Home / কিশোর গল্প / চুটিপিসি ও গোয়েন্দা বগলাচরণ -মৌসুমী পাত্র

চুটিপিসি ও গোয়েন্দা বগলাচরণ -মৌসুমী পাত্র

চুটিপিসি সকাল সকাল উঠে একতাল গোবর নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল ঘুঁটে দেবে বলে। এমন সময় গোয়েন্দা বগলাচরণ এসে তার সামনে দাঁড়াল।
তল্লাটের সবাই জানে, পিসির কিছু নিজস্ব ঢিপি, কিছু ভাঙাচোরা পাঁচিল আছে। সেগুলোতে ঘুঁটে দেবার একচেটিয়া অধিকার পিসিরই। লোকে বলাবলি করে, পিসির নাকি এককালে অবস্থা ভালো ছিল। পিসির ঠাকুরদার ঠাকুর্দা প্রচুর জমিজমা, টাকাপয়সা করেছিলেন। সে অবশ্য পিসির বাড়িখানা দেখলেও বোঝা যায়।

বগলাচরণ কিছুক্ষণ সাবধানে পিসির কাজকর্ম দেখল। তারপর মৃদুস্বরে গলাখাঁকারি দিল। গলাখাঁকারির আওয়াজ শুনে পিসি একবার আড়চোখে দেখল। তারপর একতাল গোবর থপাস করে হাতের বিচিত্র কায়দায় পাঁচিলে ছুঁড়ে দিতে দিতেই প্রশ্ন করল, “তুই ক্যা র্যাভ? সকালে ঘুঁটে দেবার সময় বিরক্ত করিস?”
সময়মতো সরে গিয়েছিল বগলাচরণ, নইলে তার গায়েও লাগত। সরে গিয়ে বিনীত ভাবে বগলা শুধোল, “তাহলে কি বিকেলে ঘুঁটে দেবার সময় বিরক্ত করব?”
পিসি প্রায় ভস্ম করে দেবার ভঙ্গিতেই তাকাল তার দিকে, “তুই ক্যা রে, আপদ?”
কোমরে হাত দিয়ে, দু পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে গোয়েন্দা বলল, “আমি গোয়েন্দা বগলাচরণ।”
“কী? ক্কী বললি? গোহন্তা? ওরে বাবা, তুই ভগবতীকে মারিস নাকি? সে তো মহাপাপ!” বলেই আনমনে পিসি তার গোবর-হাত নিজের কপালে ঠেকাল।
বগলাচরণ অপ্রস্তুত। তড়িঘড়ি বলে, “আরে, না না। গোয়েন্দা। গোহন্তা হতে যাব কোন দুঃখে?”
পিসি এবারে গোবর ঘাঁটাঘাঁটি থামিয়ে বড় বড় চোখে তাকাল, “কী যে বলিস বাপু, মাথামুণ্ডু বোঝা যায় না। অমন পা ফাঁক করে কেষ্টঠাকুরের মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সর, সর, এসব ধাষ্টামো আমার ভালো লাগে না মোটেই।”

