Home / গল্প / বিধবা – নির্মাল্য ঘরামী

বিধবা – নির্মাল্য ঘরামী

বিধবা- নির্মাল্য ঘরামী
শিল্পী- সোমক সেনগুপ্ত

 

-এই মুড়িটা খেয়ে দেখুন জবুদা, পিসীমা বললেন, -আমি একটু চা করে নিয়ে আসছি।

বলে বারান্দায় বসে থাকা জবুদা’র হাতে মুড়ির একটা বাটি ধরিয়ে দিয়ে ভিতরে চলে গেলেন পিসীমা। আর সেই গমনপথের দিকে দেখতে দেখতে কেমন সংকুচিত হয়ে উঠছিলেন জবুদা। খানিকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন মুড়ির বাটিতে। বেশ করে নিজের হাতে বানানো লংকার আচার মাখানো মুড়ি দিয়েছেন পিসীমা। সঙ্গে কিছুটা কাঁচা পেঁয়াজ আর খানিকটা চানাচুর। একটা চামচও দেওয়া আছে যাতে আর হাত ধোয়ার জন্য উঠতে না হয়। চামচ দিয়ে খাওয়াটা তাঁর ঠিক অভ্যাসে নেই। ইতস্তত করে শেষে চামচ দিয়েই মুড়ি মাখাটা খেতে শুরু করলেন জবুদা।

 

একটু পরেই একটা ট্রে-তে দু’টো চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় এলেন পিসীমা। অদূরেই প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে একটা চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন জবুদা’র দিকে।

-নিন, জবুদা।

হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিলেন জবুদা।

-পিসীমা, আপনার মুড়ি? পিসীমাকে শুধু চায়ের গ্লাসে চুমুক দিতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন জবুদা।

-আমার একটু গ্যাস হয়েছে। চা ছাড়া এখন আর আমি কিছু খাব না। তারপর একটু থেমে বললেন, -রাতেও হয়তো আর কিছু খাওয়া হবে না। বয়স হচ্ছে, শরীর যেন আর চলতে চায় না।

-আপনি খাচ্ছেন না পিসীমা, আমার খেতে খুব খারাপ লাগছে।

-তাতে কী? আপনি খেতে থাকুন জবুদা। তারপর একটু থেমে পিসীমা বললেন, -ভালই বা লাগবে কী করে? এখন সব তো মেশিনের মুড়ি। বিদেশী ধানের চাল। সে দিন কি আর আছে?

জবুদা চায়ে একটা গভীর চুমুক দিয়ে জানতে চাইলেন, -আপনাদের বাড়িতে কী কী ধানের মুড়ি হত পিসীমা?

-ভূতমুড়ি। সে কী স্বাদ গো জবুদা! আপনাদের?

-হামাই। আবার কখনও বা মুর্গিশাল। সে কী খেতে! এখনও পাওয়া যায়, তবে সংকর প্রজাতির সঙ্গে মিলে সেই টেস্ট গেছে নষ্ট হয়ে। তিক্ত গলায় বললেন জবুদা। তারপরই খেয়াল হল, পিসীমা আবার কিছু ভাবলেন না তো! তাই পরক্ষণেই বললেন, -তবে আপনি খুব সুন্দর করে মেখে দিয়েছেন। তাই স্বাদ-টা কিন্তু খোলতাই হয়েছে। আচার-টা সত্যি ভাল বানিয়েছেন।

-আপনাকে বাকি আচার-টা দিয়ে যাব। পিসীমা বললেন, -সময় করে খাবেন।

-অন্যরা কী খাবেন পিসীমা? আমাদের সাহেব?

সাহেব অর্থাৎ পিসীমার ভাইপো জগন্নাথ রায়। চাকরিসূত্রে তাঁর এখানে আগমন। সঙ্গে স্ত্রী, পুত্র-কন্যা আর বিধবা পিসীমা।

-অন্যদের জন্য আরও আচার আছে। মৃদু হেসে পিসীমা বললেন, -তাদের কোন অভাব হবে না। আপনি চিন্তা করবেন না।

-আপনি অনেক আচার বানাতে পারেন তো।

-তা মাঝে মাঝেই যে বানিয়ে রাখি, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। বলে মৃদু মৃদু হাসতে থাকলেন পিসীমা। তারপর বললেন, -আগে অনেকটা আচার দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে রোজ খেতাম। আজকাল আর সবদিন পারি না। শরীর আর টানছে না।

-আমিও ছোটবেলায় গ্রামে থাকার সময়ে খুব খেতাম। রাতে যখন যাত্রাপালা দেখতে যেতাম, লুঙ্গির কোঁচড়ে অনেকটা বেঁধে নিয়ে যেতাম। দেখতাম আর খেতাম।

-বেশ যাত্রা হত না আপনাদের ওখানে?

