শিল্পী- গুঞ্জা
(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে পাঠশালার খবর ভেসে আসে মাঝেমধ্যে। এলেই তোমাদের জানাতে থাকবো। পাঠশালাটা কোথায় জানো? বনের ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে প্রচুর গাছপালা মিলে মাথার উপরে একটা চাঁদোয়ার মত বানিয়েছে, আর দুটো সেগুনগাছের ইয়া মোটা মোটা গুঁড়ি দুদিক থেকে এসে একটা দরজার মতো তৈরি হয়েছে। জঙ্গলের যত ছানাপোনা জন্তুজানোয়ার, সবাই আজকাল সক্কালবেলা হলেই হাতমুখ ধুয়ে চাট্টি মুড়ি খেয়ে ওখানেই পড়তে যায়। তাদের মধ্যে আছে বাঘিনীর বাচ্চা ছেলে বাঘু, হাতির বাচ্চা মেয়ে হাতুশি আর হনুমানের ছানা মেয়ে হিনিমিনি। এছাড়াও আছে ভালুকের পুঁচকি মেয়ে ভালকি আর কুমীরের বাচ্চা ছেলে কুমরু।)
বাঘু বেচারির মন কয়েকদিন ধরেই বেশ খারাপ। একা একা দুষ্টুমি করা আর কাঁহাতক পোষায়? বেশ একটা মনের মতন সাথী থাকত, তাকে নানানরকম ফন্দিফিকির শেখাত, হাতুশি-হিনিমিনি-ভালকি-কুমরুকে ঝামেলায় ঝামেলায় জেরবার করে দিত, তবেই না দিব্যি ঝালমুড়ির মত জমত ব্যাপারটা! তা তো হচ্ছেই না, উল্টে বাঘুই নাকাল হয়ে যাচ্ছে!
এই সেদিন যেমন। দিদিমণির একটু ঝিমুনি মতন এসেছিল। বাঘু সেই সুযোগে তার চারখানা পেনসিলকে যথেচ্ছ ছুলে ছুলে এই এতখানা খোসা জড়ো করল। ভালকি একটু দূরে বসে মন দিয়ে হাতের লেখা করছিল। বাঘু গিয়ে পেনসিলের খোসাগুলো ভালকির মাথায় ঢেলে দিয়ে মন্ত্র উচ্চারণের মতো করে বলল, “ওঁ, পেনসিলের খোসায় স্বাহা। ওঁ হাতের লেখায়ং স্বাহা!”
তা এসব ভালো ভালো জিনিস বোঝার বুদ্ধি থাকলে তো! এত দারুণ একটা মজার জিনিস করল বাঘু, অথচ ভালকিটা মজার কদর বুঝলই না! উল্টে বাঘুকে সেই ভ্যালাটে না কী বলে তার অ্যাইসান প্যাঁচ কষল যে বাঘুই চিৎপটাং। এদিকে হাতুশি-হিনিমিনি- কুমরু হাঁইহাঁই করে দিদিমণিকে নালিশ জানাতে চলে গেল- দিদিমণি, বাঘু হাতের লেখা করতে দিচ্ছে না। খালি গণ্ডগোল পাকাচ্ছে!
দিদিমণিই বা কিরকম? বাঘুর কাছে তো একবার জানবে, শুনবে যে ব্যাপারটা কী হয়েছে! তা না, তাকে থাবা ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে বসালেন! তারপর টানা সাত পাতা হাতের লেখা করালেন!
এতসব কাণ্ড হলে বাঘুরই বা আর মনখারাপের দোষ কী?
গরমটা পড়েছে বেজায়। আকাশে যে সূর্যস্যার থাকেন, তিনি আজকাল সদাসর্বদাই খাপ্পা। কীসের এত রাগ কে জানে? যেন সেই গণ্ডারনী দিদিমণির মতো, সবসময় রেগেই আছেন! সুযোগ পেলেই যেন সব জ্বালিয়ে খাক করে দেবেন। তবে কিনা, ঝড়দাদা আর বৃষ্টিদিদিও তো আছে। সূর্যের রাগ কমাতে মাঝেমধ্যেই তারা কোমর বেঁধে নেমে পড়ে। রাগী রাগী সূর্যস্যারও তখন খানিকটা নরম হয়ে আসেন।
কাল রাতের দিকেও বেশ খানিকটা ঝড়জল হয়ে গেছে। হালকা হালকা নরম হাওয়া বইছে জঙ্গলের আলোছায়ার ভেতর দিয়ে। প্রার্থনার লাইনে দাঁড়িয়ে আছে সব পশুয়ারা (পশু+ পড়ুয়া আর কী!)। বাঘু প্রার্থনার লাইনে কিছু না কিছু গোলমাল পাকানোর ধান্দায় থাকে বলে শিয়ালনী এখন বাঘুকে সবার প্রথমেই দাঁড় করায়। শিয়ালনী দাঁড়িয়ে ওদের সামনে। চোখ বন্ধ, জোড়হাত।
প্রার্থনা শুরু হয়ে গেল। ‘বুনো বুনো গন্ধ, গানেরই ছন্দ…’। গান চলছে চলছে। ‘মন ভরা দিল নিয়ে’ অব্দি যখন পৌঁছেছে, বাঘু তখন আচমকা পিছনের দিকে হেলে জোরসে এক ঠ্যালা দিল। বাঘুর পিছনে ছিল হিনিমিনি। হিনিমিনি ঠ্যালার চোট সামলাতে না পেরে সজোরে ধাক্কা দিল তার পিছনে থাকা ভালকিকে। ভালকি হুড়মুড়িয়ে গিয়ে পড়ল হাতুশির গায়ে। হাতুশিও অমন আচমকা ধাক্কা খেয়ে পড়বি পড়, পড়ল একেবারে কুমরুর ঘাড়ে। গায়ের ওপর মোটাসোটা হাতুশি এসে পড়ায় কুমরুর চোখ ফেটে জলই বেরিয়ে গেল। আর হাতুশিরও সারা গায়ে কুমরুর কাঁটা গেল ফুটে।
হাঁইমাঁই আওয়াজ শুনে শিয়ালনী চোখ মেলে দেখে, হাতুশি আর কুমরু চিৎপাত। ভালকি গায়ের ধুলো ঝাড়ছে। হিনিমিনি হতভম্বের মত মাটিতে বসে। একমাত্র বাঘুই দিব্যি ভালোবাঘের মতো দাঁড়িয়ে আছে সামনের থাবাদুটো জোড় করে। শিয়ালনীকে দেখে বাঘু সোনামুখ করে বলল, “দেখুন দিদিমণি, ওদের কাণ্ড। প্রার্থনায় একটুও মন নেই। আপনি বলে কত্তো যত্ন করে প্রার্থনা করান দিদিমণি! কিন্তু দেখুন, ওদের যদি একটুও মন থাকে।”
তা শিয়ালনী কি আর ওসবে ভোলে? চোখ পাকিয়ে পেল্লায় এক ধমক দিল বাঘুকে, “চোওওওওপ!” তারপরই এক হুংকার, “বলি, কী হচ্ছে ওখানে? প্রার্থনা হচ্ছে না চপের ভাগ নিয়ে মারামারি ঠেলাঠেলি হচ্ছে?”
কুমরু হাঁউমাঁউ করে উঠল, “দিদিমণি, দেখুন না, হাতুশি আমার উপরে পড়েছে! আমার এত ভারি লেগেছে!”
হাতুশিও শুঁড় উঁচিয়ে ধরল, “আর আমার? আমার বুঝি গায়ে তোর কাঁটা লাগেনি?”
শিয়ালনী ফের এক ধমক লাগাল, “হাতুশি, তোমাকে কুমরুর উপরে পড়তে কে বলেছিল শুনি?”
হাতুশি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “দিদিমণি, ভালকিটা হঠাৎ করে এসে আমাকে গায়ে ধাক্কা দিল।”
শিয়ালনী ঘুরল ভালকির দিকে, “ভালকি, তুমি কেন হাতুশিকে ধাক্কা মেরেছ?”
ভালকি বলল, “দিদিমণি, হিনিমিনি আমাকে দুম করে ঠেলে দিল যে।”
শিয়ালনী ঘুরল হিনিমিনির দিকে, “হিনিমিনি, তুমি জানো আমি প্রার্থনার লাইনে ঝামেলা পছন্দ করি না। কেন ঠেলেছ ভালকিকে?”
হিনিমিনি কাঁচুমাঁচু হয়ে বলল, “দিদিমণি, আমি কী করব? বাঘুটা হঠাৎ করে পিছিয়ে এসে আমাকে এমন ঠেলা দিল যে সামলাতে পারলাম না।”
ব্যস! যা বোঝার বুঝল শিয়ালনী। চোখদুটোতে যেন আকাশের সূর্যই আগুন ঝরাচ্ছে। গমগমে গলায় বলল শিয়ালনী, “বাঘু! বাঘুউউউউউউউ! তার মানে তুই-ই যত নষ্টের গোড়া।”
বাঘু অবাক হয়ে বলল, “গোড়া কোথায় দিদিমণি? বলুন নষ্টের আগা। মানে আমি তো আগে ছিলাম, তাই আগা।”
রাগের চোটে থরথর কাঁপছে শিয়ালনী। লেজখানা খাড়া হয়ে গেছে, দাঁত কিড়মিড় করছে, চোখদুটো লাটিমের মত ঘুরছে। কাঁপতে কাঁপতেই বলল শিয়ালনী, “হতভাগা! প্রার্থনা পণ্ড করে আবার মুখে মুখে তক্কো? কোন কথা শুনতে চাই না আমি। তুই এক্ষুণি গুনে গুনে একশবার লেজবোস কর। হাতুশি- হিনিমিনি- ভালকি- কুমরু, তোরা সবাই বাঘুর লেজবোস গোন। নো চালাকি! নো কায়দাবাজি!”
বেচারি বাঘু আর কী করে? লেজবোস করতে শুরু করে দিল। হাতুশি- হিনিমিনি- ভালকি- কুমরু এদিকে হাহা- হিহি করে হেসে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।
কিছুক্ষণ পরে। পড়া শুরু হয়েছে। শিয়ালনী এসেই বলেছে সবাইকে, শোন্, তোদের আমি আজ ‘ভূগোল ভাবনা’ পড়াবো।
শুনেই বাঘু ফিসফিস করে বলল, “এ তো ভারি ভাবনার কথা।”
পাশে বসা কুমরু কোন পাত্তাই দিল না দেখে বাঘু বাধ্য হয়ে চুপ করল। শিয়ালনী এদিকে পড়াতে শুরু করেছে, “শোন্, আমরা যে গ্রহে থাকি, এই গ্রহের নাম পৃথিবী।”
অমনি বাঘু ফস করে বলল, “আমরা তো জঙ্গলে থাকি। তার মানে এই জঙ্গলের নাম পৃথিবী?”
শিয়ালনী বেজায় বিরক্ত হয়ে বলল, “আরে দূর! জঙ্গলের নাম পৃথিবী হবে কেন? বলি, জঙ্গলটা কিসের মধ্যে?”
বাঘু অবাক হয়ে বলল, “জঙ্গল আবার কিসের মধ্যে থাকবে? জঙ্গল থাকে জঙ্গলের মধ্যে। জঙ্গল কি ভাত যে হাঁড়ির মধ্যে থাকবে?”
শিয়ালনী হাল ছাড়ার ভঙ্গি করে বলল, “বাঘু! আমি এখন পড়াই। তোর যা প্রশ্ন করার পরে করিস।”
আবার শুরু করল শিয়ালনী, “ওই যে দূরের সূর্যটাকে দেখিস, ওটা হচ্ছে আসলে একটা নক্ষত্র। সূর্য আমাদের এই পৃথিবী থেকে অনেক অনেক দূরে আছে। বাঘু, শোন্ এবার। তোর প্রশ্নের উত্তর আসবে। আমি বোর্ডে ছবি আঁকছি। সবাই দ্যাখ। তাহলেই বুঝবি।”
এই বলে শিয়ালনী বোর্ডে ভারতের ছবি এঁকে বোঝাল। তারপর আঁকল পৃথিবীর ছবি। হাতের ‘ভূগোল ভাবনা’ বই দেখিয়েও বোঝাল।
বাঘু সবজান্তার ভঙ্গিতে বলল, “ভারতের কথা আমি জানি। আমার মায়ের বন্ধু আছে, সিংহিকামাসী। মাসীই একদিন দুঃখু করছিল মায়ের কাছে। ভারতে নাকি সিংহের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।”
শিয়ালনী বিরক্তই হল খানিক, “বাঘু, এসব আলোচনা পরেও করা যাবে। একদম চুপচাপ শুনে যা।”
বাঘুকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে শিয়ালনী পড়াতে শুরু করল। আমাদের এই পৃথিবী, এটা ঘোরে সূর্যের চারপাশে।
শুনে তো সবাই তাজ্জব! এও হয় নাকি? হাতুশির গলায় চিন্তার সুর, “তাহলে পৃথিবী ঘুরছে মানে আমরা সবাই ঘুরছি।”
হিনিমিনি গালে লেজ ঠেকিয়ে বলল, “এত ঘুরলে তো পৃথিবীরই মাথা ঘুরবে!”
কুমরু বলল, “এইবারে বুঝেছি। সূর্যটা আকাশে সারাদিন অত বাঁইবাঁই করে ঘোরে বলেই ওর মাথা গরম হয়ে যায়। আর তখন গরমকাল হয়।”
বাঘু দেখল, তারও কিছু বলা দরকার। তাড়াতাড়ি করে বলল, “আমার বাঘিপিসীরও না খুব মাথা গরম। আর সবসময় চরকিপাক ঘোরে। বাঘিপিসীও মনে হয় খুব তাড়াতাড়িই সূর্য হয়ে যাবে।”
শিয়ালনী আর থাকতে না পেরে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে উঠে বাঘুর লেজ ধরে এক টান মেরে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, “দ্যাখ বাঘু। আমি অনেক সহ্য করেছি। ফের যদি আর একটাও উল্টোপাল্টা কথা বলেছিস তো তোর লেজ মলে দেব। এই বলে দিলাম। চুপচাপ এখানে বসে থাক। সূর্যটা স্থির। পৃথিবী তার চারপাশে ঘোরে। সূর্যের মত স্থির থাক।”
বাঘুর কোন হেলদোল নেই। দিব্যি ভালোবাঘের মত মুখ করে শুধোল, “দিদিমণি, সূর্যের কি লেজ থাকে?”
শিয়ালনী চোখ-মুখ রাগের চোটে সত্যি সত্যিই সকালের সূর্যের মতো লাল টকটক করতে লাগল। কী হত বলা যায় না, কিন্তু তার আগেই পাঠশালার বাইরে থেকে কেউ হাঁক দিল, “শিয়ালনী, আছো নাকি?”
ওরা সকলে চমকে দেখে, বড়োসড়ো এক সিংহী পাঠশালার বাইরে দাঁড়িয়ে। তার পাশে তার ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে। শিয়ালনী একগাল হেসে বলে, “আরে সিংহিকা যে! এসো এসো। কতদিন পরে দেখা। সঙ্গে ওটি কে? তোমার মেয়ে?”
সিংহিকা ঘাড় নাড়ল, “হ্যাঁ, আমার মেয়ে সিংহালু। ওর জন্যই আসা।”
সিংহালু তার মায়ের থাবা ধরে টানল, “মা, মা, দেখো, বাঘুদাদা।”
সিংহিকা মেয়ের গায়ে এক চাপড় মেরে বলল, “যা, তুই বাঘুদাদাদের সঙ্গে বোস। আমি দিদিমণির সঙ্গে কথাটা সারি।”
হাসিখুশি, মিষ্টি, ছটফটে সিংহালুকে পছন্দ হয়ে গেল ওদের সকলেরই। বাঘু তো বেশ কায়দা করে সিংহালুর সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিল, “বুঝলি সিংহালু, এ হল হাতুশি। আমাদের মনিটর। অনেক পড়াশুনো করে আর গাদা গাদা নম্বর পায়। ও হল হিনিমিনি। কলার রকমারি খাবার খায়, আমাদেরও খাওয়ায়। আর এ হল ভালকিদিদি। খালি মধু খায় আর পড়াশুনো করে। আর এ হল গিয়ে কুমরুদাদা। ভুলভাল কবিতা লেখে আর কিছু হলেই চোখে জল চলে আসে।”
সিংহালু ফিকফিক করে হাসল, ধপাস করে লাফাল আর তারপর মুখ বাঁকাল, “আর তুমি হলে বাঘুদাদা। পড়ার নামে শুধুই কাঁদা।”
শুনেই বাঘু চুপসে গেল বেজায়। সিংহালু এদিকে মিটিমিটি করে হাসতে হাসতে বলছে, “আচ্ছা, তোমাদের একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করি। বলো তো দেখি, বালি দিয়ে ইলিশ মাছ রান্না করলে তাকে কী বলে?”
শুনে তো ওরা সকলে হতভম্ব। এ আবার কী রকম প্রশ্ন? কুমরু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করেই বসল, “বালি দিয়ে ইলিশ মাছ? তাও আবার হয় নাকি?”
বাঘু মুখচোখ গোঁজ করে বলল, “বালি দিয়ে ইলিশ মাছ রাঁধলে আমি মোটেই খাবো না। আমার জন্য সরষের ঝাল দিয়ে রাঁধা চাই।”
হাতুশি থামাল ওদের, “আরে, সিংহালু তো বলছেই, এটা একটা ধাঁধা। সত্যি কি আর?”
সিংহালু বার দুয়েক ধপাস ধপাস করে লাফিয়ে বলল, “ভাবো। ভাবো আর বলো।”
ভালকি এতক্ষণ চিন্তা করে কিছুই উত্তর না পেয়ে বলল, “বেজায় কঠিন।”
হিনিমিনি বলল, “বলেই দে না। আর ভাবতে পারি না।”
হাতুশিও সায় দিল, “হ্যাঁ হ্যাঁ। বলেই দে।”
সিংহালু ফিকফিক করে হেসে বলল, “বালিশ। বালি যোগ ইলিশ, বালিশ।”
উত্তর শুনেই তো সবাই ভেবলে টেবলে একাকার। আচ্ছা মেয়ে তো!
সিংহালু আরো দুবার ধপাস ধপাস লাফালো, তারপর বলল, “আরো ধাঁধা জিজ্ঞেস করবো নাকি?”
ভালকি সঙ্গে সঙ্গেই ঘাড় নাড়ল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। কর।”
সিংহালু লেজ নেড়ে মাথা দুলিয়ে একবার থপাস করে লাফিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “বলো তো দেখি, কেউ খুব আদর করে যদি চা খায়, তাহলে কী বলা হবে?”
এ আবার কিরকম ধাঁধা? ওরা ভারি ভাবনায় পড়ে গেল? বাঘু একটুখানি লেজটেজ চুলকে নিয়ে বলল, “কি আর হবে? আদর করে চা খেতে গিয়ে চা যদি পড়ে যায়, তাহলে পাজি, নচ্ছার, ছুঁচো এসব বলা হবে।”
সিংহালু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “উফফ! বাঘুদাদা, তোমাকে নিয়ে আর পারি না। বলছি না, এটা একটা ধাঁধা। আবার শোনো মন দিয়ে। যদি কেউ খুব আদর করে চা খায়, তাহলে কী বলা হবে?”
সিংহালু মিটিমিটি হাসছে। কুমরু লেজখানাকে দুবার মাটিতে আছড়ে বলল, “বড্ডো শক্ত। এর চেয়ে নারকেল ছাড়ানো ঢের সোজা।”
সিংহালু বারতিনেক ধপাস করে লাফিয়ে বলল, “তাহলে পারবে না? বলে দিই? কী হাতুশিদিদি?”
হাতুশি শুঁড়খানাকে একটু হাওয়ায় বারকয়েক দোলাল। তারপর মাথায় বোলাল। তারপরে বলল, “হয়েছে। চাদর। চা যোগ আদর, সমান চাদর। কী রে, হয়েছে?”
সিংহালু এক লাফ দিয়ে বলল, “হয়েছে মানে? দারুণ হয়েছে। একদম ঠিক।”
সিংহালুর কথা শেষ হতে না হতেই সিংহিকার গলা পাওয়া গেল, “সিংহালু, তুই তাহলে পাঠশালাতেই থাক। মন দিয়ে পড়াশুনা কর। আর ছুটি হলে বাঘুদাদার সঙ্গে বাড়ি চলে যাবি। বাঘু, তুই ওকে বাড়ি পৌঁছে দিস তো।”
বাঘু তো এতবড়ো একটা দায়িত্ব পেয়ে মহা খুশি। ঘাড় হেলিয়ে বলল, “আচ্ছা,সিংহিকামাসী। তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোরো না। আমি ঠিক ওকে পৌঁছে দেবো।”
সিংহিকা বলল, “শিয়ালনী, আমি আসি। ও তো এমনিতে ঠিক আছে, কিন্তু দুষ্টুবুদ্ধিও নেহাত কম নয়। অক্ষরগুলোই চেনাতে পারছি না কিছুতে।”
শিয়ালনী আশ্বাসের সুরে বলল, “আরে, কিচ্ছুটি ভেবো না। এই বাঘুটা এত ফাঁকিবাজ, তা ওকেই ধরেবেঁধে শেখাতে পারছি যখন, তখন তোমার মেয়েরও হবে। ভেবো না।”
সিংহিকা বাঘুর দিকে একবার চেয়ে ফিক করে হেসে বলল, “হলেই ভালো। আমি আসি।”
সিংহিকা চলে গেল। শিয়ালনী ওদের পড়াতে বসল। সিংহালুকে শিয়ালনী বলল, “শোন্, একটু পর তোকে পড়াবো। তোর দাদা দিদিদের একটু আগে পড়িয়ে নিই। তুইও বসে বসে শোন। ।”
সিংহালু গালে থাবা দিয়ে বলল, “কেমন করে বসবো, দিদিমণি? বাবু হয়ে না উবু হয়ে?”
শিয়ালনী এতই হতভম্ব হয়ে গেল যে খানিকক্ষণ মুখ দিয়ে আর কোন কথাই বেরোল না। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “মা সিংহালু, তুমি তো দেখছি তোমার বাঘুদাদার মতোই সরেস। তুমি বরং বাবু হয়েই বোসো।”
সিংহালু বসল বাবু হয়ে। শিয়ালনী বলল, “এবারে তোদের দেখাই পৃথিবী কেমন করে সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। তোরা এই মাঝের জায়গাটা খালি কর। বাঘু তুই একদম মধ্যিখানে এসে স্থির হয়ে বোস।”
মাঝখানটা খালি করে মধ্যিখান তো খালি করা হল। বাঘুকে বসানো হল মধ্যিখানে। এরপরে শিয়ালনী ডাকল ভালকিকে। তারপরে বলল, “মনে কর, মাঝের বাঘু হল সূর্য। আর ভালকি হল পৃথিবী। এরপর পৃথিবী কেমন করে ঘোরে দ্যাখ।” বলে শিয়ালনী ভালকিকে তার নিজের চারপাশে পাক খাইয়ে খাইয়ে গোল করে ঘুরিয়ে আনল। তারপর বোঝাল কেমন করে পৃথিবী ঘোরে সূর্যের চারপাশে।
সিংহালু বলল, “দিদিমণি, আমিও ওরকম পৃথিবী হবো। পাঁই পাঁই করে পাক খাবো।”
বাঘু তারস্বরে প্রতিবাদ করল, “না দিদিমণি, আমি এবার পৃথিবী হব। পৃথিবী হওয়াটা কত মজার!”
শিয়ালনী এক ধমক দিল, “তোকে আর পৃথিবী হতে হয় না, বাঘু। তোরা সবাই প্রশ্নমালা ৬-র অঙ্কগুলো কর। আমি এবার সিংহালুকে পড়াবো।”
সিংহালুকে কাছে ডেকে নিল শিয়ালনী। খানিকটা আদরের সুরেই বলল, “সিংহালু, ছড়া জানো কিছু?”
সিংহালু ঘাড় দুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ, অনেক ছড়া জানি। আমি তো নিজে নিজে ছড়া বানাই।”
শিয়ালনী শুনে হাঁ। বলে কী? কোনমতে সামলে সুমলে বলল, “ঠিক আছে। বলো শুনি।”
সিংহালু বলতে শুরু করল-
আগডুম বাগডুম টারে টুম
প্যাঁচা ডাকে, ভুতুম থুম।
শজারুর কাঁটা- ঝুম ঝুম;
কিল খাবি? দুম দুম?
শুনেটুনে শিয়ালনীরই আক্কেল গুড়ুম! মিহি সুরে বলল, “সিংহালু, এ ছড়াটা ভালোই। ঠিক আছে, বোস।”
সিংহালুর সঙ্গে সঙ্গে আবদার, “দিদিমণি, আর একটা অন্ততঃ বলি।”
শিয়ালনী আর কী করে? হতাশ ভংগিতে বলল, “ঠিক আছে, বল্।”
সিংহালু বেশ থাবাটাবা নেড়ে বলতে লাগল-
হাঁই রে হাঁই। হাঁই রে হাঁই।
ঝড় এল ধাঁই ধাঁই।
পালা সবে পাঁই পাঁই-
আম পেড়ে কাজ নাই।
শিয়ালনীর মুখ দুঃখী দুঃখী, “তা ভালোই বানিয়েছিস তুই। তবে কিনা, আরেকটু ইয়ে, মানে অন্যধরনের কবিতা টবিতা জানিস কিছু?”
সিংহালু গালে লেজ ঠেকিয়ে বলল, “ও মা! সে কী কথা? জানব না কেন? আমি সব রকম জানি। বড়ো হয়ে আমি কাঁধে একখানা ঝোলা থলি নিয়ে কবি হব কিনা। দাঁড়ান, শোনাচ্ছি।” বলেই শুরু করল-
ভালোবাসি গাছে ঘেরা ছায়াটি,
ভালোবাসি ঝলমলে দিনটি-
ভালোবাসি বনফুল, রাঙা পথ।
ভালোবাসি সুরধোয়া নদী-নদ…
ভালোবাসি মেঘঝরা বেলাটি,
ভালোবাসি মায়াঘেরা বনটি।
শিয়ালনী শুনে বেজায় খুশি, “বাঃ! বাঃ! এ তো দারুণ কবিতা। এও তোর বানানো নাকি রে?”
সিংহালু লজ্জা পেয়ে বলল, “না না, এ আমার বানানো হতে যাবে কেন? মায়ের বন্ধু আছে, সিংহাইমাসী। এটা তার লেখা। জানেন, সিংহাইমাসীর না ইয়া অ্যাতো মোটা একটা বেগুনী রঙের কবিতার খাতা আছে। ওই বাঘুদাদার পেটের মাপের।”
শুনে বাঘু বাদে সবাই ফিকফিক করে হাসল। শিয়ালনী বিরক্তই হল, “সিংহালু, এটা তো পাঠশালা। কথা কম বলবে। তোমাকে আমি এবার অক্ষর পরিচয় করাবো। আমি যা যা বলবো, তুমি তাই তাই বলবে। একটাও কথা কম বা বেশি বলবে না। বুঝেছ?”
বলে শিয়ালনী একটা অ-আ-ক- খ’র বই বের করে সিংহালুকে দেখিয়ে বলল, “বল্, অ।”
সিংহালু সঙ্গে সঙ্গে বলল, “বল্, অ।”
শিয়ালনী বোঝানোর ভংগিতে বলল, “বল্ টা বলতে হবে না।”
সিংহালুও বোঝানোর ভংগিতে বলল, “বল্ টা বলতে হবে না।”
একটু বিরক্তই হল শিয়ালনী, “আরে, শুধু অ বলবি।”
সিংহালুর তুরন্ত উত্তর, “আরে, শুধু অ বলবি।”
শিয়ালনী অধৈর্য হয়ে বলল, “উফফ! বাবা রে বাবা!”
সিংহালুর তৎক্ষণাৎ জবাব, “উফফ! বাবা রে বাবা!”
শিয়ালনী রেগেমেগে বলল, “তুই থামবি?”
সিংহালু রাগী রাগী মুখ করে বলল, “তুই থামবি?”
শিয়ালনী তেড়েই এল, “এইটাকে নিয়ে যত হয়েছে জ্বালা!”
সিংহালু সঙ্গে সংগেই বলল, “এইটাকে নিয়ে যত হয়েছে জ্বালা!”
দাঁতমুখ খিঁচোল শিয়ালনী, “তবে রে? দেখাবো মজা?”
সিংহালু দাঁত কিড়মিড় করল, “তবে রে? দেখাবো মজা?”
শিয়ালনী হতাশ হয়ে বলল, “এ তো আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল!”
সিংহালুও হতাশ হবার ভংগি করল, “এ তো আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল!”
শিয়ালনীর চোখমুখ কেমন যেন হয়ে গেল, “আমার এবারে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।”
সিংহালু হাসি হাসি মুখেই বলল, “আমার এবারে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।”
শিয়ালনী জোরে চেঁচাল, “একদম মুখ বন্ধ। আর একটাও কথা নয়।”
সিংহালুও জোরে জোরেই বলল, “একদম মুখ বন্ধ। আর একটাও কথা নয়।”
নিরুপায় হয়ে বলল শিয়ালনী, “আমিই বরং চুপ করি।”
সিংহালু ঠোঁটে থাবা ঠেকাল, “আমিই বরং চুপ করি।”
খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। খানিকক্ষণ বিস্তর চিন্তাভাবনার পর শিয়ালনী বইয়ের লেখা দেখিয়ে সিংহালুকে বলল, “অ।”
সিংহালু সুবোধ বালিকার মত বলল, “অ”।
শিয়ালনী পরেরটায় আঙুল দিয়ে দেখাল, “আ”।
সিংহালু ভালো সিংহ ছানার মত বলল, “আ”।
যতক্ষণ সিংহালুর পড়া না শেষ হল, শিয়ালনী আর একটা বাড়তি কথাও বলল না। এদিকে হাতুশি অঙ্ক শেষ করে দেখাতে এসেছে দিদিমণিকে। শিয়ালনী উপায়ান্তর না দেখে হাতুশির খাতার একটা পাতায় লিখল- হাতুশি, তুই সিংহালুকে বলে দে যে ওর পড়া এখনকার মতো শেষ। এবারে যেন খাতায় ইচ্ছেমতন ছবি আঁকে।
হাতুশি লেখাটা পড়ে বলে বুঝিয়ে দিল সিংহালুকে। সেও অমনি খুশি খুশি মনে বাঘুর পাশে বসে খাতায় ছবি আঁকতে শুরু করে দিল।
হাতুশির পরে হিনিমিনি, ভালকি, কুমরু সক্কলেই খাতা দেখাতে গেছে দিদিমণিকে। বাঘু অংকটংক বিশেষ পারেওনি, করেনি। সে পাশে বসা সিংহালুকে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে সাধ্যমত, “বুঝলি সিংহালু, তুই ভর্তি হয়েছিস, ভালোই হয়েছে। কী জানিস, নিজের মত একটা জন্তু না হলে কথা কয়ে ঠিক সুখ পাওয়া যায় না। ওদের দ্যাখ। পড়াশুনো করে টরে দিদিমণিকে খাতা দেখাতে গেছে। আরে, পড়াশুনো করে তো আর আমরা হাতিঘোড়া হবো না। আমি বাঘ, বাঘই থাকবো। তুই সিংহ, সিংহই থাকবি। আরে ছ্যা ছ্যা। এগুলো কোন অঙ্ক হল? একটি ছাগলে যদি সাতবার ব্যা ডাকে, তাহলে পাঁচটি ছাগলে কতবার ব্যা ডাকবে? তুই-ই বল্ না, অঙ্কটা থেকে কিরকম ছাগল ছাগল গন্ধ ছাড়ছে না? তারপরে ধর্, এই অঙ্কটা। একটি মানুষের ভুঁড়ি রোজ দুই ইঞ্চি করে বাড়লে আটদিনে তার ভুঁড়ি কত ইঞ্চি বাড়বে? মানুষ- মানুষ একটা গন্ধ বেরোচ্ছে না?”
সিংহালু ফ্যাচফ্যাচ করে হেসে বলল, “তা বাঘুদাদা, শুনেছিলাম যে তুমি বেজায় ফাঁকিবাজ। তা কথাটা দেখছি সত্যি।”
বাঘু তো বেজায় দমে গেল এ কথায়। কোনমতে সামলেসুমলে নিয়ে বলল, “আরে, তুই ব্যাপারটা বুঝলি না। সব কথা তো বইতে লেখাই আছে। বইয়ের লেখাগুলো দরকারমতো দেখে নিলেই হয়। তার জন্য সময় নষ্ট করে পড়ার কী দরকার? তার চেয়ে চল, দুজনে মিলে কিছু ভালো মজা করা যাক।
মজার নামে সিংহালু ধপাস ধপাস করে বারদুয়েক লাফিয়েই নিল। “কী মজা, বাঘুদাদা।”
বাঘু বলল, “দাঁড়া, টিফিনের সময় বলবো।”
সিংহালু ক্লাসে নতুন বলে টিফিনের সময় তাকে নিয়ে একরকম হুড়োহুড়িই পড়ে গেল। সবাই এসে এসে তাকে টিফিনের ভাগ দেয়, খেলার জন্য ডাকে। বাঘু দেখল বেগতিক। সিংহালুকে এটা ওটা বলে সরিয়ে নিয়ে গেল দূরের সেই বুড়ো বটগাছটার তলায়, যেখানে বসে বাঘু একবার ঘাস খেয়েছিল।
সিংহালু একটু রাগ রাগ মুখেই বলল, “কী ব্যাপার, বাঘুদাদা, এতদূরে নিয়ে এলে কেন? হাতুশিদিদি, কুমরুদাদারা সবাই কিতকিত খেলতে ডাকছিল। কত্ত মজা হত!”
বাঘু বলল, “আরে, দাঁড়া না। কিতকিত তো কালও খেলতে পারবি।”
সিংহালু মুখ গোঁজ করল, “আরে, মা কতদিন এখানে থাকে ঠিক নেই। গুজরাটে এখন পরিযায়ী সিংহ দের ঢুকতে দিচ্ছে না কিনা, তাই মা এখানে আছে। ক’দিন থাকবে জানি না। তার মধ্যেই তো আমাকে খেলাধূলা সব সেরে নিতে হবে। তাই না?”
বাঘু তাড়াতাড়ি করে বলল, “ঠিকাছে। আমি যেটা বলছি, সেটা শুনে নে। তাহলে খুব মজা হবে। তুই এক কাজ করবি। খেলতে খেলতে এক এক করে সবাইকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবি। যেন এমনি এমনি লেগে গেছে।”
সিংহালু আপত্তি করল, “ধুস, এরকম করা কি ঠিক? ধাক্কা দিতে হয়, তুমি নিজে দাও না।”
বাঘু বলল, “আরে, আমি তো দেবই। দুজনে হলে ব্যাপারটা জমে কিনা।”
কিন্তু কিন্তু করেও সিংহালু রাজি হয়ে গেল। যাকে বলে নিমরাজি। পাঠশালার সামনের মাঠে হই হই করে খেলা চলছে ‘ছোঁয়াছুঁয়ি।’ কুমরু মোর হয়েছে আর সকলে মিলে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে- কুমরু আমাকে ছুঁতে পারে না! কুমরু আমাকে ছুঁতে পারে না!
সিংহালুকে দেখেই ওদের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল। সকলে এগিয়ে এসে সিংহালুর থাবা ধরে টানাটানি শুরু করে দিল খেলার জন্য। বাঘুও লাফিয়ে উঠল, “আমিও খেলবো তোদের সঙ্গে।”
ভালকি কোমরে দুই থাবা দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “বাঘু! তোকে তো আমরা রোজই ডাকি। তুই তো বেশির ভাগ দিনই আসিস না। তা সিংহালু এসেছে বলে আজ যদি তোর খেলতে ইচ্ছে হয়েছে, তো খেল।”
যাই হোক, খেলা শুরু হল আবার। কুমরুই মোর। খেলা জমে উঠেছে, সকলে যে যার মত ছুটছে। কুমরু ধাওয়া করেছে সিংহালুর পিছন পিছন। আর সেই সুযোগে বাঘু গিয়ে গিয়ে জোরসে এক ধাক্কা দিয়ে ভালকিকে ফেলে দিল। ভালকি কটমট করে চেয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই সময় জোর রব উঠল, ‘সিংহালু আউট! সিংহালু আউট!’
ব্যস, বাঘু ছুটল সেদিকে। ভালকিও বিশেষ কিছু বলার সুযোগ পেল না। খেলা শুরু হয়ে গেছে ওদিকে। সিংহালু দৌড়ে আসছে। খানিক বাদেই সিংহালু যখন তাড়া করেছে হাতুশিকে, সেই ফাঁকে বাঘু গিয়ে ধাঁই করে এক ধাক্কা মারল হিনিমিনিকে। হিনিমিনি টাঁই করে পড়ে গেল সংগেসংগেই। পড়ল ঠিকই, কিন্তু চটজলদি উঠেও বসল। আর বসবি তো বস, বসল একেবারে বাঘুর ঘাড়ে। বসেই বাঘুর ঘাড় জোরে চেপে ধরে বলল, “তবে রে? আমাকে ফেলে দেওয়া? চল্ এবারে আমাকে পিঠে নিয়ে। এই ঘোড়া, হ্যাট হ্যাট।”
ঘোড়া বলায় বাঘুর খুব মানে লেগেছে। কিন্তু সে মুখ খোলার আগেই এগিয়ে এসেছে ভালকি, “দাঁড়া হিনিমিনি, আমিও বাঘুর পিঠে চাপব। আমাকেও তখন ফেলে দিয়েছিল।”
ভালকিও চেপে গেল হিনিমিনির পিছনে, “অ্যাই ঘোড়া, হ্যাট! হ্যাট!”
তা বেচারি বাঘু কি আর অত ভার সইতে পারে? পড়ে গেল ধপাস করে। আর তার উপরে পড়ল হিনিমিনি আর ভালকি। অমনি শুরু হয়ে গেল বাঘুর তারস্বরে চেঁচানি, “ও দিদিমণি গোওওওও! আমাকে এরা মেরে ফেলল গোওওওও! আমাকে এসে বাঁচান গোওওও!”
শিয়ালনী এল ছুটতে ছুটতে। এসেই চোখমুখ গোল গোল করে প্রশ্ন, “কী হয়েছে? কে কাকে ফেলেছে?”