chunupisi-r-goyenda-boglachoron
chunupisi-r-goyenda-boglachoron

সে দেখে, চুটিপিসিকে চটালে মুশকিল। তাড়াতাড়ি দু’পা জড়ো করে ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে বলে, “ওটা ইংরেজি কথা। ও তুমি বুঝবে না। কারুর কিছু হারিয়ে-টারিয়ে গেলে আমি খুঁজে দি।”
“ও! তাই বল। তুই তাহলে ওঝা। ওঝারাই তো মন্ত্রপড়া, বাটিচালান এসব করে টরে হারানো জিনিস খুঁজে দেয়। কিন্তু তোমায় তো দেখে বাপু ঠিক ওঝা বলে মনে হচ্ছে না। ওঝার মতো ওঝা ছিল গিয়ে পটাং ওঝা। ইয়া দ্দাড়ি, ইয়া চেহারা। আর কথা বললে মনে হত, যেন সাতখান গোরু একসঙ্গে ডাকছে। তা সেবারে কী একটা গোলমালে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। তা তোমাকে পুলিশ ধরবে নি তো বাবা?”
বগলাচরণ চটপট বলে, “আরে না, না। আমার কাজটা অনেকটা পুলিশের মতোই।” আর কীভাবে পিসিকে বোঝাবে বুঝতে না পেরে কোমরে গোঁজা পিস্তলটা বের করে পিসিকে দেখায়। কিন্তু ফল হয় উলটো। পিসি পরিত্রাহি চেঁচায়, “ও বাবাগো! সাতসকালে ডাকাত পড়ল গো! আমার সব ঘুঁটে নিয়ে চলে যাবে গো-ও-ও-ও!”
বগলাচরণ দেখে আচ্ছা বিপত্তি! তড়িঘড়ি পিস্তল গোঁজে কোমরে। তাড়াতাড়ি বলে, “আরে না না, আমি ডাকাত-ফাকাত নই। তোমার ঘুঁটে নিতে আমার ভারি বয়েই গেছে। আমি এসেছি, ইয়ে, মানে, শুনেছি যে তোমার আগের আমলের বেজায় বড় বাড়ি-ঘরদোর আছে। তা কোথাও কিছু টাকাপয়সা লুকোনো থাকলে খুঁজে দিয়ে তোমাকে সাহায্য করতে পারি।”
“ও! তাই বল! একবার বললি গোহন্তা, একবার বললি ওঝা, আর একবার আমিই তো ভাবলুম ডাকাত। তা সোজাকথা সোজাভাবে বললেই তো পারতি। কথায় বলে, স্পষ্ট কথার কষ্ট নেই।”
বলেই চুটিপিসির মাথায় কিরকমের একটা সন্দেহ উঁকি মেরে যায়। লেখাপড়া বেশি না শিখলে কী হবে, চুটিপিসির সাধারণ জ্ঞান কিন্তু টনটনে। “তা হ্যাঁ রে, তুই যে আমাকে ওসব খুঁজে দিবি বলছিস, তাতে তোর লাভ? আর তাছাড়া তুই তো আমাকে ঠকাতেও পারিস।”
বগলাচরণ জিভ কাটে, “ছি! ছি! কী যে বল পিসি! আমি খুঁজে দিতে পারলে তুমি আমাকে খুশি হয়ে যা দেবে, তাই নেব। আর তাছাড়া সেরকম কিছু খুঁজে বের করতে পারলে কাগজে আমার নাম ছাপবে, লোকে আমাকে আরো নানান কাজে ডাকবে। সেটাও আমার লাভ।”
চুটিপিসি মুখ খুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই তার বাপ-মা মরা আদরের ভাইপো হারাধন এসে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। তার হাতে একটা নিমের দাঁতন। হারাধনকে দেখে পিসি ব্যস্ত হয়ে পড়ে, “ও বাবা হারু! যা, দাঁতটা মেজে আয় দিকিন। এই ভদ্দরলোক এয়েচেন, গোরুখোঁজার কাজ করেন। অ্যাল্প চা পাতা তুলে রেকেচিলাম, দি ওনাকে। তুইও খাবি। তারপর পান্তা খেয়ে ইস্কুলে যাবি।”
বগলাচরণ আর পিসির ভুল ভাঙাবার চেষ্টা করে না। বিনা বাক্যব্যয়ে পিসি আর হারাধনের পিছন পিছন এগোয়।

এবারে আসল ব্যাপারটা একটু খোলসা করতে হচ্ছে। চুটিপিসির নাম যে কী করে চুটিপিসি হল, তা সে নিজেও জানে না। একটা ভালো নাম নিশ্চয়ই ছিল কোনকালে! কিন্তু সে নামটা যে কবেই হারিয়ে গেছে, তা সে নিজেও ঠিকঠাক জানে না। তবে কিনা, হারানো নাম নিয়ে তো আর থানা- কাছারি করা যায় না, তাই চুটিপিসিও করেনি। তবে বাপ-মা মরা বিচ্ছু ভাইপো হারাধনের সৌজন্যে তার ‘পিসি’ত্বের ব্যাপারে অন্ততঃ কোন প্রশ্ন ওঠার কথা নয়।

