Home / বাঘু সিরিজ / ভোটে দাঁড়ালেন বাঘুবাবু- মৌসুমী পাত্র

ভোটে দাঁড়ালেন বাঘুবাবু- মৌসুমী পাত্র

ভোটে দাঁড়ালেন বাঘুবাবু/ মৌসুমী পাত্র
শিল্পী- সোমক সেনগুপ্ত

 

          বাঘু বেচারির কী দুর্দশাই না গেল গত কয়েকদিনে! দোল মিটতে না মিটতেই বাঘিপিসী এসে হাজির। সঙ্গে আবার বাঘনি! তার উপরে, বাঘিপিসী দিদিমণির সঙ্গে কথা বলে বাঘনিকে পাঠিয়েও দিচ্ছিল পাঠশালায়! আহা! বাঘু যেন বোঝে না কিছু? আসল মতলব তো বাঘুর ওপর নজরদারি করা! আর বাঘনিটারও বলিহারি! রোজ সন্ধেবেলা গুনে গুনে বাঘু পাঠশালায় ক’বার হাই তুলেছে, ক’বার কাকে ভেংচি কেটেছে, কতবার পড়া না পেরে লম্বাগুড়ি দিয়েছে সেইসব ফিরিস্তি দিত বাঘিপিসীকে। আর তারপরই বসত বাঘুর বিচারসভা। আর বিচারসভা মানেই যথারীতি বাঘুর দোষী সাব্যস্ত হওয়া। তাপ্পর বাঘুর শাস্তি! শাস্তির নামে বাঘিপিসী ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব অঙ্ক দিত কষতে। একটি বুড়ো বাঘের যদি মাসে দুটি করে দাঁত পড়ে, তবে কতদিনে বাঘটি পুরোপুরি ফোকলা হবে? একটি বাঁদরের যদি দু’ফুট লম্বা লেজ থাকে আর প্রতিদিন যদি সে আধ ইঞ্চি করে লেজ চুলকোয়, তাহলে কতদিনে তার লেজটি একবার সম্পূর্ণ চুলকোনো হবে?

          তা এসব অংক করতে করতে বাঘুর নিজেরই দাঁত ঝরে যাবার আর লেজ চুলকোনোর জোগাড় হতো! বাঘনি হতভাগার আবার লাজলজ্জার বালাই নেই! ফটাফট করে ফেলত সব! আরে, তোর দাদা পারছে না, তুই অঙ্কগুলো সব ঠিকঠাক করিস কোন্‌ আক্কেলে? এবং তার ফলে অবধারিত বাঘিপিসীর লেজমলা! এই সেদিনের কথাই ধরো না! বাঘিপিসী দশখানা লেজখসা অঙ্ক (মানে যে করতে গেলে লেজ খসে যাবার জোগাড় হয় আর কী!) করতে দিয়েছিল বাঘুকে। আর সেইসংগে হুঁশিয়ারি, “না করতে পারলে প্রতি অংক পিছু পাঁচবার করে লেজবোস! মানে লেজ ধরে ওঠবোস! বুঝেছিস?”

          বাঘু নামতার বইতে ঝট করে দশ পাঁচে গুণটা দেখে নিয়ে চোখ মিটমিট করতে করতে বলেছিল, “পিসী, এই যে আমি পঞ্চাশবার লেজবোস করছি। তুমি গুণতে থাকো।”

          বাঘিপিসী চোখ সরু করেছিল, “লেজবোস করবি মানে? অঙ্ক করা তো শুরুই করলি না? আগেই ধরে নিচ্ছিস সব ভুল হবে?”

          বাঘু লেজ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জবাব দিয়েছিল, “চেষ্টা করেও যদি ঠিকঠাক না হয়, আর যদি অঙ্ক ভুল হয়, আর তারপর যদি লেজবোস করতে হয়, তাহলে অহেতুক কতটা সময় নষ্ট বলো দেখি? তার চে’ আমি সাদা খাতা জমা দিচ্ছি আর হিসেবমতো পঞ্চাশবার লেজবোসও দিয়ে দিচ্ছি। তুমি বরং অংকগুলো নিজের মনের মতো করে করে নিও।”

          খুব কি অন্যায় বলেছিল বাঘু? যা বলেছিল তাতে বাঘিপিসীরও ভালো হত, তারও ভালো হত! কিন্তু এসব ভালো ভালো ব্যাপার বাঘিপিসীর মাথায় ঢুকলে তো? বাঘিপিসী তাকে লেজবোস তো করালই না, উল্টে ওই প্রতিটা লেজখসা অঙ্ক তাকে দশবার করে করাল! এরপরেও শেষটায় উত্তর লিখতে গিয়ে বাঘু যদি ‘৩৫ দিন’-র বদলে ‘৩৫ খানা বাঘিপিসীর ল্যাজ’ লেখে, তাতে তাকে খুব দোষ দেওয়া যায় কি? আর যদি ‘২৪ কিলোমিটার’-র পরিবর্তে ‘২৪টি বাঘিপিসীর হাঁচি’ লিখেই ফেলে, তাতেই বা কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়?

          কিন্তু বেদনার বিষয় হচ্ছে যে বাঘিপিসী নেহাতই বেরসিক। উত্তর লিখতে গিয়ে ওই যে অতি তুচ্ছ ভুল হয়েছিল বাঘুর, তার দরুন বাঘুকে একশ বার করে হাতের লেখা করিয়েছিল বাঘিপিসী। আর সে হাতের লেখারই বা কী বহর! ‘বাঘু তোলে হাঁচি, কানে দেব কাঁচি’; ‘বাঘুবাবুর লেজখানি, উলুস ঝুলুস চাটনি’ – এসব হাতের লেখা হল? রাগ হবে না এসব লিখতে? আর সেই রাগে বাঘু যদি বাঘিপিসীর ঘুমোনোর সময় ভুষোকালি দিয়ে বাঘিপিসীর মুখে জবরদস্ত গোঁফ-দাড়ি এঁকেই দেয়, তাতেই কি বিশাল কিছু দোষ হল? কিন্তু বাঘুর বরাত এমনই খারাপ যে এতবড় যে একটা শিল্পকর্মের কদর তো কেউ করলই না, উপরন্তু বাঘুর মা বাঘিন্নী অ্যায়সান  গিঁট পাকাল বাঘুর লেজে যে তিনদিন ধরে নাগাড়ে লেজব্যথা।

