(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে পাঠশালার খবর ভেসে আসে মাঝেমধ্যে। এলেই তোমাদের জানাতে থাকবো। পাঠশালাটা কোথায় জানো? বনের ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে প্রচুর গাছপালা মিলে মাথার উপরে একটা চাঁদোয়ার মত বানিয়েছে, আর দুটো সেগুনগাছের ইয়া মোটা মোটা গুঁড়ি দুদিক থেকে এসে একটা দরজার মতো তৈরি হয়েছে। জঙ্গলের যত ছানাপোনা জন্তুজানোয়ার, সবাই আজকাল সক্কালবেলা হলেই হাতমুখ ধুয়ে চাট্টি মুড়ি খেয়ে ওখানেই পড়তে যায়। তাদের মধ্যে আছে বাঘিনীর বাচ্চা ছেলে বাঘু, হাতির বাচ্চা মেয়ে হাতুশি আর হনুমানের ছানা মেয়ে হিনিমিনি। এছাড়াও আছে ভালুকের পুঁচকি মেয়ে ভালকি আর কুমীরের বাচ্চা ছেলে কুমরু।)
বাতাসে হালকা শিরশিরে আমেজ। উত্তুরে হাওয়া অল্প অল্প করে ছুটতে শুরু করেছে জঙ্গলের মধ্যে। এমনকি আকাশে যে রাগী রাগী মুখের সূর্যস্যার থাকেন, তাঁর হাবভাবও ইদানীং কিছুটা নরম। গ্রীষ্মকালে কেন কে জানে, তিনি বেজায় খাপ্পা হয়ে থাকেন সবসময়। আর শরৎকাল পেরোলেই যেন শীতের মাফলার জড়িয়ে তাঁর মুখচোখ ভারি কোমল হয়ে আসে। জঙ্গলের গাছেদেরও এটা পাতা ঝরানোর সময়। গাছেদের গোড়ায় শুকনো ঘাসপাতার পুরু গালিচা। টুপটাপ করে পাতা ঝরছে সর্বক্ষণ। উত্তুরে হাওয়া এসে মাঝেমাঝেই গাছেদের মাথা ধরে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে আচ্ছাটি করে আর ঝরঝর করে একরাশ শুকনো, আধাশুকনো পাতা মুখ লুকোচ্ছে নীচের মাটিতে।
হাতুশি চুপচাপ বসে বসে গাছেদের পাতা ঝরা দেখছিল। তার মনটা কেমন যেন উদাস উদাস। প্রার্থনা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। দিদিমণি যে কেন এখনো ক্লাসে ঢোকেননি কে জানে? পাশে হিনিমিনি বসে একটা গাছের ডাল নিয়ে মাটিতে একমনে একটা কলার ছবি আঁকছে। কুমরু আকাশের দিকে থাবা ছুঁড়ে ছুঁড়ে কিসব নাচের ভঙ্গি অভ্যেস করছে। বাঘু নিজের থলেখানার উপর এই চিৎপটাং হয়ে শুচ্ছে তো এই উঠে বাবু হয়ে বসছে। ভালকি নিজের থলেখানা খুলে এক একবার একটা টুথপেস্ট বের করছে আবার থলের ভেতর রেখে দিচ্ছে।
শিয়ালনী ক্লাসে ঢুকল ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে, “হ্যাঁ রে, তোরা কেউ আমার চশমাটা দেখেছিস? খুঁজে পাচ্ছি না। চারিদিকে খুঁজলাম।”
ভালকি টক করে উঠে দাঁড়াল, “না দিদিমণি, এখানে তো চোখে পড়েনি।”
হাতুশি শুঁড় দোলাল, “দিদিমণি, আজ তো এই প্রথম এখানে এলেন।”
শিয়ালনী গম্ভীরমুখে ঘাড় নাড়ল, “তাই তো রে। মনে হয় বাড়িতেই ফেলে এসেছি। চশমা ছাড়া আমি আবার মোটে ভালো দেখতে পাইনা।”
তাই শুনে বাঘু খুব খুশি খুশি মুখে মাথা নাড়ল, “দিদিমণি, তবে কি আমাদের পাঠশালা আজ ছুটি?”
শিয়ালনী শুনেই খাপ্পা, “অমনি ছুটির ধান্দা, না বাঘু বাছাধন? ইসসস! কী ফূর্তি, না? ছুটি টুটি নেহি হোগা, বাঘুজী!”
রাগের চোটে হিন্দীই বলতে শুরু করেছে শিয়ালনী। বাঘু দিব্যি ভালোবাঘের মতন থাবাজোড় করে বলল, “আপনি কি আমাকে হিন্দী করে বকলেন, দিদিমণি?”