এদিকে বগলাচরণ কাজে নেমে পড়েছে পুরোদস্তুর। যাতে তাকে বেশ গোয়েন্দা গোয়েন্দা মনে হয়, সেজন্য একটা ভাঙা আতস কাঁচও জোগাড় করেছে কোত্থেকে। সেটা নিয়ে মাঝেমধ্যে এদিক সেদিক ঠাহর করে দেখে। পিসি একদিন তাই দেখে বলল, “ও বাবা বগু! অমন ভাঙা কাঁচ নিয়ে দেখিস না, চোখ খারাপ হয়ে যাবে। তার চে তুই বরং চশমা নে। ভালো দেখতে পাবি।”
বগলাচরণ এখন পিসির হাবেভাবে অনেকটা ধাতস্থ হয়েছে। অতটা ঘাবড়ায় না। সে একগাল হেসে বলল, “না গো, পিসি। এটা দিয়ে ওই যাকে বলে গোয়েন্দাগিরি, মানে, ইয়ে, যাকে বলে গুপ্তধন খুঁজছিলাম।”
গুপ্তধন কথাটা পিসি ভালো শুনতে পায় নি। ফলে সেও দুগাল ভর্তি হেসে বলল, “ও তাই বল। গোবরধন। তা বাপু, গোবর তো একরকম ধনই। এই ধর, গোবর থেকে ঘুঁটে বানিয়ে বিক্রি করে তো আমার দু পয়সা আয় হচ্ছে। তাহলে তো ধনই হল, কী বলিস? তবে যাই বলিস বাপু, তোর মধ্যে গো-ভাব প্রবল। এমনকি, তোর নামের মধ্যেও ‘গো’ আছে রে! ব-গো-লা! আহা! কী সোন্দর নাম! বেঁচে থাক বাবা, বেঁচে থাক।”
গোয়েন্দা বগলাচরণের কল্যাণে আর কিছু হোক ছাই না হোক, পিসির ঝোপজঙ্গলে ভরা বাসস্থানের শ্রী ফিরেছে। আগাছার জঙ্গল সাফ। কারণ, গোয়েন্দা বগলাচরণের নীতিই হচ্ছে, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই- পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন।
প্রথম দিনেই এই নীতি আক্ষরিক অর্থে প্রয়োগ করতে গিয়ে কিঞ্চিত বিপাকে পড়েছিল বগলাচরণ। গোয়ালের পাশেই ছাইগাদা। রাজ্যের ছাই পিসি সেখানে ফেলে। মহা উৎসাহে বগলাচরণ একখানা পেল্লাই কোদাল নিয়ে এসে ছাই সরাতে উদ্যোগী হয়। পিসি যত বলে, “ওরে বগোলা মানিক, ক্ষ্যামা দে। ছাই সরাস না। আমার গোয়াল যে ছাইয়ে ভরে গেল বাবা!” কিন্তু কে শোনে কার কথা! লাভের মধ্যে একটা তামার পয়সা, একটা ভাঙা মগ, একটা চিরুনি, একটা হাতলভাঙা কাপ আর হারাধনের একটা রংচটা বল পাওয়া গেল। ছাইগাদাকে দেশান্তরী করে বগলাচরণ যখন উঠে দাঁড়াল, তখন তাকেই দেখাচ্ছিল একটা চলমান ছাইগাদার মতো। পিসি তো প্রায় আঁতকেই উঠেছে, “ও বাবা বগু! যা চেহারা করেছিস! যা, পাশের ডোবায় গিয়ে একটা ডুব দিয়ে আয়। দুধ গরম করে রাখছি, এসে খাবি বরং।”
