দোলের আর দেরি নেই বেশি। সোনারঙা কাঁপন গাছেদের পাতায় পাতায়। ফুলে ফুলে রাঙা হয়ে আছে শিমূল গাছ। পাতাই প্রায় দেখা যায় না তার। পলাশ গাছেরা সেজেছে ভোরবেলাকার সূর্যের মতন কমলা রঙে। জঙ্গলের ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, পাখিদের কিচিরমিচির, জন্তুজানোয়ারদের হাঁকডাককে মাঝেমাঝেই ছাপিয়ে যায় কোকিলের কুহুতান। বসন্ত এসে গেছে।
পাঠশালার পশুয়াদের মনেও পুলক-কাঁপন। শীতে জবুথবু থাকার পর প্রাণকাড়া দখিনা বাতাসের দোলা লেগেছে দেহে-মনে। টিফিনের সময়ে অল্পস্বল্প নাচগান হচ্ছে প্রায়ই। হাতুশি নাচে আর তার পিঠে তুড়ুক তাঁই করে নাচতে থাকে হিনিমিনি। ভালকি আর কুমরু পছন্দ করে একে অন্যের কোমর ধরে দুলে দুলে নাচ। নাচছে না খালি বাঘু। অন্যসময় বাঘুর নাচগানের দাপটে সকলে একরকম ব্যতিব্যস্তই থাকে দিনভর, কিন্তু এখন কেন কে জানে, টিফিন টাইমেও বাঘু মুখ গুঁজে পড়ায় ব্যস্ত। সেদিন বাঘু টিফিনের সময় বই নিয়ে পাশ দিয়ে পড়তে পড়তে যাচ্ছে, লেজ ধরে এক টান দিল কুমরু, “আয় বাঘু, চল, সবাই মিলে একটু থাবানৃত্য করি বরং।”
বাঘু বই থেকে মুখ না তুলেই এক ধমক দিল কুমরুকে, “দেখতে পাচ্ছিস না নামতা মুখস্থ করছি? পড়াশুনোর সময় মোটে ডিস্টার্ব করা উচিত নয়।”
তাই শুনে শুঁড় তুলে হাতুশির সে কী হাসি, “বলিস কী রে, বাঘু? এ যে দেখি, ভূতের মুখে রামনাম!”
ভালকি তাড়াতাড়ি সংশোধন করে দিল হাতুশিকে, “বল্, বাঘুর মুখে পড়ার নাম!”
অমনি আরেক চোট হাহাহাহা, হিহিহিহি!
বাঘু ওদের কথায় মোটে পাত্তা দিয়ে “দশ এক্কে দশ, দশ দুগুণে ভুঁড়ি… না না ভুঁড়ি কেন হবে, ইয়ে মানে… ভুঁড়ি কেন হবে… দশ দুগুণে মুড়ি… না না, মুড়িই বা কেন হবে… কুড়ি… ইয়ে মানে দশ দুগুণে কুড়ি…” করতে করতে চলে গেল।
বাঘু চলে যেতেই ওদের চোখমুখ গোলগোল। হাতুশির গলায় চিন্তার সুর, “কী হল বল্ তো? বাঘু কি সত্যিই পড়াশুনো করছে নাকি?”
ভালকি সায় দিল, “ভারি ভাবনার কথা।”
কুমরু তার গায়ের কাঁটায় থাবা বোলাতে বোলাতে বলল, “হুমম। একটু আধটু হইচই, গণ্ডগোল না হলে কিসের পাঠশালা? একটুও যদি না কেউ দুষ্টুমি করে, তাহলে পাঠশালার নাম তো ধুলোয় লুটোবে রে!”
হিনিমিনি ওদের কথার মাঝে কখন যে টক করে পাশের গাছে উঠে গেছে, কেউ খেয়ালই করেনি। এইবারে ওপর থেকে ঝট করে নেমে এসে সটাসট তিনজনের লেজ টেনে একে ওকে ধাক্কা মেরে ফের উঠে গেল উপরের গাছে। ওদের শত ডাকাডাকিতেও আর নামল না। দিদিমণি যখন ক্লাসে ঢুকছেন সেইসময় নেমে দিদিমণির পাশটিতে লক্ষ্মী হনুমানের মত বসে পড়ল। ওরা কেউ আর কিছু বলার বা করার সুযোগই পেল না।
আর মাত্র একদিন পরেই দোল। টিফিনের পর পাঠশালায় পড়া শুরু হতে না হতেই একদফা আলোচনা জমে উঠেছে। হাতুশিই প্রথম কথা পেড়েছে, “দিদিমণি, কাল দোল। আমরা একটু খেলতে চাই।”
হিনিমিনি লেজ ঝাঁকাল, “হ্যাঁ দিদিমণি, দোলে খেলতে হয়, নইলে ঝামেলায় পড়তে হয়।”
ভালকি ফুট কাটল, “দোল খেলা আমাদের বাসন্তিক অধিকার!”
বাঘু থাবা ছুঁড়ল, “খেলো সবে দোল, নইলে গণ্ডগোল!”
কটমট করে তাকিয়েছে শিয়ালনী, “বাঘু! বাঘুউউউউ! এই তোর বদমায়েশির ভয়েই আমি খেলতে দিতে চাইছি না। তুই যে কখন কী করে বসবি!”
বাঘু কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, “দিদিমণি, আমি কিছু করলেও বকুনি, না করলেও বকুনি! ঠিক আছে, বকুনি খাওয়া নাহয় আমার জন্মগত অধিকার! কিন্তু এই যে হিনিমিনি, আপনার পাশে ভালো হনুমানের মত বসে আছে- ওকেই জিজ্ঞেস করুন না, সকালে আমার লেজ ক’বার টেনেছে?”
