(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে পাঠশালার খবর ভেসে আসে মাঝেমধ্যে। এলেই তোমাদের জানাতে থাকবো। পাঠশালাটা কোথায় জানো? বনের ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে প্রচুর গাছপালা মিলে মাথার উপরে একটা চাঁদোয়ার মত বানিয়েছে, আর দুটো সেগুনগাছের ইয়া মোটা মোটা গুঁড়ি দুদিক থেকে এসে একটা দরজার মতো তৈরি হয়েছে। জঙ্গলের যত ছানাপোনা জন্তুজানোয়ার, সবাই আজকাল সক্কালবেলা হলেই হাতমুখ ধুয়ে চাট্টি মুড়ি খেয়ে ওখানেই পড়তে যায়। তাদের মধ্যে আছে বাঘিনীর বাচ্চা ছেলে বাঘু, হাতির বাচ্চা মেয়ে হাতুশি আর হনুমানের ছানা মেয়ে হিনিমিনি। এছাড়াও আছে ভালুকের পুঁচকি মেয়ে ভালকি আর কুমীরের বাচ্চা ছেলে কুমরু।)
শীত প্রায় শেষের মুখে। জঙ্গলের ইতিউতি পলাশ ফুলেরা নরম নরম লাল- কমলা আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে। যেসব গাছেরা শীতে পাতা প্রায় ঝরিয়েই ফেলেছিল, তাদের সারা গায়ে এখন কচি কচি সবুজ পাতার বাহার। সূর্যের রোদ্দুরও এসময় বড় মিঠে। মৃদু তাপ আছে, কিন্তু জ্বালা নেই। শিয়ালনীর পাঠশালার পোড়োরাও মোটামুটি মন দিয়েই পড়াশুনো করছে। এমনকি, বাঘুও।
চলছে সবই ঠিকঠাক, কিন্তু শিয়ালনী এদিন সকালে প্রার্থনার পর ক্লাসে ঢুকেই ঘোষণা করে দিল, “শোন, আমার মাসতুতো বোনের চিঠি এসেছে গতকাল। ওদের ওখানে বার্ষিক শৃগাল সম্মেলন সামনের সপ্তাহে। সাতদিন ধরে সম্মেলন। আমাকে বলেছে প্রধান অতিথি হতে। তা বুঝতেই পারছিস, যাওয়া আসা মিলে দু’ সপ্তাহ লেগেই যাবে। আজ তো বুধবার। আমি ভাবছি, শুক্রবার তোদের পাঠশালার পর রওনা দেবো। পরের দুটো সপ্তাহ আমি আসতে পারবো না। বুঝলি?”
শুনেই তো বাঘু আহ্লাদে ডগমগ, “তাহলে দিদিমণি, দু’ সপ্তাহ টানা পাঠশালা ছুটি?”
হাতুশির মুখ দুঃখী দুঃখী, “দিদিমণি, অতদিন পড়া হবে না?”
শিয়ালনী কটমট করে চাইল বাঘুর দিকে, “অত ফূর্তির কারণ নেই, বাঘু বাছাধন। সব ব্যবস্থা আমি করে যাবো। আমার পরিচিত এক দিদিমণি আছেন, গণ্ডারনী দিদিমণি। তাকে বলে যাবো। সে ওই কয়েকটা দিন তোদের ক্লাস নেবে’খন।’’
শুনেই হাতুশির শুঁড় উঠে গেল মাথার উপরে, “গণ্ডারনী দিদিমণি?”
“হ্যাঁ রে। ওকেই বলেছি। কয়েকটা দিন চালিয়ে নেবে। গণ্ডারনী এমনি ঠিকই আছে, কিন্তু কথায় বলে না, গণ্ডারের গোঁ। তোরা বাবা সামলে- সুমলেই চলিস বরং। বাঘুটাকে নিয়েই আমার যত চিন্তা। বাঘুচরণ, তুমি আমার সঙ্গে যা করো করো, নতুন দিদিমণির কাছে ভালো হয়ে থেকো।”
হিনিমিনির চোখ- মুখ শুকনো, “আপনার না গেলে হয় না, দিদিমণি?”
শিয়ালনী চশমাটাকে মাথার উপর তুলে হাসল, “আরে, ঘাবড়াচ্ছিস কেন? দুটো তো সপ্তাহ। একটু চুপচাপ করে কাটিয়ে দে, তারপর তো আমি চলেই আসছি। আর তোদের অত চিন্তার কিছু নেই। আজ বুধবার। শুক্রবারে গণ্ডারনী দিদিমণিকে নিয়ে এসে সবকিছু দেখিয়ে দেবো। তোদের সংগেও কিছুটা পরিচয় হয়ে থাকবে।”
তা শুক্রবারে গণ্ডারনীকে নিয়ে এসে শিয়ালনী দেখিয়ে দিল সবকিছু। গণ্ডারনীকে দেখে ওদের সবারই কেমন কেমন যেন লাগল। বড়োসড়ো চেহারা, গম্ভীর গম্ভীর মুখ। ওদের সবার সঙ্গে মোটে কথাই বলল না ভালো করে। বাঘু ফিসফিসিয়ে পাশে বসা হাতুশিকে বলল, “নাকের উপর খড়্গটা দেখেছিস? কে জানে, গুঁতোতেও পারে!’’
হাতুশি শুঁড়খানাকে বাঘুর কাঁধে একবার বুলিয়ে দিয়ে বলল, “সাবধানে থাকিস বাঘু। তোরই গুঁতো খাবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।’’
শুনেই বাঘু থাবা দিয়ে মাথা চুলকোতে শুরু করে দিল। শিয়ালনী এদিকে গণ্ডারনীকে বোঝাচ্ছে, “শোনো, ওদের বইখাতা, পড়া- সবই তো তোমাকে বুঝিয়ে দিলাম। বাকি রইল প্রার্থনা। প্রার্থনার সময় তোমাকে কিছু করতে হবে না। ওরাই লাইন করে দাঁড়িয়ে গান করবে, তুমি খালি ওদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমার পাঠশালার পশুয়ারা সব্বাই খুব ভালো।”
ঘোঁত করে একটা শব্দ করল গণ্ডারনী, “পশুয়া আবার কী বস্তু?”
মোলায়েম একখানা হাসি দিল শিয়ালনী, “পশুয়া মানে, পশুর সঙ্গে পড়ুয়া যোগ করলে যা হয় আর কী!”
“অ।”, বলেই খড়্গটা উপরের দিকে উঁচু করল গণ্ডারনী, “ঠিক আছে, আমি আসি আজ। তুমি পড়াও ওদের। আমি সোমবার আসব।”
দেখতে দেখতে সোমবার এসেও গেল। প্রার্থনার পর ক্লাসে বসেছে সবাই। নতুন দিদিমণি, তায় আবার চশমাটা ঝুলছে নাকের খড়্গের উপর। চোখদুটো ঘুরছে ভাঁটার মতন। বুক দুরুদুরু করছে সবার। হাজিরা খাতাটা নিয়ে গমগমে গলায় বলল গণ্ডারনী, “এই যে পশুয়ারা, শোন্ সবাই। আমি এক এক করে রোল নম্বর ডাকব তোদের, আর তোরা ঊঠে দাঁড়িয়ে যে যার নিজের নাম বলবি।”
নড়েচড়ে বসল ওরা। বাঘু তো থাবা দিয়ে মাটি আঁচড়াতে শুরু করে দিল। গণ্ডারনী ফোঁত করে নাক দিয়ে একটা আওয়াজ ছেড়ে বলল, “রোল নম্বর এক।”
হাতুশি উঠে দাঁড়িয়েছে সড়াক করে, “দিদিমণি, আমি হাতুশি।”
গণ্ডারনী কুতকুতে চোখে হাতুশিকে দেখতে দেখতে বলল, “কী ব্যাপার, অমন হাতির মত চেহারা কেন?”
