে, পাজি হতচ্ছাড়া ছুঁচো! এগুলো তোরই প্রতিশব্দ, বাঘু।  লেজ-কুল-তিলক? লেজভূষণ? লেজশিরোমণি? এসব উপাধি পাবার খুব ইচ্ছে হয়েছে, না বাঘু বাছাধন? আজ যদি তোকে আমি লেজে ধরে হিড়হিড় করে চারদিকে না ঘুরিয়েছি? হতভাগা! তোর জন্য আমার পাঠশালার বদনাম! তোর লাজলজ্জা নাই রে বাঘু?”

পাশ থেকে ফুট কাটল হিনিমিনি, “লাজলজ্জা নয় দিদিমণি, বলুন ল্যাজলজ্জা নাই।”

বাঘু ছুটছে মাঠময়। পেছন পেছন শিয়ালনী। তারও পেছন পেছন সেই মোষটা। বাঘু দৌড়তে দৌড়তেই শুরু করে দিয়েছে কান্না, “ওরে, আমার এ কী সব্বোনাশ হল রে…আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… একা দিদিমণিতে রক্ষা নাই, মোষ হলেন দোসর রে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)…  আমাকে কেউ ‘লেজরত্ন’ উপাধিও দিল নাই রে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)…   মাঝখান থেকে আমার লেজের দফারফা হল রে…আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… আহা, আমার এত সাধের লেজ রে… ওরে, আমার লেজঠাকুর রে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)…আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… ।”

ভালকি চুপচাপই ছিল কাল থেকে। এবারে সুর খেলিয়ে গান ধরল-

এমন লেজ, আহা এমন লেজ…

দাপটেতে সবাই কাবু, এমন তেজ…

আহা, এমন তেজ

লেজের এমন তেজ…

বাঘুবাবুর শখটি বেজায়-

ফুলের ঘায়ে মুচ্ছো যায়,

‘লেজরত্ন’ পেলে যে তার বাড়বে নলেজ।

আহা, বাড়বে নলেজ।

 

দিদিমণি করেন তাড়া,

বাঘুবাবু দৌড়ে সারা-

নাকাল হয়ে অবশেষে ছোটেন তুলে লেজ,

আহা, ছোটেন তুলে লেজ-

আহহা, এমন তেজ…

লেজের এমন তেজ…।।

 ………০………

অংকনঃ গুঞ্জা

 

বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি থাবাছানি দিচ্ছে নিচের লিঙ্কেঃ-

১। বাগে এলো বাঘু

২। গিঁটের গেরোয় বাঘু

৩। বাঘু খেল ঘাস

৪। বাঘু হলেন মনিটর

৫। শিয়ালনী কুপোকাত

৬। অযোধ্যা পাহাড়ে বাঘু 

৭। পরীক্ষা দিলেন বাঘু

৮। গণ্ডারনী ও গণ্ডগোলিক্স

৯। নামতা শেখেন বাঘুবাবু

১০। শিয়ালনীর পাঠশালায় সিংহালু

১১। বাঘু হল চিৎপটাং 

১২। ঘুম দিলেন বাঘুবাবু  

১৩। পাঠশালায় ধুন্ধুমার

১৪। বাঘুবাবু ও জান্তা জট 

১৫। বনভোজনে বাঘুবাবু

১৬। হোলি খেলল হিনিমিনি      

১৭। ভোটে দাঁড়ালেন বাঘুবাবু

১৮। পাঠশালা মহাসভায় হাতুশি 

 

Leave a comment

Check Also

বিদেশি মোলাকাতে বাঘু- মৌসুমী পাত্র

            ধুস! ধুস! ধুস! ‘দূর ছাতা’ বলে যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে …

baghu_kobi sommelan

কবি সম্মেলনে বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

            পাঠশালায় আসছিল শিয়ালনি। আজ দেরিই হয়েছে কিছুটা। কাল সন্ধেবেলা খরগোশাই ডাক্তারদিদির বাড়ি নিমন্ত্রণ …

উল্কার কবলে বাঘু

উল্কার কবলে বাঘু – মৌসুমী পাত্র

(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা  তোমাদের দিযছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ …

শিল্পী- সোমক সেনগুপ্ত/ জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু

জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

  পিঠে থলে ঝুলিয়ে বাঘু চলেছে পাঠশালার পানে। মনে বেশ খুশি খুশি ভাব। একটা গাছের …