-না, তুমি মারা যেতে পার না। আমি বিষণ্ণ, দুর্বল গলায় বলে উঠলাম।
-আমি ঠিক-ই আছি।
তালগোল পাকানো ঠোঙার মতন ভাঙাচোরা কণ্ঠে আমার স্ত্রী বলে উঠল। কথা বলতে ওর বেশ কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু নিজেকে সুস্থ দেখাবার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় শরীরের সব শক্তি একত্র করে সে আমার দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে চাইল, অবশ্যই ব্যর্থভাবে। ওকে দেখতে দেখতে আমি ভাবছিলাম,
এই কি সেই মহিলা, একদিন যে আমাকে পাগল করে দিয়েছিল?
যার দরাজ সহযোগিতা আমার দিনগুলিকে রঙিন করে তুলেছিল?
যদিও আমি ওর ডান হাতটাকে ধরে ছিলাম, ওর কাছেই বসে ছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম কোন এক অদৃশ্য শক্তি ক্রমশ ওকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে।
-আপনি ডান হাতটা দিয়ে একটু আপনার স্বামীর হাতে চাপ দেবার চেষ্টা করুন তো, মিসেস রায়।
পাশ থেকে ডাক্তারবাবু বললেন।
-চেষ্টা করছি। ধীরে ধীরে বলে উঠল ও, -কিন্তু কেন?
আমাদের ও নিজেকে নিরাশ করে বারবার চেষ্টা করেও সে আমার হাতে চাপ দিতে পারল না। ও যে প্যারালিসিসের ফার্স্ট স্টেজে পৌঁছে গেছে, সেটা শুধু আমরাই নই, ও নিজেও বেশ বুঝতে পারছিল। জীবনসংগ্রামে পরাজিতের ব্যর্থতা ফুটে উঠল ওর চোখে-মুখে। দুই চোখের কোণ দিয়ে তার জল গড়িয়ে পড়ল।
-ঘাবড়াবেন না। ডাক্তারবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, -মিসেস রায়কে সময়মতন-ই আপনারা এখানে এনেছেন। সামান্য কিছুক্ষণ ওঁর মস্তিষ্কে অক্সিজেন যায় নি। চিকিৎসায় উনি আপাতত সেরে উঠবেন, কিন্তু………
ডাক্তারবাবুর কথা শুনতে শুনতে আমি আশান্বিত হয়ে উঠছিলাম, কিন্তু সেই আশা দ্রুত অন্তর্হিত হয়ে গেল। কেননা উনি শীতল গলায় বলে চললেন,
-ওঁর টাইপ-২ ডায়াবেটিস-টা বেশ গোলমেলে ধরনের। সঙ্গে হাই ব্লাড প্রেসার, হাই কোলেস্টেরল আছে। সারলেও খুব যত্নে রাখতে হবে। সময়মতন সব ওষুধ খেতে হবে। নিয়মিত পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। নাহলে ভবিষ্যতে হার্ট, লাংস, কিডনি, নার্ভাস সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। হয়তো শরীরের কোন জায়গা পক্ষাঘাতে অসাড় হয়ে গেল। তারপর আমাকে একঝলক ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, -ওঁর রক্ত সিরাপের মতন থকথকে হতে শুরু করেছে।
-এর কোন প্রতিকার নেই? কোন কিছু তো নিশ্চয়ই থাকবে!
আমি প্রবল আগ্রহে ডাক্তারবাবুর দিকে তাকিয়েছিলাম। কিন্তু মজে যাওয়া দিঘির মতন গম্ভীর সেই মুখ দেখে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম।
-ব্লাড সুগার কমাবার কোন প্রতিকার আমাদের জানা নেই। মিঃ রায়, উনি বলে চললেন, -ওষুধ, ডায়েট, যত্ন এবং ব্যায়াম ছাড়া এই রোগের আর কোন প্রতিকার নেই।
কিন্তু এটা কি আদৌ কোন অসুখ?
পর্ণার পাঠানো ভিডিও ক্লিপিং-টা দেখতে দেখতে এইখানে পৌঁছে দর্শকের দিকে মিঃ রায়ের ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নটা শুনে দেবেনবাবু নড়ে চড়ে বসলেন। যদিও পর্ণার সঙ্গে শুধুমাত্র মেসেজ আদান-প্রদান হচ্ছিল হোয়াটসঅ্যাপে, কিন্তু লিংক থেকে ডাউনলোড করে ভালোভাবে ভিডিও-টা দেখতে দেখতে উনি উঠে বসলেন। প্রথমে খুব গুরুত্ব দেন নি। আগের বারের মতন-ই। কিন্তু এবারে গুরুত্ব না দিয়ে আর উপায় ছিল না। সাধারণ ভদ্র পোশাক পরা একজন ব্যক্তি তাঁর স্ত্রীর জীবনযন্ত্রণা বর্ণনা করে তার থেকে মুক্তির যে উপায় বলতে চলেছেন বলে বললেন, সেটা তাঁর জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। বস্তুত ডায়াবেটিস থেকে এখনও পর্যন্ত মুক্তির কোন সুনির্দিষ্ট উপায় দেবেনবাবু খুঁজে পান নি।
-ডায়াবেটিস হল নামী-দামী ওষুধ কোম্পানীগুলির টাকা কামাবার একটা ব্যবসা। সেই ভদ্রলোক মিঃ রায় বলে চললেন,
-আমরা সজ্ঞানে বা না জেনে ওষুধের নামে একগাদা বিষাক্ত রাসায়ানিক, বা বলা ভাল বিষ খেয়ে চলেছি! জানেন কি?
-এতে আখেরে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসছে। প্রয়োজন হচ্ছে আরো দামী, আর বেশি ডোজের ওষুধ খাওয়ার। কাউকে ওইসব ওষুধ খেয়ে কোনদিন ডায়াবেটিস থেকে সেরে উঠতে দেখেছেন?