হাতুশি ঘাবড়ে গিয়ে কোনমতে বলল, “দিদিমণি, আমি তো হাতিই।”
“অ। তা একটু রোগা হতে পারো না? অমন মোটা চেহারা আমি মোটেই পছন্দ করি না। কাল একদম রোগা হয়ে আসবে। বুঝলে?”
হাতুশির তো শুঁড় ঝুলে গেছে একপাশে, “দিদিমণি, হাতিরা তো মোটাসোটাই হয়। আর তাছাড়া, একদিনের মধ্যে রোগা কি হওয়া সম্ভব?”
“খুব শুঁড়ে শুঁড়ে কথা শিখেছ দেখছি। চোপ্! তর্ক করা আমি একদম পছন্দ করি না। রোল নম্বর দুইই।”
হাতুশি শুঁড় গুটিয়ে বসে পড়ল। হিনিমিনি উঠে দাঁড়াল। গণ্ডারনী শুধোল, “কী নাম?”
“দিদিমণি, আমার নাম হিনিমিনি।”
“হিনিমিনি?”, খড়্গখানা বাঁকিয়ে বলল গণ্ডারনী, “তা বাপু, অমন প্যাঁকাটির মতন চেহারা কেন? ভালো করে খেতে পাওনা বুঝি? রোগা চেহারা আমি একদম পছন্দ করি না। হাতুশিকে দেখে শিখতে পারো না? কাল ওর মতো স্বাস্থ্য বাগিয়ে পাঠশালায় আসবে। বুয়েচ?”
কিছুই বুঝল না হিনিমিনি। মাথা তার ঘুরছে। কোনমতে ধপ করে বসে পড়েছে। ততক্ষণে হাঁক দিয়েছে গণ্ডারনী, “রোল নম্বর তিন।”
বাঘু তো গুটিশুটি মেরে উঠে দাঁড়িয়েছে। গণ্ডারনী দিদিমণির কথা শুনে তার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে, কান শোঁ শোঁ করছে, নাক টোঁ টোঁ করছে। গণ্ডারনী ততক্ষণে হাঁক পেড়েছে, “কী নাম?”
কোনমতে মুখ ফাঁক করল বাঘু, “বাঘু, দিদিমণি।”
“কী, ক্কী বললি? তোর নাম বাঘু দিদিমণি?”, বলেই বিচ্ছিরি রকমের খ্যাকখ্যাক করে হাসতে শুরু করল গণ্ডারনী।
“না দিদিমণি… মানে না… মানে ইয়ে… মানে আমার নাম তো বাঘু… মানে আপনি তো দিদিমণি… মানে ইয়ে… আমার কি দিদিমণির মত লেজ না দিদিমণির মত চশমা?”
“খুব লেজ তুলে কথা বলতে শিখেছিস না?”, চোখমুখ কুঁচকে তাকাল গণ্ডারনী, “তা বাঘু বাহাদুর, তোমার লেজ অত লম্বা কেন? লম্বা লেজ আমার একটুও পছন্দ নয়। কাল লেজ কামিয়ে পাঠশালে আসবে। বুয়েচ?”
বাঘুও দমবার পাত্র নয়, “দিদিমণি, আমাদের বাঘকুলে লেজ কামাবার নিয়ম নেই। তবে আপনি যদি বলেন, আমি ফিতে দিয়ে ফুলটুল করে বেঁধে গুটিয়ে আসব।”
চোখ বড়বড় করে বাঘুকে দেখল গণ্ডারনী, “ও-ও-ও! লেজ লম্বা বলে খুব দেমাক, না ? চাইলে আমি অমন দশটা লেজ বানাতে পারি । বুয়েচ?”
ঘাড় কাত করল বাঘু, “বুইলাম, দিদিমণি।” বলেই বসে পড়ল।
বাঘুর দিকে কটমট করে চাইল গণ্ডারনী। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর ডাকল, “রোল নম্বর চার।”
ভালকি উঠে দাঁড়াল। গণ্ডারনী কটমট করে চাইল, ‘‘কী নাম?”
ভালকি শান্তগলায় জবাব দিল, “আমার নাম ভালকি।”
ঘুঁৎ ঘুঁৎ করে একটা অদ্ভুত শব্দ বেরোল গণ্ডারনীর নাক দিয়ে আর তার সঙ্গেই ধেয়ে এল প্রশ্ন, “কী ব্যাপার, সারা গায়ে অমন লোম কেন?”
ভালকি উত্তর দিল, “দিদিমণি, আমার তো সারা গায়ে লোম হবেই। আমি ভালুক কিনা।”
“কাল লোম কামিয়ে আসবি। গায়ে অত অত লোম থাকা আমার বিলকুল না- পসন্দ। বুইলি?”
ভালকি গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে উত্তর দিল, “দিদিমণি, আমাদের তো লোম কাটে না কেউ। আমার মা- বাবা, মাসি- মেসো, পিসি- পিসে, মামা-মামী সবারই তো গা ভর্তি লোম। ভালুক মানেই তো লোমের মুলুক।”
ঘোঁত ঘোঁত করে বারকয়েক নিঃশ্বাস ছাড়ল গণ্ডারনী, “শোন্, ওসব ছেঁদো কথায় আমাকে ভোলাতে আসিস না। কাল গায়ের সব লোম কামিয়ে পরিষ্কার হয়ে আসবি। ব্যস!”
ভালকির খুব রাগ হল। সেও পালটা বলে বসল, “দিদিমণি, আপনারও তো নাকে খড়্গ। ওটা কি আপনি কামাতে পারবেন?”
“ক্কী, ক্কী বললি? তুই আমার খড়্গ তুলে কথা বললি?”, রাগের চোটে লেজখানা পাঁইপাঁই করে ঘুরতে শুরু করেছে গণ্ডারনীর।
ভালকি দিব্যি শান্ত গলায় জবাব দিল, “সে তো দিদিমণি, আপনিও আমার লোম তুলে কথা বললেন।”
হাতুশি মুখ খুলল এতক্ষণে, “দিদিমণি, আসার সময় ভালকির মা, মানে ভালকিন মাসীকে দেখলাম ওপাশের জঙ্গলে মধু খাচ্ছে। আমি বরং ডেকে আনি, তাহলেই আপনি কথা বলে বুঝতে পারবেন।”
তাড়াতাড়ি করে বলল গণ্ডারনী, “তা তিনি মধু খাচ্ছেন, এসময় ডাকাটা ঠিক নয়। হাতুশি, তোমায় অত পাকামি মারতে কেউ বলেনি। যাকগে, রোল নম্বর পাঁচ।”
কুমরু উঠে দাঁড়াল।
“কী নাম?”