          যাই হোক, আজ পাঠশালায় বাঘু ঢুকেছে বেশ খুশিমনেই। বাঘিপিসী আর বাঘনি বিদায় নিয়েছে গতকাল। বাঘিপিসীর ব্যাগে লুকিয়ে লুকিয়ে খানকয়েক কাঁটাফল ভরে দিয়েছে বাঘু, বাঘিপিসী ফিরে গিয়ে মজাটি টের পাবে! বাঘিনীর থলেতে দোলের বেঁচে যাওয়া রঙ-জল ভরা বেলুনও ভরে দিয়েছে এমনভাবে যে থলে খুলতে গেলেই ফটাস ফটাস ফাটবে আর বাঘনি বাছাধন মজাটি টের পাবেন!

          বাঘু এইসব সুখস্বপ্নে বিভোর, আর এদিকে কখন যে পড়া শুরু হয়ে গেছে, বাঘু টেরই পায়নি! দিদিমণি ওদিকে জিজ্ঞেস করেছেন, “বাঘুউউউ! নয় দশ আট কত?”

          বাঘু তখনও ঢুলুঢুলু চোখে হাসিহাসি মুখে বাঘিপিসী আর বাঘনির আসন্ন দুর্গতির কথা ভেবে যাচ্ছে তো ভেবেই যাচ্ছে। দিদিমণির কথা তার কানেই ঢোকেনি। শিয়ালনী ফের হাঁক ছেড়েছে, “বাঘু! বাঘুউউউউ! নয় দশ আট কত হয়?”

          বাঘু বেজায় ভেবলে গিয়ে ফিরল দিদিমণির দিকে, “ক্কী, কী দিদিমণি?”

          “কী? কী দিদিমণি? পড়ার সময় মন কোথায় থাকে শুনি?”, শিয়ালনী মুখচোখ কুঁচকে চাইল বাঘুর দিকে, “বল্‌, নয় দশ আটে কত হয়?”

          বাঘু তাও ফ্যালফেলে মুখে তাকিয়ে আছে দেখে শিয়ালনী কিছুটা নরম সুরে বলল, “মানে নয়ের পিঠে আট বসলে কত হয়?”

          আচমকা থাবাটাবা ছুঁড়ে চেঁচিয়ে উঠল বাঘু, “নয়ের পিঠে আট নাকি নয়ের পেটে আট? নাকি নয়ের কোলে আট বসবে, দিদিমণি? পিঠে নিলে খুব ব্যথা হবে দিদিমণি, তার চে’ বরং ওকে নয়ের কোলেই দিন!”

          শিয়ালনীর প্রায় চোখ উলটে যাবার জোগাড়! ভালকি ছিল কাছেই, দিদিমণির দুরবস্থার কথা আঁচ করে তাড়াতাড়ি এক ভাঁড় জল এগিয়ে দিল। জলটল খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়েই বিকট আওয়াজ ছাড়ল শিয়ালনী, “এঁড়ে তক্কো করবি না বাঘু! একদম এঁড়ে তক্কো করবি না বলে দিলাম। একটা অঙ্ক মানে ইংরেজিতে যাকে বলে ডিজিট, সে আরেকটার পিঠেই বসে। পেটেও বসে না আর তোমার মাথায় চড়ে নৃত্যও করে না। তোমার লেজে মাছির মতো ভনভনও করে না।”

          গণ্ডগোল যখন বেশ জমে উঠেছে, সেইসময় পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে থপাস থপাস করে হাজির কুমরু। কুমরুকে দেখেই চোখদুটো নাগরদোলার মতন পাঁইপাঁই ঘুরছে শিয়ালনীর, “কী ব্যাপার, কুমরু, পাঠশালায় সময়ের বালাই নেই বুঝি?”

          কুমরু একগাল হাসল, “দিদিমণি, কাছুয়াদিদির সঙ্গে দেখা হল। এইদিকেই আসছিল। আপনার একটা চিঠি আছে। এই যে। ওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই দেরি, দিদিমণি।”

          হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে এনে পড়তে শুরু করল শিয়ালনী। চোখমুখ গোলগোল, নাক দিয়ে ঘনঘন ভোঁসভোঁস নিশ্বাস পড়ছে। শিয়ালনীর মুখচোখ দেখে হিনিমিনি ভয়ে ভয়ে শুধোল, “কী লেখা আছে দিদিমণি চিঠিটায়?”

          শিয়ালনী পুঁউউউউস করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “লেখা তো আছে ভালোই, কিন্তু…। দাঁড়া, তোদেরই পড়ে শোনাই। তারপর তোরাই বল্‌ কী করা যায়।”

          বলেই শিয়ালনী পড়তে শুরু করল চিঠিখানা,

প্রতি

মাননীয়া শিয়ালনী মহোদয়া সমীপেষু,

          আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে ‘পাঠশালা মহাসভার’ এই বৎসর দশম বর্ষপূর্তি। এই উপলক্ষ্যে বিবিধ আয়োজন করা হইয়াছে। সেই আয়োজনের অঙ্গ হিসাবে আপনাকে অনুরোধ করা হইতেছে যে আপনার পাঠশালার একজন উপযুক্ত পশুয়াকে যেন এই মহতী সভায় প্রেরণ করেন। প্রত্যেক পাঠশালা হইতেই একজন করিয়া পশুয়া অংশগ্রহণ করিবে। উহাদের ভ্রমণ-ভোজন এবং নানাবিধ শিক্ষার বিশদ ব্যবস্থা রহিয়াছে। ফলতঃ পশুয়াদের আনন্দ-স্ফূর্তি এবং শিক্ষা- উভয়েরই সুবন্দোবস্ত আছে।

          অতএব মহাশয়া, অনুগ্রহপূর্বক আপনার পাঠশালার সবচেয়ে উপযুক্ত পশুয়াকে পাঠাইলে বাধিত হই। আপনার উত্তর পাইলে বিশদ বিবরণ জানাইব।

