(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে পাঠশালার খবর ভেসে আসে মাঝেমধ্যে। এলেই তোমাদের জানাতে থাকবো। পাঠশালাটা কোথায় জানো? বনের ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে প্রচুর গাছপালা মিলে মাথার উপরে একটা চাঁদোয়ার মত বানিয়েছে, আর দুটো সেগুনগাছের ইয়া মোটা মোটা গুঁড়ি দুদিক থেকে এসে একটা দরজার মতো তৈরি হয়েছে। জঙ্গলের যত ছানাপোনা জন্তুজানোয়ার, সবাই আজকাল সক্কালবেলা হলেই হাতমুখ ধুয়ে চাট্টি মুড়ি খেয়ে ওখানেই পড়তে যায়। তাদের মধ্যে আছে বাঘিনীর বাচ্চা ছেলে বাঘু, হাতির বাচ্চা মেয়ে হাতুশি আর হনুমানের ছানা মেয়ে হিনিমিনি। এছাড়াও আছে ভালুকের পুঁচকি মেয়ে ভালকি আর কুমীরের বাচ্চা ছেলে কুমরু।)
জঙ্গলের আবহাওয়াটা এখন ভারি মনোরম। টাপুরটুপুর বৃষ্টি ঝরছে যখন তখন। একটু আগেই এক পশলা রিমঝিম বৃষ্টি হয়ে গেল। বৃষ্টি হলেও বনের মাটিতে বিশেষ জল জমে না। হয় মাটি টেনে নেয়, নাহয় ছোট ছোট নালায় বয়ে যায়। আর তা না হলে বৃষ্টির ফোঁটারা মাটিতে পড়ে নিজেরাই মনের খুশিতে এক একটা জলধারা বানিয়ে আপনমনে জঙ্গলের ফাঁকফোকর খুঁজে বয়ে চলে। গাছেরা আবার পাতায় পাতায় জল জমিয়ে রাখতে ভালোবাসে। বৃষ্টি থেমে গেলে ধীরে সুস্থে পাতার জল ঝেড়ে ফেলে।
ভালকি দুলকি চালে পাঠশালা যাবার পথ ধরে হাঁটছিল। বৃষ্টি হলে এমনিতেই তার মন বেশ ভালো হয়ে যায়। বৃষ্টি থামার পর আকাশে নরম নরম রোদ। চারপাশে আলোছায়ার কারুকাজ। দেখতে দেখতে আপনমনে হাঁটছে ভালকি আর হাতে ধরা তালপাতার বাঁশিটা দিয়ে পুঁ পুঁ করে বাঁশি বাজাচ্ছে। গতকালই মা ‘ভালুকরানীর হাট’ থেকে কিনে এনেছে বাঁশিটা।
বাঘুও আসছিল পাঠশালায়। একটা বাঁক ঘুরেই দেখতে পেয়েছে ভালকিকে। অনেকটা আগে আগে যাচ্ছে। আবার হাতে একটা বাঁশি নিয়ে সমানে পুঁ পুঁ করে কতরকমের সুর খেলাচ্ছে। দেখেই রাগ ধরে গেল বাঘুর। বাঁশি নিয়ে নাচতে নাচতে পাঠশালা যাবার দরকার কী রে বাপু? তাড়াতাড়ি করে থাবা চালিয়ে ভালকির কাছাকাছি এগোতে থাকল সে।
এদিকে ভালকি কাল আরও একটা জিনিস পেয়েছে। একটা এইটুকুনি বাহারি আয়না। ছোট্ট কাজ করা খোপে আটকানো। নিজের মনে যেতে যেতে ভালকির একবার খেয়াল হওয়ায় আয়নাটা বের করে দেখতে গেছে। আর তখনই চোখে পড়েছে বাঘুকে। ওর দিকেই এগিয়ে আসছে চুপচাপ। ব্যস! ভালকি তো বুঝল যা বোঝার। যেই না বাঘু ঠিক পেছনে এসেছে, অমনি সেও দিয়েছে এক ভ্যালাটের প্যাঁচ ঝেড়ে। (মানুষদের যেমন ক্যারাটে, ভালুকদের তেমন ভ্যালাটে। মানুষের দেওয়া নাম ওরা নেয় না কিনা।)
ব্যস, বাঘু বাছাধন তো চিৎপাত! আর পড়বি তো পড়, পড়েছে একটা ছোট গর্তের জমা জলের উপর আর জলকাদা মেখে একশা! ভালকি সবই দেখতে পেয়েছে আয়নায়। কিন্তু কিছুই যেন হয়নি এমনি ভাব করে দুলে দুলে হাঁটছে আর পুঁ পুঁ করে বাঁশি বাজাচ্ছে।
জলকাদা ঝেড়ে উঠতে বাঘুর একটু সময়ই লাগল। তারপরই মহা বেগে ধেয়ে এল ভালকির দিকে। ভালকি তৈরিই ছিল। আয়নাতে দেখে বাঘুর দিকে ঝাড়ল একখানা ভালুক্সিং-র ঘুঁষি। (মানুষদের যেমন বক্সিং, ভালুকদের তেমন ভালুক্সিং।)
বাঘুও ঝপাং করে একটা নালার জলের মধ্যে পড়ে গেল। ভালকি এবারেও কিছুই যেন হয়নি এমনি ভাব করে যেমন যাচ্ছিল যেতে থাকল।
বাঘু রাগের চোটে চেঁচিয়ে উঠল, “ভালকি, আজ পাঠশালে গিয়ে তোর মজা দেখাবো, বলে দিলাম।”
ভালকি পিছন ঘুরল, “এ কী রে বাঘু, তুই নালার জলে গড়াগড়ি খাচ্ছিস কেন রে? এখন তো পাঠশালে যাবার সময়? এখন কি আর গায়ে কাদা মাখতে হয়?”