“আজ্ঞে দিদিমণি, আমার নাম কুমরু।”
“তা বাবা কুমরু, সারা গায়ে অমন কাঁটা কেন?”
কুমরুর মুখচোখ শুকিয়ে গেছে, “দিদিমণি, আমি তো কুমীর। আমার গায়ে তো কাঁটা হবেই।”
“আমাকে বোঝাতে এসো না। বুয়েচ?”, গণ্ডারনীর চোখ- মুখ কুঁচকে গেছে, “তুমি কি ফণিমনসা গাছ না সজারু? কাল যেন সারা গায়ে একটাও না কাঁটা দেখি। বুইলে?”
তা কুমরু আর বুঝবে কী, তার তো প্রায় কাঁদার জোগাড়। “দিদিমণি, কাঁটা সরাবো কী করে?”
অমনিই শুরু হয়ে গেল হট্টগোল। হাতুশি বলে, “রোগা হবো কী করে?”, হিনিমিনি বলে, “মোটা হবার কী উপায়?”, ভালকি বলে, “লোম আমি কাটছি না, কাটবো না”, কুমরুর চোখে জলের ধারা, “কাঁটা ছাড়া কুমীর হয়?” বাঘু তো লাফঝাঁপই শুরু করে দিল, “লেজখানা রাখতে করো যতোই মানা/ লেজকাটা জন্তু হয়ে থাকবো না না নানা!”
গণ্ডারনী হঠাৎ করে কিরকম যেন খেপে গিয়ে তেড়ে এল, “কী অসভ্য ছানাপোনা রে বাবা! তোদের ক্লাস করবোই না আজ। চললাম আমি।” বলেই পিঠে থলেখানাকে ফেলে তড়বড় করে হাঁটতে হাঁটতে উধাও হয়ে গেল।
এতোই চটপট ঘটে গেল সব যে ওরা আর কিছু বলার বা করারই সুযোগ পেল না। ভালকিই সবার প্রথমে থমথমে গলায় বলল, “এবারে কী হবে রে, হাতুশি?”
বাঘুরও মুখ কাঁদোকাঁদো, “এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গেলে মা বেজায় বকবে। বলা যায় না, বাঘিপিসীকেও খবর দিয়ে দিতে পারে।”
কুমরু মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “বলা যায় না, দিদিমণি আবার ফিরেও আসতে পারেন। তখন আবার আমাদের না দেখতে পেলে মুশকিল।”
হিনিমিনি লেজখানাকে ভালো করে দু’বার চুলকে নিয়ে বলল, “ঠিকই বলেছিস, কুমরু। বাড়ি যাওয়া চলবে না। আমি বলি কী, হাতুশি, তুই-ই বরং আমাদের পড়া। টিফিনের সময় হলে নাহয় আমরা তখন টিফিন খেয়ে খেলেটেলে নেব। তারপর তোর কাছে আবার একটু পড়ে নিয়ে বাড়ি যাবো।”
হাতুশি শুঁড় দোলাল, “ঠিকই বলেছিস। এখন বরং সময় নষ্ট না করে আমরা পড়াশোনা করি। টিফিনের সময় সবাই মিলে তখন আলোচনা করা যাবে।”
শিয়ালনী যা পড়িয়ে গিয়েছিল, তার পর থেকে হাতুশি ‘বন পরিচয়’ পড়ালো ওদের। ‘তৃণভোজী প্রাণী’ আর ‘মাংসাশী প্রাণী’ পড়িয়ে লিখতে দিল। নিজেও লিখল। তারপরে নামতা পড়ল সবাই মিলে। এই করতে করতেই সূর্যটা উঠে গেল সেগুন গাছের মাথার ওপর। সেদিকে তাকিয়ে হিনিমিনি বলল, “চল রে সবাই। টিফিনের সময় হয়ে গেছে।”
খেতে খেতেই শুরু হল ওদের আলোচনা। কুমরু চিন্তার সুরে বলল, “কিন্তু ধর, যদি গণ্ডারনী দিদিমণি আর নাই আসেন?”
বাঘু এক দাবড়ানি দিল কুমরুকে, “না এলে না আসবেন। না এলেই তো ভালো! বাবারে বাবা! আমার লেজকে বলে কিনা ছোট করে আনতে!”
ভালকি ভুউউস করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল, “শিয়ালনী দিদিমণি আমাদের কতো ভালো বল্ দেখি। কক্ষণো এরকম করেন না।”
হিনিমিনি বলল, “আমার কিন্তু বেজায় চিন্তা হচ্ছে রে। প্রথমদিনেই যদি দিদিমণি আমাদের এত বকাঝকা করেন, তাহলে পরে কী হবে রে! তাও কী? না, আমি রোগা, হাতুশি মোটা, বাঘুর লেজ লম্বা, ভালকির গায়ে লোম, কুমরুর গায়ে কাঁটা- এইসব।”
ভালকি সায় দিল, “যা বলেছিস। যে যেমন জানোয়ার তার তো সেরকম হবেই।”
হাতুশি এতক্ষণ চুপচাপ সবার কথা শুনছিল। এবারে শুঁড় তুলল মাথার ওপর, “শোন্, আমি বলি কী, বাড়িতে গিয়ে যে যার মা-বাবাকে আজকের সব কথা জানিয়ে রাখি। কারণ নতুন দিদিমণি কাল যে আবার কী করবেন, কে জানে! বাড়িতে আগে থেকে বলে রাখাই ভালো।”
হাতুশির কথা সবারই মনে ধরল। ঠিক হল যে, দিদিমণি আসুন বা নাই আসুন, ওরা নিজেদের মত পড়াশুনা করে বাড়ি চলে যাবে। বাড়িতে গিয়ে সবকথা জানাবে। তারপর কাল আবার পাঠশালা আসবে যেমন অন্যদিন আসে।
সেইরকমই হল। কিন্তু পরের দিন পাঠশালে আসার অনেকক্ষণ পরেও যখন দিদিমণি এলেন না, ওরা নিজেদের মত প্রার্থনা সেরে পড়া শুরু করে দিল। হাতুশি যেমন পারে ওদের পড়ালো, বোঝালো, লিখতে দিল। নিজেও লিখল।
তারপর সূয্যি যখন সেগুনগাছের মাথার ওপরে উঠে গেল, তখন ওরা সব বইখাতা গুটিয়ে রেখে একসঙ্গে গোল হয়ে টিফিন খেতে বসল। খেতে খেতেই হঠাৎ করে ভালকির চোখে পড়ল, আরে, তাইতো, গণ্ডারনী দিদিমণির মত কে যেন আসছেন না? বন্ধুদের বলাতে ওরাও তাকিয়ে দেখল, হ্যাঁ, ঠিকই। গণ্ডারনী দিদিমণি আসছেন হেলতে- দুলতে।
কাছে এসেই এক হাঁক পাড়ল গণ্ডারনী, “অ্যাই, পড়াশুনোয় ফাঁকি দিয়ে বসে বসে খালি টিফিন খাওয়া হচ্ছে?”