ইদানীং বগলাচরণের নজর পড়েছে বাড়ির পেছন দিকের ঢিপিগুলোর ওপর। পিসি সেদিকে রোজ সকালে গিয়ে গঙ্গাজল ছিটিয়ে আসে। বগলাচরণ মনে মনে মতলব ভেঁজে রেখেছে, পিসি দুপুরবেলা ঘুমোলে ওদিকটা গিয়ে একবার ভালো করে অনুসন্ধান করবে।
দুপুরে ঢিপিগুলোর কাছে গিয়ে বগলাচরণের হুঁশ হল, তাইতো! শাবল আর গাঁইতিটা সে এনেছে বটে, কিন্তু কোদাল আনতে ভুলেছে। কোদাল নিয়ে যখন সে ফিরছে, পেছনে হারাধনের গলা, “অ বগলাকাকু!” বগলা খানিকটা বিরক্ত হয়েই পেছনে ফেরে। হারাধনের মুখে দাঁত এঁটো করা হাসি, “কোথায় যাচ্ছ এই ভরদুপুরে?”
চোখ সরু করে তাকায় বগলা, “কেন, তোর তাতে কী?”
“না, মানে তোমার ওই খেলনা পিস্তলটা একবার দেবে? বন্ধুদের দেখাতাম।”
“ই-হি হি! শখ কত্তো! এটা খেলনা না, আসল পিস্তল।”
“বেশ, আমিও তাহলে পিসিকে তোমার নামে আজেবাজে বলে দেব।”
বাধ্য হয়েই বগলা বলে, “আমার সঙ্গে যাবি তো চল।”
ঝোপঝাড়ের মাঝখান দিয়েই একটা সরু পায়ে চলা পথ চলে গেছে ঢিপিগুলোর দিকে। পাশাপাশি তিনটে ঢিপি আর তাদের পিছনে একটা বড়ো ঢিপি। চারদিক নানারকমের আগাছা আর কাঁটাঝোপে ভর্তি।
হারাধন ফিসফিস করে বলল, “জানো, ওই বড়োঢিপিটার নাম কী?”
বগলাচরণ আনমনেই জিজ্ঞেস করল, “কী?”
হারাধন বলল, “ওর নাম গোবর্ধনের ঢিপি। আমাদের কোনো পূর্বপুরুষ ছিলেন।”
বগলা বলে, “তাহলে চল, ওখানে গিয়েই আগে খুঁজি বরং।”
বলতে বলতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটেছে বগলা। আর হাঁচোড়পাঁচোড় করে ঢিপিতে উঠতে গিয়ে বেকায়দায় পড়বি তো পড়, পড়ল গিয়ে একতাল গোবরেরই ওপর। খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে হারাধন বলল, “বললাম বোগুকাকু, ওটা গোবরধনের ঢিপি!”
গোবরধন যে কী বস্তু সেটা এখন রীতিমত গায়েগতরে টের পাচ্ছে বগলাচরণ। চোখের দৃষ্টিতে হারাধনকে ভস্ম করার একটা তোড়জোড় করছিল সে, কিন্তু তার আগেই পশ্চাতপটে বেজে উঠল চুটিপিসির গলা, “বলি ও বগা, বলি ও হারা, কোনদিকে র্যা তোরা? বলি ছোঁড়া দুটো কী করছে?” বলতে বলতেই চুটিপিসির নজর গেছে অপরূপ রূপধারী বগলাচরণের ওপর, “বলি ও বাবা বগা, নাহয় তোর গোভক্তি প্রবল, তাই বলে কি এমন করে সারা গায়ে গোবর লেপতে হয় বাবা? এবারে কাল সকালে আমি কী করে ঘুঁটে দিই? হায় হায় হায় হায় গো… শ্যামলী আর ধবলী কি আর গোবর দেবে আজ?” পিসির কথার গাড়ি চলতেই থাকল আর সেই ফাঁকে বগলাচরণ একলম্ফে দৌড়োল ডোবার দিকে।

