বর্ষা বিদায় নিয়েছে। আকাশে সোনা সোনা রঙের রোদ্দুর। সাদা সাদা মেঘ নীল আকাশে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে আপনমনে। বড়ো বড়ো গাছের মিষ্টি মিষ্টি ছায়ারা বাহারি আলপনা এঁকে রেখেছে ঘাসে মাটিতে, ঝোপেঝাড়ে। আর বর্ষাশেষে ইতিউতি গজিয়ে ওঠা বুনো ফুলের মনভোলানো সৌরভ ভরিয়ে রেখেছে শিয়ালনীর পাঠশালার চারপাশ।
তা এরকম পরিবেশে কি আর পড়ায় মনটন বসে? বাঘুর নাহয় এমনিতেই পড়ায় মন নেই। কিন্তু ভালকি, কুমরু, এমনকি হাতুশি অব্দি রোজই পড়ায় প্রচুর ছোটোখাটো ভুল করছে। এই তো, গতকালই শিয়ালনী প্রশ্ন দিয়েছিল- কে ছেলেটিকে রোজ ধমকাইতেন? উত্তর হবার কথা- গুরুমহাশয় ছেলেটিকে রোজ ধমকাইতেন। সে জায়গায় হাতুশি উত্তর লিখল- গরুমহাশয় ছেলেটিকে রোজ ধমকাইতেন!
শুধু কি এই? বাক্য সম্পূর্ণ করতে দিয়েছিল শিয়ালনী- যদি খাও বুনো ওল, …। উত্তর হবার কথা- গলা ফুলে হবে ঢোল। সে জায়গায় কুমরু লিখেছে, যদি খাও বুনো ওল, পাবে তুমি দশ গোল। হিনিমিনি লিখেছিল, যদি খাও বুনো ওল, ঢাক বাজাবে নিয়ে ঢোল। আর ভালকি লিখেছিল, খামোখা বুনো ওল খাবার দরকারটাই বা কি? মা’কে বললেই তো মাদ্রাজি ওল বা সাঁতরাগাছির ওল নিয়ে আসবে।
তা এসব উত্তর পড়েটড়ে তো শিয়ালনির লেজের চুল খাড়া হয়ে উঠল, কান দিয়ে গরম বাতাস বইতে থাকল, দাঁত কনকন করতে থাকল, নাক ফুরফুর করতে থাকল, পেট গুরগুর করতে থাকল। নেহাত বাঘু গত দুদিন আসেনি, নইলে আরো কী বিপর্যয় ঘটতো কে জানে!
প্রার্থনার পরে আজ নামতা দিয়েই শুরু করেছে শিয়ালনী। প্রথমেই ধরেছে হিনিমিনিকে, “হিনিমিনি বল দেখি, সাত আর সাতে কত?” হিনিমিনি তখন মনে মনে টিফিনে মা কটা কলা দিয়েছে তাই ভাবছিল। আজ এক ডজন কলা দিয়েছে না দু ডজন? আচমকা এরকম একটা প্রশ্নে তাইম ভয়ানক ঘাবড়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, “ইয়ে মানে দিদিমণি… সাত সাতে দু ডজন কলা।”
কীরকম যেন খেপে গেল শিয়ালনী, “সাত সাতে দু ডজন কলা? যা, বাইরে গিয়ে সাতখানা লম্বাগুড়ি দিয়ে আয়।”
হিনিমিনি কলার কথা ভাবতে ভাবতে লম্বাগুড়ি দিতে চলে গেল। শিয়ালনী এবার হাতুশিকে ধরেছে, “হাতুশি… তুইই বল দেখি, সাত সাতে কত?”
হাতুশি তখন মন দিয়ে সামান্য দূরের ঝোপে ফুটে থাকা একটা হলুদ ফুল দেখছিল। একটা রঙিন প্রজাপতি এক একবার করে দোল দিয়ে যাচ্ছে ফুলগাছের ডালে আর একবার একবার মধু খেয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। আবার একটু পরে ফিরে আসছে। শিয়ালনীর প্রশ্ন শুনে হাতুশি ভারি অন্যমনে উত্তর দিল, “সাত সাতে দিদিমণি সাতাত্তর।”
শিয়ালনীরই বা কতটুকু ধৈর্য থাকে? দাঁতমুখ খিঁচিয়ে উঠল, “ওরে গাধা, সাতের পিঠে সাত বসলে কত হয় জিজ্ঞেস করিনি। সাত সাতে গুণ করলে কত হয়?”
ভালকি দেখল, দিদিমণির একটা ভুল হচ্ছে। সে তাই ঘাড় দোলাল, “দিদিমণি, ও গাধা নয়। ও তো হাতুশি। হাতুশি মানে হাতি।”
শিয়ালনী এবারে তেড়েই এল ভালকির দিকে, “ওরে বাঁদর! সেটা আমি জানি।”
ভালকি ঘাড় গোঁজ করল, “আমি বাঁদর নই, দিদিমণি। আমি জাতিতে ভালুক।”
“উফফফ! তোদের নিয়ে আর পারি না”, বলতে বলতেই কুমরুর দিকে চোখ গেছে শিয়ালনীর। সে তখন দাঁত বের করে হাসছে। “অ্যাই ছাগল, তুই হাসছিস কেন?”
“আমি ছাগল নই দিদিমণি, আমি জাতিতে কুমীর।”, কুমরুর সটান জবাব।
রীতিমতো তিড়িং বিড়িং করে নাচছে শিয়ালনী, “হায় হায় হায়! এই অপদার্থগুলোকে আমি কী করে বোঝাই? ওফ ওফ ওফ!”, বলতে বলতে বাঘুর দিকে নজর পড়েছে শিয়ালনীর, আরাম করে আড়মোড়া ভাঙছে। “অ্যাই গরু, তুই দুদিন স্কুলে আসিস নি যে বড়?”
“আমি মোটেই গরু নই দিদিমণি। আমার জাতি বাঘ।”
রাগে, দুঃখে, হতাশায় কপালে চাপড়াতে শুরু করেছে শিয়ালনী, “ওরে! আমার কপালে এই ছিল!”
সঙ্গে সঙ্গেই ভালকি এগিয়ে এসেছে, “দিদিমণি, আপনার কপালে কী ছিল?”
হাতুশি শুঁড় দোলাতে দোলাতে এগিয়ে এসেছে, “আরে, দিদিমণির কপাল ব্যথা করছে রে,ভালকি। আমি শুঁড় বুলিয়ে দি, ব্যথাট্যথা সব সেরে যাবে।”, বলেই আর কোনকিছুর অপেক্ষা না করে হাতুশি দিদিমণির কপালে শুঁড় বোলাতে শুরু করে দিল।
শিয়ালনী এতই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে যে মুখ দিয়ে আর একটাও কথা সরছে না। হাতুশি এদিকে শিয়ালনীর কপালে প্রাণপণে শুঁড় বুলিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। ভালকি, কুমরু, এমনকি বাঘু অব্দি উদ্বিগ্ন মুখে গোল করে শিয়ালনীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে হিনিমিনি ততক্ষণে লম্বাগুড়ি সেরে ফিরে এসেছে। এসেই ওরকম একটা পরিস্থিতি দেখে সকল দুঃখ ভুলে কাছাকাছি থাকা বাঘুকেই শুকনো মুখে শুধোল, “হ্যাঁ রে, বাঘু, দিদিমণির কী হয়েছে রে?”
বাঘু গম্ভীরমুখে উত্তর দিল, “দিদিমণির মাথা খারাপ হয়েছে রে, হিনিমিনি।” শুনেই ভয়ানক চমকে উঠেছে হিনিমিনি, “অ্যাঁ? সে কী কথা? আমি থাকতে দিদিমণির মাথা খারাপ?”, বলেই তুড়ুক করে এক লাফ, “হাতুশি রে! আমি তাড়াতাড়ি করে কলার একটা প্রলেপ বানিয়ে আনছি, তুই শুঁড়ে করে ভালো করে লেপে দিবি তো।” টিফিনের মোড়কটা খুলে একটা ভুরভুরে গন্ধের পাকাকলা বের করেছে হিনিমিনি। কলাটাকে ভালো করে চটকে শিয়ালনীর মাথায় থপাস করে একতাল গোবরের মত ফেলে দিয়ে বলল, “হাতুশি, তুই শুঁড় দিয়ে ভালোটি করে লেপে দে তো। হুঁ হুঁ বাবা, এ হোল সব রোগের মহৌষধ। আমার বড়মা তো তাই বলে। অবশ্য বাবা যদিও বলে, কলাগুলোকে টুকরো টুকরো করে আঠা লাগিয়ে সাঁটাতে…”
কুমরু খুব দুঃখের সঙ্গে লেজ নাড়াল, “দাঁড়া রে, হাতুশি তো যত্ন করে শুঁড় বুলোচ্ছেই। কাজ না হলে তখন নাহয়…।”
সহসা বিকট জোরে হাঁউমাঁউ চিৎকার জুড়েছে শিয়ালনী, “বলি, তোরা কী ভেবেছিস কী? আমার সঙ্গে ফাজলামো হচ্ছে? লেখাপড়া করে না, খালি ফাঁকি মারে – আর তখন থেকে আমার মাথায় কিসব গন্ধওলা জিনিস এনে ধাঁইধাঁই করে লেপে যাচ্ছে তো লেপেই যাচ্ছে। বলি, এটা আমার মাথা না মাছের আড়ত?”
বলে একটু দম নেবার জন্য সবে থেমেছে শিয়ালনী, অমনি ভালকি টুক করে বলে ফেলেছে, “দিদিমণি, আপনার মাথা মাছের আড়ত হতে যাবে কোন্ দুঃখে? আপনি তো জাতিতে শেয়াল।”
রাগের চোটে মুখচোখ লাল হয়ে গেছে শিয়ালনীর, লেজখানা ভয়ংকর বেগে পাঁইপাঁই করে ঘুরতে শুরু করেছে, “দূর হয়ে যা। দূর হ তোরা সব।”
এ কথায় বাঘু সামনের থাবাদুটো জোড় করে বিনীতভাবে প্রশ্ন করল, “কতদূরে যাবো, দিদিমণি?”
শিয়ালনীর কপাল বেয়ে টসটস করে কলার রস গড়াচ্ছে, “যা যেখানে খুশি চরগে যা। টিপিন শেষের যখন ঘন্টা বাজাবো, তখন আসবি। ছ্যা ছ্যা ছ্যা। তোদের যে কী জন্তু গড়তে কী জন্তু গড়ছি! হায় হায় হায় হায়।”
সেই বটগাছটার তলায় চুপচাপ বসে আছে সবাই, যেটার তলায় বসে বাঘু সেবারে ঘাস খেয়েছিল। হাতুশির মা হাতুশিকে টিফিনে রোজ একটা ছোট কলাগাছ দেয়। সেটা শুঁড়ে ধরে চুপচাপ বসে আছে হাতুশি। একটা পাতা অব্দি খায়নি। হিনিমিনির হাতে তেইশটা কলা যেমনকার তেমন ধরাই আছে। ভালকির মধু, কুমরুর ডিমসেদ্ধ সামনে নামানোই আছে। এমকি, বাঘু পর্যন্ত তার ইলিশ মাছ ভাজা একদমই মুখে তোলেনি।
নীরবতা ভেঙে প্রথম কথা বলল হাতুশিই, “দিদিমণিটা দিনেদিনে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে!”
বাঘু অমনি ফোঁস করে উঠল, “যা বলেছিস। আমি সরল মনে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে গেলাম, আমাকে বলল কিনা, যেখানে খুশি চরগে যা।”
কুমরু সায় দিল, “ঠিক কথা। চরগে যা বলবে কেন? বাঘু কি গোরু?”
ভালকি মনে করিয়ে দিল, “দিদিমণি আজ কিন্তু বাঘুকে গোরুও বলেছে।”
হাতুশি শুঁড় নাড়ল, “শুধু গোরুই নয়, গাধা- ছাগল সবই বলেছে।”, পাছে হিনিমিনির মনে লাগে, তাই বাঁদর বলার কথাটা চেপেই গেল হাতুশি।
হিনিমিনি মুখ খুলল, “আমি কলা চটকে দিলাম বলেই না দিদিমণি মুখ খুলতে পারল। নইলে তার আগে অব্দি তো একটা কথাও বলতে পারছিল না। অথচ দ্যাখ, সেটা মোটেই মানল না। বলল, আমরা নাকি কিসব গন্ধওলা জিনিস লেপেছি।”
হিনিমিনির কথায় সকলেই সায় দিল। আবার সবাই চুপচাপ। বাঘুর খুব খিদে পেয়ে গিয়েছিল বলে টিফিন খেতে শুরু করল। বাঘুর দেখাদেখি বাকিরাও খাওয়া শুরু করল। চুপচাপ খাচ্ছে সবাই। একটু পর হাতুশি কী যেন ভাবতে ভাবতে বলে উঠল, “কিন্তু দ্যাখ, দিদিমণি তো আমাদের এমনিতে খুব ভালোবাসেন।”
ভালকি ঘাড় নাড়ল, “ঠিক বলেছিস। এই তো, সেদিনই দিদিমণি বাড়ি থেকে কত তালের বড়া ভেজে এনে খাওয়ালেন।”
হিনিমিনি বলে, “আমাদের গায়ে কক্ষণো হাত তোলেন না।”
বাঘু চোখমুখ বড়োবড়ো করে বলল, “জানিস, আমার বাঘিপিসির মেয়ে বাঘনি যে স্কুলে পড়ে, সেখানকার দিদিমণিরা না একটু এদিক ওদিক হলেই কান ধরে ওঠবোস করায়, মাঝেমধ্যে কান মুলেও দেয়।”
কুমরুর চোখে জল, “এমন দিদিমণি আর কোথায় পাবো রে?”
অনেকক্ষণ ধরে নানারকম আলাপ আলোচনা চলল ওদের। তারপরে ঠিক হোল, আজকের মতো দিদিমণির সব কথা ঠিকঠাক করে শুনে চলবে সবাই। তারপর বাড়ি গিয়ে মা বাবাদের সব জানানো হবে। বাবামায়েরা যেমন ভালো বুঝবে করবে।”
ওদের সব কথাবার্তা শেষ হয়ে একদান কিতকিত খেলার পর টিফিন শেষের ঘন্টা বাজল। সুড়সুড় করে সবাই গিয়ে বইখাতা নিয়ে পড়তে বসে গেল। শিয়ালনী ক্লাসে ঢুকে মহাখুশি। হাতুশি তাকিয়ে দেখল, দিদিমণি মাথা কপাল সব ভালো করে পরিষ্কার করে নিয়েছে।
শিয়ালনী বলল, “শোন, আমি হাতের লেখা দিচ্ছি। তোরা সব বসে বসে হাতের লেখা কর। এই বলে শিয়ালনী সব্বাইকে একপাতা হাতের লেখা দিল- পেটপুরে খেলে ভাত, রোগ হবে কুপোকাত।
সকলে লিখছে, যে যেমন পারে। বাঘুও লিখছে। প্রথম দুটো লাইন ঠিকঠাকই লিখল বাঘু। তারপরেই বাঘুর মনে পড়ে গেল ইলিশ মাছভাজা খাবার কথা। তাই তৃতীয় লাইনে বাঘু লিখল- পেটপুরে খেলে মাছ, রোগ হবে কুপোকাত। চতুর্থ লাইন লেখার সময় বাঘুর দুব্বোঘাস খাবার কথা মনে পড়ল। ফলে বাঘু লিখল, পেটপুরে খেলে ঘাস, রোগ হবে কুপোকাত। পঞ্চম লাইনে গিয়ে বাঘু লিখল, লেজভরে খেলে ঘাস, রোগ হবে কুপোকাত। তারপরের লাইন লেখার সময় ভাবছিল, দিদিমণিকে নিয়ে আজ সকালের কাণ্ডকারখানার কথা। ফলে শেষ লাইনে বাঘু লিখল- লেজভরে খেলে ঘাস, শিয়ালনী হবে কুপোকাত ।
বাকিরা যে যার মত লিখেছে। খুব সমস্যা হয়নি। কিন্তু সবার শেষে বাঘুর খাতা দেখতে গিয়ে শিয়ালনীর চোখমুখ প্রথমে কুঁচকে গেল, তারপর চশমা নাকের ডগায় ঝুলে পড়ল, গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল, সবশেষে রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকল শিয়ালনী। এতোই রেগে গেছে শিয়ালনী যে মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরোচ্ছে না।
এদিকে বাঘু কী লিখেছে তা তো কেউ জানে না। বাকি পোড়োরা দেখছে, হঠাৎ করে দিদিমণি কেমনধারা হয়ে গেল! হিনিমিনির কাছে একটা মাটির কলসিতে জল ছিল। সেটা হাতুশির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “হাতুশি, শিগগির শুঁড়ে করে দিদিমণির চোখে মুখে ভালো করে জল ছিটিয়ে দে। ভালো বুঝছি না। সেরকম হলে আবার কলার ওষুধ দিতে হবে।”
শুনেই হাতুশি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দিদিমণির গায়ে মাথায় যত খুশি জল ছিটিয়ে একাকার করে দিল। এমনই চটজলদি সব ঘটনাগুলো ঘটে গেল যে শিয়ালনী আর কিছু বলার সুযোগই পেল না। তারই মধ্যে যতবার হাত নাড়িয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করতে যায়, শুঁড় থেকে বেরোনো জলের বেগ বেড়ে যায়। অবশেষে শিয়ালনী যখন ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে বেজায় হাঁচতে শুরু করেছে, তখন ভালকি কাছে এসে ভারি নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, “দিদিমণি, এবারে আপনার ভালো লাগছে?”
শিয়ালনী তো এই মারে তো সেই মারে, “হতভাগা, কী পেয়েছিস কী তোরা? যা খুশি তাই করে যাচ্ছে সকাল থেকে! ওবেলা কপালে কলা লেপেও হোল না, এখন আবার গায়ে জল ঢালছে! তোদের জ্বালায় আমার মাথা সত্যিই খারাপ হয়ে গেল!”
শুনে তো এ ওর মুখের পানে আড়চোখে চায়। কুমরু খুব চিন্তার সুরে প্রশ্ন করল, “তাহলে কী হবে দিদিমণি? আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেলে কে আমাদের পড়াবে?”
বাঘু শুধোল, “আমাদের কি তখন তাহলে পাঠশালা ছুটি থাকবে, দিদিমণি?”
ভীষণ রেগে এক হুঙ্কার ছাড়ল শিয়ালনী, “একে খাতায় ভুলভাল লিখছিস, তার উপর ছুটি চাওয়া হচ্ছে? যা, গুনে গুনে তিপ্পান্নবার লম্বাগুড়ি দিবি যা।”
বাঘু বেচারি তো মুখ বেজার করে লম্বাগুড়ি দিতে গেল। কুমরুরও আর পড়তে ভালো লাগছিল না। কুমরু বলল, “দিদিমণি, বাঘু ঠিকঠাক লম্বাগুড়ি দিচ্ছে কিনা আমি বরং একটু গুনতে যাই।”
শিয়ালনী ঘাড় নাড়ল, “ঠিক আছে, তুই গুনবি যা। নইলে বাঘু ফাঁকি দেবে।”
হিনিমিনির কী খেয়াল চাপল কে জানে, একখানা লাফ দিয়ে বলল, “দিদিমণি, কুমরুটা গুনতে বড্ডো ভুল করে। আমি বরং যাই, কুমরুটা ঠিকঠাক গুনছে কিনা দেখি।”
শিয়ালনী দোনোমোনো করে বলল, “আচ্ছা, যা।”
ভালকি কাঁচুমাচু মুখে বলল, “দিদিমণি, হিনিমিনি সেদিন নামতা ক্লাসে দুটো ভুল করেছিল। তা আমিও যাই। হিনিমিনির গোনাটা ঠিক হচ্ছে কিনা দেখি। আসি তাহলে, দিদিমণি?”
শিয়ালনী দাঁত কিড়মিড় শুরু করতে না করতেই ভালকি ধাঁ। শিয়ালনী এবার দাঁতমুখ খিঁচিয়ে হাতুশিকেই প্রায় তেড়ে আসে আর কী, “এবারে তুই বল, তুই ভালকির গোনা দেখতে যাবি!”
হাতুশি খুব মোলায়েম করে শুঁড় দুলিয়ে বলল, “মোটেই না, দিদিমণি। আমি মোটেই সেকথা বলিনি। আমি খালি বলছিলাম যে আমি তো মনিটর, ওদের কাজকর্ম দেখাই আমার কাজ। ফলে আমাকে তো ওখানে থাকতেই হয়।”
দাঁত কিড়মিড় করতে করতে শিয়ালনী বলল, “আর কী, বাইরে সবাই মিলে নাচানাচি কর্ তাহলে। উফফ বাবা রে বাবা! আমি আর পারছি না।”
বলেই চশমাটাকে মাথার উপরে উঠিয়ে বসে থাকল। হাতুশি মিষ্টি করে হেসে “আসি তাহলে, দিদিমণি, বাইরে গিয়ে নাচানাচিই করি বরং”, বলে বেরিয়ে গেল। বাইরে গিয়ে হাতুশি বন্ধুদের শুঁড় নেড়ে ডাকল, “আরে শোন না সবাই, দিদিমণি বলেছেন, সকলে মিলে নাচানাচি করতে!”
শুনে তো সব্বাই মহা খুশি। শুরু হয়ে গেল নাচানাচি। হাতুশি নাচে বাঘুর থাবা ধরে, ভালকি নাচে কুমরুর লেজ ধরে। আর হিনিমিনি কখনো হাতুশির পিঠে, কখনো ভালকির পিঠে আর কখনো বা বাঘুর পিঠে তিড়িং বিড়িং করে নাচে।
নাচ চলছে চলছে, এমন সময় ঢং ঢং ঢং করে ছুটির ঘন্টা পড়ে গেল। ওরা অবাক হয়ে এ ওর মুখের দিকে চায়। ব্যাপারখানা কী? অনেক তাড়াতাড়িই ছুটি হয়ে গেল যে!
হিনিমিনি লেজখানাকে মাথায় বুলোতে বুলোতে বলল, “কী ব্যাপার রে, হাতুশি? এত তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল!”
হাতুশি শুঁড়খানাকে গম্ভীর করল, “তাইতো রে।”
বাঘু সামনের ডানদিকের থাবাটা উঁচিয়ে বলল, “অত ভাবাভাবির কিছু নেই। দিদিমণি যখন ছুটি দিয়েই দিয়েছেন, তখন আমরা বাড়ি না গেলে রাগ করতে পারেন।”
কুমরু একমত হোল, “ঠিকই বলেছিস, বাঘু। দিদিমণিকে রাগানো ঠিক নয়। হাজার হোক, উনি আমাদের গুরুজন্তু।”
হাতুশি আর হিনিমিনিও সায় দিল এ কথায়। খালি ভালকিই একটু কিন্তু কিন্তু করল, “কিন্তু… দিদিমণি তো এরকম আগে কখনো ছুটি দেন না।”
ভালকির কথায় কেউ পাত্তাই দিল না। ক্লাসে ঢুকে ওরা দেখে, দিদিমণি নিজের ঝোপে চলে গেছেন। ফলে ওরাও যে যার পাঠশালার ঝোলা নিয়ে বাড়ি চলল।
পরের দিন। শিয়ালনী নিজের ঝোপে বসে পোড়োদের পড়ার বইগুলোয় চোখ বুলোচ্ছে, হিনিমিনির মা হিনিমিনিকে নিয়ে হাজির। শিয়ালনী চশমাটা চোখ থেকে নাকে নামিয়ে আনল, “কী ব্যাপার? আজ তুমি এলে?”
বলতে না বলতেই হাতুশির মা হাতুশিকে নিয়ে উপস্থিত। পেছন পেছন বাঘু, কুমরু, ভালকি আর তাদের মায়েরা। শিয়ালনী বুঝল, ব্যাপার গুরুতর। এক হাঁক দিয়ে বলল, “বাচ্চারা, ক্লাসে গিয়ে ‘সবুজ পাঠ’ বইটার দ্বিতীয় পরিচ্ছেদটা পড়ো সবাই। আমি আসছি।”
ছেলেমেয়েরা চলে যেতেই হিনিমিনির মা কাগজের একটা ঠোঙা বের করল, “এই নাও, দিদিমণি।”
শিয়ালনী চশমাটা কপালে তুলে বলল, “এটা আবার কী?”
হিনিমিনির মা লেজটা একবার চুলকে নিল, “ওটা হচ্ছে কদলী-বটিকা। এটা খেলে সমস্ত রকম মাথা খারাপ, পেট খারাপ, লেজ খারাপ- সব সেরে যায়। হিনিমিনির দিদার নিজের হাতে তৈরি। অব্যর্থ ঔষধ।”
শিয়ালনী তো বেজায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে, “তা আমি এ নিয়ে কী করব?”
হিনিমিনির মা হনুমতী বেজায় অবাক হয়ে বলল, “তবে যে হিনিমিনি বলল, তুমি বলেছো, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে!”
বাঘুর মা বাঘিন্নী ফস করে বলে বসল, “তারপর কাল তাড়াতাড়ি ছুটিও দিয়েছো।”
হাতুশির মা হস্তিনী শুঁড় দোলাল, “তারপর ক্লাসের সময় ওদের বলেছো নাচানাচি করতে।”
ভালকির মা ভালকিন বলল, “কাল তো মোটে ক্লাস হয়নি।”
কুমরুর মা কুম্ভীরা বলল, “দিদিমণি, আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন। আপনার মাথা তাড়াতাড়ি ভালো হোক।”
শুনেটুনে শিয়ালনী একবার খুচখুচ করে কাঁদল, একবার হো হো করে হাসল, দুবার ধাঁই ধাঁই করে কপাল চাপড়াল। সবশেষে বলল, “ ও হো হো হো! এই ছানাপোনাগুলোর জ্বালায় আমাকে সত্যি সত্যিই বিবাগী হতে হবে দেখছি!”
হস্তিনীর কেমন কেমন লাগল। বলল, “কেন গো দিদিমণি?”
শিয়ালনী বলল, “খুলে বলি কাল কী কী হয়েছে। নইলে তোমরা বুঝবে না।”
শিয়ালনী কখনো থেমে, কখনো লেজ নেড়ে, কখনো চশমা পরে, কখনো চশমা খুলে ওদের বলল সব কথা। শুনেটুনে হস্তিনীর শুঁড় একপাশে ঝুলে গেল, হনুমতী সমানে কান চুলকোতে থাকল, বাঘিন্নীর মুখ ইয়া হাঁ হয়ে গেল, ভালকিনের বেজায় শীতশীত করতে থাকল, কুম্ভীরার চোখে জল চলে এল।
হনুমতীই মুখ খুলল প্রথমে, “ছানাপোনাগুলো তো বেজায় দুষ্টু হয়েছে!”
বাঘিন্নী বলল, “বাঘুটা তো চিরকেলে দুষ্টু। বাকিরাও অমনি করছে!”
ভালকিন এপাশ ওপাশ মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “আমার মনে হচ্ছে ওদের কোথাও কোন সমস্যা হচ্ছে।”
কুম্ভীরা চোখের জল মুছছে, “তাই হবে মনে হয়। ক’দিন ধরেই দেখছি কুমরুর পড়ায় মোটে মন নেই।”
হস্তিনী মুখ খুলল এতক্ষণে, “হুমমম। আমার মনে হচ্ছে, ওরা অনেকদিন একটানা পাঠশালায় পড়ছে তো, একঘেয়ে লাগছে।”
বাঘিন্নী এদিক ওদিক কীসব শোঁকার চেষ্টা করে বলল, “ঠিক। বাতাসে ছুটি ছুটি গন্ধ।”
হাতুশির মা এগিয়ে এসে শুঁড়খানা রাখল শিয়ালনীর কাঁধে, “শোন, আমি বলি কী ওদের ক’দিন তুমি ছুটি দিয়ে দাও। নইলে ওরা আরও উৎপাত করতে থাকবে।”
কুম্ভীরা গম্ভীরমুখে মাথা নাড়ল, “পড়ার চাপ তো মোটে কম নয়।”
হনুমতী বলল, “মাসখানিকের ছুটি দিয়ে দাও। ওরাও এদিক ওদিক ঘুরে আসুক। তুমিও ঘুরে এসো।”
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল শিয়ালনী, “সেই ভালো। মাসখানিকের ছুটি দিয়ে দিই।”
যেই না বলেছে শিয়ালনী, অমনি কাছেই হো হো, হা হা, হি হি করে বিস্তর হইচই আর নাচানাচির আওয়াজ পাওয়া গেল।
হিনিমিনি সামনে এসে লেজ নাচাতে নাচাতে বলল, “আমরা সব শুনে নিয়েছি।”
ভালকি একখানা ডিগবাজি খেয়ে বলল, “আড়াল থেকে।”
কুমরু ফূর্তিতে থাবাতালি দিয়ে উঠল, “একমাস ছুটি। কেমন মজা! হি হি।”
বাঘুর মুখ দিয়ে কবিতাই বেরিয়ে গেল, –
একমাস ছুটি
মজা নেব লুটি।
খাবো গরম রুটি-
সঙ্গে ডিম দুটি।
হাতুশি বন্ধুদের ডাকল, “আয়, সবাই মিলে বরং সেই গানটাই গাই। এতক্ষণ ধরে যেটা বানালাম। বন্ধুরা, সবাই সবার লেজ ধরে ঘুরে ঘুরে গান করবে।”
শিয়ালনী আর ছানাপোনাদের মায়েরা চোখ বড় বড় করে শুনতে থাকল ওদের গান-
পড়া মাখো শোনা দিয়ে-
হয় পড়াশোনা-
‘লেখা’ উল্টে ‘খেলা’ হলে
ধিন তানা না না।
গাছে গাছে ছায়া ভারি
আলোছায়া লুকোচুরি-
পাঠশালে পড়া করি
মন মানে না।
পোড়োদের উৎপাত-
দিদিমণি কুপোকাত,
মায়েদের শিরে হাত
পড়া করে না।
চার পায়ে চারপেয়ে
থাবাতে দিন গোনা-
এতদিনে পেয়ে ছুটি
করি নাচাগানা।।
……০……
(অংকনঃ রিমিল জানা)
বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি পড়ুন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করেঃ-