          নমস্কারান্তে,

                                                                                         শিয়ালিকা বিদ্যাচন্দ্রিকা

                                                                                               অধ্যক্ষা,

                                                                                        ‘পাঠশালা মহাসভা’।    

          ভালকি বলল, “দিদিমণি, তাহলে কে যাবে? হাতুশিই যাক বরং। ও হলেই ভালো।”

কুমরু তৎক্ষণাৎ সায় দিল, “হ্যাঁ দিদিমণি, হাতুশিই যাক বরং। ও গেলেই পাঠশালার মান বজায় থাকবে।”

          শিয়ালনী গালে একটা পেনসিল ঠেকিয়ে বলল, “সেই ভালো। হাতুশি, তুই-ই যা। ঘুরে আয়।”

          গালে শুঁড় ঠেকিয়ে আহ্লাদী আহ্লাদি গলা হাতুশির, “ঠিক আছে, দিদিমণি।”

          যেই না বলা, অমনি বাঘু প্রবল এক লাফ দিয়ে দুই থাবা কোমরে দিয়ে দিদিমণির সামনে দাঁড়াল, “এটা কিরকম হচ্ছে, দিদিমণি? সব সময় সব ব্যাপারে হাতুশি? সবেতেই হাতুশি কেন? যেতে যদি হয়, আমি যাবো। কত কত মজা থাকবে, সব ও একা ভোগ করবে বুঝি? উটি হবে না। আমিই যাবো।”

          শিয়ালনী রেগেমেগে তার হাতের পেনসিলখানা বাঘুর নাকের ডগায় দুলিয়ে বলল, “আর শিক্ষা? ওখানে যে অনেক পড়াশুনোর ব্যাপার থাকবে, তার বেলা? তুই তো এমনিতেই লেখাপড়ায় অষ্টরম্ভা।”

          লেজ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জবাব দিল বাঘু, “ওসব আমি বুঝিটুঝি না, দিদিমণি। যেতে হয়, আমিই যাবো।”

হিনিমিনি হালকা করে এক ঠেলা দিল বাঘুকে, “তুই যাবি কি রে? তুই গেলে আমাদের পাঠশালার মানসম্মান ধুলোয় লুটোবে। বুঝলি? দিদিমণি, আপনি হাতুশিকেই পাঠান।”

বাঘু কিসব ভাবতে ভাবতে ফিচিক ফিচিক করে একটা বদমায়েশি হাসি দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, দিদিমণি। তাহলে এক কাজ করুন। বাঘনির কাছে শুনছিলাম, মানুষদের নাকি কিরকম সব ভোট হয়। তা এখানেও ভোট হোক। যে জিতবে, সে যাবে।”

হাতুশি শুঁড় হালকা দুলিয়ে বলল, “দিদিমণি, বাঘু যখন অত করে যেতে চাইছে, তাহলে ওই যাক বরং।”

হিনিমিনি সঙ্গে সঙ্গে এক দাবড়ানি দিল হাতুশিকে, “থাম দেখি তুই। যেতে হয়, তুই-ই যাবি।”

ভালকি বলল, “দিদিমণি, অত ভোটাভুটির কী আছে? আমার ভোট আমি হাতুশিকে দিলাম।”

কুমরু লেজ নাড়াল, “আমার ভোটও আমি হাতুশিকেই দিলাম।”

হিনিমিনি লেজখানাকে মুখে একবার বুলিয়ে নিল, “দিদিমণি, আমার ভোটটাও লিখে নিন। হাতুশি।”

শিয়ালনী হাতের পেনসিলটা লেজের ফিতেয় গুঁজে বলল, “ব্যস! তাহলে আর কোনও অভিযোগ থাকার কথা নয়, বাঘু বাছাধন! ভোটেও তুমি হেরে গেছ! হাতুশিই যাচ্ছে।”

কোমরে থাবা দিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে তাকাল বাঘু, “এটা কিরকম ভোট হল, দিদিমণি? এরকমভাবে ভোট হয়? বাঘনির কাছে আমি ভোটের ব্যাপারে সব শুনেছি। এরকমভাবে আমাদের ভোট হয় শুনলে মানুষেরা ছ্যা ছ্যা করবে না? আর মানুষদের ছেলেমেয়েরা এসব শুনতে পেলে হ্যা হ্যা করে হাসবে না?”

শিয়ালনী ভারি চিন্তান্বিত হয়ে লেজের ফিতে থেকে পেনসিলটাকে বের করে গালে ঠেকাল, “তাহলে… তোরা সবাই কী বলিস? হাতুশি?”

হাতুশি শুঁড়খানাকে মুখের সামনে গোল্লা পাকিয়ে বলল, “দিদিমণি, ভোট হোক তবে। একটা নতুন রকমের ব্যাপারও হবে। আমি রাজি।”

শিয়ালনী পেনসিলটাকে উঁচু করে মাথার ওপরে ঘোরাল, “বেশ। ভোট হবে। ভোটে দাঁড়াচ্ছে হাতুশি আর বাঘু। বাকিরা ভোট দিবি। আর মানুষদের ভোট তো হয় ব্যালটে, আমরা তো পশু। তাই আমাদের ভোট হবে প্যালটে, মানে পশু যোগ ব্যালট। মানুষের দেওয়া নাম আমরা কেনই বা নেবো, বল? ভোট হবে সামনের পয়লা বৈশাখ, নববর্ষের দিন। তোরা সবাই সকাল সকাল ভোট দিতে চলে আসবি। ওইদিন আর পড়াটড়া হবে না।”

শুনেই সকলে ‘হু হা ইয়াহু’ করে ফূর্তিতে লাফিয়ে উঠল। খালি বাঘু বাদে। সে মনের সুখে খানিক লেজ চুলকে মুখ খুলল, “সবই তো হল, দিদিমণি। কিন্তু সিংহালু আর বাঘনি- ওরাও তো কিছুদিন করে পড়েছে আমাদের পাঠশালায়। তাহলে ওদেরও ভোটের ব্যবস্থা করতে হবে।”

হিনিমিনি তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল, “ওরা আবার কী করে ভোট দেবে? ওরা কি অতদূর থেকে এই ভোটের জন্য আসবে নাকি?”