হাতুশি বলল, “না দিদিমণি, আমরা তো পড়ছিলাম নিজেরা নিজেরা।”
ভালকি বলল, “আমাদের তো এখন টিফিন খাবার সময়। তাই খাচ্ছি।”
হিনিমিনি লেজ দোলাল, “দিদিমণি, হাতুশিই আমাদের পড়িয়েছে।”
কুমরু নিজের গায়ের কাঁটায় ভয়ে ভয়ে হাত বুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ দিদিমণি, টিফিন অব্দি হাতুশি আমাদের পড়িয়েছে।”
বাঘু দেখল, সবাই যখন বলছে তারও কিছু বলা দরকার। তাই তাড়াতাড়ি করে বলল, “হ্যাঁ দিদিমণি, টিফিনের সময় তো টিফিন খেতেই হয়। নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়।”
রীতিমত দাঁতমুখ খিঁচিয়ে উঠল গণ্ডারনী, “এঁ হেঁ হেঁ! টিফিন খেতে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়? যত্তসব আজগুবি কথা। চলে আয় সব। আমি এখনি পড়ানো শুরু করবো।”
ভালকি মাথা ঝাঁকাল, “টিফিন না খেয়ে তো যাবো না, দিদিমণি!”
বাঘু অমনি ফুট কাটল, “আহা! অত সাধের টিফিন! মা বলে কত্ত কষ্ট করে বানিয়েছে।”
হাতুশি দেখল, গণ্ডারনী দিদিমণি আবার না রেগে যায়! তাই তাড়াতাড়ি করে বলল, “দিদিমণি, আপনি বরং গিয়ে বসুন। আমরা চটপট করে টিফিন খেয়েই আসছি।”
গণ্ডারনী এতক্ষণ রাগে ফুলছিল, হাতুশির কথায় অল্প নরম হল। গম্ভীরমুখে গলার ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, “পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। বুয়েচ?”
কোনমতে তাড়াহুড়ো করে খাওয়া শেষ করে ওরা গিয়ে বসল যে যার নিজের জায়গায়। গণ্ডারনী গম্ভীরমুখে বলল, “তোদের যেন এখন কিসের ক্লাস?”
হিনিমিনি তাড়াতাড়ি করে উত্তর দিল, “দিদিমণি, ‘সবুজপাঠে’র।”
“বেশ, ‘সবুজপাঠ’ বইখানা সবাই বের কর্। প্রথম পাতা থেকে রিডিং পড়তে শুরু কর। যার যেমন রোল নম্বর সেইভাবে প্রত্যেকে পরপর করে পড়বি। দু’পাতা করে। রোল নম্বর পাঁচের হয়ে গেলে আবার রোল নম্বর এক থেকে শুরু হবে। এইভাবে যাবি।”
হাতুশি উঠে দাঁড়িয়ে পড়তে শুরু করল। দুই নম্বর পাতা শেষ হবার আগেই গণ্ডারনীর মাথা একপাশে ঝুলে পড়ল, নাকের উপরের খড়্গ নিঃশ্বাসের তালে তালে ওঠানামা শুরু করল, চশমাটা এক কানে আটকে গিয়ে ঝুলতে থাকল আর নাক দিয়ে বিচিত্র সব আওয়াজ বেরোতে শুরু করল। কখনো নাক ডাকে ঘড়ড়ড়- ঘোঁ, তার পরের মুহূর্তেই ডেকে ওঠে ফুড়ুৎ ফোঁ। আবার তার পরেই ডেকে ওঠে ঘুঁউউউউস্। সে শেষ হতে না হতেই আওয়াজ ওঠে ফুঁউউউউস।
ওরা সবাই মিলে তাকাতাকি করল। হিনিমিনি ফিসফিস করে বলে উঠল, “কী হবে রে হাতুশি? দিদিমণির যে নাক ডাকছে!”
বাঘু ফিকফিক করে হেসে লুটিয়ে পড়ে বলল, “আহা! নাকডাকা তো নয়, যেন বাঘিপিসী নাকের ভেতর ব্যায়াম করছে!”
হাতুশি মুখে শুঁড় চাপা দিল, “সসসস! দিদিমণি উঠে গেলে মুশকিল। চল্, যে যার মত পড়ে নি।”
পড়তে পড়তে ‘সবুজ পাঠ’ বইখানাই পুরো শেষ হয়ে গেল। তবু গণ্ডারনীর ঘুম ভাঙে না। ভালকি মহা ভাবিত হয়ে প্রশ্ন করল, “হ্যাঁ রে, এবারে কী হবে?”
কুমরু বলল, “কী আর হবে? এখনো তো ছুটির দেরি আছে। চল্, নামতা পড়ি।”
বাঘু থাবা দিয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, “নামতা না পড়ে নাকডাকা নাকডাকা খেললে হয় না? আমরা বেশ মিছিমিছি একেকজন এক একরকম নাক ডাকব!”
হিনিমিনি এক দাবড়ানি দিল বাঘুকে, “অ্যাইয়ো বাঘু! একদম ফাঁকিবাজির মতলব করবি না। দিদিমণির ঘুম ভেঙে গেলে মুশকিলে পড়তে হবে। হাতুশি, তুই বরং নামতাগুলো শুরু কর।”
হিনিমিনির ধমক খেয়ে বাঘু বেচারি তো বসল লেজ গুটিয়ে। হাতুশি শুরু করল নামতা। তা নামতাও এক সময়ে শেষ হয়ে গেল। গণ্ডারনীর ঘুম তখনও ভাঙেনি।
কুমরুর মুখচোখ শুকনো, “হ্যাঁ রে, এবারে কী হবে? দিদিমণি যে ঘুমিয়েই যাচ্ছেন!”
হিনিমিনি তাকাল দূরের দিকে। সেখানে তখন আগুনরঙা পলাশ গাছের পেছনদিকে অস্তগামী সূর্যের ছটা। তাই দেখে হিনিমিনি মাথা নাড়ল, “ছুটির সময় হয়ে গেছে রে।”
বাঘু তো শুনেই হাঁউমাঁউ করে উঠল, “অ্যাঁ, তাহলে কী হবে? আমার খিদে পাওয়ার সময় হয়ে গেছে। চল, বাড়ি যাই।”
হাতুশি এক দাবড়ানি দিল বাঘুকে, “বাঘু, তুই থামবি? দিদিমণিকে তো ডাকি আগে।”
ভালকি ডাক দিল, “দিদিমণি! ও দিদিমণি!”
উত্তরে গণ্ডারনীর নাক ডাকল- ঘড়ড়ড় ঘোঁ! ঘড়ড়ড় ঘোঁ!
কুমরু হেসেই অস্থির, “ভালকি, তুই মোটে ডাকতে পারিস না। দাঁড়া আমি ডাকি। দিদিমণি, দিদিমণি গো-ওও-ও!”
জবাবে গণ্ডারনীর নাকের আওয়াজ ভেসে এল- ফররর ফোঁ। ফড়ফড় ভোঁ!