শিয়ালনী চশমার ফাঁক দিয়ে কড়া চোখে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় শুধোল, “হিনিমিনি, তুমি ক’বার বাঘুর লেজ ধরে টেনেছো?”
হিনিমিনি নিজের লেজটা বারকয়েক চুলকে নিয়ে বলল, “দিদিমণি, বেশি আর টানতে পারলাম কই? মাত্তর চারবার টেনেছি। তবে তার মধ্যে বাঘুও আমার লেজ একবার টেনেছে, দিদিমণি। তার মানে ওই একবার শোধবোধ হয়ে থাবায় আছে মাত্তর তিনবার লেজটানা।”
শিয়ালনী এতোই চমকে গেল যে তার চশমাখানা একবার লাফ দিয়ে কপাল বরাবর উঠে গেল, আর পরক্ষণেই ঝুপুস করে নিজের জায়গায় ফিরে এল। ঢাক-পেটানো আওয়াজ ছাড়ল শিয়ালনী, “বটে? এতদূর? অ্যাইয়ো মনিটর হাতুশি, তুই-ই বল্, কী হয়েছে? সব খোলসা করে বলবি কিন্তু।”
হাতুশি মনে মনে একটু দমেই গেল। যা হয়েছে, সবই এক্কেবারে তার শুঁড়ের সামনে! কিন্তু হাজার হোক, হিনিমিনি তার প্রাণের বন্ধু! তার সম্পর্কে বলতেই কি আর মন চায়? অথচ দিদিমণি জানতে চাইলে তো বলতেই হয়! দোটানায় পড়ে ধীরে ধীরে শুঁড় নাড়ল হাতুশি, “হয়েছে কী, দিদিমণি, আজ টিফিনে মা চারটে কলাগাছ দিয়েছিল। তার মধ্যে দুটো কলাগাছ আমি নুন-লংকা-সরষের তেল মাখিয়ে খাচ্ছিলাম। আরেকটু আচার হলে জমত, কিন্তু মা আচার দেয়নি। বাকি দুটো কলাগাছ রেখেছিলাম পরে গুড় দিয়ে মাখিয়ে খাবো বলে। বাঘু আমার পাশে বসে রুটি আর মাংসের মালাইকারি খাচ্ছিল। ডিমের ডালনা আর কাঁচকলার কোপ্তাও ছিল কাছেই। আর হিনিমিনি আমাদের উপরের গাছের ডালে বসে পাকাকলার পাতুরি, চাঁপাকলার চাটনি আর সিঙ্গাপুরি কলার শিঙাড়া খাচ্ছিল। ভালকি আর কুমরু কিতকিত খেলছিল। এমন সময় আচমকা হিনিমিনি গাছ থেকে লাফ দিয়ে নিচে নেমেই বাঘুর লেজ ধরে এক টান দিয়ে দু’গালে ঠাস ঠাস করে দুই থাপ্পড় মেরে কাঁচকলার কোপ্তা নিয়ে উপরে উঠে গেল। থাপ্পড় খেয়ে বাঘুর দু’গাল তো আপেলের মতো লাল টসটসে! যাইহোক, তাড়াহুড়োতে একটা সিংগাপুরি কলার শিঙাড়া আমার শুঁড়ের উপরে পড়ল। তা সেটাকে তো আর মাটিতে পড়ে নষ্ট হতে দেওয়া যায় না, তাই আমি সেটাকে শুঁড়ের ভেতরেই ঢুকিয়ে নিলাম।”
শুনেই বাঘুর দুঃখ একেবারে উথলে উঠল, “ও হো হো হো! আমি একটুও কোপ্তা খেতে পেলাম না গোওওওও!”
শিয়ালনী এক দাবড়ানি দিয়ে থামিয়ে দিল বাঘুকে, “থামবি তুই? তোর জন্যই যত অশান্তি! আগেভাগে কোপ্তাটা খেয়ে শেষ করতে পারলি না? যত্ত সব! তারপরে হাতুশি, এ তো মাত্র একবার লেজ টানা হল। বাকি তিনবারের লেজ টানা কই?”
হাতুশি শুঁড় দিয়ে মুখের ভেতরটা একবার চেটে নিয়ে বলল, “শিঙাড়াটা সত্যি দারুণ ছিল, দিদিমণি! এখনো যেন মুখে লেগে আছে! আহা! আহহা! আপনি খেলে বুঝতেন! হ্যাঁ, তাপ্পরে বাঘু তো রেগে কাঁই। শুরু করল লম্ফঝম্ফ। আর সেই ফাঁকে হিনিমিনি আরেকবার ফস করে গাছ থেকে নেমে এসে বাঘুর লেজে আরেক টান দিয়ে ফেরত গেল। এবারে হিনিমিনির হাত ফসকে চাঁপাকলার চাটনিটা পড়ে গেল আর আমিও সেটাকে মুখের মধ্যে লুফে নিলাম। ভালো করিনি, দিদিমণি?”
শিয়ালনী গলায় মেঘের ডাক, “তা চাঁপাকলার চাটনিটা খেতে কেমন ছিল, শুনি?”