বাঘু তেড়ে গেল হিনিমিনির দিকে, “ওসব বুঝিটুঝি না। পাঠশালায় পড়েছে যখন, ওদেরও অধিকার আছে।”

শিয়ালনী পেনসিলখানাকে এত জোরে মাথায় চুলকোতে গেল যে পটাং করে পেনসিলটা ভেঙে দু’ টুকরো হয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে ভারি হতাশ ভঙ্গিতে বলল শিয়ালনী, “তাই হোক তবে। ওরাও ভোট দেবে। আমি চিঠি লিখে ওদের প্যালট পাঠিয়ে দেব। কাছুয়াকে বলে রাখলেই হবে।”

একটুখানি দম নিল শিয়ালনী। একটা বোলতা এসে পড়েছিল নাকের কাছে। সেটাকে ভাঙা পেনসিলের এক বাড়ি মেরে দূরে পাঠিয়ে বলল, “কিন্তু তোদের কার কী প্রতীক হবে? মানে ভোটাররা যে ভোট দেবে, তার জন্য তো একটা চিহ্ন চাই, যেটা প্যালটে ছাপা হবে। হাতুশি, তোমার কী প্রতীক?”

হাতুশি শুঁড় দোলাতে দোলাতে বলল, “দিদিমণি, হাতির প্রতীক তো একটাই হয়। শুঁড়। আমার প্রতীক শুঁড়।”

শিয়ালনী বাঘুর দিকে ফেরার আগেই সে লাফিয়ে উঠেছে, “আমার প্রতীক লেজ। লেজ চিহ্নে ভোট দিন, লেজ চিহ্নে ভোট দিন!”

হাতুশিও শুঁড় উঁচিয়ে শুরু করল, “শুঁড় চিহ্নে ভোট দিন, শুঁড় চিহ্নে ভোট দিন!”

ব্যস, পাঠশালা পলকে সরগরম!

 

ভোটের প্রচার জোরকদমে শুরু করে দিয়েছে বাঘু। জঙ্গলের ইতিউতি নজর চালালেই দেখা যাবে, চারিদিকে নানা রঙবেরঙের কাগজ ঝুলছে। তার কোনওটায় লেখা- লেজ চিহ্নে ভোট দিন,  কোথাও লেখা- সব জন্তুর আছে লেজ/ বাঘুর ভোটে বাড়বে তেজ; কোনটায় আবার লেখা– ভোট দেবেন কোন্‌খানে? লেজ চিহ্নের মাঝখানে!  তার উপরে বনের যত ছানাপোনা জন্তুজানোয়ারদের জুটিয়ে নিয়েছে সে। সকাল-সন্ধে তাদের নিয়ে মিছিল বেরোচ্ছে। মিছিল থেকে গরম গরম রব উঠছে- বাঘু ছাড়া গতি নাই/ভোট দিও বাঘুকে তাই; কিংবা, সবে মিলে তোলো বোল/লেজ চিহ্ন দেবেই গোল; আর নইলে, অপার মহিমা লেজের তোমার/ বাঘু বিনে সকলি অন্ধকার।      

মিছিলও বেরোচ্ছে। পুরোভাগে বাঘু। গলায় একটা গাঁদাফুলের মালা। লেজেও একটা বড় গাঁদাফুল বাঁধা। সে হাসি হাসি মুখে থাবাজোড় করে এপাশে ওপাশে মাথা দোলাচ্ছে। ছানাপোনাদের অনেকের হাতেও নানাধরনের প্ল্যাকার্ড। সে সবেও হরেক কিসিমের লেখা- ভোট ফর বাঘু; লেজ চিহ্নে ভোট দিন; লেজ চিহ্নে ভোট দিয়ে বাঘুকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করুন।

জঙ্গলের আনাচ কানাচ থেকে জন্তুজানোয়ারেরা বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে দেখছে বাঘু আর তার দলবলের কাণ্ডকারখানা। এপাশ ওপাশ ফিসফাস উঠেছে- যাই বলো বাপু, শিয়ালনীর পাঠশালা কিন্তু জব্বর! বাঘিন্নীর ছেলেটা কেমন গুছিয়ে মিছিল করছে বলো দেখি!

হিনিমিনি বিকেলবেলায় গাছের ডালে ডালে দোল খেয়ে বেড়াচ্ছিল। শোরগোল শুনে ওপরের ডালপালার আড়াল থেকে মিছিলের রকমসকম দেখে তো তার চক্ষুস্থির! মিছিলের পেছনে থাকা একটা পুঁচকে হরিণকে পাকড়াও করে সব কথা শুনল হিনিমিনি। তারপর তাড়াতাড়ি করে চলল হাতুশিকে খবর দিতে।

হাতুশি, হাতুশির মা হস্তিনী আর বাবা হস্তীর মধ্যে তখন ওদিকে চলছে জোরদার নাকডাকা, থুড়ি, শুঁড় ডাকার প্রতিযোগিতা। হাতুশির মা তার বন্ধু থাইল্যাণ্ডের শ্বেতহস্তিনীর থেকে একটা বিদেশি টেপ রেকর্ডার পেয়েছিল। সেটা পাশে অন করে রাখা। ঘুম ভেঙে দেখা হবে কে কত জোরে নাক ডাকতে পেরেছে!

হিনিমিনি তো আর অতশত জানে না। হাতুশিদের ডেরায় পৌঁছে তার আক্কেল গুড়ুম। একদিক থেকে থেকে হাতুশির শুঁড় ডাকার আওয়াজ আসছে- ঘুড়ুৎ ঘুড়ুৎ ঘুড়ুৎ ঘাঁই, অন্যদিক থেকে তার জবাব আসছে- পুঁড়ুস পুঁড়ুস পুঁড়ুস পাঁই। আবার সে ডাক মিলিয়ে যেতে না যেতেই হস্তিনীর শুঁড়ের আওয়াজ আসছে- ফুর ফুর ফুর ফোঁ! ঘুর ঘুর ঘুর ঘোঁ!     

শুধু শুঁড় ডাকা কী, তার সঙ্গে শুঁড় থেকে বেরোনো হাওয়ার প্রবল ঝটকা! দু তিনবার পড়ে যেতে গিয়েও কোনমতে সামলে সুমলে হিনিমিনি পোঁছোলো হাতুশির কাছে। মৃদু এক ঠেলা দিল হিনিমিনি, “হাতুশি! এই হাতুশি!”

যেই না ঠেলা দিতে গেছে, অমনি হস্তীর শুঁড়ের বাতাসের প্রবল ধাক্কায় হিনিমিনি গিয়ে পড়েছে হস্তিনীর পেটে। যেই না পড়া, অমনি হস্তিনীর শুঁড় থেকেও প্রবল শব্দ- ঘুম ঘুম ঘুম ঘোঁ! পুঁ পুঁ পুঁ পোঁ।     

ব্যস, হিনিমিনি উড়ে গিয়ে পড়ল হস্তীর পেটে। আর হস্তীর শুঁড় ডাকার চোটে ফের গিয়ে পড়ল হস্তিনীর পেটে। এইরকম বারকয়েক চলার পর বহুকষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছোল হাতুশির কাছে। থাবায় বারকয়েক কাতুকুতু দিতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসল হাতুশি। শুঁড় দিয়ে চোখ মুখ কচলিয়ে অবাক হয়ে শুধোল, “হ্যাঁ রে, হিনিমিনি, কী ব্যাপার? কিছু হয়েছে?”

হিনিমিনি রেগেমেগে বলল, “হয়েছে তোর শুঁড় আর বাঘুর লেজ! আরাম করে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস, আর বাঘু তো ওদিকে ভোটে জিতেই গেল!”

হাতুশি পাশে রাখা একটা জলের জায়গা থেকে শুঁড়ে করে কিছুটা জল নিয়ে চোখে মুখে ছেটাল, হিনিমিনির গায়েও খানিক জল ছিটিয়ে বলল, “ওঁ ভোটদানং স্বাহা! ওঁ প্যালটায় নমঃ!”

হিনিমিনি চটে লাল, “এসব ভড়ং ছাড় হাতুশি! বাঘু জিতলে ভালো হবে?”

হাতুশি তার শুঁড়খানাকে হিনিমিনির কাঁধে রেখে বলল, “আহা! অত ঘাবড়াচ্ছিস কেন? বাঘু জিতবে কী করে? ভোট তো দেবো আমরা পাঁচজন আর সিংহালু আর বাঘনি। এই তো! তা সবাই আমাকে সেদিন ভোট দিয়েই দিয়েছিল। সিংহালু আর বাঘনির ওপরও আমার ভরসা আছে। অত ঘাবড়াস না।”

হিনিমিনি চোখ বড়বড় করে লেজ নাচিয়ে যা যা দেখেছে বলল হাতুশিকে। তারপরে বলল, “জানিস, বাঘু ওই মিছিল নিয়ে ভালকি আর কুমরুর বাড়ি যাবে। গিয়ে ওদের নানা কথায় বোঝাবে! তারপর মিছিলে যত ছানাপোনা জন্তু আছে, ওদেরও চকলেট, খেলনা, রঙ, পেনসিল নানা রকম কিছু দিয়েছে! বাঘুদাদা বলতে সবাই অজ্ঞান!”

হাতুশি শুঁড় ওল্টাল, “তা সে যতোই দিক, ওদের তো আর ভোট নেই। তুই শুধুশুধুই ঘাবড়াচ্ছিস, হিনিমিনি।”

হিনিমিনি হাতুশির লেজ ধরে টানতে টানতে বলল, “তুই যা-ই বল্‌, তোর কথা শুনছি না। উঠে তৈরি হয়ে নে ঝটপট। তারপর চল্‌, ভালকি আর কুমরুর বাড়ি ঘুরে আসি।”

নেহাত বাধ্য হয়ে হাতুশি উঠল। তারপর চলল কুমরুর বাড়ি। সেখানে গিয়ে শুনল, বাঘু আর তার দলবল কিছুক্ষণ আগেই সেখানে প্রচার সেরে বেরিয়ে গেছে। কুমরু মহানন্দে বেশ কিছু ইলিশ মাছ ভাজা, চিংড়ির চচ্চড়ি এসব খাচ্ছিল। ওদের দেখেই বলল, “বাঃ! তোরাও এসে গেছিস? তা কী এনেছিস?”

হাতুশি খুব ঘাবড়ে গিয়ে শুঁড়টুড় চুলকে বলল, “কেন, কী আনব?”

কুমরু আরাম করে মাছভাজা চিবোতে চিবোতেই উত্তর দিল, “বাঃ রে! বাঘুই তো আমাকে এত সব দিয়ে গেল। আমি নিতে চাইছিলাম না। তাতে বলল, ভোটে দাঁড়ালে নাকি এসব দিতে থুতে হয়। তা আমি তো বাপু, কখনোও ভোটে দাঁড়াইনি। অতশত জানি না। তা তোরা কিছুই আনিসনি?”

          শুনেই হাতুশির শুঁড় শুকিয়ে এইটুকুনি। বাধ্য হয়ে হাল ধরল হিনিমিনি, “দ্যাখ কুমরু, ভোটে ওসব দেওয়াথোওয়ার নিয়ম নেই। কথা হচ্ছে, ‘পাঠশালা মহাসভা’য় যোগ্য কাউকে পাঠাতে হবে। আর হাতুশির চেয়ে উপযুক্ত কেই বা হবে? ভোটটা ভেবেচিন্তে দিস।”

          কুমরু বলল, “দ্যাখ, বাঘু এত ভালো ভালো খাওয়াচ্ছে। এরপর যদি ওকে ভোট না দিই, সেটা কি ঠিক হবে?”

          কুমরুর সঙ্গে আরও খানিকক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে বেরিয়ে এল ওরা। এবারের গন্তব্য ভালকির বাড়ি। গিয়ে দেখে, ভালকি পরমানন্দে একটা নতুন চাকের মধু খাচ্ছে। পাশেই রাখা আছে একটা ইয়াব্বড়ো নতুন টুথপেস্ট। ওদের দেখেই একগাল হাসল, “আয়, আয়। তোরাও মধু, টুথপেস্ট এইসব এনেছিস বুঝি?”

          হাতুশি শুঁড় গোঁজ করল, “না রে, ওসব কিছু আনিনি। পরে কোনসময় তোকে এমনিই বন্ধু হিসেবে খাওয়াতে পারি। তবে ভোটের প্রচারে বেরিয়ে ওসব দেওয়াটা কি উচিত?”

          ভালকি চোখ বুজে মধু চুষতে চুষতেই উত্তর দিল, “তা উচিত নয়, আমিও জানি। তবে কিনা, উপহার টুপহার পেতে তো ভালোই লাগে। তার উপর, দ্যাখ না, এই এতবড় টুথপেস্ট দিয়েছে। বাঘু যতোই বদমাশ হোক, মনে করে তো এনেছে!”

          হাতুশির মুখচোখ সত্যিই কাঁদোকাঁদো, “ভালকি, তুই তাহলে আমায় ভোট দিবি না?”

          ভালকি মধুর চাকটাকে শেষ করে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে জিভ চাটতে চাটতেই উত্তর দিল, “দেব না, তা বলছি না। দিতেও পারি, নাও পারি। সেসব পরে দেখা যাবে। আপাততঃ আমি বাবা এট্টু টুথপেস্টই খাই। মা-বাবা এখন নেই, এসে পড়লে খাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।”

          বেগতিক দেখে হাতুশি আর হিনিমিনি বেরিয়ে এল। হাতুশি খুব মুষড়ে পড়েছে। হিনিমিনি বন্ধুকে আলতো স্বরে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, “হাতুশি, তুইও বরং…!”

          হাতুশি শুঁড় উঁচিয়ে গর্জে উঠল, “কভি নেহি। আমি ওসব দিতেটিতে পারবো না। তাতে যদি বাঘু যদি জেতে তো জিতুক। ওরা যদি নিজেদের ভালো না বোঝে, আমি আর কী করব? বাঘুকে ওসব জায়গায় পাঠালে তো পাঠশালারই মুখ পুড়বে। সেসব কি ওরা বুঝছে না?”

          হিনিমিনি বলল, “সবই তো বুঝছি রে। কিন্তু আমার এসব ভালো লাগছে না। দিদিমণি যদি তোকে সরাসরি পাঠিয়ে দিতেন, সেই বোধহয় ভালো হত!”

          হাতুশি শুঁড় দিয়ে ভুঁউউউউস করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “যাকগে! ওসব আর ভেবে কী লাভ! দিদিমণি যা ভালো বুঝেছেন, করেছেন।”

          হিনিমিনি বলল, “হ্যাঁ, তাও ঠিক। যা হবার হয়েছে। তুই খানকয়েক ভালো দেখে শুঁড় চিহ্ন এঁকে রাখিস আর কিছু লিখে রাখিস। আমিও দেখি, কী করা যায়!”

 

নববর্ষের সকাল। আকাশে যে রাগী রাগী সূর্যস্যার থাকেন, তাঁর মুখচোখ আজ বেশ হাসিখুশি। অকাতরে লাল-কমলা হলুদ রঙ তিনি ছিটিয়ে যাচ্ছেন এদিক সেদিক। শিয়ালনীর পাঠশালাতেও সাজো সাজো রব। শুঁড়ের ছবি, লেজের ছবিতে চারিদিক ছয়লাপ।আশেপাশের সব গাছের ডালে নানারকম লেখা ঝুলছে। কোথাও লেখা- ‘শুঁড় চিহ্নে ভোট দিন’, তার পাশেই লেখা ‘মাননীয় বাঘুবাবুকে লেজ চিহ্নে ভোট দিয়ে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করুন’বাঘুর ওই লেখার পাশেই হিনিমিনি লিখে দিয়েছে- বাঘুকে পরাজয়যুক্ত করুন। শুঁড় চিহ্নে ভোট দিন, পাঠশালার গৌরবে অংশ নিন।

বাঘু হাসি হাসি মুখে ঢুকেছে পাঠশালায়। দুই থাবায় দুটো বড় বড় থলে। একটায় নানা রঙের আবির, অন্যটায় হরেক লাড্ডু। জিতলে মিষ্টিমুখ করাবে সবাইকে। হাতুশি খালি থাবাতেই ঢুকেছে। জিতলে দেখা যাবে। কালকেও ভালকি, কুমরুর বাড়ি গিয়ে তেমন একটা সাড়া পায়নি। বাঘু নাকি রোজদিনই প্রচুর প্রচুর জিনিস দিয়ে গেছে ওদের। আর বলে গেছে, “আর কিছু লাগলে বলিস।”

          সিংহালু আর বাঘনিকেও প্রচুর চিঠি লিখেছে নাকি বাঘু। সবই ভোট চেয়ে। হিনিমিনির জেদাজেদিতে বাধ্য হয়েই শেষটায় দুজনকে দুটো চিঠি লিখেছিল হাতুশি। কোনটারই উত্তর আসেনি।

          ভোটের তোড়জোড় সবে শুরু হয়েছে। একপাশে একটা ভোটের ঘর হয়েছে নানারঙের কাপড় দিয়ে। সেখানে যে যার ভোট দিয়ে আসবে। নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী পরপর ডাকা শুরু করেছে শিয়ালনী। কুমরুউউ…।

          এমন সময় মহা হই হট্টগোলের আওয়াজ ভেসে এল বাইরের দিক থেকে। ধুমধাম ধমাস ধাঁই, কিচিরমিচির কাঁই কাঁই। বিস্তর গোলমালের শব্দ। তার সঙ্গে কচি কচি গলার আওয়াজ- বাঘুদাদা জিতলে ’পরে/ ধমাস ধাঁই ঘরে ঘরে’; ‘ভোটে জিতবে কোনজন?/ বাঘুদাদা লেজরতন!’; ‘ভোট দেব দলে দলে/ বাঘুদাদা জিতল বলে’; ‘উলুস বুলুস গমাস গাঁই/ ভোট আমাদের দেওয়া চাই।‘   

শিয়ালনীর সঙ্গে বাকিরাও বেরিয়ে এসেছে। বাঘুকে দেখেই জোরালো আওয়াজ উঠল- বাঘুদাদা জিন্দাবাদ/ মনের সুখে খাই ভাত।

নের যত গুঁড়ি গুঁড়ি ছানাপোনা জন্তুজানোয়ার, সব চলে এসেছে। বোঝাই যাচ্ছে, সকলে বাঘুদাদার পরম ভক্ত। শিয়ালনী বেজায় রেগেমেগে হুঙ্কার ছাড়ল, “অ্যাই, তোরা সব এখানে কী করছিস?”