শিয়ালনী তেড়েই আসে আর কী, “হ্যাঁ, তোমাকে বকেছি, বাঘু বাছাধন। অত আহ্লাদের কোন কারণ নেই, বুঝেছ? আমি ঘরে যাবো, চশমা নিয়ে আসবো, তোমাদের পড়াতে শুরু করবো। ততক্ষণ তোরা যে যার মতো বই নিয়ে পড়তে থাক। বুঝেছিস সব? আর হাতুশি! তুই খেয়াল রাখবি কে কী করছে। কেউ বেগড়বাঁই করলে বোর্ডে নাম লিখে রাখবি। আমি চললাম।”
বলেই আর কাউকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে শিয়ালনী গটমট করে চলে গেল। দিদিমণি বেরিয়ে যেতেই শুরু হয়ে গেল ওদের চিৎকার, চেঁচামেচি, গণ্ডগোল, নাচানাচি। অবশ্য হাতুশি বাদে। সে সমানে চেষ্টা করে যাচ্ছে বন্ধুদের থামানোর। কিন্তু তার কথা আর কেই বা শোনে? বাধ্য হয়েই গলা ওঠাল হাতুশি, “শোন্, এবারে যদি তোরা না থামিস, তাহলে কিন্তু আমি চললাম বোর্ডে নাম লিখতে।”
হিনিমিনি অমনি হাতুশিকে কাঁচকলা দেখিয়ে বলল, “সে তুই লেখ না যত খুশি। আমিও চললাম গাছের ওপরে গিয়ে আরাম করে শোবো।”
হাজার হোক, হিনিমিনি হাতুশির প্রাণের বন্ধু। সে-ই এরকম বলায় হাতুশি মনে মনে বেজায় দমে গেল। কোনমতে বলল, “দ্যাখ হিনিমিনি, দিদিমণি বলে গেছেন বই পড়তে।”
হিনিমিনি বলল, “সে আমি নাহয় গাছের উপরে উঠে বসেই বই পড়ছি। দিদিমণি বই পড়তে বলেছেন, গাছের উপর উঠতে তো আর বারণ করেননি।”
বাঘু পাশ থেকে ফুট কাটল, “দ্যাখ হাতুশি, হিনিমিনি গাছের উপর উঠলে তুই যদি ওর নাম না লিখিস তাহলে কিন্তু আমি দিদিমণি এলেই বলে দেবো। তোর প্রাণের বন্ধু বলে তুই নাম লিখবি না, সেটা তো হবে না। অ্যায়সা চালাকি নেহি চলেগা, নেহি চলেগা।”
হাতুশি একরকম চুপসেই গেল একথা শুনে। বন্ধুর নাম লিখতে কি আর মন চায়? কিন্তু শত হলেও সে মনিটর, দিদিমণি তাকে ভরসা করেন। হাতুশি তাই চলল বোর্ডে নাম লিখতে।
বোর্ডে নাম লিখতে শুরু করবে, এমন সময় তার নজরে পড়ল, বাঘু আরাম করে থাবার উপর মাথা দিয়ে চিৎপাত হয়ে শুয়ে আছে। হাতুশি ছুটে এসে শুঁড় দিয়ে এক ঠেলা দিল, “ই কী রে বাঘু! তুই এমন শুয়ে আছিস কেন? ঘুমোবার তাল করছিস নাকি?”
বাঘু একগাল হাসল, “বুঝলি রে হাতুশি! খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। দেখি যদি ঘুম আসে, তাহলে এক চক্কর ঘুমোতেও পারি।”
হাতুশি শুনে হাঁ। শুঁড়খানাকে গালে ঠেকিয়ে বলল, “সে কী রে বাঘু! এই সাতসকালেই ক্লান্ত? কী এমন করেছিস যে এত ক্লান্ত হয়ে গেলি?”
বাঘু আয়েস করে একটু নড়েচড়ে শুয়ে বলল, “কী করিনি তাই বল? কাল রাত থেকেই ধর না। রাতে খাও রে, ঘুমোও রে, সকালে ঘুম থেকে ওঠো রে। ঘুম থেকে উঠেও কি আর শান্তি আছে? দাঁত মাজো রে, মুখ ধোও রে, একটু দুষ্টুমি করো রে, তারপরে মায়ের বকুনি খাও রে! তারপরেও কি আর রেহাই আছে? খাবার খাও রে, পড়তে বসো রে, পড়ার নামে ইচ্ছেমত ফাঁকিবাজি করো রে, আবার মায়ের বকুনি খাও রে! তাপ্পরে চান করো রে, খেয়েদেয়ে বইখাতা গোছাও রে! ইচ্ছে করে দেরি করো রে, ফের মায়ের বকুনি খাও রে! তারপরে পাঠশালায় আসো রে! উফফ… উফফ! কী খাটুনি! কী খাটুনি! এত খেটে খেটে আমার সোনার অঙ্গ বলে কালি হয়ে গেল!”
হাতুশি শুনে হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না। কোনমতে বলল, “বাঘু, উঠে বই নিয়ে বোস। নইলে কিন্তু…”
বাঘু মিটিমিটি হাসল, “নইলে কিন্তু … কী? বোর্ডে নাম লিখবি, এই তো? তা লেখ না। লেখ না যত খুশি। আমার নাম না লিখলে এমনিতেও বোর্ডটা কিরকম ন্যাড়া ন্যাড়া লাগে আজকাল। মনে হয় কী যেন নেই। আমার নামটা লিখেই দে। নইলে কিন্তু দিদিমণি তোকেও বিশ্বাস করবেন না।”
রেগেমেগে হাতুশি চলল বোর্ডে নাম লিখতে। হাতুশি পিছন ফিরতেই ধুম ধাম ধমাস ধমাস করে জোরে জোরে আওয়াজ। তাকিয়ে দেখে হাতুশি, কুমরু মনের সুখে নাচ জুড়েছে। আর নাচের সঙ্গে সমানতালে চলছে তার গান-
অ্যাড়াং ব্যাড়াং খ্যাড়াং
হাতুশির মহা ফ্যাচাং-
বাঘু ওদিকে শুয়ে আছে
ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাঙ।
হিনিমিনির বুদ্ধি ভারি
চাপে গাছের ডালে
বয়েই গেল ভারি তার
নামটি লেখা হলে।
হাতুশি ছুটে গেল কুমরুর দিকে, “অ্যাইয়ো কুমরু, তোর নাচ থামাবি? দিদিমণি পড়া করতে বলে গেছেন। নাচ থামিয়ে পড়া কর। নইলে কিন্তু তোরও নাম লিখবো।”
কুমরু গান থামাল। কিন্তু নাচের ভংগিতেই থাবা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলল, “আজ এত বড় থাবানৃত্যের সুযোগ পেয়েও যদি ছেড়ে দি, তাহলে কি সেটা ঠিক হবে রে? তুই এক কাজ বরং, ওদের দুজনের সঙ্গে আমার নামটাও জুড়ে দে। ভালোই হবে, দিদিমণির বকুনি সবাই মিলে ভাগাভাগি হয়ে যাবে।”
হাতুশি কী একটা বলতে যাচ্ছিল, তখন ওপাশ থেকে ভালকি হেঁকে উঠল, “হাতুশি, আমার নামটা বাদ দিবি কেন রে? আমি কি কিছু দোষ করেছি?”
হাতুশি বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “কেন, তুই আবার কী করছিস?”
বলতে বলতেই হাতুশির চোখে পড়ল, ভালকি ব্যাগ থেকে টুথপেস্টের মত কী যেন একটা বের করেছে। হাতুশি ভারি অবাক হয়ে শুধোল, “হ্যাঁ রে, তুই ব্যাগ থেকে ওটা কী বের করছিস রে? টুথপেস্ট নাকি?”