হাতুশি শুঁড় দিয়ে আরেকবার মুখ চাটল, “বেড়ে ছিল, দিদিমণি। আপনিও যদি ওইসময় গাছের তলায় থাকতেন, আপনিও পেতেন! যাই হোক, বাঘু তো রেগেমেগে গাছের উপরে ওঠার চেষ্টা করছে, এমন সময় হিনিমিনি করেছে কী, অন্যদিক দিয়ে নেমে বাঘুর লেজে তিন নম্বরের টান তো দিলোই সেই সঙ্গে বাঘুকে খানিক কাতুকুতু দিয়ে লাফ মেরে পালাল। আর পালানোর সময়…”
শিয়ালনী বাধা দিয়ে বেজার মুখে বলল, “থাক্, থাক্, আর বলতে হবে না। বুঝেছি। পালাবার সময় খানিকটা পাকাকলার পাতুরি তোর মুখে ছিটকে এসে পড়ল, আর তোর কিছু করার ছিল না বলে সেটাকে গিলে নিলি। এই তো?”
হাতুশি একগাল হাসল, “একদম ঠিক ধরেছেন, দিদিমণি। সে পাতুরির যে কী স্বাদ আপনাকে আর কী বলবো! আহা! আহ-হা!”
শিয়ালনী বিরসমুখে বলল, “থাক্, থাক। তোকে আর স্বাদ ব্যাখ্যা করতে হবে না। আমি ভালোই বুঝতে পারছি। তারপরে বল্, কী হল?”
হাতুশির আরেকটু স্বাদ ব্যাখ্যা করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু বাধাপ্রাপ্ত হয়ে একটু মনক্ষুণ্ণই হল। যাইহোক, আবার সে বলতে শুরু করল, “তারপরে দিদিমণি, হিনিমিনিকে কাতুকুতু দিতে দেখে আমারও কী জানি কিরকম হল! পেট গুড়গুড় করতে লাগল, কান ভুড়ভুড় করতে লাগল, শুঁড় সুড়সুড় করতে লাগল। তাই আমিও গিয়ে বাঘুকে কিছুটা কাতুকুতু দিয়েই ফেললাম।”
পাশ থেকে ভালকি ফুট কাটল, “তাই দেখে আমিও কিছুটা কাতুকুতু দিলাম। আমারও খুব কাতুকুতু দেওয়া পেয়ে গিয়েছিল কিনা।”
কুমরু বলল, “দিদিমণি, আমি ভাবলাম সবাই যখন দিচ্ছে আমি না দিলে পাছে আবার বাঘুর খারাপ লাগে! তাই আমিও এট্টু কাতুকুতু দিলাম।”
কুমরুর কথা শেষ হতে না হতেই হাতুশি গালে শুঁড় ঠেকাল, “সেই কথাই তো বলছি, দিদিমণি। কুমরুর কাতুকুতু দেওয়া শেষ হতে না হতেই হিনিমিনি আবার হাজির। আর সেই ফাঁকে বাঘু একবার লেজ টেনেছে হিনিমিনির আর সেও একবার লেজে টান দিয়েছে বাঘুর। আর সে টানাটানিতে বলবো কী দিদিমণি, হিনিমিনির হাত ফসকে খানিকটা কাঁচকলার কোপ্তা প্রথমে আমার থাবায়, তারপর থাবা থেকে মুখের ভেতরে…। কেমন স্বাদ, বলবো দিদিমণি?”
শিয়ালনী জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁটটা একবার চেটে নিয়ে শুকনো মুখে বলল, “থাক, থাক। আর অত বলাবলিতে কাজ নেই!”
বাঘু এদিকে ততক্ষণে কাঁইকাঁই করে কাতরানি শুরু করে দিয়েছে, “দিদিমণি, এই হিনিমিনিটার জ্বালায় আমি আজ ভালো করে টিফিনই খাওয়া হল না। আঁ আঁ আঁ… কাতুকুতু খেয়েই পেট ভরে গেল… উঁ উঁ উঁ উঁ…”।
শিয়ালনী ফিরল হিনিমিনির দিকে, “এই বসন্তকালে কি তোমার চিত্ত চঞ্চল হইয়াছে, হিনিমিনি?”
হিনিমিনি কি একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই কিড়িং কিড়িং করে জঙ্গলের ওপাশ থেকে সাইকেলের ঘন্টির আওয়াজ ভেসে এল। ওরা সবাই তাকিয়ে দেখে, খাকি পোশাক পরে সাইকেল থেকে নামছে কাছুয়া। কাছুয়া সাইকেল থেকে নেমে দিদিমণিকে গড় করে হাতে একটা খবরের কাগজ ধরিয়ে বলল, “দিদিমণি, এই নিন ‘জানোয়ার বার্তা।’ আজকেই এল কাগজটা। আর পরশু তো দোল, মানে হোলি। পাঠশালায় নিশ্চয়ই খেলা হবে তোমাদের। আগাম শুভেচ্ছা। হোলি হ্যায়।”
বলেই কাছুয়া যেমন এসেছিল, তেমনি তাড়াতাড়ি করে সাইকেল নিয়ে চলে গেল।
কাছুয়া চলে যেতেই ওরা সবাই মুখে প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে ফিরল দিদিমণির দিকে। বাঘু বলল, “দিদিমণি, তাহলে…?”
শিয়ালনী হতাশ ভঙ্গি করে বলল, “তাহলে আর কী? খেলা হবে। যে যার রঙ নিয়ে সকাল সকাল চলে আসিস। আমি দুপুরে খিচুড়ি রাঁধবো। খেলেটেলে চানটান সেরে খেয়েদেয়ে যে যার বাড়ি যাবি। এখন চল্, দুটি পড়াশুনা করে আমাকে উদ্ধার কর দেখি।”
টিফিনের সময় জোরদার দোল-বৈঠক বসেছে। (মানে দোলের দিন ওরা কী কী করবে সেইসব আলোচনা আর কী!) কুমরু হিহি হিহি করে হাসতে হাসতে বলল, “তোরা তো কেউ আমার কাছে এসে রঙ মাখাতে পারবি না। হিহি হিহি! হাতে কাঁটা ফুটে যাবে। হিহি হিহি!”
