বাচ্চা মেয়েটি পুতুলটিকে কুড়িয়ে পেয়েছিল একটা ঝোপের মধ্যে- ঘোড়ানিম ও পলাশের ঝোপের আড়ালে।। মাঝে মাঝে দুপুরে ও বেড়িয়ে পড়ত। এদিক-সেদিক ঘুরে ফিরে আসত বাসায়। তবে দিন দু’য়েক হল ওর মাসি যমুনা একটা দোকানে যায় কাজে। সেই সুযোগে সে আরেকটু দূরে চলে গিয়েছিল। আনমনে খেলতে খেলতে বুনো ঝোপের মধ্যে পুতুলটিকে পেয়েছিল। হয়তো বেশ দামী ছিল একটা সময়ে, আজ আর নেই। পড়ে থেকে থেকে সেটা জল-হাওয়া-আলো পেয়ে নোংরা, আধমরা হয়েছে। কিন্তু এতেই ওর কত আনন্দ। ওর তো একটাও পুতুল ছিল না আগে।
সেদিন সারাটা দুপুরের চেষ্টায় পুতুলটিকে ও বেশ ভদ্র সভ্য করেছিল। চান করিয়ে, রোদে শুকিয়ে এমনকি মুখে খাবার গুঁজে দিয়ে সেটার হাল যে ও ফেরাতে পেরেছিল, তাতে কোন সন্দেহ ছিল না।
-জানিস পুচি, ওকে পাশে শুইয়ে দিয়ে মেয়েটি বলছিল, -তোকে আমি পড়াব। তার আগে তুই এখন ঘুমো।
-আমি ঘুমোব না, পড়বও না। পুতুলটি সজোরে মাথা নাড়ল।
-তাহলে তুই কী করবি?
-আমি তোমার সঙ্গে খেলব।
-তোর পড়া হয়ে গেলে, আমি খেলতে দেব। দু’জনেই খেলব। যখন তোর জন্য রাঁধব, তুই তখন খেলবি। বুঝেছিস?
-না, আমিও তোমার সঙ্গে রাঁধব।
-এবারে তুই কিন্তু মার খাবি। ছদ্ম রাগে মেয়েটি বলল, -তুই এখনো ছোট আছিস। আমাকে আমার কাজ করতে হবে না? না রাঁধলে সংসার কি এমনিই চলবে?
-সত্যি তুমি কত কাজ কর। পুতুলটি প্রশংসাভরা মুখে বলে উঠল।
-আর কথা না বলে তুই এখন ঘুমো। বলে মেয়েটি পুতুলটিকে একটা ছেঁড়া ন্যাকড়ার ফালি দিয়ে ঢেকে দিয়ে বলল, -কম্বলটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নে।
-কী করছিস রে? বলতে বলতে মেয়েটির মা এল।
-এই দেখ না মা। বলে কোলের কাছে শোয়ানো পুতুলটিকে দেখিয়ে বলল, -এ কিছুতেই ঘুমোবে না।
-তা, ওর সঙ্গে তুইও একটু ঘুমো না রে মা।
-না, তুমি এসে আগে পাশে শোও।
-ঠিক আছে, মা বলল, -চোখ বন্ধ কর। আমি তোর পাশে এসে শুচ্ছি।
-তুমি সবসময় কেন থাকো না কাছে? মেয়েটি অভিমানভরা গলায় জানতে চাইল।
-বোকা মেয়ে, আমার অনেক কাজ আছে রে। কত কিছু যে করতে হয়।
-না আমি আজ কিছুতেই তোমাকে যেতে দেব না।
-অমন করলে হয়, ওর মা ওর পাশে বসতে বসতে ক্লান্ত গলায় বলল, -আমারও কি ইচ্ছে করে না? কিন্তু উপায় কোথায়?
-না, আজ তুমি সারাদিন, সারারাত আমার সঙ্গে থাকবে।
-আছি তো এখন। তুই একটু ঘুমিয়ে নে।
বলে ওর মা মেয়েটির কপালে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল। আর আমেজে ঘুম এসে গেল মেয়েটির।
-ওঠ, ওঠ, যমুনা চেঁচিয়ে উঠল। আর কত ঘুমোবি? অনেকক্ষণ সন্ধে হয়ে গেছে। ঠাকুরের থানে সাঁঝের বাতিটাও দিসনি। আয়, এদিকে এসে আমাকে একটু সাহায্য কর।
চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে পড়ল মেয়েটি। মাসি সদ্য সদ্য কাজ থেকে ফিরেছে। সুতরাং মেজাজ বেশ গরম। আর এখন রাতের খাবার বানাবে। কাজ না করলে সে খেতে পাবে না।
-গতরটা একটু নাড়িয়ে কাছে আয় তাড়াতাড়ি। মাসি চেঁচাল, -এমনি এমনি কি খাওয়া জোটে?
-মা চলে গেছে মাসী?
চোখে মুখে ঘুমের জড়তা এখনো যায়নি মেয়েটির।
-সে তো অনেকদিন আগেই গেছে, যখন তোর বাপ ওকে পিটিয়ে মেরে জেলে গেল। মাসি মুখ ভেংচে উঠল, -তার কথা ভেবে হবেটা কী?
কথা না বাড়িয়ে মেয়েটি এসে মাসিকে সাহায্য করতে বসল। মনে মনে বলল, “কি বকুনিটাই না দেয় মাসি!”
রাতে যখন মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছিল, কাজ থেকে সদ্য ফিরে জামা-কাপড় বদলাতে থাকা বর ভগীরথকে যমুনা বলল,
-একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারো না?