রবিবারের সকালে হারাধন বাইরে সদ্যপ্রাপ্ত বলটা নিয়ে খেলছিল। চুটিপিসি গোয়ালে গোরুদুটোকে দোয়াচ্ছে। এমন সময় হারাধনের নজরে এল, বগলাচরণ সাইকেলে চেপে বাড়ির দিকে না এসে ঢিপিগুলোর দিকে গেল। অমনি বল ফেলে হারাধনও পিছু পিছু দে দৌড়। সাইকেলটাকে ছোট ঢিপিটার গায়ে রেখে বগলাচরণ বড় ঢিপিটায় সবে উঠতে যাবে, এমন সময় তার কোমরে একটা যেন টান পড়ল। তাকিয়ে দেখে হারাধনের হাতে তার পিস্তল। চোখে চোখ পড়তেই হারাধন এঁকেবেঁকে দৌড় লাগাল। বাধ্য হয়ে বগলাও ছুটল পিছু পিছু। ঢিপিগুলোর পেছন দিকটায় ঘন ঝোপজঙ্গল। তার মধ্যে দিয়েই একবার এঁকেবেঁকে দৌড়ে, কখনো লাফিয়ে হারাধন এগোচ্ছে। মাঝখানে একটা নালা পড়ল। বিদ্যুতগতিতে লাফিয়ে পেরিয়ে গেল হারাধন। বগলা কোনক্রমে হাঁসফাঁস করতে করতে দৌড়চ্ছে আর চেঁচাচ্ছে, “ও হারা! হারু! হারাধন! বাপধন আমার! পিস্তলটা দিয়ে যা, বাবা!” কিন্তু হারাধনের সেকথা কানে গেলে তো! দৌড়তে দৌড়তে হারাধন যে জায়গাটায় এসে পড়ল, সেদিকটায় এর আগে কখনো আসেনি সে। সামনেই একটা পুরোনো আমলের বিশাল বাড়ির ভগ্নাবশেষ। তার মানে এটাই ওর ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার আমলের পুরোন বসতবাটি। চুটিপিসির কাছে অনেক গল্প শুনেছে সে। আগাছা, ধুলোবালি, খসে পড়া ইঁট প্রায় দুর্ভেদ্য করে দিয়েছে বাড়িতে ঢোকার প্রবেশপথ। হারাধন অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। পেছন থেকে বগলার “হারা, ও হারা” ডাকটা কানে ভেসে আসতেই কোনমতে খচমচ করে ঢুকে পড়ে সে। ইঁট-কাঠ-চুন-সুরকি আর নানারকম আবর্জনা পেরিয়ে যাওয়াই দায়। ঝুল, মাকড়সার জালে পরিপূর্ণ চারপাশ। বগলার গলা এবার একদম পেছনেই পাওয়া গেল, “ও হারাধন, কোথায় গেলি রে?” চমকে পেছনে তাকাতেই তার চোখাচোখি হয়ে গেল বগলার সাথে। একগাদা ঝুল মাথায় মেখে তার দিকে দাঁত বের করে হাসছে। কোনদিকে পালাবে ভাবতে ভাবতেই দোতলায় ওঠার পিতলে বাঁধানো কাঠের সিঁড়ি নজরে আসে তার। সেইদিকেই ছোটে সে। চকিতে মনে পড়ে যায় হারাধনের, ওপরের একদম মাঝের ঘরটাই ছিল তার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার। কোনমতে আবর্জনা সরিয়ে ঢুকে পড়ে সে। চারদিকে রাশি রাশি ঝুল, মাকড়সার জাল। মাথার উপর বাদুড়, চামচিকেরা দুলছে, উড়ছে। তাদের ডানার ঝটাপটি আর তীব্র কান ঝালাপালা করা আওয়াজ। এদিক সেদিক দেখে মনে হয়, প্যাঁচারো বাসা আছে। মাথার উপরে পুরনো আমলের একটা বিশাল ঝাড়লন্ঠন। হারাধন অবাক হয়ে দেখছিল, এমন সময় ঠিক ঘাড়ের কাছেই কার যেন নিঃশ্বাস, কে যেন তার হাতটা পেঁচিয়ে ধরল, আর তার সঙ্গেই পাওয়া গেল বগলার গলা, “এইবারে কোথায় পালাবি? দে পিস্তল!”
হারাধন হাত টেনে ছাড়াবার চেষ্টা করল, কিন্তু লাভের লাভ হল এই যে, টানাটানিতে হারাধনের হাত থেকে একটা ফায়ার হয়ে গুলিটা সটান লাগল ঝাড়লন্ঠনে আর সঙ্গে সঙ্গেই সেটা নিচে পড়েও চুরচুর হয়ে ভেঙ্গে গেল। হারাধন আর বগলা পিস্তলের আওয়াজ হতেই লাফ মেরে সরে এসেছিল, তাই তাদের তেমন লাগেনি। ঝাড়লন্ঠনের ভেঙ্গে পড়া টুকরোগুলো ভালো করে দেখার আগেই চুটিপিসির গলা কানে এল, “আজ সংক্কান্তির দিনে চৌদ্দপুরুষের ভিটেতে একটু কোথায় সক্কাল সক্কাল পিদিম জ্বালিয়ে পুজো করব, তা না, হারাকে খুঁজতে খুঁজতেই চোদ্দপুরুষ উদ্ধার। আজ একবার হাতে পেলে…”
বলতে বলতেই পিসি ঢুকে একদম থ। “এ কী রে, রাশি রাশি মোহর ছড়িয়ে তোরা কী করছিস?”
হারাধন আর বগলা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে, আরে তাইতো! ঝাড়লন্ঠনের কাঁচের টুকরোরে সাথেই মেঝেতে ছড়িয়ে আছে রাশি রাশি মোহর। একঝলক দেখে যদিও মনে হয় কাঁচের টুকরো।
পিসির মুখে একগাল হাসি, “ও বাবা, হারা! তুই ছাড়া এ দুজ্ঞতি কে দূর করত রে! চল, চল, মোহরগুলো ঘরে নিয়ে চল।”
বগলাচরণ মুখ গোঁজ করে বলল, “ও পিসি! হারা আবার কী করল? পিস্তলটা তো আমার আর আমিই তো ওর হাত ধরে টানাটানি করতে গিয়ে গুলি ছুটল।”
হারাধনও ছাড়বার পাত্র নয়। মোহর কুড়িয়ে কোঁচড়ে ভর্তি করতে করতেই বলে, “ইঁ হিঁ হিঁ! বললেই হল আর কী! আমি দৌড়ে এদিকে পালিয়ে না এলে আর এই ঘরে না ঢুকলে কিছু হত কী! আর তাছাড়া পিস্তলটা তো আমার হাতেই ছিল আর আমিই তো গুলি ছুঁড়লাম!”
এ কথায় যারপরনাই আহত হয়ে বগলা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই চুটিপিসি মুখ খুলল, “তাই তো বলি, আমার হারাচাঁদ ছাড়া আর কারো সাধ্যি আছে, এসব উদ্ধার করার? চল তো বাবা বগলা, আমার এখনো তিন কুড়ি ঘুঁটে দেওয়া বাকি আছে। তুই খানকতক দিয়ে দিবি।”
অগত্যা বগলাচরণ মোহর কুড়নো শেষে গুটি গুটি পায়ে চুটিপিসির পেছন পেছন এগোয়।