ভালকি লজ্জা লজ্জা মুখে হাসল, “আসলে কী জানিস তো? আমার না টুথপেস্ট খেতে দারুণ লাগে। ঘরে খেলে বকে তো! আর এখন দিদিমণিও নেই যে বকবেন। তাই আমি বরং এখন একটু টুথপেস্টই খাই। তুই খাবি একটু?”
হাতুশি শুঁড় গোঁজ করে বলল, “না, আমি খাব না। আমি টুথপেস্ট খাই না।”
ভালকি রাগ রাগ মুখে বলল, “তা খাবি না তো বয়েই গেল। না খেলে আমারই ভালো। তুই খেলে আমারো ভাগে কম পড়বে।”
হাতুশি শুঁড় তুলে বলল, “ভালকিইই, তোর নাম কিন্তু আমি লিখবো বোর্ডে।”
ভালকি মাথা দুলিয়ে বলল, “তা লেখ না। আমি বই পড়তে পড়তেই বরং টুথপেস্ট খাই। দিদিমণি বই পড়তে বলেছেন, টুথপেস্ট খেতে তো আর বারণ করেননি।”
রেগেমেগে বোর্ডের কাছে গিয়ে লিখতে শুরু করল হাতুশি-
১। বাঘু- থাবা তুলিয়া চিৎপাত হইয়া শুইয়া আছে।
২। হিনিমিনি- গাছের ডালে বই লইয়া আরাম করিতেছে।
৩। কুমরু- ড্যাং ড্যাং করিয়া নাচিতেছে।
৪। ভালকি- মহানন্দে টুথপেস্ট খাইতেছে।
সবার নামটাম লেখা হয়ে গেলে হাতুশি এসে বসল নিজের জায়গায়। মনটা তার বেশ খারাপ। বন্ধুরা কেউ তার কথা শুনল না। তাকেও সবার নাম লিখতে হল। ভাবতে ভাবতেই থলেতে হাত ঢোকাল। একটা গল্পের বই কাল ঢুকিয়েছিল না? খুঁজেপেতে বইটা বের করে আনল সে। বইটার নাম- ‘মানুষ ফানুস’। বইটা পড়া শুরু করতে গিয়ে কী যেন বেশ মনে হল হাতুশির। বোর্ডে গিয়ে লিখে এল- ৫। হাতুশি- মনের দুঃখে গল্পের বই পড়িতেছে।
ফিরে এসে সব দেখেশুনে শিয়ালনীর তো চক্ষু চড়কগাছ! দিদিমণি যে এসে গেছেন কারুর হুঁশই নেই। হাতুশি বুঁদ হয়ে গল্পের বই পড়ছে তো পড়েই যাচ্ছে- তার আর কোনদিকে খেয়াল নেই। বাঘু শুয়ে আছে চিৎপাত হয়ে আর তার নাক দিকে ভুঁ ভুঁ করে কিসব আওয়াজ হচ্ছে থেকে থেকেই। হিনিমিনিকেও দেখা যাচ্ছে না ডালপাতার আড়ালে, খালি তার লম্বা লেজখানা ঝুলছে গাছের উপর থেকে। খালি কুমরু নাচ করতে করতে নাচের তালেই দিদিমণিকে নমস্কার জানাল- দিদিমণি নমস্কার/ পাঠশালাটি পরিষ্কার।।
কুমরুর কথা কানে যেতেই ধড়মড় করে উঠে বসল হাতুশি। তার তখনও গল্পের বইয়ের ঘোর কাটেনি। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, “দিদিমণি, আপনি ফানুস আনতে গেছিলেন বুঝি?”
শিয়ালনী প্রায় তেড়েই আসে আর কী, “হতভাগা, তোকে বলে গেলাম কিনা যে ক্লাসের খেয়াল রাখতে! কে কী করছে বোর্ডে লিখতে! নিজে বসে বসে গল্পের বই পড়ছিস, আর আমাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে ফানুস এনেছি কিনা।”
ভালকি উল্টোদিক থেকে একগাল হেসে বলল, “না রে, দিদিমণি গেছিলেন টুথপেস্ট আনতে। তাই না, দিদিমণি?”
শিয়ালনী তেড়েই এল, “উফফ! উফফ! একটুক্ষণ মোটে গেছি, তাতেই পাঠশালা সব লাটে তুলে দিয়ে বসে আছে! এ বলে দিদিমণি ফানুস আনতে গিয়েছিলেন তো ও বলে, দিদিমণি টুথপেস্ট আনতে গেছিলেন? হতভাগা! যত্ত সব!”
ততক্ষণে সব খেয়াল পড়েছে হাতুশির। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে শুঁড়খানাকে যথাসম্ভব কাঁচুমাঁচু করে বলল, “কী করবো দিদিমণি, কেউ কথা শুনছিল না যে! ওই দেখুন না, আমি বোর্ডে সব গুছিয়ে লিখে রেখেছি। এমনকি, আমার নিজের নামও।”
শিয়ালনী গিয়ে দেখে বোর্ডে সুন্দর করে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে-
১। বাঘু- থাবা তুলিয়া চিৎপাত হইয়া শুইয়া আছে।
২। হিনিমিনি- গাছের ডালে বই লইয়া আরাম করিতেছে।
৩। কুমরু- ড্যাং ড্যাং করিয়া নাচিতেছে।
৪। ভালকি- মহানন্দে টুথপেস্ট খাইতেছে।
৫। হাতুশি- মনের দুঃখে গল্পের বই পড়িতেছে।
হাঁউমাঁউ করে চেঁচিয়ে উঠল শিয়ালনী, “এসব কী কাণ্ড? বলি, এসব কী কাণ্ড? অ্যাঁ? আমি মোটে একটু চশমা আনতে গিয়েছি, আর সেই ফাঁকে তোরা যার যা খুশি তাই করবি? হিনিমিনি আবার গাছের ডালে বসে আছে? হাতুশি, নামা ওটাকে। ভালকি, অত টুথপেস্ট খাওয়া কিসের? আমি তো সকালবেলা মোটে একটুখানি খাই। বাঘু! বাঘুউউউউউউ! ওঠ! ওঠ, বলছি। নাক দিয়ে আবার ভুঁ ভুঁ করে অতসব আওয়াজ করছিস কেন?”
বাঘু গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল, “আসলে দিদিমণি, কুমরু নাচ করছিল কিনা, তাই আমি ওর নাচের সঙ্গে একটু বাজনা বাজাচ্ছিলাম। এট্টু আধটু বাদ্যি ছাড়া কি আর নাচ জমে?”
“ও! ওটা বুঝি তোর বাজনা হচ্ছিল? ওই ভুঁ ভুঁ টা?”, কুমরু নাচ থামিয়ে ধেয়ে এল বাঘুর দিকে।
“হ্যাঁ রে।”, বাঘু দিব্যি ভালোবাঘের মত মুখ করে উত্তর দিল, “ওকে বলে নাক বাজনা। নাসিকাবাদ্যও বলতে পারিস।”
বাঘু সবে এই কথা বলেছে, এদিকে ততক্ষণে হিনিমিনির লেজ ধরে হাতুশি দিয়েছে এক টান। আচমকা ওরকম টানের ধাক্কা সামলাতে না পেরে হিনিমিনি, পড়বি তো পড়, পড়ল একেবারে বাঘুর ঘাড়ে। সঙ্গে সঙ্গেই বিকট এক আওয়াজ ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল বাঘু, “ওরে বাবা রে! আমাকে মানুষে ধরেছে রে! মানুষে আমার ঘাড় মটকে দিল রেএএএএএ!”
এদিকে দিদিমণিকে দেখেই ভালকি টুথপেস্ট খাওয়া থামিয়ে দিয়ে ভালো ভালুকের মতন গ্যাঁট হয়ে বসেছিল। এবার ধীরেসুস্থে এগিয়ে এল, “বাঘু! তোর কোন আক্কেল নেই? হিনিমিনিকে তুই মানুষ বলিস? ও না হনুমান?”
বাঘু জিভটিভ কেটে বলল, “ও তাই তো! তুই তো হিনিমিনি। আহা! আমি কি আর ভয় পেয়েছি? আমি এই একটু মজা করছিলাম! হে হে, কেমন মজা হল বল্ তো? তোরা ভাবলি আমি ভয় পেয়েছি! হে হে হে হে, হো হো হো হো!”
বলেই বাঘু যেন হেসে কুটোপাটি হয়ে গড়াগড়ি দিতে শুরু করল মাটিতে। শিয়ালনী এদিকে বেদম রেগে গিয়ে চিল চিৎকার জুড়েছে, “অ্যাইয়ো পশুয়ারা! নো চালাকি, নো কায়দাবাজি! সবাই ভব্যসভ্য হয়ে যে যার জায়গায় বোস। এখনই পড়া শুরু হবে। অনেক সময় নষ্ট করেছিস আজ। কোন কথা নয়। লেখাপড়া শিখে জন্তুর মতো জন্তু হবার চেষ্টা কর। ‘জন্তু জগৎ’ বইয়ের বারোর পাতা খোল সবাই।”
তাড়াতাড়ি করে যে যার জায়গায় গিয়ে বসেছে। শিয়ালনীও বই খুলে পড়াতে শুরু করেছে। এমন সময় মাঠের দিক থেকে আওয়াজ ভেসে এল- “ও দিদিমণি! দিদিমণি গো! শিয়ালনী দিদিমণিইইই! চিঠি আছে গো, চিঠিইইইই!”
চমকে ওরা সবাই তাকিয়ে দেখে, আরে! কাছুয়াদিদি যে! কাছুয়াদিদিকে চেনে ওরা। কচ্ছপী কাকীমা আর কচ্ছপক কাকুর মেয়ে। খাকি রঙের একটা পোশাক পরে আছে কাছুয়া, আর গলায় একটা লাল রঙের কার্ড। সেটায় লেখা আছে – ‘জঙ্গলের ডাক’। শিয়ালনী এগিয়ে গেল কাছুয়াকে দেখে, “কী ব্যাপার, কাছুয়া? নতুন চাকরি পেলে বুঝি?”
কাছুয়া হাসল লজ্জা লজ্জা মুখে, “হ্যাঁ দিদিমণি! ভাগ্যে আপনার কাছে পড়েছিলাম, তাই তো চাকরিটা পেলাম। গতকালই জয়েন করেছি। আর আজই আপনার চিঠি এল।” বলতে বলতেই ঢিপ করে এক প্রণাম শিয়ালনীকে।
শিয়ালনী বেজায় খুশি, “বাঃ! বাঃ! বেশ বেশ! খুব ভালো, খুব ভালো। দ্যাখ তোরা, দেখে শেখ।”, বলতে বলতেই ভুরু কুঁচকেছে শিয়ালনী, “কিন্তু চিঠিটা কে দিল বলো তো?”
কাছুয়া বলল, “চিঠি এসেছে সেই গুজরাট থেকে। সিংহলি না কী নাম দেখলাম যেন!”
ভালকি ফস করে বলে উঠল, “সিংহলি না গো, সিংহালু হবে।”
কাছুয়া ঘাড় নাড়ল, “তা হবে। দাঁড়ান দিদিমণি। এই যে।”
বলেই কাছুয়া তার কাঁধের ঝোলা থেকে দুটো বড়ো বড়ো মাটির ভাঁড় বের করল, “এইগুলো রাখুন, দিদিমণি। গরম গরম নলেন গুড়ের রসগোল্লা আর গরমাগরম ভেজিটেবিল চপ। আপনার আর ওদের জন্য। আর এই যে চিঠি।”
বাঘু শুনেই লাফ দিয়ে উঠল, “দিদিমণি, চিঠিফিঠি পরে দেখলেও চলবে। চিঠি তো আর ঠাণ্ডা হয়ে যাবে না। কিন্তু এই এতসব সুখাদ্য ঠাণ্ডা হয়ে গেলে কি আর খাওয়া যাবে? কাছুয়াদিদি বলে কত কষ্ট করে এনেছে!”
শিয়ালনী চোখ পাকিয়ে পেল্লায় এক ধমক দিল বাঘুকে, “পেটুকদাস কোথাকারের! খালি খাই খাই!”, বলেই শিয়ালনী ফিরল কাছুয়ার দিকে, “কাছুয়া, তুমিও এসো। গরমাগরম দুটো মুখে দিয়ে যাও।”
কাছুয়া তাড়াতাড়ি করে বলল, “না না, দিদিমণি। আমার আরও চিঠি বিলি করার আছে। খরগোশিতা ডাক্তারমাসীর গোটাকয়েক জরুরি চিঠি আছে, পৌঁছোতে হবে। আমি আসি, দিদিমণি।”
কাছুয়া চলে গেল সাইকেলে চেপে। হিনিমিনি এদিকে চটপট করে গিয়ে কোত্থেকে খানকয়েক শালপাতা নিয়ে চলে এসেছে ততক্ষণে। হাতুশি আর কুমরু শালপাতায় করে গরমাগরম নলেন গুড়ের রসগোল্লা আর ভেজিটেবিল চপ সবার থাবায় তুলে দিচ্ছে। বাঘুর চোখ বুজে গেছে আরামে, “আহাহা! নলেন গুড়ের রসগোল্লা! আহাহা! ভেজিটেবিল চপ!”
বেশ পরিপাটি ভোজন সেরে ওরা বসল সিংহালুর চিঠি পড়তে। শিয়ালনী চোখে চশমা এঁটে জোরে জোরে পড়তে শুরু করল-
‘সিংহ নিবাস ‘
গির অরণ্য
গুজরাট।
প্রিয় হাতুশিদিদি, হিনিমিনিদিদি, ভালকিদিদি, কুমরুদাদা ও বিচ্ছু বাঘুদাদা
এবং পরম পূজনীয়া শিয়ালনী দিদিমণি,
পত্রের প্রথমেই তোমাদের সকলকে অনেক আদর ও ভালোবাসা জানাই। দিদিমণিকে জানাই শতকোটি প্রণাম। আর বিশেষ করে বাঘুদাদাকে জানাই একরাশ কাতুকুতু। তোমাদের সবার অনেকদিন কোন খবর পাই নি। হাতুশিদিদি একবার একটা চিঠি দিয়েছিল। তাতে বাঘুদাদার ঘুমের খবর জানতে পেরেছিলাম। বাঘুদাদা কি এখনও ওইরকমই ঘুমোয়? ঘাসটাস খায়? আমাকে ফিরতি চিঠিতে সব জানাবে। হিনিমিনিদিদির লেজ কতটা লম্বা হল, কুমরুদাদা আজকাল কতটা চোখের জল ফেলে, ভালকিদিদি নতুন আর কী কী গল্পের বই পড়ল ইত্যাদি সব খবরই জানাবে। দিদিমণি কেমন আছেন? তোমাদের ওখানে পাঠশালায় কত্ত মজা হয়, আমাদের এখানকার পাঠশালায় সেসব কিছুই নেই।
যাই হোক, এখানে খুব ঠাণ্ডা পড়ে গেছে। আমি লেপের ভেতর ঢুকে তোমাদের এই চিঠি লিখছি। (দেখতেই পাচ্ছ, আমি এখন খুব ভালো বাংলা লিখতে শিখে গেছি।) আর তো কয়েকদিন পরেই জান্তা জট এসে অনেক উপহার দেবে। সেই আশাতেই বসে আছি। জান্তা জট জন্তুদের ছানাপোনাদের খুব ভালোবাসে তো, প্রতি শীতেই নানা উপহার দেয়। তোমাদেরও নিশ্চয়ই দেবে। তোমাদের কাকে কী উপহার দিল সেসব কথা আমাকে অবশ্যই জানাবে। আমিও জানাবো তোমাদের কী কী উপহার পেলাম। আমি জান্তা জটকে নিয়ে একটা গানও লিখেছি। শোনাই তোমাদের?
জান্তা জট, জান্তা জট, এসো চটপট।
উপহার নিয়ে তুমি এসো ঝটপট।
লেজে তোমার গিঁট
থাকো তুমি ফিট-
তোমার জন্য সবাই আমরা করি ছটফট।
জান্তা জট, জান্তা জট, এসো চটপট…
বুনো যত ছানা,
আহ্লাদে আটখানা-
খুশিয়াল হয়ে সবে ঘোরে গটগট।
জান্তা জট, জান্তা জট, এসো চটপট…
কেমন লাগলো গানটা? জানিও কিন্তু। পৌষ মাসের দশ তারিখ সামনেই। দশমী তিথি। ওই দিন রাত্তিরে জান্তা জট এবারে আসবে শুনেছি। কেমন দেখতে সে অবশ্য আমি ঠিক জানি না। দিদিমণি জানবেন নিশ্চয়ই। দিদিমণিকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিও।
ইতি-
তোমাদের আদরের ‘সিংহালু’
কেমন লাগলো গানটা? জানিও কিন্তু। পৌষ মাসের দশ তারিখ সামনেই। দশমী তিথি। ওই দিন রাত্তিরে জান্তা জট এবারে আসবে শুনেছি। কেমন দেখতে সে অবশ্য আমি ঠিক জানি না। দিদিমণি জানবেন নিশ্চয়ই। দিদিমণিকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিও।
ইতি-
তোমাদের আদরের ‘সিংহালু’
পুঃ- বাঘুদাদা যদি বেশি দুষ্টুমি করে, তাহলে কিন্তু জান্তা জট বাঘুদাদাকে বিছুটিও উপহার হিসেবে দিতে পারে।
ঠিকানাঃ-
হাতুশিদিদি/ হিনিমিনিদিদি/ ভালকিদিদি/ কুমরুদাদা/বাঘুদাদা
প্রযত্নে, শিয়ালনী দিদিমণি,
শিয়ালনীর পাঠশালা,
পাঠশালার মাঠ,
শাল চাঁদোয়া
বন বাটিকা।
সিংহালুর চিঠি পড়ে তো সবাই হাঁ। হাতুশি শুঁড় দুলিয়ে বলে, “দিদিমণি, জান্তা জটের কথা তো কখনো শুনিনি। সে কেমন দেখতে?”
হিনিমিনি লেজ চুলকোয়, “সে কি সত্যিই উপহার দেবে?”
বাঘু হাঁইমাঁই করে লাফিয়ে উঠল, “আমাকে ওইসব বিছুটি পাতা টাতা দিতে এলে কিন্তু আমি নেবো না। সবাইকে ভালো ভালো জিনিস দেবে, আর আমার বেলায় বিছুটি পাতা?”
ভালকি বললো, “দিদিমণি, বলুন না জান্তা জট কেমন?”
কুমরু মাথা দোলাল, “হ্যাঁ দিদিমণি, বলুন না জান্তা জটের কথা।”
শিয়ালনী চোখ বন্ধ করে কিসব ভাবল খানিকক্ষণ। তারপর খানিক পেট চুলকোল, খানিক কান চুলকোল। তারপর চশমাটাকে মুছল একটা নরম পাতায়। তারপর চোখে ভালো করে এঁটে মাথাটাকে পেন্ডুলামের মত দোলাল খানিক। তারপরে বলল, “হ্যাঁ, হয়েছে।”
সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সবাই, “কী হয়েছে, দিদিমণি?”
শিয়ালনী কিসব ভাবতে ভাবতে বলল, “হ্যাঁ, কী বলছিলি যেন? ও হ্যাঁ, জান্তা জট। জান্তা জট আসলে খুব বুড়ো জন্তু। আর বনের যত পশু আছে তাদের ছানাপোনাদের খুব ভালোবাসে।”
কুমরু শুধোল, “কেমন দেখতে দিদিমণি? নিশ্চয়ই আমার মতো।”
বাঘু লাফিয়ে উঠে এক ঠেলা মারল কুমরুকে, “দূর, তোর মত কেন হবে? ও আমার মতো।”
ভালকি ঠোঁটে লেগে থাকা টুথপেস্ট একবার চেটে নিয়ে বলল, “ধুর! তোদের মতো কেন হবে? ও আমার মতো। গায়ে অনেক লোম।”
হিনিমিনি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে লেজ দুলিয়ে বলল, “মোটেই না। এই আমার লেজের মতো লম্বা লেজ। দেখ দেখি , আমার লেজখানা কত্ত সুন্দর! ওরও লেজ নিশ্চয়ই এমনটাই হবে। অত ভালো জন্তু যখন!”
হাতুশির এখনও হিনিমিনির ওপর রাগ পুরোপুরি যায়নি। সে হিনিমিনিকে এক দাবড়ানি দিয়ে বলল, “ভুলভাল বলিস না, হিনিমিনি। আমি যখন মনিটর, তখন জান্তা জট নিশ্চয়ই আমার মতনই হবে।”
সহসাই কিরকম যেন খেপে গেল শিয়ালনী, “থামবি তোরা সব? নিজেরাই ঝগড়া করবি না আমার কথা শুনবি? শোন ভালো করে। জান্তা জটের মুখ দেখতে বাঘের মতন। তায় আবার সিংহের মত কেশর আছে। এদিকে আবার গণ্ডারের মত একখানা খড়্গ। অল্পস্বল্প গোঁফ। সারা গা ভর্তি লোম। ভালকির মতন। লম্বা একটা লেজ। হিনিমিনির যেমনটি আছে। সেই লেজের গায়ে আবার কুমরুর লেজের মতো কাঁটা কাঁটা। আর ওর পা তো নয়, যেন হাতুশির থাবা বসানো।”
শুনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে সকলে। কোনমতে সামলে সুমলে উঠে হাতুশিই সবার প্রথমে জিজ্ঞেস করল, “দিদিমণি, আমাদের কি কিছু করতে হবে উপহার পাওয়ার জন্য?”
শিয়ালনী মিটিমিটি হাসল, “তোরা? তোরা কী করবি তাই তো? তোরা সকলে জানালায় একটা করে বালিশের ওয়াড় ঝুলিয়ে রেখে দিবি। জান্তা ওতেই উপহার রেখে চলে যাবে। আর হ্যাঁ, মনে রাখিস। এখন কিন্তু ক’দিন খুব ভালো হয়ে চলতে হবে। সামনেই দশই পৌষ। বৃহস্পতিবার। ওদিন রাতেই জান্তা আসবে। বালিশের ওয়াড় ঝুলিয়ে রেখে সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়বি। সকালে উঠে দেখবি জান্তা উপহার দিয়ে চলে গেছে।”
শুনেই বাঘু খুঁক খুঁক করে কাঁদতে শুরু করেছে, “আমার কী হবে গো, দিদিমণি? আমি এ ক’দিন একটুও দুষ্টুমি করতে পাবো না গো? ও হো হো হো! আমি কেমন করে থাকবো গো? দুষ্টুমি না করতে পেলে আমি কেমন করে বাঁচবো গোওওওও! ও হো হো হো! আমি বলে ভেবেছিলাম আজ টিফিনেই সবার মাথায় খানিক খানিক বালি ঢালবো! ও হো হো হো হো!”
ভয়ানক রেগে গিয়ে দুই কোমরে থাবা দিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে তাকাল শিয়ালনী, “বাঘু! বাঘুউউউউ! তুই বদমায়েশি করতেই পাঠশালায় আসিস, না? নে, আর কোন কথা নয়। আমি বোর্ডে অঙ্ক দিচ্ছি করতে। তোরা সবাই কর। আর বাঘু, তুই একদম আমার পাশে এসে বোস। তোর দুষ্টুমি আমি বের করছি! মন দিয়ে লেখাপড়া করো সবাই। নইলে কিন্তু উপহারের ভাগে ফক্কা, এই বলে দিলাম। আর ভালকি, তোর টুথপেস্টটা এসে আমার কাছে জমা দে। কাল আমি তোর মা’কে ফেরত দেব।”
বেচারি ভালকি আর কী করে? শুকনো মুখে গিয়ে টুথপেস্ট রেখে এল দিদিমণির কাছে। বাঘুও গুটিশুটি মেরে গিয়ে বসল দিদিমণির পাশে। হইচই ভুলে পড়াশুনো শুরু হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। খালি বাঘুর ঠোঁটের কোণে ফিচিক ফিচিক হাসি। কী যেন একটা মতলব ভাঁজছে সে!
পরের কয়েকটা দিন পড়াশুনোর ফাঁকে ফাঁকে পাঠশালায় খালি জান্তা জটের আলোচনা। জান্তা জট কিভাবে আসবে, কেমন করে উপহার দেবে, কী কী উপহার দিতে পারে, উপহার না দিলেই বা কী হবে, সিংহালু এত কথা জানলই বা কোত্থেকে- আলোচনায় আলোচনায় মশগুল সবাই। শিয়ালনীও জেরবার ওদের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে।
জান্তা জটের যেদিন রাত্তিরে উপহার দেবার কথা, সেদিন সকাল থেকেই পড়াশোনায় ভালোমত মন বসছে না কারুরই। টিফিনের সময় বাঘু হুমকি দিল বাকিদের, “আমি যদি ভালো উপহার না পাই, তাহলে কিন্তু তোদের সব্বার মাথায় আমি বালিবৃষ্টি করবো।”
তাই শুনে তেড়ে গেল কুমরু, “বেশি যদি কায়দাবাজি করতে এসেছিস বাঘু তাহলে কিন্তু তোর গায়েও আমরা সবাই মিলে বিছুটি ঘষে দেবো বলে দিলাম।”
হিনিমিনি মুখ ভেংচাল, “সারাবছর তুই পড়বি না, শুনবি না, খালি ঝামেলা পাকাবি- জান্তা জট তোকে ভালো ভালো জিনিস দেবেই বা কেন?”
বন্ধুদের এসব কথা শুনে বাঘুর এতই রাগ হল যে একটা কলমের কালি পুরো নিজের মুখে ঢেলে লেপে নিল। টিফিনের পর ক্লাসে এসে তাই দেখে শিয়ালনীর প্রায় আঁতকেই উঠল, “এ কী রে বাঘু, এসব তুই কী করেছিস?”
বাঘু খুব গম্ভীরভাবে বলল, “আমাকে যদি জান্তা জট আজ রাতে উপহার না দেয়, তাহলে ওকে আমি ভয় দেখাবো ভূত সেজে।”
শিয়ালনী বলল, “বাঘু, জান্তা জট আসবে তো রাতে। যেমন বলেছি বালিশের খোল ঝুলিয়ে রাখিস। জান্তার যদি মনে হয় তোকে দেবে।”
শুনে বাঘু গোঁজ হয়ে রইলো ক্লাসের বাকি সময়টা। পাঠশালা ছুটির পর কারুর সাথে আর কোন কথা না বলে সোজা বাড়ির পথ ধরল।
রাত্রিবেলা পেটপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে বাঘু বসল সাজগোজ করতে। সাজগোজ মানে ভুষোকালি মাখা। আর চোখেমুখে লাল নীল বিতিকিচ্ছিরি রঙ করা। বাঘুর মা বাঘিন্নী কাজকর্ম সেরে পাশের ঘরে এসে কাণ্ডকারখানা দেখে গেল বেজায় চটে, “ই কী রে বাঘু! এসব কী উষ্টুম ধুষ্টুম রঙ মেখে সঙ সেজেছিস?”
বাঘু হিহি করে হাসতে হাসতে বলল, “সঙ নয় মা, সঙ নয়। এসব হচ্ছে জান্তা জটের ব্যবস্থাপনা। হুঁ হুঁ বাছাধন! আমাকে উপহার না দেওয়া? অ্যায়সা কায়দা করবো যে জান্তা জটের চালাকি খতম হো জায়েগা!”
বাঘিন্নী রেগেমেগে বলল, “দ্যাখ বাঘু, তুই যা করবি কর। আমার ভালো লাগছে না। ঘুম পেয়েছে, ঘুমোতে চললুম আরাম করে লেপের তলায়। তোর ইচ্ছে হলে আসিস।”
বাঘিন্নী চলে গেল। বাঘু মায়ের কথায় বিন্দুমাত্রও পাত্তা না দিয়ে সামনে একটা ছোট আয়না নিয়ে জাঁকিয়ে বসল নাকের তলায় জম্পেশ করে গোঁফ আঁকতে। বেশভূষা করে বাঘু যখন উঠে দাঁড়াল তখন তাকে চেনাই দায়। আপাদমস্তক কালো কালি মাখা, মুখে লাল-নীল চিত্রবিচিত্র রঙ। নাকের নিচে ইয়া বড়ো কালো মুশকো গোঁফ।
বাইরে ঘুটঘুটি অন্ধকার। সেদিকে একবার চেয়ে বাঘু একখানা বড় পাশবালিশের খোল ঝোলাল জানালার রডের সঙ্গে। আর একটা দড়ি দিয়ে নিজের পায়ের সঙ্গে পাশবালিশের অন্য প্রান্তটা বেঁধে রাখল। যাতে জান্তা জট কিছু দিতে এলে পায়ে টান লেগে ঘুম ভেঙে যায়। মেঝেতে বিছানা আগেই করে রেখেছিল। এক পা বাঁধা অবস্থায় একটা ছোট লেপ মুড়ি দিয়ে তাইতেই শুয়ে পড়ল বাঘু।
রাত কত হবে কে জানে, পায়ের টানে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল তার। আর সঙ্গে সঙ্গেই সব মনে পড়ে গেল। নির্ঘাত জান্তা জট এসেছে! খুব আলতো করে অন্ধকারেই পায়ের বাঁধন খুলে ঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল বাঘু। পিছন দিক থেকে জানালার কাছে গিয়েই হা-রে-রে-রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ‘জান্তা জটে’র ওপর। বিস্তর পোশাক আশাক পরা বলে জান্তা জটের চেহারা তেমন করে বুঝতে পারল না বাঘু। খালি তার এক ধাক্কা খেয়ে মাটিতে কুমড়োর মতন গড়াগড়ি খেতে থাকল। এদিকে ‘জান্তা জট’ ততক্ষণে তার ঝোলাঝুলি নিয়ে উধাও। বেচারি বাঘু আর কী করে? পাশবালিশের খোলের মধ্যে যে কয়টা জিনিস ছিল তাই নিয়ে সুড়সুড় করে ফিরে এল ঘরে।
পরের দিনে পাঠশালায় ঢোকা ইস্তকই তুমুল হট্টগোল। একে একে উপহার খুলে দেখাচ্ছে সবাই বন্ধুদের। হাতুশি পেয়েছে একটা শুঁড়স্ত্রাণ, রঙের একটা বড়ো বাক্স, একটা পাঠশালা ব্যাগ, থাবাস্তানা (মানে মানুষেরা যেমন হাতে দস্তানা পরে সেরকম আর কী), একটা দারুণ রঙচঙে সোয়েটার, নকশাদার পেনসিল, রাবার, পেনসিল ছোলার কল, দুটো গল্পের বই আর একটা ইয়াব্বড়ো আখের কেক।
হিনিমিনি পেয়েছে একজোড়া থাবাস্তানা, একটা বটুয়া ভর্তি রঙ পেনসিল, দারুণ দেখতে দুটো মাথায় বাঁধার ক্লিপ, নকশাদার পেনসিল, রাবার, পেনসিল ছোলার কল, ছবিওলা খাতা একখানা, একটা সবুজরঙা কলার কেক আর একটা লেজস্ত্রাণ।
ভালকি পেয়েছে থাবাস্তানা, মাথায় বাঁধার রঙিন রুমাল, পেনসিল, রাবার, পেনসিল ছোলার কল, দুটো ছবিওলা গল্পের বই, একটা মিষ্টি কমলা রঙের মধুর কেক, একটা কাঠের খেলনাগাড়ি আর একটা ছোট টুথপেস্ট।
কুমরুর ঝোলা থেকে বেরোল একটা লেজস্ত্রাণ, পেনসিল, রাবার, পেনসিল ছোলার কল, একটা চাদর, একটা বর্ষাতি, রঙীন পেনসিল কয়েকটা, দুটো ঘুঙুর আর একটা মাছের কেক।
সবার শেষে বাঘু। উপহার দেখাতে গিয়ে বাঘুর প্রায় বুক ফেটেই যায় আর কী! বাঘুর জুটেছে একজোড়া থাবাস্তানা, পেনসিল, রাবার, পেনসিল ছোলার কল, লেজস্ত্রাণ, রঙ পেনসিলের একটা ছোট বাক্স, একটা টুপি আর একটা ঘাসের কেক।
উপহার দেখাদেখি শেষ হতে না হতেই ‘হ্যাঁচ্চো’, ‘হ্যাঁচ্চো’ করে ভয়ানক হাঁচতে হাঁচতে ঢুকেছে শিয়ালনী। হাতুশি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে, দিদিমণি?”
শিয়ালনী আরেকখানা হাঁচি দিয়ে বলল, “আরে, ওই কাল রাতে… হ্যাঁচ্চো…”
ভালকি চটজলদি শুধোল, “কাল রাতে কী দিদিমণি?”
শিয়ালনী ততক্ষণে কিছুটা সামলেছে। একবার নাক টেনে নিয়ে বলল, “না, কিছু না। তোরা সবাই জান্তা জটের উপহার ঠিকঠিক পেয়েছিস তো?”
বাঘু বাদে বাকি সবাই একবাক্যে ঘাড় হেলাল, “হ্যাঁ দিদিমণি, দারুণ দারুণ সব উপহার পেয়েছি।”
শিয়ালনী ফিরল বাঘুর দিকে, “কী রে বাঘু? হ্যাঁ…চ্চো… তোর কী খবর?”
হাঁউমাঁউ করে উঠল বাঘু, “দিদিমণি, ওদের সবাইকে জান্তা জট কত ভালো ভালো দিয়েছে আর আমার বেলায় এই মাত্র ক’টা?”
শিয়ালনী দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, “তা তোমাকে কে অত পাকামি মারতে বলেছিল শুনি? আর একটু অপেক্ষা করলে তো সবই পেতে! যত্তসব! হ্যাঁ… হ্যাঁ… চ্চো…!”
এ কথায় বাঘু ভয়ানক অবাক হয়ে গেল, “দিদিমণি, আপনি এত কথা জানলেন কী করে?”
শিয়ালনী কিরকম যেন ভেবলে গেল। তারপর খানিক মাথা চুলকে, খানিক লেজ চুলকে উত্তর দিল, “আসলে কাল জান্তা জট ফিরে যাবার আগে আমায় সব বলে গেছে কিনা! হ্যাঁ… হ্যাঁ … হ্যাঁ… চ্চো!” অল্প সময় চুপ করে শিয়ালনী বলল, “আর সারাবছর এত বদমায়েশি করার সময় মনে থাকে না, না? বন্ধুদের মাথায় বালি দিস! হ্যাঁ…হ্যাঁ… হ্যাঁ … হ্যাঁ… চ্চো!”
বাঘু রাগ রাগ গলায় বলল, “আমি বালি দেবো ভেবেছিলাম, সত্যি সত্যি তো আর দিইনি!”
শিয়ালনী একটা রুমালে নাক মুছতে মুছতে কটমট করে চাইল, “জান্তা জটও তোমাকে আরো উপহার দেবে ভেবেছিল, দিতে পারেনি। বুঝেছ? হ্যাঁ…হ্যাঁ… হ্যাঁ … হ্যাঁ…হ্যাঁ… চ্চো!”
কুমরু বলল, “দিদিমণি, আপনার শরীর তো বেশ খারাপ! আপনি কি আর এখন পড়াতে পারবেন?”
হিনিমিনি মাথা ঝাঁকাল, “না, না। এত শরীর খারাপ নিয়ে পড়ানোই কি আর ঠিক হবে?”
বাঘু বেচারিও মনের দুঃখ ভুলে লাফিয়ে উঠল, “তাহলে দিদিমণি, দিনদশেক ছুটিই থাক বরং। অনেকদিন ছুটিটুটিও পাইনি।”
শিয়ালনী আর কথা বলার অবস্থাতেই নেই তখন। কোনমতে মাথাটা হেলিয়ে বলল, “হ্যাঁ…হ্যাঁ… হ্যাঁ … হ্যাঁ… হ্যাঁ… হ্যাঁ…চ্চো!”
………০………
অংকনঃ গুঞ্জা
বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি থাবাছানি দিচ্ছে নিচের লিঙ্কেঃ-
৬। অযোধ্যা পাহাড়ে বাঘু ৭। পরীক্ষা দিলেন বাঘু ৮। গণ্ডারনী ও গণ্ডগোলিক্স ৯। নামতা শেখেন বাঘুবাবু ১০। শিয়ালনীর পাঠশালায় সিংহালু ১১। বাঘু হল চিৎপটাং ১২। ঘুম দিলেন বাঘুবাবু ১৩। পাঠশালায় ধুন্ধুমার