হিনিমিনি হিহি করে হাসল, “ধুস, তোদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না। দ্যাখ, কেমন করে ডাকতে হয়?”, বলেই হিনিমিনি হাঁক দিল, “দিদিমণিইইইই! দিদিমণিইই, দিদিমণিইই! দিদি…দিদি…দিদি…, মণি…মণি…মণি! গণ্ডারনী দিদিমণি! দিদিমণি গণ্ডারনী! নি-নি-নি-নি!”, বলেই হিনিমিনি তুড়ুক তাঁই করে একপাক নেচে নিল।
গণ্ডারনীরও নাকডাকা শোনা গেল- ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ ঘুরনী! পুঁ পুঁ পুঁ পুরনী! ঘুড়ুত ঘুড়ুত ঘুইনি! পুড়ুত পুড়ুত পুইনি!
বাঘু তো শুনে হাসল বেজায়। হাসতে হাসতেই বলল, “ধুর, ধুর, তোরা কোন কম্মেরই নোস! শোন্, কেমন করে ডাকতে হয়!”, বলেই বাঘু বিকট সুরে ডাক দিল, “দিদিমণি হোইই! দিদিমণি গো…ও-ও-ও। ছুটির সময় হয়ে গেল গো-ও ও! এবারে ঘুম ভেঙে উঠুন গো! নাকডাকাটি থামান গোওওও! বেশি ঘুমোনো ভালো নয় গোওওও!”
গণ্ডারনীর নাক এবারে উত্তর দিল- ঘড়ঘড় ঘড়ঘড় ঘোঁওওও! ভড়ভড় ভড়ভড় ভোঁ!
তাই শুনে বাঘু বাদে বাকি সবার কী হাসি! হাতুশি বলল, “আমিও একবার চেষ্টা করি! দিদিমণিইইইই! দিদিমণিইইইইইইইই!”
তবুও গণ্ডারনীর ঘুম ভাঙল না। হাতুশি বলল, “চল্ সবাই মিলে একসঙ্গে ডাকি বরং। দিদিমণি, দিদিমণি বলে সবাই খুব জোরে ডাকবি। নে, এক, দুই, তিন, শুরু…।
সকলে যত জোরে পারে চেঁচাল, “দিদিমণিইইইই! দিদিমণিইইই!”
গণ্ডারনীর নাক ডাকল- ঘঁ ঘঁ ঘঁ ঘঁ। ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ। ঘুউউউউউস! ফুউউউউস!
কুমরু হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, “দিদিমণির ঘুম ভাঙবে না রে। চল্, চলেই যাই।”
বাঘু ফুট কাটল, “আমি তখনই বললাম তোদের।”
হাতুশি সায় দিল, “হ্যাঁ, চল চলেই যাই। কাল দেখা যাবে।”
থলে-টলে গুছিয়ে নিয়ে যে যার বাড়ির পথ ধরল।
পরের দিন পাঠশালে এসে সকলে দেখে, গণ্ডারনী দিদিমণি আগেই এসে গেছেন। ওদের দেখেই দাঁতমুখ খিঁচিয়ে উঠল গণ্ডারনী, “কী ব্যাপার? কাল সব পড়া না করেই পালিয়েছিলি যে?”
হাতুশি শুঁড় নাড়ল, “দিদিমণি, আমরা তো আপনাকে অনেক ডেকেছি। আপনার ঘুম তো ভাঙেনি। তাই চলে গেলাম।”
গণ্ডারনী গর্জন করে উঠল, “বটে? আমি ঘুমোচ্ছিলাম? কী প্রমাণ আমি ঘুমোচ্ছিলাম?”
হিনিমিনি মিহিসুরে বলল, “দিদিমণি, আপনার যে নাক ডাকছিল।”
বাঘু নাকডাকা নকল করার চেষ্টা করল, “ঘড়ড়ড় ঘোঁওওও। ঘুউউউউস! ফুউউউস! এমনি এমনি করে ডাকছিল, দিদিমণি।”
রাগের চোটে গণ্ডারনীর নাকের খড়্গ কাঁপছে, “তবে রে? আমি ঘুমোচ্ছিলাম? আমার নাক ডাকছিল? কই, আমি তো শুনতে পাই নি?”
ভালকি বলল, “দিদিমণি, আপনার নাক ডাকা আপনি নিজে শুনতে পাবেন কী করে?”
গণ্ডারনী কাঁইমাঁই করে উঠল, “আমাকে ভুল বোঝাবার চেষ্টা করবি না। বুঝলি? আমার নাক, আমি ডাকব, আর আমি নিজেই জানতে পারব না- হয় কখনো?”
এ কথায় হাতুশি শুঁড় দুলিয়ে আপত্তি জানাল, “দিদিমণি, আপনার মুখও তো আপনার। কিন্তু সে কি আপনি এখন দেখতে পাচ্ছেন? এও তেমনি।”
ভয়ানক রেগে গেল গণ্ডারনী, “চোপরও। শুঁড়ে শুঁড়ে তক্কো? যাও, সব্বাই সবার কান ধরো।”
একথায় হাতুশি ধরল হিনিমিনির কান, হিনিমিনি ধরল বাঘুর কান, বাঘু ধরল ভালকির কান, ভালকি ধরল কুমরুর কান, কুমরু ধরল হাতুশির কান। হিহিহিহি করে হাসতে হাসতে কান ধরে এক পাক ঘুরেও নিল সবাই। হিনিমিনি আবার এক কলি গানও গেয়ে নিল- আয় তবে কান ধরি/ গোল হয়ে ঘুরি ফিরি!
গণ্ডারনী সবে এক গণ্ডা হাই তুলেছিল, হিনিমিনির গান শুনে গেল চটে। পাঁচ নম্বরের হাইটা ঊঠতে উঠতেও ঠিকমত উঠল না। তার বদলে গাঁক গাঁক করে গর্জন বেরোল গণ্ডারনীর গলা থেকে, “কান ধরায় খুব মজা, না? আর কেউ কারো কান ধরবি না। চুপচাপ পড়তে বোস।”
ভালো জন্তুর মত ওরা সকলে বসে পড়ল যে যার জায়গায়। গণ্ডারনী ফের এক হুংকার ছাড়ল, “অঙ্ক বইয়ের প্রশ্নমালা পাঁচের সব অংকগুলো করে নে।” বলেই গণ্ডারনী চারপাশে খানকয়েক বালিশ নিয়ে আরাম করে বসল।
ওরা সব খাতাবই খুলে যে যার মতো অঙ্ক করতে শুরু করে দিল। হিনিমিনির একটা অঙ্ক টুকতে ভুল হয়েছে, হাতুশিকে বলল, “হাতুশি, তোর রাবারটা দে না।”
হাতুশি শুঁড় দিয়ে রাবারটা থলে থেকে বের করে বাড়াল হিনিমিনির দিকে, “হিনিমিনি, এই নে।”
হিনিমিনি সবে রাবারটা নিয়েছে, অমনি গণ্ডারনীর গমগমে গলা শোনা গেল, “কী ব্যাপার, হাতুশি, হিনিমিনি? অত কথা কিসের? দুজনেই উঠে কান ধরে দাঁড়াও। যে যার নিজের কান ধরবে। বুয়েচ?”
হাতুশি আর হিনিমিনি দুজনেই খুব ভালো মেয়ে- শিয়ালনীর ক্লাসে কোনদিন তাদের শাস্তি পেতে হয়নি। মন খারাপ নিয়েই দুজনে উঠে দাঁড়িয়ে কান ধরল। এমনকি, বাঘু যে বাঘু, তারও অব্দি মুখ শুকিয়ে গেল। যাই হোক, একটু পরেই গণ্ডারনীর নাকের ভেতর থেকে জোরালো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ আওয়াজ বের হতে থাকল। তাই না দেখে বাঘুও বেজায় আরাম করে ঘাসের ওপর গড়াগড়ি খেয়ে নিল। এমন সময় আওয়াজ শোনা গেল, “ও দিদিমণি! ও গণ্ডারনী দিদিমণি!”
ওরা সকলে তাকিয়ে দেখে, ভালকিন! মানে, ভালকির মা। ওরা তো চোখের ইশারায় দিদিমণিকে দেখাল। ভালকিন জোরে জোরে বারকয়েক ডাকল, কিন্তু গণ্ডারনীর ঘুম কি আর সহজে ভাঙে? শেষকালে ভালকিন গণ্ডারনীর কাছে গিয়ে আলতো করে এক ঠেলা দিল, “ও গণ্ডারনী দিদিমণি!”
গণ্ডারনী তো উঠে বসল ধড়মড়িয়ে। চোখ-মুখ কুঁচকে বেজায় রাগী মুখে বলল, “কী ব্যাপার, ভালকি? বড়ো বড়ো চেহারা করে আমাকে ভয় দেখানো হচ্ছে, না?”
ভালকিন হাসল, “দিদিমণি, আমি ভালকির মা, ভালকিন।”
“অ।”, বলেই গণ্ডারনী চমকে উঠেছে, “অ্যাঁ, সে কী? আপনি আবার এলেন কেন?”
ভালকিন মিষ্টি করে হাসল, “আসলে দিদিমণি, আমি এদিকে মধু খেতে এসেছিলাম কিনা। তাই ভাবলাম, একবার দেখা করে যাই। তা আপনার মনে হয় কাল রাতে ঘুমটা ভালো হয়নি।”
গণ্ডারনী তাড়াতাড়ি করে বলল, “আরে, না, না। ঘুমোবো কেন? আসলে আমার একটু সর্দি হয়েছে কিনা তাই জোরে নিঃশ্বাস নিলে নাক ডাকার মত লাগে। আমি আসলে চোখ বন্ধ করে ওদের পড়ানোর নানা কথাই ভাবছিলাম।”
ভালকিন তো বুঝল যা বোঝার। তারপরে বলল, “দিদিমণি, হাতুশি আর হিনিমিনি দাঁড়িয়ে আছে কেন? ওরা তো দুজনেই খুব ভালো মেয়ে।”
গণ্ডারনী সঙ্গে সঙ্গেই একগাল হেসে বলল, “আরে, তাই তো! হাতুশি, হিনিমিনি- তোমরা দাঁড়িয়ে কেন? বসে যাও, সোনামণিরা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি আর পড়াশুনা হয়?”
হাতুশি আর হিনিমিনি তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে পড়ল। ভালকিন একটু হেসে জিজ্ঞেস করল, “দিদিমণি, ওদের খাতায় যে আজকাল বিশেষ কিছু লেখাটেখা দেখতে পাচ্ছি না।”
গণ্ডারনী কেমন যেন ঘাবড়ে গেল এ কথায়। কোনরকমে তোতলাতে তোতলাতে বলল, “ইয়ে… মানে… হ্যাঁ… আসলে এই ক’দিন ওদের পড়াচ্ছি তো… পড়াটা ভালো করে তৈরি করে দি… তারপরে লেখা হবে… লেখাবো না কেন…হ্যাঁ হ্যাঁ… নিশ্চয়ই লেখাবো…।”
ভালকিন আর বেশি কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। গণ্ডারনী হেলতে দুলতে উঠে দাঁড়াল, “সবাই যে যার খাতা বের করো। ‘বন পরিচয়’ বইয়ের প্রথম দুটো পাতা সবাই দেখে দেখে হাতের লেখা করো।”
হাতের লেখা করে খাতা জমা দিয়ে এল ওরা। গণ্ডারনী খাতা দেখা শুরু করেছে। এক এক করে খাতা দেখছে গণ্ডারনী আর বিচ্ছিরি রকমের চোখমুখ কুঁচকে যাচ্ছে। হাতুশির খাতা এল সবার শেষে। একদম পিছনের পাতা খুলল গণ্ডারনী। তা শেষের পাতায় কমবেশি হিজিবিজি তো লেখে সবাই। আর হাতুশিকে দিদিমণি সকালেই মিছিমিছি শাস্তি দিয়েছেন। মনের দুঃখে একটা ছড়া লিখেছিল হাতুশি-
গণ্ডারনী দিদিমণি
খান না মোটে চিনি।
ঘুমের মধ্যে নাকটি তাঁর
ডাকতে থাকে চমৎকার।।
পড়তে পড়তে গণ্ডারনীর মাথা পাঁইপাঁই করে দুলতে থাকল, নাকের খড়্গ জোরে জোরে কাঁপতে লাগল আর লেজখানা উপরে নীচে নাগরদোলার মত ঘুরতে থাকল। তারপরে গণ্ডারনী নাক দিয়ে ঘুড়ুর- ঘুঁৎ করে একখানা বিকট রকমের আওয়াজ ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠল, “অ্যাঁ, আমার নামে কাব্যি করা হচ্ছে। কাব্যি করার আর জায়গা পাওনি?”
অমনি পাশে বসা বাঘু ফস করে বলে বসল, “কেন দিদিমণি, এই তো বেশ ভালো জায়গা।”
“ভালো জায়গা? অ্যাঁ, তোরা সবাই আমাকে কী পেয়েছিস? জানিস, আমি হলাম গণ্ডারনী। তোদের লেজ ধরে করতে পারি টানাটানি!”
ভালকি শুকনো মুখে উত্তর দিল, “তা কি আর না জানি?”
গণ্ডারনী ধুপধাপ পা ফেলে ঘুরছে ওদের চারপাশে, “আমার নাক ডাকে? আমি ঘুমোই? এতবড় কথা?”
কুমরু ভালজন্তুর মত জিজ্ঞেস করল, “দিদিমণি, এ তো খাঁটি কথা, নয় মোটেই মিথ্যা।”
রাগের চোটে গণ্ডারনী গরগর করছে, “ঠিক আছে, আমার মুখের ওপর কথা বলিস তোরা? এতোবড়ো সাহস? যা, তোদের আর পড়াবোই না আমি।”
বলতে বলতেই গণ্ডারনী গুমগুম করে বড়োবড়ো পা ফেলে হাওয়া হয়ে গেল। ওরা সবাই হতবাক।
হাতুশি শুঁড়খানা দোলাতে দোলাতে বলল, “এরেই কয় গণ্ডোগোলিক্স।”
ভালকি অবাক হয়ে শুধোল, “গণ্ডোগোলিক্স আবার কী জিনিস রে, হাতুশি?”
হাতুশি শুঁড় ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে উত্তর দিল, “খুব বেশি রকমের গণ্ডগোল হলে তাকে বলে গণ্ডোগোলিক্স। মানে মহা গণ্ডগোল।”
কুমরু খুব চিন্তিত মুখে বলল, “হুমম। গণ্ডারনীর গণ্ডোগোলিক্স!”
