“আরে এটা সেই সোনাল প্রজাপতি না?”
সাদার স্ট্রাইপ দেওয়া হলদে, কালচে সুন্দর বড় সেই প্রজাপতিটাকে ঘরের মধ্যে দেখতে পেয়ে নিজের মনেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। বেশ অনেকদিন পরে এই ধরনের প্রজাপতি আবার চোখে পড়ল। আগে যখন মফস্বলে বড় হয়েছিলাম, তখন বেশ চোখে পড়ত। গাছ-পালা, জঙ্গল-ও ছিল অনেক আমাদের ধারে কাছে।
কিন্তু ইদানীং আর চোখে বিশেষ পড়ে না। যদিও আমি অপেক্ষা করে থাকি, কখন যে দেখা পাই? কিন্তু শহরে এই ধরনের সুন্দর প্রজাপতি দূরে থাক, সাধারণ প্রজাপতিরও দেখা পাওয়া যায় না। কিন্তু আমি জানতাম, সোনালের দেখা আমি পাব….ওরা আমাকে ভুলে যায়নি…..। আমার কাছে ফিরে আসবেই।
আমি জানতাম!
(২)
নীলা আর আমি পাশাপাশিই বড় হয়েছি। শিলিগুড়ি থেকে বেশ কিছুটা দক্ষিণে মহানন্দার ধারে ছিল আমাদের বাড়ি। সপ্তাহে একদিন হাট বাদ দিলে কেমন যেন চুপ মেরে থাকত জায়গাটি। তবে সেই নীরবতা ভেঙ্গে আমাদের ছোটাছুটিতে সরগরম হয়ে উঠত চারপাশ। আমাদের ছোটবেলা থেকেই।
-ওই দ্যাখ সোনু, নীলা আ্মাকে আঙুল উঁচিয়ে দেখাল, -ওই প্রজাপতিটা দেখতে পাচ্ছিস?
-কোথায়?
আমি ঠিক দেখতে পাচ্ছিলাম না। সামনের ফুটুসের ঝোপটার দিকে যদিও নীলা আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছিল, কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। এমনিতেও আলো কমে এসেছে।
-ওই যে হলদে-কালো প্রজাপতিটা দেখতে পাচ্ছিস? নীলা আমার দিকে চাইল, -মাঝে মাঝে লম্বাটে সাদা দাগ আছে, দ্যাখ বলে আঙুল বাড়িয়ে দিল ও, “ওই যে বড় ধরনের, ডানাটা টানটান করে মেলে দিল?”
প্রজাপতিটা এবারে ঝোপটা থেকে পাখা মেলে উড়ে গেল। আমি এতক্ষণে বুঝতে পারলাম। বেশ সুন্দর ডিজাইন। আগে আমি সুন্দর এই প্রজাপতিটাকে দেখেছি। বহুবার। অনেক ধরনের প্রজাপতিই তরাইয়ের এইসব এলাকায় দেখা যায়। যদিও এদের কারুর নাম আমি জানি না।
-দারুণ! আমি মুগ্ধ গলায় বললাম, -অনেকদিন পরে দেখলাম। কী নাম রে?
-সোনাল!
নীলা আমার দিকে বিজ্ঞের মতন ঘুরে তাকাল। এমনিতে আমার সঙ্গে খুব আড্ডা দিলেও অন্যসময়ে ও পড়াশোনা করে বেশ। আর খুব ইনকুইজিটিভ ধরনের। দিদিমণিরা আমাকে প্রায়ই ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখেন, কিন্তু ওর কথা আলাদা। যাই হোক এর পর থেকে সোনাল প্রজাপতি দেখার একটা নেশা পেয়ে বসল আমাদের দু’জনের।
(৩)
কিন্তু সেবারে সোনাল প্রজাপতিটা আমিই দেখতে পেলাম। নীলা দেখার আগেই। ভাবতে পারিনি যদিও আগে, তবে ভাবাটা দরকার ছিল। হয়তো বা এটাই স্বাভাবিক।
দিদিমণিরা হয়তো আমায় দাঁড় করিয়ে দেন, কিন্তু আমার জন্য যে অনেকেই দাঁড়িয়ে থাকে, সেটা বুঝতে শুরু করেছিলাম। তাদের মুগ্ধ চোখের নীরব দৃষ্টি বেশ উপভোগ করতাম। মাঝে মাঝে হয়তো বা সেটা সরব হয়ে যেত! এই যেমন সেবারে পিকনিকের সময়ে। আজো মনে হয়, এইতো সেদিনের ঘটনা।
পানিঘাটা থেকে যে রাস্তাটা পাহাড়ি বাঁকের সঙ্গে এঁকে-বেঁকে গিয়ে মিশে গেছে শিলিগুড়ি-মিরিক রাস্তায়, তার অদূরেই নদীর ধারে আমরা পিকনিকে গেছিলাম। কো-এড স্কুল হওয়ায় উদ্যমীর অভাব হয়নি।
কিছুটা দূরে ছেলেরা কোরাসে গান গাইছিল,
“সোনুর মুখ আমি দেখিয়াছি,
তাই অন্য কারুর মুখ খুঁজিতে যাই না আমি আর।”
দূর থেকে কথাগুলো টুক-টাক আমার কানে আসছিল। শুধু আমার নয়, আমাদের-ও। আমার শুনতে অবশ্য মন্দ লাগছিল না। কে না অ্যাটেনশন পেতে চায়? বিশেষ করে যদি সেটা সহপাঠীদের থেকে হয়?
অনেকেই টুকি-টাকি টোন কাটে, সামনে-পিছনে, আমি হেসে উড়িয়ে দিই। বুঝতে পারি তাদের চোখে লুকিয়ে আছে মুগ্ধতা।
-চল ঘুরে আসি, নীলা একসময় বলল, -এদের অসভ্যতামি আর সহ্য হচ্ছে না।
-কোথায়?
আমি জিজ্ঞেস করলাম। আমার খুব একটা উঠবার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু নীলা আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। ফলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠতে হল।
-চল, তোকে কিছু গাছ-পালা চিনিয়ে দিই। নীলা বিজ্ঞ গলায় বলল, -একটু নলেজ থাকা ভাল।
অন্যসময়ে কথাটা শুনলে ভাল লাগত হয়ত। কিন্তু এখন ওর কথায় কোথায় যেন লুকিয়ে ছিল ঈর্ষা, হতাশা অথচ ঠুনকো আত্মগর্বের ছাপ।
ও আমার হাতে টান দিল। অগত্যা উঠতে হল। কিছু সময় পরে যখন আমরা কিছু পাহাড়ি গাছপালা ‘সার্ভে’ করে ফিরে আসছি, এমন সময় কানে এল দেবা’র গলা। সে মনে হয় কিছুটা দূরে একটা ঘন ঝোপের মধ্যে বসে সিগারেট ধরিয়েছে।
-নীলা যেমন দেখতে, দেবা বলল, -তেমনি তার হাব-ভাব।
-একেবারে, সিগারেটে মনে হয় একটা জোরালো টান দিল রাজু। তারপরে ধোঁয়া ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, -সোনুসুন্দরীকে নিয়ে একটু মজা করছি, সেটাও নিতে পারছে না। অথচ ওদের মধ্যে কত না বন্ধুত্ব।
-সব লোক-দেখানো। দেবা বলল, -মেয়েদের মধ্যে ঈর্ষা খুব বেশি।