বাঘু দাঁত কিড়মিড় করল, “তবে রে? আমাকে বেশি জ্ঞান দিতে আসিস না, বুঝলি! তোকে একবার হাতে পাই, তারপরে দেখাচ্ছি।”
ভালকি ভালো ভালুকের মত মুখ করে জিজ্ঞেস করল, “কী দেখাবি রে, বাঘু? তোর কি আরেকটা বাড়তি লেজ গজিয়েছে নাকি রে? সেইটা দেখাবি?”
বাঘু হাঁচোড় পাঁচোড় করে উঠতে উঠতে বলল, “লেজ গজিয়েছে না কী গজিয়েছে তুই টের পাবি। আজ যদি দিদিমণিকে আমি নালিশ না করেছি তোর নামে!”
ভালকি অবাক হবার ভান করল, “সে কী কথা রে? আমি আবার কী করলুম?”, বলেই বলল, “যাই বাবা, এখুনি ঘন্টা পড়ে যাবে। বাঘু তোর গড়াগড়ি খাওয়া শেষ হলে আসিস বরং।”
বলেই ভালকি ধীরেসুস্থে হাঁটা লাগাল। বাঘুর বইখাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিল। সেগুলো সব গুছিয়ে সেও পাঠশালার পথ ধরল।
প্রার্থনার পর ক্লাস শুরু হতে না হতেই হাঁউমাঁউ করে উঠল বাঘু, “দিদিমণি, দেখুন না, এই বদমাশ ভালকিটা পাঠশালে আসার সময় দু’বার আমাকে ঘুঁষি মেরে ফেলে দিয়েছে।”
ভালকি সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ করে উঠল, “আমি আবার কখন তোকে ঘুঁষি মেরে ফেললাম? তোকে বরং দেখলাম যে নালার জলে গড়াগড়ি খাচ্ছিস!”
বাঘু তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “সে তো তুই আমাকে ফেলে দিলি বলে!”
ভালকি চোখ গোলগোল করে বলে, “আমি আবার কখন তোকে ফেলে দিলাম?”
বাঘু জোরে জোরে মাথা ঝাঁকায়, “অমন কথা বলিস নি, ভালকি। তুই পুঁ পুঁ করে বাঁশি বাজাতে বাজাতে আসছিলি না?”
ভালকি বলে, “হ্যাঁ, আসছিলাম। তাতে কী হয়েছে?”
“তারপর আমাকে তুই পিছনদিকে কিসব প্যাঁচ কষিয়ে ফেললি না?”
“ও তুই আমার পিছনে আসছিলি? আমি কী করে জানবো বল্?”, বলেই ভালকি মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে, “ও দুবার যেন ঝটকা মেরেছিলাম বাঁশি বাজাতে বাজাতে। তুই কি তখন আমার পিছনে ছিলি?”
“পিছনে ছিলি?”, বাঘু প্রায় ভেংচেই ওঠে, “জানিস না যেন?”
শিয়ালনী এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এবারে হাল ধরে, “কিন্তু বাঘু, তুই-ই বা পিছন থেকে ভালকির ঘাড়ে পড়তে গেছলি কেন? ওকে ডাকলি নাই বা কেন?”
বাঘু থাবা দিয়ে ঘাড় চুলকোয়, ইতস্ততঃ করে, “ইয়ে… ম… মানে… ইয়ে দিদিমণি, মানে… ইয়ে… মানে…ওই আর কী… মানে আমি ওকে আসলে ওই একটু চমকে দিতে চেয়েছিলাম।”
“ও, চমকাতে চেয়েছিলি? তা প্রথমবার ঘুঁষি খেয়েও ডাকলি না কেন?”
বাঘু এবার পড়েছে মুশকিলে। খানিকক্ষণ থাবা দিয়ে লেজ চুলকেটুলকে নিয়ে বলে, “আসলে… মানে… ওকে ডাকতে মনে হয় ভুলে গেছলাম। তবে আপনি এমনি প্রশ্ন করবেন জানলে তো অবশ্যই ডাকতাম।”
শিয়ালনী বাজপড়া গলায় ডাকল, “বাঘু! বাঘুউউউউউ!”
বাঘু থাবাজোড় করে বলল, “কী দিদিমণি?”
শিয়ালনী চোখ দুটোকে গোল্লা পাকিয়ে বলল, “কী দিদিমণি? আমার সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে? চালাকি পায়া হ্যায়? কায়দাবাজি পায়া হ্যায়?”
রাগের চোটে হিন্দী বলতে শুরু করেছে শিয়ালনী। বাঘু ভালোবাঘের মত মুখ করে বলল, “না, দিদিমণি। চালাকি নেহি পায়া হ্যায়। কায়দাবাজি একটু একটু পায়া হ্যায়।”
এতই খেপে গেছে যে শিয়ালনী যে রাগের চোটে তার কান কটকট করতে থাকল, দাঁত কনকন করতে লাগল, নাক ফুরফুর করতে শুরু করল, আর লেজ পাঁইপাঁই করে ঘুরতে থাকল। শিয়ালনী বলল, “বাঘু! তুই এখন একমাস একদম আমার পাশে বসবি। চলে আয় বইখাতা নিয়ে। নো চালাকি! নো কায়দাবাজি!”