হিনিমিনি বলল, “সে নাহয় হল, কিন্তু এবারে কী হবে রে?”
বাঘু গালে থাবা ঘষতে ঘষতে জবাব দিল, “কী আর হবে? বাড়ি যাওয়া হবে।”
হাতুশি সায় দিল, “সেই ভালো। চল্, বাড়ি চলে যাই। কাল সময়মতো চলে আসবি সবাই।”
পরের দিন ওরা সবাই পাঠশালা চলে এল, কিন্তু দিদিমণির আর দেখা নেই। বাধ্য হয়ে ওরা নিজেরাই প্রার্থনা করল। তারপর হাতুশির কাছে পড়তে বসল সকলে। পড়ছে সবাই যে যার মতো। আচমকাই বাঘুর কী খেয়াল চাপল, কে জানে, নিজের মনেই জোরে জোরে গান ধরল-
ধপাস ধপাস ধাঁই
গুলুস গুলুস গাঁই…
গণ্ডারনী আসেন তেড়ে-
পালা পাঁই পাঁই।
গান গাওয়া শুধু নয়, একটু পরে বাঘু ঘুরে ঘুরে নাচও শুরু করে দিল। বাঘু নাচ করছে, আর সবাই হাততালি দিয়ে গান গাইছে-
ধপাস ধপাস ধাঁই
গুলুস গুলুস গাঁই…
গণ্ডারনী আসেন তেড়ে-
পালা পাঁই পাঁই।
একটু পরেই বাঘুর গলা দিয়ে আর্তনাদ বের হল, “ওরে বাবা রে! গণ্ডারনী! গণ্ডোগোলিক্স শুরু হল রে!” বলতে বলতেই বাঘু এক লাফ দিয়ে ঝোপঝাড় বনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে দৌড়তে শুরু করে দিল। ওরা তাকিয়ে দেখে, দূরে কালবৈশাখীর মতোই ধেয়ে আসছে গণ্ডারনী। ভালকি হাঁউমাঁউ করে উঠল, “ওরে! পালা পাঁই পাঁই।”
হিনিমিনি লাফ দিয়ে উঠে গেল সামনের গাছে। কুমরু পালাতে গিয়ে একটু দূরে একটা ছোট ডোবা পেয়ে তার মধ্যেই ঢুকে বসে রইল। বাঘু তো আগেই কোনদিকে পালিয়েছে। হাতুশিও হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ে গিয়ে একটু দূরের পুরনো বটগাছটার মোটা গুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে রইল। ভালকি কোনদিকে পালাবে বুঝতে না পেরে কিছু দূরের একটা কাঁঠালগাছের নিচের ডাল ধরে কোনমতে ঝুলে রইল।
গন্ডারনী এদিকে পাঠশালায় এসে ওদের দেখতে না পেয়ে খেপে গেল বেজায়। ভীষণ রাগে এক হুংকার ছাড়ল গণ্ডারনী, “কী হল, পালালি কোথায় সব? আমার নামে গান গাওয়া হচ্ছিল? অ্যাঁ? সব আমি শুনেছি। গন্ডারনী আসেন তেড়ে… ? অ্যাঁ? ধরতে পারলে পিটিয়ে যদি না তক্তা করে যদি না ছেড়েছি বাছাধনেদের! নিজেদের ভালো চাস তো চটপট এখানে আয়।”
তা এরকম শুনলে কি আর কেউ আসে? এদিকে গন্ডারনী চেঁচিয়ে যাচ্ছে সমানে। চেঁচাতে চেঁচাতে গন্ডারনী গিয়ে দাঁড়িয়েছে সেই কাঁঠালগাছটার তলায়। আর তার ফলে ভয়েই হোক আর কাঠপিঁপড়ের কামড় খেয়েই হোক, ভালকি ধপাস করে পড়বি তো পড়, পড়ল একেবারে গন্ডারনীর পিঠের উপর। গন্ডারনী ভয়ের চোটে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটতে লাগল। ভালকিও ভয়ের চোটে গন্ডারনীর পিঠ জোরে আঁকড়ে ধরেছে। খানিক দূর এগোতেই কে যেন রাস্তা আটকে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “কী দিদিমণি, কোথায় যাচ্ছেন? পিঠে ওটা পোঁটলার মত কী?”
বাধ্য হয়েই থমকাল গন্ডারনী। ভালকি সামনে তাকিয়ে দেখে, হাতুশির মা হস্তিনী। হস্তিনী বলে, “কী ব্যাপার, দিদিমণি? পাঠশালায় গিয়ে দেখি, কেউ নেই। তারপরে দেখি, আপনি দৌড়োচ্ছেন। ও মা ভালকি, তুই দিদিমণির পিঠে কেন?”
বাধ্য হয়েই ভালকি নামল দিদিমণির পিঠ থেকে। গন্ডারনী কটমট করে চাইছে ভালকির দিকে। নেহাত হস্তিনী আছে বলে কিছু করতে পারছে না। আচমকা ভোল বদলে মোলায়েম সুরে বলল গণ্ডারনী, “ও ভালকি, তুইই আমার পিঠে ছিলি? তা তোর লাগেনি তো?”
তা ওসব মিষ্টি মিষ্টি কথায় কি আর ভালকি ভোলে? ভালকিও ভারি নরম সুরে উত্তর দিল, “না দিদিমণি, মোটেই লাগেনি। আসলে আপনি হঠাৎ করে টিফিনের সময় পাঠশালে ঢুকবেন, সেটা বুঝতে পারিনি কিনা।”
হস্তিনী তো সবই শুনেছে হাতুশির কাছে। তবু অবাক হবার ভান করে গালে হাত ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সে কী রে? তোরা সকাল থেকে একা ছিলি?”
ভালকি হাসল মিটিমিটি, “একা কী গো মাসী? তা আমরা পাঁচজনে মিলে ছিলাম। তা বলতে গেলে, আমরা তো এখন বেশির ভাগ সময়ই পাঁচজনে মিলে একা একা থাকি আর হাতুশির কাছে পড়ি।”
এমন সময় ঝোপঝাড় গাছপালার ভেতর দিয়ে একটা জোরদার আওয়াজ হল আর ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বাঘু। সে তখনও গান গাইছে-
ধপাস ধপাস ধাঁই
গুলুস গুলুস গাঁই…
গণ্ডারনী আসেন তেড়ে-
পালা পাঁই পাঁই।
হস্তিনী হাসতে গিয়েও সামলে নিয়ে চোখ পাকাল, “ও কী? ও কী গান গাইছিস বাঘু?”
বাঘুও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে আচমকা এতজনকে সামনে দেখে। কোনমতে জিভটিভ কেটে বলল, “ইয়ে… মানে, হস্তিনীমাসী গো… বাঁচাও গো…”। বলতে বলতেই বাঘু এসে হস্তিনীকে জড়িয়ে ধরেছে, “ও মাসী গো… গণ্ডারনী দিদিমণি বেজায় রাগী গো… আমি ভয়ে কাঁপছি গো…।”
হস্তিনী বাড়িতে সবই শুনেছে হাতুশির কাছে। তবু অবাক হবার ভান করল, “সে কী দিদিমণি, আপনাকে ওরা এত ভয় পায় কেন?”