আঙুল তুলে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন উনি। তারপর কিছুক্ষণ বিরতি দিলেন। পাশেই রাখা একটা বালি ঘড়ি থেকে বালি পড়ছিল নিচের পাত্রে। সবটা নিচের পাত্রে জমা হওয়ার পর উনি বললেন,
-না, সম্ভব না! আমি এক কোটি টাকা পুরষ্কার বাজি ধরছি যদি কেউ এইসব নামী-দামী কোম্পানীর ওষুধ খেয়ে ডায়াবেটিস সারাতে পারেন। মাঝখান থেকে ওরা আপনাকে লুটে নিচ্ছে, শুষে নিচ্ছে। আপনাকে রিক্ত, নিঃস্ব করে আপনার কষ্টার্জিত সর্বস্ব লুঠ করছে এইসব ওষুধ কোম্পানী। এদের একটাই উদ্দেশ্য- গাদা-গাদা দামী-দামী ওষুধ বেচে নিজেদের মুনাফা করা। তাতে কোম্পানীগুলির শেয়ারের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হয়। শুধু এটা হলেও চলে যেত।
কিন্তু……!
-কিন্তু এতে তারা যে আপনাকে আরো বেশি করে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সেটা আমি-আপনি বুঝেও বুঝছি না। ডায়াবেটিস থেকে কিডনি খারাপ হয় না, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, চোখে কেউ ঝাপসা দেখে না বা হার্ট দুর্বল হয় না। এগুলো হয়, বলে একটু থামলেন উনি। তারপর জোর গলায় বলে চললেন,
-উপসর্গগুলো দেখা দেয় গাদা-গাদা ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার ফলে। সেটা আমাদেরকে জানানো হয় না। পশ্চিমী দেশের বাতিল বা অপরীক্ষিত ওষুধ পরীক্ষার জন্য আমাদেরকেই বেছে নেওয়া হয়। কিন্তু এই লোক ঠকানো ব্যবসা বেশিদিন চলতে পারে না। আপনারা কী বলেন?
বলে দর্শকদের দিকে প্রশ্নটা উনি ছুঁড়ে দিলেন। সামনের টেবিলে রাখা একটা গ্লাস থেকে খানিকটা জল পান করলেন।
-আমার স্ত্রী কিভাবে ডায়াবেটিসের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পেয়েছে, সেটা জানিয়ে মানব সমাজকে ডায়াবেটিসমুক্ত করার অঙ্গীকার আমি নিয়েছি। ডায়াবেটিসহীন একাদশ শতাব্দীর স্বাস্থ্যকর ভারতের স্বপ্নে আমি বিভোর।
ভিডিও-টা দেখতে দেখতে ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন দেবেনবাবু। ময়নাগুড়িতে বাড়ি। বছর পাঁচেক হল চল্লিশের ঘরে পা রেখেছেন। সেবারে ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য কোলকাতায় একটা নামজাদা হাসপাতালে গেছিলেন। সেখানেই আলাপ হয়েছিল পর্ণার সঙ্গে। তার পাওয়ার ব্যাংকটা নিয়ে নিজের মোবাইল চার্জ করেছিলেন।
তর তর করে হেঁটে চলেছেন উনি। বহুদিন পরে। এভাবেও হাঁটা যায়! তবে এখন লাগাম টানলেন।
-এই স্বপন, রাস্তা থেকেই হাঁক দিলেন দেবেনবাবু, -মর্নিং ওয়াকটা সেরেই আসছি। তোর সব রেডি হল?
-আপনি ফিরতে ফিরতে হয়ে যাবে কাকু। বলে কুণ্ডু কেবিনের স্বপন ডেকচির দিকে একপলক দেখে নিয়ে বলল, -সব্জিটা হয়ে এল। আপনি তাড়াতাড়িই চলে আসতে পারেন কাকু, হয়ে যাবে।
-না রে, উনি এগিয়ে যেতে যেতেও থেমে গিয়ে বললেন, -আরো মিনিট কুড়ি সময় লাগবে। তারপরে চোখ মটকে বললেন, -ক্ষিধেটা পুরো নিয়েই আসব।
-আসুন কাকু, স্বপন বলল, -আমি না হয় আপনার জন্য ততক্ষণে স্পেশ্যাল করে কোয়েলের ডিম সেদ্ধ করে রাখছি।
-আর কী দিবি রে?
-পরোটা-সবজি, জিলিপি আর গরম গরম সিঙ্গাড়া।
-পারবি?
-বাবা এই চলে এল বলে। গরমাগরম-ই খাওয়াব। তাড়াতাড়িই ফিরবেন কাকু।
রাস্তায় দেখা হল রেবার সঙ্গে। সকাল সকাল-ই সে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। ছোটবেলায় পাশাপাশি স্কুলে পড়েছেন। একসময় রেবার প্রতি একটা দুর্নিবার আকর্ষণ উনি অনুভব করেছিলেন। আজ বোঝেন যে প্রেম নয়, মোহ ছিল সেটা। কিন্তু ছিল গভীর……।
সেই টানে রেবার স্কুল থেকে ফেরার পথে উনি অপেক্ষা করতেন। কখন একটু চোখের দেখা দেখবেন। রেবাকে এখন দেখলে বিশ্বাস-ই হয় না যে তার প্রতি তাঁর টান একসময় অদম্য হয়ে উঠেছিল। কেমন মোটা হয়ে গেছে। হাসি-খুশী রেবার মুখটা হয়ে গেছে পুরো মেদবহুল, গম্ভীর। আর একগাদা পাকা চুল। কলপ-ও করেনা মেয়েটা। অবশ্য মেয়ে নয়, মহিলা!
-কি রে? বলে হাঁক দিলেন উনি, -কোথায় চললি?
-বাজারের ব্যাগ নিয়ে সকালবেলা লোকে কোথায় যায়? নাহ! রেবা রসিকতা ছাড়েনি। চেহারাটাই সব নয়।
-তোর হাবি?
-সে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। তারপর ওঁকে একঝলক ভালো করে দেখে নিয়ে রেবা বললে, -তোর মতন তরতাজা যুবক কিন্তু আমাদের শহরে বিরল।
এইরে! লেগ পুলিং শুরু করছে। তবে এখন সবসময় বেশ চনমনে লাগে। ফলে কথাটা গায়ে মাখলেন না।
-যুবক না হলেও তরতাজা তো বটেই।
-হ্যাঁ, রে। রেবা চোখ নাচিয়ে বলল, -এবারে বিয়ে করে ফ্যাল একটা। আমরাও নেমন্তন্ন পাই।
-হবে হবে। উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন, -বিয়েটাই সব নয়। তা, তোর কি দেরী করিয়ে দিলাম?
-আরে, আসলে তোর মর্নিং ওয়াকের দেরী হয়ে যাচ্ছে, সেটা বল। রেবা বলল, -এরপরে তো কুণ্ডু কেবিনে ঢুকে যা-তা সাঁটাবি। তারপরে গলাটা খানিক নামিয়ে বলল, -সত্যি তোকে দেখে হিংসে হয়। পারিস কী করে এই বয়সে?
-শরীরের নাম মহাশয়।
-যাই রে। রেবা বলল, -ফিরে আবার রান্না চাপাতে হবে। ও আবার আজ মালবাজার যাবে। গেলাম রে……
মিঃ রায় বলতে শুরু করলে পর দেবেনবাবু আবার নেমে এলেন মাটির পৃথিবীতে।
-মিসেস একদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল। কিন্তু সেই যে তার ওজন আশি থেকে একশ তিরিশ কেজিতে পৌঁছে গেছে, সেটার হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া অসম্ভব মনে হল। সে ক্রমশ ডিপ্রেসনে তলিয়ে যাচ্ছে, এমন সময় সেদিন মিসেসের চেক আপ হয়ে গেলে তাকে একজায়গায় বসিয়ে আমি ওষুধ কেনার লাইনে দাঁড়াতে গেলাম। সেখানেই আলাপ হল মিঃ সাঙ্গে পালজোরের সঙ্গে। ওঁর সঙ্গে ঠোকাঠুকিতে একগাদা কাগজপত্র আমার হাত থেকে পড়ে গেছিল। সেগুলো যত্ন করে মেঝে থেকে তুলে নিয়ে আমার হাতে দিতে দিতে উনি হয়তো মিসেসের কোন একটা রিপোর্ট দেখে থাকবেন। হিন্দি-ইংরিজি মিশিয়ে উনি বললেন,
-ওঁর সুগার তো বেশ অনেকটা।
-হ্যাঁ, আমি বললাম, -খুব সমস্যায় পড়েছি।
-জানেন, উনি স্মিত হেসে বললেন, -আমাদের গ্রামে, আশে-পাশে কারুর সুগার নেই।
আমি আশ্চর্য হয়ে ওঁর দিকে তাকালাম, এও কি সম্ভব? উনি কোন শতাব্দীতে বাস করছেন?
-কোন একদিন হয়তো ছিল, সুদূর অতীতে। তারপরে আমাকে ভাল করে দেখতে দেখতে উনি বললেন, -তবে আজ নেই। একেবারেই না। অনেকদিন ধরেই।
আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-বলছেনটা কী?
-দেখুন, উনি বললেন, -আমরা আজকাল বিষাক্ত সব জিনিস খেয়ে চলেছি। সার, কীটনাশক সবজি-মাছ-মাংস থেকে শরীরে ঢুকছে। আবার সেগুলো জলে মিশে গিয়ে মাটির নিচে চলে যাচ্ছে। সেই জল আমরা পান করছি। তাছাড়া আছে ফাস্ট ফুড।
-কিন্তু সেটা তো সবার-ই। আমি খানিক অধৈর্য হয়ে বলে উঠলাম, -মুক্তির উপায়?
-আছে। স্থির গলায় উনি বললেন, -কালিম্পং পাহাড়ে কাগে’র কাছে এক প্রত্যন্ত গ্রামে আমার বাড়ি। সেই গ্রামে আমরা এখনও লালিগুরাস মানে রডোডেনড্রনের ছালের শুকনো গুঁড়োর সঙ্গে স্থানীয় ভেষজ লতা-গুল্ম বেটে মিশিয়ে একটা মিশ্রণ বানিয়ে তা দিয়ে খাবার-দাবার তৈরী করি। ফলে আমাদের কারুর ডায়াবেটিস হয় না।
-আপনাদের সেখানে চাষে সার, কীটনাশক ব্যবহার হয় না। আমি সখেদে বলে উঠলাম, -পাচ্ছেন হিমালয়ের বিশুদ্ধ জল। কিন্তু এখানে তো সবই বিষাক্ত।
-তার থেকেও মুক্তির উপায় আছে। শান্ত গলায় উনি বললেন। মনে হল না আমার টেনশন ওঁকে স্পর্শ করেছে। বললেন, -সমতলের উপযোগী ওষুধ বানাতে সময় লাগবে যেটা এই পরিবেশে কার্যকরী। তবে খুব ব্যয়বহুল নয়।
-ওঁর এক নাতি জে এন ইউ থেকে বায়ো-কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করে পি এইচ ডি করছে। সে ডায়াবেটিস নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী। সে এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী পেস্ট বানাতে চায়, যেটা রান্নায় ব্যবহার করলে ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি মেলে। শেষে আমি তার গবেষণায় টাকা ঢালতে রাজি হলাম। শর্ত একটাই, সেটার প্রথম প্রয়োগ হবে আমার স্ত্রীর উপরে। অবশেষে ইঁদুরের উপরে প্রয়োগ করে ফল পেয়ে সে আমাকে দিল সেই রেসিপি। আমার স্ত্রীর সুগার বিশ দিনেই অনেক কমে গেল। একমাসের মধ্যেই সে বিপদসীমার বাইরে চলে গেল। আর এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ। এইমুহূর্তে তার ওজন সত্তরের ঘরে। তবে এখনও এটা ট্রায়ালে আছে। জানি না শেষে কী হবে।
বলতে বলতে শেষদিকে কেমন যেন ধরে এল তাঁর গলা,
-বেশ কিছু নামী-দামী ওষুধের কোম্পানী আমাকে মানহানির ভয় দেখিয়েছে। কেউ কেউ তো রীতিমতন শাসিয়েছে। জানি না শেষে পেটেন্ট পাব কিনা। জানি না এই ভিডিও-টা কতদিন ইন্টারনেটে আপনাদের দেখাতে পারব। তবে মানবজাতির স্বার্থে, আমার বিবেকের প্রতি দায়বদ্ধতায়, শক্ত গলায় বলে চললেন উনি,
-ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে আমি শেষ লড়াই লড়ে ছাড়ব। আমার সেই মিশ্রণের রেসিপিটা এই বইতে পাবেন। বই আর মিশ্রণ-টা কিনতে পারবেন কেবলমাত্র অনলাইনে। এটা একশ’ শতাংশ নিরাপদ এবং প্রাকৃতিক। যদি কেউ ডায়াবেটিস থেকে সুস্থ হতে চান, যদি নিঃস্ব হতে না চান, তাহলে এটাই উপায়, এবং একমাত্র উপায়। আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি……! অন্যথায় টাকা ফেরত………
(২)
দেবেনবাবু চেয়ে ছিলেন দূরের সিকিম পাহাড়ের দিকে। হাতের প্লেটে মুদুং খোলার ট্রাউট মাছ ভাজা। ছোট ছোট কিন্তু অতি সুস্বাদু। সন্ধ্যা নেমে আসছে। সিকিম পাহাড়ের এখানে ওখানে ইতস্তত ফুটে উঠছে আলোর বিন্দু। চেয়ে চেয়ে দেখছিলেন কিছুটা দূরে আশামায়া তার মোরগটার পায়ের দড়ি খুলে নিয়ে খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দিল। যে ঘেরাটোপে মুরগি দু’টো ছিল, সেটা থেকে তাদের বের করে নিয়ে কটেজের নিচে খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দিল। খোঁয়াড়ের দরজা ভারী পাথর দিয়ে বন্ধ করে সে এগিয়ে গেল ওদের ঘরের পাশে ছাউনিটার দিকে। সেখানে ন্যাশপাতি গাছের নিচে একটা জায়গা পলিথিন দিয়ে ঢাকা। তার নিচে রান্নার ব্যবস্থা আছে। সেখানে কাছেই রাখা একটা জলের ড্রাম থেকে জল নিয়ে হাত ধুয়ে সে জল গরম করতে দিল। তারপরে চা বানিয়ে একটা ভাল ট্রে-তে করে এনে তাঁর সামনে টেবিলে রেখে হাত জোড় করে দাঁড়াল।
-আর কিছু লাগবে সাহেব? ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে সে জিজ্ঞেস করল।
অনলাইনে মিঃ রায়ের ডায়াবেটিসের সেই মিশ্রণ ও বইয়ের জন্য টাকা পাঠিয়ে অফিস থেকে একসপ্তাহের ছুটি নিয়ে উনি বেরিয়ে পড়েছিলেন। সেই ভিডিও-তে দেখা বর্ণনা অনুসারে আজ ভোরে উনি রওনা দিয়েছিলেন। কালিম্পং পৌঁছে খোঁজ-খবর নিয়ে আগের গাড়িটা ছেড়ে স্থানীয় গাড়ি একটা ভাড়া নিলেন। আলগাড়া হয়ে পেডং থেকে রিশপের দিকে যাওয়ার রাস্তায় গ্রামটাকে উনি শেষ অবধি খুঁজে পেলেও সেখানে কেউ সাঙ্গে পালজোরকে চিনতে পারল না।
-পালজোর একজন ছিল বটে, এক বয়স্ক ব্যক্তি বললেন, -কিন্তু সে তো অনেকদিন আগেই কোথায় যেন চলে গেছে।
-সাঙ্গে পালজোর? আগ্রহ ফুটে উঠেছিল দেবেনবাবুর গলায়, -কোলকাতায় থাকেন এখন?
-হতেও পারে। উনি মাথা নাড়লেন, -জানি না।
ড্রাইভার বাংলা জানে ভাল। সেই দোভাষীর কাজ করে যাচ্ছিল।
কিন্তু গ্রামে কেউ লালিগুরাসের ছাল থেকে ডায়াবেটিসের ওষুধ তৈরী করে না। না, কেউ না! কস্মিনকালেও না।
এটা তিনি নিশ্চিত জানেন। তবে পাশের গ্রামে সিঙ্কোনা প্ল্যান্টেশন আছে। সেখানে শ্রমিকেরা সিঙ্কোনার ডাল, গুঁড়ি থেকে ওষুধ তৈরীর জন্য ছাল ছাড়ায়।
শুনে দেবেনবাবু ঘাড় নাড়লেন। তাঁর ম্যালেরিয়া হয় নি!
তবে কাছেই কাগে-তে লালিগুরাসের সিরাপ তৈরীর একটা ছোট্ট কারখানা খুলেছে, সেখানে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে।
ব্যর্থ হয়ে ফেরার সময়ে লাঞ্চ করতে ছোট্ট পাহাড়ী নদী মুদুং খোলার ধারে এই হোম স্টে-তে থেমেছিলেন। দেখে বেশ পছন্দ হয়ে গেছিল। নদী থেকে কাছেই, কিন্তু নিরাপদ দূরত্বে। একটা ছোট্ট পাথরের বেদীর উপরে বেশ ছিমছাম পরিবেশে তৈরী। পরদিন সেই গ্রামে গিয়ে না হয় আরেকবার ভালো করে খোঁজ নেওয়া যাবে। বা আশে-পাশে।
এই হোম স্টে-টিতে একটাই মাত্র ঘর। সঙ্গে অ্যাটাচড ডাইনিং। আর ওদিকে মুদিখানার দোকান। ভাই-বোন মিলে এসব চালায়। তবে ভাই সবসময় এখানে থাকে না। মাঝে মাঝেই জিনিসপত্র কিনতে বাইরে যায়। বস্তুত বিবাহবিছিন্না বোন আশামায়াই হোম স্টে-টা চালায়। সংক্ষেপে স্থানীয় লোকজন বলে আশা। খাওয়া দাওয়ার পরে বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে মুদুং খোলা আর আশাকে লক্ষ্য করছিলেন। দুপুরে এখানে এসে ওঠার পর থেকে তাকে দেখেছেন সমানে কাজ করে যেতে। কখনও পাশের খেতে গিয়ে বাঁধাকপি, রাই শাক, জনারের পরিচর্যা করছে, আগাছা পরিষ্কার করছে। কখনও বা গোরু দু’টোকে দেখছে। মাঝে মাঝে এসে আবার দোকানের খরিদ্দার সামলাচ্ছে। আবার এক ফাঁকে গিয়ে মুরগিগুলো ও কুকুরটাকে খাইয়ে এল। রোদ এসে যাওয়াতে মুরগির ঘেরাটোপের উপরে একটা কাপড় চাপিয়ে দিয়ে হাওয়ার হাত থেকে সেটার উড়ে যাওয়া আটকাতে ইঁট দিয়ে দিল। এদিকে জনারের লোভে একটা বাঁদর এগিয়ে এসেছিল। ওটাকে তাড়িয়ে ফিরে ভারায় মেলে দেওয়া কম্বলগুলোকে গুটিয়ে নিয়ে ঘরে রেখে এল।
রোগের উৎপত্তি কি অবকাশের গভীরতায়?