জবাবে হাতুশি শুঁড় তাক করল কুমরুর দিকে, “আমি শুঁড়ে রঙজল নিয়ে তোর কাঁটায় ছেটাবো! হোহো হোহো!”
ভালকি মাথা দোলাল, “আমার সারা গায়ে যা লোম তুই জল ছেটালেও গা বেশি ভিজবেই না। হেহে হেহে!”
হিনিমিনি বলল, “আমি যা একখানা খাসা মতলব ভেঁজেছি না! হুহু হুহু!”
বাঘু বলল, “কী মতলব ভেঁজেছিস রে? তাহলে আমিও সেই মতলবটাই করবো। হৌ হৌ হৌ হৌ!”
হিনিমিনি বেশ গর্ব- গর্ব গলায় বলল, “আমি বানাবো বাঁদরকালি। আর তোদের সবার মুখে লাগাবো।”
শুনেই হাতুশি শুঁড় ওল্টাল, “ধুস, কী যে বলিস! বাঁদরকালি আবার কী বানাবি রে তুই? বল্, হনুমান-কালি বানাবি।”
বাঘু তৎক্ষণাৎ এক লাফ দিল তুড়ুক করে, “ইয়াহু! আমি বানাবো বাঘ-কালি!”
হিনিমিনি এপাশে-ওপাশে জোরে জোরে ঘাড় নাড়ল, “বাঘ-কালি হয় না। কখনও হতে নেই।”
বাঘু দমাস করে মাটিতে এক ঘুঁষি মেরে বলল, “আলবত হয়। বাঁদর-কালি, হনুমান-কালি যদি হয়, বাঘ-কালি হতে কী দোষ? বাঘের কি কোন মানপ্রেস্টিজ নেই?”
ভালকি দুখী দুখী মুখে বলল, “আমি বরং ভেলুন বানাই তবে।”
“ভেলুন? ভেলুন আবার কী রে?”, কুমরুর গালে থাবা।
“ভেলুন জানিস না?”, ভালকির মুখে মিটিমিটি হাসি, “মানুষে যেমন বেলুন বানায়, তেমনি আমরা বানাই ভেলুন। মানে ভালুকের বানানো বেলুন। মানুষের দেওয়া নাম আমরা নিই না কিনা।”
সঙ্গে সঙ্গেই একখানা জগঝম্প লাফ দিল বাঘু, “ঠিকাছে। ঠিকাছে। আমি তবে কাল বাঘকিরিই নিয়ে আসবো।”
হাতুশি গালে শুঁড় ঠেকাল, “বাঘকিরি? অ, বুঝেছি। মানে বাঘের বানানো পিচকিরি। মানুষের বানানো নাম তোরাও নিশ্চয় নিস না! হো হো হো হো!”
বেজায় রেগে বাঘু তেড়ে গেল হাতুশির দিকে, “তোকে আমি কাল রঙ মাখিয়ে ইয়েতি… না না… ধুস, না না…ইয়েতি না… ইঁচড় বানাবো।”
ভালকি বাঘুকে একটা আলতো খোঁচা মেরে বলল, “আর তোকে আমি ভেলুনের ঘায়ে ভুটকম্বল বানাবো।”
তারপরই শুরু হয়ে গেল মহা হইচই। এ ওকে খোঁচা দেয়, সে তার লেজ ধরে টানে, একজন আরেকজনকে কাতুকুতু দেয়। এ বলে ‘খেলা হবে’, ও বলে ‘হনুমান-কালিও হবে’, অন্য একজন বলে, “খেল খতম হবে।’ চিৎকার, চেঁচামেচি। ভাগ্যে ঢং ঢং করে টিফিন শেষের ঘন্টা পড়ে গেল, নইলে এসব জিনিস আর কতক্ষণ চলত, বলা মুশকিল।
দোলের দিন সকালবেলা। শিশির ভেজা মাটির নরম সুবাস বনের আনাচে কানাচে। গাছে গাছে পাখিদের কূজন আরম্ভ হয়ে গেছে ভোর হতে না হতেই। হাতুশি হেলতে দুলতে আসছে পাঠশালার পানে। রাতশেষে ঝরে পড়া লাল-কমলা-হলুদ ফুলে ছেয়ে আছে বনের মাটি। গাছে গাছে রকমারি রঙের বাহার। হাতুশির গলায়, পিঠে রকমারি ঝোলা। কোনটায় আবির, কোনটায় এটাসেটা রঙ, কোনটায় পিচকিরি। তার শুঁড়ে আবার একটা বালতি ঝুলছে। সেটায় রঙ গোলা জল। প্রয়োজনে যাতে ঝটপট শুঁড়ে করে রঙ ছেটাতে পারে, তার ব্যবস্থা।
পাঠশালায় ঢুকছে হাতুশি, এমন সময় হঠাৎ করে ওপর থেকে থপাস! একটা জলভর্তি বেলুন কোন্দিক থেকে এসে পড়ল তার মাথায়। এদিক ওদিক চাইল হাতুশি, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। বাধ্য হয়ে আরেকটু এগিয়েছে, তখন আবার থপ থপ থপাস! আরেকটা জলভর্তি বেলুন এসে ফেটেছে তার পিঠে। আর তার সঙ্গেই হিনিমিনির গলার আওয়াজ, “হোলি হ্যায়! হোলি হ্যায়!”