গন্ডারনী থতমত খেয়ে কোনমতে বলল, “না না, ভয় পাবে কেন? ভয় পাবার কিই বা আছে? এই তো ওদের পড়াতেই যাচ্ছি। বাবা বাঘু, ভালকি মা- চলো তো দেখি। তোমাদের কত্তো আদর করে পড়াবো।”
গণ্ডারনী ওদের নিয়ে চলে গেল। হস্তিনী সেই দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী যেন ভাবতে ভাবতে উল্টোদিকের পথ ধরল।
কিছুক্ষণ পরে। গন্ডারনী পড়ানো শুরু করেছে। হাতুশি, বাঘু আর কুমরুও এসে গেছে। গন্ডারনী এসেই বলে দিয়েছে, “আমি এবার পড়াব। চুপচাপ পড়া শুনবে সবাই। নো গণ্ডগোল।”
হিনিমিনি চাপা গলায় বলল হাতুশিকে, “আবার গণ্ডগোলিক্স না হয়!”
গন্ডারনী গাঁক গাঁক করে বলল, “শোন, তোদের আমি এখন পড়াবো ইংরেজি। ডু ইউ নো আই অ্যাম রাইনোসোরাস?”
বাঘু বলল, “দিদিমণি, অত শক্ত ইংরেজি যে বুঝি না।”
গন্ডারনীর চোখ লাল করে বলল, “রাইনোসোরাস মানে গন্ডার। মানে, তোরা কি জানিস আমি গণ্ডার?”
কুমরু ঘাড় হেলাল, “হ্যাঁ দিদিমণি, জানি তো। আপনার নাম গন্ডারনী।”
“ও! খুব জ্ঞান হয়েছে না? ব্যাড ক্রোকোডাইল!”
কুমরুকে ওরকম বলায় হাতুশির খুব রাগ হল। বলল, “দিদিমণি, আপনি কুমরুকে বাজে বললেন কেন? ও কি ভুল বলেছে?”
গন্ডারনীর চোখ লাটিমের মত ঘুরছে, “ইউ, নটি এলিফ্যান্ট! এলিফ্যান্ট ইজ এ নটি অ্যানিমাল।”
এ কথায় ভয়ানক গোলমাল বেধে গেল। বাঘু লাফিয়ে উঠল, “দিদিমণি, হাতুশি খুব ভালো মেয়ে। শিয়ালনী দিদিমণি ওকে কত ভালোবাসেন!”
গন্ডারনী বাঘুর দু’গুণ জোরে লাফ দিল, “ও! আমাকে শিয়ালনী দেখানো হচ্ছে, না? ননসেন্স অ্যানিমাল, ইউ টাইগার!”
হিনিমিনি শান্ত গলায় বলল, “দেখুন দিদিমণি, পাঠশালায় তো আমরা পড়তে আসি। এরকম হলে তো পড়াশুনাটাই হচ্ছে না।”
তখন ওপাশ থেকে অনেকগুলো গলা একসঙ্গে বলে উঠল, “না, একদমই না।”
ওরা সকলে চমকে তাকিয়ে দেখে, হস্তিনী, ভালকিন, বাঘুর মা বাঘিন্নী, কুমরুর মা কুম্ভীরা আর হিনিমিনির মা হনুমতী পাঠশালার দোরে। হস্তিনী সবাইকে খবর দিয়ে নিয়ে এসেছে। বাঘিন্নী বলল, “দিদিমণি, এভাবে পাঠশালা চলতে পারে না। ওরা তো এ ক’দিন হাতুশির কাছেই যা পড়ার পড়ছে।”
কুম্ভীরা অল্প হেসে বলল, “আপনি শুনেছি, খুব ভালো নাক ডাকেন!”
হনুমতী বলল, “ছানাপোনাদের বেশ ভালো বকাঝকাও করতে পারেন শুনেছি।”
বাঘু গুটিশুটি মেরে ধীরে ধীরে বাঘিন্নীর কাছে এগিয়ে এল, “মা, আমার না কেমন কেমন গণ্ডারাতঙ্ক লাগছে।”
ভালকিন বলল, “না না, এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। বাচ্চারা বেশির ভাগ সময়েই পাঁচজনে মিলে একা একা থাকছে। নতুন করে এ ক’দিনে কিছুই প্রায় শেখেনি। এভাবে চলতে পারে না।”
গন্ডারনী তেড়েমেড়ে এল, “অ্যাঁ? আমাকে ডেকে এনে অপমান? শিয়ালনী আমাকে বলে গেল কিনা, বাচ্চারা খুব ভালো, ওদের মায়েরাও খুব ভালো। এই তার নমুনা? এতদিন হয়ে গেল, কেউ আমাকে একটা বাড়ি থেকে খাবারদাবার অব্দি এনে খাওয়ালো না? ছি ছি ছি! আর অত পড়াশুনা করেই বা কী হবে? ওরা কি মানুষের মতো চাকরিবাকরি করবে না কী! নেহাত আমি ভালো গন্ডার বলে সব সরবে সহ্য করেছি! অন্য কেউ হলে কবেই ছেড়ে দিত!”
হস্তিনী এগিয়ে এসে শান্ত গলায় বলল, “সেটাই বলছি, দিদিমণি! আপনারও কষ্ট, ওদেরও কষ্ট। বেকার সকলে মিলে এত কষ্ট করার তো দরকার নেই। আপনিও ভালো থাকুন, ওরাও ভালো থাকুক।”
মুখচোখ কেমন হয়ে গেল গন্ডারনীর, “ও! তার মানে আমি চলে যাবো, এই তো?”
মায়েরা ঘাড় হেলিয়ে সমস্বরে সায় দিল, “হ্যাঁ- অ্যাঁ-অ্যাঁ।”
থলেখানা বাগিয়ে নিয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে উধাও হয়ে গেল গন্ডারনী। বাঘু এবার হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে বসে বলল, “আহা! কী শান্তি! কী শান্তি! কয়েকটা দিন বেশ ছুটি পাওয়া গেল।”
সঙ্গে সঙ্গেই হস্তিনী শুঁড়ে করে মাটি থেকে টেনে তুলল বাঘুকে, “অত আনন্দের কিছু নেই, বাঘু বাছাধন! কাল থেকে আমরা মায়েরাই পালা করে একেকজন একেকদিন পড়াবো যতদিন না শিয়ালনী ফিরে আসে!”
বাকি মায়েরা ফিকফিক করে হাসতে শুরু করে দিল। এমনকি, বাঘিন্নীও। বাঘু বেচারির কি আর এত দুঃখ সয়? রীতিমতো কান্নাই জুড়ে দিল বাঘু, “ওরে, আমার কোন ছুটি জুটল না রে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… কাল থেকে মায়েরা নাকে দড়ি দিয়ে পড়া করাবে রে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… ওরে, আর যে কোন ফাঁকি মারা চলবে না রে… আঁই আঁই আঁই (কান্না)… ওরে, গণ্ডারনী চলে গিয়ে শেষকালে আমারই গণ্ডগোলিক্স হয়ে গেল রে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)…আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)…আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)।”
………০………
অংকনঃ রিমিল জানা
বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি পড়ুন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করেঃ-