উচ্ছল, গর্বিতভাবে বয়ে যাওয়া নদী মুদুং খোলার সঙ্গে আশা’র মিল আছে বেশ। হাসিমুখে, অজানা ভবিষ্যতকে দূরে সরিয়ে প্রাত্যহিক কাজে ডুবে যেতে দু’জনেই সমান পারদর্শী।
তাহলে উনি এত দুর্বল হয়ে পড়ছেন কেন?
এত তাড়াতাড়ি?
“আর কিই বা লাগবে?”
নিজের মনেই নিজেকে প্রশ্ন করলেন উনি। প্রবেশের সময়ে ওঁকে গলায় খাদা পরিয়ে হাতে একটা পাহাড়ি ফুলের স্তবক দিয়ে অভ্যর্থনা করেছিল আশা। দুপুরে বেশ খানিকটা ভাত খেয়েছেন- গাওয়া ঘি দেওয়া মুগ ডাল, রাই শাক ভাজা, বাঁধাকপির তরকারি আর আচার। ডাল বাদে সব-ই নিজেদের ক্ষেতের। ফলে খাব না খাব না করেও অনেকটা খেয়ে ফেলেছেন। তায় আতিথেয়তার ধরনটাও খুব সুন্দর। বিশেষ করে সামনে কিছু রেখে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকাটা। সদ্য মুদুং খোলা থেকে ধরা এক প্লেট ট্রাউটভাজা এদের ঘরে বানানো সস দিয়ে শেষ করে ফেলেছেন।
-না। আর কিছু লাগবে না।
-রাতে কী খাবেন সাহেব?
-কী খাওয়াবেন?
-ভাত, রুটি- আপনি যা বলবেন।
-তাহলে রুটি দিন। রাতে হাল্কা খাব।
-ঠিক আছে সাহেব। আশা বলল, -রুটি, ডিমের তরকারী, স্যালাড আর পায়েস।
-পায়েস দরকার নেই। দেবেনবাবু হাত নেড়ে বললেন, -আর দেরী করে খেলেও ক্ষতি নেই।
-ঠিক আছে। তবে, বলে হাত কচলে আশা বলল, -আসলে আকাশের অবস্থা সুবিধের ঠেকছে না। আমি আপনার খাবার-টা করে হট-পটে রেখে দেব? তারপর ওঁকে লক্ষ করে সঙ্কুচিতভাবে বলল, -যদি আপনার অসুবিধে না থাকে?
-কোন অসুবিধে নেই। দেবেনবাবু ওকে আশ্বস্ত করে বললেন, -হয়ে গেলে ডাইনিং টেবিলে রেখে দেবেন।
এত পরিশ্রমী হাসি-খুশী, অথচ! ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়েস। বাবা-মা মারা গেছে। স্বামী ছেড়ে চলে গেছে। ভাই শিলিগুড়িতে কাজ করত। সে ফিরে আসায় এখন দু’জনে মিলে দোকান-হোম স্টে সামলাচ্ছে- ড্রাইভারটি ওঁকে নামিয়ে দেওয়ার সময় বলেছিল।
(৩)
সন্ধ্যার কিছু পরে দেখতে দেখতে সামনে সিকিমের পাহাড়টা মেঘে ঢেকে ঝাপসা হয়ে গেল। বাতাসের আর্দ্রতা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে, এটা স্পষ্ট বুঝছেন। কোথা থেকে একগাদা মেঘ-কুয়াশা এসে সামনে ডুমুর ও কলা গাছগুলিকে ঢেকে দিল। কাছের মুদুং খোলাও ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে উঠল। আর ঝড় উঠছে। ক্রমশ বৃষ্টি পড়া শুরু হল। দেবেনবাবু ঘরের ভিতরে চলে এলেন। অচিরেই ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। একটা সোলার লাইট ছিল। সেটা না জ্বালিয়ে কাঁচের জানালা দিয়ে চোখ মেলে দিলেন বাইরে।
বেশ ভালই বৃষ্টি হচ্ছে। নদী ক্রমশ মদমত্ত হচ্ছে। সঙ্গে ঝড়- কখনও বাড়ছে, কখনও কমছে। চাঁদের আবছা আলোয় বাইরে অস্পষ্ট দেখা যায়। কষ্টসহিষ্ণু পাইন গাছগুলি নীরবে সবকিছু সহ্য করে চলেছে। কিন্তু দেখতে দেখতে ডুমুর গাছটা নুইয়ে পড়ল। তবে কলা গাছগুলি এখনও অক্ষত আছে। কম্বলে নিজেকে ভাল করে ঢেকে নিয়ে আয়েশ করে আধশোয়া হয়ে নানান ভাবনায় তলিয়ে গেলেন উনি।
বেশ একটা ঘুম দিয়ে উঠে বসলেন। দশটা বেজে গেছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টির সঙ্গে হালকা একটা হাওয়া দিচ্ছে। তবে ইলেকট্রিসিটি এসে গেছে, এই যা ভরসা। উঠে ঘরের আলোটা জ্বেলে দিলেন উনি।
এই ঝড়ে কি আর আশা রান্না করতে পেরেছে?