-কি করে তাড়াতাড়ি আসি বলতো? বিরক্তিভরা গলায় ভগীরথ বলল, -এত এত কাজ। সিভিক পুলিশের কি ডিউটির শেষ আছে? তাও ফ্যামিলি আছে বলে আমাকে রাতে বাইরে থাকতে হয় না। নাহলে…
-আমার কেমন ভয় ভয় করে মাঝে মাঝে।
-তোমার ভয়ের কী আছে? বিরক্তিভরা গলায় ভগীরথ বলল, -সেদিন সেই যে বাচ্চাটাকে কে বা কারা রেপ করে মেরে রেখে গেছে, সেই থেকে আমাদের ডিউটির খুব চাপ। অনেক বলে কয়ে তবেই রাতের ডিউটি কাটাতে পেরেছি।
-খুনটা তো এখান থেকে বেশি দূরে হয়নি গো।
-সেজন্যই তো চাপ বেশি। বড়বাবু আমাকে গাল-মন্দ করে জানতে চাইলেন, আমি কেন এলাকার সব খবর রাখি না? লোকটা নাকি সাইকো, সিরিয়াল কিলার। মাথা নাড়ল ভগীরথ, -আমি কি টিকটিকি? না আমার দশটা চোখ? ডিউটিতে সারাদিন বাইরে থাকলে এলাকার কোন খবরটা পাব?
-জান, মেয়েটা না মাঝে মাঝে দিদি’র কথা বলে। যমুনা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, -শুনে আমার কেমন যেন অস্বস্তি হয়। ওর মা নাকি ওকে খুব করে ডাকছে। পাগল কোথাকার! কপাল চাপড়ে যমুনা বলল, -কবে যে আপদটা সত্যি যাবে?
শুনে গম্ভীর গলায় ভগীরথ মাথা নাড়াল। শান্ত স্বরে বলল,
-কাল ওকে একটা ভাল দেখে খেলনা এনে দেব।
আবার কপাল চাপড়াল যমুনা। ওটা ওর স্বভাব। কারণে বা অকারণে। দিদি’র মেয়েটা কেমন ডাগর-ডোগর হয়ে উঠল। অথচ তার মাথায় ছিট। সারাক্ষণ সে নিজের মনে বিড় বিড় করে। আর নিজের?
কবে যে ভগবান ওকে তুলে নিয়ে ওর মা’র কাছে পাঠিয়ে দিয়ে যমুনাকে নিশ্চিন্ত করবে?
এদিকে এতদিন হল যমুনা চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু ভগবান এখনও মুখ তুলে চাইলেন না।
ভগবানের এ কেমন বিচার, হ্যাঁ? সামর্থ্য আছে অথচ…………
এই নিয়ে ওদের দু’জনের আক্ষেপের শেষ নেই। মাঝে মাঝে ভগীরথ গভীর রাতে বিছানা ছেড়ে উঠে শূন্য দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে বাইরের ঘোড়ানিম ও পলাশের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের দিকে। কয়েকবার ঘুম ভেঙে সেই দৃশ্য দেখে বুকটা হতাশায় ভরে উঠেছিল যমুনার। চুপিসারে আবার শুয়ে পড়ত বিছানায়।
-জানিস পুচি, পরদিন দুপুরে পুতুলটিকে কোলে শুইয়ে একটা প্লাস্টিকের বোতল তার মুখে গুঁজে দিয়ে মেয়েটি আস্তে করে বলল,
-মেসো না কাজে বেরোনোর আগে আমাকে বলেছে একটা ভাল পুতুল কিনে দেবে আজকে।
-তাই?
-হ্যাঁ, বলেছে তোর চেয়েও অনেক ভালো একটা পুতুল নিয়ে আসবে আজ।
-আমিও এককালে দারুণ ছিলাম। শুধু একদিন………। পুতুলটি হতাশ মুখে মাথা নাড়ল।
-কী হল সেদিন?
-জান, সেদিনের পর থেকে আমি অনাথ হয়ে গেলাম। ওখানেই পড়ে ছিলাম। রোদে-জলে কষ্টে থাকতাম। তুমি গিয়ে তুলে আনলে। এখন আর কষ্ট নেই। কিন্তু তুমি নতুন পুতুল পেয়ে আমাকে ফেলে দিলে…
পুতুলটির চোখ-মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে এল।
-তোকে আমি ফেলব না রে। সত্যি বলছি রে পুচি, মেয়েটি তার ছোট্ট মাথাটি দোলাতে দোলাতে বলল, -আমরা তিনজনে একসাথে থাকব। আর মাঝে মাঝে মা এসে আমাদের সঙ্গে থাকবে।
-সত্যি? পুতুলটির মুখ-চোখ ঊজ্জ্বল হয়ে উঠল।
-তিন সত্যি! জানিস, বলে চাপা গলায় পুতুলের কানের কাছে মুখ এনে মেয়েটি বলল, -মেসো না কাউকে বলতে বারণ করেছে। আজ সন্ধের আগেই ফিরে এসে আমাকে নিয়ে বেরোবে। একটা ভাল খেলনার দোকানে নিয়ে যাবে। দেখতে পাচ্ছিস, বলে জানালা দিয়ে বাইরের পলাশ ও ঘোড়ানিমের মাঠটা দেখাতে দেখাতে বলল,
-ওর ওপারেই নাকি একটা ভাল দোকান আছে। আমার মাকেও ডাকবে। মা’ই পছন্দ করে দেবে। তোকে খাইয়ে এবারে আমি তৈরী হব।
কাজ থেকে ফিরে শুধু ছেঁড়া পুতুলটিকে ঘরে দেখতে পেয়ে যমুনা সবই বুঝেছিল। কিন্তু সে সনাতন ভারতীয় সতী-সাধ্বী টাইপের স্ত্রী। যতই হাটে-বাজারে কাজ করুক, তার বেশী নয়!
………০………