ওপরের দিকে চাইল হাতুশি। হিনিমিনিকে দেখা যাচ্ছে না। তবে প্রায় সব গাছেরই ডালে ঝুলছে বিভিন্ন ধরনের পোঁটলা, নানারকম ঝোলা। হিনিমিনি সেই কোন্ ভোরবেলা এসে গাছের উঁচু ডাল বেছে বেছে ঝোলাভর্তি, পোঁটলা ভর্তি রঙ, বেলুন, জলের বোতল, আরও কত কী গুছিয়ে রেখে গেছে। সেসব কথা তো আর হাতুশি জানে না। সে খালি অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে এক জায়গায় হিনিমিনির লেজ সামান্য একটু ঝুলতে দেখল। শুঁড় ভর্তি করে রঙ-জল নিয়ে হাতুশি ধেয়ে গেল সেদিকে, “তবে রে! আমাকে তুই জল-বেলুন দিস! ইতনা বড়া আস্পর্ধা!”
বলতে না বলতেই শুঁড় ভর্তি রং-জল ভুউউস করে হিনিমিনির দিকে তাক করে ছুঁড়তে গেছে হাতুশি। আর সেই সময়েই অন্যদিক থেকে ভেসে এসেছে হিনিমিনির গলা, “বেশ। আর জলবেলুন দেবো না। এই নে, কেলুন। মানে কলার রস ভর্তি বেলুন! কেলুন নিয়ে খেলুন! কেলুন নিয়ে খেলুন!”
বলতে না বলতেই খানদুয়েক কেলুন ফটাস ফটাস করে ফাটল হাতুশির ঘাড়ে। আর হাতুশি এমনই চমকে গেছে যে তার শুঁড় ভর্তি রঙ-জল ভুউউউস করে ছুঁড়তে গিয়ে চারপাশের গাছপালা খানিক ভিজল আর গলার বালতি কেতরে গিয়ে সে নিজেই ভিজেটিজে একশা। বেজায় নাকাল হয়ে হাতুশি চলল একটু দূরের ফাঁকা জায়গায় ঝোপঝাড়ের আড়ালে। এদিকে ততক্ষণে একখানা ইয়েতি-মার্কা পোশাক পরে কে যেন ঢুকছে পাঠশালায়। দেখতে পেয়েই হাতুশি ধেয়ে গেছে সেদিকে আর গিয়েই ফুউউউউচ করে পিচকিরির মত ফোয়ারায় দিয়েছে ভিজিয়ে। ইয়েতির পোশাকের এদিকে সেদিকে আবার বড় বড় পকেট। সেখান থেকে একটা পিচকিরি বের করে আনল ‘ইয়েতি’, “হা রে রে রে হাতুশি, বাঘকিরি দিয়ে ভেজাবো যত খুশি!”
শুঁড়ের জল ঝাড়তে ঝাড়তে হাতুশি বলল, “তবে রে বাঘু! দেখবি এবার ঘুঘু!” এই বলে বাঘুকে শুঁড়ে দু’পাক খাইয়ে মাথার মুখোশ খুলে মুখে আচ্ছাটি করে রঙ মাখিয়ে বলল, “যা! এবারে যেখানে খুশি চরগে যা।”
আর সেই সময়েই ফের ধপ ধপ ধপাস! ওপর থেকে শিলাবৃষ্টির মত গুচ্ছ গুচ্ছ বেলুন, রঙের ফোয়ারা এসে পড়ল হাতুশি আর বাঘুর গায়ে-মাথায়। আড়াল থেকে উড়ে এল হিনিমিনির গলা, “হনুমান-কালির খেল দেখলি! রসে ভরা কেলুন খেলি!”
হাতুশি আর বাঘু দেখবে কী, হিনিমিনির হাত থেকে পালানোর জন্য পাঁইপাঁই করে দুজন তখন দুদিকে পালাতে ব্যস্ত।
হাতুশি আর বাঘু যখন চম্পট দিচ্ছে, এদিকে তখন পাঠশালার একদিক দিয়ে ঢুকছে রাক্ষসের মুখোশ পরা একজন, আর অন্যদিক দিয়ে ঢুকছে হাঙরের পোশাক পরা কেউ। ঢুকেই দুজনে মুখোমুখি আর ভয়ের চোটে দুজনেই চিৎপটাং। আর সেই সময়েই ধপাস ধপাস করে দুটো ইয়া সাইজের বেলুন এসে ঘায়েল করে দিল দুজনকেই। কোনমতে তাড়াতাড়ি করে গা ঝেড়ে রাক্ষসটা তেড়ে গেল হাঙরের দিকে, “অ্যাই হাঙর, আমাকে ভিজিয়ে দিলি যে বড়?”
হাঙরও গায়ের ধুলো ঝেড়েঝুড়ে উঠে বসল, “তুইও আমাকে ভিজিয়ে দিলি কেন রে? হ্যাঁ হ্যাঁ?”
রাক্ষস এবারে দুই কোমরে থাবা দিয়ে চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “অ্যাই হাঙর, তুই কুমরুর মতন গলা করেছিস কেন রে?”
হাঙর হাঁ করল, “অ্যাইয়ো রাক্ষস, ভালকির মতন গলায় কথা বলছিস কেন রে? জানিস, ও আমার বন্ধু হয়!”