কিন্তু দরজা খুলে ডাইনিং-এ এসে উনি অবাক হয়ে গেলেন। সেখানে দু’টো হট-পট রাখা। দেরী না করে হাত ধুয়ে বসে গেলেন উনি। খাবার এখনও কিছুটা গরম আছে।
এবং বেশ উপাদেয়।
খাওয়া শেষ করে বারান্দায় এসে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। কিন্তু দুর্যোগ যে পিছু ছাড়েনি, সেটা আবার বোঝা গেল। একটু পরেই বেশ ঝোড়ো হাওয়া বইতে থাকল। আর শুরু হল বৃষ্টি। কারেন্ট চলে গেল।
গ্ল্যান……গ্ল্যান……গ্ল্যান
বাস্তবের পৃথিবীতে ফিরে এলেন উনি। হোম স্টে-টির ছাদ পাকা হলেও আশারা যেখানে থাকে, সেটা পাকা নয়। পাথরের স্ল্যাবের উপরে কাঠ দিয়ে বাড়িটা বানানো, ছাদে টিন। ঝোড়ো হাওয়ায় সেখানে টিন নড়ে নড়ে শব্দ হচ্ছে। পাশেই গোয়াল। সেখানেও টিনের চাল। সেখান থেকেও শব্দ আসছে। একটু পরেই একটা ছায়া মূর্তি বেরিয়ে এল। হাতে একটা টর্চ।
আশা!
এত খাটাখাটুনি করেও রেহাই নেই। সে মনে হয় গোয়ালের টিনটা ঠিক করতে এসেছে।
কিন্তু পারবে কি?
ওকে অসহায়ভাবে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি সংকোচ কাটিয়ে বেরিয়ে এসে জোর গলায় বলে উঠলেন,
-আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
চমকে উঠে এদিকে তাকাল সে। তারপরে বুঝল যে দেবেনবাবু কিছু বলছেন। এগিয়ে বারান্দায় উঠে এল। পরনের টপ-পাতলুন বৃষ্টিতে বেশ ভিজে গেছে।
-কী করতে চাইছেন?
-গোয়ালের ছাদটা না উড়ে যায়। আশা বলল, -টিনের উপরের পাথরগুলো সব পড়ে গেছে।
-টিনটাকে বেঁধে দিলে হয় না?
-ভেবেছি সাহেব, কিন্তু আমি উপরে উঠতে পারব না।
-আমি যদি করে দিই?
-না, এই অন্ধকারে আমি সেই ঝুঁকি নিতে দেব না। শান্ত অথচ কঠোর শোনাল তার গলাটা, -সেটা হয় না।
-আপনার কাছে বড় ত্রিপল আছে? বা পলিথিন?
-আছে একটা।
-সেটা দিয়েই তো তিনদিকে ভালো করে বেঁধে দিতে পারেন। তাহলে আর টিন উড়ে যাওয়ার ভয় নেই। বিস্মিত আশাকে দেখতে দেখতে উনি বললেন, -চলুন আমি দেখছি।
ওর অনুরোধে আর কান দিলেন না। এই মেয়েটিকে দুপুর থেকে সমানে পরিশ্রম করে যেতে দেখেছেন, আর উনি এতক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তাহলে কী করলেন?
কাজটা সারতে বেশ সময় লেগে গেল। যতক্ষণে হবে ভেবেছিলেন, তার চেয়ে বেশিই সময় লাগল। আশা গোরুগুলোকে কিছুটা ঘাস খেতে দিল। কাজটাজ সেরে ওর বাড়ির অবস্থা দেখতে গেলেন। এখানে ছাদের টিন-টাও মনে হচ্ছে বেশ নড়বড়ে। একটা তোয়ালে চেয়ে নিয়ে মাথাটা একবার ভালো করে মুছে নিলেন। জামাটা ভিজেছে, তবে একটু পরেই পালটে নেবেন। চারিদিকে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে বলে উঠলেন দেবেনবাবু,
-আরে, আপনাদের ঘরেও তো বেশ জল পড়ছে।
করুণ চোখে হাসল আশা। ঘর থেকে বেরোবার আগে কয়েকটা জায়গায় বালতি রেখে গিয়েছিল সে, ছাদ থেকে চুঁইয়ে পড়া জল ধরার জন্য। সেগুলোতে জল অনেকটা করেই জমা হয়েছে। বালতিগুলো একে একে খালি করে আবার জায়গা মতই রেখে দিল আশা। কয়েকটা ভিজে জায়গায় চটের থলে বিছিয়ে দিল। তারপরে পাশের ঘরে ঢুকল পোশাক ছাড়তে।
গ্ল্যান……গ্ল্যান শব্দে প্রবল হাওয়ায় আবার ছাদের টিন কাঁপতে থাকল। মনে হল কয়েকটা জায়গায় কড়ি আলগা হয়ে গেছে। বেশিক্ষণ থাকা ঝুঁকির। এখানে এভাবে থাকা অবিবেচকের মত হবে। তাছাড়া বিছানাতেও জল পড়েছে। সেকথা আশাকে বলে বললেন হোম স্টে’র ডাইনিং-এ গিয়ে বসতে। দো-আঁশলা জার্মান শেফার্ড কুকুরটাকে নিয়ে তাঁর পিছু পিছু হোম স্টে’র দিকে এগিয়ে চলল আশা। যেতে যেতে দেখলেন বাইরে যেখানে রান্না করে, সেখানের ছাউনি উড়ে চলে গেছে। জিনিসপত্র লণ্ড-ভণ্ড হয়ে গেছে। তবে জলের ট্যাংক দু’টি অক্ষত আছে।
ডাইনিং-এর একদিকে ফায়ার-প্লেস মতন করা আছে। আধ শুকনো কিছু কাঠ-কুটো দিয়ে, কিছু বাতিল কাগজ নিয়ে, বেশ কিছুক্ষণ নিচু হয়ে ফুঁ দিয়ে অবশেষে সেটা ধরাতে সক্ষম হল আশা। জামা-কাপড় বদলে ফায়ার প্লেসের কিছুটা দূরে এসে বসলেন দেবেনবাবু, আগুনের ফুলকি ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। একটু দূরে দঁড়িয়ে স্টোভে চা বানাচ্ছিল আশা। কিছু পরে তাঁর হাতে একটা বড় কাপ ধরিয়ে দিয়ে নিকটেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
-এরকম আবহাওয়া সারা বছর থাকে?