-তাই বলে উঠে চলে যাবে! তাও সোনুকে নিয়ে।
ওদেরকে অতিক্রম করে চলে আসায় আর ওদের গলা শুনতে পাচ্ছিলাম না। ভিতরে নিষ্ঠুর একটা পুলক জেগেছিল। রাজুর উপরে নীলার যে দুর্বলতা ছিল, সেটা সবাই না জানলেও আমি জানতাম। ফেরার সময় থমথম করছিল নীলার মুখখানা। লিউসিপাখড়ি রেল-গেট ক্রসিং-এ যখন বাসটা থেমেছিল, তখন আবছা আলোতে সোনাল প্রজাপতিটাকে দেখতে পেলাম। একটা ডেউয়া গাছকে বেড় দিয়ে জড়িয়ে থাকা অনামী লতার ছোট্ট একটা পাতার চারিদিকে সেটা ঘোরাঘুরি করছিল।
-দ্যাখ, আমি কনুই দিয়ে একটা গোঁত্তা দিলাম নীলাকে, -ওই যে একটা সোনাল।
নীলা মুখ তুলল না। তাকিয়ে দেখলাম বাইরের আঁধারের চেয়েও ঘন আঁধার নেমে এসেছে সেই মুখে। শুধু আমিই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলাম সোনাল’টির দিকে।
(৪)
কলেজ জীবন শেষ হতে বেশি সময় লাগল না। রঙিন দিনগুলো কেমন দ্রুতলয়ে যেন কেটে গেল। নীলা ছিল সিরিয়াস স্টুডেন্ট। এবং মেধাবীও বটে। এবারে আমরা ভর্তি হলাম উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। হোস্টেলে থাকতাম। একেবারে খারাপ লাগছিল না। এম-এ তখন প্রায় কমপ্লিট করে এনেছি, এমন সময় শুনতে পেলাম যে নীলা চাকরি পেয়ে গেছে। পি এস সি’র পরীক্ষা দিয়ে। মোটামুটি ভাল গেজেটেড অফিসার। ভাগ্য মন্দ না হলে থাকার কোয়ার্টার্সও পেয়ে যাবে। সেদিন ওর বদান্যতায় হোস্টেলেই গ্র্যাণ্ড ডিনারের আয়োজন করা হয়েছিল।
-শোন, নীলা হাসিমুখে বলল, -আজ কিন্তু কোন অজুহাত শুনব না। আসতেই হবে।
-যাব না কখন বললাম! আমি ঈষৎ গম্ভীর গলায় বললাম, -সন্ধ্যায় আর কী কাজ আছে?
-কেন অ্যাপো?
নীলা লেগ পুলিং করতে পারলে আর ছাড়ে না। এটা সত্যি যে আমার অনুরাগীর সংখ্যা একটু বেশিই। তাদের মধ্যে এক-দু’জনকে আমি কিছু প্রসাদ বিতরণ করি, অবশ্য মাঝে-সাঝে। তবে তা বেশিকিছু নয়। টাইম-পাস হিসেবেই দেখি। কিন্তু নীলা যে কোন ব্যাপারেই সিরিয়াস। কিভাবে যে লোকজন এত সিরিয়াস হয়, আমি বুঝি না। বাবা আমার জন্য পাত্র দেখা শুরু করেছেন। তাঁর কাজ তিনি করুন। বিয়ে হয়ে গেলে পর চুটিয়ে না হয় সংসার করা যাবে’খন। কিন্তু তাই বলে জীবন থেকে আনন্দ-কে বিসর্জন দিয়ে সেইসব নিয়ে এখন আমি অহেতুক আমি ভাবতে পারব না।
তবে নীলার এই সাফল্যে কিছুটা যে ঈর্ষাকাতর আমি হইনি, তা বলব না। ওর কথা শুনতে শুনতে হঠাৎই আমার কেন জানি না মনে হল,
একটু সিরিয়াস হয়ে পড়াশুনো করলে ক্ষতিটা কী হত?
গুরুত্ব ছাড়া জীবনে আর কিই বা দাম আছে?
আর সেই মুহূর্তেই নীলা উত্তেজিত গলায় ছোটবেলার সেই উচ্ছল মেয়েটির মতন বলে উঠল,
-আরে একটা সোনাল!
-কই রে?
বললাম বটে, কিন্তু গলায় সেই জোরটা আর পাচ্ছিলাম না। যে কেউ কথাটা শুনলে বুঝবে যে গলায় কৃত্রিম একটা উত্তেজনা আনার বিফল প্রয়াস করছি। নীলা কি আর এইটুকু বোঝে না?
-ওই যে, ও আঙুল তুলে জানালার দিকে দেখাল, -জামবুড়া গাছটার ডালে।
আমি দেখতে পেলাম না। তায় চোখে ইদানীং দেখতে সমস্যা হচ্ছে। হয়ত শীঘ্রই ডাক্তার দেখাতে হবে। নীলা তো অনেকদিন আগেই চশমা নিয়েছে। ফলে ওর সেইসব সমস্যা নেই।
-ঠিক দেখতে পাচ্ছি না। আমি বললাম, -চোখে এখন সমস্যাও হচ্ছে।
-আমাকে অনুকরণ কর!
বলে ও কিছুটা থামল। চোখে-মুখে ওর সাফল্যের ছটা ফুটে উঠেছে। ও কি আমাকে সোজা আওয়াজ দিতে চাইছে?
আমার দিকে একঝলক তাকিয়ে ও কি বুঝল, বুঝলাম না। ঝটিতি বলে উঠল,
-মানে আমাকে অনুসরণ কর। আরে চশমা নে!
মানুষ হঠাৎ না ভেবে কথা বলতে গেলে, মনের মধ্যে পুষে রাখা সত্যি কথাটা বলে ফেলে। ও ঠিক-ই বলেছে। আমার ওকে অনুকরণ করাই উচিত ছিল। কিন্তু এখন যে বড্ড দেরী হয়ে গেছে। সেদিন আমার আর সোনাল’টিকে দেখা হয়নি।
(৫)
-আরে নীলা, আমি উৎফুল্ল গলায় ডাক দিলাম, -কেমন আছিস?
আজ একটা সাংস্কৃতিক সভায় গেছিলাম। আমার বর’ই মুখ্য অতিথি। সেই সূত্রে আমার-ও ডাক পড়েছে। উনি তখন মঞ্চে উঠেছেন। আমি প্রেক্ষাগৃহের মুখ্য অতিথির চেয়ারের পাশে অনুরূপ সজ্জিত একটি চেয়ারে বসে চারিদিকে তাকাচ্ছিলাম। এদিক-সেদিক চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ-ই দৃষ্টি চলে গেল পিছনের দ্বিতীয় সারির দিকে।
আরে সেখানে যে নীলা বসে! তার মানে ও আমাকে আগেই দেখেছে!
কিন্তু……………?
বুঝলাম!
ঠিক আছে, আমিই না হয় ওকে ডেকে নেব।
এ আমন্ত্রণ ফেলার সাধ্য ওর নেই। স্রেফ সম্ভব নয়। অফিসার র্যাংেকে ধাপগুলি এখানে অতি শক্তভাবে মেনে চলা হয়। আজ আমি সোনালের দেখা পাবই! আমি নিশ্চিত জানি………।
(৬)
পেয়েওছিলাম! আমার ঘরেই! এতটুকু না কষ্ট করে।
আনমনা হয়ে আমি তলিয়ে গেছিলাম হরেক ভাবনাচিন্তায়। একটি অধ্যায় আজ এখানে সমাপ্ত হল। একটা বৃত্ত পেল তার সম্পূর্ণতা।
কিন্তু………।
-আরে সেই সোনাল’টি গেল কোথায়? আতংকের গলায় আমি নিজের মনে নিজেই বলে উঠলাম, -এই তো ঘরের মধ্যেই ছিল!
আমি দ্রুত উঠে তাকে খুঁজতে শুরু করলাম।
জানালা তো বন্ধই আছে। তার মানে ও জানালা দিয়ে বেরোয় নি।
গেল কোথায়?
আমি তড়িৎ গতিতে চলা গাড়ির চাকার মতন সোনালটিকে খুঁজে চললাম ঘরের সর্বত্র। কিন্তু সে যেন বেমালুম মিলিয়ে গেছে।
খোলা দরজা দিয়েই সে কি চলে গেছে?
তাহলে?
আবার কি আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে?
এবারে কি বিপরীতদিকে?
দরজায় ওটা কিসের ছায়া পড়েছে?
আমার বদমেজাজি বরের? নাকি………?
কে ও? কী ওটা?
আমি সবকিছু ভুলে আতংকে নিঃশ্বাস চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম। ছায়াটা আর যাই হোক, সোনালের নয়!