-খুব। বিশেষ করে শীতে নতুন ধান ওঠার পরে। আর মেলা বসত। সঙ্গে ছিল ঘোড়দৌড়। কত দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসত সেইসব ঘোড়াগুলোর দৌড় দেখতে। আমিও মেলায় দোকান দিতাম।

-কিসের? কৌতূহলী মুখে জিজ্ঞেস করলেন পিসীমা।

-মুড়ি,আলুর দম, ফুলুরি আর পাঁপড়ের। মেলার দিনগুলো মন্দ চলত না।

-অত বড় ফাঁকা মাঠ পড়ে ছিল? পিসীমা চোখ একটু বেশিই বড় করে জানতে চাইলেন।

-কেন থাকবে না? অঘ্রানে পুজো’র ধান উঠে গেলে মাঠ তো ফাঁকা। সেখানেই বসত মেলা। তবে আমার ফুর্তি হত বর্ষার সময়।

-কেমন? আগ্রহভরা গলায় জবুদা’র দিকে ঝুঁকে পড়ে পিসীমা জানতে চাইলেন।

-চারদিক ডুবে যেত। শুধু ধানগুলো মাথা উঁচু করে জেগে থাকত। এখনকার এইসব সংকর জাতের ধানের ক্ষমতা নেই সেই বন্যা সহ্য করার। বেশি জল জমলেই সব পচে যায়। আন্দাজে আন্দাজে আল ধরে হেঁটে যেতাম। ঘুনি পাতা থাকত। ঘুনি জানেন তো?

-হ্যাঁ, ওই বাঁশ বা কঞ্চি চিরে বানানো ফাঁদ। মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি জলের তোড়ে সেখানে ঢুকে পড়ে, কিন্তু বেরোতে পারে না।

-ঠিক। কত যে মাছ পড়ত। আর এখন? এত এত সার, কীটনাশক তেল দেয় যে আর মাছ পাওয়াই যায় না। এমনকী মেঠো কচ্ছপও নির্বংশ করে ছেড়েছে। এভাবে চললে……। বলে মাথা নেড়ে খেদোক্তি করলেন জবুদা।

-যা বলেছেন জবুদা। সম্মতির সুরে পিসীমা বললেন, -আমাদের গ্রামে আগে চাষ হত তুলসী মুকুলের। সে কী খেতে! আর এখন সেসব কোথায়? সব হারিয়ে যাচ্ছে এক এক করে।

বলে ঘনিয়ে আসা অন্ধকারের দিকে তাকালেন পিসীমা। তাঁর মনেও ঘনিয়ে এসেছিল অন্ধকার। কিন্তু…। কিন্তু এই সম্পর্কে যে ঘনিয়ে এসেছে চির অন্ধকার!

(২)

পিসীমার ভাইপো জগন্নাথ রায় ট্রান্সফার হয়ে চলে যাচ্ছেন কানপুরে। তাঁর কোয়ার্টারের মালপত্র সব গোছানো হয়ে গেছে। কাল ভোরে ট্রাকে সেইসব রওনা হয়ে যাবে। তাই কোয়ার্টার অগোছালো থাকার জন্যে বদলির শেষ দিনগুলি রায় সাহেব কাটিয়ে দিলেন তাঁদের অফিসের এই গেস্ট হাউসে। জবুদা এখানে কেয়ারটেকার। আগামীকাল সপরিবারে দুপুরের দিকে এখান থেকেই বেরিয়ে পড়বেন রায় সাহেব। বিকেলে তাঁদের ট্রেন।

 

মাঝে মাঝেই সপ্তাহান্তে রায়সাহেব সপরিবারে এসে উঠতেন এই গেস্ট হাউসটায়। সেই সূত্রে পিসীমার এখানে আগমন ও বিপত্নীক জবুদা’র সঙ্গে পরিচয়। কতদিন এই গেস্ট হাউসের বারান্দায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অজস্র গল্প করেছেন দু’জনে। অথচ…। একদিন…। আর হয়তো আসা হবে না এখানে। নিশ্চয়ই না! ভাবতে ভাবতেই মনটা কেমন নির্জীব হয়ে যাচ্ছিল- ঠিক যেমনভাবে বুঝছেন যে জীবনী শক্তি ক্রমশ কমে আসছে। সেদিন মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। তারপর কত কত টেস্ট ও নার্সিংহোমে কিছুদিন কাটানো। যদিও এখন খানিক সুস্থ আছেন, তবে তা যে সাময়িক, তা তিনি নিশ্চিত জানেন। আর বেশিদিন নেই! যে শূন্যতা থেকে তাঁর আগমন, সেখানেই একদিন মিলিয়ে যাবেন। অথচ …। গঙ্গার মোহনা থেকে বয়ে আসা মনোরম, ঠাণ্ডা হাওয়াও তাঁর ভারী হয়ে আসা নিঃশ্বাসকে লঘু করতে পারল না।

 

-যাবেন পিসীমা?

জবুদা’র গলা শুনে সম্বিত ফিরল তাঁর। ঈষৎ চমকে চেয়ে দেখলেন যে আগ্রহান্বিত মুখে তাঁর দিকেই চেয়ে আছেন জবুদা। জবুদা’র নিষ্প্রভ চোখদু’টি এখন বেশ উজ্জল মনে হল।

-কোথায় জবুদা?

-ওই যে পিসীমা, মন্দিরে সন্ধ্যারতি হচ্ছে। শেষ হয়ে এল প্রায়। এবার প্রসাদ দেবে। তারপর একটু থেমে মাথা নিচু করে জবুদা বললেন, -আর তো কোনদিন যেতে পারবেন না।

-যাবেন? খানিক বিরতির পর প্রবল আগ্রহের সঙ্গে ওঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন জবুদা।

-আমি যেতে পারব? কিন্তু কিন্তু করে বলেই ফেললেন পিসীমা, -শরীরটা আসলে……।

গভীর এক ভরসার সুরে জবুদা বললেন,

-আমি তো আছিই!

শেষদিনে আর কত সংকোচ করবেন? মনটাকে ঠিক করে নিয়ে, বৌমাকে বলে, জবুদা’র সঙ্গে বেরিয়েই পড়লেন পিসীমা। রায়সাহেব এক কলীগের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে গেছেন। বৌমাকে বললেন চিন্তা না করতে, জবুদা’র সঙ্গে মন্দিরে যাচ্ছেন, একটু পরেই ফিরে আসবেন।

 

মন্দিরে সন্ধ্যারতি তখন সবে শেষ হয়েছিল। শালপাতায় প্রসাদ নিয়ে দু’জনে গিয়ে গঙ্গার ধারে একটি সিমেন্টের বেঞ্চে পাশাপাশি বসলেন। হু-হু করে বয়ে আসা শীতল হাওয়া শরীরে আছড়ে পড়ল। মনেও আছড়ে পড়ছিল আর এক হাওয়া। তবে এর উৎপত্তি মানব মনের গভীরে। একে একে সন্ধ্যা তারার আকাশে আগমনের ন্যায় মনের মণিকোঠায় উজ্জল হয়ে উঠছিল সেই সব স্মৃতি- অধিকাংশই দুর্বিসহ, তবে কিছু স্মৃতির কোন জুড়ি নেই- যেমন এখানে কাটানো গত চার বছরের স্মৃতির।

 

-তারপর জবুদা? পিসীমা অবাক জিজ্ঞেস করলেন, -আপনার বৌমা মোটে খাওয়া-দাওয়ার খোঁজ রাখত না?

-আর কী? জবুদা উদাস গলায় বললেন, -অথচ নিজেই দেখে-শুনে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলাম। শেষে একদিন রাগ করেই বেরিয়ে পড়লাম।

-তারপরই এখানে?

-না, পিসীমা। পুরোনো চেনা-জানা কয়েকজনের কাছে কিছুদিন কাজ করলাম। কিন্তু কোথাও ঠিক টিকতে পারছিলাম না। ঘুরতে ঘুরতে শেষে দাস এজেন্সির মালিক বিশুদার সঙ্গে দেখা। আগে ওঁর কাছে কিছুদিন কাজ করেছিলাম। শুনলাম সরকার থেকে এই গেস্ট হাউসটা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব উনি পেয়েছেন। সেই থেকেই আমি এখানে।

-তা কতদিন হবে?