-না সাহেব, আশা মাথা নাড়ল, -অনেকদিন পরে দেখছি।
-ট্যুরিস্ট আসে কেমন? সারাবছর?
-অন্যসময় মোটামুটি আসে। তবে বর্ষায় প্রায় ফাঁকা থাকে।
-দুর্যোগ এলে?
-কী আর করব? ওভাবেই থাকতে হয়। মৃদু হাসল ও। বলল, -তবে ট্যুরিস্ট না থাকলে, বিপদ বুঝলে এই হোম স্টে-তেই আমরা থেকে যাই রাতে।
-কাল সকালে তো অনেক কাজ?
-হ্যাঁ।
করুণ মুখে হাসার চেষ্টা করল আশা। হালকা আলোতে সেইরকম ম্লান লাগছে গলাটা, মুখটাও।
-কিরকম?
-আপনাকে চা-বিস্কুট দিয়ে গোয়ালের কাজে লেগে যাব। গোরুদের খাওয়ানো, বাইরে বেঁধে দেওয়া, গোয়াল পরিষ্কার করা। একটা লোক আসবে দুধ নিতে, শহরে সাপ্লাই দেয়। ক্ষেতের জায়গায় জায়গায় জমা জল বের করে দিতে হবে। কাল হাটবার। একজন আমার থেকে শাক-সব্জি নিয়ে হাটে গিয়ে বিক্রী করে, তার জন্য সেসব বেছে রাখতে হবে। আর শেষে, মৃদু হাসল ও, -নিজের ঘরটাকেও তো দেখতে হবে।
-বেশ ক্ষতি হয়ে গেল, না? সহানুভূতির গলায় দেবেনবাবু বললেন।
-সবে মুলো চাষ শুরু করেছিলাম, সেগুলো ধুয়ে গেলো। একটা ডুমুর গাছ পড়ে গেছে। জনারেরও বেশ ক্ষতি হল। আর বাড়ি ঘর তো দেখতেই পাচ্ছেন।
দুঃখিত মুখে মাথা নাড়লেন দেবেনবাবু।
-তবে কাল একটা মেয়ে আসবে সাহায্য করতে। আশা আশান্বিত মুখে বলল, -সে সকালে আপনার খাবার বানিয়ে দেবে, জায়গাটা পরিষ্কার করবে। আমাকেও সাহায্য করবে।
“তাও ভালো।”
মনে মনে বললেন দেবেনবাবু। কিন্তু সারাদিন এমন হাড়ভাঙা খাটুনির পরে এখানে রাতটা বসে থেকে সে কাল সকালে অতসব করতে পারবে? ভাবতে ভাবতেই দেখতে পেলেন ফায়ার প্লেসের কাছে গিয়ে নিচু হয়ে সেটার জ্বলন্ত কাঠগুলোকে উল্টে-পাল্টে দিচ্ছে আশা। এমনিতে খুব একটা ঠান্ডা ছিল না। কিন্তু বৃষ্টির ফলে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাও বেড়ে যাচ্ছে।
ফট করে একটা শব্দ হয়ে ফায়ার প্লেসটা থেকে আগুনের একটা ফুলকি ছিটকে বেরিয়ে এল। আরেকটু হলে টি-শার্টে এসে পড়ত।
-আরেকটু সরে আসুন সাহেব।
চেয়ারটা একটু সরিয়ে নিলেন উনি। বাইরের আঁধারের দিকে চেয়ে দেখলেন তাঁর অন্তরের দাবদাহও অনেকটা প্রশমিত হয়েছে।
“জীবন কোথায় সহজ?”
নিজেকেই প্রশ্ন করলেন উনি। সবাই নিজের নিজের মতন করে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। কাল সকাল থেকে ওর প্রাত্যহিক জীবন সংগ্রাম শুরু হয়ে যাবে। সারাটা রাত জেগে থাকলে, সে পারবে?
-শুনুন, দেবেনবাবু বললেন, -আমি আজ এখানেই ফায়ার প্লেসের ধারে বসছি। আপনি ভিতরে গিয়ে বরং শুয়ে পড়ুন।
-তা হয় না সাহেব। আশা বলল, -আমার অভ্যাস আছে।
-আছে, আমি জানি। কিন্তু যেটা বলছি, সেটা শুনুন। জোর গলায় নিজের কর্মস্থানে বড়বাবুর মতন ব্যক্তিত্বে বলে চললেন উনি, -আমি বেশ কিছুটা ঘুমিয়েছি। কিন্তু আপনি মোটেও বিশ্রাম পান নি। আমি এখানেই দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারব।
শেষ পর্যন্ত ওঁর জোরাজুরিতে উঠতেই হল আশাকে। তবে সে কুকুরটাকে তাঁর কাছেই রেখে গেল। তার মাথায় একটা আলতো থাপ্পড় মেরে উনি চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসলেন। খাট যদিও দু’টো ছিল, কিন্তু ভারী বলে ভিতর থেকে বের করা হ্যাপার। একটা রাত স্বচ্ছন্দে চেয়ারে বসে কাটিয়ে দিতে পারবেন।
-হ্যা, হ্যা, হ্যা।
বিশ্রী শব্দে দূরে কোথাও একটা হায়না ডেকে উঠল। দেখলেন শুয়ে থাকা অবস্থাতেও কুকুরটার কানদুটো খাড়া হয়ে গেল। হায়নাটা এতক্ষণ বৃষ্টির জন্য মনে হয় চুপ করে ছিল। এবারে বৃষ্টি থামায় খাবার খুঁজতে বেরিয়েছে।
শোঁ শোঁ করে শব্দ হচ্ছিল ফায়ার প্লেস-টা থেকে। সম্বিৎ ফিরতে দেখলেন আগুন প্রায় নিভে এসেছে। একটাই কাঠ অর্ধেক জ্বলছে। উঠে আরও কিছুটা কাঠ দিলেন। আগের কাঠটাকে ঘুরিয়ে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ফুঁ দিলে পর তবেই আগুনটা ধরল। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখলেন মেঘ অনেকটা কেটে গেছে। চাঁদের আলোয় দূরের সিকিম পাহাড়ের চূড়াগুলোও বেশ দেখা যাচ্ছে। চেয়ে চেয়ে উচ্ছল মুদুং খোলা-কে লক্ষ করতে থাকলেন। সকালে শীর্ণকায়া লাগছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কোন ভরযৌবনা যুবতী যেন মনের ফূর্তিতে অবিরল নেচে চলেছে তাঁর সামনে।
-তুমি দুর্বল নও! মুদুং খোলা চিৎকার করে ওঁকে বলল, -তার প্রমাণ আজ তুমি দিয়েছ।
-আমাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাও। কোন অদৃশ্য আত্মা এসে চুপি চুপি বলল, -সব ভাবনা দূর হয়ে যাবে।
-আর কতদিন বদ্ধ ঘরে খাঁচার পাখির মতন আটকে থাকবে? গম্ভীর স্বরে দূরের কালো পাহাড়টি হাতছানি দিয়ে বলে উঠল, -মাথা নিচু করে কলম পিষে বেঁচে থাকাটাই কি মানুষের মোক্ষ?
-মুক্ত করো নিজেকে, আকাশের চাঁদ বলল, -সংকীর্ণ গণ্ডী ছেড়ে বেরিয়ে এস মুক্ত দুনিয়ায়।
আশে-পাশের সবাই একে অন্যকে ফিসফিস করে বলল, -ওর অভিশাপকাল শেষ হয়েছে।
(৪)
-আপনি পুরোটা আমাকে খুলে বলুন তো সাহেব।
আশার ভাই যোগেন্দ্র ওঁকে বলল। দুপুরে সে ফিরেছে। পর্ণার সঙ্গে পরিচয় থেকে শুরু করে তার পরামর্শে ডায়াবেটিসের জন্য নানান ওষুধ, থেরাপি নেওয়া, ডায়াবেটিস ক্লাবে ভর্তি হয়ে প্রথমে সস্তায় মেডিসিন পেলেও উত্তরোত্তর তার দাম বেড়ে চলা- সবই তিনি বললেন।
-প্রথমে দেখুন আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা আছে কিনা?
এস এম এস পাঠিয়ে নিশ্চিত হলেন যে অ্যাকাউণ্টে টাকা ঠিক-ই আছে।
-তাহলে জুস জ্যাকিং হয়নি। অচেনা কারুর থেকে পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে কখনও মোবাইল রিচার্জ করবেন না। যোগেন্দ্র ওঁকে সতর্ক করে বলল, -আপনার মোবাইলের সব ডাটা হ্যাক করে নিতে পারে।
-কিন্তু ডায়াবেটিসের ওষুধ?
-বুঝনু ভয়ে ন দাজু? যোগেন্দ্র হাসল, -মেয়েটা বিভিন্ন ওষুধ সংস্থার এজেন্ট। সেই আপনাকে নানান ওষুধের খোঁজ দিত। বিনিময়ে সে একটা কমিশন পেত ওদের থেকে। এরকম ওর অনেক কাস্টমার আছে।
-ওষুধগুলো কাজের কিছু নয়, না?
-ব্যবহার করেই তো বুঝতে পারছেন আপনি। হাসল যোগেন্দ্র, -এমনিতে লালিগুরাসের অনেক গুণ আছে। কিন্তু ডায়াবেটিস সারে কিনা, জানি না।
-অ্যাঁ!
-আসলে এখানে আশে-পাশে লোকজনের ডায়াবেটিস হয় না, তেমনটা নয়। তবে আমরা সারাদিনে অনেক পরিশ্রম করি, পাহাড় ভেঙে এতটা পথ চলাফেরা করতে হয়। আর মোটামুটি বিশুদ্ধ খাবার খাই। তাই আমাদের হয় কম।
-তার মানে মিঃ রায়ের ডায়াবেটিস সারাবার গল্পটা ফালতু?
-তেস্তোই লাগদেইছ দাজু। যোগেন্দ্র মাথা নাড়ল, -শিলিগুড়িতে একটা প্যাথলজিক্যাল ল্যাবে কাজ করতাম। ডাক্তারবাবু বলতেন যে লাল রক্ত কণা বাঁচে একশ’ দিনের বেশি। সেখানে মাত্র কুড়ি-তিরিশ দিনে সেটা মরে গিয়ে রক্তে সুগার কিভাবে কমবে? তবে…
-তাহলে? কিছুটা আশার আলো দেখলেন দেবেনবাবু।
-আরো উপরে সিকিমের নাথাং উপত্যকার একটা গ্রামে একজন লোক হরেক রকম তিব্বতী জড়ি-বুটির ব্যবসা করে বলে শুনেছি। ওদিকের খাটো খাটো লালিগুরাস গাছ থেকে অনেক ওষুধ তৈরী হয়। আমি সঙ্গে থাকলে সুবিধে হবে। আপনি চাইলে একদিন যাওয়া যেতে পারে।
পড়ন্ত বিকেলে সিকিম পাহাড়ের উপরের দিকে অপলকে চেয়ে ছিলেন দেবেনবাবু। নীলচে আকাশের জলভরা কালচে মেঘের ফাঁক দিয়ে নিভন্ত সূর্যের লালচে আলো পড়ে অপরূপ এক রং-বাহারের সৃষ্টি হয়েছে। মায়াবী লাগছে আঁধার ঘনিয়ে আসা মুদুং খোলার ওপারের অজানা, অচেনা পাহাড়ি জঙ্গলকে। তাঁর মনেও যে হরেকভাবের সৃষ্টি হতে শুরু করেছে।
কিন্তু আশা কি জানে সে কথা?
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
অংকনঃ পুণ্যতোয়া