রাক্ষস বলল, “তাই বুঝি? তাহলে এই দ্যাখ!”, বলেই রাক্ষস একটানে মাথার মুখোশ খুলল আর হাঙরটা অবাক হয়ে দেখল, আরে, এ যে ভালকি! ওদিকে হাঙরও ততক্ষণে তার মুখোশ খুলে ফেলেছে আর দেখা গেল যে সে কুমরু!
আর সেই সময়েই ধাঁই ধপধপ ধপাস! গাছের ওপর থেকে হিনিমিনি একের পর এক ছুঁড়ে যাচ্ছে জলভরা বেলুন, কলার রসভরা কেলুন, হনুমান-কালি ভরা পিচকিরি। সে আবার গাছের মগডালে বালতিও ঝুলিয়ে রেখেছে, আর সেখান থেকে রঙ গোলা জল পাইপে করে হুউউউস করে ছুঁড়ছে।
হিনিমিনির নাগাল থেকে বাঁচতে হাঁইহাঁই করে ছুটে কে যে কোন্দিকে গেল, আর পাত্তাই পাওয়া গেল না।
এদিকে সেইসময় অনেক ব্যাগপত্তর থাবায়, গলায়, পিঠে ঝুলিয়ে পাঠশালায় ঢুকছে শিয়ালনী। ঢুকেই খানিক থমকেছে! আরে, পশুয়াগুলো গেল কোথায় সব? ওদের তো এতক্ষণে খেলা আরম্ভ হয়ে যাবার কথা!
এদিকে হাতুশি ততক্ষণে ঝোলাঝুলি ভর্তি করে রঙ টঙ রেডি করে গুটিগুটি থাবায় বেরিয়েছে ঝোপের আড়াল ছেড়ে। হিনিমিনিও তক্কে তক্কে ছিল। হাতুশি বেরোতেই ‘কেলুন নিয়ে খেলুন’, ‘কেলুন নিয়ে খেলুন’ বলে চিল চিৎকার করে খানকয়েক কেলুন ছুঁড়েছে। আর পড়বি তো পড়, কেলুনগুলো গিয়ে পড়েছে শিয়ালনীর মাথায়, গালে, কপালে, ঘাড়ে। আর সর্বাংগ কলার রসে চটচট। তাতেও কি রেহাই আছে। তার পরপরই হিনিমিনি তাগ করেছে পিচকিরি ভরা হনুমান-কালি। ব্যস, আর যায় কোথায়? শিয়ালনীকে চেনার আর কোন উপায়ই রইল না। এমনকি, পিচকিরিতে ভিজে তার লেজ অব্দি এই সরু হয়ে গেল। সেই সময়েই হাতুশি থাবাভর্তি আবির, শুঁড় ভর্তি রঙ-জল নিয়ে হাজির। দিদিমণিকে দেখে চিনতেও পারেনি মোটে। ভেবেছে, হিনিমিনি। ব্যস, আর যায় কোথায়? অমনি দিদিমণিকে জাপটে ধরে শুঁড়ভর্তি রঙজল ছেটাতে ছেটাতে হাঁক দিয়েছে, “তবে রে, হিনিমিনি! বলি, পালাবি কোথায়? খুব ভেবেছিলি না, আমাকে রঙ মাখাবি? এইবার? এইবার? দ্যাখ, কেমন লাগে!”, বলে শিয়ালনীর গায়ে আবির মাখাতে মাখাতে শুঁড় তুলে ডাকল বাকিদের, “ওরে বাঘু- তাড়াতাড়ি আয়। হিনিমিনিকে বাগে পেয়েছি। চটপট আয়।”
সব কিছুই এমন ঝটিতি ঘটে যাচ্ছে যে শিয়ালনী আর কিছু বলারই সুযোগ পাচ্ছে না। তার উপর হাতুশির চাপে হাঁসফাঁস অবস্থা। উপরন্তু বাঘু এসেই বাঘকিরি নিয়ে আচ্ছাটি করে রঙ মাখিয়ে দুই থাবা কোমরে দিয়ে দাঁড়াল শিয়ালনীর সামনে। তারপরে গালে আচ্ছাটি করে আবির ঘষতে ঘষতে বলল, “এইবারে, হিনিমিনি, আয়নায় গিয়ে নিজের চেহারা দেখবি যা। তুই হিনিমিনি না দিদিমণি- নিজেই মালুম পাবি না!”
শিয়ালনী হাঁউমাঁউ করে উঠল, “হ্যাঁ রে, আমি সত্যিই দিদিমণি।”
বাঘু তৎক্ষণাৎ এক দাবড়ানি দিল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ! উনি আবার দিদিমণি! যা যা! আর দিদিমণির গলা নকল করতে হবে না!”
হাতুশির ততক্ষণে নজর গেছে শিয়ালনীর লেজের দিকে। ভেবলে গিয়ে বলল, “ওরে হিনিমিনি, তোর লেজটা এরকম ছোট হল কী করে… আরে, লেজে আবার দিদিমণির মত ফুল… তাহলে কি … তাহলে কি…”
শিয়ালনী ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, “হ্যাঁ রে বাবা, আমি সত্যিই দিদিমণি! তোদেরকে কি হাতের লেখা লিখে দেখাবো? তবে বিশ্বাস করবি?”
শুনেই তো হাতুশির শুঁড় উঠে গেছে মাথায়! কোনমতে সামলে নিয়ে শুঁড় দিয়ে স্যাটস্যাট খানদশেক থাবাপ্রণাম সারল। তারপরেই খেয়াল হল, আরে, আবির দিয়ে প্রণাম করা হল না! অমনি গলার একটা ঝোলা থেকে শুঁড় ভর্তি আবির নিয়ে ভুউউউস করে আবির ছিটিয়ে দিদিমণির পা পুরো ঢেকে দিয়ে প্রণাম সেরে বলল, “দিদিমণি, দোলের প্রণাম!”