এর কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, বগলা গোয়ালঘরের বারান্দার পাশে দাঁড়িয়ে। পিসি তার পেছনে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছে, “এইখানেতে এক থাবড়া। আহা! এই ঘুঁটেটা ভালো হল না, বগলা! ঠিক করে মন দিয়ে কর।”
বগলা আবার একদলা গোবর হাতে তোলে! কাজ শেষ হলে চুটিপিসি তাকে দুটো মোহর দেবে বলেছে!

Leave a comment

Check Also

ভুতুম থুম- মৌসুমী পাত্র

পূর্ণিমার চাঁদটা ভেসে আছে বিরাট একটা গোল থালার মতো। একটা শিশুগাছের ডালের কয়েকটা পাতার ছায়া …

 ছেঁড়া রামধনু – মৌসুমী পাত্র

আমার মা বেজায় দুষ্টু হয়েছে আজকাল। একটা কথাও শুনতে চায় না। এই তো পরশুদিন, বললাম, …

chitrogupter-computer-mp

চিত্রগুপ্তের কম্পিউটার- মৌসুমী পাত্র

“যত্ত সব আদ্যিকালের জিনিস নিয়ে কাজকারবার! আর পারা যায় না বাপু!”, নিজের মনেই গজগজ করতে …

শিল্পী- গুঞ্জা

ফুল-পাখি কথা – মৌসুমী পাত্র

সে ছিল এক গভীর বন। আর সেই বনের ঠিক মধ্যিখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় ছিল এক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *