(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে পাঠশালার খবর ভেসে আসে মাঝেমধ্যে। এলেই তোমাদের জানাতে থাকবো। পাঠশালাটা কোথায় জানো? বনের ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে প্রচুর গাছপালা মিলে মাথার উপরে একটা চাঁদোয়ার মত বানিয়েছে, আর দুটো সেগুনগাছের ইয়া মোটা মোটা গুঁড়ি দুদিক থেকে এসে একটা দরজার মতো তৈরি হয়েছে। জঙ্গলের যত ছানাপোনা জন্তুজানোয়ার, সবাই আজকাল সক্কালবেলা হলেই হাতমুখ ধুয়ে চাট্টি মুড়ি খেয়ে ওখানেই পড়তে যায়। তাদের মধ্যে আছে বাঘিনীর বাচ্চা ছেলে বাঘু, হাতির বাচ্চা মেয়ে হাতুশি আর হনুমানের ছানা মেয়ে হিনিমিনি। এছাড়াও আছে ভালুকের পুঁচকি মেয়ে ভালকি আর কুমীরের বাচ্চা ছেলে কুমরু।)
চৈত্রমাস প্রায় শেষের দিকে। বাতাসে হালকা আগুনে আঁচ। শীতের রোদের মতো অমন মিঠে না হলেও সয়ে যায়। তবে থেকে থেকে মন জুড়োনো দখিনা হাওয়া যেন আঁচলে ঢেউ তুলে নেচে বেড়াচ্ছে জঙ্গলের আনাচকানাচে। বনের গাছপালাদেরও সবুজ রঙের নতুন নতুন জামা পরে ভারি আহ্লাদ। খুশিতে মাথা ঝাঁকিয়ে এ যদি বলে- আমায় দ্যাখ, তো ও বলে- আমায় দ্যাখ! শিয়ালনী অবশ্য এই হাওয়াকে বলে, ‘মলয় সমীরণ’।
বাঘু তো প্রথমদিন শুনেই হেসে লুটোপুটি। “দিদিমণি, আজ বিকেলে মলয় সমীরণ খেতে যাবো। ওরে হাতুশি, হিনিমিনি, ‘মলয় সমীরণ’ খেয়ে পেট ভরা না রে! তোদের টিফিনটার নাহয় আমিই দায়িত্ব নিচ্ছি।”
শিয়ালনীর এক দাবড়ানিতে বাঘু তখনকার মতো চুপ করেছিল। তা এখন শিয়ালনী নামতা লিখতে দিয়েছে সবাইকে। একদম শেষের ক্লাস রোজদিনই এখন নামতার। বাঘু খানিকক্ষণ পেনসিল মুখে দিয়ে কুটকুট করে কামড়াবার চেষ্টা করল। তারপর মুখ দিয়ে ফেলে দিল। ধুস, ভালো খেতে না। কিরকম তেতো তেতো। এরপর বাঘু খানিকক্ষণ থাবা দিয়ে লেজ চুলকোল, তারপর লেজখানাকে পাকিয়ে কানে রাখার চেষ্টা করল। খানিক বাদে একবার আড়মোড়া ভেঙে হা-ই-ই করে হাই তোলারও চেষ্টা করল। শেষটায় উবু হয়ে বসে কাগজের গোল্লা পাকাতে শুরু করে দিল।
বাঘুর পাশে বসেছিল ভালকি। সে মন দিয়ে লিখছিল। বাঘুর উৎপাতে তার অনেকক্ষণ ধরেই বিরক্ত লাগছিল বেজায়। এবারে এক দাবড়ানি দিল বাঘুকে, “বাঘু, চুপচাপ বসে নামতা লেখার চেষ্টা কর। একটুও তো পড়ছিস না।”
বাঘু বলল, “ভালকি, একটু বলে দে না রে। তাহলে আর কক্ষণো তোর মধু ছাড়িয়ে খাবো না।”
ভালকি ঠোঁট উল্টে বলল, “সে তোকে এমনিতেও খেতে হবে না। আমি এখন ভালুক্সিং শিখছি। অ্যায়সান প্যাঁচ কষবো না, তুই একেবারে ছাতু হয়ে যাবি। মা বলেছে, পরের মাস থেকে ভ্যালাটেও শেখাবে।”
বাঘু খুব ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ভালুক্সিং, ভ্যালাটে- এসব আবার কী রে?”
ভালকি মিটিমিটি হাসল, “ভালুক্সিং কী জানিস না? মানুষেরা যেমন বক্সিং শেখে, সেরকম। আর ভ্যালাটে হল ওদের ক্যারাটের মতন। মানুষের দেওয়া নাম আমরা নিই না। কেমন একটা মানুষ মানুষ গন্ধ ছাড়ে কিনা।”
শুনেটুনে বাঘুর মুখ তো পুরো ওলকপির মতো হয়ে গেল। এদিকে শিয়ালনী এক হাঁক ছেড়েছে, “তাড়াতাড়ি খাতা জমা দে। আর মাত্র পাঁচ মিনিট।”
বাধ্য হয়েই বাঘু কাকুতি মিনতি করল, “ভালকি, একটা অন্ততঃ বলে দে। এই সাত পাঁচে গুণটা।”
ভালকি লিখতে লিখতেই উত্তর দিল, “তিরিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। বাকিটা তুই নিজে কর। তোকে বলে দিলে তুই নিজে আর কোনদিনই পড়বি না।”
“ভালকি! ভালকি রে! বল না। তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে কিনা অন্ততঃ বল।”
“হ্যাঁ, তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যেই।”, বলে ভালকি উঠে খাতা জমা দিতে চলে গেল।
বেচারি বাঘু আর কী করে? যেমন যা পারল লিখে একটু পরে খাতা জমা দিয়ে এল।
শিয়ালনী খাতা দেখতে শুরু করেছে একটু পরে। সকলের খাতা দেখার শেষে এল বাঘুর খাতা। খাতা দেখে শিয়ালনী তো রেগে কাঁই, “বাঘুউউ। বাঘুউউউউ! বলি, এসব কী হচ্ছে? একে তো একটা মোটে করেছিস, তাও আবার এত কাণ্ড? সাত আর পাঁচে গুণ করতে দিয়েছি; তুই একত্রিশ, বত্রিশ, তেত্রিশ, চৌত্রিশ, পঁয়ত্রিশ সব লিখে বসে আছিস কেন রে হতভাগা? ইয়ার্কি হচ্ছে? ইয়ার্কি?”
বাঘু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দিদিমণি, সবকটাই আমি লিখে দিলাম। আপনার যেটা পছন্দ সেটা রেখে বাকিগুলো বাদ দিলেই হয়। অত রাগ করার কী আছে?”
“মানে, তুই আমাকে শেখাতে আসছিস? যা, তুই সাত পাঁচে পঁয়ত্রিশ বার লম্বাগুড়ি দিবি যা। আর শুনে রাখ। কাল আমি আরও অনেক নামতা দেব। সব উত্তর করবি কিন্তু। না পারলে কিন্তু কাল অনেক লম্বাগুড়ি দিতে হবে। হাতুশি, তুই গুনবি যা বাঘু ঠিকঠাক লম্বাগুড়ি দিচ্ছে কিনা।”
মানুষেরা যেমন হামাগুড়ি দেয়, জন্তুজানোয়ারেরা সেরকম দেয় লম্বাগুড়ি। বাঘু পিছনের দুটো পায়ে ভর দিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে সামনের থাবাদুটো জড়ো করে লম্বাগুড়ি দিতে চলে গেল। পিছন পিছন গেল হাতুশি।
সেদিকে তাকিয়ে ভু-উ-উ-স্ করে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ল শিয়ালনী, “কী যে করি বাঘুটাকে নিয়ে? এতো করেও নামতা শেখাতে পারছি না! কী যে হবে?”
হিনিমিনি সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল দিদিমণিকে, “দিদিমণি, আপনি মনখারাপ করবেন না। আগে তো বাঘু পুরো সাদা খাতাই জমা দিত! এখন তাও চেষ্টা করে!”
সেকথা শুনে ভালকি আর কুমরুর খিকখিক করে সে কী হাসি! তাই না দেখে শিয়ালনী চোখ পাকিয়ে পেল্লায় এক ধমক দিল, “চোপ! বাঘু কী করেছিল, সে কথায় আর কাজ নেই। তোরা মন দিয়ে এখন মুখস্থ কর।”
দিদিমণির বকা খেয়ে ওরা তো নামতা পড়তে শুরু করে দিল। আর সামনের মাঠে হাতুশি তখন বাঘুর লম্বাগুড়ি গুনে যাচ্ছে, “দশ, এগারো, বারো…”।
পরের দিন । টিফিনের পর শিয়ালনী নামতা লিখতে দিয়েছে ওদের সবাইকে। বাঘু যথারীতি কিচ্ছুটি পড়েটড়ে আসেনি। আর তারপর সকালেই বাড়িতে শুনে এসেছে, বাঘিপিসী দু’চারদিনের মধ্যে এলেও আসতে পারে। ফলে বাঘুর আরও তালগোল পাকিয়ে গেছে। বাঘু প্রথমে বিস্তর গা চুলকোল, তারপর থাবা চুলকোল, তারপর লেজ চুলকোল। কিছুতেই কিছু হল না। কিছুতেই কিছু হল না দেখে বাঘু ফিসফিসিয়ে পাশে বসা কুমরুকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে, আট আর ছয়ে গুণ করলে কত যেন হয় বেশ?” উত্তরে কুমরু দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “গাধা!” বাঘুও তার খাতায় লিখল, ৮×৬= গাধা।
তার পরের গুণ, পাঁচ গুণিত পাঁচ। বাঘু সেই কুমরুকে প্রশ্ন করল, “এইটা কত হবে রে? পাঁচ গুণ পাঁচ?”
কুমরু খুব মন দিয়ে গুণগুলো করছিল। খাতা থেকে চোখ না তুলেই বলল, “ছাগল কোথাকার!”বাঘু চটপট নিজের খাতায় উত্তর লিখল, ৫×৫= ছাগল কোথাকার!
পরপর দুখানা উত্তর লিখতে পেরে বাঘুর আত্মবিশ্বাসই বেড়ে গেছে। আবার সেই কুমরুকেই জিজ্ঞেস করল, “আর এইটা? তিন গুণ ছয়?”
কুমরুও ঝাঁঝিয়ে উঠল, “আর পারিনা! বাবা রে বাবা!” বাঘুও সঙ্গে সঙ্গেই খাতায় লিখল, ৩×৬= আর পারিনা! বাবা রে বাবা!
একটু পরেই বাঘু ফের ফিসফিস করল, “ওরে কুমরু! কুমরু রে! এইটা একটু বল না রে! এই যে, সাত গুণ আট?”
কুমরু তেড়েই এল, “জ্বালাবি না বলে দিলাম।” বাঘু সঙ্গে সঙ্গে খাতায় লিখল, ৭×৮= জ্বালাবি না বলে দিলাম!
এর পরের গুণ- নয় গুণিত ছয়। কিন্তু কুমরুকে ডেকেও আর কোন সাড়াই পেল না বাঘু। সে পড়ল মহা ফ্যাসাদে। বাধ্য হয়ে একটু দূরে থাকা হিনিমিনিকেই জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে হিনিমিনি, নয় আর ছয়ে গুণ করলে কত যেন বেশ হয়?”
হিনিমিনি খুব মন দিয়ে কী একটা লিখছিল। ভালো করে না শুনেই বলল, “নয়ছয়।” বাঘু পেনসিল বাগিয়ে খসখস করে লিখল, ৯×৬= নয়ছয়।
তারপরেই আবার বাঘুর খোঁচা হিনিমিনিকে, “বল্ না রে, পাঁচকে চার দিয়ে গুণ করলে কত হয়?”
হিনিমিনি দাঁত খিঁচিয়ে এল, “কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দেব।” বাঘু তার খাতায় যথাসম্ভব সুন্দর করে লিখল, ৫×৪= কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দেব।
তার পরের গুণ ছিল আট গুণিত দুই। বাঘু এবারে জিজ্ঞেস করল ভালকিকে, “এইটা একটু বলে দে না রে!”
ভালকির নিজের তখন একটা নামতা কিছুতেই মনে পড়ছিল না বলে এমনিতেই মন মেজাজ খারাপ হয়ে ছিল। বাঘুর প্রশ্নে তাই তেরিয়া ভঙ্গিতেই উত্তর দিল, “দিদিমণিকে জিজ্ঞেস করবি যা না!” বাঘু খুচখুচ করে খাতায় লিখল, ৮×২= দিদিমণিকে জিজ্ঞেস করবি যা না!
আর মোটে একটাই বাকি। দশ গুণিত দশ। বাঘু ভাবল, হাতুশিকে একটাও জিজ্ঞেস করা হয়নি, ওর যদি আবার মন খারাপ হয়! তাই ভেবে হাতুশিকেই জিজ্ঞেস করল, “হাতুশি রে, শেষেরটা তুইই বলে দে বরং। এই যে, দশ আর দশ।”
হাতুশির ততক্ষণে সব শেষ। উত্তরগুলো মেলাচ্ছিল। হঠাৎ করে ঘাবড়ে গিয়ে শুঁড় বাগিয়ে বলল, “ভাগ্ হিঁয়াসে।” বাঘুও গুছিয়ে তার খাতায় লিখল, ১০×১০= ভাগ্ হিঁয়াসে!
ব্যস্! খুশি খুশি মনে বাঘু তো খাতা জমা দিয়ে এল। খানিকক্ষণ পর শিয়ালনী খাতা দেখাও শুরু করল। শিয়ালনী খাতা দেখতে হলে আজকাল বাঘুর খাতাটাই শেষের জন্য রাখে। কারণ, বাঘুর খাতা দেখতে শুরু করলে এমন মাথা ঝিমঝিম, লেজ টিমটিম শুরু করে যে বাকি খাতাগুলো দেখাই কষ্টকর হয়ে ওঠে।
যাইহোক, সবার শেষে বাঘুর খাতার পাতা উল্টিয়েই তো শিয়ালনীর আক্কেল গুড়ুম! সেখানে লেখা আছে-
৮×৬=গাধা।
৫×৫= ছাগল কোথাকার!
৩×৬= আর পারিনা! বাবা রে বাবা!
৭×৮= জ্বালাবি না বলে দিলাম!
৯×৬= নয়ছয়।
৫×৪= কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দেব।
৮×২=দিদিমণিকে জিজ্ঞেস করবি যা না!
১০×১০= ভাগ্ হিঁয়াসে!
শিয়ালনী তো উত্তর পড়ে কেমন যেন হয়ে গেল! চোখদুটো প্রায় কপালে উঠে গেল, চশমাটা নেমে এসে মুখের সামনে ঝুলতে থাকল, নাক দিয়ে অদ্ভুত একটা বোঁ বোঁ আওয়াজ হতে থাকল, আর লেজখানা নাগরদোলার মতো পাঁইপাঁই করে ঘুরতে থাকল তো ঘুরতেই থাকল।
ভালকি চট করে গিয়ে ধরে ফেলেছে দিদিমণিকে। নাহলে শিয়ালনী হয়তো পড়েই যেত। হাতুশি, হিনিমিনি আর কুমরুও দৌড়ে গেছে। কুমরুর সারা গায়ে কাঁটা কিনা, তাই দিদিমণিকে ধরতে বিশেষ সাহস পাচ্ছে না। পাছে দিদিমণির লেগে যায়! হাতুশি মোলায়েম করে শুঁড় বুলিয়ে দিচ্ছে দিদিমণির গায়ে। হিনিমিনি হাঁটু গেড়ে বসেছে দিদিমণির সামনে আর বলেই যাচ্ছে, “ও দিদিমণি! দিদিমণি ! কী হল, দিদিমণি? এরকম করছেন কেন, দিদিমণি?”
বাঘুও এগিয়ে এসেছে, “দিদিমণি, বেশ তো খাতা দেখছিলেন আপনি? হঠাৎ আবার কী হল?”
উত্তরে শিয়ালনী ও-হোহো-হো করে বেজায় এক ডাক ছুঁড়ে কাঁদতে শুরু করে দিল। তার দু’চোখ দিয়ে জল ঝরে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। হাতুশি চাইল হিনিমিনির দিকে, “হিনিমিনি রে, তোর সেই ‘রম্ভা রস’টা আছে? থাকলে দিদিমণিকে একটু খাইয়ে দে না!”
হিনিমিনি জিভ কেটে বলল, “এই যা! ভুলেই গিয়েছিলাম।” বলে তাড়াতাড়ি করে তার কলাপাতার থলেটা খুলে একটা বোতল বের করে নিয়ে এল। ভালকি আর কুমরু মিলে দিদিমণির ঠোঁট ফাঁক করে ধরল আর হিনিমিনি তাড়াতাড়ি করে খানিকটা ‘রম্ভা রস’ খাইয়ে দিল দিদিমণিকে।
‘রম্ভা রস’ বস্তুটা খুব কাজের। হিনিমিনি আজকাল তার থলেতে ‘রম্ভা রসে’র একটা বোতল রেখেই দেয়। কখন কাজে লাগে বলা তো যায় না! হিনিমিনির দিদার বানানো আসল মর্তমান কলায় তৈরি।
তা ‘রম্ভা রস’ খেয়ে একটু পরেই খানিকটা চাঙ্গা হয়ে উঠল দিদিমণি। হাতুশি খুব উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছিল দিদিমণি?”
শিয়ালনী উঁহুঁ হুঁ হুঁ করে একচোট বিলাপ করে নিয়েই অকস্মাৎ গলা তুলল, “আরে, ওই যে বাঘু! ওকেই জিজ্ঞেস কর না কী লিখেছে?”
বাঘু নিতান্ত ভালোবাঘের মতো মুখ করে বলল, “আমি? আমি তো কিছুই করিনি দিদিমণি। আমি তো খালি নামতা লিখেছি!”
“নামতা? ওকে নামতা বলে? পাঁচ আর চারের গুণফল, কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দেব? দশ আর দশের গুণফল ভাগ্ হিঁয়াসে? ও হো হো হো! আমার বরাতে এই ছিল? এত খেটেখুটেও তোদের জানোয়ারের মতো জানোয়ার বানাতে পারলাম না রে! ও হো হো হো!”
শিয়ালনী ফের ফুচ ফুচ করে কাঁদতে শুরু করে দিল। তাই দেখে কুমরুরও চোখে জল এসে গেল। দেখেশুনে হিনিমিনি ‘রম্ভা রস’ বের করে খাওয়াতে শুরু করেছে দিদিমণিকে। এদিকে হাতুশি রেগেমেগে বাঘুর ওপর চোটপাট শুরু করেছে, “বাঘু! কেমন জন্তু তুই? কোন আক্কেল নেই?”
বাঘু দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, “কেন, তুই-ই তো আমাকে বললি, দশ আর দশে ভাগ্ হিঁয়াসে হয়? তুই যদি আমাকে ভুল বলিস, তার দায় কি আমার?”
হাতুশি অবাক হয়ে গালে শুঁড় ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি আবার কখন তোকে বললাম?”
বাঘু তার সামনের ডানপায়ের থাবা ছুঁড়ে বলল, “সে কী? বলিসনি? মিছে কথা বলিস নি হাতুশি। মুখে গোবরপচা পড়ে যাবে। আমি তোকে জিজ্ঞেস করলাম না, দশ আর দশে কত হয়? তার উত্তরে তুই আমাকে বলিসনি, ভাগ্ হিঁয়াসে?”
এতক্ষণে হাতুশির মনে পড়ল। সে বলল, “ও, তখন আমি মন দিয়ে উত্তরগুলো মেলাচ্ছিলাম। তাই হয়তো বলেছি তুই যাতে না জ্বালাস। তাই বলে তুই ওটাকেই উত্তর বলে ভেবে নিবি? কিছুই কি পড়িস না?”
শিয়ালনী এদিকে ‘রম্ভা রস’ খেয়ে খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে। জোরালো গলায় হাঁক দিল শিয়ালনী, “বাঘু! বাঘুউউউউ! তুই যা। এখুনি বাইরে গিয়ে লম্বাগুড়ি দিবি যা। দিয়েই যাবি, দিয়েই যাবি যতক্ষণ না আমি ডাকি। আজ তুই পাঁচশ বার লম্বাগুড়ি দিবি, বুঝলি? হাতুশি, তুই বাঘুর তদারকি করবি যা। আর হ্যাঁ, বাঘু বাছাধন, পরশুদিন কিন্তু আমি নামতা আবার লিখতে দেব। নম্বরও দেব। সেদিন যদি না পেরেছিস কী ভুলভাল লিখেছিস, তাহলে কিন্তু হাজার বার লম্বাগুড়ি দিতে হবে। বলে রাখলাম। নো চালাকি! নো কায়দাবাজি!”
বাঘু তো মুখচোখ গোঁজ করে লেজ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চলে গেল। পেছন পেছন লাফাতে লাফাতে গেল হাতুশি।
পরের দিন। ভালকি সকালে পাঠশালায় এসে দেখে বাঘু আগেই এসে সামনের মাঠে একমনে লম্বাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছে। ভালকি তো হতবাক। কোনমতে বাঘুকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে, তুই এখন লম্বাগুড়ি দিচ্ছিস কেন? তোকে এখন নিশ্চয়ই দিদিমণি লম্বাগুড়ি দিতে বলেননি?”
বাঘু লম্বাগুড়ি দিতে দিতেই জবাব দিল, “কী জানিস, নামতা তো পারবোই না। আর তাহলে হাজারবার লম্বাগুড়ি দিতেই হবে। তাই প্র্যাকটিস করছি আর কী! তাহলে তখন কষ্টটা কম হবে।”
ভালকি আপত্তি করল, “তা কেন? ভালো করে পড়লেই তো পারিস।”
বাঘু ঠোঁট ওল্টাল, “ধুস! ওসব পড়াটড়া আমার দ্বারা হয় না। কাল পড়তে বসলাম। নাক ডাকা পেয়ে গেল।”
ভালকি শুনে চটেই গেল, “তাহলে তোর যা ভালো মনে হয় কর। কাল তো দিদিমণি নামতায় নম্বরও দেবেন। পড়াটা করে নিলে ভালোই করতিস বাঘু।”
তা বাঘুর ওসব ভালো কথা শুনতে বয়েই গেছে। বাঘু আর ভালকির দিকে তাকালও না, কথাও বলল না।
ধীরে ধীরে বাকিরা এসে পড়ল, দিদিমণিও এলেন। প্রার্থনার পর ক্লাস শুরু হয়ে গেল যথারীতি।
টিফিনের আগের ক্লাসে ‘সবুজ পাঠে’র প্রশ্নোত্তর বোর্ডে লিখে দিচ্ছে শিয়ালনী। সকলেই একমনে লিখছে, খালি বাঘু একমনে হাতুশি আর হিনিমিনির পিছনে বসে তাদের লেজে গিঁট বাঁধছে। বাঘুর খুব রাগ হয়েছে হাতুশির ওপর। আগের দিন একে হাতুশির সঙ্গে নামতা নিয়ে কথা কাটাকাটি হল আর তারপরে বাঘু একশ তিরিশটা লম্বাগুড়ি দিয়ে থেমে গিয়েছিল। হাতুশিকে বাঘু কত করে বলেছিল, তুই দিদিমণিকে গিয়ে বল না, আমি পাঁচশখানা লম্বাগুড়ি দিয়েছি, কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হল না। বাঘু আরও বলেছিল, চল্, দুজনে মিলে চুপচাপ বসে থাকি নইলে দুজনেই খেলি! কিন্তু তাতেও সে কিছুতেই রাজি হল না। তার সাফ কথা, দিদিমণি আমাকে বিশ্বাস করেন। আমি সেটা ভাঙতে পারবো না।
বাঘুর তাই ভয়ানক রাগ হয়েছে হাতুশির উপর। ওদের দুজনের লেজে গিঁট বাঁধা হয়ে গেলে বাঘু বোর্ডের লেখা যেমন পারে টুকল আর তারপর তাড়াতাড়ি করে গিয়ে খাতা জমা দিয়ে এল। এদিকে হাতুশি খাতা জমা দিতে যাবে বলে উঠতে গেছে আর উঠতে গিয়ে লেজে লেগেছে এক টান। তাই দেখে হিনিমিনিও উঠতে গেল আর লেজে টান লেগে দুজনেই ধপাস করে ফের মাটিতে পড়ে গেল।
কুমরু আর ভালকি তাড়াতাড়ি করে এসে লেজের গিঁট খুলে দিল বলে রক্ষে। শিয়ালনী সবই দেখেছে। গমগমে গলায় ডাকল, “বাঘু! বাঘুউউউউ! এ নিশ্চয়ই তোর কাজ?”
বাঘু মাথা চুলকে টুলকে বলল, “কিন্তু দিদিমণি, আমি করলাম কখন? আমি তো দেখুন সব পড়া টুকে খাতা জমা দিয়েছি।”
“তুই কখন করেছিস জানি না, কিন্তু এ কাজ তুই ছাড়া আর কার হবে? নে, কান ধরে ওঠবোস কর দশবার। নিজের কান ধরবি। ডান হাতে ডান কান, বাঁ হাতে বাঁ কান।”
বাঘু বেচারি কান ধরে ওঠবোস তো শুরু করল আর বাকি পশুয়ারা তো মুখে হাত চাপা দিয়ে ফিকফিক করে হাসতে শুরু করে দিল।
টিফিনের সময় হাতুশি একটা ছোটো কলাগাছ শুঁড়ে জড়িয়ে চিবোতে চিবোতেই বলল হিনিমিনিকে, “বুঝলি রে, বাঘুকে এবার কিঞ্চিৎ কায়দা না করলেই নয়। বড্ডো জ্বালাচ্ছে!”
হিনিমিনি একটা কলার রসগোল্লা খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করল, “কিছু কি ভেবেছিস?”
“হ্যাঁ রে। একটা উপায় ভেবেছি।”
“বল্, শুনি। মাথাটা কাছে আন, বলছি।”
হিনিমিনি তো মাথাটা এগিয়ে আনল হাতুশির কাছে। দুজনে মিলে ফিসফিস করে অনেকক্ষণ আলাপ আলোচনা চালাল। ওদের কথাও শেষ হয়েছে, এমন সময় বাঘু এসে দুজনের মাথা ঠকাস ঠাঁই করে ঠুকে দিয়ে পালাল। হাতুশি মাথায় শুঁড় বুলোচ্ছে। হিনিমিনি বাঘুর দিকে চেয়ে দাঁত কিচমিচ করে বলল, “তুই আয় কালকে। তোর হচ্ছে।”
পরের দিন। প্রার্থনার পর সবাই বসেছে ক্লাসে। হাতুশি আর হিনিমিনি বাঘুর বেশ কাছাকাছিই বসেছে। একটু পরেই হাতুশি শুঁড় তুলল, “হ্যাঁ রে, হিনিমিনি, কাল তোকে যেটা আনতে বলেছিলাম, সেটা এনেছিস?”
হিনিমিনি চাপাস্বরে বলল, “দাঁড়া দিচ্ছি। কাউকে দেখাস না কিন্তু।”
বলতে বলতে হিনিমিনি ব্যাগ থেকে একটা মাদুলির মতো কী যেন বের করে আনল। একটা লাল সুতোয় বাঁধা গুটলি পাকানো কাগজের মতো কী একটা জিনিস। বাঘু তো এদিকে সবই আড়চোখে লক্ষ্য করছে। হাতুশি মাদুলির মতো জিনিসটা মাথায় একবার ঠেকিয়ে বলল, “জয় বাবা!” আর তারপরে নিজের মনেই স্বগতোক্তি করল, “যাক্ বাবা! আর নামতার পরীক্ষা নিয়ে কোন ভয় নেই!”
শুনেটুনে বাঘুর চোখ তো দইবড়ার মতো হয়ে উঠল। এরা বলে কী? তাহলে হাতুশি যে পরীক্ষায় এত এত নম্বর পায়, সব ওই মাদুলি না কিসের যেন কারসাজি? হ্যাঁ, ওরকম একটা জিনিস পেলে তো বাঘুর আর আজের পরীক্ষা নিয়ে কোন চিন্তাই নেই!
হিনিমিনি এদিকে হাতুশিকে বলছে, “শোন্, এখন নাহয় তুই থলেতে রেখে দে। টিফিনের সময় ওটা আমি তোকে পরিয়ে দেব’খন।”
ব্যস, বাঘু শুনে নিল যা শোনার। যাইহোক, এসবের মধ্যেই শিয়ালনী দিদিমণিও এসে পড়েছেন। ক্লাসও ওদের শুরু হয়ে গেল।
টিফিনের সময় খাওয়াদাওয়ার শেষে হিনিমিনি হাতুশিকে সেই মাদুলির মতো জিনিসটা পরাতে যাচ্ছে, বাঘু এসে হাজির। এসেই প্রশ্ন, “হিনিমিনি, ওটা কী জিনিস রে?”
হিনিমিনি তাড়াতাড়ি করে সরিয়ে নিতে গেল, “না রে, ওটা কিছু নয়। এই অমনি।”
“অমনি বললে তো শুনবো না। ওটা কী বলতে হবে তোদের। নইলে দিদিমণিকে বলে দেব।”
হাতুশি যেন খুব ভয় পেয়েছে এইভাবে বলল, “হিনিমিনি, বাঘুকে বলেই দে বরং। নইলে যদি আবার দিদিমণিকে বলে দেয়?”