বেচারি বাঘু আর কী করে? বইখাতা নিয়ে গিয়ে বসল শিয়ালনীর পাশটিতে। শিয়ালনী সামনের দিকে তাকিয়ে পড়াতে শুরু করেছে আর সেই সুযোগে বাঘু ভালকির দিকে তাকিয়ে বিকট এক ভেংচি কাটল। ভালকিও রেগেমেগে ভেংচি কাটল বাঘুকে। আর সেইসময় শিয়ালনী তাকিয়েছে ভালকির দিকে। ভালকির জিভ তখনও বেরিয়ে আছে। দিদিমণি রেগে কাঁই, “তোর এতবড় আস্পর্ধা ভালকি যে তুই আমাকে ভেংচি কাটছিস?”
ভালকি জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল, “না, দিদিমণি, না। আপনাকে নয়, বাঘুকে।”
“বাঘুকে?”,শিয়ালনী ঝাঁঝিয়ে উঠল, “বাঘুকেই বা তুই কেন ভেংচি কাটবি?”
ভালকি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “দিদিমণি, বাঘু আমাকে ভেংচি কাটছিল আপনার পাশে বসে।”
হিনিমিনি সায় দিল, “হ্যাঁ দিদিমণি, আমি দেখেছি।”
হাতুশিও শুঁড় নাড়ল, “দিদিমণি, আমিও দেখেছি। আপনি যেই পড়াতে শুরু করলেন, বাঘু অমনি ভালকির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভেংচি কাটতে শুরু করল।”
কুমরু মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ দিদিমণি, বাঘু ভেংচি কাটায় তখন ভালকি কাটল।”
শিয়ালনী তো বুঝল যা বোঝার। গমগমে গলায় ডাকল, “বাঘু! বাঘুউউউউ! তোর জ্বালাতে আমি কি একটু শান্তিতে পড়াতেও পারবো না?”
বাঘু কাঁচুমাঁচু হয়ে বলল, “দিদিমণি, আমি তো কোন ঝামেলা করিনি। খালি ভেংচি কেটেছি।”
“অ। খালি ভেংচি কেটেছো? তাই না? নে, তুই এখন রচনা লেখ- ভেংচি কাটার কুফল। নে, লেখা শুরু কর। ওটাই তোর শাস্তি।”
বেচারি বাঘু আর কী করে? মনের দুঃখে রচনা লেখা শুরু করল। শিয়ালনীও আরম্ভ করল পড়াতে।
টিফিনের সময়। হাতুশি আর কুমরুর টিফিন খাওয়া হয়ে গেছে। দুজনে মিলে কিতকিত খেলছে। হিনিমিনি আর ভালকি টিফিন খেতে খেতে গল্প করছে। ভালকি বলছে, “তারপর বুঝলি, যেই না বাঘু পিছন থেকে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেছে, অমনি আমি দিয়েছি এক ভ্যালাটের প্যাঁচ। হিহি হিহি…”। দুজনে মিলে হেসে লুটোপুটি।
ভালকি আর হিনিমিনি হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ছে, এমন সময় ঝপাং! এক কলসি জল এসে পড়ল ভালকি আর হিনিমিনির মাথায়! আর সেই সঙ্গে পাওয়া গেল বাঘুর গলা, “আর কোনদিন দিদিমণিকে আমার নামে লাগাবি?”
বাঘু যে কোন্দিকে হাওয়া হয়ে গেল বোঝাই গেল না। এদিকে হিনিমিনির ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে হাঁচি শুরু হয়ে গেছে। হাতুশি ব্যাপারস্যাপার দেখে দৌড়ে গেছে শিয়ালনীকে খবর দিতে। কুমরু ওর রুমাল নিয়েই হিনিমিনি আর ভালকির গা মাথা মুছিয়ে দেবার চেষ্টা করছে।
শিয়ালনী ওদিকে নিজের ঝোপে বসে বাঘুর লেখা রচনা পড়ছিল। বাঘু লিখেছে-
ভেংচি কাটার কুফল
ভেংচি অতি বিষম বস্তু। ভেংচি কাটার সবচেয়ে বড় কুফল হচ্ছে ভেংচি কাটতে গিয়ে ধরা পড়া এবং ভেংচি কাটার উপর রচনা লেখা। এমনিতে ভেংচি ব্যাপারটা অত খারাপ নয়। কাউকে মারাও নয়, ধরাও নয়। খালি জিভ বের করে মুখ সামান্য কুঁচকে কাউকে নিজের মনোভাব বোঝানো। কিন্তু যাকে ভেংচি কাটা হয়, সে এর ফলে প্রায়ই রেগে যায়। আর রাগারাগি শরীরের জন্য খারাপ, কে না জানে? আরও মুশকিল, বড়রা নিজেরা ভেংচি কাটতে পায় না বলে ছোটদের ওপর প্রায়ই হম্বিতম্বি করে। তা বড়রা মারপিট না করে ভেংচি কাটে না কেন কে জানে? অবশ্য কাউকে ভেংচি কাটলে, সে এর ফলে অনেক সময়ই পালটা ভেংচি কাটে। তার ফলেও ঝামেলা বাধতে পারে। ঝামেলা হলে সেটা অবশ্যই ভেংচি কাটার কুফল।
ডাক্তারেরা রুগী দেখার সময় যে জিভ বের করতে বলে সেটাও একরকমের ভেংচি কাটা। কিন্তু ডাক্তারেরা তাই বলে কোনদিন রুগীকে পালটা ভেংচি কাটে না। যদি কাটত, তাহলে হয়তো রুগী রাগারাগি করে বাড়ি চলে যেত। যদি বাড়ি চলে যেত, তাহলে সেটাকে ভেংচি কাটার কুফল বলে ধরতে হত। ডাক্তারও ফিজ পেত না। সেটাকেও কুফল বলে ধরা যেত। কিংবা দোকানী যদি ঠকায় বা ওজনে জিনিস কম দেয়, তখন তার সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি না করে ভেংচিও কেটে আসা যায়। কিন্তু তার ফলে দোকানী যদি তেড়ে মারতে আসে, সেটাকে ভেংচি কাটার কুফল বলে ধরতে হবে। তাই বলে কি পরীক্ষায় নম্বর কম পেলে খাতা যিনি দেখেছেন, তাঁকে ভেংচি কাটা যায়? কক্ষণোও না। কারণ তাহলে ভেংচি কাটার কুফল পিঠের উপর দুমদুম করে পড়বে।…
এই অব্দি পড়েই শিয়ালনীর ভুরু দুপাশে ধনুকের মত কুঁচকে গেল, পেট ভুটভুট করতে থাকল, নাক কুটকুট করতে লাগল, কান পুটপুট করতে লাগল। আর লেজখানা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বাঘুর খাতায় কিসব লিখতে যাচ্ছে শিয়ালনী, এমন সময় হাতুশি এসে উপস্থিত। হাতুশি এসেই হাঁইমাঁই করে বাঘুর জল ঢালার কথা বলল দিদিমণিকে। সব শুনে শিয়ালনীও ছুটতে ছুটতে গেল হিনিমিনি আর ভালকির কাছে। হাতে একটা গামছা। হিনিমিনি আর ভালকির গা মাথা মুছিয়ে দিল ভালো করে। রোদে বসিয়ে রাখল। হিনিমিনি একটু পরে ধাতস্থ হল বটে, কিন্তু ভালকির জ্বর চলে এল। জ্বরের চোটে কোঁ কোঁ করছে ভালকি। শিয়ালনী পড়ল মহা দুশ্চিন্তায়। হাতুশি গালে শুঁড় ঠেকাল, “দিদিমণি, আমি বরং ভালকিকে ওর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।”
শিয়ালনী ঘাড় নাড়ল, “সেই ভালো। তুই ভালকিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়। আর কুমরু, তুই যা বাঘুর বাড়ি। বাঘুর মাকে বলবি এখুনি যেন একবার আসে। তোরা সব ফিরে এলে আজ ছুটি দিয়ে দেব। পুরো দিনটাই আজ জলাঞ্জলি গেল।”
ভালকিকে ধরাধরি করে তুলে দেওয়া হল হাতুশির পিঠে। হাতুশিও বাচ্চা হাতি, তারও কষ্ট হচ্ছে ভালকিকে পিঠে নিয়ে। কিন্তু বন্ধুর কথা ভেবে পিঠে ভালকিকে নিয়ে গুটিগুটি চলা শুরু করল।
জঙ্গলের অন্য প্রান্তে ভালকির বাড়ি। ঝোপঝাড়, ছোটখাটো নালা পেরিয়ে হাতুশি যাচ্ছে, যাচ্ছে। গভীর বন। ঝিঁঝিঁপোকা ডাকছে জোরালো সুরে। মাঝে মাঝে হাঁটা থামিয়ে জিজ্ঞেস করছে, “হ্যাঁরে ভালকি, জল খাবি?” ভালকি হ্যাঁ বললে গলায় ঝোলানো জলের বোতলটা শুঁড়ে করে পিঠের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আর প্রায় আধ মাইল মত বাকি যখন বাড়ি পৌঁছতে, ভালকি কাঁপতে কাঁপতে বলল, “হাতুশি রে, আর পারছি না। আমি আর পিঠে বসে থাকতে পারছি না। আমাকে নামিয়ে দে রে।”
হাতুশি খুব আস্তে আস্তে নামিয়ে দিল ভালকিকে। ভালকি চিঁ চিঁ করে বলল, “হাতুশি রে, খুব ঠাণ্ডা লাগছে। আমি আর যেতে পারবো না।”, বলেই ভালকি রাস্তার পাশে ঘাসের ওপরেই শুয়ে পড়ল।
হাতুশি আর কী করে? ভালকির কপালে শুঁড় বুলিয়ে বুঝল যে বেশ জ্বর চলে এসেছে। তাড়াতাড়ি করে ছুটল ভালকির বাড়ির দিকে। ভালকির বাড়ি পৌঁছে ভালকির মাকে কোথাও দেখতে পেল না হাতুশি। ঘরদোর খোলা। ‘ভালকিনমাসী’, ‘ভালকিনমাসী’ করে কয়েকবার ডাক দিল। তাও সাড়া পেল না। ওদিকে ভালকি একা ওভাবে জ্বরে পড়ে আছে। বাধ্য হয়ে হাতের কাছে যা কাঁথা কম্বল পেল তাই নিয়ে দৌড় লাগাল সে।
ভালকিন এদিকে বাড়ির পিছনদিকে গিয়ে একটা চাক ভেঙে মধু বের করছিল। কাজটাজ সেরে ঘরে ঢুকতে গিয়ে সে হতবাক। সঙ্গে সঙ্গেই তার প্রবল চিৎকার, “ধর ধর ধর। আমার কাঁথা কম্বলের পা গজিয়ে গেল রে। সব ছুটে পালাচ্ছে আমার ঘর ছেড়ে।”
কাঁথা কম্বলের তলায় যে হাতুশি আছে, ভালকিন বুঝতেই পারেনি। আর এদিকে কাঁথা কম্বলের চাপে হাতুশিরও গলা দিয়ে আওয়াজ ফুটছে না। যাই হোক, যখন ভালকির কাছে গিয়ে কাঁথা কম্বল দিয়ে সব চাপাচুপি দিয়েছে হাতুশি, তখন ভালকিন হাঁফাতে হাঁফাতে হাজির।
যাই হোক, হাতুশি বুঝিয়ে বলল সবকিছু। দুজনে মিলে ধরাধরি করে ভালকিকে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়ে কাঁথা- কম্বল চাপাচুপি দিল। ওকে ভালকিন যেতে দিল না কিছুতেই। নিমকি আর নারকেল নাড়ু খাইয়ে তবে ছাড়ল। হিনিমিনির গায়ে জড়ানোর জন্য একটা চাদরও দিয়ে দিল।
হাতুশি ফিরে এসে দেখে কুমরু আগেই ফিরে এসেছে বাঘুর মা সহ। বাঘিন্নীকে শিয়ালনী বাঘুর কীর্তিকাহিনী শোনাচ্ছে। শুনতে শুনতে বাঘিন্নীর চোখ লাল টকটক করছে, মুখ থমথম করছে। প্রবল এক হাঁক ছাড়ল বাঘিন্নী, “বল্ তুই, ওদের মাথায় কেন জল ঢেলেছিলি?”
বাঘু অম্লানবদনে উত্তর দিল, “ভালকি কেন আমাকে ভেংচি কেটেছিল?”
শিয়ালনী গর্জে উঠল, “সে তো তুই ওকে ভেংচি কেটেছিলি বলে।”
বাঘু দমার পাত্র নয়, “আমি কি এমনি এমনি ভেংচি কেটেছি? ও আমাকে দু’ দু’বার প্যাঁচ কষে জলে ফেলে দিয়েছিল বলেই তো।”
“বাঘু! তুই পিছন থেকে ওর ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেছিলি কেন?”, শিয়ালনী প্রায় তেড়েই গেল বাঘুর দিকে।
বাঘু মুখ গোঁজ করে বলল, “মা কেন আমাকে ওর মতো বাঁশি কিনে দেয়নি? কিনে দিলে তো আমি ওর উপর ঝাঁপাতে যেতাম না।”
তা এরকম কথায় কার না রাগ হয়? এমন রেগে গেল বাঘিন্নী যে বাঘুকে বগলদাবা করে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল।
পরের দিন। টিফিন হতেই শিয়ালনীকে বলে ছুটি নিয়ে ভালকি চলে গেছে। আগের দিন ভালকির শরীর খারাপ ছিল বলে শিয়ালনীও আর বিশেষ আপত্তি করে নি।
ছুটির সময় বাঘু বাড়ি ফিরছে। একটা গাছের ডাল ভেঙে লাঠির মত বানিয়েছে, তাই দিয়ে ঝোপঝাড় ডালপালা সব ভাঙতে ভাঙতে যাচ্ছে। আচমকা খুব কাছ থেকে কে যেন গুরুগম্ভীর গলায় ডাকল, “বাঘুউউউউ!”
ভারি চমকে গেল বাঘু। এদিকওদিক তাকিয়ে দেখে, কাছেই এক বটগাছের তলায় এক সাধুমাতা বসে। লোমশ কালো চেহারা, টকটকে কমলা রঙের পোশাক পরনে, কপালে লাল রঙের বড়ো টিপ। বাঘু তো দেখেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। মাতাজী ডাকলেন, “বাঘু! এদিকে আয়।”
বাঘু ভয়ে ভয়ে থাবাজোড় করে তাঁর কাছে গেল। মাতাজী বললেন, “বাঘু! তোর পাঠশালা ছুটি হয়ে গেল?”
বাঘু চমকেই গেল মাতাজি তার নাম জানেন, তার পাঠশালা ছুটিরও খবর রাখেন! বাঘু ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল, “মাতাজী, আপনি আমার সম্পর্কে এত সব জানলেন কী করে?”
বিকট আওয়াজ করে মাতাজী হাসলেন, “হা হা হাহা! তুই আমাকে হাসালি বাঘু! আমি হলাম ভ্যালাকিচালাকিউৎপটানেন্দাশ্বরী মাতাজী! দীর্ঘ ষাট বছর ধরে হিমালয়ের দুর্গম গুহায় আমি তপস্যা করছি। আমি তোর সম্পর্কে সব জানবো না তো কি তুই জানবি আমার সম্পর্কে?”
বাঘু খুব ভয়ে ভয়ে ঘাড় নাড়ল, “ইয়ে… মানে মাতাজী… খুব ভুল হয়ে গেছে।”
বম বম বম বম করে বিকট এক আওয়াজ করে মাতাজী বললেন, “বাঘু! আমি বলছি, মিলিয়ে নাও। ক্লাসে তোমার বন্ধুদের নাম- হাতুশি, হিনিমিনি, কুমরু আর ভালকি। এদের মধ্যে ভালকির সঙ্গে তোমার কাল খুব ঝামেলা হয়েছে। কী, ঠিক কিনা?”
বাঘু টকাত করে ঘাড় নাড়ল, “হ্যাঁ, মাতাজী। ওই ভালকির জন্য মা কাল আমার কান মুলে দিয়েছে, লেজ মুলে দিয়েছে আর বাঘিপিসীকেও আসতে লিখে দেবে বলেছে।”
মাতাজী খুব গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন, “হুমমম। বুঝলাম। তা তুমি এখন কী করতে চাও?”
বাঘু চটপট করে বলল, “মাতাজী, এমন কিছু একটা করুন যাতে ভালকি আর আমার সঙ্গে লাগতে সাহস না পায়!”
মাতাজী যেন কিসব চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, “বাঘু! ভালকি তোকে কাল প্যাঁচ কষিয়ে ফেলে দিয়েছিল, না?”
শুনে তো বাঘুর আক্কেলগুড়ুম। তড়িঘড়ি বলল, “হ্যাঁ মাতাজী, আপনি এত কথা জানলেন কী করে?”
মাতাজী শুনে প্রচণ্ড রেগে চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, “কী? আবার প্রশ্ন? জানিস, হিমালয়ের দুর্গম গুহায় আমি ষাট বৎসর সাধনা করেছি?”
বাঘু বেজায় ভেবলে গিয়ে বলল, “ও! ওখানে তপস্যা করলে বুঝি পাঠশালার এইসব ব্যাপার স্যাপার দেখতে পাওয়া যায়!”
মাতাজী রেগে কাঁই হয়ে এমন বমবম আওয়াজ জুড়লেন যে বাঘু ভয়েই গুটিসুটি মেরে থাবাজোড় করে বসে রইল। মাতাজী একটু পর শান্ত হয়ে বললেন, “বাঘু! এবারকার মতো মাপ করে দিলাম। এসব বেয়াদবি যেন আর না দেখি। ঠিক আছে, তোর ব্যবস্থা আমি করে দেব। কিন্তু কিঞ্চিৎ গুরুদক্ষিণা যে লাগবে, বাঘুবাবু!”
বাঘু খুশি খুশি ভংগিতে বলল, “তাহলে আমার পাঠশালার বইখাতাগুলো সব দিয়ে দিই?”
মাতাজী ফের রেগে গেলেন, “বাঘু, আমার সঙ্গে মশকরা হচ্ছে? তোর পাঠশালার বইখাতা নিয়ে আমি কি করবো? আমার নিজের কি নেই?”
বাঘু ভারি অবাক হয়ে গেল, “সে কি মাতাজী, আপনিও পাঠশালায় পড়েন?”
মাতাজী যেন একটু অপ্রস্তুত, “আরে না না। মানে বলছি যে আমার ছোটবেলার বইখাতাগুলো তো এখনও রাখা আছে। তুই বরং আমাকে অন্য কিছু দে।”
বাঘু তার থলে হাতড়ে হাতড়ে পেল ভালকির বাঁশিটা। সেটাই দিয়ে বলল, “এই বাঁশিটা লুকিয়ে রেখেছিলাম, মাতাজী। এই বাঁশিটা পেয়ে ওর চালচলন পুরো বদলে গেছে, বুঝলেন না মাতাজী?”
মাতাজী বাঁশিটা হাতে নিয়ে বললেন, “ভালোই হল, যার বাঁশি তার কাছেই ফেরত এল।”
বাঘু কথাটা ভালো শুনতে পায়নি। বলল, “কী বলছেন, মাতাজী?”
মাতাজী বললেন, “কিচ্ছু না। যার বাঁশি তাকে আমি মন্ত্রবলে ফিরিয়ে দেব।”
বাঘু এদিকে অধৈর্য হয়ে পড়েছে, “কিন্তু মাতাজী… ভালকিকে ওই জব্দ করার ব্যাপারটা…।”
মাতাজী বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ। ওটাই বলছি। শোন, এসব ব্যাপারে কার্যসিদ্ধি করা খুব জটিল। তোকেও একটু কষ্ট সহ্য করতে হবে। তুই কি পারবি?”
বাঘু তাড়াতাড়ি করে ঘাড় নাড়ল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, মাতাজী। ওকে জব্দ করার জন্য আমি সব পারবো।”
মাতাজী হাত নেড়ে বললেন, “আয় তবে, কাছে আয়। খুব মন দিয়ে শোন। কিন্তু… কিন্তু… না তুই পারবি না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে যে তুই পারবি না।”
বাঘু জোর দিয়ে বলল, “না, মাতাজী আপনি বলেই দেখুন না। আমি ঠিক সব পারবো।”
মাতাজী কিরকম ফিক করে হাসলেন। তারপর বললেন, “শোন তবে। প্রথমে ওই সামনে যে কাদা আছে, ওই কাদায় আচ্ছাসে গড়াগড়ি খাবি। পুরো শরীর যেন কাদায় ঢেকে যায়। একটুও যেন বাদ না থাকে। তাহলেই কিন্তু মুশকিল। তারপরে এই ছাইটা তোকে দিচ্ছি। মন্ত্রপূত ছাই কিন্তু। খুব সাবধান। এটা লেজে আর মুখে মাখবি। তারপরে এই কাঁটাফলের মালাটা গলায় ঝোলাবি। কাদা মেখে থাকবি তো, গলায় লাগবে না। আর এই কাকের বাসাটা নে। মাথায় কাদার উপর আটকে নিবি। তারপর থাবাজোড় করে চোখ বন্ধ করে একটা মন্ত্র জপ করেই যাবি যতক্ষণ না আমি আবার এসে তোকে চোখ খুলতে বলি। আর মনে রাখবি, তুই যত কাদা মাখবি, তার দ্বিগুণ কাদা এমনি এমনিই ভালকির গায়ে লেপা হয়ে যাবে। তোর গলায় একটা কাঁটাফলের মালা মানে ভালকির গলায় পাঁচটা কাঁটাফলের মালা ঝুলবে। তোর মাথায় একটা কাকের বাসা মানে ওর মাথায় তিনটে কাকের বাসা বসবে।”
এতসব ফিরিস্তি শুনে বাঘু একটু দমে গেলেও ভালকিকে জব্দ করার কথা ভেবে উৎসাহভরে জিজ্ঞেস করল, “মন্ত্রটা কী, মাতাজী?”
মাতাজী বললেন, “শোন তবে। তুই বলবি-
আমি বাঘু মন্ত্র পড়ি,
ভালকিটাকে জব্দ করি-
কাদায় মাখা চেহারা খাসা,
শিরে মোর কাকের বাসা।
ওঁ হ্রীং ক্লিং ঘটঘটাং,
ভালকি হবে চিৎপটাং!’’
মন্ত্র শুনে বাঘু মহা খুশি। বার কয়েক আউড়ে মুখস্থ করে নিল সঙ্গে সঙ্গে। মাতাজি বললেন, “বাঘু, যেমন যেমন বললাম, মন দিয়ে তেমন তেমন করতে থাক। আমি আসি। এসব তো একরকমের সাধনাই। সাধনার সময় অন্য কারুর থাকা চলে না।”
বাঘু কাতরস্বরে বলল, “মাতাজী, আবার কখন আপনার দেখা পাব?”
মাতাজী করুণার হাসি হাসলেন, “ওরে! তোর সাধনা সফল হলেই আমি তোর তপস্যার টানেই এসে হাজির হবো রে। তোকে ভাবতে হবে না। তুই একমনে নিজের কাজ করে যা। কিন্তু সাবধান! যা যা বললাম, যেমন যেমন বললাম, সব ঠিকঠিক করে করবি। এতটুকুও যেন ভুলচুক না হয়। তাহলে কিন্তু উলটো ফল ফলে যেতে পারে! মনে রাখিস।”
বলে মাতাজী ঝোপজংগলের মধ্য দিয়ে কোনদিকে যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন, বাঘু আর ঠাহরই করতে পারল না।
যাই হোক, বাঘু কাজ শুরু করে দিল। কাদায় গড়াগড়ি খেল আচ্ছাসে। যত পারল কাদা মাখল সারা গায়। তারপর বেশ করে মুখে আর লেজে ছাই মাখল। গলায় কাঁটাফলের মালা ঝুলিয়ে দিল। কাঁটাফলের মালাটা কুটকুট করছে বেজায়। কিন্তু এখন কী আর ওসব নিয়ে মাথা ঘামালে চলে? বাঘু চোখ বন্ধ করে থাবাজোড় করে মন্ত্র বলা শুরু করল-
আমি বাঘু মন্ত্র পড়ি,
ভালকিটাকে জব্দ করি-
কাদায় মাখা চেহারা খাসা,
শিরে মোর কাকের বাসা।
ওঁ হ্রীং ক্লিং ঘটঘটাং,
ভালকি হবে চিৎপটাং!’’
মন্ত্র আউড়েই যাচ্ছে বাঘু, আউড়েই যাচ্ছে। একটু পরে আশেপাশে কিসব অল্পস্বল্প আওয়াজ পেল বাঘু। ঝোপঝাড় ভেঙে কারা যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু চোখ খোলা বারণ বলে বাঘু আর চোখ খুলল না। দ্বিগুণ জোরে মন্ত্র বলতে শুরু করল-
আমি বাঘু মন্ত্র পড়ি,
ভালকিটাকে জব্দ করি-
কাদায় মাখা চেহারা খাসা,
শিরে মোর কাকের বাসা।
ওঁ হ্রীং ক্লিং ঘটঘটাং,
ভালকি হবে চিৎপটাং!’’
হঠাৎ করে মাথায় সজোরে গাঁট্টা। বাঘু আহ্লাদের সুরে বলল, “মাতাজী, আপনি এসেছেন? একটু দিব্যদৃষ্টিতে দেখুন না, ভালকির গায়ে কতটা কাদা লাগল!”
অমনি পাশ থেকে হাহা হিহি হাহৌ হাহৌ করে অনেকের হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল। কুমরুর গলা পেল বাঘু, “ওরে, মাতাজী নয়, পিতাজী! চোখ খোল।”
ভয়ানক চমকে গিয়ে চোখ খুলল বাঘু। তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে কুমরু আর তার পাশে হাতুশি আর হিনিমিনি। তিনজনে মিলে হেসেই কুটোপাটি। হিনিমিনি বাঘুর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে, “ই কী রে বাঘু, এমন সঙ সেজেছিস কেন? ওফ! চেহারাখানা যা খোলতাই হয়েছে রে তোর!”
বাঘু এদিকওদিক চাইল, “ইয়ে… মানে আমি আসলে… মানে ভালকি… মানে ভালকি নয়… মানে ওই ইয়ে… মানে আমি একটু কী বলে ধ্যান করছিলাম।”
“ধ্যান করছিলি? বলিস কী রে বাঘু?”, বলতে বলতেই হাতুশির সারা শরীর দুলিয়ে হাসি, “ধ্যান করলে বুঝি সারা গায়ে কাদা মাখতে হয়?”
বাঘু তাড়াতাড়ি করে বলে, “ইয়ে … মানে মাতাজী বললেন… জানিস, মাতাজী কথা বললে বাজ পড়ে, বমবম আওয়াজ করলে ভূমিকম্প হয়…।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি”, বাঘুকে থামিয়ে দিয়ে হাতুশি শুঁড় দুলিয়ে হো হো করে হাসল, “মাতাজী নাক ডাকলে ঝড় হয়, হাঁচলে বৃষ্টি হয়…, জল খেলে বন্যা হয়…”।
হিনিমিনি হাতুশির কথার খেই ধরল, “মাতাজী রেগে গেলে গরম হাওয়া বয়…, কথা বললে ঝপাঝপ ভাদ্র মাসের তাল পড়ে…।”
বাঘু ভয়ানক রেগেমেগে গিয়ে বলল, “জানিস, মাতাজী ষাট বছর ধরে হিমালয়ে তপস্যা করেছেন… আমার সম্পর্কে সব কথা বলে দিলেন?”
“হে হে হে হেহেহে… তাই বুঝি তুই ভালকির বাঁশিটা মাতাজিকে দিয়ে দিলি?”, হাসতে হাসতেই বলে কুমরু।
এ কথায় বাঘু এতই চমকে গেল, “তোরা কী করে জানলি?”
“হিহি! আমরা আড়াল থেকে সব দেখেছি বাঘু। স-অ-অ-অ-ব!”
হিনিমিনি দাঁত বের করে হাসে, “নাও, বাঘু। এবারে সত্যি সত্যিই তোমার আসল মাতাজী আসছেন!”
বাঘু চমকে পেছন ফিরে দেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে ধেয়ে আসছে তার মা বাঘিন্নী। সঙ্গে ভালকি। বাঘিন্নী এসেই সোজা বাঘুর কান ধরে, “অ! পাঠশালা থেকে ফেরার পথে এইসব সঙ সাজা হচ্ছিল না? ভাগ্যে ভালকি আমাকে গিয়ে বলল। লেখাপড়া করতে পাঠাচ্ছি, আর তুই এইসব করে বেড়াচ্ছিস, না?”
বাঘু বলার চেষ্টা করল, “আসলে মা কাদায় পড়ে গিয়ে…”
বাঘুর কানে আরেক পোঁচ পড়ল, “অ! কাঁটাফলের মালাটাও কাদায় পড়ে গিয়ে? ছাইগুলোও কাদায় পড়ে গিয়ে? মাথার কাকের বাসাটাও কাদা থেকেই উঠে তোর হাতে এসেছে?”
“আসলে … মানে… এক মাতাজী…”, বলতে বলতেই বাঘুর চোখ গেছে ভালকির কপালের দিকে। সেখানে তখনও জ্বলজ্বল করছে মাতাজীর সেই লাল টিপ। তাড়াহুড়োতে ভালকি ওটা খুলে আসতে ভুলে গিয়েছে।
পিছন থেকে একটা খুব চেনা গলার আওয়াজ ভেসে এল, “কী ব্যাপার রে সব? বাড়ি যাসনি? এখানে কী করছিস? বাঘুউউউ, তুই আবার রাস্তার মাঝে ভেলকিবাজি শুরু করেছিস?”
বেচারি বাঘুর কি আর এত দুঃখ সয়? কান্নাই জুড়ে দিল হাঁউমাঁউ করে, “ইয়ে মানে … ওরা সবাই মতলব করে আমায় জব্দ করেছে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… সব ওই বদমাশ ভালকির কারসাজি… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… মাতাজী সেজে সর্বনাশটা করল গো… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… আমার বলে কাদা মনে সাদা নেই… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… মানে ইয়ে… সাদা মনে কাদা নাই… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… ও দিদিমণি গো… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)…আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… ।”
আর ভালকি? সে তখন পুঁ পুঁ করে বাঁশি বাজাতে বাজাতে মনের সুখে গান জুড়েছে-
ভালকি আমি ফন্দি করি
বাঘুটাকে নাকাল করি;
কাদায় মাখা চেহারা খাসা–
বাঘুর শিরে কাকের বাসা।
ছাইমাখা মুখখানি,
কাঁটাফলের চুলকুনি।
মায়ের হাতের কানমলা,
দিদিমণি ধরায় জ্বালা।
ওঁ হ্রীং ক্লিং ঘটঘটাং,
বাঘু হল চিৎপটাং!’’
……০……
অংকনঃ সোমক সেনগুপ্ত
বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি পড়ুন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করেঃ-
৬। অযোধ্যা পাহাড়ে বাঘু ৭। পরীক্ষা দিলেন বাঘু