সমস্বরে আওয়াজ উঠল- বনের যত ছানাপোনা/ ভোট দিতে নেই মানা।/ বাঘুদাদাকে ভোটটি দেব/ পেটটি পুরে মিঠাই খাবো।

শিয়ালনীর শুনে আক্কেলগুড়ুম! বলে কী সব?  কোনমতে বলল, “বলিস কী রে তোরা? ভোট দিবি? তোরা এই পাঠশালায় পড়িসই না। ভোট দিবি কী করে?”

সমস্বরে উত্তর এল- “দিদিমণি, আমরা আজ হোক আর কাল হোক, আপনার পাঠশালাতেই তো পড়বো। কিভাবে ভোট দিতে হয় সব জানি! ওই প্যালট একটা করে দিয়ে দিন, আমরা বাঘুদাদাকে ভোট দেবো!”

“ভোট দিবি? বটে? একে পাঠশালায় পড়িস না, ভোট দেবারও বয়স হয়নি। ইসসস! মামাবাড়ির আবদার! বেশি যদি বাড়াবাড়ি করিস, তাহলে তোদের একটাকেও পরে আর পাঠশালায় ভর্তি নেবো না। বুঝেছিস?”, বলেই চোখেমুখে আগুন ঝরাতে ঝরাতে শিয়ালনী ফিরেছে বাঘুর দিকে, “আর এই যে বাঘু বাছাধন! আপনিও শুনে রাখুন, আপনার এইসব চালাকিবাজি নেহি চলেগা। ভালোয় ভালোয় ওদের বাড়ি পাঠান, নইলে ভোটফোট বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু! হাতুশির নামই ওখানে পাঠিয়ে দেবো।”

বেচারি বাঘু আর কী করে? কোনমতে বুঝিয়েসুজিয়ে ওদের ফেরত পাঠাল। আবার ভোট শুরু হবে, তার আগেই কাছুয়া এসে দুটো খাম দিয়ে গেল দিদিমণিকে, “এই যে, দিদিমণি, সিংহালু আর বাঘনি পাঠিয়েছে।”, তারপরই কাছুয়া ফিরল ওদের দিকে, “এই যে, পশুয়ারা, মন দিয়ে ভোট দিস সবাই। হাতুশি আর বাঘু, আগাম অভিনন্দন রইলো। যেই জিতিস, আমাকে মিষ্টি খাইয়ে যাস।”

এই বলে কাছুয়া যেমন তড়বড় তড়বড় করে এসেছিল, সেরকমভাবেই কিড়িং কিড়িং করে সাইকেলের ঘন্টি বাজাতে বাজাতে চলে গেল।

কাছুয়া চলে যেতেই শুরু হয়ে গেল ভোটপর্ব। কুমরু ভোট দিয়ে এসে পাশে রাখা একটা বাক্সের ওপরের ফুটোয় তার প্যালটখানা ঢোকাল। শিয়ালনী তার বাঁ হাতের তর্জনীতে স্কেচ পেন দিয়ে রঙ করে দিল।  বাঘু গেল ভোট দিতে। ভোট কামরায় অনেকটা সময় নিল বাঘু। কে জানে, কী ব্যাপার!

যাই হোক, একে একে সবারই ভোট হয়ে গেল। শিয়ালনী বলল, “চল, গোনা শুরু করি। আগে ওদের দুজনেরটা গুনে নিই। দুটো চিঠিও আছে দেখছি। তা থাক, সেগুলো শেষে পড়ব।”

দেখা গেল, দুটো ভোটই পেয়েছে হাতুশি। হিনিমিনির এতোই আনন্দ হল যে তিড়িং করে লাফ দিয়ে উঠে গেল পাশের গাছের ডালে আর ফের লাফ দিয়ে নিচে নামার সময়, পড়বি তো পড়, পড়ল দিদিমণির ঘাড়ে! কটমট করে চাইল শিয়ালনী, “হিনিমিনি, ফের যদি এরকম বেচাল দেখি তাহলে কিন্তু তোর ভোট বাতিল করে দেবো!”

হিনিমিনি বসে পড়ল কাঁচুমাঁচু হয়ে। শিয়ালনী গোনা শুরু করল ওদের ভোট। হাতুশি পেয়েছে চারটে ভোট আর বাঘু পেয়েছে দশটা!

সবাই তো তাজ্জব! এ আবার কী! অতজন তো নেই-ই পাঠশালায়! বাঘু ধিচাং ধিচাং করে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে, “আমি জিতে গেছি! ইয়াহু! আমি জিতে গেছি! ইয়াহু! হাতুশি হেরে গেছে! হুঃ হাঃ!”

হিনিমিনি শুকনো মুখে বলল, “কিন্তু দিদিমণি, হাতুশি তো ওদের দুটো ভোটও পেয়েছে। মানে, চার আর দুইয়ে ছয়।”

শিয়ালনী বলল, “হিনিমিনি, এই তোর হিসেব? ছয় হলেও সেটা দশের চাইতে কম! মানে হল, জিতেছে…”

বাঘু ‘হুপ্পাউউউউ’ করে বিশাল এক ডাক ছেড়ে লাফ মেরে এসে বসল শিয়ালনীর সামনে, “মানে হল, আমি জিতেছি! কী মজা! ইয়াহু! আমি যাবো মহাসভায়! ইয়াহু!”

শিয়ালনী কঠিন চোখে চাইল বাঘুর দিকে, “না, তুমি যাবে না, বাঘু বাছাধন! হাতুশিই যাবে। চিটিংবাজি করে জেতা যায় না। বুঝেছো? এই যে! দ্যাখ রে তোরা। বাঘুর কাণ্ড! এই ক’টা প্যালট ও নিজে বানিয়েছে! এরকম কিছু একটা করতে পারে আমি আন্দাজ করে প্রতিটা প্যালটে একটা করে নাম্বার দিয়ে রেখেছিলাম। এই প্যালটগুলোতে কোন নম্বরই নেই। তার মানে বাঘুর জালিয়াতি। ওগুলো বাতিল। আর তার মানে, হারল বাঘু আর জিতল হাতুশি! হাতুশি যাচ্ছে ‘পাঠশালা মহাসভায়’!