বাঘু গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়িয়ে ইনিয়েবিনিয়ে শুরু করল, “দিদিমণি, দিদিমণি গো। এই হিনিমিনি আর ভালকি আমাকে ফেলে দিয়েছে গো। খেলতে খেলতে ওরা দুজনেই আমার পিঠে চড়ে ঘোড়া হ্যাট হ্যাট বলে পিঠে চড়ে বসে গেল।
ভালকি আর হিনিমইনি সমস্বরে প্রতিবাদ জানাল, “দিদিমণি, বাঘু আমাদের খেলার সময় ইচ্ছে করে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল।”
শিয়ালনী ঘুরল সিংহালুর দিকে, “হ্যাঁ রে, সিংহালু, তুই জানিস কী হয়েছে?”
সিংহালু মাথা নাড়াল, “হ্যাঁ, দিদিমণি। সব জানি। হয়েছে কী, টিফিনের সময় বাঘুদাদা আমাকে ওদিকে নিয়ে গিয়ে বলল, খেলার সময় দুজনে মিলে বাকিদের ধাক্কা দিয়ে দিয়ে ফেলে দেব। তাতে খুব মজা হবে। তারপরে খেলা শুরু হতে বাঘুদাদা ভালকিদিদিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। আমি দেখেছি।”
হাতুশিও মুখ খুলল, “হ্যাঁ দিদিমণি, ভালকিকে বাঘু ফেলে দিয়েছিল। তারপর হিনিমিনিকেও ওই ঠ্যালা দিয়েছে। তাতে ওরা রেগেমেগে বাঘুর পিঠে চড়ে বসেছে আর বাঘু পড়ে গেছে।”
শিয়ালনী গম্ভীরমুখে মাথা দোলাল, “হুমম। যেমন কর্ম, তেমনি ফল। বাঘু বাছাধন, অনেক নাটক হয়েছে। পঞ্চাশবার লম্বাগুড়ি দিয়ে ক্লাসে এসে বোস। ভালকি আর হিনিমিনি, তোরা দুজনে পাহারা দে বাঘুকে। তারপর একসঙ্গে ক্লাসে আসবি।”
ক্লাস শুরু হল একটু বাদেই। আঁকার ক্লাস। ফলে ওদের সবারই মন খুশি খুশি। হাতুশিদের সবাইকে যেমন খুশি আঁকতে দিয়ে শিয়ালনী সিংহালুকে ডাকল, “সিংহালু, তোর স্লেট- পেনসিল নিয়ে এদিকে আয়। থাবা ধরে তোকে লেখা শেখাই।”
সিংহালু বাধ্য জন্তুর মতো গেল শিয়ালনীর কাছে। গিয়েই প্রশ্ন, “আচ্ছা দিদিমণি, আপনি যা যা বলবেন, আবার কি তাই তাই বলতে হবে আমাকে?”
শিয়ালনী আঁতকেই ওঠে আর কী, “আরে না, না। একদম না। আমি তোকে থাবা ধরে অ- আ লেখাবো, তুই দেখতে থাক কেমন করে লেখা হয়। তোর আজ থাবাখড়ি।”
বলতে না বলতেই সিংহালুর জিজ্ঞাসা, “থাবাখড়ি? সে আবার কী জিনিস, দিদিমণি?”
শিয়ালনী খুব যত্ন করে বোঝাল, “থাবাখড়ি মানে থাবায় খড়ি বা পেনসিল ছোঁয়ানো। মানে প্রথম লেখানো শেখা। মানে মানুষের যেমন হাতেখড়ি হয়, সেরকম আর কী!”
বাঘু শুনতে পেয়ে ওদিক থেকে পোঁ ধরল, “দিদিমণি, আমারও থাবাখড়ি চাই। আমাকেও থাবাখড়ি দিন।”
শিয়ালনী পেল্লায় এক ধমক দিল বাঘুকে, “বাঘু, তোর ক’বার থাবাখড়ি হবে রে? পাঠশালে ভর্তির সময় তোদের সবারই থাবাখড়ি দিয়েছি। যেটা করতে দিয়েছি, সেটা মন দিয়ে কর।”
ভালকি এদিকে একটা দারুণ ছবি এঁকে নিয়ে গেছে। একটা বিশাল বড় জামগাছের তলায় একটা ভালুক হাত পা ছড়িয়ে চোখ বুজে বসে আছে। জামগাছের নিচের ডালে একটা বিশাল বড় মৌচাক। মৌচাক থেকে ফোঁটা ফোঁটা মধু ঝরছে আর ভালুকটা হাঁ করে খাচ্ছে।
ভালকির ছবি দেখে শিয়ালনীর কি যেন মনে পড়ল। মাথাটা চুলকে নিয়ে বলল, “এই যাঃ!”
ভালকি উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “কী হল, দিদিমণি?”
শিয়ালনী বলল, “আরে, তোদের খাওয়াবো বলে বাড়ি থেকে আমসত্ত্ব আর আমের আচার বানিয়ে এনেছি। ভেবেছিলাম, টিফিনের সময় দেবো। ভুলেই গেছি।”
এই শুনে বাঘু এক লাফ দিয়ে সামনে এসে বলল, “তাতে কোন অসুবিধে নেই, দিদিমণি। আপনি দিন। নিমেষে সাবাড় করে দিচ্ছি।”
শিয়ালনী চোখ পাকাল, “থামো বাঘু। অত উপকার এক্ষুণি এক্ষুণি না করলেও চলবে। সকলে যে যার আঁকার কাজ শেষ করে নে। তারপরে সবাই মিলে খাবো। ভালোই হল, আজ সিংহালুরও থাবাখড়ি হল।”
কুমরু ফূর্তিতে থাবাতালি দিয়ে বলে উঠল, “বেশ উৎসব উৎসব হবে, না?”
হাতুশি ফস করে বলল, “সিংহালু বরণ উৎসব।”
শিয়ালনী শুনেই খুশি, “বাঃ! বেশ বললি তো রে হাতুশি! সিংহালু বরণ উৎসব।”
হাতুশি তো শুনেই ফূর্তিতে শুঁড় দোলাতে শুরু করল। সবাই আঁকার খাতা জমা দিয়ে দিল তাড়াতাড়ি। বাঘুর আঁকা দেখেই শিয়ালনীর নাকমুখ কুঁচকে গেল, “এটা কী এঁকেছিস, বাঘু?”
বাঘু বলল, “বা রে! আপনিই তো বললেন, যেমন খুশি আঁকো। তাই এঁকেছি।”
কুমরু পাশ দেখে গলা বাড়িয়ে বলল, “দিদিমণি, আমার আঁকাটা দেখুন।”
কুমরুর আঁকা দেখে তো শিয়ালনী তাজ্জব। বাঘু দাঁড়িয়ে আছে, আর তার দুই কান ধরে তার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে হিনিমিনি আর ভালকি।
বাঘু তো দেখেই কুমরুর দিকে তেড়ে আসে আর কী, “এসব কী উল্টোপাল্টা এঁকেছিস?”
কুমরু হো হো করে পেট চেপে হাসে, “আরে, তুই যখন আঁকছিলি, তখন তোর আঁকাটা আমি দেখেছিলাম। তাই আমিও এইরকম আঁকলাম।”
শিয়ালনী বলল, “চুপ! চুপ! এবারে আমরা ‘সিংহালু বরণ উৎসব’ করবো। বাঘু, কুমরু- নিজের জায়গায় গিয়ে বোস।”
বাঘু নিজের জায়গায় গিয়ে বসল বটে, কিন্তু গজগজ করতে লাগল সমানে, “দ্যাখ সিংহালু, এটা কি ঠিক হল? কুমরু কেন আমার নামে যা খুশি আঁকবে?”
সিংহালু বিশেষ পাত্তা দিল না। ওদিকে হিনিমিনি একটা বড়ো কাগজে ‘সিংহালু বরণ উৎসব’ লিখে ব্ল্যাকবোর্ডের উপর সাঁটিয়ে দিয়েছে। শিয়ালনী বলল, “চল্, আমাদের পাঠশালা সংগীতের সংগেই বরং সবাই মিলে নাচ করি। তোরা সবাই জানিস। সিংহালুও শিখে যাবে।”
ব্যস্, শুরু হয়ে গেল ঝাঁপাঝাঁপি। শিয়ালনীও নাচ করছে ওদের সবার সাথে। সঙ্গে চলছে গান-
বুনো বুনো গন্ধ
গানেরই ছন্দ-
কচি কচি পশুদের মেলা…
মোদের এই পাঠশালা।।
বনের এই কোণেতে
আলো- ছায়া মেশাতে
হইহই যত খুশি খেলা…
মোদের এই পাঠশালা।।
রঙ ভরা মন নিয়ে
লিখি পড়ি দিল দিয়ে,
আসা চাই সকালবেলা…
মোদের এই পাঠশালা।।
মনের সুখে নাচ গান চলল বেশ অনেকক্ষণ। নাচ গান শেষ হতে না হতেই বাঘু গিয়ে বলল, “ও দিদিমণি, তাহলে এবার আমসত্ত্ব আর আচার…”।
শিয়ালনী হালকা করে এক ধমক দিল, “পেটুকদাস কোথাকারের! দাঁড়া, আর একটু। হ্যাঁ রে, তোরা কেউ সিংহালুকে কিছু বলতে চাস?”
হাতুশি উঠে দাঁড়াল, “দিদিমণি, আমি কিছু বলি। সাধুভাষায় না চলিতভাষায়?”
শিয়ালনী বলল, “তোর যা খুশি।”
হাতুশি শুঁড় নাড়াল, “তাহলে সাধুভাষাতেই বলি। ওতেই জমে ভালো।” বলেই শুরু করল-
“হে সিংহালু, তুমি আলু খাও কিনা তাহা আমাদের জানা নাই। কিন্তু তুমি যে মুখে মুখে ভাল কবিতা বানাইতে পার, তাহার প্রমাণ আমরা পাইয়াছি। আশা রাখি, খুব তাড়াতাড়িই তোমাকে আমরা কাঁধে ঝোলা লইয়া বার্ষিক জানোয়ার সভায় কবিতাপাঠ করিতে শুনিব। তথাপি তোমাকে দুই চারিটি কথা বলি। আমাদের দিদিমণির নিকট মন দিয়া শিক্ষালাভ করিলে তুমি আরও উত্তম কবিতা বানাইতে পারিবে। মানুষেরা কী ভাবে? তাহাদের একটিও লেজ নাই, তথাপি তাহারা নিজেদের অত্যন্ত চালাক ভাবে। অতই যদি চালাক, তাহা হইলে বৃক্ষ নিধন করে কেন? মানুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধেও তুমি কবিতা বানাইবে আশা রাখি। আর একটি কথা। আমাদের পাঠশালায় আমরা সকলে মিলিয়া মিশিয়া থাকি। তুমিও আমাদের সহিত মিলিয়া মিশিয়া থাকিবে, আশা রাখি। যদিও তোমার বাঘুদাদা কিঞ্চিৎ দুষ্টামি করে। সেরকম কিছু হইলে বলিও। আমরা উহার কান মুলিয়া দিব। যাহাই হউক, তুমি ভাল থাকো। মন দিয়া পড়াশুনা কর। তোমার লেজের শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি।”
এই বলেই হাতুশি বসে পড়ল। সকলে মিলে হাততালি দিল চটাপট চটাপট। শিয়ালনী হাঁক দিল, “ব্যস! এবারে খাওয়াদাওয়া। কুমরু, ভালকি- এগিয়ে আয়। শালপাতার বাটি আছে। বাটিতে করে সবার থাবায় থাবায় দিয়ে আয়। ”
ব্যস, খাওয়াদাওয়া হল জোরদার। বাঘুর ইচ্ছে ছিল, কুমরুর ভাগের থেকে খানিকটা সরায়, কিন্তু বিশেষ সুবিধে করতে পারল না। উপরন্তু ভালকি শালপাতার খালি ঠোঙাগুলো বাঘুর মাথায় টুপির মত পরিয়ে বলল, “ওঁ আমসত্ত্বং স্বাহা, ওঁ আচারং স্বাহা!”
বাঘু চটল বেজায়, কিন্তু কিছু বলার আগেই দিদিমণি ফেরত এলেন। আর এসেই বললেন, “নে, এবার তোদের ছুটি।”
যেই না বলা, অমনি সিংহালু থলেটলে গুছিয়ে এক লাফে চড়ে বসল বাঘুর পিঠে। তাই না দেখে হাতুশি- হিনিমিনি- ভালকি- কুমরুর সে কী হাসি! বাঘুর তো মানে লাগল বেজায়। চোখ মুখ লাল করে বলল, “এসব কী হচ্ছে,সিংহালু?”
সিংহালু উত্তর দিল, “কী হচ্ছে, শুনবি? শোন্ তবে। –
চল্ রে ঘোড়া হ্যাট হ্যাট!
তাকাস কেন প্যাট প্যাট?
তুই হলি দাদা মোর-
পায়ে আছে বেজায় জোর।
চল্ রে দাদা গড়গড়িয়ে-
বাড়ি দিবি পৌঁছিয়ে।
হেই দাদা তোর কাঁধে ধরি-
তাড়াতাড়ি চল্ রে বাড়ি।।”
হতভম্ব বাঘুর মুখ দিয়ে একটাই কথা বেরোল, “অ্যাঁ?”
……০……
অংকনঃ গুঞ্জা
বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি পড়ুন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করেঃ-