-বছর ছয়েক তো বটেই।

-ছেলে পরে আর কোন খোঁজ নেয়নি জবুদা? পিসীমা উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, -অন্তত আপনার ছানি অপারেশনের পর?

-না। আমি তো এখন বোঝা। কেন নেবে আমার খবর? রাস্তায় একদিন হরু খুড়োর সঙ্গে দেখা। বলল যে ছেলে সব বেচে-টেচে রাজস্থানে চলে গেছে। সেখানে কোথায় নাকি দোকান দিয়েছে।

-তারপর? গম্ভীর স্বরে পিসীমা জানতে চাইলেন।

-আমার তো সাড়ে তিনকাল কেটে গেছে। যে ক’দিন শরীর ঠিক আছে, লোকে পাত্তা দেবে। তারপর বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে, মালিক কি আর আমাকে রাখবে? কেউ কোন খোঁজ নেবে না!

মাথা ঝাঁকিয়ে বিষাদভরা গলায় কথা শেষ করলেন জবুদা।

-এভাবে বলবেন না জবুদা!

সেদিন আবেগে জবুদা’র হাত-টি ধরেই ফেলেছিলেন পিসীমা। মনে মনে বলতে চেয়েছিলেন, আমি তো আছি। পরক্ষণেই ভেবে দেখলেন সেইরকম কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে, কতটুকুই বা তিনি করতে পারবেন ওঁর জন্যে? জবুদা যা বলছে, তা মিথ্যে নয়। তাঁর নিজের স্মৃতি তো আদপেই সুখকর নয়।

 

কয়েকবছর ঘর করার পর সন্তান না হওয়াতে একবার পুজোতে সেই যে তাঁকে বাপের বাড়ি রেখে গেলেন তিনি, আর এলেন না। বিস্তর অনুরোধ, উপরোধেও চিড়ে ভিজল না। একদিন শুনতে পেলেন যে তিনি আবার একটা বিয়ে করেছেন। বেশ কয়েক বছর পরে একদিন তিনি মারাও গেলেন। কিন্তু সিঁদুর ত্যাগ করলেও শুধুমাত্র নিরামিষ খাওয়াতে পিসীমার ছিল প্রবল আপত্তি। অবশ্য বাড়ির লোকজন যে আমিষ ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিল, তা কখনই নয়। তারপর কেটে গেছে অনেক, অনেকদিন। আর গত কয়েক বছর ধরে গেস্ট হাউসটায় আসতে আসতে এই যে এক বিশেষ মানসিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সেও তো শেষ হতে চলল। সব সম্পর্কের পরিণতিই কি নিরাশা? অন্তত তাঁর জন্য?

 

স্মৃতির কশাঘাতে ছটফট করলেও স্থির হয়ে বসে থাকলেন পিসীমা। আর তো মোটে কয়েকটা ঘণ্টা! তারপর এই চার বছরের পরিচিতি শেষ হয়ে যাবে- চিরদিনের মতন। শুধু চার বছর নয়, তারও বেশি…। অনেক বেশি……। অনেকটাই বেশি……। মানব সম্পর্ক কি আর বছর দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব? ভাবতে ভাবতেই মনটা দুর্বল হয়ে এল। মনে হল মাথা ঘুরে যাবেন। শরীরটা মনে হল অনেকটা হাল্কা হয়ে গেছে। এমন সময় সবল একটি বন্ধন এসে তাঁকে শক্ত করে ধরল।

-চলুন পিসীমা। জবুদা বললেন, -আপনার শরীরটা হয়তো ভাল নেই।

কী করে ওকে বোঝাবেন পিসীমা, শরীর নয়, তাঁর মনটা যে আসলে ভাল নেই। মন ও শরীর তো অঙ্গাঙ্গী ভাবে সম্পর্কিত। একটি থেকেই তো আরেকটির আগমন। একটির অন্তিমে অন্যটিরও চিরনিষ্পত্তি! পিসীমা তাঁর আবেগকে সামলে নিয়ে শান্ত গলায় বললেন,

-চলুন জবুদা, আজ ওঠা যাক।

আর পরক্ষণেই মনে হল, আজ নয়, চিরদিনের মতনই হয়তো উঠে গেলেন- উঠে গেলেন এই সম্পর্ক থেকে। ভাবতে ভাবতেই আবারও মনে হল শরীরটা দুর্বল লাগছে। হয়তো বা আবার মাথা ঘুরে পরে যাওয়ার উপক্রম হবে। পিসীমা শুধু ডান হাতটি বাড়িয়ে ধরে বললেন,

-আমার হাত ধরে একটু নিয়ে চলুন জবুদা।

 

(৩)

পরদিন সকালে নিকটেই একটি মোড়ায় বসে জবুদা’র কাজ কর্ম দেখছিলেন পিসীমা।

-পিসীমা, জবুদা বললেন, -আমি এই দু’টো বাঁধা কপি আর কিছু বীট ভাল করে বেঁধে দিচ্ছি। এখনও গরম বিশেষ পড়েনি, নষ্ট হবে না। আপনারা বেশ ক’দিন ধরে খেতে পারবেন। আর কিছুটা লাল শাক দিয়ে দিচ্ছি। যেখানে যাচ্ছেন, সেখানে তো এসব পাবেন না।

বলে গেস্ট হাউসের ছোট্ট বাগানে নিজ হাতে যত্ন করে লাগানো বাঁধা কপি আর বীট গুলো মাটি ঝেড়ে কাগজের মোড়কে গুছিয়ে রাখতে থাকলেন জবুদা। অন্যদিন হলে পরম উৎসাহে পিসীমাও বসে পড়তেন জবুদা’র পাশে। সাগ্রহে দেখতেন জবুদা’র কাজ কর্ম। প্রয়োজনে নিজেও হাত লাগাতেন। কিন্তু আজ পিসীমা নির্জীবের মতন খানিক দূরের মোড়াটায় বসে বললেন,

-ঠিক আছে জবুদা। পরক্ষণেই পিসীমা আলতোভাবে হাত নাড়িয়ে বললেন, -আর কিছু দেবেন না। এতটা রাস্তা, তায় ট্রেনে যেতে হবে। বেশি নেওয়ার জায়গা নেই।

-কিছুটা পালং শাক নিয়ে যান পিসীমা। আর তো কোনদিন আপনাদেরকে দিতে পারব না।

পিসীমার মনে হল আপনাদেরকে নয়, জবুদা বলতে চাইলেন আপনাকে। কিন্তু সমাজ! সত্যি হে সমাজ, তুমিই সত্য আর সব মিথ্যা। ধন্য হে তুমি! চোখ তুলে তাকালেন একবার ভাল করে জবুদা’র দিকে। দেখলেন জবুদাও তাঁর দিকে একঝলক দেখে নিয়ে চোখ নামিয়ে মন দিয়েছেন নিজের কাজে।

 

(৪)

ট্রেনের একটা ফার্স্ট ক্লাস ক্যুপে দরজা আটকে দিয়ে বসে ছিলেন পিসীমা’রা। রায়সাহেবের মেয়ে রুনু একটা বাটি বের করে তাতে খানিকটা মুড়ি আর পেঁয়াজের আচার দিয়ে বেশ করে মেখে খানিকটা খেয়ে বাটিটা এগিয়ে দিল পিসীমার দিকে। পিসীমা শুধু ওর মাথাটা আদর করে একটু নাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

-আজ আর খাবো না রে। আর মনে মনে বললেন, -আজ থেকে আমি আর আমিষ খাব না।

বিধবা পিসীমা সমাজের অগোচরে আজ এতদিনে প্রকৃতই বিধবা হয়েছেন!

+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++

অংকনঃ সোমক সেনগুপ্ত

 

Leave a comment

Check Also

স্বীকারোক্তি

স্বীকারোক্তি- ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য্য

    আজই ফোনটা ডেলিভারি দিয়ে গেলো। অনলাইনে একবার দেখেই ভারি পছন্দ হয়ে গেছিল সমীর …

দর্পণে

দর্পণে – নির্মাল্য ঘরামী    

    -চল, আমি জোরের সঙ্গে বললাম, -ওসব একদম ভাবিস না। তোকে এতদিন পরে পাচ্ছি, …

ফয়সালা

ফয়সালা – নির্মাল্য ঘরামী

  -দেখুন স্যার। বলে সিকিউরিটি গার্ডটি বিজয়ীর দৃষ্টিতে মহাকুলসাহেবের দিকে তাকালো। তার হাতে ধরা ব্যাগটির …

রক্তগোলাপ/ মৌসুমী পাত্র/ পুণ্যতোয়া ধর

রক্তগোলাপ – মৌসুমী পাত্র

  একটা মোটা দড়ি থেকে পাশাপাশি ঝোলানো সারি সারি মৃতদেহ। ছাল ছাড়ানো। গত কদিন ধরেই …