হাতুশি এতক্ষণ ধরে মনখারাপ করে বসেছিল একধারে। হিনিমিনি, ভালকি আর কুমরু এসে টানাটানি করে নিয়ে এল তাকে মাঝে। তারপরেই শুরু হয়ে গেল নাচানাচি-

ভোটের বাজার সরগরম-

কচুরি-আলু দমাদ্দম!

হুম চটপট ধাঁই ধপাস!

হাতুশি জেতে, আরিব্বাস!

হারল বাঘু গোহারা,

মুখে তার নাইকো রা!

জিতবে হাতুশি, আবার কে?

ভোটটি সবাই দিয়েছি ওকে।

আয়রে বাঘু, তুইও আয়,

লাড্ডু যত আছে কোথায়?

         

নাচ কতক্ষণ চলত বলা যায় না, কিন্তু হঠাৎ করে হাতুশির টনক নড়ল, “দিদিমণি, সিংহালু আর বাঘনি কী লিখেছে?”

শিয়ালনীও ওদের নাচ দেখছিল বিভোর হয়ে। চমকে উঠে বলল, “হুমম। তাইতো! দাঁড়া বাঘনির চিঠি পড়ি।”

বাঘনি চিঠিতে লিখেছে-

প্রিয় বাঘুদাদা,

যদিও তুমি আমাকে অনেক চিঠি দিয়েছো, তবুও ভোটটা হাতুশিদিদিকেই দিলাম। কারণ এক, হাতুশিদিদি খুব ভালো মেয়ে। ওরই ভালো জায়গায় যাওয়া উচিত। আর দুই, তুমি আমাকে এবারে কম জ্বালাওনি। এমনকি, ফেরার সময় আমার থলেতে অব্দি রঙজলের বেলুন ভরে দিয়েছিলে! ঢিল মারলে তো পাটকেলটি খেতেই হবে। যাকগে, তুমি আমার অনেক অনেক লেজমলা নিও(দেখা হলে সরাসরিই দেবো)।

ভেংচি সহ,     

                                                                                                      বাঘনি

সিংহালুর চিঠিটা খুলে দেখা গেল, সেটা আসলে একটা ছড়া। সিংহালু লিখছে-

 

ভোটটি দেওয়া বিষম বালাই।

কাকে দেবো ভাবছি তাই।

 

সবার প্রিয় দিদি হাতুশি,

মেজাজখানা সদাই খুশি।

 

বাঘুদাদা দুষ্টু বেজায়,

তাতেই বলো, কী আসে যায়?

 

ফন্দিফিকির যতরকম,

ভোটের বাজার সরগরম।

 

ভালো পশুয়াই জিতুক তবে,

ভোটটি দিই হাতুশিদিকে।।

 

বেচারি বাঘুর প্রাণে কি আর অত দুঃখ সয়? মাটিতে লেজ আছড়াতে আছড়াতেই শুরু করে দিল ভেউভেউ, “ওরে আমার এ কী সব্বোনাশ হল রে… আঁই আঁই আঁই আঁই(কান্না)… এত কাণ্ড করেও সব পণ্ড হয়ে গেল রে…আঁই আঁই আঁই আঁই(কান্না)… ওরে, এরা সব পেটপুরে সাঁটিয়ে শেষে হাতুশিকেই ভোটটি দিল রে এ এ এ এ…আঁই আঁই আঁই আঁই(কান্না)… ওরে, আমার সব চালাকি মাঠেই মারা গেল রে এ এ এ…আঁই আঁই আঁই আঁই(কান্না)…ওরে আমার প্রাণে এক বালতি দুঃখু হয়েছে রে এ এ এ … আঁই আঁই আঁই আঁই(কান্না)…ওরে, আর এক বালতির সঙ্গে এক গামলাও দুঃখু হয়েছে রে এ এ এ এ…আঁই আঁই আঁই আঁই(কান্না)…আঁই আঁই আঁই আঁই(কান্না)…আঁই আঁই আঁই আঁই(কান্না)…।”

 

……০…… 

অংকনঃ সোমক সেনগুপ্ত

 

বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি থাবাছানি দিচ্ছে নিচের লিঙ্কেঃ-

১। বাগে এলো বাঘু

২। গিঁটের গেরোয় বাঘু

৩। বাঘু খেল ঘাস

৪। বাঘু হলেন মনিটর

৫। শিয়ালনী কুপোকাত

৬। অযোধ্যা পাহাড়ে বাঘু 

৭। পরীক্ষা দিলেন বাঘু

৮। গণ্ডারনী ও গণ্ডগোলিক্স

৯। নামতা শেখেন বাঘুবাবু

১০। শিয়ালনীর পাঠশালায় সিংহালু

১১। বাঘু হল চিৎপটাং 

১২। ঘুম দিলেন বাঘুবাবু               

১৩। পাঠশালায় ধুন্ধুমার

১৪। বাঘুবাবু ও জান্তা জট 

১৫। বনভোজনে বাঘুবাবু

১৬। হোলি খেলল হিনিমিনি      

Leave a comment

Check Also

বিদেশি মোলাকাতে বাঘু- মৌসুমী পাত্র

            ধুস! ধুস! ধুস! ‘দূর ছাতা’ বলে যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে …

baghu_kobi sommelan

কবি সম্মেলনে বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

            পাঠশালায় আসছিল শিয়ালনি। আজ দেরিই হয়েছে কিছুটা। কাল সন্ধেবেলা খরগোশাই ডাক্তারদিদির বাড়ি নিমন্ত্রণ …

উল্কার কবলে বাঘু

উল্কার কবলে বাঘু – মৌসুমী পাত্র

(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা  তোমাদের দিযছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ …

শিল্পী- সোমক সেনগুপ্ত/ জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু

জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

  পিঠে থলে ঝুলিয়ে বাঘু চলেছে পাঠশালার পানে। মনে বেশ খুশি খুশি ভাব। একটা গাছের …