হিনিমিনি মোড়কটা বাঘুকে দেখিয়ে বলল, “এটা বাবাদুলি।”
“বাবাদুলি?”, বাঘুর চোখ তো পুরো চমচমের মতো হয়ে গেল, “সে আবার কী বস্তু?”
“আরে চুপ চুপ! হাতুশি ঠোঁটে শুঁড় ঠেকাল, “সবাই শুনতে পেলে মুশকিল হয়ে যাবে!”
হিনিমিনি মুখ খুলল, “এটা মাদুলির মতোই একরকম জিনিস। মাদুলিতে যে কাজগুলো হয় না, সেগুলো বাবাদুলিতে হয়। এটা নামতাতে বা অন্য পরীক্ষায় দারুণ কাজে দেয়।”
“বলিস কী রে?”, বলতে বলতেই বাঘু খপ করে তুলে নিয়েছে সুতোয় বাঁধা মোড়কটা, “এটা বরং আমিই নিই। তোরা তো পড়াশুনা করিস, তোদের লাগবে না।”
“আরে শোন্ না বাঘু, আজের দিনটা ছেড়ে দে। আজ আমার মোটে ভালো পড়া হয়নি। আমি কত করে বলে হিনিমিনিকে দিয়ে আনালাম।”
হিনিমিনি ফোঁস করে উঠল, “আরে, আনা কি অতই সহজ? বাবাদুলি তো বাড়ির বাবাকেই বানাতে হয়। তা বাবাকে বলাতে বাবার সে কত প্রশ্ন! কত যে ভুজুং ভাজুং দিতে হল!”
বাঘু ছাড়বার পাত্র নয়, “সে তুই যা করেছিস করেছিস। এখন এটা আমি নিচ্ছি। আর আমাকে না দিলে আমি দিদিমণিকে গিয়ে বলে দেব তোরা বাবাদুলির কারবার করিস!”
এ কথায় হাতুশি শুঁড়খানা দুলিয়ে ভয়ের সুরে বলল, “না না বাঘু! বলিস না। দিদিমণি আমায় খারাপ ভাববেন। বলিস না, দ্যাখ।”
বাঘু খুব গম্ভীর চালে মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে নে। ক্ষমা করে দিলাম।”
তারপরেই বাঘুর হুকুম হিনিমিনিকে, “নে, এবারে এটা কোথায় বাঁধতে হয় বেঁধে দে দিকিনি।”
হিনিমিনি তো খুব যত্নের সঙ্গে বেঁধে দিল বাঘুর পিছনের বাম দিকের থাবায়, “এটাই নিয়ম। পিছনের বামদিকের থাবায় বাঁধাটা।”
বাঘু তেরছা চোখে চাইল হিনিমিনির দিকে, “আবার কোন গণ্ডগোল হবে না তো?”
হাতুশি তাড়াতাড়ি করে বলল, “হিনিমিনি, বাঘুকে ওটা দিয়ে দিয়ে কাজ নেই। তুই আমার পায়েই বেঁধে দে।”
বাঘু দেখে, সব ভেস্তে যায়। আমতা আমতা করে বলল, “আরে না না, আমি এমনিই বলছিলাম। হিনিমিনি, তোকে কি আর অবিশ্বাস করি?”
যাইহোক, টিফিনের পর তো নামতা লেখার পরীক্ষা শুরু হল। শিয়ালনী সব্বাইকে দূরে দূরে বসিয়ে দিল। বাঘু ভেবেছিল, ‘বাবাদুলি’র দৌলতে পরীক্ষা শুরু হলেই চটপট চটপট ওর সব মনে পড়ে যাবে আর ফটাফট লিখে ফেলবে! কিন্তু লিখতে গিয়ে বাঘু দেখল, একটাও মনে পড়ছে না! ‘বাবাদুলি’ ছুঁয়ে বারকয়েক প্রণামও করল বাঘু, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না। হিনিমিনিকে দূর থেকে বারকয়েক ইশারা করারও চেষ্টা করল সে, কিন্তু সে যেন কিছুই বুঝতে পারল না। এদিকে আবার শিয়ালনীর হুংকার ভেসে এল, “কী হল বাঘু? লিখছিস না কেন? এদিক ওদিক তাকাচ্ছিস কী করতে? নো চালাকি! নো কায়দাবাজি!”
বাঘু বেচারি আর কী করে? বাধ্য হয়েই জোরে একটা প্রণাম ঠুকতে গেল ‘বাবাদুলি’কে আর পটাং করে লাল সুতোটা গেল ছিঁড়ে। বাঘু সেটা হাতে নিয়ে দেখল, একটা কাগজ পাকিয়ে পাকিয়ে মোড়কের মতো বানানো। সেটাতে আবার কিসব যেন হিজিবিজি লেখা আছে। দিদিমণির চোখ বাঁচিয়ে খাতাটা আড়াল করে খুব সাবধানে কাগজের ভাঁজটা খুলল সে। সেখানে লেখা আছে-
বাঘতা
(বাঘুর নামতা)
বাঘু এক্কে বাঘু
বাঘু দুগুণে ডাবু
বাঘু তিনে তাঁবু,
বাঘু চারে হাবু-
বাঘু পাঁচে ডুবু,
বাঘু ছয়ে উবু
বাঘু সাতে সাবু
বাঘু আটে বাবু
বাঘু নয়ে নিবু
বাঘু দশে কাবু।।
পুঃ- এই ‘বাঘতা’ অর্থাৎ বাঘুর নামতা প্রত্যহ প্রভাতে সূর্যের দিকে মুখ করিয়া ১০৮ বার করিয়া জপ করিতে হইবে। জপ করিবার সময় সম্মুখের বাম থাবা এবং পশ্চাতের ডান থাবা যেন উত্থিত অবস্থায় থাকে এবং বাকি দুটি থাবা ভূমিস্পর্শ করিয়া থাকে। অন্যথায় কোন ফললাভ হইবে না।
আচমকাই পাঠশালার মাঝে একটা ঘোরতর আওয়াজ উঠল, ‘ঘোঁ ঘোঁ ঘোঁয়াক!’ দিদিমণি সুদ্ধ সকলে চমকে তাকিয়ে দেখে, বাঘু মেঝেয় লুটোপুটি খাচ্ছে আর তার খাতা, পেনসিল, রবার, এমনকি সেই ‘বাবাদুলি’ অব্দি ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে চতুর্দিকে।
শিয়ালনী গিয়ে লেজ ধরে টেনে তুলল বাঘুকে আর তারপরই এক ধমক, “এসব কী হচ্ছে বাঘু? কায়দাবাজি হচ্ছে? নামতার ভয়ে তুই এবারে এইসব শুরু করেছিস?”
বেচারি বাঘু কোনমতে কেঁউকেঁউ করে বলে, “ইয়ে… মানে, দিদিমণি… মানে বাবাদুলি… মানে বাবাদুলি না… মানে হাতুশি আর হিনিমিনি… মানে ওরাও না… মানে বাবাদুলি … মানে বাবাদুলিও নয়…মানে, ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ।”
বলতে বলতেই ঘুঁ ঘুঁ করে কান্না শুরু হয়ে গেল বাঘুর। তা শিয়ালনী কি আর ওসবে ভোলে? হাতুশিকেই জিজ্ঞেস করল, “কী রে হাতুশি, বাঘু যে কিসব ‘বাবাদুলি’ বলছে, জানিস কিছু?”
হাতুশি সুতোয় বাঁধা কাগজটা এনে দিল দিদিমণির হাতে। পড়তে পড়তে শিয়ালনী ফ্যাকফ্যাক করে খানিক হেসেই গম্ভীর হয়ে গেল, “এইসব হচ্ছে বাঘু? তোর এইসব কারবার? তোর খাতার থেকে এই কাগজ বেরিয়েছে বাঘু! হ্যাঁ, তোর নামে নামতা, সে আবার একশ আট বার জপ করতে হবে? তবে রে? আমার সঙ্গে ইয়ার্কি? আমার সঙ্গে চালাকি? তোকে আজ হাজারবার লম্বাগুড়ি দিতে হবে।”
লম্বাগুড়ির কথায় বাঘুর মুখে সামান্য হলেও হাসি ফুটল। হাজার হোক, প্র্যাকটিস করা আছে কিনা। শিয়ালনীর কিন্তু বাঘুর হাসি চোখ এড়ায়নি। গনগনে গলায় বলল শিয়ালনী, “এখানেই শেষ নয়, বাঘু। সবার ছুটি হলেও আজ কিন্তু তোর ছুটি নয়। তোকে আমি আজ আলাদা করে পড়িয়ে নামতা মুখস্থ করাবোই করাবো। তাতে যদি সন্ধ্যা হয়ে যায় তো হবে। হিনিমিনি, তুই যাবার সময় বাঘুর বাড়িতে খবর দিয়ে দিস। নামতা কেমন মুখস্থ না হয় দেখি!”
আর বাঘু? সে এবারে হাঁইমাঁই করে কান্নাই জুড়ে দিল, “ওরে, এ আমার কী হল রে? আঁই আঁই আঁই আঁই( কান্না)… বাবাদুলি যে আমাকে কী প্যাঁচে ফেলল রে… আঁই আঁই আঁই আঁই( কান্না)…ওরে হাতুশি, হিনিমিনি… তোদের পেটে পেটে এই ছিল রে… আঁই আঁই আঁই আঁই( কান্না)… এবারে আমার কী হবে রে… আঁই আঁই আঁই আঁই( কান্না)… দিদিমণি আমাকে ঘাড়ে ধরে নামতা মুখস্থ করাবে রে… আঁই আঁই আঁই আঁই( কান্না)… এত এত নামতা কী আর মুখস্থ করা যায় রে… আঁই আঁই আঁই আঁই( কান্না)… এর চেয়ে ঘরে পড়াশুনা করা ভালো ছিল রে… আর কোনদিন বাবাদুলি পরবো না রে… আঁই আঁই আঁই আঁই( কান্না)… আঁই আঁই আঁই আঁই( কান্না)…।”
……০……
অংকনঃ মৌসুমী পাত্র
বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি পড়ুন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করেঃ-