যেই না বলা, বাঘু সঙ্গে সঙ্গে এক প্যাকেট আবির দিদিমণির পায়ে উপুড় করে ঢেলে ধাঁই ধাঁই করে থাবাপ্রণাম সারল, “দিদিমণি, আমার দোলের প্রণাম!”
এত ভক্তির চোটে শিয়ালনী দিশেহারা! ঠিক সেই সময়, গাছের উপর থেকে দুটো আবির ভরা বেলুন শিয়ালনীর দুই পায়ে পড়ে ফটাস ফটাস ফাটল। ওপর থেকে পাওয়া গেল হিনিমিনির গলা, “দিদিমণি, আমার প্রণাম!”
হাতুশি শুঁড় বাগিয়ে ডাকল, “হিনিমিনি, নিচে নেমে প্রণাম কর। ওপর থেকে ওরকম প্রণামে কোন ফল হয় না। দিদিমণি তোকে আশীর্বাদ করবেন কী করে?”
হিনিমিনি আর কী করে? গাছ থেকে লাফিয়ে নেমে এসে প্রণাম সারল দিদিমণিকে। শিয়ালনী থাবায় পলাশ ফুলের রঙ নিয়ে আশীর্বাদ করল ওদের, “বাছাধনেরা, জন্তুর মতো জন্তু হও! জানোয়ারকুলের নাম যেন উজ্জ্বল করতে পারো! পশুকুলের পশুত্ব যেন তোরা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারিস!”
হিনিমিনি তালে ছিল, দিদিমণির আশীর্বাদ সারা হলেই পাঁইপাঁই করে পালাবে! কিন্তু হাতুশিও তক্কেতক্কে ছিল। আশীর্বাদ শেষ হতেই হিনিমিনিকে শুঁড়ে জাপটে ধরে দেদার রঙ মাখাতে শুরু করে দিল। বাঘু তার পিচকিরি তাক করল, “এই দ্যাখ, আমার বাঘকিরির কেরামতি!”
হাতুশি বলল, “তোর বাঘকিরি, আর আমার শুঁড়কিরি! এইবারে হিনিমিনি, হোলি খেলতে খুব ভালো লাগছে, না? খুব মজা হচ্ছে নিশ্চয়ই!”
বাঘু হিনিমিনির লেজে আচ্ছাটি করে রঙ মাখাতে মাখাতে বলল, “এইবারে? সেদিন খুব আমার লেজ টেনেছিলি না? হুঁহুঁ বাছাধন, বাঘু দেখেছো, বাঘকিরি তো আর দেখোনি!”
শিয়ালনী একটুখানি ওদের খেলা দেখে বলল, “ঠিক আছে, তোরা খেলাধূলা কর। আমি যাই, নদীতে চান সেরে আসি। তোরা কেউ কিন্তু আর আমার গায়ে রঙ লাগাস না। ফিরে এসে আমি একটা কাপড় দিয়ে ওদিকটায় ঘেরাটোপ বানিয়ে রান্না করবো। কেউ কিন্তু ওদিকে যাবি না। দরকারে দূর থেকে ডাকবি।”
শিয়ালনী চলে গেল। দিদিমণি চলে যেতেই দ্বিগুণ উৎসাহে ওরা শুরু করল হিনিমিনিকে রঙ মাখানো। এমনকি, হিনিমিনির থলে থেকে খানকয়েক কেলুন বের করে ফটাস ফটাস করে ফাটালো ওর গায়ে মাথায়। হিনিমিনি মাখলো বটে, কিন্তু তার ফাঁকেই দু-চারবার জিভ বের করে কলার রসও চেটে নিল।
ওদিকে ভালকি একটা ঝোপের আড়ালে বসে মহানন্দে তার ভেলুনগুলো ঠিকঠাক করছিল। মধু খাবার পর যে খালি চাকটা পড়ে থাকে, তার মধ্যে মনের সুখে রঙ ভরেছে ভালকি। তারপর হালকা মোম দিয়ে বাইরেটা আটকে দিয়েছে। ব্যস, ভেলুন রেডি। এইবারে মুখের দুপাশে বড়বড় দুখানা লাল রঙ মাখা দাঁত আটকাল ভালকি, যাতে তার চেহারাটা আরও ভয়ংকর লাগে! তারপর ঝোপের আড়াল থেকে থাবা বাড়াল।
ভালকি খেয়াল করেনি, তার ঠিক উল্টোদিকের ঝোপের আড়ালে বসে কুমরুও তার সাজসরঞ্জাম তৈরি করছিল। সে অতশত ঝামেলায় যায়নি। পিচকিরি ভর্তি ঘন সবুজ রঙ আর বড় বড় ঠোঙা ভর্তি আবির। তবে তার হাঙরের মাথায় কী মনে করে দুটো বড় শিং লাগিয়ে মুখোশে আরও খানিক কালিঝুলি মেখে তৈরি হয়ে বেরোল।
ভালকিও বেরিয়েছে, আর উল্টোদিক থেকে কুমরু! আর দুজনের খোলতাই চেহারা দেখে দুজনেই ফের ঘেমেনেয়ে একশা। ভালকির ভেলুন কুমরুর গায়ে লেগে ভটাস ভটাস ফাটল আর ভয়ের চোটে কুমরুর হাতের পিচকিরি চাপ খেয়ে পিচকিরি ছুটে ভালকি ভিজে টইটুম্বুর!
ভোঁ ভোঁ করে ছুটল ভালকি আর কোঁ কোঁ করে দৌড়োল কুমরু। ছুটতে ছুটতে ভালকি গিয়ে গোঁত্তা মেরেছে হাতুশিকে আর কুমরু গিয়ে ঢুঁসো মেরেছে বাঘুকে। হিনিমিনি তখন সবে হাতুশি আর বাঘুর থাবা থেকে ছাড়া পেয়ে জব্বর রকমের খোলতাই চেহারা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে! আর তার সেই চেহারা দেখে রাক্ষস আর হাঙর দুজনেই দাঁতকপাটি খেয়ে উল্টেছে।
হাতুশি হাঁইমাঁই করে উঠেছে, “ওরে বাবা রে! পাঠশালায় রাক্ষস!”
বাঘু কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসে বলল, “একা রাক্ষসে রক্ষা নাই, হাঙর দোসর!”
হিনিমিনি বলল, “দাঁড়া! রাক্ষস হোক আর হাঙরই হোক, আজ আমার হাতের কেলুন না খেয়ে কারুর রেহাই নেই।”
হিনিমিনির ঝোলায় তখনও কয়েকটা কেলুন ছিল। কেলুনের গুঁতো খেয়ে রাক্ষস রে রে করে উঠেছে, “ওরে কুমরু রে! তুই কোথায় গেলি রে?”
ওদিকে হাঙর হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছে, “ওরে ভালকি রে! তুই আমাকে বাঁচা রে! এ কোন্ সব্বোনেশে জন্তু এলো রে!”
হাতুশি শুঁড় দোলাল, “হিনিমিনি, তুই এবারে থাম। ওটা রাক্ষস নয়, ভালকি। আর ওটা হাঙর নয়, কুমরু। বাঘু অত ভয়ের কিছু নেই। উঠে বোস। খেলা শেষ।”
বাঘু চোখ পিটপিট করতে করতে উঠে বসল। কাঁদোকাঁদো মুখে বলল, “খেলা শেষ কোথায় রে? এই তো, খেলা শুরু।”
হিনিমিনি বলল, “তার মানে?”
বাঘু পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা চিঠি বের করল। ওরা ঝুঁকে পড়ল সেটার ওপর। লেখা আছে-
প্রিয় বাঘুদাদা,
পত্রের প্রথমে তুমি আমার লেজমলা নিও। তারপরে খুব গোপনে, তোমাকে একটা খবর দিই। মা বলেছে, দোলের পরপরই তোমাদের ওখানে যাবে। আমিও যাবো। মা পাঠশালাতেও যাবে, তোমার খোঁজখবর করবে। বাঘিন্নীমামী জানিয়েছে, তুমি নাকি খুব ফাঁকি মারো, মোটেই পড়া করো না। মা বলেছে, দরকারে তোমাকে এনে আমাদের এখানে রাখবে, আর নাকে দড়ি দিয়ে পড়াশুনা করাবে। আর ওখানে যদি থাকি, তাহলে আমাকেও তোমাদের পাঠশালায় পাঠিয়ে দেবে! অতএব, নিজের যদি ভালো চাও, তাহলে ফাঁকিবাজি ছাড়ো, পড়াশুনো করো।
নেহাত তুমি আমার বাঘুদাদা, তাই এত কথা লিখলাম। নইলে আমার বয়েই গেছল।
আমার শতকোটি ভেংচি নিও।
ইতি- বাঘনি।
চিঠিটা মন দিয়ে পড়ল ওরা। হাতুশি শুঁড়ে দুবার হুম হুম আওয়াজ তুলে বলল, “এতক্ষণে বোঝা গেল, বাঘু কেন হঠাৎ করে এত ভালো হয়ে গেছে! কিন্তু হিনিমিনি, তোর এত দুষ্টুমির কারণ কী?”
বলেই পাশের দিকে চাইল হাতুশি। এ কী, হিনিমিনি কই? তার জায়গায় পাশের গাছের উপর থেকে পাইপ ভর্তি রঙজলে ভিজে গেল সবাই, দমাস দমাস করে কেলুন এসে এসে পড়ল ওদের গায়ে পিঠে। আর তার সঙ্গে পাওয়া গেল হিনিমিনির গলা, “বা রে! তোরাই তো বলছিলি, পাঠশালায় কেউ দুষ্টুমি না করলে মানায়? এই নে, পাঠশালার মানসম্মান বজায় রাখছি। হোলি হ্যায়! আর এই নে, আমার স্পেশাল ডোজ, হনু-কালি-কিরি!”
বলতে না বলতেই পিচিক পিচিক করে হনু-কালি ভরা রঙের ফোয়ারা গাছের উপর থেকে ছুটে এসে ভিজিয়ে দিল ওদের সবাইকে। আর বালতি বালতি রঙ উপুড় হয়ে পড়তে থাকল ওদের গায়ে মাথায়। আর নেপথ্যে চলল হিনিমিনির গান-
ইড়িং বিড়িং ধমাস ধাঁই
দোলের দিনের জবাব নাই।
কট কটাকট কটকটাং-
ভালকি-কুমরু চিৎপটাং!
হাতুশি আসে শুঁড় বাগিয়ে,
কেলুন খেয়ে যায় হেদিয়ে…
বাঘুর থাবায় বাঘকিরি
ইকিড় মিকিড় ধাঁই কিড়ি!
রঙ মেখেছেন দিদিমণি-
খেলল হোলি হিনিমিনি!
……০……
অংকনঃ গুঞ্জা
বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি থাবাছানি দিচ্ছে নিচের লিঙ্কেঃ-